ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আর্মি
লেখক: বিশ্বজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য (চিত্রচোর)
৭ই সেপ্টেম্বর, ১৮১৮
স্থানঃ রবার্ট ওয়াল্টনের জাহাজ, যা ব্যর্থ উত্তর মেরু অভিযানের শেষে ফিরে চলেছে লন্ডনের দিকে
রবার্ট ওয়াল্টন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেই দানবের দিকে, যে নিজের সৃষ্টিকর্তার এবং তার পরিবারের নির্মম ধ্বংসের জন্য দায়ী। দানবের থেকে অদূরে শোয়ানো রয়েছে ভিক্টর ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের মরদেহ। রবার্ট ওয়াল্টন এবং ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দানবের মাঝে যে দূরত্ব, সেখানে জমাট বেঁধেছে তমিস্রার কুয়াশা ও অন্ধকার, সেই অন্ধকার, যা কেবল ভয় পেতে শেখায়। যা জাগতিক সজীবতাকে নির্মম, ভয়াবহ ধ্বংসের অভিমুখে ঠেলে দেয়।
নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করল ওয়াল্টন। বলল, “তাহলে কী ভাবলে? এইভাবে নিরীহ, নিরস্ত্র মানুষকে খুন করে তুমি তোমার জন্মের সার্থকতা অর্জন করবে?”
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের দানব গর্জন করে বলে ওঠে, “মানুষ মেরে আমি কোন আনন্দ পাই না। আমি কোনও মানুষের থেকে আজ অব্দি কোন সহানুভূতি পাই নি। তারা কেবল আমায় দিয়েছে বিদ্বেষ এবং ঘৃণা। ক্রমাগত ঘৃণার পাত্র হতে হতেই আমার মধ্যে জন্মেছে প্রতিশোধস্পৃহা। তাই আজ আমি রক্তপিপাসু খুনী।”
“কিন্তু ধর, কেউ যদি তোমায় ভালোবেসে আপন করে নেয়, তবে?”
“এই পৃথিবীতে এমন উদারতা দেখাবার মত লোক আছে নাকি?”
“ধরে নাও, যদি আমি, আমিই ভালোবাসি তোমায়?”
“তুমি! সত্যি বলছ?”
“হ্যাঁ, বলছি। কিন্তু বিনিময়ে একটা জিনিস তোমার কাছ থেকে আমি চাই। আমি অভিযান করতে ভালোবাসি। যেমন এবারে উত্তর মেরুতে এসেছিলাম, এমনি করে ছুটে যাব আফ্রিকা বা দক্ষিণ আমেরিকায়। তোমাকে আমি দেহরক্ষী হিসেবে নিযুক্ত করব। তুমি এইসব অভিযানে বিপদ থেকে আমায় রক্ষা করবে। তার বদলে তোমায় খেতে পরতে দেব। মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে তোমার রাগ ও খুনে মনোভাবকে দেখব। আর তোমায় ভালোবাসব।”
“কিন্তু, লোকসমাজে আমি বের হলেই যে আমাকে মানুষ পাথর ছুঁড়ে মারবে, গুলি করবে।”
“আমার লন্ডনের কাছে একটা ব্যক্তিগত খামারবাড়ি আছে। সেখানে তোমায় লুকিয়ে রাখব। আর জনসমক্ষে যখন বেরোবে তখন মুখভর্তি ব্যান্ডেজ করে বেরোবে। লোকে ভাববে যে তুমি কোনও দুর্ঘটনায় আঘাত পেয়েছ। কোনও সমস্যা হলে আমি তার ব্যাখ্যা করে দেব।”
“স্বীকার না করে পারছি না যে প্রস্তাবটা… প্রস্তাবটা সত্যিই ভেবে দেখবার মতো। আজ রাতটুকু সময় দাও। কাল সূর্যের আলো ফোটার পরে তোমায় জানাব।”
এই কথা বলে দানব জাহাজের পাশে থাকা সেই বরফের ভেলাতে লাফাতে গেল, যে ভেলায় করে সে এসেছিল। লাফাবার আগে একবার শুধু পেছনে ফিরল ক্যাপ্টেন রবার্ট ওয়াল্টনের উদ্দেশ্যে। তারপর বলল, “আর হ্যাঁ, অন্যদের মতো তুমি আমায় দানব বলে ডেক না। যে বংশের লোকেদের আমি হত্যা করেছি, সেই বংশের অভিশপ্ত পরিচয় আমি একাই বহন করে যাব। আজ থেকে আমার নাম ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন!”
৪ঠা মে, ১৯৪৫
স্থানঃ বার্লিন শহর
মিত্রবাহিনীর ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার স্যার র্যালফ রেইনার অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। চারদিকে ধ্বংসের মূর্ত প্রতিচ্ছবি। পাশের অট্টালিকার থামগুলো ভেঙে পড়েছে। রাস্তায় এক ফোয়ারার কাছে এক দেবদূতের প্রতিমূর্তির ভগ্নস্তূপ। দেবদূতের মুখ ও পাখনাগুলো গোলাগুলির লড়াইয়ে উড়ে গেছে। ফোয়ারার জল বন্ধ। রাস্তায় অদূরে তিনটে নাৎসি সৈন্যের মৃতদেহ পড়ে আছে। কেউ সরায়নি। সোজা রাস্তার শেষ প্রান্তে আগুন জালিয়ে লালফৌজের সৈন্যরা নাচছে, গান করছে। রেইনার সেইদিকে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ পায়ের শব্দে সে সচকিত হয়ে উঠল। কে?
