বাতাসে স্বপ্ন ভাসে
লেখক: পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়
শিল্পী: চিত্রা মিত্র
মাথায় তীব্র একটা যন্ত্রণা নিয়ে ঘুম ভাঙল মোহরের। কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। জমাট নিরেট অন্ধকার। ওঠার চেষ্টা করেও পারল না। হাত পা নড়ছে না। নরম কাদা কাদা কোন জায়গায় ও শুয়ে আছে। আমি কোথায়, কি করে এলাম? ভাবার চেষ্টা করল। নিরেট অন্ধকারের মতো নিরেট নিস্তব্ধতা। অগত্যা মোহর আবার চোখ বুজে ফেলল। যেখানে চেষ্টা করে লাভ নেই সেখানে বিনা চেষ্টায় পড়ে থাকাই ভাল। অযথা শক্তি ক্ষয় করে কী হবে?
যতদূর মনে পড়ে গতকাল মোহর অফিসে যায়নি। এমনিতে ইচ্ছেমতো ছুটি ও নিতে পারে না। পদমর্যাদার দিক দিয়ে মাঝারি স্তরের সরকারি আধিকারিক। কিন্তু পদটা এমনি যে ওর টেবিলে একদিনও কাজ ফেলে রাখা যায় না। গুরুতর সমস্যা ছাড়া ছুটি নেবার প্রশ্নই নেই। বছর বছর ক্যাজুয়াল লিভ, আর্নড লিভ পচে নষ্ট হয়। কিন্তু বছরের কয়েকটা দিন অফিসে যাবেনা বলে আগে থেকে বসকে জানিয়ে রাখে। যেমন কালীপুজোর আগের দিন, মায়ের মৃত্যুদিন আর এই বর্ষ শেষের দিন। গতকাল নিউ ইয়ারস পার্টিতে একটু বেশি মদ্যপান করে ফেলেছিল সে। ও খায় হয় রেড ওয়াইন নয় ভদকা। কাল হঠাৎ ওয়াইন খাবার পরেও স্কচ খেল আর বেশ কয়েকবার নিয়েছে। ফলে একটু বেহুঁশ হয়েছিল। রম্যানি বোধ হয় তাকে উবারে তুলে দিয়েছিল। উফ, সেই উবার চালক তাকে তার মানে এখানে এনে তুলেছে। কী করবে সে এখন? হাত নাড়াতে পারছেনা। মোবাইলটাও নিশ্চয়ই নিয়ে নিয়েছে। কেন যে হঠাৎ স্কচ চাখবার সাধ জাগল! কী করে এখন উদ্ধার পাবে এখান থেকে? ইদানীং একটু বেশি নেশাসক্ত হয়ে পড়েছে। মা চলে যাবার পর আরো বেশি জড়িয়ে পড়েছে। শাসন করার কেউ নেই। তাছাড়া বাড়ি ফেরার পর একাকিত্ব। মায়ের মৃত্যুর জন্যও তো নিজেকেই দায়ী মনে হয়। মা কেবল বলত তুই আর কুশল যদি দুজন দুজনকে ভালইবাসিস আর একসঙ্গে থাকিস তাহলে বিয়ে নয় কেন? তারপর যখন ফিরে এল সব চুকিয়ে তখন শুধু একদিনই বলেছিল- তুই তো নিজের কয়েক জন বন্ধুর মধ্যে নিজের জগতে থাকিস। কিছুই শুনতে পাস না, বুঝতে চাস না। কিন্তু আমাকে তো সমাজে চলতে হয়। বিয়ে ভাঙাও খারাপ। কিন্তু তোর এই ঘটনাটার ফলে তোর স্ট্যাটাসটা কি দাঁড়াল তা জানিস? যতই ভাল চাকরি করিস, লোকে তোকে একটি ছেলের হাতফেরতা মেয়ে ছাড়া কিস্যু ভাববে না। মোহর তখন বলেছিল- মা, তুমি যখন অত অল্প বয়েসে একটা শিশু বুকে নিয়ে বিধবা হয়েছিলে সেদিন ওই সমাজ খাওয়ায়নি পরায়নি। তোমাকেই বহু পুরানো সার্টিফিকেট গুলো বার করে চাকরি খুঁজতে বেরোতে হয়েছিল। আজ আর আমাদের কাউকে দরকার নেই। ব্যস, সেই যে মা চুপ করে গেছিল আর ওর ব্যাপারে কখনো কথা বলেনি। ওই চুপ করে যাবার চাপেই বোধ হয় একদিন অসুখ নেই বিসুখ নেই টুপ করে খসে পড়ল। এত কিছু ঘটে গেল কিন্তু তবুও মোহর ভুলতে পারেনি একটা আধো দেখা স্বপ্নের কথা। স্বপ্ন? হ্যাঁ, স্বপ্নই তো। ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমিয়ে পড়ে ক্লান্ত মোহর।
