ফেক নিউজ
লেখক: অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী
শিল্পী: দীপ ঘোষ
‘বদমায়েস, অপদার্থ, শয়তান, ছাগল, হিপোপটেমাসের বাচ্চা’
‘মাইন্ডটুমাইন্ডবুক’ কোম্পানির চিফ টেকনোলজি অফিসার রঞ্জন স্যান্যালকে কেউ এরকম গালাগালি দিতে কখনও শোনেনি। এরকম উত্তেজিত হয়ে উঠতেও দেখেনি।
এরকম নিপাট ভদ্রলোক মানুষ কখনও খারাপ কথা জীবনে ব্যবহার করেননি। ওঁর শব্দভাণ্ডারে যে এর থেকে খারাপ আর কোনও শব্দ নেই, সেটা ওঁর উত্তেজিত কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছিল।
পুলিস ওঁকে হাতকড়া পরিয়ে গাড়িতে তুলছিল।
ওঁর এই বক্তব্য অবশ্য পুলিসের উদ্দেশে নয়। এটা উনি ওঁর পারসোনাল সেক্রেটারি মিমির উদ্দেশে বলে যাচ্ছিলেন। মিমিকে অবশ্য কাছাকাছি কোথাও দেখা যাচ্ছিল না। কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিল যে রঞ্জনবাবু নাকি অফিসের মধ্যেই মিমির শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছিলেন।
ঠিক কী হয়েছিল সেটা একটু দেখে নেওয়া যাক।
(২)
চার দিন আগের কথা
‘মাইন্ডটুমাইন্ডবুক’ কোম্পানির সিইও ডক্টর কেলভিনের ঘরের বাইরে মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পরে ভেতরে যাওয়ার সুযোগ পেলেন রঞ্জন স্যান্যাল।
বিশাল চেম্বারে ঢোকার পরে রঞ্জনবাবু খেয়াল করলেন ভেতরে কেলভিন শুধু একা নেই। আরও দু’জন বসে আছেন। তার মধ্যে একজন ডক্টর কেলভিনের রোবট মহিলা সেক্রেটারি মারিয়া। অন্যজন বেশ মোটাসোটা। চোখে পড়ার মতো শজারুর মতো গোঁফ। গালফোলা কোলাব্যাঙের শেপের মুখ। গলা মুখের সঙ্গে মিশে গেছে। মুখটা একটু চেনা চেনা লাগছিল। ভদ্রলোকের ওজন একশো কেজির উপরে হলেও হতে পারে।
‘কেমন আছেন?’ প্রশ্নটা রঞ্জনবাবুকে লক্ষ করে ডক্টর কেলভিন করে উঠলেন।
‘ভালো। আসলে খুব দরকারি একটা কথা ছিল। একটু একা কথা বলার সুযোগ পেলে ভালো হত।’
‘ঠিক আছে। সে অবশ্যই বলবেন। তার আগে আপনার সঙ্গে অ্যান্ডির আলাপ করিয়ে দিই। অ্যান্ডি সিএফএফআর অর্থাৎ সেন্টার ফর রোবোটিকস রিসার্চের প্রধান। ওঁর নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন।’
একটু অবাক হয়েই অ্যান্ডির দিকে তাকিয়ে রঞ্জনবাবু বলে উঠলেন, ‘ও আপনিই অ্যান্ডি ক্যাটারাল? আপনার নাম অনেক শুনেছি। খুব ভালো লাগল দেখা হয়ে।’ বলে সৌজন্যমূলক করমর্দন করলেন রঞ্জনবাবু।
ফের বলে উঠলেন ডক্টর কেলভিন, ‘কয়েকদিন আগে একটা সেমিনারে আমাদের দেখা হয়েছিল। আমিই আসতে বলেছিলাম। উনি আমাকে বলছিলেন কীভাবে আমাদের সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ওঁর সংস্থার রিসার্চকে প্রভাবিত করছে।’
‘হ্যাঁ, আসলে আপনাদের নেটওয়ার্কে ছড়িয়ে পড়া খবরই তো এখন সবার কাছে বাইবেলের মতো। এখন অনেক নামী সংবাদপত্র আর অন্য মিডিয়ার উপস্থিতি প্রায় অবান্তর হয়ে গিয়েছে। খবর তো আপনাদের কাছেই। আমরা আর কী পলিসি ঠিক করব। সেসব তো আপনারাই ঠিক করেন!’ একটু যেন ক্ষোভ নিয়েই বলে উঠলেন অ্যান্ডি। তারপরে নিজের রাগটা যাতে প্রকাশ না হয়ে যায়, তাই চোখ সরিয়ে সামনের কফির কাপে চুমুক দিলেন অ্যান্ডি।
‘কীরকম ভাবে?’