একটা বিশাল বড় ছায়ামূর্তি ভাঙা থামের ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরিয়ে এল। ছায়ামূর্তিটা প্রায় আটফুট লম্বা হবে। অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছিল না। এবার ছায়ামূর্তিটা কথা বলতে শুরু করল।
-শুভ সন্ধ্যা, মি. রেইনার।
-শুভ সন্ধ্যা, ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন।
-আজকে সারাদিন তুমি কী করলে?
-ঐ যা আপনি বলেছিলেন। প্রায় একশোর ওপর জার্মান সৈন্য সমেত বার্লিনের সাধারণ মানুষদেরও নিকেশ করেছি।
–বেশ।
-একটা প্রশ্ন ছিল, স্যার।
-বল।
-আগামীকালও কি আমায় এই কাজ করে যেতে হবে?
-না, থাক। আর দরকার নেই। আমাদের বার্লিন বিজয় সপূর্ণ হয়ে গেছে। তুমি এবার দেশে ফিরতে পার। আমি তোমার লন্ডনে যাত্রার জন্যে একটা গোপন বিমানের ব্যবস্থা করেছি।
–আর আমার দাবিটার কথা মনে আছে তো স্যার? আপনি বলেছিলেন যে আপনার কথামতো কাজ করলে আপনি আমার দাবি নিয়েও ভাববেন।
-হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে আছে। তোমার দাবি হল যে তোমার আরও সঙ্গী বা সঙ্গিনী তৈরী করতে হবে, তাই তো?
-হ্যাঁ।
-হবে হবে, সব হবে। তুমি বুঝতেই পারছ যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ডের কী বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সেসব আগে একটু সামাল দেওয়া যাক। তারপর না হয়…
-আচ্ছা। কিন্তু আপনি ভুলে যাবেন না।
-না, না। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন, আমি তো তোমায় বলেইছি যে ব্রিগেডিয়ার স্যার র্যালফ রেইনার কথার খেলাপ করে না।
-বেশ। আমি চললাম তবে। কাল আবার এখানে দেখা করব। গোপন বিমানে ওঠার জায়গাটুকু জানাবেন।
রেইনারের মনে হল যে একটা কালো জাগুয়ার অন্ধকারে নিঃশব্দে হেঁটে চলে গেল। রেইনার প্রবল সাহসী হলেও ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের সাথে কথা বলার সময় তার ভেতরটা যেন কেঁপে ওঠে। এই দানবের কথার খেলাপ হলে সে আক্রোশে জ্বলে উঠবে। তারপর রেইনার পৃথিবীর যেখানেই আত্মগোপন করে থাকুক না কেন, তাকে খুঁজে বের করবে আর নির্বংশ করে ছাড়বে।
১৪ ই মে, ২০৩৮
স্থানঃ উত্তর কলকাতার একটা বাড়ি
টিভি চ্যানেলে সন্ধেবেলা ব্রেকিং নিউজ দেখানো শুরু হল।
“কলকাতা শহরে মাত্র তিনদিন আগে এক জিবোলা আক্রান্তের দেখা মিলেছে। আক্রান্ত ব্যক্তি মাদ্রিদ গিয়েছিল ঘুরতে। সেখানেই রাস্তায় ঘোরবার সময় জিবোলা আক্রান্ত কেউ তাকে কামড়ে দেয়। প্রাথমিক জ্বরটুকু নিয়ে সে ফিরে এসেছে। কিন্তু ইতিমধ্যেই জিবোলা রোগের প্রভাব তার মধ্যে দেখা দিতে শুরু করেছে। শরীরের স্বাভাবিক চামড়া একটু একটু করে খসে পড়ছে। প্রকট হয়ে পড়ছে হাড়, মাংস আর চাপ-চাপ জমাট রক্ত। আচার-আচরণে জান্তব প্রবৃত্তি দেখা যাচ্ছে। আর.জি.কর. হাসপাতালের যে বিশেষ কেবিনে তাকে রাখা হয়েছে সেখানে সে জিনিসপত্র ভাঙচুর করবার চেষ্টা করছে। আমাদের প্রতিনিধি শঙ্কর পাল জানিয়েছে যে গতকাল রাতে একজন নার্স ঘুমের ইঞ্জেকশান দেবার সময়, আক্রান্ত ব্যক্তি নার্সকে আঙুলে কামড়ে দেয়। নার্সের শরীরে জিবোলা নামক জোম্বি ভাইরাসের সংক্রমণ হয়েছে কিনা, তা পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। অবস্থা সামাল দিতে দুজন পুলিশকর্মী সেখানে মোতায়েন করা হয়েছে। এই মুহূর্তে আমাদের সাথে টেলিফোনে রয়েছেন ডাক্তার পার্থ সেনগুপ্ত। উনি ভারতের একমাত্র জিবোলা বিশেষজ্ঞ। ডাক্তার সেনগুপ্ত, যদি জিবোলা রোগটা সম্পর্কে আমাদের কিছু বলেন…”
