প্ৰেত পাহাড়ের সরোবর
লেখক: রথীন্দ্র সরকার
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য (চিত্রচোর)
১৯৩৬ সাল।।
গেল যুদ্ধের আগের কথা। আমি তখন তিব্বতে। গ্যাংটক থেকে মাইল দশেক উত্তর পূবে একটা সরকারী বাংলোয় উঠেছি। ইংরেজ সরকারের জরিপের কাজে এসেছি বটে। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য একেবারে অন্য।
ধাতুবিদ্যায় এম-এস-সি পাশ করার পর থেকেই আমার মাথায় ঝোঁক চেপেছিল হিমালয়ের দুৰ্গম পাহাড়ে-উপত্যকায় সোনার খনি খুঁজে বের করব। সোনা না হোক, তামা, টিন বা দস্তা নিশ্চয় পাব! নতুন ঝোঁক, হিসেরেও তাই খানিকটা গরমিল ছিল বৈকি। মাটির ধরন ধারনে বোঝা যায় হিমালয়ের বিরাট অঞ্চলে অঢেল সম্পদ মাটির তলায় লুকিয়ে থাকার যথেষ্ট সম্ভাবনা। কিন্তু কতগুলো ধাতু পাওয়া যে একেবারেই দুষ্কর সে কথা তখন বুঝিনি।
কিন্তু সম্ভাবনার কথা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া চলে না। তাই সরকারী জরিপের কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমার “বেসরকারী” অভিযানও চলেছে। গেল বছর সারা গরমকালটা ঢুঁ মেলে বেড়িয়েছি কারাকোরাম থেকে লাদাখ পর্যন্ত, এবার এসেছি পূবে। পূবের পাহাড়ের সৌন্দৰ্য আলাদা, কিন্তু মাটির নিচে কী আছে, কে বলবে ! আপাতত তাই তিববতী পাহাড়ের উপত্যকা আর পাহাড়ঘেরা সমতল প্ৰান্তরের চমৎকার রূপই আমায় মুগ্ধ করে রেখেছে।
এদিকে বনের ভাগটা কম। কেমন যেন উশকো-খুশকো উদভ্ৰান্ত প্ৰকৃতি। দূরে দূরে তুষার-ধবল পাহাড়ের চূড়োগুলো আকাশ ঠেলে উঠেছে। বাতাস শুকনো খট্খটে। এমনকি মাঝে মাঝে মনে হয় যেন শরীরে জ্বালা ধরিয়ে দেয়। প্ৰাগৈতিহাসিক পৃথিবীর মতো থমথমে নীরবতা। নির্জন নিঃশব্দ ভাব যেন চারিদিকে অনেকটা মরুভূমির মতো। তাই একঘেয়ে হলেও বিরক্তিকর মনে হয় না। অপরূপ এক মায়া যেন !
ঝোঁকের মাথায় ঘাঁটি ছেড়ে অনেক দূরে সরে আসি। মাঝে মাঝে শুধু চোখে পড়ে চমরী গাইয়ের পাল। পাহাড়ের প্রকাণ্ড ছায়া কালো ডানা মেলে থাকে সমতল প্ৰান্তরে। ওপাশে ভারতবর্ষের উষ্ণ সূৰ্য। যেখানে রোদ এসে পড়ে সেখানকার উত্তাপ ১২০ ডিগ্রী পর্যন্ত ওঠে ! অথচ ছায়ার নিচে বরফ জমে, গা হিম হয়ে যায়-কী আশ্চৰ্য আবহাওয়া !
