ফ্যানাটিক
লেখক: সরিতা আহমেদ
শিল্পী: ইন্টারনেট
পাওয়ার হাউজ থেকে রিচার্জ শেষে বেরিয়ে এল জুজু। তার সোলার ওয়াচে এখন সময় সকাল ১০টা। একটু পরেই তাদের এডুল্যাব শুরু হবে। তার লাল টুকটুকে অটোরোডিতে উঠে আসতেই প্যাক্সি বলল, “যাক আগামী আটচল্লিশ ঘণ্টার মতো নিশ্চিন্ত।” জুজু বুড়ো আঙুল তুলে ‘ইয়েস’ বলে রোডির সুইচ অন করতেই চোখের পলকে বাতাসে ভর করে সেটা ছুটে চলল ল্যাবের দিকে। যদিও অটোরোডি তার বয়সী ছেলেদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় গাড়ি, কিন্তু জুজু এখনও ঠিক মানিয়ে নিতে পারেনি। বিশেষত যখন রোডিতে অটোমেসেজ ভেসে আসে ‘আমরা এবার ছুটতে শুরু করছি’; অথবা ‘সিটবেল্ট ঠিকমতো বেঁধে নাও, নইলে ল্যান্ডিঙের সময় দুর্ঘটনা ঘটবে।’ এই ঘোষণা শুরু হলেই আপনা থেকেই জুজুর চোখ বন্ধ হয়ে আসে, হাত-পা শক্ত হয়ে যেন জমে যায়, পেটের ভেতরটায় এক ঝাঁক ব্যাঙাচি যেন বুড়বুড়ি কাটে। ঠিক এরকমই অস্থির লাগত ফ্লাইটে উঠলেও। পৃথিবীতে যদিও সে মাত্র দু’বার সুযোগ পেয়েছিল প্লেনে চাপার। তখন এমনই অস্থিরতা টের পেয়েছিল। রোডিতে উঠলেই তাই আপনা থেকেই চোখ বন্ধ হয়ে যায় জুজুর।
পেছনের সীট থেকে এই সময় প্যাক্সির খুক-খুক হাসি ভেসে এল “ওফ জুজু! দু’বছর হয়ে গেল! এখনও এত ভয়! আমাদের ২৬ বছর বয়স হয়ে গেছে বন্ধু। আর কবে তুই ঠিকমতো ফ্যানাটিক হবি?”
প্রায়দিনই প্যাক্সি এরকম বলে জুজুকে লজ্জায় ফেলে দেয়। এটা সত্যি যে, বছর দু’য়েক আগে তারা যেমন ছিল এখন তা থেকে একেবারে বদলে গেছে। অন্তত প্যাক্সি তো চলনে বলনে, আচার ব্যবহারে এখন বেশ কেতাদুরস্ত ফ্যানাটিক হয়ে উঠেছে। সে জুজুর মতো ফেলে আসা দিন নিয়ে স্মৃতিচারণ করে না। জুজুও যে এরকম কেতাদুরস্ত হতে চায় না, তা নয়। কিন্তু কোথাও যেন দু’বছর আগের সেই বোকাসোকা কিশোরটি তার মধ্যে এখনও মাঝে মাঝে জেগে ওঠে এবং তাকে বুঝিয়ে দেয় দৈহিক গঠনে যুবক হয়ে গেলেও তার ভেতরের বাচ্চাটি এখনও বেঁচেবর্তে আছে। আর যখনই এরকম হয়, তার ভেতরের সমস্তটা তোলপাড় হয়ে যায়। ভীষণ ইচ্ছে করে অটোরোডির সুইচ টিপে দু’বছর আগের সেই দাঁত ভাঙা বারো বছরের ছেলের চেনা জগতে ফিরে যেতে।
হিসেবটা মিলল না, তাই না!
জুজুও এই হিসেব মেলাতে একদম পারে না। এই যেমন আজও নিয়ম মেনে রোডিতে চেপে ল্যাবে যাচ্ছে ব্যাজার মুখে, আর পৃথিবীতে ফেলে আসা দিন আর বর্তমান জীবনের পারা না-পারার মাঝে দমবন্ধ অবস্থার কথা চিন্তা করছে। এখনও প্রায় তিরিশ মিনিট সময় আছে ল্যাবে পৌঁছাতে। ওরা যতক্ষণ রোডিতে থাকবে ততক্ষণ কথা বলা মানা, মোরালিশদের কড়া নিয়ম গোটা ফ্যান গ্রহে। রোডি চলাকালীন শুধু রোডির অটোমেসেজই কথা বলতে পারে, প্যাসেঞ্জারদের কাজ চুপচাপ সেই নির্দেশগুলো মেনে চলা।
যাক গে, যতক্ষণ ওরা ল্যাবে পৌঁছচ্ছে ততক্ষণ আমরা জেনে নিই জুজুর গল্প। আসলে এ গল্প জুজুর একার নয়, জুজুর বয়সী প্রায় সবারই গল্প।
(২)
সেটা ২০৯৮ সালের একটা হেমন্তের দিন।
জুজুর পৃথিবীতে তখনও উৎসবের রেশ রয়ে গেছে। স্কুলের পরীক্ষা শেষ। ফল যেমনই হোক না কেন, নতুন করে পড়াশুনা শুরু করতে এখনও দু’সপ্তাহ তাদের সময় লাগবে। কালী পুজোর পর পরই ঘটনাটা ঘটল। ভাইফোঁটার পরদিন বিকেলে যখন মানুমাসী, মশাই ও বনি দিদিরা চলে গেল; তখন জুজু তাদের স্কুলের পেছনের পুকুর ধারটায় গেল। স্কুলে এখন ছুটি, তাই পুকুরের এদিকে লোকজন একদম নেই। এমনিতেও নতুন সরকারি আইনে এমন সংরক্ষিত জলাশয়ের ধারে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাফেরা করা নিষেধ, নইলে সন্দেহ ভাজনের খাতায় নাম উঠতে পারে। কিন্তু এদিকটায় সিসিটিভি এখনও লাগানো হয়নি, তাই জুজুর প্রাথমিক দ্বিধাটুকু কেটে গেছিল। পুকুরের এদিকে বড় গাছপালা না থাকলেও ছোট ঝোপঝাড় বেশ আছে। সে একটা ছোট লাঠি নিয়ে ঝোপগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে হাঁটতে লাগল অন্যমনস্কভাবে। একে তার মন খারাপ, তারপর দুপুরে একটা কাণ্ড হয়েছে যা বনিদিদিদের বলা হয়নি, নইলে ওরা খুব খ্যাপাত। আজ দুপুরে খাওয়ার পরেই তার নিচের পাটির নড়বড়ে দাঁতটা টুক করে পড়ে গিয়েছে।
পুকুরের এদিকে স্কুলের বাচ্চারা ছাড়া সাধারণত অচেনা কেউ আসে না। আসলে এখন সবাই জেনে গেছে এসব জলা জায়গা সাধারণ মানুষের ব্যবহারের স্থান নয়। গত দশ বছর ধরে সমস্ত নদী, দীঘি, পুকুর, ডোবা বা যে কোনও বড় জলাশয় সরকারের সংরক্ষিত ভূমির অধীনে পড়ে। বহু আগে রেল লাইনের পাশে, মানে যেখানে এখন তাদের স্কাইহাইট হয়েছে সেটার উলটো দিকে অপরিচ্ছন্ন বস্তি এলাকা ছিল। ২০৫০ থেকেই তার দেশ জনসংখ্যায় সব দেশকে টপকে গিয়েছে। সেইসময় জমি মাফিয়াদের মতো জল মাফিয়ারাও সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে সরকার থেকে সমস্ত ‘ওয়াটার-বডি’গুলোয় রেড-এলার্ট জারি করা হয় নতুন আইন এনে।
যাই হোক, সেসব বড়দের ব্যাপার। নানা আলোচনায় জুজু এসব কথা শুনেছে। যদিও এখানে ভরদুপুরে কেউ তাকে দেখতে পাবে না, তবু মনের মধ্যে একটু দ্বিধা নিয়ে জুজু সবার নজর এড়িয়ে ঘোরাফেরা করছিল। আসলে সে খুঁজছিল একটা ইঁদুরের গর্ত। ভাঙা দাঁতটা ফেলবে বলে। অবশ্য এটা জুজু কোনওদিন কাউকে বলতে পারবে না, নইলে সবাই তাকে ‘ব্যাকডেটেড’ বলে খ্যাপাবে।
ভাঙা দাঁত ইঁদুরের গর্তে ফেলার ব্যাপারটা সে জেনেছিল দাদুর আলমারিতে পাওয়া এক সত্যিকার ‘বই’য়ে। তার দাদুর বাবা ছিলেন বেশ রাশভারি ব্যক্তি। তরুণ জীবনে তিনি নাকি থিয়েটার করতেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল তখনকার নানা প্রতিভাশালী ব্যক্তির। তাঁর আলমারি ভর্তি আছে বিভিন্ন রকমের স্মারকে। জুজুর দাদু সেইসব বইগুলোকে মোটা চামড়া দিয়ে বাঁধাই করে অতি যত্নে সংরক্ষিত করে রেখেছিলেন। খুব ছোট বয়সে জুজুকে তার দাদুই হাতে ধরে নানা কবি সাহিত্যিকের গল্প বলতেন। কিন্তু স্কুলের ই-বুক পড়ার চাপে জুজুর সুযোগই হয়নি ‘সত্যিকারের বই’গুলোকে খুলে দেখার। এমনিতেও অত মোটা আর ভারী বই দেখে তার প্রথমদিকে বেশ ভয়ই করত। যাই হোক, কিছুদিন আগেই সে আলমারি থেকে বেশ কিছু পাতলা বই পড়েছে। অবশ্য সেইসব ছোটদের বইয়ের গল্প নিয়ে এত কার্টুন টিভিতে বেরিয়ে গেছে যে গল্পগুলোর মধ্যে অচেনা কিছুই মনে হয়নি। তবু কী যেন একটা আকর্ষণ ছিল ওই সত্যিকার বইগুলোয় – তাদের অদ্ভূত সব গন্ধ নেশা ধরিয়ে দিত জুজুকে। এসব কথা অবশ্য জুজু কাউকে বলতে পারেনি। তার এইসব উদ্ভট খেয়াল কেউ জানতে পারলে খুব খ্যাপাবে।
কালচে-লাল মলাটে বাঁধাই করা একটা গল্পের বইয়েই ছিল ভাঙা দাঁতের বিষয়টা, তা প্রায় একশো বছর আগের লেখা। তখনকার ছোটরা ছিল ভীষণ সরল, তারা যেমন বেশ কিছু শিশুতোষ সংস্কার মেনে চলত; সেরকমই আবার সত্যিকারের কাগজ-সুতো বাঁধাই করা বইখাতা নিয়ে লেখাপড়াও করত। যেসবের ছবি দেখেছে জুজুরা তাদের ই-ক্লাসে। প্রয়াত দাদুর আলমারিতে নানা অ্যান্টিক জিনিস ঠাসাঠাসি করে রাখা। বড়দের অত সময় নেই ওসব দেখার। যদিও বইটা খুব ভারি কিছু নয়, তবু তাদের বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র জুজুই দেখেছিল এত এত সত্যিকারের বই। এরকম ‘অ্যান্টিক পিস’-এর মালিক হওয়াটার আলাদা দাম আছে বৈ কি! সুতরাং তাদের ই-ক্লাসের বাইরে পড়া সেই সত্যিকারের কাগজের বইগুলো নিয়ে জুজুর আগ্রহ ছিল সীমাহীন। আর কে জানে কেন ওইসব বইয়ে পড়া অতীতের ছেলেবেলার গল্পগুলো তাকে ভীষণ ছুঁয়ে গিয়েছিল।