ডাক্তার সেনগুপ্ত বলতে শুরু করল, “প্রথম কথা, এই জোম্বি রোগটা ভারতে প্রথম। এই রোগ সম্পর্কে চিকিৎসা করবার মতো প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো আমাদের নেই। আমি যতদূর জানি আক্রান্ত রোগীকে প্রথমে সেপটিসেমিয়া তার সেপসিসের ওষুধ দেওয়া হয়েছে। এতে কোনও সুফল মিলবে না। কারণ জিবোলা আর সেপসিস এক নয়। আর এই রোগ সম্পর্কে এটুকু বলে দিই, কোনও ব্যক্তি যদি জিবোলায় আক্রান্ত হয়, তবে সাতদিন মাত্র বেঁচে থাকবে। এক্ষেত্রে আমাদের আক্রান্ত ব্যক্তির পঞ্চম দিন চলছে। এই সময়ে যদি জিবোলা রোগের অ্যাণ্টি ভেনম ইঞ্জেকশন শরীরে না দেওয়া হয়, তবে লোকটি মারা যাবে এবং পুরোদস্তুর জিবোলা দানবে পরিণত হবে। তখন মৃত ব্যক্তির ভাইরাস তার মস্তিষ্কের দখল নেবে। অন্য মানুষ ও জীব-জন্তুকে সেই মৃত শরীরে সে কামড়ে তাদের মাংস খেতে চাইবে, তাদের মেরে ফেলতে চাইবে। দুঃখের কথা এই মুহূর্তে আমাদের কাছে জিবোলার অ্যাণ্টি ভেনম ইঞ্জেকশন নেই। আমেরিকার কাছে ভারত এই মুহূর্তে অ্যাণ্টি ভেনম ইঞ্জেকশন চেয়ে পাঠিয়েছে, যা জুনের আগে সম্ভবত আসবে না। কারণ বিপুল চাহিদার জন্যে আমেরিকার নিজের কাছেই স্টক তেমন নেই। সুতরাং আমি অত্যন্ত হতাশ। আর একটা কথা, জিবোলা কিন্তু বাতাস বা জলের মাধ্যমে ছড়ায় না। একমাত্র আঁচড় বা কামড়ের মাধ্যমেই এটা ছড়ায়।”
৩ রা অক্টোবর, ২০৩৮
স্থানঃ আর্মি হেডকোয়ার্টার, নিউ দিল্লী
“স্যার, জিবোলা ভাইরাস আমাদের বোকা বানিয়েছে। আমরা যা আশা করেছিলাম, তার থেকেও দ্রুততার সাথে এটা ছড়িয়ে পড়ছে। কলকাতার উত্তর অংশ এই ভাইরাসে ছেয়ে গেছে। আর দেরী করলে দক্ষিণ কলকাতাও জিবোলা আক্রান্ততে ছেয়ে যাবে। পুরো শহরটাতে আর কেউ বেঁচে থাকবে না। আমরা কি উত্তর কলকাতায় সেনা অভিযান করব?” কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে বলে একটু থামল সিনিয়র আর্মি অফিসার রিচা প্যাটেল।
ভারতীয় সেনাপ্রধান শ্রীনিবাস রাও উত্তর দিল, “চব্বিশ নম্বর ও পঁচিশ নম্বর ব্যাটেলিয়নকে আগেই সেখানে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু প্রায় কুড়ি লক্ষ আক্রান্তের সাথে হ্যান্ড-টু-হ্যান্ড কমব্যাটে পেরে ওঠা যাবে না। আমাদের ওখানে বোম ফেলতে হবে। কিন্তু তাতে রাজনৈতিক বাধা আসছে। বোম ফেললে কলকাতার সব ঘর-বাড়ি-উড়ালপুল ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। জনগণের সম্পত্তির প্রচুর ক্ষতি হবে। তাই রাজ্য সরকার আপত্তি করছে। যদি শেষ মুহূর্তে ফেলাও হয়, তবে তার আগে আমাদের আক্রান্ত জায়গায় গিয়ে দেখতে হবে যে কেউ বেঁচে আছে কিনা। থাকলে তাদের উদ্ধার করে দক্ষিণ কলকাতায় নিয়ে আসতে হবে।”
-স্যার, উত্তর কলকাতা থেকে সাধারণ মানুষদের উদ্ধার কাজের জন্য কি স্পেশাল কমান্ডো বাহিনীকে পাঠানো হবে?”
-না, স্পেশাল কমান্ডো ফোর্সও এত দানবের মধ্যে উদ্ধারকার্য চালাতে পারবে না। এর জন্য দরকার অন্য শক্তি।
-শক্তি! কী ধরণের শক্তি?