চলতে চলতে কতোদূর এসে পড়েছি খেয়াল নেই। ঢেউ খেলানো পাহাড়, উচু মালভূমি, আবার গভীর খাদ-মাটির এমনি এক বিচিত্ৰ সমুদ্র দেখতে দেখতে চলেছি।
একটা ছোট্ট নদীর ধারে এসে পড়ি। নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে টলটলে জলের ধারা।
কে জানে হয়তো এই নদী আরো কয়েকটা নদীর সঙ্গে মিলে গিয়ে প্রকাণ্ড নদী হয়ে ভারত, বৰ্মা বা চীনে চলে গেছে কিনা ৷
নদীটা ডিঙিয়ে ও পারে চলে যাই। ধূপ গাছের ঘন অরণ্যের ভেতর পথ অদৃশ্য। শেওলায় পা ডুবে যায়। ঢালু পাহাড়টা যেন আচমকা ওপরদিকে উঠেছে।
এতটা পথ আসতে কঠিন পরিশ্রম হয়েছিল। তাই ভাবি ফিরে যাব কিনা।
আকাশটা অদ্ভুত রকম স্বচ্ছ। বরফ ঘেরা পাহাড়চূড়োগুলোর উপর সূর্যের লাল যেন উজাড় হয়ে ঝরে পড়েছে। ওপারের পাহাড়টাকে ওই নীলের ওপাশে যেন শূন্যে ঝোলানো মনে হয়। আর পাহাড়টার ওপাশ থেকে যেন একটা আলোর আভা ছড়িয়ে পড়েছে আকাশের গায়। পাহাড়ে আগুন লাগল নাকি ! আলো ছায়া বরফ রোদ রঙের এ এক অপূর্ব কুহক।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি এমন সময় পিঠের ওপর কে হাত দিতেই চমকে উঠি। পেছন ফিরে চেয়ে দেখি এক চীনা ভদ্রলোক। স্বভাব সিদ্ধ অমায়িক মুখের ভাবের সঙ্গে খানিকটা যেন রুক্ষতা মেশানো। বয়সের ভারে একটু নুয়ে পড়া দেহ।
–চিনতে পারছেন না তো ? আমি কিন্তু আপনাকে ঠিক চিনেছি।-বললেন উনি।
–আপনি কে ? এখানে এলেন কখন ? কোত্থেকে ?
উনি হাসলেন। দুরে আঙুল তুলে দেখাতেই আমি সেদিকে চেয়ে দেখি একটা ছবি আঁকার ইজেল।
–আপনি আর্টিস্ট ৷ আশ্চৰ্য এখানে এলেন কেমন করে ? আমি তো টেরই পাইনি কাছে-পিঠে কোন জ্যান্ত মানুষ আছে।
–জ্যান্ত মানুষ? কেমন রহস্যময় ভঙ্গিতে যেন হেসে উঠলেন উনি। মুখের মধ্যে ছড়িয়ে আছে একটা ফ্যাকাশে বিষন্ন ভাব।
–হ্যাঁ মানুষ এদিকটায় বেশি আসে না, ঠিকই।
খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে ফের বললেন-আচ্ছা, কিন্তু আমাকে আপনি চিনতে পারলেন না ?
– না তো।
–আপনি আমার স্টুডিওতে এসেছিলেন একবার। মনে করে দেখুন। কালিম্পং থেকে অনেকটা দূরে পাটাংগোডাক বলে একটা জায়গায়। মনে পড়েছে ?
এবার সব কথা আমার মনে পড়ে গেল ! চাও শু-লি ! ইনি সেই বিখ্যাত চীনা চিত্রশিল্পী চাও শু-লি! চাওয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল চার বছর আগে। কিন্তু এই চার বছরে উনি এতটা বুড়ো হয়ে গেছেন ?
আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই উনি বললেন-চেহারা দেখে অবাক লাগছে তো ? আসুন তবে, সব কথা খুলে ৰলব। আসুন আমার ছবি দেখবেন। বিশ্রামও হবে আপনার।
ওঁর ইজেলের কাছে গিয়ে বসতেই উনি বললেন-ল্যাণ্ডস্কেপটা কেমন হচ্ছে ?
চাওয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম-চমৎকার। ওই পাহাড়টা ভাৱী সুন্দর ধরা পড়েছে আপনার তুলিতে।
–পাহাড়ের ওপাশের ওই অদ্ভুত আলোর আভাটা দেখতে পাচ্ছেন ? ওটাই এবার ছবিতে ফুটিয়ে তুলিবার চেষ্টা করব। “আলোর আলেয়া’-নাম দিলে কেমন হয়। ছবিটার ?
–হেঁয়ালি করছেন ?
–না হেঁয়ালি নয়।-হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেলেন চাও শু-লি। বাদামি কাগজের মোড়ক দেওয়া আরেকটা বড়োসড়ো ছবি পাথরের গায়ে হেলান দিয়ে রাখা। সেটা তুলে নিয়ে উনি মোড়ক খুললেন। এতক্ষণ যে নিম্প্রভ দৃষ্টিটা ওঁর চোখে দেখেছি সেটা এবার যেন তীক্ষ আর উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
–দেখুন।
আশ্চৰ্য সুন্দর আর ভয়াবহ একটা ছবি !
