বিকল্প
লেখক: সাকিয়ো কোমাৎসু
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
তার মনে হলো সে হয়ত পথ হারিয়েছে। এতক্ষন ধরে সে নির্দেশিত পথেই চলছিল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যে ল্যান্ডমার্কটার কথা তাকে বলা হয়েছিল, সেটা পেরিয়ে এসেছে ভুলে। এই ঘিঞ্জি জায়গায় বেশ কিছুক্ষন এদিক ওদিক করার পর, সে বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিল।
আচ্ছা – এই নোংরা প্যাঁচালো গলিঘুঁজি ছেড়ে বড় রাস্তায় উঠে আবার সেখান থেকে খোঁজ শুরু করলে কেমন হয়? ব্যাপারটা কেঁচে গণ্ডুষ হয়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু তাছাড়া সে আর কোনো উপায় দেখতে পাচ্ছে না আপাতত। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতে হবে। বড় রাস্তাটা পাবার জন্য কিছুটা হাঁটতেই, ল্যান্ডমার্কটা দেখতে পেল সে।
দোকানের সামনেটা যেরকমটি থাকবে বলে তাকে বলা হয়েছিল, তার থেকে অনেকটাই অন্যরকম দেখাচ্ছে। সেই লোকটি কিন্তু পইপই করে বলে দিয়েছিল যে এটা একটা ডুবসাঁতারের পোষাক বিক্রি করার দোকান। কিন্তু দোকানটা পুরানো আমলের সেকেন্ড হ্যান্ড রোবোট, দ্বিমাত্রিক টিভি সেট – এই সব প্রাচীন জিনিসপত্রে ঠাসা। দেখে তো এটাকে অ্যান্টিক জিনিসপত্রের দোকান বলে মনে হচ্ছে!
সে ঠিক করলো, দোকানীর সঙ্গে একবার কথা বলে দেখবে। বয়স্ক দোকানদারকে দেখে মনে হচ্ছিল, সেই হয়ত দোকানটার মালিক।
“শুনছেন? দোকানটা একটু দেখতে পারি?”
চকচকে পরচুলা পরিহিত দোকানী তাঁর নিষ্প্রভ চোখ তুলে অদ্ভুতভাবে তাকে দেখলেন। এতক্ষন তিনি তাঁর সামনে রাখা ত্রিমাত্রিক টিভি সেটে কিছু একটা অনুষ্ঠান দেখছিলেন। দোকানী তার দিকে তাকাবার পর সে বুঝল, দোকানীর একটি চোখ ছাই-রঙা ইলেকট্রন গ্লাসে তৈরি, সেইজন্যই চোখটা কিরকম একটু ফ্যাকাসে আর বিকৃত লাগছে।
“পরিচয়পত্র আছে কিছু?” রুক্ষ স্বরে দোকানী বলে উঠলেন।
সে পকেট থেকে অদ্ভুত দর্শন স্বাক্ষর সম্বলিত একটা কাগজের টুকরো বের করল যেটা তাকে ওই অচেনা লোকটি দিয়েছিল। আর সঙ্গে পাঁচ ডলারের একটা নোট। বুড়ো দোকানী স্বাক্ষরটা ভালোভাবে পরীক্ষা করলেন, তারপর কাউণ্টারের নীচে রাখা একটা মেশিনের নীচে কাগজটা রাখলেন। ব্যাঙ্কে যেরকম চেকের সই মেলানোর যন্ত্র থাকে – দেখে অনেকটা সেরকমই মনে হলো। তারপর তিনি কাউন্টারের ওপর থেকে পাঁচ ডলারের নোটটা পকেটস্থ করে বললেন,
“আসুন”।
দোকানঘরের একদম শেষপ্রান্তে একটি দরজা খুলে দিলেন তিনি। “এই দরজা দিয়ে আসুন।”