***
এবারে যখন ঘুম ভাঙে তখন হাত পা নাড়তে পারছে। জমাট অন্ধকার কেটে একদিকের দেওয়ালে ভেসে উঠল ছবি ও স্বর। এক সুশ্রী মহিলার মুখ।
“সুপ্রভাত। অন্য স্বপ্নের দেশে স্বাগত। আপনি এসেছেন বায়ুমন্ডলের অস্তিত্বের অন্য একটা স্তরে। আপনাকে সহজ করে বোঝাতে চেষ্টা করছি। মন দিয়ে শুনুন।
ধরুন, একটা পিঁপড়ে কি একটা গোটা হাতি বা গন্ডার বা জিরাফ বা মানুষের দেহ কল্পনা করতে পারে? অথচ তারা আছে একই পৃথিবীর মাটিতে। অথবা ধরুন যেখানে কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না সেখানে অণুবীক্ষণ ধরলে দেখতে পাবেন কোটি কোটি প্রাণ। যেমন ধরুন কুকুর যে শব্দ শুনতে পায় বা যে গন্ধ পায় তা মানুষ পায় না। অথচ গন্ধ বা শব্দের উৎস দুজনের সামনেই রয়েছে। তেমনই বায়ুমন্ডলে একই সঙ্গে অনেকগুলো স্তর রয়েছে। প্রত্যেক স্তরে পৃথক পৃথক প্রাণী, বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব রয়েছে। প্রত্যেক স্তরের প্রাণী ভাবে যে শুধু তারাই রয়েছে। অন্য স্তরের খবর তারা রাখে না। মাঝে মধ্যে এক স্তরের সঙ্গে অন্য স্তরের ধাক্কা লেগে যায়। সেটা বিপর্যয়। দুটো গাড়ির ধাক্কার মতো। তখনই শুধু দুটো স্তরের প্রাণীর হঠাৎ দেখা হয়ে যায়।
আপনি ভাবছেন এসব পাগলামির কথা। পাগলের পাল্লায় পড়েছেন। ড্রাইভারটা বদ। আপনাকে এখানে এনেছে। তা নয় ম্যাডাম। আপনি আসলে আছেন আপনারই বাড়ির সামনে। যেখানে ড্রাইভার নামিয়ে দিয়েছিল। কেবল অন্য একটা স্তরে। আপনি ছোটোদের কল্পবিজ্ঞানের গল্পে টাইম মেশিনের কথা পড়েছেন তো? একই জায়গায় দাঁড়িয়ে টাইম মেশিনে চড়ে সেই জায়গারই অন্য সময়ে অন্য কালে পৌঁছনর কথা জানেন তো? এটা সেরকমই। কিন্তু অন্য সময়ে আপনি পৌঁছননি। কাল একত্রিশে ডিসেম্বর দুহাজার আঠারো তে আপনি এখানে এসেছেন। এখন পয়লা জানুয়ারি দুহাজার উনিশের সকাল। আপনার বাড়ির সামনের সকাল। আপনার স্তরে এখন হইচই চলছে, নতুন বছর পালন হচ্ছে। আপনি এখন ঠিক সেখানেই আছেন। কিন্তু বায়ু লোকের অন্য স্তরে। অন্য জোনে।
রেডিয়োতে যেমন নব ঘুরিয়ে একটা শব্দ তরঙ্গের থেকে আরেকটা শব্দ তরঙ্গের স্তরে চলে যান, টিভিতে যেমন এক অনুষ্ঠান থেকে অন্য অনুষ্ঠানে, তেমনই একটা মেশিন আমি আবিষ্কার করেছি যাতে বায়ুমন্ডলের এক স্তর থেকে আরেক স্তরে যাওয়া যায়।