এ ছবির বর্ণনা দেওয়া কঠিন, কিন্তু না দিলে এ গল্পও অসম্পূর্ণ থাকবে।
রঙের অদ্ভুত সমারোহ, জীবন্ত হয়ে উঠেছে অস্তগামী সূর্যের আলোয়। ছবির নিচে তিব্ববতীভাষায় যা লেখা তার বাংলা অর্থ দাঁড়ায় ‘প্রেতপাহাড়ের সরোবর’! ছবির মাঝখানের জায়গাটা দখল করে আছে নীলচে-ধূসর নিস্তরঙ্গ একটা থমথমে হ্রদ। একেবারে সামনে সবুজ থাসের ফাঁকে ফাঁকে ঝকঝকে বরফের চিলতে। হ্রদের জলে নীলচে বাদামি ছায়া পড়েছে ছোটবড় নানা আকারের পাথরের। দুটো ছোট ভাঙা দেবদারু গাছের রুক্ষ ডাল আকাশের দিকে যেন করুণ আবেদন জানিয়ে হাত বাড়িয়ে রয়েছে। পেছনে এবড়ো খেবড়ো পাহাড়ের সারি; বেগুনি আর হালকা-হলদের ডোরা তাদের গায়ে। বাঁ দিকে ভয়ানক উচু একটা তিন শিঙওয়ালা পিরামিড। পাহাড়ের গা বেয়ে যেন ধাপে ধাপে সিড়ি নেমে এসেছে একেবারে হ্রদের কিনারায়।
গোটা ছবিটার মধ্যে যেন একটা নিঃসঙ্গ, শীতল ছায়ালোকের নিঃশ্বাস। দেখলে চােখ ফেরানো যায় না। এমন জাদু। যারা এর নাম দিয়েছে ‘প্ৰেতপাহাড়ের সরোবর তাদের শিল্পদৃষ্টির তারিফ না করে পারি না। প্ৰেতপাহাড়ের সরোবর ! সুন্দর আর ভয়ংকর।
জিজ্ঞেস করলাম-কোথায় পেলেন এই হ্রদটা ? সত্যিই কি অস্তিত্ব আছে। এর ?
-হ্যাঁ আছে, সত্যিকারের যেটা সেটা এর চেয়েও অনেক অনেক সুন্দর, আরো ভয়ঙ্কর … পারিনি ছবির মধ্যে সবটা ফুটিয়ে তুলতে। ভয়ানক কঠিন, ভীষণ কষ্ট হয়েছিল এইটুকু আঁকতেই … কিন্তু সে সব কথা আপনাকে বলে কী হবে ?
–না না, বলুন। এমন সুন্দর হ্রদ … মনে হচ্ছে যেন দেখবার জন্য প্ৰাণও দিয়ে দিতে পারি।
আমার চোখের দিকে নিবিষ্টভাবে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। চাও শু-লি-কথাটা মন্দ বলেন নি : প্ৰাণও দিয়ে দিতে পারি ! আপনি বোধহয় জানেন না। এই হ্রদের সম্পর্কে তিব্বতীদের ভেতর কতো অদ্ভুত কাহিনী প্ৰচলিত।
–নাম শুনে তো মনে হয় তেমন কিছু থাকা বিচিত্র নয়।
ছবিটার দিকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বললেন – এটির মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু আপনার চোখে পড়েনি?
–হ্যাঁ। বাঁ দিকের ঐ পিরামিডের মতো পাহাড়টার কোণায়।
কিছু মনে করবেন না। -ওখানকার রঙটা একটু যেন বেশি উগ্র আর বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে।
–হ্যাঁ। দেখলে তাই মনে হয় বটে, কিন্তু ওইটেই ওর সত্যিকারের রঙ। আর একটু কাছে গিয়ে দেখুন।
তিনকোণা পিরামিডাকৃতি পাহাড়টার নিচে উজ্জ্বল বাম্পের একটা শ্বেত সবুজাভা। জলের ওপর বাম্পের যে ছায়া পড়েছে সেটা কোন অজ্ঞাত কারণে একটু লাল। পাহাড়ের ফাটলগুলোর ভেতর দিয়ে উকি দিচ্ছে রক্তের মতো টকটকে লাল ঘন ছায়া। আর সবচেয়ে আশ্চৰ্য-যেখানেই বরফ আর পাথরের ওপর রোদ এসে পড়েছে সেখানে একেকটা প্ৰকাণ্ড ছায়ামূর্তি দাড়িয়ে আছে কিস্তৃত কিমাকার মানুষের মতো। গোটা দৃশ্যটাকেই ভয়াল আর ভূতুড়ে করে তুলেছে ওই ছায়ামূর্তিগুলো।
–ওগুলো কি ? বুঝতে পারছি না তো -আমি অবাক হয়ে বলি – অমন আবার হয় নাকি ?
