বাড়ি
লেখক: ঋজু গাঙ্গুলী
শিল্পী: সুমন দাস
গুজরাটে থাকার সময় বিল্ডার মিরচন্দানি নিজের জীবন নিয়ে একটা ঘটনা আমায় বলেছিলেন। যেহেতু ব্যাপারটার সত্যাসত্য নিয়ে আমি কিছু বলতে পারব না, তাই সেটা গল্প হিসেবেই লিখলাম, ওনার বয়ানে।
“বিল্ডাররা যে লাইনটাকে বিজ্ঞাপন হিসেবে সবথেকে বেশি ব্যবহার করে সেটা হল – আপনার স্বপ্নের বাড়ি এবার আপনার সাধ্যের মধ্যে। কিন্তু স্বপ্নের বাড়ি জিনিসটা ঠিক কী?
আমরা সবাই জানি যে এই স্বপ্ন হল আসলে দিবাস্বপ্ন, বা খেয়াল, বা শখ। সিনেমা, সিরিয়াল, বই, প্রতিবেশী, সহকর্মী, এমন সব সূত্র থেকে যেসব বাড়ির কথা আমরা জানতে বা দেখতে পারি, তাদের কিছু-কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমাদের মনে একটা বাড়ির ডিজাইন গড়ে ওঠে।
কিন্তু সত্যিই কি কেউ স্বপ্নে একটা বাড়ি দেখে?
আমি দেখেছিলাম। অনেক-অনেক বার। সেই স্বপ্নে দেখা বাড়ি নিয়ে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেটাই আপনাকে বলব আজ।
আমি যখন খুব ছোটো তখন পার্টিশন হয়। আমাদের দেশ, মানে সিন্ধ চলে যায় পাকিস্তানে। সেই দাঙ্গা আর রক্তপাতের স্মৃতি আমার নেই। আমার বাবা মিলিটারি কন্ট্রাক্টর ছিলেন বলেই হয়তো কোনভাবে তিনি মা আর আমাকে নিয়ে নিরাপদে ইন্ডিয়াতে চলে আসতে পারেন, তবে পরিবারের অন্যরা কেউই অতটা ভাগ্যবান ছিলেন না।
একমাত্র সন্তান হলেও খুব ছোটো থেকেই বাবা-মা’র সঙ্গে আমার একটা দূরত্ব ছিল। আসলে, যখনই আমি নাদিয়াদের ঘিঞ্জি মহল্লার ছোট্ট বাড়িটা আর হাজার একটা সমস্যার থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্যে আমাদের ফেলে আসা মুল্কের কথা জানতে চাইতাম, তখনই বাবা আর মা চুপ করে যেতেন। একদা আমরা সিন্ধের বাসিন্দা ছিলাম, এ ছাড়া অন্য সব বিষয়ে আমাদের অতীতের ওপর একটা পর্দা টেনে দিয়েছিলেন বাবা আর মা।
ফেলে আসা ঘর বা দিনের সঙ্গে তাঁদের নিত্যকার জীবনের কোন সম্পর্কই ছিল না। তাছাড়া, মিলিটারির সঙ্গে পেশাগত সম্পর্ক ছিল বলেই বোধহয় বাবার মধ্যে প্রথাগত ধর্ম বা আচার নিয়ে কোন মাতামাতি বা উগ্রতা দেখিনি। বাবার শোয়ার খাটের পাশে শুধু একটা ছোট্ট চৌকিতে একটা লাল কাপড় সযত্নে ভাঁজ করা থাকত, যার ওপরে আমাদের বাড়ির গীতাটা রাখা থাকত।
বাবা খুব গম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন, আর মা ছিলেন একটু ভীতু আর খুব নরম মনের, যাঁকে কিছু বললে আগে মানসিক প্রস্তুতি নিতে হত বিষয়টা নিয়ে এক দফা কান্নাকাটির জন্যে। হয়তো সেই জন্যেই ছোটোবেলা থেকে আমি যে স্বপ্নটা দেখতাম, সেটা নিয়ে আমি তাঁদের কিছু বলতে পারিনি।
আমি একটা বাড়ির স্বপ্ন দেখতাম। একটা রুক্ষ মাঠ। তার সীমায় জলছবির মতো আবছা হয়ে আছে গাছের রেখা। মাঠটার মধ্য কয়েকটা ক্ষয়ে যাওয়া চেহারার কাঁটা-কাঁটা গাছ। আর সেই গাছগুলোর পাশে একটা একতলা, কিন্তু অনেকটা জায়গা নিয়ে ছড়ানো বাড়ি। বাড়িটার একদিকে একটা ছোট্ট ঘর একটু আলাদা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকত, যার মাথায় একটা নিশান উড়তে দেখতাম, যেমনটা থাকে মন্দিরে। বাড়িটা, এবং তার আশপাশের পৃথিবী একেবারে জনহীন মনে হত। কিন্তু স্বপ্নেও আমি বুঝতে পারতাম, ওই বাড়িটাতে এমন কেউ আছে যে আমায় চেনে, আর যে আমার খোঁজ করছে। আমি স্বপ্নের মধ্যেও বাড়িটা থেকে ভেসে আসা জলের ছোঁয়া পেতাম, যেন বাড়িটার পাশেই আছে একটা বাওলি (ধাপ-ধাপ কেটে নিচে নেমে যাওয়া কুয়ো, যাতে বৃষ্টির জল জমিয়ে রাখা হত)। সেই বাওলির জলের ছোঁয়ায় আমার ঘুম ভেঙে যেত।
