বজ্রবিদ্যুৎ সহ ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস
লেখক: অরুনাভ গঙ্গোপাধ্যায়
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
“আচ্ছা, আজকে কি ঝড় আসবে?”
“এই আপনি কে বলুনতো? সেদিন থেকে ফোন করে করে এই একই প্রশ্ন করে চলেছেন! ইয়ার্কি হচ্ছে? মজা পেয়েছেন নাকি?”
কথাটা বলেই, কান থেকে ফোনটা প্রায় আছাড় মেরে নামিয়ে রাখতে গেলেন গৌরাঙ্গ, কিন্তু রিসিভারটা ক্রেড্লে না বসে, হাত ফসকে সোজা গিয়ে লাগল টেলিফোনের পাশে শোকেসের ওপরে রাখা ইন্দ্র এবং পুলমার বাঁধানো একটি ছবিতে; ফল- ছত্রভঙ্গ। কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন গৌরাঙ্গ। সাতসকালে এই কাজ বেড়ে যাওয়াতে মেজাজটা আরও বিগড়ে গেল তাঁর। ভাঙা কাচগুলো ডিঙিয়ে ডিঙিয়ে তিনি বাইরে গেলেন ঝাঁটা আনতে।
এই অদ্ভুত ফোন আসার ব্যাপারটা প্রায় মাস দুয়েক হল শুরু হয়েছে। যেদিন গৌরাঙ্গ তাঁর অফিস থেকে রিটায়ার করলেন সেদিন থেকেই। তবে রিটায়ার করলেন বলাটা পুরোপুরি সঠিক নয়, উনি স্বেচ্ছাবসর নিলেন, ভলেন্টেয়ারি রিটায়ারমেন্ট যাকে বলে। আরও সাত বছর চাকরী ছিল ওঁর। সে যাকগে, কথা হচ্ছিল ওনার অবসর নেওয়ার দিন নিয়ে। অফিস থেকে সেদিন তিনি চারটের মধ্যেই বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। চমৎকার ফেয়ারওয়েল দেওয়া হয়েছে তাঁকে। একদিকে দীর্ঘ সাতাশ বছরের কর্মক্ষেত্রের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ব্যাথা, অন্যদিকে সহকর্মীদের দেওয়া ভালোবাসার অঢেল উপহার, এই দুই সঙ্গে করে বেশ একটা দোআঁশলা মন নিয়ে তিনি ফিরছিলেন। ফেরার সময়ে তিনি যখন মাঝরাস্তায়, তখনই লক্ষ্য করেছিলেন- আকাশের কোণ কালো হচ্ছে ধীরে ধীরে। “আয় বাবা আয়, গা-হাত-পা’র জ্বালা জুড়োক”, মরসুমের প্রথম কালবৈশাখীকে এভাবেই সেদিন আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর সেই আহ্বান যে এমন ভয়ংকরী রূপ নেবে তা তিনি ঘুণাক্ষরেও টের পাননি! বাড়ির উঠোনে পা দিতে না দিতেই শুরু হল এলোপাথাড়ি হাওয়া। আর ঘরে ঢুকে সবেই জামাটা ছাড়তে যাবেন, প্রকান্ড শব্দে একটা বাজ পড়ে আরম্ভ হল ঝড়! সঙ্গে দোসর বৃষ্টি। বাইরে যেন প্রলয় শুরু হল! এমন ঝড়বৃষ্টি বহুদিন হল এ তল্লাটে হয়নি! রীতিমত ভয় ধরিয়ে দেয়! জামাটা ছেড়ে, হাত-পা ধুয়ে, রান্নাঘর থেকে কোনওরকমে এক কাপ চা, আর মুড়ি চানাচুর নিয়ে এসে, ঘরের দরজা জানলা সেঁটে খাটে বসলেন গৌরাঙ্গ। ওঁর সর্বক্ষণের সঙ্গী বলাই আজ নেই, দেশের বাড়ি গেছে। বলেছিল আজই ফিরবে, কিন্তু এই অবস্থায় ফিরবে কি করে? ফেরা উচিতও নয়। তাহলে রাতের খাওয়ার কি হবে? সে যা হবার হবে, কিন্তু এখন যদি একবার বলাইকে ফোন করে বারণ করে দেওয়া যেত যাতে সে না ফেরে, কিন্তু এদিকে মোবাইলে সিগন্যাল নেই আর ওদিকে… ভাবতে ভাবতেই ল্যান্ডফোনটা বেজে উঠল। বলাই নাকি! প্রায় তড়াক করে লাফিয়ে উঠে গিয়ে ফোনটা ধরলেন গৌরাঙ্গ-
“হ্যালো…”
“হ্যালো, আজকে কি ঝড় হবে?”
বাইরে ঝড়ের শোঁশোঁ শব্দে প্রথম চোটে কিছু বুঝতেই পারলেননা তিনি। তাই প্রথমে কয়েকবার অ্যাঁঅ্যাঁ করলেন, তারপর শুনতে পেলেন যেন অনেক দূর থেকে, খুব কাতর এবং ক্ষীণ কন্ঠে কেউ কথা বলছে, একটি মেয়ে-
“আচ্ছা, আজকে কি ঝড় আসবে?”