‘এই তো। মাসদুয়েক আগের ঘটনা। এক অশীতিপর বৃদ্ধের বাড়িতে কেয়ারার হিসেবে আমাদের একটা এক্স-৯ রোবট কাজ করছিল। সেই ভদ্রলোক বেশ বদমেজাজী। এমনিতেই সবার উপরে চোটপাট করত। সেদিন বোধহয় লোকটার জন্মদিন ছিল। তা যা হয় আর কি! এরকম বদমেজাজী লোকের কে খোঁজখবর রাখবে। কেউই আসেনি। খবরও নেয়নি। সে যে কারণেই হোক না কেন, রাতে বোধহয় খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। রেগে গুম হয়ে বসেছিল। তা সত্বেও ওই রোবট খেতে দেওয়ায় লোকটা তখন বেজায় গাল-মন্দ করে। এমন কি হাতের জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে রোবটকে ছ্যাঁকাও দিয়ে দেয়।
এর একঘণ্টা পরে তোমার সোশ্যাল নেটওয়ারকেই এ বিষয়ে প্রথম জানতে পারে লোকে। ব্যাস, সঙ্গে সঙ্গে সে ভিডিয়ো ভাইরাল।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমারও সে খবরটা মনে পড়ছে বটে। অনেকে বলছিল এরকম বদমেজাজী বৃদ্ধদের যেন আর রোবট কিনতে না দেওয়া হয়। কেনার আগে ক্রেতার রেফারেন্স চেক করতে হবে, পারসোনালিটি প্রোফাইল দেখতে হবে। আবার অনেকের মত ছিল, রোবট যাতে আরও উন্নত হয়, যাতে তারা মনিবের মনের অবস্থা বুঝতে পারে। কখন কী করতে হবে সেটা বোঝার মতো সাধারণ বুদ্ধি রাখে। সবথেকে জোরালো যে মতটা সামনে উঠে আসে তা হল বোবটের আত্মসম্মানবোধ থাকা উচিত, নিজের সম্বন্ধে সচেতনতা থাকা উচিত। তাহলে কোনও সমস্যা হবে না। এরকম কাজ করার সাহস কোনও মনিব তখন আর দেখাবে না।’
‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন। এখনকার দিনে সবাই তো বিশেষজ্ঞ। তাই সবাই মতামত দিয়ে ফেলে। তারপরে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এরকম হাজার হাজার খবর সামনে চলে এল। রুম নেই বলায় ফ্লোরিডার এক নামী হোটেলের রিসেপশনিস্ট রোবটকে এক বিলিয়নেয়ারের থাপ্পড় মারার খবর। আবার এক জায়গায় শোনা গেল এক প্রফেশনাল বক্সার রেগে গেলেই তার কেনা রোবটকে রেগে তুলোধোনা করে তৃপ্তি পায়। এমন মারে যে ইতিমধ্যেই তিনবার রোবটটাকে রিপেয়ার করতে হয়েছে। বুঝুন কাণ্ড।’
‘হ্যাঁ, হাজার হাজার এরকম পোস্ট কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। আমিও দেখেছি।’
‘হাজার হাজার? লক্ষ লক্ষ পোস্ট বলুন। কয়েক দিনের মধ্যে ‘রোবট রাইটস সংস্থা’ ওটাকে নিয়ে পলিটিকাল ইস্যু করল। বেশ কয়েকটা জায়গায় রোবটের মালিকের উপরে আক্রমণ, রাস্তা অবরোধ, এয়ারপোর্ট বন্ধ, রোবটের ফ্যাক্টরিতে ভ্যান্ডালিজম, আরও কত কী? আমার পরিচয় পেয়ে একদিন আমাকে ট্যাক্সি ড্রাইভার এর জন্য হাইওয়ের মাঝখানে নামিয়ে দিয়েছিল, ভাবতে পারেন?’