–হবে না কেন-প্ৰেতপাহাড়ের দানব তো ওগুলোই !-গম্ভীর হয়ে উনি বলেন। ঠাট্ট যে করছেন না সে তাঁর মুখ দেখলেই বোঝা যায়।
–শুনুন তবে —থমথমে গলায় বলেন উনি-এই অপার্থিব হ্রদটার নাম ‘প্ৰেতপাহাড়ের সরোবর’ হয়েছে শুধু সৌন্দর্যের জন্য নয়। একটা ভয়ানক দুর্নামও আছে হ্রদটার। এই ছবি আঁকতে গিয়ে আমি প্ৰায় মরতে বসেছিলাম। ১৯৩২ সালে গিয়েছিলাম ওই হ্রদের কাছে আর আজ পর্যন্ত আমি অসুস্থ।
–তার মানে ? খুলে বলুন তো সব।
প্রেতপাহাড়ের ভুতুরে মায়া। চাও শু-লি বলতে লাগলেন-ও হ্রদের সৌন্দর্যের জন্য অনেকেই ছুটে যায় দেখতে। কিন্তু যারা কাছে যায়, তারা কোন অলৌকিক কারণে প্ৰাণ ত্যাগ করে। আমিও এর মারাত্মক মায়ায় পড়েছিলাম। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার হল—গরমের দিনে হ্রদটার সৌন্দৰ্য হয়ে ওঠে অপরূপ-কিন্তু তখনই ওর সবচাইতে ভয়ঙ্কর রুদ্র প্ৰতাপ৷ পাহাড়ের ওই রক্তের মতো লাল আলো আর নীলচেসবুজ ছায়ামূর্তিগুলো চোখে পড়ামাত্র লোকের কেমন যেন অদ্ভুত এক স্নায়বিক অনুভূতি জাগে। মনে হয় যেন বুকটার ওপর প্রচণ্ড ভারি বোঝা চেপে বসেছে, চোখের সামনে ধক্ধক্ করে আগুন জ্বলছে। তবু যেন ইচ্ছে হয় ওই সবুজ বাষ্পের ছায়ামূর্তিগুলোকে দেখতে। কিন্তু আশ্চৰ্য। কাছে গেলেই সব অদৃশ্য। তখন দম আটকে আসতে চায়। হঠাৎ যেন নিজেকে অসহায় মনে হয়। তারপর তাড়াতাড়ি হামাগুড়ি দিয়ে ফিরে আসতে গিয়ে অনেক হতভাগ্যই মৃত্যুর কবলে সঁপে দেয় নিজেকে। যারা বেঁচে থাকে তারা হয় পরে মারা যায় নয়তো চিরজীবনের মতো পঙ্গু হয়ে থাকে।
–প্ৰেতপাহাড়ের কুখ্যাতি আজকের নয়, অনেকদিনের। মানুষ কাছে পিঠে যেতে সাহস পায় না। পশু-পাখিও হ্রদের ধার মাড়ায় না ভয়ে। যেখানে ওই ভুতগুলোর নাচ চলে, সেখানে তো ঘাসই গজায় না।
এর পর চাও শু-লি এক নিঃশ্বাসে বলে চললেন এক অদ্ভুত রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা। এই ছৰি আঁকার ইতিহাস। চার বছর আগে জান-প্ৰাণ কাবুল করে উনি হ্রদের কাছে গিয়েছিলেন। যেমন মারাত্মক সে রাস্তা তেমনি ভয়ঙ্কর শারীরিক কষ্ট সইতে হয়েছিল তাকে।