আমি কিন্তু আপনার বায়ুস্তরেরই লোক। আপনার অঞ্চলের। এই মেশিনটা আবিষ্কার করার পর দেখলাম কাছাকাছি বেশিরভাগ বায়ুস্তরে বিভিন্ন প্রাণের বসতি আছে। ডাকিনী যোগিনী হাঁকিনি এসব কিন্তু কল্পনা নয়। এদের রাজ্য সত্যিই আছে। অনেক ঘুরতে ঘুরতে এই স্তরটাই ফাঁকা পেলাম। তারপর এখানে গড়ে তুললাম আমার বসতি। বলতে পারেন আমি এই স্তরটারও স্রষ্টা। একমাত্র আমিই অনেকগুলো স্তরে যাতায়াত করতে পারি। কাউকে নিয়ে আসতে পারি, ফেরত পাঠাতে পারি। কিন্তু আমি স্থায়ী ভাবে এখানে কাউকে রাখি না। শুধু থাকে আমার সৃষ্টি করা প্রাণ। এখানে আমার বিরাট ল্যাবরেটরি। এখানে আমি প্রাণ সৃষ্টি করি।
এতক্ষণের কথাবার্তায় মোহরের মনে হচ্ছিল সে কি পাগল হয়ে গেল নাকি অ্যাক্সিডেন্টে মরেই গেল। এখন ফেরত পাঠানোর কথায় তার ধড়ে প্রাণ এল। যাক বাবা, পাগলিটা তাকে আবার বাড়ি পৌঁছে দেবে। তাই নিশ্চিন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করতে পারল “ আমাকে এনেছেন কেন? আমি কি করেছি?”
স্ক্রিনের মানবী হেসে উঠলেন। “সেকি? কিছু করবেন কেন? এখানে বেড়াতে এসেছেন। কাল রাত থেকে কিছু খাননি। আপনি আগে সুস্থ হোন। তারপর আবার কথা হবে।”
বাবারে বাবা, আরও কত কথা আছে ভদ্রমহিলার? কথা বলার জন্য আর কাউকে মনে ধরল না?
স্ক্রিনের আলো নিবে গেল। কিন্তু এবারে চারপাশে আলো জ্বলে উঠল। দেখল সে একটা সুন্দর ঘরের মধ্যে রয়েছে। একটা বিছানায়। বিছানাটা জেলির মতো থলথলে নরম কাদাকাদা গোলাপি। কিন্তু গায়ে লেগে যাচ্ছে না। কিছুটা চেষ্টার পর মোহর উঠে বসল। দেখল একটা টেবিল হেঁটে হেঁটে ওর দিকে এগিয়ে আসছে। ও ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল। ওকে ভয় পেতে দেখে টেবিলটা থেমে গেল। একটা পায়া শুঁড়ের মতো টেবিলের পিঠে গিয়ে খাবারটা নিয়ে খাটের ওপর রাখল। তারপর হেলেদুলে একটা দেওয়ালের কাছে যেতে দেওয়ালটা দুভাগ হয়ে গেল আর টেবিলটা সুড়ুত করে গলে ওপারে চলে যেতেই দেওয়াল জোড়া লেগে গেল। খাবারের দিকে তাকিয়ে দেখল খাবারটা চেনাজানা। কিছু ফলমূল আর সবজি। ওর খুব খিদে পেয়েছিল। তাই আর অপেক্ষা না করে খেয়েই নিল।
আবার দেওয়াল খুলে গেল। এবারে একজন মহিলা হেসে তার খাবারের ট্রে তুলে নিয়ে বলল, “সরি ম্যাডাম, আপনার কাছে টেবিলটাকে পাঠান উচিত হয়নি। আমি বুবুন। ওই টেবিলটা একটা কম্পিউটার । আপনি ওয়াশ রুমে যাবেন তো? আসুন।”
অনেকক্ষণ পর মাটিতে পা ফেলল মোহর । বুঝতেই পারছে না এসব ওয়াইন স্কচ সব একসঙ্গে খাবার ফলাফল জনিত বিকার দেখছে না স্বপ্ন দেখছে। বুবুন নাম্নী মহিলা ওকে আরেক দিকের দেওয়ালের গায়ে নিয়ে যেতে সেটা খুলে গেল। ও দেখল টয়লেট মোটামুটি ঠিকঠাক। তবে বুবুন বলল যে টয়লেটের বর্জ্য মুহূর্তের মধ্যে ফরমেশন চেঞ্জ করে কোন প্রয়োজনীয় গ্যাস এ পরিণত হয়ে পাইপ বেয়ে গিয়ে অন্য জরুরী পরিষেবায় কাজে লাগবে। ব্যবহৃত জলও মুহূর্তেই পরিশুদ্ধ হয়ে সাইক্লিক অর্ডারে ফিরে আসবে।