(৩)
কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করেও একটা ভালোমতো ইঁদুরের গর্ত খুঁজে পেল না জুজু। অগত্যা সেই জলভরা পুকুরেই দাঁতটা ছুঁড়ে ফেলল সে। দাঁতটা টুপ করে জলে পড়ে গোল ছোট্ট একটা রিঙের আলপনা দিয়েই ডুবে গেল। শীতটা ঠিক পড়েনি এখনও, তবে শিরশিরে একটা বাতাস বয় মাঝেমাঝেই। এতক্ষণ খেয়াল করেনি সে, তবে হাতটা পকেটে ঢোকাতে গিয়েই বুঝল প্যান্টের কিছু জায়গায় কাদা লেগে গেছে। বাড়িতে দেখে ফেললেই কৈফিয়ত দিতে হবে। এই অবেলায় কেন গিয়েছিল সে জলা জায়গায়। কিন্তু কীভাবেই বা বলা যাবে আসল কারণটা। তার মতো ক্লাস সেভেনে পড়া ছাত্রের কাছে এমন কাজ তো সত্যিই হাস্যকর। জুজু তাড়াতাড়ি গোড়ালির দিকে প্যান্ট গোটাতে লাগল। তারপর ফেরার জন্য পা বাড়াতেই হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল পুকুরের একটা বিশেষ কোণায়। সবুজ মতো ওটা কী! ওইখানেই তো দাঁতটা সে ছুঁড়ে ফেলেছিল। আর সেখানেই এখন দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা সবুজ বকচ্ছপ।
এ প্রাণীটা সে দেখেছিল যাদুঘরে। বাবা-মায়ের কাছে শুনেছিল বাংলায় যত লেখক বিভিন্ন কাল্পনিক প্রাণীর কথা লিখে গেছেন সেগুলোকে বিজ্ঞানীরা নানা চেষ্টায় জিন থেরাপির মাধ্যমে বানিয়েছেন এবং সেসব প্রাণীকে কৃত্রিম আবহাওয়ায় সংরক্ষণ করার একটা চেষ্টা করা হয়েছে এই যাদুঘরে। সেদিন অমন অদ্ভুতুড়ে সব জিনিস আর তাদের কাণ্ডকারখানা দেখে জুজুর ভারি মজা লেগেছিল। পরে বাড়িতে এসে দাদুর আলমারি থেকে এইসব জীবদের নিয়ে লেখাও পড়েছে সুকুমার রায়ের রচনায়। কিন্তু সেই যাদুঘরের কাল্পনিক বকচ্ছপ এখানে কেন!
পা টিপে টিপে সবুজ বকচ্ছপের দিকে এগিয়ে গেল জুজু। প্রাণীটা খুব একটা খারাপ দেখতে নয়, খুব বড়ও না আবার খুব ছোটও না। হাতের মুঠোয় বেশ ধরা যায়। জুজু ভয়ে ভয়ে তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বলল, “অ্যাই আমার হাতে উঠে আয় তো। এখানে থাকলে বিপদ হতে পারে। চল তোকে যাদুঘরে পৌঁছে দিই।” প্রাণীটি ড্যাবড্যাব করে তার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে ফ্যাচ করে কেমন শব্দ করল। জুজুর মনে হল ওটা তাকে দেখে হাসছে। বেজায় অবাক হয়ে জুজু যেই না আরেকটু এগিয়েছে ওটাকে ধরবে বলে, অমনি ব্যাটা লাফ দিয়ে জলে পড়ল। তবে জলে ঝাঁপানোর আগে সেটা জুজুর দিকে একবার ফিরে তাকাল, যেন বলতে চাইল, “আয় দেখি, কেমন পারিস জলে ভাসতে!”
জুজু সাঁতার জানে না, তার’পর মা’কেও বলে আসা হয়নি। বিকেল নামছে দ্রুত। তার শীত করতে লাগল। কিন্তু এমন আশ্চর্য প্রাণীর হাতছানিকে এড়িয়ে যাওয়াও তো মুশকিল। কপালে যা থাকে থাকুক, বকচ্ছপের সঙ্গে একবার জলে নেমে দেখাই যাক না! জুজু জলের দিকে এগিয়ে যেতেই কাদা মাটিতে টাল খেয়ে সুড়ুৎ করে জলে পড়ল। আর তার পরেই ঘটল ম্যাজিক।
এঁদো পুকুরের তলায় এমন অদ্ভুত জিনিস আছে কেই বা জানত! আঁশটে শ্যাওলার পর্দা সরতেই জুজু স্পষ্ট বুঝল বকচ্ছপের পিঠে চেপে সে ভেসে যাচ্ছে। উঁহু, ঠিক ভেসে যাচ্ছে না, বকচ্ছপটাই যেন তাকে নিয়ে যাচ্ছে কোনও এক অজানা দেশে। এইভাবে সে কতক্ষণ ভেসেছিল মনে নেই। তবে যখন জলের স্রোত কমে এল তখন বুঝল সে একটা বিশাল জাহাজে। বকচ্ছপ তাকে সেই জাহাজে ফেলে দিতেই ঘটাং করে জাহাজের ঢাকনা বন্ধ হয়ে গেল আর মাথায় জোরে ঠোকা লেগে জ্ঞান হারাল জুজু।
পরে সে জেনেছিল ওটা ছিল একটা সাবমেরিন যা আসলে এসেছিল ফ্যান গ্রহ থেকেই।
(৪)
ফ্যান গ্রহে নামার পর কখন তার জ্ঞান ফিরেছিল সে জানে না। কিন্তু যখন চোখ খুলল তখন দেখল সে একটা আয়না-ঘরে পড়ে আছে। ঘরটার চার দেওয়ালেই আয়না লাগানো। সেখানে নিজেকে দেখে সে ভয়ানক চমকে গেল। দেখল সে আর বারো বছরের ক্লাস সেভেনে পড়া জুজু নেই। সে এখন রীতিমতো একজন যুবক। শুধু নিচের পাটির একটা দাঁতই ভাঙা, এই যা।
ভালো করে নিজেকে দেখার জন্য আয়নায় হাত ছোঁয়াতেই পাশ থেকে একটা চেম্বার খুলে একটা ট্রে বেরিয়ে এল তার সামনে। আর সঙ্গে সঙ্গেই তার চোখ পড়ল নিজের হাতের কব্জিতে। তারপর অন্য কব্জিতে। কী আশ্চর্য, তার কব্জিতে এসব ট্যাটু কবে থেকে হল! কিন্তু না, ট্যাটু তো নয়। এগুলো এক ধরণের সঙ্কেত বা কোড। আয়না থেকে বেরোনো ট্রের একটা বোতামে আঙুল ছোঁয়াতেই সেই কব্জির ট্যাটু থেকে এক ধরণের নীল আলো বেরল আর তারপরেই এক অজ্ঞাত রোবট স্বরে ঘোষিত হল “ওয়েলকাম টু প্ল্যানেট ফ্যান। প্লিজ রিমেম্বার ইয়োর আইডি কোড ‘ফ-০১০’ অ্যান্ড গেট রেডি ফর এডুল্যাব।” তারপরেই সেই চেম্বারের এক কুঠুরি থেকে বেরল এক সেট নতুন জামা।
এ কোথায় এসে পড়ল জুজু! সে এত বড় হয়ে গেল কীভাবে? অবশ্য এসব ভাবার মতো সময় তাকে দিল না ফ্যানাটিকরা। সদ্য প্রাপ্ত জামাটিকে পরামাত্রই সামনের এক দরজা দিয়ে বেশ কিছু তারই বয়সী ছেলে ঘরে প্রবেশ করল। সবাই একরঙের জামা পরা, সবার হাতের কব্জিতেই ওইরকম ট্যাটু যাতে বিচিত্র সব নাম্বার লেখা রয়েছে। আর ঠিক তখনই চোখে পড়ল প্যাক্সিকে। ওই ছেলেদের দলে সবার শেষে ধীরে সুস্থে ঘরে ঢুকল প্যাক্সি। তাদের স্কুলের সবচেয়ে বোকা, সবার কাছে মার-খাওয়া ছেলেটাকে এখানে দেখে জুজু দারুণ চমকে গেল।
এরপরের ঘটনা খুব একটা নাটুকে নয়।
ফ্যান গ্রহের আপাত চেহারা তাদের পৃথিবীর মতোই। শুধু রাস্তাঘাটে কোনও মাটি নেই, গাছপালা, ফুল-পাখি নেই আর এখানকার বাসিন্দাদের মুখ দেখা যায় না। সবাই এক বিশেষ ধরণের পোষাক পরে মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে চলাফেরা করে। এটাই নিয়ম এখানে। বলা যায় ফ্যান হল এক নিয়মনিষ্ঠ গ্রহ। প্রথম প্রথম জুজু সারাটা দিন ঘুরে ঘুরে দেখার চেষ্টা করেছে,প্যাক্সির সঙ্গে গল্প করার চেষ্টা করেছে। তবে যেহেতু স্কুলে প্যাক্সিরসঙ্গে জুজুদের গ্রুপের সেরকম বন্ধু ছিল না, তাই এখানেও প্যাক্সি ঠিকমতো সহজ হতে পারছিল না তার সঙ্গে। জুজু অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে তাকে এখানে কীভাবে এল সে, প্যাক্সি ততবারই ঠোঁট উলটে উত্তর দিত “জানি না”।