-হ্রদের পারে এসে কোনোরকমে ছবিটাকে তো খাড়া করলুম। কিন্তু হাতের তুলি যেন উঠতে চায় না। অসম্ভব দুর্বল মনে হয় নিজেকে। মাথা ঘুরে ওঠে। শেষ পর্যন্ত বমি করে ফেলি। তবু তুলি চালিয়ে যাই। শেষ টানটা কোন রকমে দিয়েই পাগলের মতো ছুটে নেমে আসতে থাকি। কয়েক শো ফুট কিভাবে যে নেমে এলাম জানি না। তারপরেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ি। মরিনি, কিন্তু শরীরের যে প্ৰচণ্ড ক্ষতি হল তা আজও পূরণ করতে পারিনি।
গল্পটা শুনতে শুনতে আমার মাথায় অজস্র কল্পনা কিলবিল করতে থাকে। দেখতেই হবে, যা থাকে কপালে! ভূতুড়ে মায়া আর রহস্যের স্থান গল্পের বইয়ে হতে পারে। বাস্তবে কি তা সম্ভব ? না, না, এর পেছনে নিশ্চয় অন্য কোনো ব্যাপার আছে।
ফস করে বলে ফেলি – হ্রদটা কোথায় ? বলুন তো আমায়। আমি যাব। যেমন করে হোক যাব।
–যেতে পারেন। কিন্তু পাহাড়ী ভূতের মায়ায় পড়ে আরেকটা মানুষ মরল বলে ধরে নিতে পারি।–হেসে বললেন উনি – “আলোর আলেয়া’ বলছিলাম না তখন ? ওই চেয়ে দেখুন।
দেখালেন সামনের সেই পাহাড়টা যার ল্যাণ্ডস্কেপ উনি এখন আঁকছেন। আমি বললুম-ওখানেই নাকি ?
–হ্যাঁ, কিন্তু দূরত্বটা সহজ নয়। পাহাড়ের ওপরের ওই যে আকাশটা দেখছেন অদ্ভুত রকম স্বচ্ছ, ওখানেই সেই হ্রদ। এখান থেকে পনের মাইলের কম নয় ; নোট বইয়ে লিখে নিন, দিয়ে দিচ্ছি রাস্তার বর্ণনাটা। চিনে নিতে কষ্ট হবে না। কিন্তু সাবধান, সঙ্গে লোকজন নিয়ে যাবেন।
পথের সম্পূর্ণ নিশানাটা জেনে নিয়ে আমি আগ্রহভরে দেখতে লাগলাম ছবিটা।
উনি বললেন-এ ছবির মায়া কাটানো বড়ো শক্ত। আপনি যদি চান এর একটা নকল আপনাকে দিতে পারি। কিন্তু সেটা এখানে নেই। দাৰ্জিলিঙে ফিরে গিয়ে আপনার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিতে পারি। আপনি নিশ্চয় এখুনি যাত্রা শুরু করেছেন না, কি বলেন ?
আমি হ্যাঁ না কিছুই বললাম না।
১৯৬৫ সাল।।
সেই ঘটনার পর বহু বছর কেটে গেছে। এর মধ্যে অজস্র পরিবর্তন ঘটে গেছে সারা পৃথিবীর বুকে। জরিপের কাজ করতাম। একের পর এক নানা দেশের মানচিত্র চোখের ওপর দিয়ে বদলে গেল। সে চাকরি ছেড়ে খনি-সংক্রান্ত কাজে ঢুকলাম। নিজের লাইনের কাজ পেয়ে তাতেই ডুবে রইলাম।
কিন্তু সেই ‘প্ৰেতপাহাড়ের সরোবরের” কথা ভুলিনি। আজো আমার কাছে-কাছেই রয়েছে চাও শু-লির আঁকা সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর ছবিখানা। মাঝে মাঝে দেখি আর ভাবি কবে যাওয়া হবে-কবে। সেই অদ্ভুত ভূতুড়ে রহস্যের উদঘাটন করব ?