বড়ো হয়ে মোটামুটি পড়াশোনা সেরে আমি বাবার ফার্মেই যোগ দিলাম। তারপর বিয়ে-থা করে আমি একদিন নিজস্ব সংসার পাতলাম। নাদিয়াদ-এর বাড়ি ছেড়ে আমি চলে গেলাম সুরাটে, কারণ তখন গুজরাটের সবথেকে সমৃদ্ধ শহরই শুধু নয়, সবথেকে ‘হ্যাপেনিং’ জায়গা ছিল সুরাট। নিজের ফার্ম তৈরি করে ছোটো-ছোটো কাজ ধরতে শুরু করলাম। এক ছেলে আর এক মেয়ে হল। একদিন তারাও বড়ো হল। নিজের ব্যবসা, পরিবার, নানা চিন্তা আর প্যাঁচপয়জারে জড়িয়ে পড়লেও, আশ্চর্যজনক ভাবে সেই ছোটোবেলার স্বপ্নটা কিন্তু আমায় তখনও পুরোপুরি ছাড়েনি।
এমনিভাবেই সব চলছিল। তারপর একদিন, এখন থেকে বছর পনেরো আগে, হঠাৎ করেই পাকিস্তান যাওয়ার সুযোগ পেলাম। তখন গুজরাল সাহেব দেশের প্রধানমন্ত্রী। পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরির জন্যে যা-যা করা সম্ভব সবই তিনি করছেন। সেসবেরই অঙ্গ হিসেবে দু’দেশের নামকরা সংস্থাগুলোর মধ্যে সহযোগিতার কথাও হচ্ছে। করাচিতে আয়োজিত এক সেমিনারে আমাদের দেশের বেশ কিছু নামকরা সংস্থা তাদের প্রতিনিধি পাঠাল এই কারণেই। আমি তখন যাদের হয়ে সাব-কন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করি (এক বিশাল ফার্মের নাম করলেন মিরচন্দানি) তারা পাঠাল আমাকে।
করাচি যাওয়ার আগে নাদিয়াদ গেলাম বাবা’র সঙ্গে দেখা করে তাঁর আশীর্বাদ নিতে। মা ততদিনে মারা গেছেন, কিন্তু বাবা তাঁর শক্ত মন আর মোটামুটি শক্ত শরীর নিয়ে আমাদের ছোট্ট বাড়িটায় শক্ত হয়েই বাস করছিলেন। বাবা আমার প্রায় কোন কথাতেই কোনদিন ‘না’ বলেননি, কিন্তু আমি করাচি যাচ্ছি শুনে মানুষটাকে আমি প্রথমবার কেঁপে উঠতে দেখেছিলাম। এবারেও উনি আমায় বারণ করেননি, কিন্তু ওনার কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারছিলাম, আমার এই যাওয়াটা উনি মেনে নিতে পারছেন না। কিন্তু আমিও কেমন যেন গোঁয়ার হয়ে গেলাম। মনে হল, আমাদের ফেলে আসা ঘর আর দেশ নিয়ে যে প্রশ্নগুলোর উত্তর বাবা-মা দেননি, এবার সেগুলোর উত্তর আমিই খুঁজে বের করব।
এর ক’দিন পরেই আমি মুম্বই হয়ে পৌঁছে গেলাম করাচি।
নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি করাচি ছিল পৃথিবীর সবথেকে বিপজ্জনক শহরগুলোর একটা। আজকের মতো ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীদের হাতে তখনও ও দেশটা চলে যায়নি। তবু, স্রেফ আইন-শৃঙ্খলার বিচারেই, করাচিতে মানুষের জীবনের দামটাই বোধহয় ছিল সবথেকে কম। সেই সময় পাকিস্তান আর সিন্ধ, দু’জায়গাতেই যাদের শাসন, সেই পাকিস্তান পিপলস পার্টির সঙ্গে করাচি শহরের একচ্ছত্র শাসক এম.কিউ.এম-এর প্রায় যুদ্ধ চলছে। ফলে অপহরণ, খুন, গুলি, বোমা, আর আগুন তখন ওখানে রুটিন ব্যাপার।
আমাদের রাখা হয়েছিল শাহ ফয়সল টাউনের একটা গেস্ট হাউসে। মাত্র দু’দিনের জন্যে যাওয়া, তাও আবার নিজের ফেলে আসা দেশে! কিন্তু পৌঁছনোর মুহূর্ত থেকেই নিরাপত্তার ঘেরাটোপ, সন্দেহ, আর সযত্ন আতিথেয়তার আড়ালে লুকিয়ে রাখা অপছন্দর ঠেলায় মনটা একেবারে পালাই-পালাই করতে শুরু করেছিল।
সেমিনারে অংশ নেওয়া অনেক বিল্ডারই তখন সিন্ধ সরকারের উদ্যোগে হালেজি লেকের পাশে নির্মীয়মান আবাসন নিয়ে আগ্রহী ছিল। যেহেতু কচ্ছের রুক্ষ অথচ ভূমিকম্প-প্রবণ এলাকায় আলিশান বাড়ি বানানোর অভিজ্ঞতা আমার ছিল, তাই আমি সেমিনারে এই বিষয়ে বলতেই পারতাম। কিন্তু কয়েকবার লোকজনের সঙ্গে মেশার চেষ্টা করতে গিয়ে বাজে অভিজ্ঞতা হয়েছিল বলে এমনকি সেমিনারেও আমার কিছুই বলতে ইচ্ছে করছিল না।
প্রথম দিনটা এভাবেই কাটল। সন্ধেবেলায় নিজের ঘরে বসে, পরের দিনটাও গেস্ট হাউসের ঘরে, নয়তো সেমিনার রুমের বিরক্তিকর পরিবেশে বন্দি হয়েই কাটাতে হবে ভেবে যখন ক্রমেই মুষড়ে পড়ছি, তখনই কলিং বেল বাজল।