“আচ্ছা, এই দোকানটা কি বদলে গেছে?” সে কৌতুহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করল, “আমি শুনেছিলাম এটা ডুবসাঁতারের পোষাক বিক্রি করার দোকান।”
“ওহ – আচ্ছা। না না সেরকম কিছু না। দোকানের ওই মুখটা রাস্তার অন্যদিকে আছে। মানে এর ঠিক বিপরীতে। আপনি ভুল করে এদিক দিয়ে ঢুকেছেন। কিন্তু যেদিক দিয়েই আসুন না কেন, দোকানের ভেতরটা একই।” দোকানী ব্যাখ্যা করে দিলেন।
দরজার পিছনে একটা সিঁড়ি খাড়া নেমে গেছে নীচে পর্যন্ত। সেদিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে দোকানী বললেন, “ওখানে একটা দরজা আছে, সেটা দিয়ে সোজা ঢুকে যাবেন। একটাই করিডোর – কিন্তু বড় অন্ধকার। সাবধানে চলে যান।”
বলা বাহুল্য এই নির্দেশটুকু দরকার ছিল। ভালোভাবে ঠাওর করলেই বোঝা যায়, সিঁড়িগুলি খুব পলকা কিছু জিনিসের বিভিন্ন টুকরো জোড়া লাগিয়ে বানানো হয়েছে। বড় বড় কন্সস্ট্রাকশন সাইটে যেভাবে ভারা বাঁধা থাকে- মোটামুটি সেইসব দিয়েই বানানো। এতটাই পলকা, তার যেন মনে হচ্ছিল যে শরীরের ভার রাখতে পারবে না সিঁড়িগুলো, এখুনি হুড়মুড় করে ভেঙে নীচে পড়ে যাবে সবশুদ্ধ। একটা আঙুলও যদি বেখাপ্পা ভাবে এই ঝুরঝুরে রেলিঙে ঠেকে যায়, তাহলেই আর দেখতে হবে না।
চারপাশে কোনো আলো লাগানো নেই, কিন্তু সিলিং থেকে একটা পুরোনো ফ্লুরোসেন্ট ল্যাম্প ঝুলছে। সেই আলোতেই হাল্কা একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে পায়ের তলার মড়মড়ে সিঁড়ির ধাপগুলোর। সিঁড়ির দুলুনি থেকে বোঝা যাচ্ছিল যে সিঁড়িটার তলায় চাকা লাগানো আছে। সিঁড়ির তলায় নেমে সামনেই যে দরজাটা দেখা যাচ্ছে, ভালো করে ঠাওর করে বোঝা গেল সেটাও সদ্য বসানো হয়েছে। পুরো কাঠামোটাই এমন ভাবে তৈরী যেন মুহুর্তের ইঙ্গিতেই বমাল সমেত সমস্ত গায়েব করে দেওয়া যেতে পারে।
সিঁড়ির নীচে বিচিত্র ধরনের লোহার দরজাটা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই একটা স্যাঁতস্যাতে ভাব তাকে ঘিরে ধরলো। তার মনে হলো, এখানে আশেপাশে নিশ্চই কোনো বাতাস পরিষ্কার করার আয়োনাইজড যন্ত্র বসানো রয়েছে। সেটা সত্ত্বেও কিরকম একটা নর্দমামার্কা বোটকা গন্ধ যেন সম্পূর্ন বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। এদিকে পায়ের তলায় লাল কার্পেট পাতা, দুপাশে দেওয়ালে রঙ গুলিও চমৎকার –উচ্চ রুচির পরিচায়ক। তবে কার্পেটে পা দিয়েই সে বুঝতে পারল, এই পুরো করিডোরটাই সদ্য জোড়াতালি দিয়ে তৈরী করা এক অস্থায়ী কাঠামো।
কিরকম একটা বিশ্রী গন্ধওয়ালা জায়গা রে বাবা!! কিন্তু এটা যদি সত্যিই সেই জায়গা হয়……