একদিন বিকেলের দিকে ছবিটা খানিকক্ষণ নেড়ে চেড়ে তারপর সেটা রেখে দিয়ে একটা মাইক্রোসকোপ নিয়ে বসেছি। বিশেষ ধরনের একটা মিশ্র ধাতুর শিলাখণ্ড চেঁছে তুলে অণুবীক্ষণের স্টেজের ওপর রেখে ফোকাস্ কষছি, কিন্তু ইলেকট্রিকের বাতিতে মিশ্রিত পারদ-স্ফটিকের সূক্ষ্ম রঙগুলো কিছুতেই চোখে ধরা দিচ্ছে না। কি ভেবে একটা ডেলাইট বালব জ্বালিয়ে নিলাম আর মাইক্রোসকোপের তলায় একটা “সিলভারম্যান’ তেরছা-আয়না রাখলাম।
মগজে বোধহয় সেই ভূতুড়ে পাহাড়ের দৃশ্যটাই ঘুরছিল! তাই একটা নীলচে পটের ওপর রক্তলাল আলোর রেখা দেখেও যেন তেমন অবাক লাগিল না। ঠিক সেই ছবির রংটার মতো। পর মুহুর্তেই মনে হল, না তো, সে ছবি তো দেখছি না এখন, এ তো পারদের মিশ্র আকার, ‘মার্কারি ওরা যাকে ইংরেজিতে বলে। কী আশ্চর্য। রঙটা হুবহু এক। একটা অকারণ উত্তেজনায় কী একটা ভাবনা মাথায় দানা বাঁধতে থাকে। ছবিটার ওপর ডেলাইট বালবের আলো ফেলে লক্ষ্য করি। তেকোণা পাহাড়ের নিচের রঙটার হুবহু প্ৰতিবিম্ব যেন দেখলাম ওই মাইক্রোসকোপে।
ধাতুবিজ্ঞানে প্ৰায় সাতশো রকমের বিভিন্ন জাতের বিভিন্ন রঙের তালিকা রয়েছে। উল্টেপাল্টে দেখি। ঠিকই তো ! ছবির রঙের প্ৰত্যেকটা আমেজ পারার স্ফটিকের ওপর বিভিন্ন কোণ থেকে আলো ফেললে যে জটিল রঙের ঢেউ বিচ্ছরিত হয় তার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে! পারদ ! মার্কারি !
ভয়ানক আপশোস হতে লাগল-কেন তিব্বতের সেই পাহাড়ে আবার ফিরে গেলাম না !
ট্যাক্সি ডেকে নিয়ে ছুটলাম এক ডাক্তারের ল্যাবরেটরীতে। আমার পুরনো বন্ধু। আমাকে দেখেই হাঁক ডাক করে উঠল—
–আরে আরে, কী ব্যাপার ? এত হন্তদন্ত কিসের ? –মার্কারির চরিত্রটা একটু বর্ণনা করো তো ভাই। খুব জরুরি।
–সে তো এক অদ্ভুত ধাতু হে! মোটা একখানা বই লেখা যায় মার্কারির ওপর।
–পারা তো ৩৭o ডিগ্রী উত্তাপে ফুটতে থাকে। কত উত্তাপে বাম্প হয় বলতে পারো ?
–যে কোন উত্তাপে হতে পারে।
–তাহলে সহজেই বাস্প হয়ে উবে যেতে পারে বলছ ?
–নিশ্চয়।
–আরেকটা প্রশ্ন। পারার বাস্প কি নিজের থেকে আলো দেয় ? দিলে তার রঙ কী ?
–না। পারার বাম্পের নিজের কোনো আলো নেই। তবে খুব ঘন হয়ে চাপ ধরে থাকলে বাইরের আলোতে একটা নীলচেসবুজ রঙ দেখা যায় ওতে। উঁচু পাহাড়ী জায়গায় বিদ্যুতের চলাচলে অনেক সময় সবুজাভ-সাদাও হয় রঙটা।
–পারদের গ্যাসের বিষে কী কী লক্ষণ দেখা যায় ?
–দারুণ গাঁজলা ওঠে মুখে! বমি হয়। রক্তের চাপ কমে যায়, দারুণ মানসিক চাঞ্চল্য আসে, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়- এমনি ধরনের নানারকম বিচ্ছিরি লক্ষণ আছে। হার্টফেল করে মারাও যায় অনেকে।
–চমৎকার !
ডাক্তার হাঁ হয়ে রইল। আমি ছুটে বাড়ি ফিরে এলাম। আমার ধারণা তাহলে সম্পূর্ণ ঠিক। ভূতুড়ে সরোবরের রহস্য কি তাহলে পরিষ্কার হয়ে যাবে এবার?