করাচির পরিস্থিতি নিয়ে খবর দেখে আর শুনে সত্যিই ভীত হয়ে পড়েছিলাম, অস্বীকার করব না। কিন্তু দরজার পিপহোল দিয়ে যাঁকে দেখে নিশ্চিন্ত হয়ে দরজা খুললাম, সে হল ইকবাল। এয়ারপোর্ট থেকে যে দলটি আমাদের সঙ্গেই জুড়ে গেছিল, তাদেরই অন্যতম সদস্য এই ছেলেটিকে, তার মিশুকে স্বভাব আর একমুখ হাসির জন্যে, আমার খুব ভালো লেগে গেছিল। ইকবাল আসায় আমি হাতে প্রায় চাঁদ পেলাম।
নানা বিষয়ে গল্পগুজব করার ফাঁকে আমি ইকবালকে খোলাখুলি বলেই ফেললাম যে পাকিস্তানে এসে অবধি নিরাপত্তা আর অবিশ্বাসের এই ঘেরাটোপ আমার অসহ্য লাগছে। আমি যখন বললাম যে করাচির আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দোহাই দিয়ে আমাদের গেস্ট হাউস থেকে বের হওয়াই কার্যত বারণ, তখন ও হো-হো করে হেসে ফেলল। ও’র কথা থেকে যা বুঝলাম তাতে ইন্ডিয়া থেকে কেউ ও দেশে গেলেই তাদের পেছনে নিরাপত্তারক্ষীদের লাগানো হয়। আমাদের দেখাশোনার দায়িত্ব যাদের দেওয়া হয়েছে তারা নিজেদের কাজ কমানোর জন্যে আমাদের ভয় দেখিয়ে অন্তরীণ করে রেখেছে। ও এটাও বলল যে পরদিন খুব ভোরে আমি যদি তৈরি থাকি তাহলে ও আমাকে হালেজি লেকের কাছ থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে, যাতে সেমিনারের অন্তত দ্বিতীয় পর্যায়ে আমি আমার বক্তব্য রাখতে পারি। সেমিনারে নিজের বিদ্যে জাহির করার খুব একটা ইচ্ছে আমার ছিল না, কিন্তু গেস্ট হাউস, তথা করাচি ছেড়ে বাইরে কোথাও যাওয়ার এই সুবর্ণ সুযোগ আমি ছাড়তে চাইলাম না।
পরদিন খুব ভোরে উঠে আমি, পূর্ব-পরিকল্পনামাফিক, জগিং করার মতো পোষাক আর স্পোর্টস শু’তে সেজেগুজে গেস্ট হাউসের লন-এর পাশে গিয়ে ওয়ার্ম আপ করা শুরু করলাম। গেস্ট হাউসের রসুইখানার জন্যে তাজা সব্জি, মাংস, দুধ, ডিম -এসব নিয়ে মালবাহী একটা গাড়ি যখন ঢুকল, তখন তার পাশ দিয়ে হেঁটে আমি ইকবালের গাড়িতে, যেটা রসুইখানার পেছনে দাঁড় করানো ছিল, উঠে পড়লাম। একটু পরেই ইকবাল ধীরে-সুস্থে গাড়িটা পেছনের সার্ভিস গেট দিয়েই বের করে নিল, আর করাচির ফাঁকা রাস্তা ধরে আমরা ছুটে চললাম শহরের উত্তর-পূর্ব দিকে, হাইওয়ে ধরে। এমন নয় যে আমাদের বেরোতে কেউ দেখেনি, কিন্তু ভেতরে-ভেতরে এই ‘পালানো’ নিয়ে একটা ছেলেমানুষি উত্তেজনা অনুভব করছিলাম।
করাচির যেটা মূল শহর এলাকা, সেটার পরেই শুরু হয়ে গেছে একের পর এক ইন্ডাসট্রিয়াল এস্টেট। আলো ফুটলেও, জানলা দিয়ে বাইরের ওই একঘেঁয়ে ল্যান্ডস্কেপ দেখতে-দেখতে বিরক্তি আর ঘুম, দুই-ই এসে গেছিল। কিছুক্ষণ পর খিদে পেলেও থামতে হল না, কারণ জলের বোতল আর শুকনো ফল গাড়িতেই ছিল। তবে হাত-পাগুলো একটু সচল করার জন্যে ইকবালকে বার কয়েক থামতে বলেছিলাম, কিন্তু ও হাসিমুখেই নানা কথা তুলে সেটা এড়িয়ে গেছিল।
বেশ খানিকক্ষণ চলার পর হাইওয়ে থেকে গাড়িটা প্রথমে একটা ছোটো রাস্তা, আর তারপরে কাঁচা রাস্তা ধরল। আমি সিন্ধের কিছুই না চিনলেও হালেজি লেকের দিকে যাওয়ার জন্যে এমন রাস্তা কেন নিতে হল সেটা ভাবছিলাম। এইভাবে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর গাড়িটা একটা বালিভরা মাঠের কাছে এসে থেমে গেল। আর তখনই, ক্যাটকেটে সবুজ রঙের একটা মসজিদ আর কয়েকটা খেজুর গাছের ফাঁক দিয়ে আমি বাড়িটা দেখলাম।
স্বপ্নে বাড়িটা আমি এতবার দেখেছি, যে এই বাড়িটার সঙ্গে তার সূক্ষ্ম পার্থক্যগুলোও আমার নজর এড়ায় নি, যার মধ্যে প্রধান ছিল বাড়িটার লাগোয়া যে অংশটাকে মন্দির বলে মনে হত, তার মাথায় কোন নিশান না থাকা। অযত্নের ছাপ বাড়িটার সর্বত্র, কিন্তু তাতেও, আমার আবার মনে হতে লাগল, বাড়িটায় কেউ আছে যে আমায় চেনে, যে আমায় ডাকছে।
ইকবাল কিছু বলার আগেই আমি দরজা খুলে নেমে পড়লাম, আর মসজিদের পাশ দিয়ে এগিয়ে গেলাম। তারপর আমি কতক্ষণ ধরে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, জানি না। চটকা ভাঙল যখন ইকবাল পাশ থেকে বলল, “বাড়িটায় যাবেন আপনি?”
