বনলতা
লেখক: অদিতি সেন চট্টোপাধ্যায়
শিল্পী: অঙ্কিতা
আবার সেই পিঁ-পিঁ বিপ-বিপ শব্দ। আবার হচ্ছে সেই – মাথার মধ্যে কানের মধ্যে। অসহ্য যন্ত্রণায় যেন ফেটে যাচ্ছে সারা শরীর। রোজ কি একই সময়ে এটা হচ্ছে? এই নিয়ে কদিন যেন হল? তিন দিন, না কি চার দিন? ছুঁচ ফুটছে শরীরের সব নরম জায়গায়।
সে দম বন্ধ করে থাকলো কয়েক মিনিট। তাও মুক্তি কই! পরের স্টপেই নেমে পড়তে বাধ্য হল না পেরে। আর নামতেই তুমুল বৃষ্টি; এই নভেম্বরে বৃষ্টি! যেন বনলতাকে আরাম দিতেই। আহ!নিভে যাচ্ছে সব যন্ত্রণা। কান মাথা শুনছে বৃষ্টির শব্দ। এখান থেকে মাত্র দুটো স্টপেজ পরেই বাড়ি। সে হেঁটেই চলে যেতে পারবে। বৃষ্টি ভিজে ভিজে কতদিন হাঁটা হয়না। আজ হাঁটবে।
পরের স্টপেজ আসতে না আসতেই বৃষ্টি থেমে গেল। এদিকটা একদম শুকনো। ধুর!
নিজের মোবাইলে পাস ওয়ার্ড টাইপ করে দরজা খুললো বনলতা। কী কান্ড! দিদি এসেছে! মা আর দিদি দিব্ব্যি গল্প করতে করতে কফি খাচ্ছে।
“কখন এসেছিস রে দিদি? ফুটকি আসেনি? দাঁড়া, চেঞ্জ করে এসে বসছি তোদের সাথে। মা, কুট্টি কোথায়? ওদের ডাকো টেবিলে, এক্ষুণি আসছি আমি।”
“বনু রে! কেমন আছিস। আসলে কুট্টি আর ফুটকিকে নিয়ে একটু বেরল শুভ। মা দেখ, বনু টা একটুও পাল্টালো না। এখনও কেমন হই হই করে সবসময়।”
“না রে, আজকাল একটু টেনশনে দেখি মাঝে মাঝে। কী সব গণ্ডগোল চলছে ওর অফিসে। শরীরটাও বোধহয় ভালো নেই কদিন। আমি চিন্তা করব বলে কিছু বলে না। কিন্তু মায়ের চোখ তো…” চুপ করে গেলেন আভেরী; উঠে কফি মেকারটা চালু করে দিলেন।
“যাই বলো মা, ও আমার থেকে অনেক বেশি স্মার্ট, অনেকটাই প্র্যাক্টিক্যাল। নিজের জীবনটা নিজের মতো বাঁচতে জানে।”
“তুমিও তো তাই চেয়েছিলে, তোমার জীবন তোমার মতো করেই বাঁচতে, নীরা! আসলে সময় সব হিসেব পালটে দেয়। আমাদের হাতে কিছুই নেই। কৃত্রিমতা দিয়ে সুখ কিনতে পারো, কিন্তু শান্তি পাবে কি?, সেই কথা বিজ্ঞান কোনদিন বলতে পারে নি, পারবেও না।”
বনলতা ফিরে এসে টের পেল, ডাইনিং হলে একটা ঝড়ের পূর্বাভাস। থমথমে মুখে বসে আছে দিদি। মা নিশ্চুপে কফির কাপে চামচ নাড়াচ্ছেন।
“এই, দিদি, বাচ্চাদুটো কই?”
“বললাম যে, শুভ নিয়ে বেরোল একটু, শুনিসনি? তোর মেয়েটা বড্ড মিষ্টি হয়েছে রে।”
“ও। তা তোদের বিয়ের রেজিস্ট্রেশন তো এই মাসেই শেষ হয়ে যাচ্ছে। কী ভাবলি? রিনিউ করাবি? শুভ কী বলে?”