-দানবীয় শক্তি। এই ব্যাপারে ইতিমধ্যেই ব্রিটেনের সেনাপ্রধানের সাথে আমার কথা হয়েছে। আগামীকালই ব্রিটেন থেকে এক বিশেষ আর্মি ব্যাটেলিয়ান ভারতে এসে পৌঁছচ্ছে। সদস্য সংখ্যা ১০০০ জন। এরা উত্তর কলকাতায় সেনা অভিযান চালাবে। আর আমাদের সেনাবাহিনী এদের পেছন থেকে ব্যাক-আপ দেবে। মিশনের উদ্দেশ্যই হবে সাধারণ মানুষকে উদ্ধার করা। মিশন চলাকালীন কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারকে রাজি করাবে যে অপারেশন সম্পূর্ণ হলেই যাতে বোম ফেলা যায়।
-স্যার, এত বড় একটা ব্যাপার নিয়ে আমার কাছে কোনও আপডেট ছিল না!
-ব্যাপারটা অত্যন্ত গোপনীয় বলে জানানো হয়নি। যাইহোক, এখন তো জানলে। আর হ্যাঁ, আমাদের অতিথিরা কিন্তু স্বাভাবিক মানুষ নয়। সুতরাং ওদের থেকে আমাদের অফিসারদের দূরে থাকতে বলবে। শুধু কাজ নিয়ে কথা হবে। আর অপারেশন শুরুর আগে পর্যন্ত রোজ ওদের দিনে দু’কিলো করে মাংস খেতে দিতে হবে। বুঝেছ?
-দু’কিলো করে রোজ মাংস! মানুষ না অন্য কিছু?
-ধরে নাও অমানুষই।
-আচ্ছা। একটা প্রশ্ন মাথায় আসছে, স্যার। আমাদের সেনাশক্তি বিশ্বসেরা। কিন্তু তাহলে আমরা ব্রিটেন থেকে সেনা সাহায্য নিচ্ছি কেন?
-কারণ যারা আসছে, তারা জিবোলা রোগে আক্রান্ত হবে না। আমাদের সেনারা হবে।
-সে কী! এই বিশেষ সেনারা কারা? এদের কি অ্যাণ্টি ভেনোম ইঞ্জেকশান আগে থেকেই নেওয়া আছে?
সেনাপ্রধান শ্রীনিবাসের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি খেলে গেল। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে সেনাপ্রধান বলল, “এদের কোনও অ্যাণ্টি ভেনমের দরকার নেই। এরা ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আর্মি।”
৫ ই অক্টোবর, ২০৩৮
স্থানঃ উত্তর কলকাতা
শহরের আকাশের দিকে ধোঁয়ার কুন্ডলী উঠছে। বাতাসে মাংস পচে যাওয়ার গন্ধ। জিবোলা আক্রান্ত এক গৃহবধূ বাড়ির ছাদে বসে পায়রার মাংস খুঁটে খাচ্ছে। তার নিজের কাঁধের কাছে খানিকটা মাংস নেই। সম্ভবত কেউ আগেই কামড়ে তুলে নিয়ে গেছে সেই মাংস। গৃহবধু জানেই না যে সে এক জীবন্মৃত লাশ। সে মহানন্দে কাঁচা পায়রার রক্তাক্ত মাংস খেয়ে চলেছে। বাড়ির নিচের সরু গলির রাস্তায় রক্ত শুকিয়ে লাল হয়ে গেছে। সেখানে পাঁচটা জিবোলা আক্রান্ত নেড়ি কুকুর একটা মানুষের পচা-গলা শরীর থেকে মাংস ছিঁড়ে খাচ্ছে।
শহরের বিভিন্ন রাস্তা জুড়ে গাড়িগুলো ইতস্তত দাঁড়িয়ে আছে। শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড় হোক বা উল্টোডাঙার মোড় – সর্বত্রই একই দৃশ্য। গাড়িগুলো দোমড়ানো। কাঁচ ভাঙা। গাড়ির ভেতরে বা বাইরে মানুষ মরে পড়ে আছে। কেউ কেউ জিবোলা দানবে পরিণত হয়ে টলতে টলতে ইতস্তত ঘুরছে। কোনও কোনও জিবোলা দানব গাড়ির ভেতরে হাত ঢুকিয়ে শরীরগুলোকে টেনে-হিঁচড়ে বের করছে। তারপর দাঁত দিয়ে বা ধারাল অস্ত্র দিয়ে মাংস ছিঁড়ে মুখে পুরছে। কমবেশি সব রাস্তাতেই গোঁ-গোঁ, গর-গর শব্দ শোনা যাচ্ছে। ওগুলো জিবোলা দানবের চাপা কণ্ঠস্বর।