বাড়িটাকে দেখতে পাওয়ার পর থেকে আমি কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। হঠাৎ ইকবালের এই প্রশ্নটা শুনে, কেন জানি না, আমার খুব ভয় করতে লাগল। আমার মনে হল, একে তো পাকিস্তানের এক বাড়িতে হঠাৎ করে এক ভারতীয় ঢুকে পড়লে তার প্রতিক্রিয়া ভালো হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। তার ওপর, স্বপ্নে যে বাড়িটাকে আমার খুব আপন লাগত, এখন কাছ থেকে তার রুক্ষতা আর রিক্ততা দেখে সেটাকে কেমন যেন অভিশপ্ত বলে মনে হল। তাছাড়া, বাড়িটায় যাওয়ার যুক্তি হিসেবে আমি যদি কাউকে বলি যে আমি এই বাড়িটাকে স্বপ্নে দেখেছি, তাহলে বিল্ডার হিসেবে আমার সাধ বা শখ নিয়ে বাজারে হাসি-তামাশা ছড়ানো ছাড়া কিছু হবে না।
সবেমাত্র ভেবেছি যে আমার গাড়িতেই আবার উঠে বসা উচিত, ঠিক সেই মুহূর্তেই পিঠে একটা জোরালো ধাক্কা খেলাম। রাগ ও বিরক্তি নিয়ে পেছন দিকে তাকিয়ে আমি এমন একটা চমকের সম্মুখীন হলাম, যেটার জন্য আমার বিন্দুমাত্র প্রস্তুতি ছিল না।
আমি দেখলাম, ইকবালের হাতে একটা আগ্নেয়াস্ত্র। পিস্তল, রিভলবার এসবের ছবি দেখলেও কোনটা কী তা আমি ভালো জানি না। কিন্তু ইকবালের হাতের ওই ছোট্ট জিনিসটা যে মৃত্যুবাহী, সেটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। তবে সেটার থেকেও আমাকে বেশি অবাক ও ভীত করেছিল ইকবালের মুখের পরিবর্তন। হাসিখুশি মানুষটার মুখ তখন বদলে গেছে, বরং তার দু’চোখে ফুটে উঠেছে এক শীতল ক্রূরতা, যার সঙ্গে গত তিন দিনের লোকটাকে কোনমতেই মেলানো যায় না। সেই অচেনা মানুষটা খুব শান্ত ভাবে বলে উঠল, “সোজা এগিয়ে চলো ওই বাড়িটার দিকে।”
আমি প্রতিবাদ করার কথা ভেবেছিলাম, কিন্তু ইকবালের চোখের দিকে তাকিয়ে চেঁচামেচি করার সাহস পাই নি। এক ঝলকের জন্যে ও’র পেছনে তাকিয়ে দেখেছিলাম যে মসজিদ থেকে বের হওয়া কয়েকজন মানুষ আমাদের দেখছে, কিন্তু তাদের হাবভাব দেখে এটাও বুঝেছিলাম যে তারা এক অপরিচিত মানুষের জন্যে হঠাৎ করে নিজের জীবন বিপন্ন করবে না।
জীবনে কখনও এমন অবস্থায় পড়িনি, জানেন? হাত-পা শিথিল হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল, আরও কত কী করা বাকি ছিল। কত কী বলা হয়নি বন্ধুদের। কত কী দেওয়া হয়নি প্রিয় মানুষদের। কিন্তু উদ্যত বন্দুকের সামনে কোন কথা চলে না। তাই আমায় এগিয়ে যেতেই হল বাড়িটার দিকে। মাথায় নানা রকম আক্ষেপের পাশে যে দুটো চিন্তা সবথেকে বেশি করে আছড়ে পড়ছিল তাদের প্রথমটা এই যে, ইকবালের এমন পরিবর্তন হঠাৎ কেন হল। দ্বিতীয়টা ঠিক চিন্তা ছিল না, বরং ছিল একটা আশা, যে গেস্ট হাউস থেকে কেউ-না-কেউ নিশ্চয়ই আমাদের বেরোতে দেখেছে, আর পাকিস্তানের বিখ্যাত নজরদাররা নিশ্চয়ই আমার পিছু নিয়েছে। এবার তারা যদি সময় মতন এসে পৌঁছয় …
রাস্তাটা পেছনে রেখে আমি বাড়িটার দিকে এগিয়ে যেতে থাকলাম। মনটা নানা রকম ভাবনার ধাক্কায় প্রথমে প্রবলভাবে আন্দোলিত হলেও আস্তে-আস্তে কেমন যেন শান্ত আর ফাঁকা হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পরেই দেখলাম যে আমি বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। মনে হচ্ছিল, যেন আমি আমার মধ্যে আর নেই। যেন বাইরে দাঁড়িয়ে আমি দেখছি একটা নাটক, যেখানে আমার স্বপ্নে দেখা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমিই, আর পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে মৃত্যু। সেই ‘বাইরে’ থেকে দেখলাম, বাড়িটার পাশে একটা মন্দিরের মতো ঘর, যার সামনে রয়েছে একটা বাওলি। বাড়িটায় ক’টা ঘর, ক’টা জানলা, এসব কিছুই অবশ্য জানতে পারলাম না, কারণ ইকবালের শান্ত অথচ নিষ্ঠুর কন্ঠ আমায় আদেশ দিল বাওলির ভেতরে যাওয়ার জন্যে।