মেয়েদের কথা বলতে দিয়ে আভেরী গনগনে মুখে সোফায় গিয়ে বসলেন ডাইনিং টেবিল ছেড়ে। ওএলইডি টিভির রিমোট অন করতেই টিভি স্ক্রিন রোল খুলে নেমে এলো প্রায় মেঝে অবধি। এই সেট টা খুব পছন্দের আভেরীর। এই জন্মদিনে মেয়েদের কাছ থেকে পাওয়া উপহার। রিমোট অফ করলেই স্ক্রিন নিজেই আসন গুটোনোর মত গুটিয়ে ওপরে উঠে যায়। থ্রি ডি মোডে চালিয়ে দিল টিভিটা। মাথা ঠাণ্ডা করা দরকার আগে।
দুই বোন আড়চোখে দেখে নিল মাকে। বনলতা নীরার হাতের ওপর হাত রেখে খুব চুপিচুপি যেন ডাকল, “দিদি…”
নীরার দুই চোখ বেয়ে অবিশ্রান্ত অশ্রু গড়িয়ে নেমে ভিজিয়ে দিচ্ছিল তার গাল, চিবুক, জামা। টেবিল থেকে টিস্যু পেপার নিয়ে গাল চিবুক মুছতে মুছতে নীরা অস্ফুটে বলে উঠল, “আসলে বুঝতে পারিনি রে, আমিও কোনোদিন ভালোবেসে ফেলব। শুভ কিন্তু চায় নি যে আমরা রিনিউয়েবল ম্যারেজ অ্যাক্ট এ যাই। আমিই গোঁ ধরলাম। অপশন আছে যখন, কেনই বা সারাজীবনের জন্য বাঁধা পড়ব? যদি বোর হয়ে যাই? আমার ইচ্ছেতেই পাঁচ বছরের জন্য রেজিস্ট্রি করেছিলাম বিয়েটা।”
“প্রথম রিনিউয়ালের সময় কিন্তু কোনও ঝামেলাই হয়নি। মা অবশ্য খুব টেনশনে ছিল। এবারে শুভ চাইছে না আর, নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে তার। দ্যাখ দিদি, নাচতে নেমে ঘোমটা টানার আমি ঘোর বিরোধী, তুই জানিস। ভালোবেসে ফেলেছিস, বুঝলাম। তাই বলে সেটা জোর করে অন্যকে ধরে গিলিয়ে দিবি, তা তো আর হয় না! এখন শুভ নতুন কাউকে ভালবাসতেই পারে, বা নাও পারে, যাই হোক না কেন- সে আর তোর সঙ্গে থাকতে চাইছে না, এটা মেনে এবং মনে নেওয়াটা জরুরী। আর ফুটকির কথাটা তোরা আলোচনা করে নিয়েছিস তো? তাকে জানিয়েছিস?”