ফ্যান গ্রহের এডুল্যাব জিনিসটা বেশ জটিল একটা প্রজেক্ট। প্রথম দিকে জুজু ল্যাবের ভেতরের কাজটাজগুলো বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করত। সবার পোষাক এক রকম ও মুখে মাস্ক থাকত বলে, চেহারা অনুযায়ী পরিচয় মনে রাখা সম্ভব ছিল না প্রায় কারুরই। তবে যে সাবমেরিন জুজুকে এই গ্রহে এনেছিল সেটা দেখতে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি তাকে। মুশকিল হল সাবমেরিনটা ল্যাবে প্রবেশ করার পরে যে কোথায় যায় আর তাকে ঘিরে কী করে অন্যান্য ফ্যানাটিকরা সেটা বোঝার কোনও উপায় নেই। ল্যাবের কোনও কক্ষে ইচ্ছেমতো ঢোকা যায় না। প্রতিটা কক্ষে প্রবেশের জন্য কব্জির ট্যাটু স্ক্যান করাতে হয়। স্ক্যানিং মেশিন জুজুকে প্রবেশের অনুমতি দেয় না। শুধু জুজুকেই নয় অবশ্য। তার সঙ্গে আসা অনেক ছেলেকেই মেশিন ‘প্রহিবিটেড’ বলে লাল চোখ দেখায়। ল্যাব স্যুট পরার জন্য যখন তারা চেঞ্জিং রুমে ঢোকে, তখনই একমাত্র সবার চেহারা দেখার সুযোগ মেলে। ওই ঘরে কৃত্রিম ভাবে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা আছে, ফলে বাথরুম আর চেঞ্জিং রুমে ওই মাস্কের দরকার পড়ে না। ল্যাবে জুজুর কাজ হল রোডিগুলোকে বিশেষ রাসায়নিকে পরিষ্কার করে ধোওয়া। অক্সিজেনের মতোই জলও এখানে দুষ্প্রাপ্য।
এই গ্রহে যে ফ্যানাটিকের সংখ্যা খুব বেশি নেই তা বুঝতে গোটা একটা বছর সময় লেগেছে তার। এই এক বছরে সে অটোরোডি চালাতে শেখার সময় বেশ কিছু অজানা জায়গায় ইচ্ছে করেই চলে যেত, যাতে এখানকার পরিস্থিতি সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা করা যায়। ফ্যান গ্রহের একটা সুবিধা হচ্ছে এখানে কোনও দেশ-বিদেশ বলে ব্যাপার নেই। পুরোটাই একটা দেশ, একটা গ্রহ আর একরকমই এখানকার অধিবাসী – সবাই ফ্যানাটিক নামে পরিচিত। কোনও জাত-ধর্ম বিভেদ নেই। তাই নেই নামের পদবী বা ঠিকুজী। এখানে নাম অর্থে এক একটা আলাদা কোড ব্যবহার করা হয়। যেমন–জুজুর ফ্যানাটিক আইডি এফ-০১০। সমস্ত ফ্যানাটিক একই রকম দেখতে বাড়িতে বাস করে। সবার বাড়ির রং সাদা, বরফের মতো। সবার পোষাকও একই রকম সাদা। গোটা গ্রহের চলমান ছবি দেখলে মনে হবে এখানে সবাই বর্ণচোরা অথবা বর্ণান্ধ। চারিদিকে এত এত সাদা দেখে জুজুর চোখ ধাঁধিয়ে যেত প্রথম প্রথম।
অটোরোডি চালাতে শেখার পরেই সে প্রথম রং বাছাইয়ের সুযোগ পেল। তার রোডির রং হল – টকটকে লাল। এই গ্রহের সব কিছুই যেন উড়ন্ত। মাটি নেই, সবকিছুই বরফে ঢাকা। গোটা গ্রহটাই যেন বরফে তৈরি। তাই এদের যানবাহন চলাচল সবটাই হয় আকাশ পথে। রোডি চালাতে শেখার সময় জুজুর ভাবতে ভালো লাগত যে এখানে ট্রাফিক জ্যামে পড়তে হবে না। স্কাইওয়ে-ট্রাফিক অবশ্য আছে, তবে সেসব পুরোটাই অটোমেটিক ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় মোরালিশদের কঠোর তত্ত্বাবধানে। মোরালিশ হল ফ্যান গ্রহের নীতি নিয়ামক বা সোজা কথায় পুলিশ। কোনও ফ্যানাটিক কিছুতেই মোরালিশের চোখ এড়িয়ে কিছু করতে পারে না।
জুজুর সঙ্গে যে সাতজন ছেলে এসেছিল প্রথমবার, তাদের সবার জন্য একটাই ঘর বরাদ্দ হয়েছিল। এই নিয়ে দু’একজন প্রতিবাদ করলে মোরালিশরা তাদের টানতে টানতে কোথায় যে নিয়ে গিয়েছিল কে জানে, তবে যখন সেই দু’জন ঘরে ফিরল তখন তারা একেবারে বদলে গেছে। জুজু অবশ্য এসব বিদঘুটে ব্যাপার স্যাপারে এতটাই হতবাক হয়ে গিয়েছিল যে বাড়ির জন্য, মায়ের জন্য মন খারাপের কথা একদম ভুলেই গিয়েছিল। যখন মনে পড়ল তখন খেয়াল করে দেখল তার ঘরের নতুনদের মধ্যে কেউই বাড়ির জন্য কান্নাকাটি করছে না। অবশ্য সবার মুখেই তখন মাস্ক। কাজেই কারোর মনের অবস্থা বোঝার কোনও উপায় নেই।
প্রথম রাত সাদা ইনক্যুবেটরে কাটিয়ে জুজুর যখন ঘুম ভাঙল, তখন সে ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টায় ছিল যে এটা স্বপ্ন নাকি সত্যি! রাতারাতি কেউ ১২ বছর থেকে এক লাফে ২৪ বছরের যুবক হতে পারে নাকি! তবে আগামী দু’বছরে সে যখন সত্যিই ২৬ বছরের তরতাজা যুবক হয়ে গেল তখন সাধারণ বুদ্ধিতে বয়সের এমন গরমিল অঙ্কটা না বুঝলেও মেনে নেওয়া ছাড়া তার কোনও উপায়ও রইল না।
প্যাক্সির সঙ্গে বন্ধুত্বটা এক রকম জোর করেই করেছিল জুজু। এই অচেনা গ্রহে অন্তত একজন চেনা মুখ যখন সে পেয়েছে তখন বন্ধুত্ব না করে নিজেকে একলা রাখার কোনও যুক্তি থাকতে পারে না। প্যাক্সি প্রথমদিকে বেশ গুটিয়ে থাকলেও ধীরে ধীরে সেও জুজুর বন্ধু হয়ে উঠল। একবছর ওই কমন ইনক্যুবেটরে থাকার পরে তাদের জন্য দু’কামরার ঘর দেওয়া হল। মোরালিশরা অবশ্য রুমমেট বাছাইয়ের স্বাধীনতা দিয়েছিল। সেই সুবাদেই জুজু আর প্যাক্সি একই ঘরে থাকার সুযোগ পেল। ল্যাবে তারা একই অটোরোডিতে যাওয়া আসা করে। প্যাক্সি যায় ল্যাভেটরির কাজে আর জুজু যায় রোডি ওয়াশিং-এ। অবশ্য এমন বিদঘুটে কাজ আর বেশি দিন তাদের করতে হবে না। এখন তারা জানে, যেসব মানুষ পৃথিবী থেকে এখানে এসেছে তাদের জন্য দু-বছরের একটা প্রভিশনাল পিরিয়ড থাকে। প্রতিটা হিউম্যান বিয়িংকে ‘ফ্যানাটিক’ হয়ে ওঠার জন্য এই দু-বছরের কঠিন সময় অতিক্রম করতেই হয়। যারা এতে সফল হয় তারা ফ্যানাটিক হয়ে ওঠে এবং লোয়ার, আপার, হায়ার, এলিট ইত্যাদি পরপর ধাপে উন্নতির দিকে এগিয়ে যায়। অবশ্য এইসব কিছুই নিয়ন্ত্রণ করে মোরালিশরা। বলা যায় ফ্যান গ্রহের সমস্ত কিছুই মোরালিশদের হাতের মুঠোয়, কিন্তু এই ভগবান তুল্য মোরালিশদের কেউ কখনও দেখতে পায় না।
একমাত্র যারা নিয়ম ভাঙার অপরাধী বা ক্ষমা অযোগ্য দণ্ডের আসামী তাদেরকেই দেখা দেয় মোরালিশরা।
(৫)
ল্যাবের পার্কিং প্লেসে তার লাল টুকটুকে রোডিকে পার্ক করে জুজু আর প্যাক্সি নেমে পড়ল। এবার তারা যাবে ‘ইটারী’তে। এখানে তাদের জন্য নির্ধারিত ‘ফুডলস’ খেয়ে তবেই যাবে চেঞ্জিং রুমে। হাতে এখনও সাত মিনিট সময় আছে। রোডির সুইচ অফ করে ট্যাটু স্ক্যান করিয়ে জুজু যখন পা বাড়াল ‘ইটারী’র দিকে, তখনই পেছন থেকে একটা চাপা স্বর শুনতে পেল। সুকো ডাকছে। জুজু আর প্যাক্সির সঙ্গে সুকোর আলাপ হয়েছে তিন দিন হল। এখন জুজু মোটামুটি ভাবে সহকর্মীদের চিনতে পারে, তাদের প্রত্যেকের ট্যাটুর নকশা অনুযায়ী। প্যাক্সিই এই বুদ্ধিটা দিয়েছিল। এই একঘেয়ে সাদা জীবদের ভিড়ে পরিচিত হতে গেলে হাতের নকশা আর গলার স্বর মনে রাখা ছাড়া উপায় নেই। গলার স্বর আলাদা করে চেনারও উপায় নেই, কারণ মোরালিশদের নীতি অনুযায়ী কাজ করতে করতে উচ্চস্বরে কথা বলা নিষিদ্ধ। জুজুরা একে অপরের আসল নাম জানলেও সবার সামনে কাজ করতে করতে সেসব নাম উচ্চারণ করা নিষিদ্ধ। তখন কোড ‘ওয়ান-জিরো’, কোড ‘ফোর সেভেন’ ইত্যাদি বলে ডাকতে হয়।
সুকো তার কালো রোডিকে পার্ক করে এগিয়ে এল জুজুদের দিকে। এই ছেলেটির উচ্চারণ আর অঙ্গভঙ্গি দেখে জুজুর ধারণা ছেলেটি এসেছে জাপান থেকে।
ওরা তিনজন হাত মিলিয়ে নিয়ে হাঁটা দিল ‘ইটারী’র দিকে। আজ প্যাভিলিয়নে ভিড় যেন একটু বেশিই। প্রায় সতেরো জনের পরে ওরা তিন জন লাইনে দাঁড়াল। ফুডলসের চারটে করে দানা আর এক পাউচ জল সবার প্রাপ্য। তবে দুজনের মধ্যে বাড়তি পাউচ জল নিয়ে বোধহয় ঝামেলা লেগেছে। মাইকে চাপা অথচ গম্ভীর স্বরে মোরালিশদের যান্ত্রিক নির্দেশ ভেসে আসছে। কিছুটা ধমক খেয়ে ঝগড়ারত দুই লোক আলাদা হয়ে গেল। ফুডলসগুলোকে মুখে ভরে নিয়েই ঢকঢক করে জল খেয়ে নিল সুকো। তারপরেই মুখ দিয়ে একরকম শব্দ বের করল যার অর্থ দাঁড়ায় “উফ, ম্যাগো! কী জঘন্য!”