অপরপ্রান্তে ঝড় হচ্ছে কিনা জানেননা গৌরাঙ্গ, তবু গলার স্বর কয়েক পর্দা চড়িয়ে তিনি বললেন-
“আসবে মানেটা কি? বাইরে তো মুষলধারে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে!”
“ওহ্…”
“ওহ্ মানে? আপনি কোথায় থাকেন? ওখানে হচ্ছেনা?… আর আপনি আমাকেই বা ফোন করলেন কেন শুধু শুধু? কে আপনি?”
ওপারে খানিক্ষণের নিস্তব্ধতা। এপারে তখনও তারস্বরে হ্যালো হ্যালো করে যাচ্ছেন গৌরাঙ্গ। তারপর হঠাৎই ওনাকে থামিয়ে দিয়ে ওপারের নারীকন্ঠ বলে ওঠে-
“একটু দেখবেন… দয়া করে কোনও ক্ষতি হতে দেবেননা!”
এই কথার পরে কিছুক্ষণ আবার সব চুপচাপ। ফোনের লাইনেও শুধুই শোঁশোঁ আওয়াজ! গৌরাঙ্গ আরও দু’চারবার হ্যালো হ্যালো করেন, ভদ্রমহিলা কী বলতে চান তা জিজ্ঞেস করেন, কিন্তু আর কিচ্ছু শোনা যায়না। একটু পরেই লাইন কেটে যাওয়ার শব্দ শুরু হয়। গৌরাঙ্গ হতবাক হয়ে যান। কে ইনি? কী উদ্দেশ্য এই ফোনের? ফোনটা নামিয়ে রেখে তিনি আবার ডিভানে ফিরতে যাবেন এমন সময়ে আবার, গগনবিদারী শব্দে একটা বাজ! গৌরাঙ্গের মনে হল সেই বাজ থেকে তৈরি হওয়া বিদ্যুৎ যেন- ফোনের তার বেয়ে, রিসিভারের মধ্যে দিয়ে এসে তাঁকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল, এবং কয়েক লক্ষ ভোল্টের শক খেয়ে, উনি যেন ছিটকে সরে গেলেন ফোনের কাছ থেকে! আর রিসিভারটা হাত থেকে পড়ে গিয়ে ক্রেড্ল থেকে ঝুলতে লাগল!…
গৌরাঙ্গ ফিরে আসেন ঝাঁটা নিয়ে। এসে দেখেন জিষ্ণু ইতিমধ্যেই ঘরে ঢুকে কাচ পরিস্কার করতে লেগেছে। সেই দেখে হাঁহাঁ করে উঠলেন তিনি-
“একিরে! খালি হাতে কাচ ধরছিস কেন? রক্তারক্তি হবে তো!”
গৌরাঙ্গের চেঁচানিতে প্রথমে সত্যিই চমকে ওঠে জিষ্ণু। হাতে ধরা কাঁচের টুকরোর কয়েকটা আবার হাত ফসকে পড়েও যায়! তারপর ধাতস্থ হলে, মামার দিকে তাকিয়ে ‘আর পারা যায়না তোমায় নিয়ে’ গোছের একটা এক্সপ্রেশন দিয়ে, হাত বাড়িয়ে ঝাঁটাটা নিয়ে কাচগুলো পরিস্কার করতে থাকে সে।
২
“কখন উঠলি আজ?”
“তুমি ওঠার আগেই। জগিংটাও সেরে এলাম”।
“ও বাবা! জেট ল্যাগ কেটেছে?”
“কি যে বলো! এক সপ্তাহ হয়ে গেল এসেছি, এখনও জেট ল্যাগ কাটবে না?”
গৌরাঙ্গ হেসে ওঠেন। তারপর জিজ্ঞেস করেন-
“ফিরলি কখন?”