“হ্যাঁ,” ঘাড় নাড়ল নীরা। নাক টানল একবার; কফিতে চুমুক দিল অন্যমনস্ক ভাবে। “ওর কোনও রিয়াকশন বুঝতে পারলাম না।” একটু থেমে কী যেন হিসেব করল মনে মনে। “কত অপেক্ষা করেছিলাম মনের মতো সন্তানের জন্য। দু’বছর অপেক্ষা করেছিলাম স্পার্ম ফ্যাক্টরি থেকে ঠিকঠাক স্পার্ম পাবার জন্য। আমরা দুজনেই চেয়েছিলাম, আমাদের সন্তান ইনটেলিজেন্ট হবে।নীরোগ ও সুন্দর হবে। সেই মতই স্পার্ম বেছেছিলেন ডাক্তার। কিন্তু সেই মেয়ে যে এত আবেগহীন যন্ত্র হয়ে উঠবে, ভেবেছিলাম কি, বল? ভেবেছিলাম কখনও? ‘মা’ বলে ডাকেনা, হাসে না, খেলে না। গল্প করা মানে সময় নষ্ট এইটুকু একটা বাচ্চার কাছে। ভাবা যায়? হ্যাঁ, তুই আর মা বারণ করেছিলি, তোরা চেয়েছিলি স্বাভাবিক উপায়ে সন্তান আসুক আমাদের, কিন্তু কী করব, বল? দেখছিস তো, কী কম্পিটিশন চলছে এখন বাচ্চা নিয়ে। একটা মাত্র সন্তান নিতে পারব, তারপর ঠিকঠাক কোয়ালিটির না হলে…”
গা গুলিয়ে উঠল বনলতার। দিদি সন্তানের নয়, কোনও গ্যাজেটের আলোচনা করছে বলে মনে হল। ‘কী চায় এরা? যেমন চেয়েছিল, ফুটকি তো তেমনই! আবেগ কি চেয়েছিল ওরা? দিদি কী চায়, সে নিজেই জানেনা। মা তো পইপই করে বারণ করেছিল, যে, খোদার ওপর খোদকারী করতে যেওনা। কিছু জিনিস তার আপন সৃষ্টিপথেই চলতে দেওয়া ভালো। এই কৃত্রিম ডিএনএ দিয়ে তৈরী কৃত্রিম স্পার্ম, বিশ্বাস কি, যে সে তোমাদের সাথে স্বাভাবিক বন্ডিং তৈরী করতে পারবে? তখন তোমার মাতৃত্ব মাথা খুঁড়ে মরবে না তো?’
বনলতা মাঝে মাঝে ভাবে, মা কী করে যেন ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। মায়ের সব আশঙ্কাই কেমন করে সত্যি হয়ে ওঠে। ওরা বাবাকে দেখেনি। দেখলেও মনে নেই। দিদির মনে থাকলেও থাকতে পারে। দিদি তখন চার আর ও দুই বছরের। একদিন হঠাৎ আস্ত একটা মানুষ অফিসের জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফিরে আসেননি। ভ্যানিশ হয়ে গেছিলেন পঁয়ত্রিশ বছর আগে। সাপের মত আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা অসংখ্য সেতু আর চলমান গাড়ি নিয়ে নির্বিকার কলকাতার বুকে, এক প্রচণ্ড গ্রীষ্মের দিনে হারিয়ে গেলেন একজন জলজ্যান্ত মানুষ। থানা, পুলিশ, সাংবাদিক, গোয়েন্দা- বেশ কদিন গমগমে ছিল তাদের বাড়ি। তারপর সব চুপ।এই সবই সে পরে শুনেছে, পড়েছে। মা বলেছিলেন, বাবা যদি নিজে না চান, তবে তাঁকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। মায়ের এখনও বিশ্বাস, বাবা ফিরবেন একদিন না একদিন।
হুড়মুড় করে ঢুকল এসে ওরা তিনজন- শুভ, ফুটকি আর বনলতার মেয়ে কুট্টি। শুভর হাতে একটা ঢাউস স্যুটকেস।
“ওমা, এতবড় স্যুটকেস কোত্থেকে নিয়ে এলি, শুভ?”
সবাই খিলখিল হেসে উঠলো। -“ছাদে আয়” ,বলে শুভ সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল। ছাদে গিয়ে খুলে ফেলল স্যুটকেস ধাপে ধাপে। ওমা! কী সুন্দর চার সিটের গাড়ি একখানা!মাথায় সোলার-প্যানেল লাগানো।বাচ্চা মেয়ের মতো হাততালি দিয়ে উঠল বনলতা। শুভ বলল,“তোর পছন্দ?”
“দারুণ পছন্দ!এই গাড়িটা তোর ডিজাইন করা না?”
“ইয়েসসসস, ম্যাডাম!চড়াব একদিন তোকে,” বলে গাড়িটা ভাঁজ করে ফেলে আবার ইয়াব্বড় স্যুটকেস বানিয়ে ফেলল। ফুটকি আর কুট্টি দুজনে দিব্বি সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল।
“বাহ! তোর একটা ট্রিট পাওনা হল। তা, দিদি কী দিল তোকে? তোর নতুন আবিষ্কারের জন্য?”