ওয়াশ রুমের কাজ সেরে ঘরে ফিরতে মোহর দেখল খাটটা গুটিশুটি মেরে সোফা হয়ে গেছে। এবারে ভয় পাবার আগেই বুবুন ঘরে এসে বলল “ওটা জেলি। ওটাকে অনেক কাজে ব্যবহার করা হয়। এটাও যন্ত্র। চলুন আপনাকে এই শহরটা ঘুরিয়ে দেখাই।”
মোহর মহিলার পেছন পেছন দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে গলে একটা কাচে ঢাকা ব্যালকনিতে দাঁড়াল। চওড়া একটা হাইওয়ে দিয়ে শাঁ শাঁ করে চলেছে কয়েকটা বাড়ি। দূরে শস্য ক্ষেত, পুকুর এসব দেখা যাচ্ছে। তাদের বাড়িটিও চলছে। বুবুন বলতে বলতে চলেছে “এখানকার প্রকৃত বাসিন্দাদের বয়েস আটের নীচে। ম্যাডাম, মানে যিনি আপনার সঙ্গে কথা বললেন, তিনি দশ বছর আগে এখানে এসেছেন আর আট বছর আগে ওদের তৈরি করতে পেরেছেন। আর আছে কিছু রোবট আর আমরা ওঁর কিছু ছাত্রছাত্রী বা এসিস্ট্যান্ট। আমরা স্বেচ্ছায় ওঁর সঙ্গে এসেছি। আর ফিরে যাব না। আপনাদের স্তরে আমরা এখন নিরুদ্দিষ্টের দলে। যাদের কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।”
বুবুন বলে চলেছে, “এখানে বাড়ি গুলোই ব্যাটারি চালিত। কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত। আলাদা করে গাড়ি লাগেনা। এখন আমরা যাচ্ছি ল্যাবরেটরিতে।”
বলতে বলতে এক বিরাট বাড়ির গায়ে এই বাড়িটা লাগল। ব্যালকনি থেকে সিঁড়ি বেরিয়ে লেগে গেল ওই বাড়ির ল্যান্ডিং এ। ওই বাড়ির গেটে পৌঁছে বুবুন পাসওয়ার্ড টাইপ করতেই দরজা খুলে গেল। প্রথম ঘরটা সাজানো গোছান একটা হল। তারপর সারে সারে ঘর। এক এক ঘরে এক এক রকম মেশিন পত্র, শিশি বোতল। অনেকে কাজ করছে। বুবুন জানাল যে ওগুলো সব রোবট। একটা ঘরে ঢুকে তারা দেখল নানা আকৃতির বিশাল বড় বড় কাচের জারে, বয়ামে, টিউবে নানা ভ্রূণের উপস্থিতি।
“এই ঘরটিই বিশেষ করে আপনাকে দেখানোর কথা। ম্যাডাম পরে আপনার সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলে নেবেন। “বুবুন খুব বিনয়ী ভাবে জানাল। মোহরের মাথা বনবন করে ঘুরছিল। ও বলল “এবারে কি ফিরতে পারি?”
ফেরার পর মোহর সোফা জেলিতে বসতেই ঘর আবার অন্ধকার হয়ে গেল। তবে মোহরের আর তত ভয় লাগছে না। ও বুঝে গেছে কোন কারনে তাকে এখানে আনা হয়েছে। দরকার মিটলেই তাকে আবার নিজের বাড়িতে ফেরত পাঠাবে।
স্ক্রিনে আবার সেই মুখ। “আমি স্বপ্না। স্বপ্না বিশ্বাস। পিতৃদত্ত নাম নয়। অবশ্য আমার পিতাই নেই। অনাথ আশ্রমে মানুষ। আমি মাধ্যমিক পরীক্ষার সময়ে নিজেই নিজের নাম আর পদবী স্থির করি। মানুষের স্বপ্নতে মানুষকে বিশ্বাস করাব এই ইচ্ছা নিয়ে এই নাম নিয়েছিলাম।” একটু থামলেন তিনি। একটু দীর্ঘশ্বাস পড়ল কি? নামটা চেনা চেনা ঠেকল। কোথাও শুনেছিল কি?