নতুন হওয়া চশমার ফাঁক দিয়ে মামাকে একঝলক দেখে নিয়ে জিষ্ণু বলে-
“যখন ফোনটা ভাঙতে গিয়ে ফ্রেমটা ভাঙলে, তখন”।
হোহো করে হেসে ওঠেন গৌরাঙ্গ। কাচ-টাচ পরিস্কার করে ঘর এখন সাফসুতরো। ইন্দ্র-পুলমার ছবির ফ্রেমটা ভেঙে যাওয়াতে ছবিটার কি গতি হবে ভাবতে ভাবতে হঠাৎ গৌরাঙ্গের মাথায় আসে- “আরে আমার কাছেই তো আছে একটা নতুন ফ্রেম!” ফেয়ারওয়েলে পাওয়া, ব্রাসের কাজ করা দারুণ একটা ফটোফ্রেম জিষ্ণুকে বের করে দেন তিনি। বাবা-মা’র ছবিটা সেখানে যত্ন করে সাজিয়ে রাখে জিষ্ণু।
জিষ্ণুর স্কুলে এখন সামার ভেকেশন। আবার সেই অগস্টে স্কুল খুলে নতুন সেশন শুরু হবে। পড়াশোনার চাপ অতটা নেই এখন। তাই মামাবাড়িতে গরমের ছুটি কাটাতে সুদুর সিয়াটেল থেকে চন্দ্রকেতুগড় উড়ে আসা, মাসখানেক পর ফিরবে। অফিসের জন্য জ্যোতিরাদিত্য আসতে পারেনি এবার। বেচারা দাদাটা! এদিকে গৌরাঙ্গও অফিস থেকে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে, বিঘে খানেক পৈত্রিক চাষের জমিতে অরগ্যানিক ভেজিটেব্ল ফার্ম করবেন বলে তোড়জোড় শুরু করেছেন। তাই এই ফার্মের কাজে আর ভাগ্নের সান্নিধ্যে, ছুটির সময়টা তারও কাটছে ভালো। মাঝে মাঝে এই অদ্ভুতুড়ে ফোনের ব্যাপারটাই শুধু যা একটু…
দোতলার বারান্দায় দুজনে ব্রেকফাস্ট করতে বসেছেন। ডালপুরি, ঘুগনি আর আম। সঙ্গে গৌরাঙ্গের জন্য চিনি দেওয়া লাল চা, আর জিষ্ণুর জন্য গ্রিন টি, চিনি ছাড়া। গৌরাঙ্গের ভাষায় সবুজ রঙের গরম জল! আম বাদে বাকি জিনিস গুলো বলাই-ই বানিয়েছে তা বলাই বাহুল্য। ওই মহাদুর্যোগের পাঁচদিন পরে বলাই ফিরতে পেরেছিল এখানে। এই অঞ্চলেও অজস্র গাছপালা, কাঁচা বাড়িঘর ভেঙেছিল, তবে প্রাণহানি হয়নি। কিন্তু বলাইয়ের দেশে বাজ পড়ে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে! তার নিজের বাড়ির চালটাই তো উড়ে গিয়েছিল! সেসব সারিয়ে-টারিয়ে তবে ফেরা। খেতে খেতে জিষ্ণু হঠাৎ জিজ্ঞেস করল-
“আচ্ছা মামা, তোমার হিসেব আছে ঠিক কতবার তোমার কাছে এই ফোনটা এসেছে?”
গৌরাঙ্গ থালা থেকে মুখ না তুলেই বললেন-
“আট বার”।
“হিসেব আছে!”
জিষ্ণু অবাক। এবার গৌরাঙ্গ মুখ তুললেন।
“আজকে নিয়ে ঠিক আট সপ্তাহ কমপ্লিট হল। প্রতি সপ্তাহে একবার করে ফোনটা আসে। দিনের যেকোনো সময়ে”।
“রোজই ওই একই কথা বলে? মানে ঝড় আসবে কিনা জিজ্ঞেস করে?”
“মোর অর লেস। তবে…”
“তবে?”
“একবার বলেছিল, দেখবেন ওর বাসাটা যেন পড়ে না যায়, দেখবেন ডিমগুলো যেন ভেঙে না যায়!”
“ডিম?”
“হুম্, ঘোড়াড্ডিম”।
ডালপুরি শেষ করে গৌরাঙ্গ এবার আমের দিকে হাত বাড়ালেন। কিন্তু জিষ্ণুর ভেতরের খচখচানিটা মিটলনা! সে খাওয়া থামিয়ে দিয়ে কথা বলছে-
“আচ্ছা তোমার ব্যাপারটা উইয়ার্ড লাগছেনা? কন্টিনিউয়াসলি একজন তোমায় ফোন করে করে এরকম অদ্ভুত সব কথা বলে যাচ্ছে!”
এবার খাওয়া থামান গৌরাঙ্গ। মুখ নীচু করেই কিছু যেন ভাবেন, তারপর খানিক অন্যমনস্ক হয়ে বলেন-
“উইয়ার্ড লাগছেনা তা একেবারেই নয়, অবশ্যই লাগছে, কিন্তু কি বলতো? ফোনটা আসাতে আমার তো কোনোরকমের ক্ষতি হয়নি, তাই ঐ নিয়ে আর আমি মাথা ঘামাইনি বেশি। বিরক্ত লাগলেও, পাত্তা দিইনি”।
“কিন্তু…”
জিষ্ণুর কথা শুরুতেই থামিয়ে দিয়ে আবার গৌরাঙ্গ বলেন-
“প্রথমে কি ভাবছিলাম জানিস? কোনও বাচ্চা করছে ফোনটা, কিন্তু বার দুয়েক শোনার পরেই বুঝলাম, উঁহু বাচ্চা নয়, যে ফোন করছে তার বয়স হয়েছে, মানে বেশ ভালোই বয়স হয়েছে!”
“তবে! যতই তুমি ইগ্নোর করো মামা, ব্যাপারটা মোটেই এত সোজা নয়। কারোর তো কোনও ব্যাড ইন্টেনশন থাকতে পারে!”
কিছুক্ষণ জিষ্ণুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন গৌরাঙ্গ। তাঁর ষোলো বছরের ভাগ্নের কথা বলায় তাঁর বোনের ছায়া স্পষ্ট! তাঁর মনে পড়ে, খুব ছোট বয়স থেকেই, পুলমাও এইভাবে যুক্তির পিঠে যুক্তি বসিয়ে কথা বলতে পারত!… স্মৃতি থেকে ফিরে এসে গৌরাঙ্গ বলেন-
“তাহলে? কী করতে বলিস?”