জুজুর বেশ হাসি পেল। প্রথম প্রথম ফুডলস খেতে তারও ওইরকম লাগত। আসলে ফ্যান গ্রহে যেহেতু মাটি নেই, তাই ফসল ফলে না। ফুডল্যাবে প্রস্তুত একরকম পুষ্টিকর ট্যাবলেট খেয়েই বেঁচে থাকতে হয় সমস্ত ফ্যানাটিকদের। ফুডলস হল সেই ট্যাবলেট। ফ্যান গ্রহের জল আসে প্রধানত বৃষ্টি থেকে। তাই জল নিয়ে মোরালিশদের একশোর বেশি আইন আছে। সময় আর পরিমাণ অনুযায়ী জল চাইতে হয় সবাইকে। একফোঁটাও বেশি খরচ না।
প্রথমদিকে জুজুর মনে হত জলের ব্যাপারে মোরালিশদের নিয়মই পৃথিবীর লোকেরা অনুসরণ করছে। ২০৯৮ সালের পৃথিবীতেও তো জল মাফিয়াদের হাত থেকে সমস্ত জলাশয় বাঁচানোর জন্য এমনই কড়াকড়ি আইন বানিয়েছিল সরকার। তবে এখানে এসে তার মনে হয়, মোরালিশরা বোধ হয় জল নিয়ে একটু বেশিই কড়া। এর পেছনে শুধুই কি বৃষ্টির অসম বন্টন দায়ী নাকি অন্যকিছু!
ল্যাবের কাজ শেষ করে রাতের জন্য বরাদ্দ চারটে ফুডলস আর দু’প্যাকেট জল নিয়ে যখন জুজু তার রোডিতে চেপে বসল তখন সোলার ওয়াচে সময় বিকেল পাঁচটা। ফ্যান গ্রহে সূর্য ডোবে সাতটারও পরে। তাই বাড়ি ফিরে তার নিজের জন্য সময় থাকে আরও দু’ঘণ্টা। এই সময় তারা বেলচা হাতে বাড়ির সামনের রাস্তাটুকু পরিষ্কার করে নেয়। নইলে রাতের ঠান্ডায় বরফের স্তূপে রোডির গ্যারাজটা পুরো ডুবে গেলেই মুশকিল হবে, ঘরের ছাদে, গ্যারাজে বরফের চাদর ঢাকা থাকলে পাওয়ার হাউজ থেকে চার্জ বেশি টানে। আর বেশি চার্জ খরচ করা মানেই বেতনের বেশ মোটা অংশ কেটে নেয় মোরালিশ আইন। তাই সূর্য ডোবার আগেই তাদের দ্রুত বাড়ি ফিরতে হয়। রাত নেমে গেলে যখন চারদিক নিস্তব্ধ হয়ে যায় তখন ছুটি মেলে সমস্ত কাজ থেকে। ফ্যান গ্রহের কেউই রাতে কোনও কাজ করে না। কারণ অত পাওয়ার সাপ্লাইয়ের ব্যয়ভার বহন করার ক্ষমতা খুব বেশি ফ্যানাটিকদের নেই। এখানে প্রতিটা পদক্ষেপ তাই নিয়ম অনুযায়ী মেপে, বুঝে ফেলতে হয়। বাড়তি খরচের ভাবনাচিন্তারও অবকাশ নেই কারোর।
দ্রুত হাতে বরফ সাফাই করতে করতে অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিল জুজু। আজকাল মাঝে মাঝেই তার এরকম হচ্ছে। চারিদিকে সাদা বরফ, সাদা বাড়ি আর মাথার উপর অবিরত রোডিদের আলোর ঝলকানি দেখে সে ক্লান্ত। যতক্ষণ না সূর্য ডোবে ততক্ষণ এই এক দৃশ্য দেখতে দেখতে আর মূহুর্মূহু মোরালিশদের রোবোটিক ঘোষণা শুনতে শুনতে মাঝে মাঝেই তার বেলচাধরা হাত থেমে যায়। এক-একদিন এই সময় মায়ের কথা খুব মনে পড়ে তার। বাড়িতে থাকার সময় মনে মনে সে খুব বড় হতে চাইত, একলা থাকতে, একা একা বড়দের মতো বাড়ি থেকে বেরোতে চাইত, আপন খেয়ালে যেখানে খুশি যেতে ইচ্ছে হত তার খুব। কিন্তু তা বলে সে যে একেবারে পৃথিবী থেকেই এতটা দূরে একলা এসে পড়বে তা কেই বা জানত!
আশার কথা, আগামী কাল থেকেই তার ওয়াশিংরুমের ডিউটি শেষ হচ্ছে। আজ এক ঘোষণায় প্রভেশনাল পিরিয়ড শেষ হচ্ছে এমন কর্মচারীদের তালিকায় তার ও প্যাক্সির নাম রয়েছে। ঘোষণার কথা মনে হতেই কালো দরজার কন্ট্রোল রুমের কথা মনে এল তার, যেখানে এত দিন ধরে ‘প্রবেশ নিষিদ্ধ’-র বোর্ড ঝোলানো আছে, সেখানে কাল থেকে ঢুকতে পারবে সে। কাল থেকে তাদের সিলভার পোষাক আর কালো মাস্কের সাজ। নির্বাচিত কর্মচারীদের ওটাই পোষাক। প্যাক্সি আজ বেশ চনমনে আছে। ল্যাভেটরি সাফাই সত্যিই বড্ড কষ্টের কাজ। সেটা থেকে মুক্তি পেয়ে প্যাক্সি আজ যে বেজায় খুশি তা বোঝা যাচ্ছে তার গুনগুন সুর ভাঁজা শুনে। আহ! কত দিন পরে জুজু সুর শুনতে পেল! পৃথিবীতে থাকার সময় দিনের বেশির ভাগ সময় হেডফোন গুঁজে রাখা নিয়ে মায়ের সঙ্গে কতই না তর্ক হত তার।
আর এখন, এই বিবর্ণ প্রাণহীন, সুরহীন, সবুজহীন গ্রহে যান্ত্রিক শব্দ আর রোবোটিক ঘোষণা ভিন্ন আর কিছুই শোনা যায় না।
“প্যাক্সি, আর একটু জোরে গাও না,প্লিজ।” মাস্কটা একটু তুলে জুজু কথাটা বলতেই প্যাক্সিও বেশ উচ্চস্বরে গাইতে লাগল। যদিও ওর গলাটা এমন কিছু শ্রুতিমধুর নয়, তার উপর মাস্কে ঢাকা মুখ দিয়ে যে স্বর বেরোচ্ছে তাও খুব একটা সুরেলা হওয়ার নয়। তবু এতদিন পরে গান শুনতে খুব একটা বেসুরো লাগল না। প্যাক্সির সঙ্গে গলা মেলাল জুজুও। ততক্ষণে গ্যারাজের সামনের বরফ পরিষ্কার হয়ে এসেছে, আর কিছুক্ষণ পরেই অন্ধকারে ঢেকে যাবে চারপাশ। গান গাইতে গাইতেই দ্রুত হাত চালাচ্ছিল তারা। ঠিক এই সময় মাথার উপর থেকে গ্যাঁওগ্যাঁঅ্যাঁ… শব্দে কানে প্রায় তালা লেগে গেল। সভয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে তারা দেখল লাল আলো জ্বলা একটা ড্রোন বিকট শব্দে দ্রুত গতিতে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে।
কি ব্যাপার কিছু ঠাহর করার আগেই তীব্র হর্ণ আর আলোর ঝলকানিতে তাদের হাত থেকে বেলচা খসে পড়ল, তার তখনই ড্রোন থেকে দুটো বড় বড় ধাতব সাঁড়াশির মতো দেখতে জিনিস বেরিয়ে এসে জুজু আর প্যাক্সিকে মাটি থেকে প্রায় শূন্যে তুলে নিয়ে উড়ে চলল সাঁই সাঁই করে। সারাদিনের পরিশ্রমের ফলে ক্ষিদে তেষ্টায় এমনিতেই ক্লান্ত ছিল তারা,তার উপর এমন ভয়াবহ ঘটনার আকস্মিকতায় আর ধাতব জিনিসটার চাপে জ্ঞান হারাল দু’জনেই।
(৬)
ঠিক কতক্ষণ বাদে তাদের জ্ঞান ফিরেছে, জুজু বা প্যাক্সি কেউই জানে না। প্রথম বোধহয় প্যাক্সিরই হুঁশ ফিরেছে। তার ধাক্কায় জুজু ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। ঘরটা আলো-আঁধারিতে বেশ অস্পষ্ট। জুজু দেখল তাদের মুখে মাস্ক নেই। একটা ভীষণ ঠান্ডা ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে তারা।
“জুজু, এই ঘরটা কাচের তাই না! ঠিক আমাদের কন্ট্রোল রুমের মতো।” প্যাক্সির কথায় জুজু বুঝল একদম ঠিক কথাই বলেছে প্যাক্সি। এটা তো তাদের ল্যাবের কন্ট্রোল রুমই। কিন্তু এখানে এরকম অসময়ে তারা এল কীভাবে! মাথাটা বেশ দপদপ করছে জুজুর। সামনের একটা চেয়ারের হাতল ধরে সে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, আর তখনই কাচের দরজা ঠেলে একটা বেঁটেমতো মুখোশধারি জীব এসে যান্ত্রিক স্বরে জানিয়ে গেল, ‘ফ্যানাটিক আইন ভেঙে গান গাইবার জন্য মোরালিশ রুল-বুকের পাঁচশো পাঁচ ধারায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আজ তারা এখানেই বন্দী থাকবে। আগামীকাল সকালে চীফ মোরালিশ এলে তাদের আদালতে পেশ করা হবে।’
কী অদ্ভূত গ্রহ এই ফ্যান!
