ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ‘দানব’ এর বিবর্তন
লেখক: দেবজ্যোতি গুহ
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য (চিত্রচোর)
“I saw the dull yellow eye of the creature open; it breathed hard, and a convulsive motion agitated its limbs.”
লন্ডন – ১৮১৮ সালের ১লা জানুয়ারী, প্রকাশ পেল এক নামহীন রচয়িতার উপন্যাস – “Frankenstein Or, The Modern Prometheus”; যা কিনা প্রখ্যাত সায়েন্স ফিকশন লেখক Brian Aldiss এর মতে প্রথম প্রকৃত সায়েন্স ফিকশন গল্প। এই রচনা প্রকাশ পেয়েছিল খুবই ছোট প্রকাশনা Lackington, Hughes, Harding, Mavor, & Jones থেকে, মাত্র ৫০০ কপি।
গত দুই শতাব্দী ধরে ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন এবং তাঁর তৈরি ‘দানব’ নানা রূপে প্রকাশিত হয়ে আসছে সিনেমা, টিভি, নাটক, বই, কার্টুন এবং কমিক্সের পাতায়। সারা বিশ্বে সাহিত্যে সৃষ্ট উল্লেখযোগ্য প্রথম ১০টি চরিত্রের মধ্যে অন্যতম ধরা হয় ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ‘দানবকে’।
১৮২২ সালের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশের আগে খুব কম জনই জানতেন এর রচয়িতা মেরি শেলী । কিন্তু ১৮১৮ এবং ১৮২২ – এই দুই সংস্করণেই কোন ছবি দেখা যায়নি। লেখিকার বর্ণনা পড়েই পাঠক এবং ভক্তদের তাদের মনের আয়নাতেই কল্পনা করে নিতে হয় ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ‘দানবকে’ (ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের জবানীতে) – ৮ ফুট লম্বা, হলদে চোখ এবং পাতলা চামড়ার আবরণ ভেদ করে পেশীকোষ এবং রক্তনালী ফুটে উঠছে।
১৮২৩ সালে English Opera House এ মঞ্চস্থ হয় তিন অঙ্কের নাটক “Presumption; or, the Fate of Frankenstein” । তৎকালীন পেশাদার মঞ্চ-অভিনেতা Thomas Cooke অভিনয় করেন নামহীন ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ‘দানবের’ ভূমিকায়। স্বয়ং মেরী শেলী এই নাটক দেখেন এবং Thomas Cooke এর অভিনয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেন, “Frankenstein had prodigious success as a drama & was about to be repeated for the 23rd night at the English opera house. The play bill amused me extremely, for in the list of dramatis personæ came, ——— [i.e., the Creature] by Mr. T. Cooke: this nameless mode of naming the un{n}ameable is rather good.”; “The story is not well managed— but Cooke played ———’s part extremely well—his seeking as it were for support—his trying to grasp at the sounds he heard—all indeed he does was well imagined & executed.”এই প্রথম সকলের সাথে চাক্ষুষ পরিচয় ঘটে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ‘দানবের’ সাথে।
নাটকটি অসাধারণ সাফল্য লাভ করে এবং দ্রুত আরও বড় মঞ্চে স্থানান্তারিত করা হয়। বছর শেষের আগেই পাঁচটি ভিন্ন সংস্করণ – একটি প্যারডি সহ,মঞ্চস্থ হয়। পরের তিন বছরে, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও আমেরিকা মিলিয়ে প্রায় ১৪টি নাটকের প্রোডাকশন মঞ্চস্থ হয়। ১৮২৩ সালে এই নাটকের সাফল্যের সাথে সাথে আরও কিছু নাটক মঞ্চস্থ হয় ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ‘দানবকে’ নিয়ে, যদিও সব কটা সমান সাফল্য লাভ করেনি।