রবীন্দ্রসদনের কাছে ও বারাসাতের কাছে প্রচন্ড ভিড়। এখানে সেনারা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। যে সামান্য কিছু মানুষ প্রাণ বাঁচিয়ে ফিরে আসতে পেরেছে, তাদেরকে চেকিং করে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেসব নিয়ে ঝামেলাও চলছে। যেমন কোনও এক পরিবারে মা-ছেলের সংক্রমণ নেই, বাবার জিবোলা সংক্রমণ ঘটেছে। ছ’দিনের পুরোনো সংক্রমণ। সেনাবাহিনী মা-ছেলেকে ছেড়ে দিল। কিন্তু বাবাকে ধরে জিবোলা দানবদের মাঝে ছুঁড়ে ফেলে দিল। কারণ সংক্রমিত হওয়া কাউকে সাধারণ মানুষদের সাথে ঢুকতে দিলে রোগটা নিরাপদ জায়গাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়বে। মা-ছেলে চোখের সামনে দেখল যে একটা শরীরের ওপর কিছু জিবোলা দানব উপুড় হয়ে শরীরটাকে ধারাল অস্ত্র দিয়ে কোপাতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে একটা দানব সোজা হয়ে দাঁড়াল। তার হাতে ধরা মৃত শরীরের হৃৎপিণ্ড। দানবটা গোগ্রাসে কামড়ে কামড়ে হৃৎপিণ্ড খেতে লাগল। নিজের আপনজনের ঐ হাল দেখে মা অজ্ঞান হয়ে গেল, আর ছেলে বমি করতে লাগল। এই ধরণের নৃশংস, অমানবিক ঘটনা নিত্যদিন হয়ে চলেছে।
৬ ই অক্টোবর, ২০৩৮
স্থানঃ নলিনী সরকার স্ট্রীট, উত্তর কলকাতা
হাতিবাগানের কাছে একটা রাস্তা। নাম নলিনী সরকার স্ট্রীট। সেখানে একটা ভাঙাচোরা বাড়ির ভেতরের দৃশ্য। খাটের নীচে প্রিয়া বলে একটা দশ বছরের মেয়ে লুকিয়ে আছে। গতকাল রাতে কিছু জিবোলা দানব তাদের বাড়ির দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ে। প্রবল চিৎকার-চেঁচামেচি, ধ্বস্তাধ্বস্তির মধ্যেও প্রিয়ার বাবার চিৎকার করে বলেছিল, “প্রিয়া, শিগগির খাটের তলায় ঢুকে যাও। শিগগির…”
এর পরে প্রিয়া বাবা-মায়ের কানফাটা আর্তনাদ ছাড়া কিছু শুনতে পায়নি। দানবগুলো তার ঘরেও ঢুকেছিল। কিন্তু যে কারণেই হোক, খাটের তলাটা খুঁজে দেখেনি। সেই সময়ের পর থেকে প্রিয়া আর বেরোতেই পারছেনা।
দুপুরের দিকে প্রিয়া বেশ অনেকগুলো হেলিকপ্টারের শব্দ শুনতে পেল। হেলিকপ্টার থেকে বাংলা-হিন্দী-ইংরাজিতে বলতে বলতে যাচ্ছে, “নগরবাসীগণ, যদি আপনাদের মধ্যে কেউ এখনও বেঁচে থাকেন, এবং সংক্রমণ মুক্ত হন, তবে অবিলম্বে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে হাতিবাগান এবং শোভাবাজার মোড়ের দিকে আসুন। আমরা আপনাদের উদ্ধার করতে এসেছি।”
প্রিয়া ইংরাজি মিডিয়ামে পড়া ছাত্রী। বাংলা-ইংরাজি-হিন্দি – সে তিনটে ভাষাই বলতে এবং বুঝতে পারে। ফলে তার বক্তব্য বুঝতে অসুবিধে হল না। আস্তে আস্তে গুটিসুটি মেরে সে খাটের তলা থেকে বের হয়ে এল। ঘর থেকে বের হতে গিয়ে তার চোখ আটকে গেল মেঝের দিকে। মেঝেতে তার মায়ের মরদেহ পড়ে। একটা হাত নেই। পায়ের দুপাশে কালচে লাল জমাট রক্ত। মুখটা থ্যাঁতলান, চোখদুটো যেন খুলে বেরিয়ে আসবে। বীভৎস দৃশ্য। প্রিয়ার মাথাটা ঘুরে গেল। সে জোরে জোরে শব্দ করে কাঁদতে শুরু করেছে। এমন সময় ধুপ-ধুপ-ধুপ শব্দ শুনে তার কান্না থেমে গেল। নিজের হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল প্রিয়া। নিজের চোখের জলকে অবশ্য সে চাপতে পারছেনা।