এর পরের ইতিহাস সংক্ষিপ্ত। সংক্ষিপ্ত কিন্তু অসামান্য। ভারত ও তিব্বতের সীমানায় ১৮০০০ হাজার ফুট উচু পাহাড়ের উপত্যকায় অভিযাত্রী হয়ে এসেছি আমি। আমার চোখে নতুন আবিষ্কারের স্বপ্ন।
পথে অসহ্য যন্ত্রণা সয়ে, গ্যাসের বিষাক্ত বায়ুতে আক্রান্ত হয়েও এক অতিকায় সরোবরের ধারে কোনোক্রমে পৌছেছি। চাও শু-লির বর্ণনা দেওয়া রাস্তা ধরে এসেছি সেই ‘প্ৰেত পাহাড়ের হ্রদে’।
অপূর্ব সুন্দর হ্রদ। শুধু সুন্দর বলে বর্ণনা দিলে অবশ্য আন্দাজ করা যায় না এর প্রকৃত রূপ ! সূৰ্য যতোই মাথার ওপর উঠছিল ততোই যেন চঞ্চল আর উদ্বেল হয়ে উঠছিল গোটা হ্রদটা। ক্রমেই সূর্যের উত্তাপে ভয়ঙ্কর উত্তাল হয়ে উঠছে-রুপোর মতো চিকচিক করছে আর স্বচ্ছ অস্বচ্ছ নানা নীলচে-সবুজ ছায়ামূর্তি নেচে নেচে ফিরছে কিন্তুত কিমাকার রূপ নিয়ে। শিল্পী চাও শু-লির মুখে যা বর্ণনা শুনেছিলাম তার এক বিন্দুও অতিরঞ্জিত নয়। সেই সঙ্গে তার ছবির কথাও মনে হল -এমন একটা ‘অবাস্তব” দৃশ্যকে কী কঠিন অধ্যাবসায়ের সঙ্গে তিনি বাস্তব রূপ দিয়েছিলেন তাঁর চিত্ৰকৰ্মে।
ছুটে গিয়ে হাত ডুবিয়ে দিলাম সরোবরের জলে। জল নয় – পিছল এক ধরনের তরল পদার্থ, হাতের ছোঁয়া লেগে যেন পালিয়ে যেতে চায়। কতো হাজার হাজার টন পারদ এখানে রয়েছে কে জানে! পারদের অগাধ সমুদ্র! পৃথিবীতে এতদিন একটাই বৃহৎ পারদ-খনির অস্তিত্ব ছিল, স্পেনের আলজাদেনে। আজ বোধ হয় আবিষ্কৃত হল পৃথিবীর বৃহত্তম পারদ-ভাণ্ডার !
অনুবাদ প্রসঙ্গেঃ
গল্পটি ১৯৬২ সালে আনন্দধারা প্রকাশন থেকে প্ৰেত পাহাড়ের সরোবর গ্রন্থে সংকলিত হয়েছিল। গল্পটি ইভান ইয়েফ্রেমভ (Ива́н Анто́нович (Анти́пович) Ефре́мов) (Ivan Antonovich (Antipovich) Yefremov)এর লেখা ‘The Lake of the Mountain Spirits’ গল্প অবলম্বনে লেখা। গল্পটি টাইপ করে সাহায্য করেছেন দোয়েল বর্মণ।
কৃতজ্ঞতা: রথীন্দ্র সরকার, আনন্দধারা প্রকাশন
Tags: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য, দ্বিতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, প্ৰেত পাহাড়ের সরোবর, রর্থীন্দ্র সরকার, রাশিয়ান অনুবাদ গল্প
প্রায় লিখতে যাচ্ছিলাম এটা বহু পুরোনো কোনো শুকতারায় পড়েছি।তারপরে অনুবাদ প্রসংগে খেয়াল করলাম।
প্রসংগত আমি যে গল্পটা পড়েছিলাম তার শেষে নায়ক পারা পাননি।
পেয়েছিলেন এক শুকনো সরোবর।
উনি এবং ওনার কেমিষ্ট সহকর্মী হ্রদের ধারের পাথর পরীক্ষা করে পারদের যৌগ পেয়েছিলেন কিন্তু হ্রদ ছিল শুকনো।
খোজ নিয়ে নায়ক জেনেছিলেন ওনার পারদ সরোবর দেখার কয়েক বছর পরে(ওই গল্পে নায়ক নিজে পারদের বিষক্রিয়াএবং হ্যালুসিনেশন উপলব্ধি করেছিলেন হ্রদ দেখতে গিয়ে) এক বিশাল উল্কা এসে পড়ে ওই অঞ্চলে।
এবং সেই তাপেই সম্ভবত হ্রদ বাষ্পীভূত হয়ে যায়।
শুকতারায় সম্ভবত ক্ষিতীন্দ্র নাথ ভট্টাচার্য্য লিখেছিলেন|