লম্বা করিডোরটার শেষপ্রান্তে এরকম আরও একটা বন্ধ দরজা। সেটিতে নক করতেই, ভেতর থেকে স্পষ্ট ক্যামেরা ক্লিকের শব্দ শোনা গেল। তারপরেই একটা গম্ভীর শব্দ করে ভারী দরজাটা খুলে গেল।
দরজার পিছনে একটা আয়তাকার বিশ্রামকক্ষ – দেখে মনে হয় পেছনে ফেলে আসা করিডোরটারই একটা প্রলম্বিত অংশবিশেষ। অনেকটা যেন পুরনো আমলের রেলওয়ে ওয়াগনের ভেতরের অংশের মত চারপাশটা। পায়ের তলায় এখন গাঢ় সবুজ কার্পেট – ওপর ওপর দেখলে বেশ দামী মনে হয়, কিন্তু চারপাশের আসবাবপত্রগুলো একদম রদ্দি। দেওয়ালে একটা ত্রিমাত্রিক টিভি সেট ঝোলানো। গনিকালয়ের রিসেপশনগুলি যেরকম ভাবে আধো আলো আধো অন্ধকারের মধ্যে ডুবে থাকে, তার সঙ্গে কি প্রচন্ড মিল এই জায়গাটার। সে কয়েকবার নাক টেনে গভীর শ্বাস নিয়ে ভুরু কুঁচকে চারদিকে তাকিয়ে দেখতে থাকল। অনেকগুলো চেয়ার পাতা রয়েছে এদিক সেদিক। যদিও চেয়ারগুলোতে বসতে তার প্রবৃত্তি হলো না। সে একটা চেয়ার ধরে দাঁড়িয়েই রইল।
এইভাবে কিছুক্ষন অপেক্ষা করার পর, পাশের ঘরের দরজা খুলে একটা নিষ্প্রাণ চোখের বেঁটে খাটো মানুষ ঢুকে এলো এবং তাকে ভিতরে আসার আমন্ত্রন জানালো।
“এরকম আর কত ঘর পেরোতে হবে কে জানে” –এইসব ভাবতে ভাবতেই সে পাশের ঘরটিতে প্রবেশ করল। ঘরে ঢুকে প্রথমেই তার মনে হলো, সে এবারে একদম শেষ কক্ষে এসে হাজির হয়েছে কিন্তু তারপরেই সে ঠাওর করে দেখলো, ঘরে রাখা একটা টেবিলের পেছন দিকে আরও তিনটে দরজা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। ভালো করে দেখে সে বুঝতে পারল, এই তিনটি দরজার প্রতিটারই উপর অংশটি কিরকম সিনেমার পর্দার মতো।
“বসুন” – সেই বেঁটে লোকটি অস্পষ্ট স্বরে যেন একটু অন্যমনষ্কভাবেই তাকে বলল।
চেয়ারে বসার পরেই সে আশা করতে লাগল, এখুনি হয়ত ঐ তিনটি দরজার কোনো একটি থেকে ম্যানেজার গোছের লোক বেরিয়ে আসবে, কিন্তু সেরকম কিছুই ঘটল না। বরং সেই বেঁটে লোকটিই এখন তার সামনে ডেস্কের অপরপাশের চেয়ারটিতে জাঁকিয়ে বসল।
“কেউ কি ব্যাপারটা নিয়ে কিছু জানিয়েছে আপনাকে?” বেঁটে লোকটি জিজ্ঞেস করল।
সে তখন তার স্বল্পপরিচিত অচেনা লোকটির প্রতীকী নাম উল্লেখ করে বলল যে তার সঙ্গে লোকটির একটি ভাটিখানায় দেখা হয়। দেখার পর টুকটাক কথায় আলাপ জমার পর সেই লোকটি তাকে এই ব্যাপারে সামান্য কিছু আলোকপাত করে। যদিও বিশদে তাকে কিছু বলা হয়নি।
পুরোটা শুনে সেই বেঁটে লোকটি একটু বিষণ্ণ ভাবে মাথা নেড়ে বলল, “হুম – ঠিকই আছে। ও আমাদেরই একজন বিশ্বস্ত বন্ধু। যাইহোক, আপনি কি পুরো টাকাটা এখানেই দেবেন?”
“নিশ্চই – আমি পুরো টাকা সঙ্গে করে এনেছি –পঁচিশ লাখ, তাই তো?”
“চেকে না ক্যাশে?”