“লেট’স গো টু দ্য পুলিস টু ট্রেস দ্য নাম্বার”।
“ও বাবা না না! পুলিশে ছুঁলে আগে ছত্রিশ ঘা হত, এখন বাহাত্তর ঘা হয়, পুলিশ না…”
মামার ছেলেমানুষি দেখে জিষ্ণু অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। গৌরাঙ্গ আবার কথা বলে ওঠেন-
“আর তাছাড়া পুলিশ নাম্বার বের করতে পারবেনা।…”
“সে আবার কী? পুলিশ পারবেনা! কেন পারবেনা?” জিষ্ণু অবাক!
“কিকরে পারবে বল? রাস্তায় যে জলের পাইপলাইনের কাজ হচ্ছে তার জন্যে তো প্রায় তিন-সাড়ে তিন মাস হল ফোনটা ডেড ছিল, এই তুই আসার দিন কুড়ি আগে সবে ঠিক হল…”
“আরে সে যতই ডেড থাক, পুলিশ একটা নাম্বার বের করতে পারবেনা তাই হয় নাকি? ওদের অনেক টেকনিক্স… মামা!”
চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে সবেই প্রথম চুমুকটা দিতে যাচ্ছিলেন গৌরাঙ্গ। কিন্তু মাঝপথে কথা থামিয়ে জিষ্ণুর আচমকা চেঁচিয়ে ওঠাতে চুমুক তো দিতে পারলেনই না, উল্টে এমন চমকে উঠলেন যে কাপের চা প্রায় অর্দ্ধেকটাই চলকে পড়ে গেল তাঁর জামায়। কোনওরকমে সামলে নিয়ে সামনে তাকিয়ে দেখেন প্রায় বিস্ফারিত চোখে তাঁর দিকে চেয়ে আছে জিষ্ণু। কিন্তু গৌরাঙ্গ তখন বুঝতেও পারলেন না যে কোন সাংঘাতিক কথা তিনি বলে ফেলেছেন!
৩
দেড়শো বছরের পুরোনো, প্রায় পোড়ো হয়ে যাওয়া হালদার বাড়িটা আজ ভাঙা শুরু হল। জিষ্ণুর মামাবাড়ির দক্ষিণ দিকে একটা বড়সড় পুকুর আছে। অবশ্য আছে বলাটা ভুল; ছিল, কোনও এককালে। এখন সেটা মজা ডোবা। মাঝেসাঝে কেবল শাপলা ফুটতে দেখা যায় ডোবাভর্তি কচুরিপানার মধ্যে। পুকুরটা এ বাড়ির খিড়কির দরজার ঠিক সামনে, আর পুকুরটা শেষ হলেই হালদার বাড়ির সীমানা শুরু। প্রায় পনেরো কাঠা জমির ওপর দাঁড়িয়ে বাড়িটা, বলতে গেলে একটা প্রাসাদই!
ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জিষ্ণু দেখছিল বাড়ি ভাঙার কাজ। এবাড়ির যিনি অধুনা ওয়ারিশ, তিনি পরিবার নিয়ে বর্তমানে থাকেন জার্মানিতে। কিন্তু এখন তিনি দেশে ফিরেছেন, এই ভাঙাভাঙির কাজ তদারকি করতে। জমিটা তিনি প্রোমোটারের হাতে তুলে দিয়েছেন। হাউজিং কমপ্লেক্স হবে। যাজ্ঞসেনী হালদার, অর্থাৎ সেই ওয়ারিশ এই মুহুর্তে জিষ্ণুর মামাবাড়ির বৈঠকখানাতেই বসে। গৌরাঙ্গের সঙ্গে কথা বলছেন।
“আপনি এতদিন ধরে দেশছাড়া, তবু বাংলাটা কিন্তু দিব্য দিব্ব্যি বলেন!” গৌরাঙ্গ বললেন, যাজ্ঞসেনীকে উদ্দেশ করে।
“এতদিন কি বলছেন! আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা, কাজকর্ম সবই হামবুর্গে!” হেসে উত্তর দেন যাজ্ঞসেনী।
“সেইজন্যই তো বলছি, ব্যাপারটা রীতিমত প্রশংসনীয়!”
বৈঠকখানায় বসে চা খাচ্ছিলেন দুজনে, খাওয়া শেষ হয়েছে। যাজ্ঞসেনী এবার উঠবেন। কলকাতায় ফিরতে হবে তাঁকে। ঘর থেকে বেরোবার আগে যাজ্ঞসেনী বললেন-
“আসলে কি বলুনতো, আমি তো এই এলাকায় আর কাউকে চিনিনা… আপনাদেরও যে চিনি তা নয়, তবে ওনার কাছ থেকে আপনাদের পরিবার সম্পর্কে অনেককিছু শুনেছি, তাই আসা… আমার তো এদেশে সেট্ল করার কোনও প্ল্যান নেই, তাই আপনি যদি আমাদের প্রাপ্য ফ্ল্যাটটা কিনে নিতেন…”
“সবই বুঝতে পারছি ম্যাডাম” এবার গৌরাঙ্গ বলেন, “কিন্তু আপনিও তো আমাকে দেখলেন, একা মানুষ আমি, থাকার মধ্যে দুটো ভাগ্নে, তারা আবার এর মধ্যেই বিদেশে সেটল্ড… এই অবস্থায় এত বড় একটা ইনভেস্টমেন্ট!… আমার কোন কাজে লাগবে বলুন?”