“আমরা গান কখন গাইলাম জুজু! শুধু গুনগুন করছিলাম তো।” প্যাক্সি ভারি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল। অবাক যে জুজু হয়নি, এমন না। তবে দীর্ঘ দু’বছর ধরে ফ্যানাটিকদের রকমারি সব নিয়মকানুন শুনেটুনে আজকাল তার খুব বেশি বিস্ময় জাগে না। তবে এই পাঁচশো পাঁচ নাম্বার আইনের ব্যাপারটা কী – সেটা আগে জানতে হবে। গান গাইবার শাস্তিটা ঠিক কী, কতটা মারাত্মক সেসব না জেনে শুধুশুধু বসে থেকে রাত কাটালে চলবে না।
সামনের সুপার কম্পিউটারটা হালকা নীল রঙের আলো ছড়াচ্ছে। আশপাশের বাকি সবকিছুই নিকষ অন্ধকার। এই দু-বছরে জুজু একবারও কোনও কম্পিউটারে হাত দেওয়ার সুযোগ পায়নি। অথচ পৃথিবীতে প্রতিটা ঘরে, প্রতিটা মানুষের হাতে হাতে ঘুরত কম্পিউটার। কিন্তু এই গ্রহে সমস্ত প্রযুক্তি, সমস্ত গ্যাজেটস ব্যবহারের অধিকার কেবলমাত্র ফ্যানাটিকদের হাতেই আছে। নবাগতরা সেসব জিনিসের নাগাল পায় না, অথবা পায় অনেক পরে। জুজু গোটা কন্ট্রোল রুমটা ভালো করে দেখতে লাগল। এটা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, এখানকার গ্যাজেটসগুলো পৃথিবীর তুলনায় অনেক উন্নত মানের। যেসব প্রযুক্তি নিয়ে পৃথিবীতে গবেষণা চলছিল বলে জুজুদের জিকে ক্লাসে জানানো হত সেইসব প্রযুক্তি এখানে ফ্যানাটিক কাজকর্মে বহুল ব্যবহৃত। যেন কতশত বছর ধরেই তারা এসবে অভ্যস্ত।
কন্ট্রোল রুমের বাইরের জগৎ এখন সম্পূর্ণ শান্ত। রাত নামলেই মোরালিশদের আইন মেনে এই গ্রহের সমস্ত ল্যাবের সুরক্ষা ব্যবস্থা চলে যায় মাইক্রোক্যামেরার অধীনে। প্রতি মিলি সেকেন্ডের আইসোমেট্রিক ইমেজ ‘সেভ’ হয়ে থাকছে ওইসব অত্যাধুনিক ক্যামেরার মেমোরিতে।
প্যাক্সি এখন ক্লান্ত ক্ষুধার্ত শরীরে একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর দিকে চেয়ে জুজুর বেশ মায়া হল। এই নিরীহ, সোজা সরল ছেলেটা যখন তাদের স্কুলের সহপাঠী ছিল তখন কেন যে একে তারা বন্ধু বানায়নি! থাক বেচারা ঘুমিয়ে। বরং এই ঘরের সুপার কম্পিউটারগুলোকে ঘুরে দেখা যাক। রাত কাটতে এখন ঢের দেরি।
যেমন ভাবা তেমন কাজ। জুজু ওই নীল আলো লক্ষ করে এগিয়ে গেল সবচেয়ে বড় মেশিনের দিকে। প্রচুর গ্রাফিক্সের নক্সা ফুটে উঠছে, ভাগ্যিস কন্ট্রোল রুমের মধ্যে কোনও সিকিওরিটি ক্যামেরা নেই। নইলে সুপার কম্পিউটারের এত কাছাকাছি কেউ এসেছে জানলে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে বড় কোনও বিপদ নেমে আসতে পারত।
আলো জ্বালার কোনও সুইচ হাতের কাছে নেই। অন্ধকারেই আন্দাজ করে জুজু স্ক্রিণের উপর ফুটে ওঠা একটা বাটনে আঙুল বোলাতেই বেশ কিছু ভার্চুয়াল ফাইল খুলে গেল। সে আরও কিছু ফাইলে আঙুল ছোঁয়াল পর পর বেশ কয়েকবার। কিন্তু কোনও রেড এলার্ট জ্বলল না এখনও, তার মানে এগুলো মামুলি কিছু ব্যাপার। এমন অদ্ভুত সুন্দর গ্রাফিক্স ইমেজ দেখে জুজু বেশ মজা পেয়ে গেল। সে ভুলেই গেছে আগামী কাল সকালে তার জন্য ভয়ংকর শাস্তি অপেক্ষায় আছে। এইভাবে একটার পর একটা বোতামে আঙুল বোলাতে বোলাতেই হঠাৎ টেবিলের তলা থেকে একটা খট করে শব্দ হল। চমকে গিয়ে সেটায় নজর ঘোরাতেই জুজু দেখল হালকা সবুজ আলো জ্বলে উঠেছে একটা বিশেষ ড্রয়ারে। ড্রয়ারটা লক করা। সামনে একটা স্ক্যানার বসানো। একটু ভেবে জুজু তার কব্জির ট্যাটু স্ক্যানারের সামনে ধরল। আর তাতেই ম্যাজিকের মতো খুলে গেল ড্রয়ারটা। এমনিতে এসব গোপনীয় কুঠুরিতে তাদের মতো নবাগতদের ‘অ্যাক্সেস পারমিট’ কোনওদিন হয় না। তবে যেহেতু আজকেই তার প্রভিশন পিরিয়ড কেটে গেছে, তাই হয়তো নয়া ফ্যানাটিকের খাতায় তার আইডি প্রবেশাধিকার পেয়েছে। সেইজন্যই হয়তো এই ড্রয়ারের চাবিকাঠি তার হাতে এল।
জুজু বুঝতে পারছে তার ভেতর হৃৎস্পন্দন কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। ড্রয়ারটাকে সাবধানে টেনে এনে সে দেখল ভেতরে বেশ কিছু কাগজ। তারমানে ফ্যানাটিকরা এত আধুনিক হয়েও কাগজ ব্যবহার করে! একটু দমে গেল জুজু। সে ভেবেছিল ড্রয়ারে হয়তো আরও কিছু নতুন গ্যাজেট পাওয়া যাবে। কিন্তু … এ কি! এক গোছা কাগজের নীচে রাখা একটা ছোট কাঠের বাক্স। সেটাকে টেনে বার করতেই বুঝল দেখতে ছোট হলেও বেশ ওজন আছে বাক্সটার।
গুপ্তধনের মতো দেখতে এই বাক্সটার ব্যাপারে জুজুর তখন প্রচণ্ড আগ্রহ। ওপাশে হেলান দেওয়া প্যাক্সিকে ডাকতে গিয়েও সতর্ক হল সে। নাহ, থাক। বরং আগে বিষয়টা নিজে বোঝা যাক। তারপর ওকে ডাকা যাবে। বাক্সটা খুলতেই বেশ চমক লাগল। ভেতরে একটা বই, বেশ মোটা। কোনও মলাট নেই। বেশ কিছু আলগা কাগজ জুড়ে দিয়েই যেন বইটা বানানো হয়েছে। তাই এটা কিসের বই তা এক নজরে বোঝা গেল না। এমন কাগজের বইয়ের ধারণা জুজুর আগেই হয়েছে। ফলে প্রথমবারের মতো এবার অতটা চমকে গেল না সে। কিন্তু আশ্চর্যের বড় কারণটা হল বইটার মধ্য থেকে বেরনো আলো। যেন ফ্লুরোসেন্ট ইঙ্ক লাগানো রয়েছে এর প্রতি পাতায়। ফলে ঘরের মধ্যে আলো না জ্বালিয়েও বেশ পড়া যাচ্ছে বইটা। প্রথম পাতায় যা লেখা রয়েছে তার মানেটা হল – ‘অতএব… সমস্ত ‘ইচ্ছে’দের বিষয়ে সম্যক জ্ঞান লাভের পরে আজ ফ্যানাটিকদের হাতে তুলে দেওয়া হল এই আইন গ্রন্থ।’
ইচ্ছে? সম্যক জ্ঞান? – জুজুর মাথাটা আবার ব্যাথা করে উঠল। কী বিষয়ে কথা বলছে এই বই? কাদের ইচ্ছে?