“না না, ছোট ছোট ক্রেডিটে – যেমনটা বলা হয়েছিল।”
“বেশ।” বেঁটে লোকটি মাথা নাড়ল। সে পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করতে উদ্যত হতেই, লোকটি তাকে বাধা দিল। “এত তাড়াহুড়ো করার কিছু নেই। আপনি পরেও টাকাটা দিতে পারেন। এত বড় একটা অ্যামাউন্ট – যখন আপনি সত্যি সত্যি ব্যাপারটা করতে চাইবেন, তখনই দেবেন, তার আগে নয়।”
সে ভাবল বেঁটেটা ঠিকই বলছে – এত তাড়াহুড়োর কি আছে? দেখাই যাক না কি ব্যাপার। সে তার হিপ পকেট থেকে হাত সরিয়ে নিল।
“বেশ তাহলে শুরু করা যাক।” থুতনিতে হাত ঠেকিয়ে সামনে ঝুঁকে এল সেই বেঁটে লোকটি, “এই জিনিসটা নিয়ে আপনার ধারণা কি?”
“আমি শুনেছিলাম – কেউ তার নিজের ভবিষ্যত কে বেছে নিতে পারে, এরকম কিছু একটা ব্যাপার।”
“ব্যাস? এটুকুই?”
“মানে – ওই আর কি –এটুকুই।”
বেঁটে লোকটি উঠে দাঁড়িয়ে এক হাত দিয়ে মাথা চুলকোতে চুলকোতে আর অন্য হাতের নখ খুঁটতে খুঁটতে বলে উঠল, “তাহলে তো দেখি ব্যাপারটা একটু জটিল হয়ে পড়ল। আমি জানিনা আপনি কি ভেবে এসেছেন, কিন্তু এটা যে কোনো ম্যাজিক নয়, সেটাও আপনার জানা উচিত। আপনার ভবিষ্যতের ওপর তাৎক্ষনিক ভাবে খুব সুক্ষ্ম ভাব পড়বে এই ব্যাপারটার। যদিও খুব বিশাল আবিষ্কার টাইপ কিছু না –তবে বলতে পারেন খুব অপ্রত্যাশিত ভাবে ব্যাপারটা ঘটে গেছ আর কি।”
“সে যাই হোক – একটু বুঝিয়ে বলবেন দয়া করে?” উত্তেজিত ভাবে বলে উঠল সে। বেঁটে লোকটির এই কুন্ঠিত ভাব সাব দেখে তার আগ্রহ ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছিল – যদিও এসব লোকঠকানো কৌশলও হতে পারে।
“তাহলে সত্যিটাই বলি। আমি বা আমার পার্টনার –আমরা কেউই বর্তমান দুনিয়ার অধিবাসী নই।”
“তার মানে? তাহলে আপনারা……?” একটা ঢোঁক গিলে সে বলল, “কোনোভাবে কি আপনারা……?”
“যা ভাবছেন তাই। আমরা ভবিষ্যত থেকে এসেছি – সময় ভ্রমণ বা টাইম ট্রাভেল করে। আমাদের সময়কার বিশ্বে টাইম ট্রাভেল নিয়মের কড়াকড়ি থেকে কোনরকমে পালিয়ে এসেছি বলতে পারেন।”
সে ভাবতে লাগল, সে যা শুনল সেটা সত্যি কি না – সামনে বসা বেঁটে লোকটিকে এবার খুব মনোযোগ দিয়ে সে দেখতে থাকল। সেরকম বিরাট আলাদা কিছু তো দেখতে নয় একে – বর্তমান দুনিয়ার সাধারণ মানুষের মতোই আকার প্রকার। একটু অগোছালো ধরনের আর একটু অস্থির মনে হচ্ছে যদিও –তাছাড়া তো……।
“তারপর?” সে উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল।
“তারপর এই দুনিয়াতে এসে আমরা একটা নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছি, যার দ্বারা সময় ভ্রমন অনেক বেশী নিয়ন্ত্রিত এবং দ্রুত করা যেতে পারে। আমরা এখন এমন দেশ –কালে ভ্রমন করতে পারি, যেখানে ওই সব সময়-আধিকারিকরা আমাদের কেশাগ্র স্পর্শ করতে পারবে না। সময় জালের জটিল আবর্তে আমরা যখন তখন বিলীন হয়ে যেতে পারি।”
“এক মিনিট,” সে বাধা দিয়ে উঠল, “কি হয়েছিল? আপনারা কি কোনো বিপদে পড়েছিলেন?”