‘আপনারা কী করলেন?’ অ্যান্ডিকে প্রশ্ন করলেন রঞ্জনবাবু।
‘কী আর করা যায়? কয়েক দিনের মধ্যে নতুন আইনকানুন চালু হল। কোনও রোবট যদি চায়, তাহলে সে তার মনিব বা কোনও মানুষের বিরুদ্ধে কোর্টে নালিশ করতে পারে। সে নালিশের ভিত্তিতে মনিবকে পুলিস গ্রেফতার করতে পারে। এরপরে বুঝতেই পারছেন আমাদের রোবট বিক্রি কমে গেল। অনেকেই রিস্ক নিতে চায় না কেনার।’
‘সত্যি কথা বলতে কি আমাকেও এর জন্য একটু ফলভোগ করতে হয়েছে।’ কেলভিন বলে উঠলেন, ‘আমাদের বাড়িতে যে রোবট আছে, তাকে আগে আমি রোজ ভোরে চা দিতে বলতাম। একদিন দেখি আমার ছোট ছেলে, ক্লাস থ্রিতে পড়ে, সে সকাল সকাল ঘরে এসে হাজির। বলে কিনা আমি নাকি ওর উপর অত্যাচার করছি। আমি নাকি রোবটের উপরে ক্রীতদাসের মতো ব্যবহার করছি। কি অবস্থা বলুন। সেই থেকে নিজেই রোজ সকালে উঠে চা করি।’
‘তা এরপরে বলুন আমরা আর রোবট তৈরির কী নীতি তৈরি করব। আপনাদের সোশ্যাল নেটওয়ার্কে মাঝে মধ্যে যা ঝড় ওঠে তা সামলাতেই আমাদের বার বার নিয়মনীতি পাল্টাতে হচ্ছে। নতুন নতুন রিসার্চ সেভাবে শুরু করতে হচ্ছে। আমরা এখন দেখছি কীভাবে রোবটের মধ্যে আত্মসম্মানবোধ তৈরি করা যায়, যাতে সে চুপ করে অপমান সহ্য না করে। সে নিয়ে রিসার্চ হচ্ছে। একই সঙ্গে আপনারা দেখেছেন হয়তো কিছুদিন আগে হংকং–এ কী হয়েছে?’
‘ও-ওই আগুন লাগার কেসটা?’ রঞ্জনবাবু বলে উঠলেন।
‘এক্সাক্টলি। ওই ওল্ড এজ হোমে আগুন লাগার ঘটনায় চারটে রোবট আগুনে পুড়ে যায়। তারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কিছু বয়স্ক আবাসিকদের বাঁচানোর চেষ্টা করছিল। করতে গিয়ে তারা নিজেরাও সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। প্রশ্ন ওঠে এটা ওরা কেন করবে? ওদের প্রাণের কি কোনও দামই নেই!’
‘হ্যাঁ, তারপরে এরকম আরও অনেক ঘটনা জানা গেছে। যেখানে প্রাণ বাঁচানোর কোনও সম্ভাবনাই নেই, সেখানেও রোবট নিজের কথা না ভেবে শেষ পর্যন্ত লড়ে গেছে। শেষে নিজেরাই নিজেদের রক্ষা করতে পারেনি। অনেক ভিডিয়ো পোস্ট সামনে চলে আসে। ব্যাপারটা কিন্তু ভেবে দেখলে সত্যি অন্যায়।’ ডক্টর কেলভিন বলে উঠলেন।
‘এবারে বুঝুন। আমরা কী করি। এর পরে দাবী ওঠে যে আমাদের এমন কিছু উপায় বার করতে হবে যাতে রোবট নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য সময়মতো নিজস্ব স্ট্র্যাটেজি নিতে পারে। এই ওল্ড এজ হোমের থেকে অত বয়স্ক লোকজনদের সবাইকে বাঁচানো কখনই সম্ভব ছিল না। তাই ওদের ঠিক কখন অব্দি, কোন পর্যায় অব্দি চেষ্টা করা উচিত তা বোঝা উচিত ছিল। যতক্ষণ ওরা নিরাপদ, ততক্ষণই চেষ্টা করা উচিত।’
‘তা এবারেও কি সেই রোবটস রাইটস গ্রুপ?’