১৮২৬ সালেপ্যারিসে “Le Monstre et le magician” নাটকে Thomas Cooke আবার অভিনয় করেন এবং উল্লেখযোগ্য ব্যাপার এই নাটকে ওনার মেকআপে মুখে সবুজ রঙ প্রয়োগ করা হয়, যা আর এক শতাব্দী পরে এই চরিত্রের প্রায় সিগ্নেচার মেকআপ হয়ে দাঁড়ায়।
১৮২৭ সালে আবার নাটকটি মঞ্চস্থ হয় এবং এবারে Richard John O. Smith অভিনয়করেন “দানবের” ভূমিকায়। যদিও আগের নাটকটির মতন এটি অতটা জনপ্রিয় হয়নি।
১৮৩১ এর বইয়ের তৃতীয় সংস্করণে, বইয়ের মুখবন্ধতে Theodor von Holst এর আঁকা ছবিতে প্রথম উপন্যাসের ইলাস্ট্রেটেড সংস্করণ প্রকাশ পায়।
এর পরবর্তী সমস্ত উপন্যাসের সংস্করণেই “দানবের” ছবি ছাপা হতে থাকে। খেয়াল করার বিষয় যে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ‘দানবের’ চেহারা কিন্তু সেরকম ভয়াল দর্শন নয়, যা আমরা পরবর্তী কালে দেখতে অভ্যস্ত, বরঞ্চ এখনো তা শুধু আয়তনে বড় কিন্তু কিম্ভুত দর্শন নয়।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগের আগেই ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন এবং তার ‘দানব’ প্রাত্যহিক ব্যাবহারের কথার মধ্যে ঢুকে পরে। কোন উচ্চাকাঙ্খা এবং তার করুণ পরিসমাপ্তি বোঝাতে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ‘দানব’ প্রায় নিত্যদিনের কথায় ব্যবহৃত হতে থাকে। কার্টুনিস্টরা এই সময়ের রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ এবং হুমড়ি খেয়ে পড়াকে ব্যবহার করেছেন ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ‘দানবের’ সাথে তুলনা করে।
১৯১০ সালে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ‘দানবের’ প্রথম প্রকাশ ঘটে ছায়াছবির জগতে। Edison Studios এর ফিল্ম Frankenstein এ Charles Ogle অভিনয় করেন দানবের ভূমিকায়।
১৯৩৪ সালে প্রকাশ পায় বিখ্যাত উডকাট আর্টিস্ট Lynd Ward এর আঁকা উপন্যাসের সংস্করণ। এখানেও কিন্তু শিল্পী ‘দানবের’ বেশ সহানুভূতিশীল চিত্রণ করেছেন।
কিন্তু এর মধ্যে ১৯৩১ সালে মুক্তি পেয়েছে Universal Pictures এর James Whale পরিচালিত এবং Boris Karloff অভিনীত Frankenstein সিনেমাটি। এই সিনেমাটি ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ‘দানবের’ চেহারা আগামি ৬০ বছর ধরে কেমন হবে তা যেন ঠিক করে দেয়, এর পরের দশকগুলিতে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ‘দানবের’ চেহারা এবং মেকআপ সিনেমাতে তৈরি হতে থাকে Boris Karloff এর মেকআপ আর অভিব্যক্তির অনুকরণে।
১৯৩৯ সালে কমিক্সে আত্ম-প্রকাশ ঘটে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ‘দানবের’, DC Comics এর Movie Comics no. 1 (April 1939)। এখানেও সেই Boris Karloff অনুপ্রানিত ‘দানবের’ ছবি আঁকা হয়েছে। কমিক্সের এই গল্পটি অবশ্য ১৯৩৯ এ রিলিজ হওয়া Son of Frankenstein সিনেমার গল্প।
১৯৪৫ এ Classics Illustrated কমিক্স no. 26 এ মেরী শেলীর উপন্যাসকেই চিত্ররূপ দেওয়া হয়। যদিও Boris Karloff এর ছায়া এরমধ্যে কম দেখা যায়।
৪০, ৫০ এবং ৬০ এর দশকের সিনেমা এবং প্রকাশিত কমিক্সগুলি মুলত ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ‘দানবকে’ Boris Karloff এর ছায়ায় পরিবেশন করতে থাকে, এবং বাজারে ছেয়ে যায় Karloff অনুপ্রানিত ‘দানবের’ খেলনা, অ্যাকশান ফিগার, বোর্ড গেম ইত্যাদিতে। এরই মধ্যে সিনেমাতে ‘দানব’ তার নিজস্ব কণ্ঠস্বর লাভ করে, পড়াশোনা করতে শেখে এবং বিবাহও করে।