“তোর দিদির কাছে আমি সামান্য এক গাড়ির ডিজাইনার, লতু। তোর দিদির ভাষায় পাতি মাল। সে তার সন্তানের জন্য তাই আমার স্পার্ম নেয়নি। তুই যখন আবীরের সাথে শুচ্ছিলি পেট বাধাবার জন্য, তোর দিদি পেট হবার ভয়ে আমাকেও কন্ডোম পরাচ্ছিল , নিজেও ক্যাপ পরছিল।”
বনলতার মুখ একটু বিকৃত হল। শুভ ওর থেকে দুই বছরের জুনিয়র ছিল কলেজে। বনলতা কলেজ পাস করতেই শুভ ‘কলেজ ফ্রম হোম’ অপশন নিয়েছিল। তখন মাঝে মাঝেই আসত ওদের বাড়ি। ওদের বাড়িটা ওদের পাড়ায় বেঁচে থাকা মাত্র ছটা বাড়ির একটা। বাকি সব ফ্ল্যাট বাড়ি হয়ে গেছে। দোতলার দক্ষিণের ঘরে একদিন বনলতা আবিষ্কার করেছিল শুভ আর দিদিকে। দরজা পুরো বন্ধ করেনি ওরা। বনলতার আজও মনে হয়, সেটা ইচ্ছে করেই। দিদির চরিত্রের মধ্যে এক হিংস্র, বুনো গন্ধ পেত ও। দখলের গন্ধ, আঁচড় কেটে সীমানা নির্দেশের গন্ধ। বনলতা সরে যেতে পারেনি দরজার সামনে থেকে। দেখছিল, আবার দেখছিলও না যেন। যেন ও নিজেকে আর শুভকেই দেখছিল। নীরা বলে কেউ ছিল না যেন সেখানে। কী ভাবে কখন নিজের ঘরে ফিরে এসেছিল, আজও মনে নেই। অনেক পরে টের পেয়েছিল, সে সম্পূর্ণ ভিজে গেছে। সেই রাতে আবীর ফোন করতে আধঘন্টা টানা কেঁদেছিল।
তার একদিন পর আবীরের সঙ্গে ডেটিং-এ গেছিল সে। কলকাতার পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম স্কাই হোটেলে আবীর নিয়ে গেছিল ওকে। শিশুর মতো খুশী হয়ে গেছিল বনলতা। আবীরের আদরে আদরে গলে যেতে যেতে টের পাচ্ছিল- কিচ্ছু হারায়নি ওর, কোথাও দুঃখ বলে কিছু নেই। না হারালে যে পাওয়াগুলো অসম্পূর্ণ থেকে যায়। মনে মনে দিদি আর শুভকে বলে দিয়েছিল-‘থ্যাংক ইউ!’
না, ও আরআবীর বিয়ে করেনি। মনেও আসেনি কোনোদিন বিয়ের কথা। যে যার কেরিয়ার নিয়ে এগিয়ে গেছে, অথচ বন্ধুত্বের হাত ছাড়িয়ে নেয়নি কেউ। বনলতা সন্তান চেয়েছিল। আবীর আপত্তি করেনি। কুট্টি ওদের সেই সন্তান – ভালোবাসার, আদরের, বন্ধুত্বের।আবীর আপাতত কানাডায় আছে। কিন্তু যোগাযোগ রাখে পুরোদস্তুর। কুট্টি ওদের জীবনের আনন্দ বন্ধন।
বাচ্চারা নেমে গেছে দুদ্দাড়িয়ে একতলায়। ওরাও নামছিল। ফার্স্ট ল্যান্ডিং-এ হঠাৎ শুভ এক হ্যাঁচকায় বনলতাকে কাছে টেনে আনল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই শুভর ঠোঁটের মধ্যে ঢুকে গেল ওর ঠোঁট। জামার মধ্যে থেকে একটা হাত টেনে বের করে আনল হিসহিসে স্তন। আর তখন, তখনই আবার সেই পিঁই-ইই বিপ-বিপ…জ্ঞান হারানোর মুহূর্তে টের পেল, একটা নীল আলো যেন ঘিরে ধরেছে ওকে।
একটা নীল আলো ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না বনলতা। ও কোথায়? নড়তে পারছে না কেন? কী ভীষণ অন্ধকার! কথাও বলতে পারছে না। জিভ অসাড়। সামনে নীল আলোর অনেকগুলো ওয়েভ তৈরি হচ্ছে।এবং কী আশ্চর্য, এ তো ব্রেন ম্যাপিং এর প্যাটার্ন! ও সব প্যাটার্ন বুঝতে পারছে! কেউ কথা বলতে চাইছে ওর সাথে, যোগাযোগ করতে চাইছে!