“নিজের চেষ্টায় বিজ্ঞানে অনেকদূর এগিয়েছিলাম” আবার শুরু করলেন তিনি, “প্রচুর দেশি বিদেশি পুরস্কার, অনেক টাকা, সম্পদ পেয়েছি বিভিন্ন আবিষ্কারের পেটেন্ট বিক্রি করে। তারপর দশ বছর আগে এক বিজ্ঞান সম্মেলন থেকে আমাকে বিতাড়িত করা হয় পাগলি বলে। ওই সম্মেলনেই আমি বায়ুমন্ডলে বিভিন্ন স্তরের উপস্থিতির কথা বলেছিলাম। তত দিনে আমি অন্য স্তরে যাবার যন্ত্র আবিষ্কার করে দু একটা স্তরে ঘুরেও এসেছি। আমি ভেবেছিলাম এর ফলে বসবাস সমস্যার অনেকটা সমাধান হবে। আর মহাকাশে বাসোপযোগী অন্য গ্রহ খুঁজে বেড়াতে হবে না। কিন্তু কেউ শুনল না। দু একজন আগ্রহী থাকলেও তারা লবিবাজিতে আমাকে জেতাতে পারল না। আসলে বিজ্ঞানের প্রথম কথা হল মনটা খোলা রাখতে হবে। যে কোন সম্ভাব্যতার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আগে থেকে মনের মধ্যে কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে রাখা বিজ্ঞানের পক্ষে ক্ষতিকর। আর সেই সম্মেলনে বেশিরভাগ সদস্য আসলে বদ্ধ মনের মানুষ ছিল। তারা বলল ঠিক সময়ে বিয়ে টিয়ে না হয়ে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তাড়িয়ে দিল। শুধু ঐ সম্মেলন থেকেই নয়, কাজের ক্ষেত্র থেকেও। আমার জন্য কিছু পুরুষের সমস্যা হচ্ছিল। তারা এই সুযোগটা নিল। আমি মানুষের বিন্দুমাত্র ক্ষতি হতে পারে এমন কোন বিষয় নিয়ে কাজ করতে চাইতাম না। একগুঁয়ে ছিলাম। তাই কিছুটা একজোট হয়ে তাড়াল। বুঝল না মানুষের কত উপকার হত আমার কথাটা শুনলে।” স্বপ্না আবার একটা শ্বাস ফেললেন। সঙ্গে সঙ্গে মোহরেরও অনেক কিছুই মনে পড়ে গেল। হ্যাঁ, এই জন্যই নামটা চেনা চেনা লাগছিল। বছর দশেক আগে বিরাট একটা হই চই শুনেছিল এই নামটা নিয়ে। বড়রা বলতেন যে বাঙালির প্রতিভা এমনিতেই কেউ মেনে নেয় না। তার ওপর মেয়ে – অনাথ আশ্রমে বড় হওয়া মেয়ে, অবিবাহিত। এত দূর উঠেছে স্রেফ প্রতিভার জোরে। কেউ মেনে নিতে পারছে না। তাই ছল ছুতোয় সরিয়ে দিল লাইম লাইট থেকে, কাজ থেকে। তারপর একসময় শোনা গেল তিনি নাকি নিরুদ্দিষ্ট। তার ছাত্র ছাত্রীরাও কেউ কেউ মাঝে মধ্যেই গায়েব হয়ে যেতে লাগল। সকলে বলতে লাগল ওঁর কোন ফরমুলা পাবার জন্য কোন বিদেশি চক্র সবাইকে গাপ করে দিচ্ছে। তারপর কালের নিয়মে সে সব নিয়ে মাথা ঘামানো এক সময়ে বন্ধ হয়ে গেল।
স্বপ্না আবার বলতে শুরু করলেন “আমার তৈরি করা জিনিস পত্র আর কাছের ছাত্র ছাত্রীদের নিয়ে এখানে চলে এলাম। এখানে এসে কিন্তু আমি সম্পূর্ণ অন্য কাজে ডুবে গেলাম। আর সেই কাজেও আমি সফল। সেই কাজটা দেখাতেই আপনাকে এখানে আনা। আমি ভেবেছিলাম এই স্তরে কেউ কেউ বসবাস করতে এলে বাসস্থান সমস্যার অনেকটাই সমাধান হবে। কিন্তু কেউ যখন বিশ্বাসই করল না তখন ভাবলাম নিজেই এখানে জনবসতি তৈরি করব। আমরা মায়ের জাত। নিজে মা হই না হই, একটা বসতি তৈরি করা খুব কি এমন কঠিন হবে?”