যাজ্ঞসেনী আর কথা বাড়াননা। তাঁরা দুজনে বেরিয়ে পড়েন ঘর থেকে। বেরিয়েই দেখেন ছাদ থেকে নেমে আসছে জিষ্ণু। তাকে দেখে গৌরাঙ্গ বলেন-
“কিরে, এই রোদ্দুরে ছাদে কি করছিলি?”
কিন্তু জিষ্ণু কিছু বলার আগে যাজ্ঞসেনীই কথা বললেন-
“তোমার সঙ্গে তো ভালো করে কথাই বলা হলনা!”
“চলুন তাহলে, আপনাকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিই”। হেসে বলল জিষ্ণু।
গৌরাঙ্গকে বিদায় জানিয়ে যাজ্ঞসেনী বেরিয়ে পড়লেন, সঙ্গে জিষ্ণুও। হালদার বাড়ির সিংহদরজার সামনে যাজ্ঞসেনীর গাড়িটা পার্ক করা ছিল। জিষ্ণুর মামাবাড়ি থেকে বেরিয়ে পুরো পুকুরটাকে ঘুরে তবে হালদার বাড়ি, বেশ খানিকটা পথ। জিষ্ণু সেই পর্যন্ত সঙ্গ দিল যাজ্ঞসেনীকে, এবং যাজ্ঞসেনী তার ঠিকুজি কুলুজি জানতে চাওয়ার আগেই জিষ্ণু কতগুলো প্রশ্ন করতে শুরু করল তাঁকে। কিছু হিসেব চট করে মিলিয়ে নিতে হবে!
“আচ্ছা সম্পর্কে উনি আপনাদের ঠিক কে হতেন?” জিষ্ণু প্রশ্ন করে।
হাঁটা থামিয়ে দেন যাজ্ঞসেনী। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন-
“অত্যন্ত অন্যায় হচ্ছে জানো, কিন্তু বিশ্বাস করো আমি ঠিক জানিনা যে কী সূত্রে উনি আমাদের পরিবারের সাথে জড়িত ছিলেন!”
“আপনি তো তখন বললেন যে উনি হালদার ছিলেননা, তার মানে কি উনি আপনাদের আত্মীয় ছিলেননা?… কিছু মনে করবেননা, আশ্রিত ছিলেন কি উনি?”
“না না তা নয়, আমার বাবা ওনাকে বড়পিসী বলে ডাকতেন। সেই সূত্রে আমি বড়ঠাম্মি বলতাম, কিন্তু কী সম্পর্ক, মানে…”
এই পর্যন্ত বলে ঠোঁট ওল্টান যাজ্ঞসেনী। আবার জিষ্ণু জিজ্ঞেস করে-
“ওনার বয়স কত হয়েছিল?”
“নাইন্টি সেভেন!”
“এখান থেকে হঠাৎ করে হামবুর্গে গিয়ে সেট্ল করলেন কেন উনি?”
“উনি তো নিজের ইচ্ছেতে করেননি, ওনার গোটা পরিবারটাই তো চলে গেল ওখানে! যতদূর মনে পড়ছে, বোধহয় নাইন্টিন থার্টি নাগাদ! তখন ওনার ন’বছর বয়স। আর আমার বাবা যখন বাইশ বছর বয়েসে জার্মানি গেলেন, তখন ওঁদের বাড়িতেই উঠলেন, পরে অবশ্য বাড়ি বদলান”।
“কিন্তু উনি আমাদের পরিবার সম্বন্ধে এত কিছু জানলেন কিকরে?”
“সে না জানার কি আছে বলো? ছোটবেলার কিছুটা হলেও তো উনি কাটিয়েছিলেন এখানে!”
হাঁটতে হাঁটতে ওরা হালদার বাড়ির সামনে চলে এসেছিল। যাজ্ঞসেনী গাড়ির কাছে এলেন, একটু দাঁড়ালেন, কিছু যেন ভাবলেন, তারপর আবার জিষ্ণুর দিকে ফিরে বললেন-
“একটা কথা বলব? তোমার হয়তো অদ্ভুত লাগতে পারে…”
“বলুন না!”
“আমি তো বেশি আসতে পারবো না এখানে, তুমি কিংবা তোমার মামা মাঝে মাঝে যদি বাড়ি ভাঙার সময়ে এখানে আসো… মানে, পারবে? তোমাদের সময়মতো এলেই হবে!”
“কেন বলুনতো?” জিষ্ণু সন্দিগ্ধ।
“কিভাবে যে বলি!” ইতস্তত করেন যাজ্ঞসেনী, “বড়ঠাম্মি মারা যাবার আগে, মানে কোমা থেকে ফিরে আসার পর বেশ কয়েকবার গুপ্তধন গুপ্তধন আওড়াচ্ছিলেন… ইশ্! আমি কি পাগলের মতো কথা বলছি দেখো!” হেসে ফেলেন যাজ্ঞসেনী, “আমি কি আশা করছি যে, এই দেড়শো বছরের বাড়ি ভাঙতে ভাঙতে মাটির তলা থেকে ঘড়া ঘড়া সোনাদানা-মোহর এইসব বেরোবে! শিট! সাচ আ ননসেন্স আই অ্যাম! বাদ দাও বাদ দাও, আমি আসি এখন, কেমন?”