হঠাৎ তার মনে পড়ল ড্রয়ারের ভেতরে রাখা বাক্সের উপরের আলগা কাগজগুলোর কথা। সঙ্গে সঙ্গে উঠে গিয়ে সে পুরো ড্রয়ারটাই টেনে নামিয়ে এনে মেঝেতে ছড়িয়ে বসল। তারপর ওই কাগজগুলো নাম্বার অনুযায়ী সাজিয়ে পড়তে শুরু করল। তারিখ, ভাষা ইত্যাদি দেখে জুজু বুঝতে পারল এগুলো সবই এসেছে পৃথিবী থেকে। জুজু বুঝতে পারল ওই ফ্যানাটিক আইনের বইটা বোঝার জন্য এই কাগজগুলোর পাঠোদ্ধার আগে করতে হবে। ঠিক এই সময় বাইরে মোরালিশ সাইরেনের শব্দে বুঝল ঠিক রাত বারোটা বেজেছে। মানে তার হাতে এখনও ছ’ঘণ্টা সময় আছে। সূর্যের প্রথম আলো পড়ার আগেই এই গুপ্তজ্ঞান আবিষ্কার করতেই হবে তাকে। হাতে একদম সময় নেই বেশি। সে একে একে কাগজগুলো পড়তে শুরু করল। আর তক্ষুনি মাথার ভেতরের দপদপে ব্যাথাটা চাগাড় দিল আবারও। এখানে আসার আগে এরকম ব্যাথা তার কোনওদিন হয়নি। কপালের কাটা দাগও ছিল না আগে। তাহলে কি সুকোর অনুমান ঠিক? ও একবার বলেছিল জাপানে আবিষ্কৃত একটা ‘লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা চিপ’-এর কথা যা মাথায় ইন্সটল করে দিলে যে কোনও দুর্বোধ্য ভাষার মানে বোঝা যায়। ফ্যানাটিক গ্রহেও কি এরকম কোনও অপারেশন হয়েছে জুজুর? নইলে এখানকার ভাষা সে বুঝছে কীভাবে! যাইহোক, এসব ভাবার সময় এখন নয়। মাথায় বিজবিজে ব্যাথাটা ছাড়া খুব কষ্টকর কিছু হচ্ছে না যখন, তখন কাগজের পাঠোদ্ধারে মন দেওয়া যাক।
(৭)
প্রতিটা কাগজ যেন এক একটি চিঠি। সেগুলো একে একে পড়ে যা বুঝতে পারল সে তার সারমর্ম হল এই রকম –
পৃথিবীর হিসেব অনুযায়ী এটা যদি ৩০০০ সাল হয়ে থাকে, তবে আজ থেকে প্রায় হাজার বছর আগে থেকেই ফ্যান গ্রহে এরকম চিঠি আসছে পৃথিবীবাসীর কাছ থেকে। সেই সময় ঘটেছিল নানারকম বিরুদ্ধধর্মী ঘটনা। পৃথিবীবাসীরা তখন নানা ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের উন্নতি করতে শুরু করেছে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর মাধ্যমে। কিন্তু প্রদীপের আলোর নিচেই যেমন অন্ধকারের বাস, তেমনই আধুনিক হওয়ার দৌড়ে অগ্রগামী পৃথিবীর কিছু মানুষ নিজেদের স্বার্থে বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করেই গোটা পৃথিবীকে কয়েকশো বছর পেছনের দিকে নিয়ে যাওয়ার কাজ শুরু করেছিল। তারা ধর্মান্ধতা, কুসংস্কারের বীজ ছড়িয়ে দিয়েছিল বিজ্ঞানকে হাতিয়ার করেই। উন্নতিকামী মানুষের পাশাপাশি এইসব স্বার্থান্বেষী মানুষও কিছুদিনের মধ্যেই রাজনৈতিক ক্ষমতায় বলীয়ান হয়ে বিভিন্ন দেশের প্রধান শাসকের সিংহাসনে বসে। আর তারপরেই গোটা পৃথিবী জুড়ে জন্ম হয় এক চরম অসহিষ্ণু অরাজক অবস্থার।
ভালো-মন্দ মতামত, ইতিবাচক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া, বিরুদ্ধ চিন্তা, সংস্কার-কুসংস্কার, শান্তিকামী ও যুদ্ধকামী নীতি, কুৎসা, গুজব ইত্যাদি ছড়াতে শুরু করে তারা বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে। বিভিন্ন গ্যাজেটের মাধ্যমে এই অ্যাপ্লিকেশনগুলো চালাতে মানুষ ক্লাউড প্রোগ্রামিং-এ জমাতে শুরু করে তাদের যাবতীয় তথ্য। আর এইসব তথ্যবহুল ক্লাউড মহাশূন্যের স্যাটেলাইট তরঙ্গে গিয়ে এক অদ্ভুত সাইবার স্পেসের সৃষ্টি করে। যত মানুষ বেড়েছে পৃথিবীতে ততই বেড়েছে স্থানসঙ্কট এবং সাইবার ক্রাইম। আর এই সবকিছুর প্রভাবে জন্ম নিয়েছে বিভিন্ন ইচ্ছেরা। মানুষের সেইসব ইচ্ছে-অনিচ্ছে আর ক্লাউড স্পেসে সাইবার ক্রাইমের ক্রমবর্ধমান তথ্যবৃদ্ধি সৃষ্টি করেছে এক মহাজাগতিক বিস্ফোরণ। ছোট-বড় গ্রহ, গ্রহাণু, গ্রহাণুপুঞ্জ এবং ছায়াপথের মধ্যে থাকা আরও অসংখ্য মহাজাগতিক অনুজীবের মধ্যের ক্রমাগত সংঘর্ষে সৃষ্টি হয়েছে ফ্যান-এর মতো এক অদ্ভুত গ্রহ। পৃথিবীর ধারণ ক্ষমতার বাইরে থাকা মানুষের সব রকম চাহিদা পুরণের জন্যই যেন ফ্যান গ্রহের সৃষ্টি।
যেমন, পৃথিবীর ছোটরা তখন কেরিয়ারের চাপ, আর্থ সামাজিক নানা জটিলতা–ভঙ্গুর পরিবারের নানা প্রতিবন্ধকতা ও মানসিক অবসাদ থেকে মুক্তি পেতে চেয়েছে দ্রুত বড় হয়ে যেতে, ফ্যান গ্রহে তাই কোনও ছোট বাচ্চা নেই। এই গ্রহে প্রবেশের পরেই দ্বিগুণ হারে বয়স বৃদ্ধি ঘটে।
যখন পৃথিবীর বড়দের মধ্যে কিছু নীতি পুলিশ চেয়েছে মানুষের সবকিছুর ওপর দখল নিতে, তাদের পোষাক-খাদ্যাভ্যাস-আচার-ব্যবহার-বিশ্বাস-অবিশ্বাস-প্রেম-ঘৃণা-পছন্দ-অপছন্দ-লেখা-গান-কথা বলা ইত্যাদি সবকিছুর ওপর একটা নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ পেতে চেয়েছে, ক্ষমতার শীর্ষে উঠে দম্ভ দেখাতে চেয়েছে। তাই জন্ম হয়েছে ফ্যানাটিক মোরালিশদের যারা গোটা ফ্যান গ্রহের একছত্র অধিপতি।
আবার পৃথিবীর বেশির ভাগ মেয়েরা জন্মাবধি ক্রমাগত অত্যাচার-অনাচার ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে, ধর্ষণ-পণপ্রথার শিকার হয়ে মনুষ্যেতর জীবন কাটিয়ে বারবার মুক্তি চেয়েছে, বিবাহিত দম্পতি কণ্যাভ্রূণ হত্যা করেছে পুত্র সন্তানের আকাঙ্ক্ষায়। তাই ফ্যান গ্রহ হয়েছে সম্পূর্ণ নারীশূন্য একটি গ্রহ। এখানে পুরুষের দেহ থেকেই এক বিশেষ রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় পার্থেনোজেনেসিস অথবা ক্লোনিং প্রক্রিয়ায় সমজাতীয় বংশগতি বিস্তার হচ্ছে। যদিও তাদের বংশগতির স্থায়িত্ব নিয়ে এখনও নির্ভরযোগ্য কোনও প্রমাণ তাদের কাছে নেই, তবে বিজ্ঞানচর্চায় যেভাবে ফ্যান গ্রহের উন্নতি হচ্ছে তাতে ফ্যানাটিকরা সমস্ত সৌরজগতের ভবিষ্যৎ শাসক হবে বলে বেশ আশাবাদী।
যে পৃথিবী একসময় সুজলা সুফলা ছিল, মানুষের অত্যাচার আর লোভের শিকার হয়ে যেই পৃথিবীতেই জল আর অক্সিজেনের আকাল শুরু হয়েছিল। সেই হাহাকারের পরিনতিতে ফ্যান গ্রহে জল আর অক্সিজেন মহা মূল্যবান দ্রব্য।
এইখানেই জুজুর মনের খটকা আবার বেড়ে গেল। বাকি পয়েন্টগুলো তবু মানা যায় কিন্তু জলের ব্যাপারটা বড্ড গোলমেলে। এখানে বৃষ্টি সঞ্চিত জলের স্বাদ সে নিয়েছে, সেই জল মোটেই সুস্বাদু মিষ্টি জল নয়, বরং কষাটে স্বাদের। কিন্তু তাদেরকে যে জল দেওয়া হয় তা কি শুধুই ফিল্টার করা এই বৃষ্টির জলই?
মাথার মধ্যে ক্রমাগত বিপবিপ শব্দটা বাড়ছে, আর তত কপালের ওই কাটা জায়গায় লালচে ভাব ফুটে উঠছে। তারমানে সুকোর অনুমান সত্যি। এখানে আনার পরেই তাদের মাথায় কিছু একটা ‘ফরেন বডি’ ইন্সটল করা হয়েছে। কাগজগুলো পড়া শেষ হলে বইটা খুলে সে দেখল তাতে কেবলই নানা নিয়ম ও নিয়ম ভাঙার ভয়াবহ শাস্তির বর্ণনা।
বইটার শেষের দিকে সে জানতে পারল ফ্যানাটিকদের আরেক কালো দিক। তার এতক্ষণের খটকা এবার একটু একটু করে পরিষ্কার হল। যেহেতু এটি একটি বরফগ্রহ, তাই এখানে গাছপালা, ফসল ইত্যাদি নেই। আর স্বাভাবিক বাস্তুতন্ত্র বলতে পৃথিবীর লোকেরা যা বোঝে তার কিছুই এই গ্রহে গড়ে উঠতে পারে নি। ফলে এখানে জলবায়ু বড্ড রুক্ষ প্রকৃতির। পৃথিবীর মানুষের পক্ষে এখানে বাস করা সম্ভব না। আর তাই প্রথম দিকে তারা পৃথিবী থেকেই মানুষ চুরি করে এখানে আনত। তাদের বানানো ছোট ছোট রকেট পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢুকে সোজা কোনও জলাশয়ে নেমে পরিবর্তিত হত সাবমেরিনে। আর যে কোনও নিরীহ মানুষ তাদের নাগালের মধ্যে এলেই বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে তাদের সাবমেরিনে ঢুকিয়ে দেওয়া হত। শুধু যে মানুষ চুরিই করত তাই না, পৃথিবী থেকে ফ্যানাটিকরা জলও চুরি করে আনত। আর এইকাজে তাদের সাহায্য করত পৃথিবীরই কিছু মানুষ!
পৃথিবী থেকে আনা সেইসব জল একটু একটু করে বিভিন্ন স্তর বিন্যাসের মাধ্যমে আপার-মিডল ও লোয়ার ফ্যানাটিকদের মধ্যে ভাগ করা হত।
বইটা শেষ করে জুজু স্পষ্ট বুঝতে পারল উত্তেজনায় তার বুকের ঢিপঢিপ শব্দ দশ গুণ বেড়ে গেছে, তার নিজের কানেই সেই শব্দ দামামার মতো লাগছে। এবার বুঝি বাইরে থেকে মোরালিশরাও শুনতে পাবে। বাইরে শেষ রাতের অস্পষ্ট আলো আঁধারি। ভোর হতে এখনও ঘণ্টাখানেক দেরি আছে। কিন্তু ফ্যানাটিকদের এমন ভয়াবহ কারসাজির কথা পৃথিবীবাসীর কাছে না জানালে তো ক্ষতি হবে আরও অনেক বেশি। পৃথিবীতে থাকার সময় জুজুর জীবনটা যে খুব সুন্দর ছিল তা নয়। মন খারাপ, হতাশা, বন্ধুদের মধ্যে ঝামেলা, পরীক্ষার ভয় ইত্যাদি অসুন্দরের পাশাপাশি মন ভালো করা গান ছিল, ফুল পাখি ছিল, বাবা-মায়ের শাসনের পাশাপাশি তাঁদের নিখাদ ভালোবাসাও তো ছিল। এখানে ফ্যানাটিকদের যেমন কান্না নেই, তেমন হাসিও তো নেই। ভাবতে ভাবতে তার আবারও মাথার ভেতরটা দপদপ করে উঠল। নাহ, আর নয়, যে করেই হোক পালাতে হবে এই গ্রহ থেকে। কালকের জন্য বসে থাকলে চলবে না। না জানি কাল কী শাস্তি তার জন্য বেছে নিয়েছে এরা।
বই আর কাগজগুলোকে আবার ড্রয়ারের মধ্যে রেখে প্যাক্সির কাছে এল জুজু। প্যাক্সি তখনো ঘুমাচ্ছে। জুজু তাকে ধাক্কা দিয়ে জাগাল, তারপর সব কথা বলতে গিয়েও থমকে গেল। বাইরে যেন কিসের শব্দ!