ধাপ-ধাপ সিঁড়ি বেয়ে আমি নামতে শুরু করলাম বাওলির মধ্যে।
এদিকে কেমন বৃষ্টি হয় জানিনা, তবে আমাদের গুজরাটে ক’দিন আগেও তুমুল বৃষ্টি হয়ে গেছিল। হয়তো তার কিছুটা ছোঁয়া লেগেছিল সিন্ধের এই নাম-না-জানা এলাকাতেও। তাই সিঁড়িতে পা দিয়ে কিছুটা নামার পর, চোখ কম আলোয় অভ্যস্ত হতেই, আমি নিচে খুব মৃদুভাবে দুলতে থাকা জল দেখতে পেলাম। জলের উপস্থিতি টের পাওয়ার অবশ্য আরও একটা উপায় ছিল। খরখরে শুকনো হাওয়ায় মিশেছিল একটা ভেজা ভাব, যেটা আমাকে বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল আমার স্বপ্নের কথা।
দারুণ ভয়ে হতবুদ্ধি হয়ে যাওয়াই বোধহয় স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু যে কোন কারণেই হোক না কেন, আমার মাথা-চোখ-কান খুব ভালোভাবে কাজ করছিল। আর সেজন্যেই আমি সিঁড়ি দিয়ে নামতে-নামতেই বুঝতে পারছিলাম, বাওলিটা জল জমানো আর সরবরাহের জন্য নয়, বরং লাশ গায়েব করার জন্যই ব্যবহৃত হয়।
সাধারণত বাওলির মধ্যে মূল কুয়োটার মুখে একটা পাতলা ঝাঁঝরি লাগানো থাকে, যাতে খোলা ছাদ দিয়ে বর্ষার জল এসে পড়তে পারলেও আবর্জনা পড়ে জলটা নষ্ট করে দিতে না পারে। এখানে দেখলাম তেমন কিচ্ছু নেই। জলটা দুলছে অল্প-অল্প। কুয়োটার চারপাশে পড়ে থাকা বিভিন্ন জিনিস, শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ, আর জলের ভেজা ভাবটার সঙ্গে মিশে যাওয়া একটা গা-ঘিনঘিনে মিষ্টি গন্ধ: এগুলোই বুঝিয়ে দিল, আমার আগেও বেশ কিছু হতভাগ্য হারিয়ে গেছে এই কুয়োয়।
আমি আশংকা করেছিলাম যে জলের কাছে পৌঁছলেই ইকবাল আমায় গুলি করবে। তাই আমি সিঁড়ির সবচেয়ে নিচের ধাপটা পেরিয়েই কাঁপতে-কাঁপতে মাটিতে বসে পড়লাম। ইকবাল কয়েকটা গালাগাল, এমনকি আমায় লাথি মারার হুমকি দিলেও আমি ভান করলাম যে বয়স আর নার্ভের যুগপৎ আক্রমণে আমার পা আর আমার সঙ্গে সহযোগিতা করছে না।
আমি ওকে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলাম, কেন ও আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। ও আমার প্রশ্নের উত্তর দিল না, বরং আমার থেকে একটু দূরত্ব বজায় রেখে কুয়োর কাছটায় পৌঁছে গেল। কুয়োটাকে পেছনে রেখে ইকবাল যখন আমার দিকে বন্দুকটা আবার তুলে ধরল, আমি তখনই বুঝলাম, আমার গল্প শেষ হতে চলেছে, কারণ পরিত্রাতা হিসেবে কারও যদি আসার হত, তাহলে সে বা তারা এতক্ষণে এসে পড়ত।
কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই একটা আশ্চর্য ঘটনা ঘটল।
কুয়োর জলটা থেকে হঠাৎ যেন বাষ্প উঠতে শুরু করল। মাটির ফাঁক দিয়ে গরম জল আর বাষ্প উঠতে আমি আগেও দেখেছি, কিন্তু সেগুলো হয় প্রাকৃতিক কুন্ডে, তাও বিশেষ-বিশেষ জায়গায়। এখানে, মাটির বেশ কিছুটা নিচে, একটা কৃত্রিম কুয়ো থেকে হঠাৎ বাষ্প উঠতে দেখে আমি এতটাই অবাক হয়েছিলাম যে ইকবাল, বন্দুক, নিজের আসন্ন মৃত্যু, এসবই আবছা হয়ে গেছিল তার কাছে। ইকবাল আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে একটু বেঁকে পেছনে দেখে নিজেও যে চমকে উঠেছিল সেটা বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু জলের ধার থেকে ও যেই সরে আসতে যাবে, বাষ্প জমে জলের ওপরে যে কুয়াশাটা তৈরি হয়েছিল, সেটা এক নিমেষে এগিয়ে এসে ওকে ঘিরে ফেলল!