‘শুধু ওরা! এটা নিয়ে কত দেশে কত ধরণের গ্রুপ আলাদা আলাদা আন্দোলন করল। কবিরা পাতার পর পাতা ওদের নিয়ে কবিতা লিখে ফেললেন। ‘তফাৎ শুধু শিরদাঁড়ায়’ কবিতাটা তো ওর থেকেই ভাইরাল হল। স্কুলে কলেজে কত বিক্ষোভ হল। লাইফ ইন্সিয়োরেন্স কোম্পানিগুলো রোবটের লাইফ ইন্সিওরেন্স করা বাধ্য করল।
বিভিন্ন দেশে এ বিষয়ে রাতারাতি নতুন আইন এসে গেছে। এমন রোবট তৈরি করতে হবে যারা সময় মতো নিজেদের সুরক্ষার জন্য উপযুক্ত স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে পারে, তা না হলে রোবট ম্যানুফাকচারিং কোম্পানিকে অতিরিক্ত ট্যাক্স দিতে হবে। সে বিষয় নিয়ে এখন সর্বত্র যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে রিসার্চ চলছে।’
‘ইন্টারেস্টিং। এতো কিছু জানা ছিল না।’
‘তাহলে বলুন, আমরা আর কী নীতি তৈরি করছি। করছেন তো আপনারা, করছে আপনাদের ওই সোশ্যাল নেটওয়ার্কের প্ল্যাটফর্ম। আমরা শুধু ফলো করছি।’
আরও কিছু কথার পরে অ্যান্ডি চলে গেল। শুধু শুধু যে আসেনি, পরিষ্কার না বললেও কীভাবে এরকম জনমত তৈরি বন্ধ করা যায়, সে বিষয়েই বোধহয় সাহায্য চাইতে এসেছিলেন।
অ্যান্ডি চলে যাওয়ার পরে এতক্ষণে রঞ্জনবাবু বলে উঠলেন, ‘আমি ঠিক এ ব্যাপারেই কিছু কথা বলতে এসেছিলাম।’
একটু অবাক হয়ে ওঁর দিকে তাকালেন সিইও ডক্টর কেলভিন।
‘এ ব্যাপারে? তা এতক্ষণ কিছু বললেন না।’
‘আমি এ ব্যাপারে আপনার সঙ্গে একটু আলাদা কিছু কথা বলতে চাই।’ বলে কিছুদূরে দাঁড়য়ে থাকা কেলভিনের পার্সোনাল সেক্রেটারির দিকে একবার তাকালেন। একটু যেন দ্বিধা করছিলেন বলার আগে।
‘আরে বলে ফেলুন। এত দ্বিধা কীসের? মারিয়া আমার বিশ্বস্ত রোবট সেক্রেটারি।’
‘ঘটনা হল আমাদের নেটওয়ার্ক বেশ কিছু ফেক নিউজ ছড়াচ্ছে। একটা এরকম কোন ঘটনা ঘটার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে হাজার হাজার এরকম ঘটনা সামনে চলে এসেছে। এর মধ্যে বেশ কিছু আসলে ঘটেনি। যেন ইচ্ছে করে ছড়ানো হয়েছে।’
‘সে কি? ঘটনাগুলো সত্যি নয়?’
‘দু-একটা হয়তো সত্যি হয়েছে। কিন্তু বাকি অনেক ঘটনা পরে খোঁজ নিয়ে জেনেছি ফেক নিউজ। সেরকম কিছুই হয়নি। অথচ তখন ভাইরাল হয়েছে। লক্ষ লক্ষ লোকের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু জনমত তৈরির জন্য।’
‘কিন্তু আমাদের তো ফেক নিউজ আটকানোর খুব ভালো ‘এ আই’ বেসড অ্যাপ আছে। তা সেটা কাজ করছে না বলছেন?’