(৮)
ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই। উড়ন্ত ড্রোনেদের কাজ শুরু হয়ে গেছে এর মধ্যেই। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এই রোবোটিক জগৎ জেগে উঠবে। ল্যাবের কন্ট্রোল রুমের বাইরে বেরোতে গিয়েও পারল না জুজু। তার ট্যাটু কিছুতেই ‘অ্যাক্সেস গ্রান্ট’ করছে না স্ক্যানারে। প্যাক্সিও চেষ্টা করল। কিন্তু নাহ, ড্রয়ারের অ্যাক্সেস পাওয়া গেলেও দরজার কোড কিছুতেই খুলল না। এদিকে রুমের মধ্যে লুকিয়ে থাকার কোনও জায়গা নেই। ভোরের আলো পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই একে একে ল্যাবের সমস্ত আলো জ্বলে উঠল, স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রাংশগুলো ঘটাং ঘটাং করে অন হল। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের কাজকর্ম চালু হবে।
ঠিক সেই মূহুর্তে ভারী পায়ের শব্দ পাওয়া গেল দরজার বাইরে। প্যাক্সির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। কোনওরকমে ফিস ফিস করে বলল, “খুব খিদে পেয়েছে জুজু। তুই যে কী বলছিলিস…”
জুজু বুঝল বিপদ আসন্ন। ইশারায় প্যাক্সিকে তার গায়ে সেঁটে সেঁটে চলার নির্দেশ দিল। একটা প্ল্যান মাথায় এসেছে, কিন্তু আরেকজন সাহায্যকারী না পেলে এখান থেকে বেরোনো সম্ভব হবে না। ভাবতে ভাবতেই দরজা খুলে গেল এবং তিন জন মুখোশধারী এসে তাদের সঙ্গে চলার নির্দেশ দিল।
ওদের সঙ্গে চলতে চলতে হঠাৎ প্যাক্সি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল “আচ্ছা এরা আমাদের হাত বাঁধেনি কেন রে?” জুজুও ব্যাপারটা খেয়াল করে বেশ অবাকই হল। পৃথিবীর সঙ্গে এদের আদব কায়দায় সত্যিই কোনও মিল নেই। এখন শাস্তির কঠোরতা কেমন সেটাই দেখার। প্যাক্সি আবার মৃদু স্বরে বলল, “গুনগুন করার জন্য খুব বেশি কঠিন সাজা দেবে না, বল!” মুখোশধারীরা ওদের কথা বুঝতে পারছে কি না বোঝা গেল না, কারণ রিমোট চালিতের মতো ঋজু ভঙ্গিতে সবার পায়ের তালে তাল মিলিয়ে চলছে ওরা।
ক্রমে ল্যাবের বাইরের দিকের একটা ডিম্বাকার ডর্মে আনা হল তাদের। এখানে কী হয় ওরা জানে না। জুজু কোনওদিন এইদিকে আসার সুযোগ পায়নি। কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী এখানে। মোট তিনটে নিরাপত্তা বলয় পার হয়ে তবে ভেতরে ঢোকা যায়।
বডি চেকিং-এর শেষ ধাপের পরে ওদের দু’জনকে অন্য দুই নিরাপত্তা কর্মীর সঙ্গে ভেতরে যেতে বলা হল। জুজু অবাক হয়ে ভেতরটা দেখছে, রাশি রাশি ছোট বড় মেশিন, রকেট, স্পেসকার আর সাবমেরিন রাখা আছে ভেতরের প্যাভিলিয়নে। তার মানে ওদের যেসব সাবমেরিনে করে পৃথিবী থেকে আনা হয়েছিল সেগুলো এই ডর্ম থেকেই পাঠানো হয়। এরপর ওদের দুজনকে একটা ঘর দেখিয়ে ভেতরে যেতে বলা হল।
ট্যাটু স্ক্যান করিয়ে সেই ঘরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই একটা পরিচিত শিস শুনতে পেল ওরা। ঘরের ভেতরে মাস্ক খুলে ঢুকতে হল। ভেতরে কোনও জানলা নেই, ফলে সূর্যের আলো প্রবেশের কোনও সুযোগ নেই। হালকা সবুজ আলো জ্বলছে। তবু তার মধ্যেই ওরা স্পষ্ট দেখতে পেল ওকে – সুকো! আরে এ যে তাদের জাপানি বন্ধু সুকো।
জুজু ভীষণ অবাক হয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই সুকো ওদের ইশারায় এক পাশে টেনে নিয়ে গেল। তারপর হাত তুলে উপরের দিকে দেখাতেই জুজু দেখল একটা স্পাইক্যামেরা গোটা ঘরের নজরদারি করছে। সুকোর ইশারা মতোই পাশের বাথরুমে তারা ঢুকল। তারপর খুব দ্রুত এবং সংক্ষেপে জুজু খুলে বলল সবকিছু। শুনতে শুনতে প্যাক্সির মুখ ভয়ে বিস্ময়ে রক্তশূন্য হয়ে গেল। তারপর সুকোর কাছে যা জানল তা আরও ভয়ংকর।
জুজু আর প্যাক্সিকে এখন অবস্কুরান্ট রুমে নিয়ে যাওয়া হবে। জুজু এমন রুমের কথা শোনেইনি, তবে প্যাক্সি এটার নাম শুনেই আঁতকে উঠল। ইউনিট ফোর-এ ল্যাভেটরিতে কাজ করার সময় এক সহকর্মীর কাছে অবস্কুরান্ট রুমের কথা শুনেছে সে। এ হল ফ্যানাটিক হওয়ার শেষ এবং কঠিনতম ধাপ। এই অবস্কুরান্ট রুমে ইলেকট্রিক শক থেরাপির মাধ্যমে মস্তিষ্কের সমস্ত কোষ থেকে পুরানো সব স্মৃতি মুছে ফেলে ফ্যানাটিক প্রোগ্রামিং দিয়ে মস্তিষ্ককে ‘গ্রুমড’ করা হয়। ফলে এই পরীক্ষা থেকে সফল হয়ে আসা ব্যক্তি সম্পূর্ণরূপে এলিট ফ্যানাটিক হিসেবে পরিচিতি পায়। তবে সবাইকে এই পরীক্ষা দিতে হয় না। যেসব নবাগতরা ভাগ্যক্রমে দু-বছরের প্রভিশনাল পিরিয়ডের সব কাজ বিনা প্রশ্নে, অনুগত হয়ে পার করে ফেলে এবং স্বেচ্ছায় সব ফ্যানাটিক আদর্শ মেনে চলে, যাদের আচারণে দীর্ঘ দু-বছর কোনও ভুল রেকর্ড পাওয়া যায় না, তাদের ছাড় দেওয়া হয় এই কঠিন পরীক্ষা থেকে।
জুজু বুঝল প্যাক্সির আশঙ্কা অমূলক নয়। অবস্কুরান্ট রুমে তার মানে পৃথিবীর সব সুখস্মৃতি সে হারিয়ে ফেলবে! ভুলে যাবে তার মায়ের মুখ, তার বন্ধুদের কথা! না না না, কিছুতেই সে এই শাস্তি মেনে নেবে না। কাল রাতেই সে নিয়মের বইয়ে দেখেছে ফ্যানাটিকদের সব রকম মানবিক গুণাবলী বিসর্জন দিতে হয়। এই গ্রহে গান, কবিতা, আঁকা, নাচ অথবা ফুল পাখি ভালোবাসাও অমার্জনীয় পাপ। কিন্তু জুজু এসব ছাড়া থাকবে কি করে! নাহ পালাবেই সে এখান থেকে। প্যাক্সি ও সুকোর সঙ্গে চট করে একটা ফন্দি আঁটল সে।
(৯)
ফ্যানাটিকদের দেওয়া ট্যাবলেট খেয়ে নির্ধারিত পোষাক পরে তারা দুজন উপস্থিত হল অবস্কুরান্ট রুমে। অপারেশন টেবিলের মতো একটা জায়গায় তুলে দিয়ে তাদের মাথায় পরানো হল একটা অদ্ভুত হেলমেট। সেটায় প্রচুর সরু সরু তার আর ছোট ছোট বাল্ব যুক্ত আছে। ডাক্তারের মতো সাদা গাউন পরা দুজন ফ্যানাটিক ছাড়া আর কেউ নেই। এই দুজনই বড় অদ্ভুত আকৃতির। একজন খুব বেঁটে অন্যজন বেশ লম্বা। একজনের মাথা সূঁচালো আর অন্যজনের মাথা প্রকাণ্ড হাতির মতো। হাতির মতো মাথাওলা লোকটা মনিটরে কি সব প্রোগ্রাম সেট করে জুজুর দিকে তাকাল। তারপর মাস্কটা খুলে হাতে একটা ইনজেকশন নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসতেই জুজু ভীষণ চমকে গিয়ে বলে ফেলল, “আরে এতো কুমড়োপটাশ!” প্যাক্সি এতক্ষণ ভয়ে বেশ গুটিয়ে ছিল, সে কুমড়োপটাশ কী বস্তু তা জানে না। তবে জুজুর স্বরে কুমড়োপটাশ যখন থমকে গিয়ে কুলোর মতো খাড়া কান আর হাতির মতো কুতকুতে লাল চোখ বের করে দেখতে লাগল তখন তার চেহারা দেখে প্যাক্সির বেদম হাসি পেল।
অবস্কুরান্ট রুমের ভীষণ শাস্তির মধ্যে, সুকুমার রায়ের সব ক’টা অদ্ভুতুড়ে জীব এখানে দিব্যি হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে – এই দৃশ্যটা মনে করেই জুজুর বেশ হাসি পেল! তারপর হঠাৎই তার মনে পড়ে গেল গত রাতের বইয়ে লেখা কিছু কথা। ফ্যান গ্রহের সৃষ্টিই হয়েছে মানুষের কল্পনা জগৎ দিয়ে। যেসব জিনিস মানুষের পৃথিবীতে বাস্তবায়িত হতে পারেনি, কেবল গল্প বা গবেষণায় থেকে গেছে তারাই সব ফ্যানাটিক হয়ে এই গ্রহে দিব্যি বেঁচে আছে। জুজু এবার বুঝল পুকুর পাড়ে সেদিন দেখা বকচ্ছপ তার মানে যাদুঘর থেকে পালিয়ে আসেনি; সে এই গ্রহেরই একজন ফ্যানাটিক। সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা ব্যাপারও তার মনে এল, মোরালিশ নামের যেসব নীতি পুলিশ এই গ্রহের রাজা তাদের কেউ সচরাচর দেখতে পায় না। এই বিদঘুটে প্রাণীরাই মোরালিশ নয় তো!