১৯৭৩ এ Andy Warhol প্রযোজিত Flesh for Frankenstein এক নতুন ‘দানবের’ চেহারা দর্শকের সামনে আনে, Srdjan Zelenovic অভিনয় করা ‘দানবকে’ এখনো অবধি বলা হয় সবচেয়ে হ্যান্ডসাম ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ‘দানব’।
উল্লেখযোগ্য এই সময়েই মুক্তি পায় blaxploitation ছবি Blackenstein প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ‘দানব’।
১৯৮৩ তে আঁকা Bernie Wrightson কমিক্স ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন এ আবার অনেক দিন বাদে এক নতুন চেহারার ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ‘দানবকে’ দেখা যায়, এর চেহারার সাথে যেন মেরী শেলীর উপন্যাসের বর্ণিত চরিত্রটি যেন পুরো মিলে যায়।
৮০র দশকের শেষ ভাগে অভীক চিত্রকথা থেকে প্রকাশিত কমিক্স ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন এ কিন্তু এইদিকে সেই পুরনো Boris Karloff এর ছায়াই পাওয়া যায়।
১৯৯৪ তে রিলিজ হওয়া Mary Shelley’s Frankenstein এ আবার নতুন করে সিনেমাতে ভাবতে শুরু করায় দানবকে নিয়ে, Kenneth Branagh পরিচালিত এবং Robert De Niro অভিনীত ছবিটি তথাকথিত হিট ছবি না হলেও এর বাইরে বেরিয়ে নতুন আঙ্গিকে ‘দানবের’ রূপায়ন দর্শককে ভাবায়।
২০১১ তে National Theatre, লন্ডনে Danny Boyle র পরিচালনায় নতুন আঙ্গিকে থিয়েটারে Frankenstein পরিবেশন করে। মুখ্য অভিনেতা Jonny Lee Miller এবং Benedict Cumberbatch দুজনেই একই নাটকে রোল পাল্টাপাল্টি করে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন এবং ‘দানব’ চরিত্রে অভিনয় করেন।
২০১৮ সালে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ২০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে Restless Books এক নতুন সংস্করণ প্রকাশ করতে চলেছে, মেক্সিকান আর্টিস্ট Eko র আঁকা নতুন ছবি সুদ্ধু।
ফ্রাঙ্কেন্সটাইন এর দানব এর ছায়া সাহিত্য, শিল্পের বিভিন্ন উপাদানে এইভাবে ছেয়ে আছে গত প্রায় ২০০ বছর, বাণিজ্যিক ফ্রাঞ্চাইসিগুলোর এক সার্থক কাঁচামাল হয়ে। এর পেছনে হয়তো আমাদেরই মনের গহীনে লুকিয়ে থাকা কোন অল্টার ইগো দায়ী। আমরা ভয় পেতে ভালোবাসি অনেক সময়। যে ভয় অজানার আবছায়ার মাঝে দেখা দেয় দুঃস্বপ্নের গভীরে।
তথ্যসূত্রঃ
- Wikipedia
- The New Annotated Frankenstein – Leslie Klinger (editor); W.W. Norton & Co.
- Frankensteinia – The Frankenstein Blog (https://frankensteinia.blogspot.in/)
- The Strange and Twisted Life of “Frankenstein” – Jill Lepore; The New Yorker, February 12 & 19, 2018
একটা বড়ো ক্যানভাসে বিস্তৃত ফ্রাঞ্চাইসিটা তুলে এনেছে এই রচনা। দুশো বছর আগের সেই ছায়া শরীরকে ঘিরে বিস্তৃত বর্ণালী সার্থকভাবে ফিরে দেখা।
চমৎকার তথ্যপূর্ণ দৃষ্টিসুখ নিবন্ধ। দারুণ!
১৯৫০/৬০ এর দশকে বাংলায় এই উপন্যাসটির অনুবাদ বেরিয়েছিল বলে মনে হয়। সেই বইয়ের প্রচ্ছদের ছবিটা দেখতে পেলে বেশ হত।
আপনার লেখা এই প্রথম পড়বার সুযোগ পেলাম দেবজ্যোতি বাবু । চমৎকৃত হলাম ।
অলংকরণে, নাটকে, ছায়াচিত্রে, কমিকসে দানব মহাশয়ের অনায়াস বিচরণের এ এক পুঙ্খানুপুঙ্খ ছবি !
একটি ক্ষুদ্র অপ্রাসঙ্গিক সংযোজন ।
শরৎ সাহিত্য ভবন থেকে একসময় প্রকাশিত হতো ‘অনুবাদ সিরিজ’ ।
সিরিজের প্রথম বইটি ‘মানুষের গড়া দৈত্য’ । ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন-এর বঙ্গীকরণ ।
লেখক – বলাই বাহুল্য – স্বয়ং হেমেন্দ্রকুমার রায় ।
চারু সেন বিচিত্রিত সেই গ্রন্থের অলংকরণে কিন্তু কার্লফ সাহেবের তেমন ছায়া পড়েনি ।