চারদিকে তাকিয়ে প্রিয়া বুঝতে পারল যে ধুপ-ধুপ-ধুপ শব্দটা আসছে রান্নাঘর থেকে। পা টিপে টিপে প্রিয়া এগিয়ে গেল রান্নাঘরের দিকে। আস্তে আস্তে করে উঁকি মেরে যা দেখল তাতে বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল প্রিয়ার। দেখল যে এক জিবোলা দানব তার বাবার ছিন্ন নরমুন্ডটা টেবিলে আছড়ে ফেলে ভাঙবার চেষ্টা করছে। যেন নারকেল ফাটাচ্ছে! দৃশ্যটা দেখে প্রবল ভয়ে ও ঘৃণায় প্রিয়া আর্তচিৎকার করে উঠল। দানবটা সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়ার দিকে তাকাল। তার কুঁচকে যাওয়া চামড়ার রক্তাক্ত মুখ ভারী ভয়ঙ্কর। দানবটা প্রিয়ার দিকে তেড়ে এল। প্রিয়া অবশ্য ততক্ষণে ছুটতে শুরু করেছে। নিজের অবস্থা বাবা-মায়ের মতো যেন না হয়, তা ভাবতে ভাবতেই ছোট্ট মেয়েটা শিউড়ে উঠছে।
রাস্তায় কিছু জিবোলা দানব তার দিকে তেড়ে এল। কিন্তু প্রিয়া দ্রুততার সাথে তাদেরকে কাটিয়ে দৌড়তে লাগল। বিভিন্ন ভাঙা গাড়ির আড়াল দিয়ে প্রিয়া ভালোই দৌড়চ্ছিল কিন্তু তার স্বাভাবিকভাবে দৌড়নোর দৃশ্য দেখে বিভিন্ন দিক থেকে জিবোলা দানবরা তাকে ঘিরে ধরল। প্রিয়া একটা গাড়ির সামনের দরজায় সেঁটে দাঁড়িয়ে ছিল। সে আর কোনও আশা দেখতে পাচ্ছিল না। হঠাৎ করে দুটো হাত তাকে পেছন থেকে চেপে ধরল। প্রিয়া ছটফট করতে করতে চিৎকার করে উঠল, “ছাড়ো আমাকে, ছাড়ো বলছি!” কিন্তু বিশাল হাতের পাঞ্জাদুটো তাকে ছাড়ল না। বরং এক ঝটকায় তাকে গাড়ির ওপর টেনে তুলল। তারপর হাতের পাঞ্জার অধিকারী ইংরাজিতে বলল, “আমি না বললে তুমি গাড়ি থেকে নিচে নামবে না। বুঝেছ?”
প্রিয়া একটু ধাতস্থ হয়ে এটুকু বুঝল যে গাড়ির মাথার ওপর যে দাঁড়িয়ে আছে, সে আসলে উদ্ধারকারী দলের অংশ। কিন্তু লোকটাকে দেখতে দানবের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। বিরাট লম্বা। তার সারা মুখ ব্যান্ডেজ। এক হাতে মেশিনগান। আর এক হাতে বিশাল বড় কুঠার।
এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখল প্রিয়া। যতদূর দৃষ্টি যায় হাতিবাগানের দিকের প্রতিটা গাড়ির ওপর দাঁড়িয়ে আছে উদ্ধারকারী দলের কেউ না কেউ। যেমন একজন তার সাথেও আছে। এরা ইচ্ছাকৃত গর্জন করে জিবোলা দানবদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। দানবরা তাদের দিকে ছুটে আসছে আর মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে। প্রায় ঘণ্টাখানেক লড়াই চলল। তারপর সেই দৈত্যাকার, মুখে ব্যান্ডেজ বাঁধা লোকটা প্রিয়াকে একরকম বগলদাবা করে গাড়ি থেকে নিচে নামল। প্রিয়া ততক্ষণে অজ্ঞান। লাশ ও জিবোলা দানবের স্তূপ ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে সে প্রিয়াকে নিয়ে এগিয়ে চলল।
৭ ই অক্টোবর, ২০৩৮
স্থানঃ শ্যামবাজারের কাছে একটা পুরনো অট্টালিকা, উত্তর কলকাতা
রাতটুকু তার কোথায় কেটেছে, তা প্রিয়া জানে না। সকাল হতে তার চেতনা ফিরে এল। প্রিয়া দেখলো তার গায়ে চড়া রোদ এসে পড়েছে। উঠে দেখে যে তার পাশে কে যেন একটা শুকনো পাঁউরুটি আর জলের বোতল রেখে গেছে। প্রিয়ার খুব খিদে পেয়েছিল। সে গ্রোগ্রাসে খেতে খেতে তার মা-বাবার কথা মনে পড়ল। প্রিয়া হাউহাউ করে কাঁদতে লাগল। এমন সময় একটা গম্ভীর স্বরে একজন ইংরাজিতে বলল, “কী হয়েছে?”