এসব ভাবনার মধ্যেই সুঁচালো মাথাওয়ালা লোকটা জুজু আর প্যাক্সির মাথার হেলমেটগুলো একটা তার দিয়ে জুড়ে দিল। প্যাক্সি একবার ব্লগব্লগ করে কি সব বলার চেষ্টা করল। তবে জুজু কিছুই বুঝতে পারল না।
এদিকে মেশিন থেকে চিঁইইই শব্দে খুব তীক্ষ্ণ শব্দ বের হতেই জুজু তাদের ফন্দি অনুযায়ী মনে মনে দশ থেকে এক অবধি উলটো গুনতে শুরু করল। যেই তিন অবধি গুনেছে অমনি দুম করে একটা শব্দের সঙ্গে সঙ্গেই লোডশেডিং হয়ে গেল। ঘরের সমস্ত যন্ত্রপাতি একসঙ্গে নিবে গেল। দুই অদ্ভুতুড়ে ফ্যানাটিক হতভম্ভের মতো দাঁড়িয়ে আছে দেখে জুজু এক লাফে তার হেলমেট খুলে ফেলল। তারপর সমস্ত তার, মেশিন আর মনিটরগুলোয় লাথি মেরে ফেলে দিয়ে প্যাক্সিকে নিয়ে পেছনের দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল। এই ল্যাবে লোডশেডিং পঞ্চান্ন সেকেন্ডের বেশি স্থায়ী হয় না। তারপরেই সমস্ত ক্যামেরা, স্ক্যানার, ড্রোন ইত্যাদিসহ পুরো সিস্টেমটাই স্বয়ংক্রিয় হয়ে সচল হবে আবার। তাই হাতে তাদের একদম সময় নেই। ওরা উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটতে ছুটতে পেছনের দিকের একটা সুড়ঙ্গের মধ্যে নেমে গেল। এই সুড়ঙ্গটি বেশ বড়, দৌড়াতে দৌড়াতেই জুজু খেয়াল করল প্যাক্সি বেশ চুপচাপ হয়ে গেছে। সে ছুটছে ঠিকই তবে মুখের মধ্যে নেই কোনও মুক্তির আনন্দ।
সুকো তাদের অপেক্ষায় লুকিয়ে ছিল টানেলের শেষে। এই পুরো ব্ল্যাক আউটের নেপথ্যে আছে তাদের পরম বন্ধু সুকোই। বাড়ি ফেরার তাড়া আছে তারও।
অনেকটা দৌড়ে, কিছুটা পা হড়কে শেষমেশ যেখানে তারা এসে পড়ল, সেখানে সুকো দাঁড়িয়েছিল হাতে স্টপ ওয়াচ নিয়ে। জুজু আর প্যাক্সিকে বেরিয়ে আসতে দেখেই বলল “নাইনটিন সেকেন্ড লেফট, হারি আপ!” প্যাক্সি এতটা রাস্তা কোনওদিন দৌড়ায়নি। প্রচণ্ড হাঁপাচ্ছে সে। জুজু তাড়া দিল। সামনে একটা সাবমেরিনের মতো দেখতে স্পেসকার রাখা আছে, যেটা জলে স্থলে ও অন্তরীক্ষে সমান গতিতে ছুটতে পারে। ওটার মুখটা এখন খোলা কারণ পাওয়ার অফ; কিন্তু লোডশেডিং শেষ হয়ে পাওয়ার এসে গেলেই সেটার দরজা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাবে আর রকেট গতিতে সেই স্পেসকার ছুটতে শুরু করবে পৃথিবীর দিকে।
মুক্তির কাছাকাছি এসে জুজুর বুকের ভেতরের লাব-ডুব শব্দটা যেন অকস্মাৎ থমকে গেল। প্যাক্সির হাত ধরে টান দিতেই বুঝল সে হাত ছাড়িয়ে নিয়েছে। জুজু ভীষণ অবাক হয়ে তাকাতে সে বলল, “আমি আর পারছি না জুজু। তুই যা। আমার এখানে থাকাই ভালো।”
প্যাক্সি কি পাগল হয়ে গেছে আনন্দের উত্তেজনায়! জুজু ধমক দিয়ে বলল, “কী আবোল তাবোল বকছিস! যা বলার যেতে যেতে বলিস, পৃথিবী পৌঁছাতে অনেক দেরি আছে। কিন্তু এখন একদম সময় নেই প্যাক্সি।”
সুকো তাড়া লাগাল “হারি আপ জুজু! অনলি ইলেভেন সেকেন্ড লেফট!”
জুজু প্যাক্সির দিকে তাকাতেই সে হাত নেড়ে বলল, “তুই সেদিন জানতে চেয়েছিলি না, আমি কেমন করে এই গ্রহে এলাম। আজ এটুকু জেনে রাখ, এই গ্রহে আমি আমার বাবার জন্য এসেছি। চাঁদসহ নানা গ্রহ-উপগ্রহে যেদিন থেকে জমি কেনা শুরু হয়েছে, আমার বাবা প্রায় পাগল হয়ে উঠেছিল। জানি না কোথা থেকে খবর পেয়ে বাবা এই ফ্যান গ্রহে জায়গা কিনেছিল। এখন বুঝছি জল মাফিয়াদের সঙ্গেই কারবার করত বাবা। তাই তো রাতারাতি এত টাকা হয়েছিল আমাদের। তুই জানিস না, আমার বাবা কী ভীষণ কড়া ধর্মান্ধ লোক! ক্ষমতা আর উচ্চাকাঙ্ক্ষার লোভে বাবা গিনিপিগের মতো ব্যবহার করেছে আমায়। এই গ্রহে মোরালিশদের হাতে জিম্মা করে পাঠানো হয়েছে আমায়, তা এতদিনে বুঝেছি। এই গ্রহ ওর জন্য আদর্শ কিনা সেটা আমাকে দিয়েই পরীক্ষা হবে। আমি জানি পৃথিবীতে বাবা খুব বেশিদিন থাকবে না, এই ফ্যান গ্রহেই আসবে খুব তাড়াতাড়ি। বাবার বাড়িতে আমি ফিরতে চাই না জুজু। শুধু আমার মাকে একবার খবর দিস; বলিস ‘আমি ফিরতে চাই না, ফ্যানাটিক হয়ে দিব্যি ভালো আছি’। জুজু আর দেরি নয়, তুই যা। আমি এদের সামলে নেব, বাবার রেফারেন্স দিলে নিশ্চয় বুঝবে এরা। তুই পালা জুজু, আর সময় নেই।” এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে প্যাক্সি উলটো পথে দৌড়াল।
জুজুকে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুকো তাড়াতাড়ি ওকে টেনে নিয়ে স্পেসকারের দিকে ছুটল। ওদিকে তখন পাওয়ার সাপ্লাই চালু হয়ে গেছে। স্পেসকারে রোবোটিক স্বরে কাউন্টডাউন হচ্ছে – ফোর… থ্রি… টু… ওয়ান…
(১০)
কয়েক মিলিসেকেন্ড বাদে যখন তাদের স্পেসকার ফ্যান গ্রহের সীমানা ছাড়িয়ে মহাশূন্যে ভুস করে ভেসে উঠল তখন তাদের চারপাশে চাপচাপ অন্ধকার। সুকো দু’হাত তুলে “ইয়োওও…!” বলে আনন্দে নাচতে শুরু করেছে। কিন্তু জুজুর তখনো ঘোর কাটেনি। প্যাক্সির শেষ কথাগুলো সে আত্মস্থ করার চেষ্টা করছে। যে ছেলেটা স্কুলের শেষ বেঞ্চে গোমড়া মুখে বসত, তার বুকের ভেতর যে এতখানি কষ্ট জমে আছে বন্ধু হিসেবে জুজু একটুও বুঝতে পারেনি! অবশ্য অত কষ্টের মধ্যেও যে প্যাক্সির এত বড় একটা মন আছে, তা-ই বা সে বুঝল কবে!
রাত এখন কত কে জানে! সুকো হিসেব করে বলল, ফ্যান গ্রহ থেকে তারা পাঁচশো সত্তর মাইল দূরে চলে এসেছে। সুতরাং ফ্যানাটিকদের হাতে ধরা পড়ার ভয় আর নেই। সুকো বেশ হাসিখুশি এক ছেলে। ফ্যান গ্রহে খুব বেশি কথা বলার সুযোগ হয়নি। তবে এবার ওর সঙ্গে খুব ভালো করে আলাপ করতে হবে। জুজুর হাতে এখন অনেক সময়। স্টক চেম্বারে থাকা জল আর ফুডলসের প্যাকেট নিয়ে মুখোমুখি বসল ওরা দুজন। সুকোর গল্পটা এবার মন দিয়ে শুনতে হবে। বাড়ি ফিরে তো মাকে জানাতে হবে ফ্যান গ্রহ তার একটা স্কুলের বন্ধুকে কেড়ে নিলেও অন্য একটা জাপানি বন্ধুকে ফিরিয়ে দিয়েছে।
অবশ্য পৃথিবীতে ফিরে তার সবচেয়ে বড় কাজটি হল, তার মাথার একটা স্ক্যান করানো। পৃথিবী থেকে তার সন্ধান দেওয়া কোনও সিগন্যাল যেন ফ্যানাটিকদের কাছে না পৌঁছায়। তারপর বাবার সাংবাদিক বন্ধুদের মাধ্যমে সরকারের কাছে ফ্যান গ্রহ এবং পৃথিবীতে তাদের পাঠানো সাবমেরিনের খবর দিতে হবে। পৃথিবীর জল মাফিয়ারা যে ভিন গ্রহেও তাদের জাল পেতেছে মোরালিশদের মতো অদ্ভুতুড়ে সব জীবের মাধ্যমে, সেই খবরটাও তো ভাইরাল হওয়া দরকার।
ফুডলসের দানা চেবাতে চেবাতে বাইরের কালো আকাশের দিকে তাকালো জুজু। চারপাশে মিটমিটে কিছু আলোক মালা আর নাম গোত্রহীন বিচিত্র সব নক্ষত্র ও গ্রহাণুপুঞ্জদের ভিড়।
তাদের মাঝে অটোপাইলটে চলা ফ্যানাটিক স্পেসকার এখন দ্রুত গতিতে পৃথিবীর দিকে ছুটে চলেছে।
Tags: ইন্টারনেট, কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, সরিতা আহমেদ
মোটামুটি ভালোই। কিশোর কল্পগল্প, এডভেঞ্চার টাইপ। প্লটটা ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারিনি। আরেকবার পড়লে হয়তো কিছু বিষয় ক্লিয়ার হবে।
বেশ কিছু নতুন নতুন টার্ম এসেছে, কল্পগল্পের ক্ষেত্রে যা খুব আকর্ষণীয়, এই ব্যাপারটা ভালো লেগেছে।
শুভকামনা রইল।
দারুণ লাগল
ভালো লাগলো, মেইন থিমটা ইন্টারেস্টিং, আরো একটু ইলাবোরেট করা গেলে ভালো হতো আরো ।