দৃশ্যটা এতই অবিশ্বাস্য ছিল যে আমি নিজের অবস্থা ভুলে ইকবালের জন্যে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। কুয়াশাটা তখন ওকে ঘিরে ধরে আস্তে-আস্তে ঘুরছে। ইকবাল বন্দুকসহ ওর হাতটা নিজের শরীরের পাশ থেকে তোলার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। কিন্তু একটা অজগর সাপের মতো করে কুয়াশাটা ওকে পেঁচিয়ে ধরেছিল, আর একটু-একটু করে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল জলের দিকে।
কুয়াশা আর ইকবালের ওই নিঃশব্দ যুদ্ধ দেখতে-দেখতে আমি ভাবছিলাম, ইকবালের পর এই অদ্ভুত কুয়াশা আমায় শিকার করবে কি না। হাত-পা তখন সত্যিই শিথিল হয়ে গেছিল, তাই ভাগ্যের হাতে নিজেকে এক রকম ছেড়েই দিয়েছিলাম।
যখন ঘুরতে থাকা পিণ্ডটা জলের কাছে পৌঁছে গেছে, তখনই আমি কুয়াশার মধ্যে ইকবালকে ছাড়াও অন্য দুটো শরীরের অবয়ব দেখতে পেলাম। একটা শরীর বেশ লম্বা, যাতে মুখ বা অন্য কোন শারীরিক বৈশিষ্ট্য নয়, বরং তার নিম্নাঙ্গে জড়িয়ে থাকা একটা লাল কাপড়ের আভাসই তার পৌরুষকে স্পষ্ট করে তুলেছিল। অন্য শরীরটা অপেক্ষাকৃত হ্রস্ব, আর সেখানেও অন্য কিছু নয়, বরং পোষাক আর কিছু আভূষণ আভাসই বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে সে নারী।
আমি এখনও জানিনা যে আমি সত্যিই কুয়াশার মধ্যে ওই দুটি ছায়া বা কায়া দেখেছিলাম কি না, তবে এর পরেই আমি শুনতে পেয়েছিলাম তীব্র হুইসলের আওয়াজ, আর ভারী বুটের ছুটে আসার শব্দ। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।
জ্ঞান ফিরেছিল কোন একটা অতিমাত্রায় সুরক্ষিত নার্সিং হোমে। ভারতীয় কনসুলেট, স্থানীয় পুলিশ, লোকাল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, সাদা পোষাকে ও মিলিটারি পোষাকে সজ্জিত কত মানুষকে যে পরের দু’দিনে এই ঘটনাটা আমায় বলতে হয়েছিল, এখন আর তা মনে করতে পারব না। কিন্তু আমার সব কথা তাঁরা শুনলেও, এবং তাঁদের প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর বারবার দেওয়া সত্ত্বেও, ইকবাল হঠাৎ আমায় কেন মারতে চেয়েছিল, এই প্রশ্নের কোন উত্তর পাইনি।
যেদিন ফেরার কথা, তার একদিন পরেই আমাকে প্রায় প্যাক করে মুম্বইগামী প্লেনে তুলে দেওয়া হল। আমার মাথায় গিজগিজ করতে থাকা প্রশ্নগুলোর কয়েকটার উত্তর অবশ্য পাকিস্তান ছাড়ার আগে কনসুলেটের একজনের কাছে জানতে পেরেছিলাম, যেটা আরও একবার আমাকে ভাবিয়েছিল, মৃত্যুর কতটা কাছে পৌঁছে গেছিলাম আমি।
আগেই বলেছিলাম, সেই সময় এম.কিউ.এম. আর পি.পি.পি.-র মধ্যে করাচির দখল নিয়ে সরাসরি যুদ্ধ চলছে, আর সেই যুদ্ধে তারা সব রকমের অস্ত্রশস্ত্রই ব্যবহার করেছিল। ইকবাল ছিল এম.কিউ.এম.-এর একটি স্লিপার সেলের সদস্য, যেমন সেল সিন্ধের সমাজে ও প্রশাসনের সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। পাকিস্তান সরকারের তরফে আয়োজিত এই সেমিনারে যোগ দিতে ভারত থেকে লোকজন আসছে, এটা ঠিক হওয়ার পরেই ওই স্লিপার সেলটি চালু হয়। ইকবালের কাছে আদেশ আসে আমায় গায়েব করার, যার পরেই এটা রটিয়ে দেওয়া হত, যে আমি ভারতের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি বা নাশকতা করতেই এসেছিলাম। এরপর স্বাভাবিকভাবেই পি.পি.পি. সরকার বেইজ্জত হত। আর আমাকে মারার পর যে কুয়োটায় ফেলে দেওয়া হবে বলে প্ল্যান করা হয়েছিল, তেমন গুমঘর আর টর্চার চেম্বার সিন্ধের সর্বত্র আছে, যাদের মূলত এম.কিউ.এম. আর বহুক্ষেত্রে প্রশাসনও ব্যবহার করে।