অনেক পাখির ডাকের সাথে আস্তে আস্তে চোখ খুলল বনলতা। হ্যাঁ, এ শহরে আবার নতুন করে পাখিরা সব ফিরে এসেছে, মনে পড়ল তার। সামনে মস্ত কাঁচের জানলা দিয়ে দেখতে পেল একটা টাওয়ার আর টাওয়ার ঘিরে ঝাঁকড়া মাথার সব গাছ।অদ্ভুত এক আবেশ ঘিরে আছে তাকে। খুব দুর্বল, অথচ সেই দুর্বলতাটাই ভালো লাগছে। সেই মুহূর্তেই সে তার কপালে একটা হাতের স্পর্শ পেল।
মা!
“কেমন লাগছে রে এখন?”
“ভালো।”
“দাঁড়া, ডঃ মুখার্জীকে জানিয়ে দিই। কাল সারারাত উনি তোকে রিমোট অবজারভেশনে রেখেছিলেন। খুব ক্লান্ত ছিলিস, না রে? অফিসে এত চাপ নিস না আর। কুট্টির কথা ভাব, সারারাত কেঁদেছে মেয়েটা তোর জ্ঞান আসছে না দেখে।”
মা উঠে যেতেই বনলতা ওঠার চেষ্টা করল। নাহ, সেরকম কোনও অসুবিধা হচ্ছেনা। দিব্ব্যি বিছানা থেকে উঠে ওর ওয়ার্কিং টেবিলের চেয়ারে গিয়ে বসল এবং পার্সোনাল কম্পিউটারের সমস্ত টার্মিনালগুলো চেক করে নিল।
ওর পুরো টেবিলটাই আসলে একটা ছোটখাটো ওয়ার্কস্টেশন। ব্রেন ম্যাপিং ওর অন্যতম নেশা। মানুষের চিন্তার ওয়েভকে ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক ওয়েভে পরিবর্তিত করা এবং প্যাটার্নগুলোকে রেকর্ড করে রাখা – এই পর্যন্ত সে করে ফেলেছে। কিন্তু রিসেপ্টর প্রান্তে সেটাকে আবার চিন্তায় পরিবর্তিত করতে পারেনি। এছাড়াও সে আশাবাদী, যে ভবিষ্যতে প্রত্যেক মস্তিষ্কের ওয়েভ সিগন্যাল মোবাইল নম্বরের মতো কোড হিসেবে স্টোর করা যাবে, এবং প্রেরক তার ইচ্ছে মতো চিন্তার তরঙ্গ পাঠাতে পারবে তার বাছাই করা গ্রাহকের কাছে।
গতকালের ঘটনাটা সেই বিষয়টির দিকেই যেন আঙুল তুলে দেখাচ্ছে। কেউ একজন সফল ভাবে এই কাজ করে ফেলেছে। তাকে চিন্তার তরঙ্গ পাঠিয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছে। কে সে? বনলতা স্থির হয়ে বসল, হেডফোনটা পরে নিল।কালকের ম্যাপিং প্যাটার্ন গুলো মনে করে করে ফিড করাল অ্যাপ্লিকেশনে। কিন্তু, এই ওয়েভ তার কাছে কী ভাবে পৌঁছল, এটা ভাবতেই আবার অস্থির হয়ে উঠল বনলতা। না, অস্থির হলে হবে না। সময় চাই তার – একান্ত, নিরিবিলি।
মা ফিরে এলো এই সময়। মা কিছু বলার আগেই বনলতা বলে দিল, সে এখন একা থাকতে চায়। কেউ যেন না আসে এ ঘরে। মা কী যেন দেখল মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে। তারপর ঘাড় নেড়ে নিশ্চুপে চলে গেল।