প্রিয়া কাঁদতে কাঁদতে দেখল যে প্রশ্নকর্তা কালকের সেই লোকটা যে কালকে তাকে জিবোলা দানবদের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। প্রিয়া ইংরাজিতে বলল, “আমার মা-বাবাকে ওরা মেরে ফেলেছে কাকু। তুমি না এলে ওরা আমাকেও…”
প্রিয়া দেখল, মুখে ব্যান্ডেজ বাঁধা লোকটার দৃষ্টি কেমন অসহায় হয়ে গেল। লোকটা তবু গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে বলল, “যা হয়েছে, তা আমি বদলাতে পারব না। কিন্তু আর কিছু হবেনা। তোমাকে আমি সুস্থ শরীরে সঠিক জায়গায় পৌঁছে দেব।”
“তুমি খুব ভালো কাকু”, এই বলে প্রিয়া ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনকে জড়িয়ে ধরল। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আবেগে চোখ বন্ধ করল। আজ পর্যন্ত সমস্ত মানুষ তাকে ঘৃণার চোখে দেখেছে। সেনাবাহিনী তাকে স্বার্থের জন্য ব্যবহার করেছে। কিন্তু এই ছোট্ট, নিষ্পাপ মেয়েটা একটু হলেও তাকে আপন করেছে। মেয়েটা এখনও জানেনা যে জিবোলার দানবের মতো না হলেও সেও তো আসলে দানবই। বহু নৃশংস হত্যা সে করেছে। জানলে সে হয়তো অন্যদের মতোই তাকে ঘৃণা করবে। কথাটা মনে আসতেই ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন দুর্বলতাকে আর মনে জায়গা দিল না। চোখ খুলল। তারপর প্রিয়ার শরীরটাকে আস্তে আস্তে দূরে সরিয়ে দিল। প্রিয়া অবাক চোখে তার দিকে তাকাল। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী?”
প্রিয়া বলল, “প্রিয়া… প্রিয়া কর।”
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন বলল, “আমার নাম… থাক, নাম জেনে কাজ নেই।”
এবার একটু থেমে যোগ করল, “মন দিয়ে শোন প্রিয়া। এখানে আমি এবং আমার সহকর্মীরা একটা মিশনে এসেছি। মিশনটা হল তোমার মতো সাধারণ লোকেদের এই জিবোলা কবলিত এলাকা থেকে উদ্ধার করা। কাল দুপুর থেকে এখনও পর্যন্ত আমরা কয়েকশো লোককে উদ্ধার করতে পেরেছি। আমরা তোমাদের উদ্ধার করে বাগবাজার বা নিমতলা ঘাট নামক জায়গায় পৌঁছে দেব। আমি যতদূর জানি এই জায়গাগুলো নদীর কাছে। সেখান থেকে লঞ্চ বা হেলিকপ্টারে করে তোমরা নিরাপদ জায়গায় পৌঁছবে। বুঝেছ? সুতরাং এখন কান্নাকাটির সময় না। চটপট উঠে পড়। আর মাথায় রাখবে কোনও অবস্থাতেই রাস্তায় চলা থামাবে না।”
৭ ই অক্টোবর, ২০৩৮
স্থানঃ শ্যামবাজার মোড় থেকে বাগবাজার যাওয়ার পথ, উত্তর কলকাতা
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন দেখল যাওয়ার পথ প্রায় বন্ধ। হাজার হাজার জিবোলা দানব পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে। বেলগাছিয়া, গ্যালিফ স্ট্রীট, বাগবাজার সবদিকেই থিকথক করছে জীবন্মৃত শয়তানের দল। এদেরকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। যুদ্ধ করতে হবে। ভয়ানক প্রাণঘাতী যুদ্ধ। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন পেছন ফিরে বলল, “আপনারা সবাই দেখতে পাচ্ছেন যে সামনে কী ভয়ানক প্রতিরোধ রয়েছে। এদের সবাইয়ের সাথে আমরা যুদ্ধ করতে পারব না। তাই আমরা রাস্তার বাঁদিকটা ফাঁকা করতে করতে এগিয়ে যাব। সুতরাং সাধারণ মানুষদের অনুরোধ করা হচ্ছে যে আপনারা রাস্তার বাঁদিক ঘেঁষে চলবেন। কেউ ডানদিকে ভুলেও যাবেন না।”
এই বলে সামনে তাকিয়ে একটা হুঙ্কার দিল। তারপর সামনে এগিয়ে গিয়ে মেশিনগান থেকে গুলি করতে লাগল। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি বেরোচ্ছে। সামনের প্রতিরোধ ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে। দলটা একটু একটু করে সামনে এগোচ্ছে। কারুর কার্তুজ খতম হয়ে গেলেই সে পেছনে সরে যাচ্ছে এবং ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আর্মির অন্য কেউ এসে তার জায়গা নিচ্ছে। দেখতে দেখতে জিবোলা দানবদের প্রতিরোধ খানিকটা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। এই সুযোগে পুরো দলটা সাধারণ মানুষদের নিয়ে বাগবাজারের দিকে চলল। প্রিয়া মাটির দিকে চোখ দিয়ে হাঁটছে। কারণ চারদিকের রক্ত দেখলেই সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। তার জীবনের সবচেয়ে দুঃখের, বিস্ময়ের আর ভয়ের অনুভূতি প্রিয়া একই সাথে অনুভব করছে।
গিরীশ অ্যাভেনিউয়ে পৌঁছে দেখা গেল যা কারুরই মেশিনগানের গুলি আর অবশিষ্ট নেই। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন তার কোমরবন্ধ থেকে একটা কুঠার ও ছুরি বের করল। এরপর ধেয়ে আসা শত্রুদের দিকে তেড়ে গেল। খপ-খপ-খপ-খপ করে শব্দ হচ্ছে। এক এক কোপে এক এক দানবের ঘাড় থেকে মাথা নামিয়ে দিচ্ছে সে। কারুর কারুর কুঠার দিয়ে হাত-পা কেটে ফেলছে। ফোয়ারার মতো একেকটা শরীর দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। বাগবাজার অঞ্চলে রক্তের হোলিখেলা চলছে। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আর্মির সকলেই প্রায় আট ফুটের কাছাকাছি লম্বা হওয়ায় তারা শারীরিক সুবিধে নিচ্ছে। হাতের মুঠো-কনুই দিয়ে মারছে, পা দিয়ে লাথি মারছে।