সেদিন গেস্ট হাউস থেকে আমাদের বেরোতে সত্যিই একাধিক মানুষ দেখেছিল, কিন্তু তাদের সঙ্গে ইকবালের যোগসাজশ ছিল। সেমিনার শুরু হওয়ার পর আমাদের দলেরই একজন আমার খোঁজ করায় সিকিউরিটি ডিটেইল দেখার দায়িত্ব যাদের ছিল, তাদের টনক নড়ে। তারপর কার্যত ম্যানহান্ট চালিয়ে ইকবালের গাড়ি খুঁজে বের করা হয়, এবং নিরাপত্তাবাহিনী ওই গ্রামে পৌঁছে যায়।
কুয়োর মধ্যে ইকবালের দেহটা পাওয়া গেছিল।ও’র শরীরে কোন আঘাতের দাগ ছিল না। ভয়ে চোখ-মুখ ঠিকরে আসার একটা ভাব থাকলেও সেটা শ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার সময়ে মুখের বিকৃতি বলেই মনে করা হয়েছে।
মসজিদ থেকে বেরিয়ে যারা আমাদের দেখেছিল সেদিন, তারা একথা বলেছিল যে বন্দুক হাতে ইকবালই আমায় বাধ্য করেছিল ওই বাওলিতে নামতে। বন্দুকটা ইকবালের হাতেই মুঠোবন্দি অবস্থায় পাওয়া যায়। তাছাড়া আমি যেখানে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম সেটা কুয়ো থেকে বেশ কিছুটা দূরে। ফলে, ইকবালের মৃত্যুতে আমার ‘হাত’ থাকা নিয়ে কোন অভিযোগ ওঠেনি।
মৃত্যুর অত কাছে গিয়েও আমার ফিরে আসাটা বোধহয় মৃত্যু এত সহজে মেনে নেয়নি, তাই মুম্বই থেকে সুরাটে ফিরে আসার পরই আমি কঠিন অসুখে পড়ি। প্রায় তিন সপ্তাহ পর আমি যখন নার্সিং হোম থেকে বেরিয়ে আসি, তখন পাকিস্তানের ওই অভিজ্ঞতা আমার মনে অনেকটা ফিকে হয়ে এসেছে। বাড়ির লোক এটা জেনেছিল যে পাকিস্তানে গিয়ে আমি একটা সাংঘাতিক বিপদে পড়েছিলাম, কিন্তু ফেরার পর এমনই যমে-মানুষে টানাটানি করে আমায় সুস্থ করতে হয়েছিল যে তারা আমায় খুব বেশি খোঁচাতে পারেনি।
নার্সিংহোম থেকে ফিরে আত্মীয়-পরিজনদের সবার শুভেচ্ছা আর আশীর্বাদ নিয়ে আমি যখন মোটামুটি গুছিয়ে নিচ্ছি নিজের জীবন, তখনই ব্যবসার কাজে আমায় মুম্বই যেতে হল। যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না, কিন্তু ক্লায়েন্ট বড়ো বালাই। তবে সেসব কাজকর্ম মিটে যাওয়ার পর একটা পার্টিতে গিয়েই আমার এই গল্পটা শেষ হয়।
পার্টিতে ভারতীয় মিডিয়ার পাশাপাশি পাকিস্তানি মিডিয়ার বেশ কিছু প্রতিনিধি ছিলেন, যাঁদের মধ্যে ছিলেন বিখ্যাত পত্রিকা ‘ডন’-এর এক সাংবাদিক। তিনি আমাকে যেভাবে চিনে ফেলেন, সেটা থেকেই আমি বুঝেছিলাম যে অনেক চেষ্টা করেও নিরাপত্তা বাহিনী করাচিতে আমার সেই ‘অ্যাডভেঞ্চার’ পুরোপুরি গোপন করতে পারেনি।
সেই ঘটনা নিয়ে আমার কাছ থেকে কোন ‘এক্সক্লুসিভ’ আদায় করতে না পেরে সাংবাদিক ভদ্রলোক বেশ মুষড়ে পড়েছিলেন। তবে আমার বয়স আর ভেঙে যাওয়া স্বাস্থ্য দেখে তাঁর বোধহয় একটু দয়া হয়েছিল, তাই তিনি আমাকে সেই বাড়িটার ইতিহাস বলেছিলেন, যে বাড়ির লাগোয়া বাওলিতে আমি মরতে বসেছিলাম।
বাড়িটা ছিল এক হিন্দু সিন্ধ্রি পরিবারের। পরিবারটি বংশানুক্রমিকভাবে মাতা নানি-র (বালুচিস্তানের হিংলাজ দেবীকে মুসলিমরা যে নামে ডাকে) উপাসক ছিল। তাই বাড়ির লাগোয়া একটি মন্দির তো ছিলই, নিত্যপূজার জন্যে একটি বাওলির ব্যবস্থাও ছিল বাড়ির সঙ্গেই। পার্টিশনের পর ভারত থেকে আসা মোহাজিরদের উন্মত্ত আক্রোশের শিকার হয়েছিল তখনও পাকিস্তানে থেকে যাওয়া হিন্দু পরিবারগুলো। তাদেরই একটি দল ওই বাড়ি আক্রমণ করে। বাড়িতে তখন ছিলেন পরিবারের প্রধান পূজারী মানুষটি, আর তাঁর স্ত্রী এবং তাঁদের একমাত্র ছেলে, যার বয়স তখন ছিল বছর চারেক। সেই সময় পূজারীর ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে করাচি শহরে গেছিল। ইজ্জৎ বাঁচানোর তাগিদে মহিলাটি বাওলির কুয়োয় আত্মহত্যা করেন। পূজারীকে মেরে ওই কুয়োতেই ফেলে দেওয়া হয়। বাড়িতে আর কাউকে না পেয়ে, এমনকি লুট করার মতো বিশেষ জিনিস না পেয়ে, সেই দলটি মন্দির অপবিত্র করে দিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।