মা চলে যেতেই ও তার অসমাপ্ত মডেমের রিসেপ্টর এন্ড অন করে দিল। খটাখট প্যাটার্ন ফিড করতে থাকল একের পর এক। কতক্ষণ কেটেছে জানেনা, একঝাঁক নীলচে আলো ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। ও পড়তে পারছে, “বনলতা… বনলতা… আর্জেন্ট… এসো… ১৩ নম্বর বাড়ি… পার্ক টেরাস… একা… বিপদ… এসো… বনলতা…”
যেন গভীর অতল খাদ থেকে উঠে এসে চকিতে সোজা হয়ে বসল সে। হেডফোন খুলে রাখল। চোয়াল শক্ত। উঠল চেয়ার থেকে; দ্রুত পরে নিল জিন্স আর জ্যাকেট। পার্সোনাল পডের চাবিটি নিয়ে নেমে এলো নীচে। গাড়ি কেনেনি বনলতা। পাবলিক ট্রান্সপোর্টই ব্যবহার করে বেশি। খুব দরকার হলে তবেই এই বোম্বাই সাইজের হেলমেটের মতো দেখতে কাঁচে ঢাকা প্রাইভেট ট্রান্সপোর্ট পড নিয়ে বেরোয়।
একতলার হলঘরে মা দিদি আর শুভর উৎসুক চোখকে এড়িয়ে বেরিয়ে পড়ল বারান্দা থেকে পডটা নিয়ে। রাস্তায় পড়েই ডেস্টিনেশন ফিড করল – ১৩ নং পার্ক টেরাস। আজ শনিবার। এখন সকাল আটটা, রাস্তা মোটামুটি ফাঁকা। আধঘন্টার মাথায় পার্ক টেরাসে পৌঁছেও গেল। এবারে ১৩ নম্বর বাড়ি। এই তো, সাত নম্বর। আট, নয়, দশ, এগারো, বারো, চোদ্দ… চোদ্দ? তেরো কোথায়? বারোর পরেই চোদ্দ কেন? রাস্তাটা এইবার ইউটার্ন নিয়েছে। ও কি ঘুরে এসে আবার দেখবে? কিন্তু পডটা চলছে না। বন্ধ হয়ে গেল রাস্তার মধ্যে? না, এই তো, চলছে। কিন্তু ও কন্ট্রোল করতে পারছে না! কোনও কন্ট্রোল ওর হাতে নেই! ইউ টার্ন নিয়ে পড সেঁধিয়ে গেল ডানদিকের সরু গলিতে। খুলে গেল এক বন্ধ গ্যারাজের দরজা। পডের স্পিড বেড়ে গেছে।গ্যারাজ দিয়ে ঢুকে আবার অন্ধকার সরু গলির মত রাস্তা। চলছে তো চলছেই। বনলতা দম বন্ধ করে, চোয়াল শক্ত করে বসে আছে। তার মস্তিষ্ক এই মুহূর্তে সম্পূর্ণভাবে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।
বিশাল বড় এক হলঘরের মধ্যে এসে থেমে গেছে তার পড – কাঁচের প্যানেল দিয়ে ঘেরা, এয়ারকণ্ডিশনড, চারিদিকে শুধুই ইলেকট্রনিক যন্ত্র। কাঁচের ঢাকা খুলে পড থেকে নেমে দাঁড়াল বনলতা। প্রচুর লোকজন চারিদিকে। কিন্তু সবাই নিশ্চুপ, নিঃশব্দ। যে যার নিজের নিজের যন্ত্রে মগ্ন। তারা কেউ বনলতাকে যেন দেখতেই পেল না। বনলতা দেখল, এক বয়স্ক ব্যক্তি এগিয়ে আসছেন তার দিকে।
ভদ্রলোক হাত দিয়ে ঈশারা করলেন তাঁকে অনুসরণ করতে। অপার কৌতূহল নিয়ে সে এগিয়ে গেল। এটা একটা অফিস চেম্বারের মত। বড় টেবিলের একধারে চেয়ার টেনে উনি বনলতাকে বসতে দিলেন, নিজে বসলেন টেবিলের ওধারে।
“আমরা এখন যা যা কথা বলব, সব থট ওয়েভ দিয়ে। কারণ, আমার জিভ নেই। এখানে আমাদের কারোর জিভ নেই।”
বিষম, বিষম চমকে উঠল বনলতা!