এমনি ভাবে চলতে চলতে অবশেষে গঙ্গা দেখা গেল। সেখানে ভারতীয় আর্মির জওয়ানরা ইতিমধ্যেই অন্য দানবদের মেরে পথ তৈরী করে রেখেছিল।
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আর্মির সবাই ততক্ষণে হাঁপাচ্ছিল। জিবোলা দানবের কামড় ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আর্মির অনেকেই খেয়েছে। তাতে সংক্রমণ না হলেও, বিভিন্ন জায়গায় মাংস উঠে গেছে, পোষাক ভেদ করেও সারা শরীরে ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র আঁচড় আর মাংস খোবলানোর চিহ্ন।
সব আঘাতকে তুচ্ছজ্ঞান করে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আর্মির সবাই নিরীহ লোকেদের হেলিকপ্টার এবং স্টিমার-লঞ্চে তুলে দিচ্ছে। প্রিয়াকে কাঁধে চাপিয়ে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন নিজে হেলিকপ্টারে তুলে দিল। প্রিয়া শেষবারের মতো ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের বিশাল ডানহাতটা ছুঁয়ে বলল, “তুমি আমাদের সবাইকে বাঁচালে। তুমি খুব ভালো লোক, কাকু।”
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলল, “আমি ভালো লোক নই… আমিও… আমিও এক দানব।”
হেলিকপ্টারটা প্রিয়া এবং আরও বেশ কিছু সাধারণ লোককে নিয়ে ওপরে উঠে গেল। যাবার আগে সেনাবাহিনীর থেকে জানিয়ে দেওয়া হল যে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আর্মিকে এখান থেকে সরিয়ে আবার সল্ট লেক বলে একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হবে। সেখানে কিছু মানুষকে উদ্ধার করা বাকি। তার জন্য নতুন করে অস্ত্র ও রসদ দেওয়া হবে। কিন্তু সেটা কাল সকালের আগে সম্ভব নয়। আজ রাতে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আর্মিকে এই গঙ্গা নদীর পাড়েই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
হেলিকপ্টার ও লঞ্চগুলো ধীরে ধীরে বিদায় নিল। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন শহরের দিকে তাকিয়ে দেখল যে জিবোলা দানবদের একটা নতুন বড়সড় দল জড়ো হয়েছে এই ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আর্মির সাথে লড়াই করবার জন্যে। সেই দলে রয়েছে লোহার রড, ক্রিকেট ব্যাট এবং রান্নার ছুরি হাতে দানবেরা। এবং সঙ্গে রয়েছে শহরের বিভিন্ন বাড়ির পোষা কুকুরগুলো, যেগুলো এখন দানবে পরিণত হয়েছে। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন ও সহযোগীরা তীব্র আক্রোশে ছুটে গেল সেই দলের দিকে। আবার যুদ্ধ শুরু হল।
ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আর্মির এক এক জনের জন্য দানবেরা সংখ্যার অনুপাতে পাঁচ-ছ’জন এবং সশস্ত্র। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন নিজে দশ বারো জনের সাথে একা লড়ে যাচ্ছে। সবাই ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের শরীর লক্ষ করে লাফ দিচ্ছে ও জাপ্টে ধরে তাকে মাটিতে ফেলার চেষ্টা করছে।
দানবদের ভারে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের বিশাল শরীরটা অবশেষে নেমে আসছে মাটিতে। দুটো কুকুর দানব ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের পা কামড়ে ধরেছে। ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের ঘোলাটে চোখে অন্ধকার নেমে আসছে। তার কুঠারটা তিন-চারটে হাত চেপে ধরে আছে। সে অন্ধের মতো সমানে বড় ছুরিটা ভিড়ের মধ্যে চালিয়ে যাচ্ছে। আর দাঁতে দাঁত চেপে বলছে, “ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আর্মিকে কোনও দানব এত সহজে খতম করতে পারবে না। আমরা বেঁচে থাকব… কাল সকালের সূর্য দেখব… দেখবই…”
কিন্তু যে কথাটা আসলে ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের মাথার ভেতরে ঘুরছিল সেটা হল যে জিবোলা দানবদের বিরুদ্ধে লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে যাতে প্রিয়ার মতো অসংখ্য নিরীহ মানুষের জন্যে আগামীকালের পৃথিবীটা নিরাপদ ও বাসযোগ্য থাকে।
একটা ছোট্ট মেয়ের নিষ্পাপ, সরল ভালোবাসায় ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের মতো দানবের ভেতরেও মনুষ্যত্ব জেগে উঠেছিল।
Tags: গল্প, তৃতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য, ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন আর্মি, বিশ্বজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়