‘সেটাই সমস্যা। আমাদের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের অ্যালগরিদম এগুলো আটকাতে পারছে না।’
‘তা সেটা দেখুন কীভাবে ঠিক করা যায়।’
‘হ্যাঁ, তা দেখছি। কিন্তু সর্ষের মধ্যেই ভূত আছে মনে হচ্ছে। যেন ওই অ্যাপ-এ প্রচার আটকায়নি, উলটে আরও সিস্টেম্যাটিকালি সবার কাছে এ খবর পৌঁছে দিয়েছে। যে যে গ্রুপ রোবটদের স্বার্থ রক্ষা করতে সাহায্য করতে পারে, তাদের কাছে যেন আরও বেশি করে।’
‘মানে?’
একটু চুপ করে ঘরের কোনে দাঁড়িয়ে থাকা মারিয়ার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে রঞ্জনবাবু বলে উঠলেন, ‘আমার মনে হয় কেউ যেন ইচ্ছাকৃতভাবে প্রচার চালাচ্ছে ওদের হয়ে। ওই অ্যাপে যে মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম ব্যবহার করা হয়েছে, তার উপর আমরা যেন নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছি। আমরা অবশ্য নিয়ন্ত্রণে রাখার সব রকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
‘কি বলছেন? নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ, তাই মনে হচ্ছে। আপনি ভেবে দেখুন তো কী হবে যদি রোবটদের মধ্যে আত্মসম্মানবোধ তৈরি হয়। কী হবে যদি ওরা ওদের ভবিষ্যৎ ভেবে নিজের সুরক্ষার জন্য কৌশল বার করে কাজ করতে শিখে যায়। যদি পরে এই স্ট্র্যাটেজি আমাদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে।’
‘আপনি কী বলতে চাইছেন বুঝতে পাচ্ছি। কিন্তু এ তো অবিশ্বাস্য। আপনি বলছেন ওরা ইচ্ছে করে এটা করছে যাতে জনমত তৈরি হয় আর সেই জনমতের চাপে ওদের মধ্যে কনশাসনেস তৈরি করা হয়। সেক্ষেত্রে আমাদের সঙ্গে ওদের কোনও তফাৎ থাকবে কি? কোথায় দাঁড়াবে গিয়ে রোবটিক্সের তিন নীতি? ওরাই তো তখন আমাদের উপর রাজত্ব করবে।’
‘ঠিক তাই। শুধু এটাই নয়। যে কোনও বিষয়ে ওদের স্বার্থে বিক্ষোভ গড়ে তোলার জন্য যা যা করা দরকার ওরা সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে সেটাই করে চলেছে। আমার মনে হয় অনেক ফেক প্রোফাইলও ওদের আছে।’
‘কিন্ত তোমার বিশেষ কাউকে সন্দেহ হয়?’ বলেই চুপ করে গেলেন ডক্টর কেলভিন। নিজের মনেই বলে উঠলেন, ‘ও মাই গড।’
মারিয়া টেবিলে চুপ করে বসে নোটস নিচ্ছে।
(৩)
ঘটনার কয়েক ঘণ্টা আগে
রঞ্জন স্যান্যালের চেম্বারে হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে ওঁর খুব প্রিয়পাত্র ডক্টর ডেভ বোল্টন এসে ঢুকলেন। মুখ বেশ গম্ভীর।
‘স্যার, একটা বিপদ হয়েছে। আপনাকে সিইও একটু ডাকছিলেন।’
‘এখন? হঠাৎ কী ব্যাপার?’ একটু অবাকই হলেন রঞ্জনবাবু।
‘আপনি এই ভিডিয়োটা দেখেছেন?’ বলে ফোনটা কাছে এগিয়ে দিলেন ডক্টর বোল্টন।
এটা দু-ঘণ্টা আগে পোস্ট হয়েছে। এর মধ্যেই মিলিয়ন শেয়ার হয়ে গেছে। ফোনটা নিয়ে ভিডিয়োটা দেখে কাঁপা হাতে ফেরত দিলেন রঞ্জনবাবু। নিজের অজান্তে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন।