এই বলে জিষ্ণুর গাল ধরে আদর করে দিয়ে যাজ্ঞসেনী গাড়িতে উঠে চলে গেলেন। কিন্তু উনি যা বলে গেলেন, যে গুপ্তধনের কথা শুনিয়ে গেলেন, তা যে একেবারেই মিথ্যে নয়, সেটা জিষ্ণু জানে, জানেন গৌরাঙ্গও! গুপ্তধন ছিল। সেটা কী এবং তা কোথায় ছিল, তাও তারা জানে।
৪
সেদিন কিছুক্ষণের জন্যে গৌরাঙ্গ কথা বলার অবস্থায় ছিলেন না। জিষ্ণু যেটা একবার শুনেই বুঝতে পেরে গেল, এতদিন ধরে তিনি তা ধরতেই পারলেন না! রাস্তায় যে জলের পাইপলাইনের কাজ হচ্ছে তার জন্যে প্রায় তিন-সাড়ে তিন মাস হল ফোনটা ডেড ছিল, জিষ্ণু আসার দিন কুড়ি আগে সেটা ঠিক হল… তার মানে প্রথম চারটে কল এসেছিল যখন, ফোনটা তখন ডেড ছিল! এ যে চুড়ান্ত অলৌকিক! এখন প্রায় সমস্ত কথোপকথনই মোবাইলে সারেন বলে ল্যান্ড ফোনের প্রয়োজন তেমন হয়না গৌরাঙ্গের, কিন্তু প্রতি সপ্তাহে যখন কেবল একবার করেই ফোনের রিং বাজছিল, এবং ওপার থেকে শোনা যাচ্ছিল সেই রহস্যময়ীর স্বর, তখনও গৌরাঙ্গের মাথায় এলনা যে অকেজো দূরভাষ যন্ত্রে কিভাবে ফোন আসতে পারে! নাকি কেবলমাত্র নির্দিষ্ট সেই সময়টুকুর জন্য ইচ্ছাকৃত ভাবেই গৌরাঙ্গের মাথা থেকে মুছে দেওয়া হচ্ছিল মানুষের সাধারণ বিচারবোধ! কিন্তু কী উদ্দেশ্যে এবং কিভাবেই বা!
জলখাবার খেতে খেতে যেদিন ব্যাপারটা ধরা পড়ল, সেদিনকেই আবার শেষরাতের দিকে ফোনটা এল। সেদিন গোটা রাত গৌরাঙ্গ প্রায় বিনিদ্র কাটিয়েছেন। ঠায় বসেছিলেন খাটে। যেদিন প্রথম আসে ফোনটা, সেদিন বাইরে চলছিল প্রলয়ংকারী দুর্যোগ। আর আজ ঘরে দুটো ফ্যান চালিয়েও গৌরাঙ্গ ঘামছেন। অদ্ভুত একটা গুমোট করে আছে বাইরে। একটুও হাওয়া নেই। একটা যেন অমঙ্গল, কোথাও যেন অশুভ কিছু ঘটছে- পরিবেশে যেন তারই ইঙ্গিত!
দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে থাকতে থাকতে খুব স্বাভাবিক ভাবেই চোখটা বুজে এসেছিল গৌরাঙ্গের। হঠাৎ ফোনটা বেজে ওঠে। আর তার মনে হয় উনি যেন আবার বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হলেন। গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসেন তিনি। সেদিন জিষ্ণুও গৌরাঙ্গের ঘরেই শুয়েছিল, মাটিতে বিছানা করে। সেও উঠে বসে। দেখে, বিস্ফারিত চোখে মামা ফোনের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। ফোনের রিংটা অনবরত বেজেই চলে, সাধারণ কল এলে যেটা হয়না; কয়েকবার বাজার পরেই তা থেমে যায়। জিষ্ণু বলে-
“যাও মামা, ফোনটা ধরো, ইউ ডোন্ট হ্যাভ এনি আদার অপশন… এটা ঐ কলটাই এসেছে”। গৌরাঙ্গ সত্যিই বোঝেন, যে আর কোনও উপায় নেই। খুব ধীরে ধীরে তিনি বিছানা থেকে নামেন। ফোনের কাছে যান, ধীরে ধীরে। রিসিভারটা তুলে কানে লাগান। প্রথমে গলা দিয়ে স্বর বেরোয়না, পরেরবার বেরোলেও স্পষ্টতই গলা কেঁপে যায়-
“হ্য্… হ্যালো…”
ফোনের ওপারে কিছুক্ষণ স্তব্ধতা। গভীর অন্ধকার সুড়ঙ্গের মতো শূন্য মনে হয় সেই স্তব্ধতাকে। কিছুক্ষণ পর, হঠাৎ সেই সুড়ঙ্গ থেকে ছেঁড়া ছেঁড়া স্বর বেরিয়ে আসে। কিন্তু এবারের স্বর আর কোনও বৃদ্ধার ছিলনা, ঠিক যেন একটি চপলমতি শিশুকন্যা কোন সুদূর থেকে কথা বলছিল গৌরাঙ্গের সঙ্গে-