মোহর ভাবছিল- আমি কেন? আমি তো কোন বিজ্ঞান গবেষক নই। মোহরের ভাবনা বুঝে বা না বুঝে স্বপ্না বলেই চললেন “এখানে এসে আমি যে কাজটা শুরু করেছিলাম তা হল ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃত গর্ভপাতের ফলে যে ভ্রূণ অসময়ে মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়ে যায় তাদের আবার স্থানান্তরে বাঁচিয়ে তুলে বড় করা যায় কি না। যেমন চারাগাছ উপড়ে এনে অন্য জায়গায় বসালেও তারা বড় হয়।”
এবারে মোহরের বুক চিনচিন করে উঠল। ভোলেনি, মোহর ভোলেনি। সে যে বড় আপন হয়ে উঠেছিল কয়েকমাসেই। মোহরের আত্মার অংশ হয়ে গেছিল সে। অথচ কুশল চায়নি বলে চালাকি করে নষ্ট করিয়ে দিয়েছিল। একদিন ঘুম ভেঙে মোহর নিজেকে কুশলের এক বন্ধুর নার্সিং হোমে আবিষ্কার করেছিল। ততক্ষণে সব শেষ। সেই থেকে কুশলের সঙ্গেও সম্পর্ক শেষ। সম্পূর্ণ একা মোহর।
ওদিকে স্বপ্না তখন বলে চলেছেন “আমার ছোট্ট ক্ষমতা। বেশি লোকবল নেই, অর্থবল নেই। তাই সব নষ্ট ভ্রূণ কে আবার পুনর্নির্মাণ করতে পারি না। নার্সিং হোম গুলোর কাছাকাছি গারবেজ থেকে কিছু সংগ্রহ করি। কিছু সংগ্রহ করি স্টাফদের হাত করে। তাদেরই বাঁচিয়ে তুলেছি। এখানে যত বাচ্চা দেখবেন তারা কেউ জন্মাতই না। আমি এদের যত্ন করে জন্ম দিয়েছি। এবারে আপনাদের স্তরের সঙ্গে এই স্তরের একটা স্থায়ী প্যাসেজ তৈরি করতে হবে। আস্তে আস্তে সেই সব বৈজ্ঞানিককে এখানে নিয়ে আসব যারা আমাকে কর্মক্ষেত্র থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল পাগল বলে। ভাগ্যিস ততদিনে অন্য অনেক পুরস্কার বাবদ আর কিছু আবিষ্কারের পেটেন্ট বিক্রি করে বেশ কিছু টাকা করে নিতে পেরেছিলাম। কিছু ধনী শিল্পপতিকেও আনতে হবে। ফান্ড চাই। সত্যিকারের জনবসতি গড়ে তুলতে হবে, অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে। এই শিশু গুলোর ভবিষ্যত তৈরি করতে হবে। আমার নিরুদ্দিষ্ট ছাত্রছাত্রীদের এগিয়ে দিতে হবে তাদের সম্মানিত ভবিষ্যতের দিকে। আমি আর কদিন থাকব? আপনাকে এখানে আনার কারন কি জানেন? আপনার না-জন্মানো বাচ্চার জন্য আপনি খুব কেঁদেছিলেন। এখনও কাঁদেন। আমাদের রাডারে সব ধরা পড়ে। কাল আপনাকে আপনার বাচ্চা দেখাব।”
“না না। আজ আজ এখনই, এক্ষুনি দেখতে চাই তাকে।“ চিৎকার করে ওঠে মোহর। তৎক্ষণাৎ স্ক্রিনে ফুটে ওঠে এক বছর পাঁচেকের বাচ্চার মুখ। মিষ্টি একটা মেয়ে বাচ্চা।“ দিন দিন। ওকে দিন। আমি নিয়ে যাব ওকে। ওরে আমি তোর মা রে।“ হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে মোহর। সঙ্গে সঙ্গে স্ক্রিন থেকে বাচ্চার মুখ চলে যায় । ফিরে আসে ডঃ স্বপ্নার মুখ। “শান্ত হোন, আপনি শান্ত হোন। ওকে আপনার কাছে এখন নিয়ে যাব না। আপনি দুর্বল হয়ে পড়বেন । আগে বিশ্বের কাছে দেখাই আমার সৃষ্টি । ওরা ভাল আছে। মনে করুন ওরা এক শিশু হোস্টেলে আছে। আরও যে সব মা তাদের বাচ্চাদের বাঁচাতে চেয়েছিল তাদেরও এক এক করে এখানে এনে দেখিয়ে দেব তাদের সন্তানদের। আপনি এখন স্থির হোন। আপনাকেই আমরা প্রথম এনেছি। কারন আপনার ব্যাক গ্রাউন্ড বলছে আপনিই এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রগতিশীল, যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক, পরিণত মনের মানবী। আপনার কাছে ঠিক সময়ে দিয়ে আসব আপনার মেয়েকে। এতদিন কত কষ্ট পেতেন ওকে জন্ম দিতে পারেননি বলে। এখন তো মন শান্ত হল। ও ভাল আছে।“
ধীরে ধীরে স্ক্রিন অন্ধকার হয়ে গেল আর সোফাজেলিতে বসে কাঁদতে কাঁদতে মোহর ঘুমিয়ে পড়ল।
***
ঘুম যখন ভাঙল তখন মোহর তার বাড়ির সামনের সিঁড়ির ধাপে হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে। সদ্য ভোরের আলো ফুটছে । ভাবল “বড় অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম তো। সবসময় ভাবি ওর কথা। কাল মাত্রাতিরিক্ত মদ্য পান করে আবোলতাবোল স্বপ্ন দেখেছি। ট্যাক্সি ড্রাইভার এখানে নামিয়ে দেবার পর এখানেই বসে বসে ঘুমিয়েছি এই ঠান্ডায়। এই জন্যই ওই জেলি খাটটাকে অত ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছিল।” ভাবতে গিয়ে ফিক করে আপন মনে একটু হেসেও ফেলল মোহর।
প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে দেখল মোবাইল, চাবি সব ঠিকঠাক ই আছে। তালা খুলে ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই এসে গেল মানিকের মা। বলল “কি গো দিদি, কাল থাকবেনি বলনি তো ? ফাস্টো জানুয়ারী শুধু শুধু কাজে এনু। তোমার কষ্ট হবে ভেইব্যে আসি। নইলে ফাস্টো জানুয়ারী অন্য কারো ঘরে যাই নে কো। কি হাল হইয়েছে দেখ চেহারার। এই ফিরলে নাকি গো? যাও যাও হাত মুখ ধোও। কফি করে দিই। অফিস যাবে নাকি আজ যাবে নি কো?”
মোহর ততক্ষণে অবাক। তাহলে ওসব স্বপ্ন নয়? সে গোটা একটা দিন মিসিং ছিল?
নিজেকে সামলে নিয়ে মোহর বলল “যাও মাসি কড়া করে কফি করে দাও। আজ শরীরটা খারাপ লাগছে। জ্বর জ্বর ভাব। বেরোব না। ঘুমোব।”
“হ্যাঁ। তা তো হবেই। এত অত্যেচার শরীলে সয়? মা থাকলে এত সব হত? মাসির কথাটা আর গেরাহ্যি হবে কেন?” মানিকের মা আপন মনে গজগজ করতে করতে কাজে লেগে যায়। আর মোহর হাঁ করে তাকিয়ে থাকে গতবছরের ক্যালেন্ডারের দিকে। নতুন বছরের ক্যালেন্ডার এখনও হাতে আসেনি।
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, চিত্রা মিত্র, পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায়
সুন্দর গল্প। শুধু বায়ুমণ্ডলের স্তর টা অন্য ডাইমেনশন করে দিলেই কল্পবিজ্ঞান হিসেবে দারুণ।
Excellent. Science fiction er moddhye manobik anubhuti mishe daarun matra diyechhe galpotike. Khub bhalo laaglo . Dhonnyobad.