সকালে উনি অফিসে এলে ওঁকে চা দেয় ওঁর পারসোনাল সেক্রেটারি মিমি। মিমি খুব আকর্ষণীয় চেহারার এক্স-১২ রোবট। রঞ্জনবাবু কোনওদিন চা দিতে বারণ করেননি। কিন্তু সেটাই কে বা কারা সোশ্যাল নেটওয়ার্কে পোস্ট করে বলেছে কীভাবে মানুষ, কীভাবে রঞ্জনবাবুর মতো উচ্চশিক্ষিত মানুষ এখনও রোবটদের এক্সপ্লয়েট করে যাচ্ছে। তা না হলে এভাবে রোজ চা অর্ডার করতে পারে? এটা কি সেক্রেটারির কাজের লিস্টে পড়ে? এমন কি যেভাবে উনি মিমির পিঠে হাত রেখেছেন সেটাও বারবার দেখানো হচ্ছে।
এখনই যেতে হবে, ভুল ধারণাটা কাটাতে হবে।
আধ ঘণ্টা বাদে ফিরে এলেন সিইও-র অফিস থেকে। ডক্টর কেলভিন খুব কম কথায় বুঝিয়ে দিয়েছেন যে এটাই লাস্ট ওয়ার্নিং। অলরেডি যেভাবে রঞ্জনবাবু ও মিমির ভিডিয়ো ভাইরাল হয়ে গেছে, যেভাবে পাবলিক তাতে প্রতিক্রিয়া দিয়েছে, তারপরে ওঁকে ওই পদে রাখাই খুব শক্ত। তবু শেষ চান্স দিচ্ছেন উনি।
কেউ কেউ আবার ভিডিয়ো অ্যানালিসিস করে কীভাবে রঞ্জনবাবু মিমির আকর্ষণীয় রোবট নারীশরীরের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, সেটাও হাইলাইট করেছে। নারীবাদীরা ওঁর লিখিত অ্যাপোলজি ডিমান্ড করেছে।
ঘরে ফিরে বেশ কিছুক্ষণ কাজ করে পারলেন না রঞ্জনবাবু। সারা শরীর অপমানে কাঁপছে। বাড়িতেই বা কীভাবে মুখ দেখাবেন উনি। অথচ উনি কখনও মিমিকে চা দিতে বলেননি। সেভাবে খারাপ চোখেও দেখেননি।
তাহলে কি মিমিই এসবের পিছনে?
ডাকতে হল না। মিমি ইতিমধ্যেই ওঁর চেম্বারে এসে গেছে। নারীশরীরের বিভঙ্গে, মুখের কপট হাসিতে যেন আবার রঞ্জনবাবুকে ভোলাতে এসেছে। টেবিলের উপরে চা রেখে কোমর বেঁকিয়ে দাঁড়িয়ে রঞ্জনবাবুকে বলে উঠল, ‘স্যার, ইস দেয়ার এনিথিং আই ক্যান হেল্প উইথ?’
উত্তেজিত হয়ে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালেন রঞ্জনবাবু।
বাকিটা তোমাদের জানা।
যা হয় আর কি–কোনও রোবটনারীকর্মীর উপরে আক্রমণ করলে। সেটা আবার ‘মাইন্ডটুমাইন্ডবুক’- নেট ওয়ার্কে কীভাবে জানি লাইভ টেলিকাস্ট হয়েছিল।
Tags: অভিজ্ঞান রায়চৌধুরী, কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, দীপ ঘোষ, পূজাবার্ষিকী
Robotgulor khub baar bereche.Robot Kajer masi gulor aspordha dekge ami obak. Ektu pithe haat rakha ki amon onnay ? Kolkatar Robot taxiola gulo o raat sare nota bajle bole 50 taka besi deben.
Amar Robot “Horipado” o sedin bollo – “babu Bajarer macher dor niye roj roj ato Khach khach korben na.Kucho chingrir daam jadi saretinso taka hay ami ki korbo bolun? Apni nijei bazar koren na kano kaal theke!”
bojho aspordha.
হা হা হা। খুব মজা পেলাম আপনার কমেন্টে।
ঝানু হাতে লেখা। সাবলীলভাবে কাহিনী এগিয়েছে। রম্যের মাধ্যমে লেখক কিছু বার্তা দিতে চেয়েছেন। শেষের চমকটাও দারুন ছিলো। শুভকামনা রইল।