“…আমি চলে যাচ্ছি আজ! মা বলে ভিটেতে ঘুঘুর বাসা রাখতে নেই। কিন্তু ও কোথায় যাবে বলো? আর কদিন পরেই তো ডিম ফুটে বাচ্চাগুলো বেরোবে… ওর বাসাটা যদি এখন ভেঙে দিই, তখন ও কোথায় থাকবে বলো? তাই আমি একটা কাজ করেছি! আমি তো খুব ভালো গাছ বাইতে পারি, তাই তোমাদের বাড়ির পাশে যে মস্ত মেহগেনি গাছটা আছে আমি তার মগডালে বাসাটাকে বেঁধে দিয়েছি! আমার একটা রূপোর অ্যাত্তো মোটা চেন ছিল, সেইটা দিয়ে। হিহিহি! অনেক পাতা দিয়ে ঢেকে দিয়েছি। যেভাবে গুপ্তধন লুকিয়ে রাখত রাজাবাদশারা, ঠিক সেইভাবে লুকিয়ে রেখেছি, কেউ দেখতে পাবেনা! হিহিহি!… কিন্তু ভয় করছে, যদি ঝড় আসে! যদি বাসাটা পড়ে যায়!…”
“তোমার নাম কী?” গৌরাঙ্গের হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে। প্রশ্নটা তিনি কোনওরকমে করেন।
“সুধা, সুধাময়ী চট্টোপাধ্যায়”।
এবং এরপরে গৌরাঙ্গকে আর কোনও কথা জিজ্ঞেস করতে হয়না। সুধাময়ী আপনা থেকেই নিজের সম্বন্ধে অনেক কথা বলে যেতে থাকে অনর্গল, এবং বলতে বলতে কথার মাঝপথে আচমকাই ফোনটা কেটে যায়!… ভোর হতে আর কিছুক্ষণই বাকি ছিল, মামা কিংবা ভাগ্নে কারোরোই আর ঘুম আসেনা বাকি রাতটা।
৫
পৃথিবীতে এমন ব্যাখ্যার অতীত ঘটনাও ঘটে তাহলে? যাদের বিশ্বাস না করার তারা তো করেবনই না, কিন্তু যারা এই ধরণের ঘটনার সম্মুখীন হয়েছেন? ভুক্তভোগী হয়েছেন এই ধরণের অকল্পনীয় পরিস্থিতির? তাদের তো বিশ্বাস না করে কোনই উপায় নেই, অথচ বিশ্বাস করতেও যে মন সায় দেয়না!… গৌরাঙ্গ এবং জিষ্ণুর সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা, ঐ ফোনের সঙ্গেই শেষ হয়ে যেতে পারতো! কিন্তু তা হয়নি। উপসংহার বাকি ছিল তখনও।
ওই শেষরাতের ফোন যেদিন এল, তার ঠিক তিন সপ্তাহের মাথায় কলকাতা থেকে গৌরাঙ্গের এক পরিচিত জানালেন, জার্মানি নিবাসী এক ভদ্রমহিলা গৌরাঙ্গের সাক্ষাতপ্রার্থী। কলকাতা নিবাসী ভদ্রলোক; গৌরাঙ্গ এবং সেই প্রবাসী ভদ্রমহিলা, ঘটনাচক্রে দুজনেরই পরিচিত। একদিন খুব সকালবেলা নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে ভদ্রমহিলা অর্থাৎ যাজ্ঞসেনী হালদার উপস্থিত হলেন চন্দ্রকেতুগড়। উদ্দেশ্য উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া, পনেরো কাঠা জমির ওপর নির্মিত, প্রাসাদোপম তাঁদের যে পারিবারিক বাড়ি, তাকে প্রোমোটারের হাতে তুলে দেওয়া। সেই নিয়েই গৌরাঙ্গের সঙ্গে বৈষয়িক আলোচনা। ঐ ভুতুড়ে কিংবা অদ্ভুতুড়ে ফোন সেই রাতের পর থেকে আর আসেনি, ফলে গৌরাঙ্গের মানসিক অবস্থা ততদিনে স্বাভাবিক। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি যাজ্ঞসেনীর সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেন। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ যা ভাবে তা হয়না, আর যা ভাবেনা সেটাই ঘটে। যাজ্ঞসেনী বলতে থাকেন-
“বড়ঠাম্মি প্রায় তিনমাস কোমায় ছিলেন! তারপর যেদিন মারা গেলেন, তার ঠিক দু’ঘন্টা আগে উনি কোমা থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন!”
এরপর খুব স্বাভাবিক একটা প্রশ্ন করেন গৌরাঙ্গ, স্বাভাবিক ভাবেই-
“ওঁর নামটা কি?”