“শোনো, গত তিন দশকের কিছু বেশি সময় আমরা এখানে আছি, মানে, আমাদের রাখা হয়েছে। সরকারী বিভিন্ন গোপন প্রোজেক্ট চলে এখানে। এই যে যাদের দেখছ এখানে, এরা সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বনামধন্য বিজ্ঞানী। এঁদের কথা বলার ক্ষমতাটি প্রথমেই কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সব মেশিন এবং সমস্ত কাগজপত্রের হিসেব সরকারের নিযুক্ত বিশেষ টিম দেখাশোনা করে। অতএব, কোনও ভাবেই এখান থেকে প্ল্যান ছকে পালানোর উপায় নেই।”
বিজ্ঞানী নিজের কপালের দুই দিক টিপে ধরেছেন। খানিক নিস্তব্ধতা। তারপর আবার শুনলো বনলতা। “আমার ওপর বর্তেছিল ডিএনএ ক্লোনিং এর কাজটি। যে সমস্ত মানুষ তার নিজের দলের প্রতি নয়, বরং গদিতে প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে আসছিল বারবার – সেই রকমই কিছু মানুষ আমার টিমকে সাপ্লাই দেওয়া হয়, যাতে তাদের ডিএনএ ম্যাপিং করে সেই ডিএনএর ক্লোন তৈরি করে দিতে পারে আমার টিম এই সরকারকে। এই ক্লোনড ডিএনএ ব্যাবহার করার সবচেয়ে সুবিধাজনক জায়গা হলো স্পার্ম ফ্যাক্টরিগুলো। সব স্পার্ম ফ্যাক্টরিই সরকারের হাতের মুঠোয় এখন। চাইলেই তাদের মগজধোলাই করতে পারবে। এছাড়াও আর কী কী প্রযুক্তির সাহায্য তারা নেবে, ভেবে আমি শিউরে উঠছি।”
ভদ্রলোক সত্যিই শিউরে উঠলেন একবার, দেখলো বনলতা।
“কিন্তু এরই মধ্যে আমি অন্য একটি ক্লোনও বানিয়ে ফেলেছি, গোপনেই। সেটি নিয়েই তোমার সাথে কথা বলার আছে। সেটি তোমার মাধ্যমে এখান থেকে পাচার করতে চাই। তবে, কীভাবে সেটি তুমি কাজে লাগাবে, সেটা তোমাকেই ঠিক করতে হবে। এবং আমি জানি তুমি সেটা পারবে।”
“কীভাবে জানলেন?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল বনলতা।
কিন্তু ভদ্রলোক এর উত্তর দিলেন না। স্মিত হাসলেন শুধু।
“জানি। এখন শোনো, এই ডিএনএ ক্লোনিং হলে ইম্পালসিভ সেক্সুয়াল প্লেজার থেকে মুক্তি পাবে মানুষ, কমে যাবে ধর্ষণের হার। আরও শোনো, সেরেটোনিন হরমোনের নাম শুনেছ নিশ্চয়ই? সেই সেরেটোনিনের ক্ষরণ বাড়িয়ে মানুষকে আনন্দ দেবে সহজেই। আর আনন্দে থাকলে মানুষের চাহিদা যাবে কমে, চাহিদা কমলে কমবে লোভ। মেয়েদের সুরক্ষা বেড়ে যাবে। এই ডি এন এর বেশিরভাগটাই আমি মহিলাদের থেকে সিন্থেসিস করেছি। এখন এর ভার তুমি নাও।”
একটা ছোট্ট পেন ড্রাইভের মতো জিনিস এগিয়ে দিলেন তিনি।
“এর মধ্যেই রয়েছে।”
বনলতা সেটি হাতে নিয়ে বসে রইল খানিকক্ষণ। তারপর প্রশ্ন করল, “এই কড়া নিরাপত্তার মধ্যে আপনি কী করে আমায় নিয়ে এলেন এখানে, তাও সবার চোখের সামনে দিয়ে? কীভাবে সম্ভব হলো?”