এই খবর নিঃসন্দেহে করাচি শহরে পৌঁছেছিল। পূজারীর ভাই, তাঁর স্ত্রী, আর সেই ছেলেটি বাড়িতে কখনও ফিরে আসেনি। বাড়িটি নানা বদ কাজের জন্যে ব্যবহৃত হয়ে শেষে এম.কিউ.এম.-এর টর্চার চেম্বার তথা গুমঘরে পরিণত হয়েছিল।
আমার মুখ-চোখের অবস্থা দেখে সাংবাদিক ভদ্রলোকের বোধহয় মনে হয়েছিল যে এর বেশি কিছু বললে আমার হার্ট-অ্যাটাক হবে। আসলে কিন্তু হয়েছিল তার উল্টোটাই। তাই, সেই রাতে পার্টি থেকে বেরিয়ে আমি সোজা এয়ারপোর্ট যাই, আর প্লেনের টিকিট কাটি। মোটামুটি ঘন্টা পাঁচেকের মধ্যে আমি নাদিয়াদে আমাদের বাড়ি পৌঁছই।
তখন অনেক রাত হয়েছিল, কিন্তু তবু আমি থেমে থাকতে পারছিলাম না। আমার মনে হয়েছিল, যা জেনেছি, যা দেখেছি, তারপর বাবা’র কাছ থেকে কয়েকটা প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর আমায় আদায় করতেই হবে। অত রাতে আমায় দরজায় দাঁড়িয়ে অধৈর্যভাবে কলিং বেল বাজাতে দেখে আশেপাশের বাড়িতে কৌতূহলী লোকেরা উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে, এটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু তাও আমি থামিনি।
রানে, যে আমাদের বাড়িতে থেকে তখন বাবা’র দেখাশোনা করত, বেশ অবাক হয়ে দরজা খুলে দিল। ও যখন আমার হঠাৎ আসা নিয়ে বিস্ময়, আর ভেঙে যাওয়া স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে, ততক্ষণে আমি বাবা’র শোয়ার ঘরের কাছে এসে গেছি। দীর্ঘ-দীর্ঘ দিনের সংস্কার আমার পা দুটোকে মন্থর করে দিল, তাই আমি নিজের উত্তেজনা যতটা সম্ভব চেপে রেখে বাবা’র কাছে ঘরে আসার অনুমতি চাইলাম।
জানিনা, অত রাতে আমার আসা, কলিং বেল বাজানো, আর সোজা শোয়ার ঘরের দরজায় পৌঁছে যাওয়া থেকে বাবা কিছু আন্দাজ করেছিলেন কি না। এও হতে পারে যে আমি পাকিস্তানে যাওয়ার সময় থেকেই উনি প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এই মুহূর্তটার।
বাবা নিজেই দরজা খুলেছিলেন। আমি ওনার পেছন-পেছন ঘরে ঢুকেছিলাম। উনি কিন্তু চেয়ারে, বা খাটে বসেননি। বরং ছোট্ট চৌকিটা থেকে সেই সযত্নে ভাঁজ করে রাখা লাল কাপড়টা আমার হাতে তুলে দিয়ে উনি আমায় জড়িয়ে ধরেছিলেন। প্রায় পাঁচ দশক ধরে দমিয়ে রাখা স্বজন হারানোর কষ্টই বোধহয় সেইরাতে ওই শক্ত আর চুপচাপ মানুষটার বুকফাটা কান্না হয়ে বেরিয়ে এসেছিল। সেই কান্নার সামনে ভেসে গেছিল আমার তুচ্ছ অভিমান, আমার তুচ্ছ প্রশ্নগুলো। আমিও খুব কেঁদেছিলাম সেদিন।
অনেক-অনেকক্ষণ পর আমি অশীতিপর মানুষটাকে ধরে-ধরে আবার খাটের কাছে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিয়েছিলাম। অনেক-অনেকদিন পর, সেই রাতে, আমি আমার শক্ত বাবা’কে প্রণাম করেছিলাম একেবারে ভেতর থেকে।
তারপর থেকে আর কখনও আমি ওই বাড়িটাকে স্বপ্নে দেখিনি!”
Tags: ঋজু গাঙ্গুলী, প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, বাড়ি, সুমন দাস