“সুধাময়ী চট্টোপাধ্যায়”।
৬
ফেলে যাওয়া ভালোবাসা, ছেড়ে যাওয়া মায়া মনের কোন গহীনে বাসা বেঁধে থাকলে, মৃত্যুর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েও মানুষ তাকে নিয়ে এভাবে ভাবতে পারে! কিন্তু শুধু কি মৃত্যুর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা! যেখানে মানুষটার চেতনাটাই লুপ্ত হয়ে যায়! কিংবা চেতনা হয়তো থাকে, কিন্তু শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেই চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারেনা মানুষ! সেক্ষেত্রে, পৃথিবীর সম্পূর্ণ অন্য গোলার্ধে উপস্থিত থাকা একটা মানুষের সঙ্গে দিনের পর দিন এই যে যোগাযোগ, তাকে কি বলা হবে? টেলিপ্যাথি? নাকি অন্য কোনও অনাবিষ্কৃত তরঙ্গের মাধ্যমে যোগাযোগ!… উফ্! আর পারছেনা ভাবতে! মাথা ঘুরে যাচ্ছে জিষ্ণুর।
ওই অদ্ভুত ফোনের কথা যাজ্ঞসেনীকে তারা ঘুণাক্ষরেও জানতে দেয়নি। তিনি চলে যাবার পরে, গৌরাঙ্গের বক্তব্য এবং যাজ্ঞসেনীর কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মিলিয়ে জিষ্ণু দেখল, যেদিন প্রথম সেরিব্রাল অ্যাটাক করে কোমায় চলে যান সুধাময়ী, সেদিনই প্রথম ফোনটা আসে গৌরাঙ্গের কাছে, আর সেদিনেই এখানে তুমুল ঝড়বৃষ্টি হচ্ছিল। এবং শেষ যেদিন ফোনটা আসে, সেদিন সুধাময়ী মারা যান!
জিষ্ণু আজ ফিরে যাবে। রাত্রিবেলায় ফ্লাইট। সকালবেলাতেই কলকাতার উদ্দেশ্যে রওনা দেবে সে। তারপর বিকেলবেলা এয়ারপোর্ট যাত্রা। সঙ্গে অবশ্য গৌরাঙ্গও যাবেন। দেখতে দেখতে কোথা দিয়ে যে একটা মাস কেটে গেল, যেন টেরই পাওয়া গেলনা! একটা টর্নেডো বয়ে গেল যেন এই একটা মাস জুড়ে! কিন্তু এর মধ্যে জিষ্ণু একটা কান্ড করে বসেছে, মামাকে না জানিয়েই। গৌরাঙ্গ একদিন বাড়ি ছিলেননা, সেই সুযোগে জিষ্ণু তাদের বাড়ির পাঁচিল ঘেঁষা মেহগেনি গাছটায় চড়ে বসে। কিন্তু কী আশায় সে চড়েছিল গাছে? তার কি ধারণা ছিল যে- শতাব্দী প্রাচীন গাছের শাখাপ্রশাখার আশ্রয়ে, প্রায় নব্বই বছর আগে ফেলে যাওয়া মা ঘুঘু পাখি তার সন্তান সন্ততিদের নিয়ে সুখে দিনাতিপাত করছে? নাহ্, সে আশা জিষ্ণুর অবশ্যই ছিলনা। তবু চড়ে বসে, এবং যথারীতি কিছুই পায়না। জিষ্ণু নেমে আসতে যায়, আর নেমে আসতে গিয়ে, গাছের ডালে ঝাঁকুনি লেগে হঠাৎ তার কাঁধের ওপরে ভারী মতন কি যেন একটা পড়ে। জিষ্ণু তাকিয়ে দেখে সেটা একটা মোটা চেন! কোনও ধাতুর তৈরি। কি ধাতু বোঝা যাচ্ছেনা, কারণ সেটা কালো হয়ে গেছে। হঠাৎ জিষ্ণুর মনে পড়ে সেই ফোনের কথা, “…আমি মগডালে বাসাটাকে বেঁধে দিয়েছি! আমার একটা রূপোর অ্যাত্তো মোটা চেন ছিল, সেইটা দিয়ে। হিহিহি!” জিষ্ণু বাড়ি ফিরে এসে চেনটাকে পরিস্কার করে। রূপো ফিরে পায় তার আসল রূপ। রোদ লেগে তার গা থেকে আলো ঝিলিক দিয়ে ওঠে। সত্যি! সুধা তাদের ভোলেনি! তার পাখিবন্ধুর কাছে ফিরে আসার সাধ আমৃত্যু তাকে তাড়া করে গেছে!
দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল জিষ্ণু। সকাল আটটা বাজে। মামা গাড়ি ডাকতে গেছে। একটু পরেই বেরোবে। হঠাৎ আকাশের দক্ষিণে চোখ যায় তার। আকাশের রং যেন হালকা ধুসর লাগে… মেঘ করছে। বৃষ্টি আসবে না তো! ঝড় উঠবে কি?
Tags: অরুনাভ গঙ্গোপাধ্যায়, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, ফ্যান্টাসি গল্প, সুপ্রিয় দাস
বাহ! ভারি মনকেমন একটা গল্প পড়লাম। নন-লিনিয়ার ফর্ম্যাটটাও বেশ লেগেছে।
আরও হোক।
অনেক ধন্যবাদ 🙂