“হুম। আসলে নিরাপত্তাবাহিনীও কখনো কখনো আত্মতুষ্টিতে ভোগে। এই দিনটির জন্য বহু বহু বছর অপেক্ষা করেছি আমি এবং আমার মতো আরো কিছু বিজ্ঞানী, এই বন্দীশালায়। বহু বীভৎসতা প্রত্যক্ষ করেছি জিভ কেটে নেওয়া ছাড়াও। সবাই এখানে কমবেশি বিদ্রোহী এখন। তবে এই চিন্তার তরঙ্গ নিয়ে কাজটা একান্তই গোপন কাজ আমার।”
উনি উঠে দাঁড়ালেন। “আর বেশি দেরী করা যাবে না। তোমাকে যেতে হবে এখন।যাও। আলার্ট থেকো। আমাদের কথা হবে। এভাবেই…”
উঠে পড়ল বনলতা। পডের দিকে এগলো। উনি সঙ্গে এলেন। পডের ঢাকা বন্ধ করার ঠিক আগের মুহূর্তে ওঁর হাত ছুঁয়ে দিল বনলতার মাথা। ততক্ষণে পডের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গেছে। রিমোটশাসিত হয়ে সে অন্ধকার গলিপথ আর বন্ধ গ্যারেজের দরজা পেরিয়ে যখন পার্ক টেরাসের ঝলমলে রাস্তায় এসে আবার তার পডের কন্ট্রোল ফিরে পেল, তখন নভেম্বরের শীতে একসাথে রোদ আর বৃষ্টি খেলায় নেমেছে।
মগজ ভর্তি কিলবিলে অস্বস্তি নিয়ে বাড়ি ফিরল বনলতা। একটা প্রবল খচখচানি চলছে মনের মধ্যে। কিছু একটা ব্যাপার সে মিস করে যাচ্ছে। অথচ কী সেটা ধরতে পারছে না।
ওকে বাইরে থেকে ফিরতে দেখে সবাই হইহই করে উঠল। মা প্রায় ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন। কুট্টি চীৎকার করতে শুরু করল। আর আচমকাই বিদ্যুৎ ঝলকানির মতো বনলতার মনে পড়ল, বিজ্ঞানীর হাত যখন নিমেষের জন্য ওর মাথা ছুঁয়ে দিচ্ছিল, সেই হাতের কব্জিতে একটা উল্কি দেখেছিল সে, লেখা ছিল – ‘আভেরী’!
মাকে খুব খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বনলতা হু হু করে কেঁদে ফেলল।
Tags: অঙ্কিতা, অদিতি সেন চট্টোপাধ্যায়, কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ প্রথম সংখ্যা
Aha…..mon chuye gelo …..kalpobigyan niye pora eti amar tritiyo golpo….bigyaner sathe abeg ke je bhabe mishiye diyecho….Tate golpo ta mone geNthe thakbe…..
খুব ভালো লাগলো, কিন্তু মনে হল শেষ হলোনা যেন
অসাধারণ।।। এটি শুধু কল্প বিজ্ঞান নয়, এটি স্বপ্ন বিজ্ঞান