“আপনি এখানে বসে আন্দাজও করতে পারবেন না, সময় ভ্রমনের নিয়ে আমাদের দুনিয়াতে নিয়মের কি মারাত্মক কড়াকড়ি।” বেঁটে লোকটা খুব দুঃখিত হয়ে মাথা নাড়ল, “একটা অনুমতিপত্র যোগাড় করতে কত যে লাল ফিতার ফাঁসের মধ্যে দিয়ে আমাদের যেতে হয়, তার ধারণাও করা দুষ্কর। তারপরও, সময় ভ্রমন কালে একজন সময়-অধিকর্তাও লেজুড় হয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরতে থাকে। বলতে গেলে, সর্বক্ষণই সময়ভ্রমন নিয়ন্ত্রন অধিকর্তার কড়া নজরে থাকতে হয়। একা একা সময় ভ্রমণ করা বলতে গেলে আমাদের দুনিয়ায় একটা প্রথম শ্রেনীর অপরাধের পর্যায়েই পড়ে।”
“হয়েছে হয়েছে। যথেষ্ট” সে বলে উঠল, “আপনাদের সমাজের গতিবিধি আমার পক্ষে সম্পূর্ন অনুধাবন করা ততটাই অসম্ভব, যতটা গরুর গাড়ীতে অভ্যস্ত একটা সমাজব্যবস্থাকে হাইওয়ে দিয়ে প্রচন্ড স্পিডে গাড়ি চালানোর ব্যাপারে সতর্ক করা। কিন্তু আপনাদের তৈরী সময় ভ্রমন পদ্ধতি ব্যবহার করে একজন তার ভবিষ্যতকে কিভাবে বেছে নিতে পারে, সেটা একটু বোঝালে ভালো হয়।”
“বলতে পারেন, আমাদের দুনিয়ার সময় ভ্রমন পদ্ধতির মধ্যে সামান্য কিছু রদবদল ঘটিয়ে সেটা করা যেতেই পারে। শুধু একটা টাইম স্পেস চ্যানেল সিলেক্টর আর একটা টাইম স্কোপ হলেই ব্যাপারটা করা সম্ভব।”
“আমার মনে হচ্ছেনা আপনার কথা আমি বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারছি বলে।”
“সেটা খুবই স্বাভাবিক। আপনার যদি সময় ভ্রমন পদ্ধতি সম্পর্কে কিছুই জানা না থাকে, তাহলে এটা ব্যাখ্যা করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার এখন। যাইহোক, মেশিনের এই চালন ক্ষমতাকে ইচ্ছেমতো আমরা ব্যাবহার করতে পারি না। অর্থাৎ, আপনাকে ধরে একটা মেশিনে বসিয়ে দিলাম আর সে আপনাকে ভবিষ্যতে রেখে এল, ব্যাপারটা অতটা সোজা নয়। এরকম করলে, গতির অভিঘাতে সময় আবর্তে যা চাঞ্চল্য দেখা দেবে, তাতে সময়-অধিকর্তারা যে কোনো মুহুর্তে টের পেয়ে যেতে পারে।”
“আচ্ছা – তবে?”
“সেই জন্যই তো টাইম-স্পেস চ্যানেল বা দেশ-কাল সুড়ঙ্গ ব্যাবহারের কথা আসছে। এটার জন্য একটা বহুমাত্রিক জায়গা তৈরী করে ফেললেই, কেল্লাফতে।”
“একটু সোজা করে বোঝাবেন?” সে একটু বিরক্ত হয়ে উঠেছে এবার, “আমার ভবিষ্যত নির্বাচন করার সঙ্গে এই হাবিজাবিগুলোর সম্পর্ক কোথায়?”
বেঁটে লোকটি এবার একটু সহানুভুতির সুরে বলল, “একজন কিভাবে সময় ভ্রমণ করবে সেটা বুঝতে গেলে এগুলোর ব্যাপারে একটু ধারণা থাকা জরুরি। যদিও আমি যেভাবেই ব্যাখ্যা করি না কেন, আপনার কাছে দুর্বোধ্যই ঠেকবে, তাই একটু অন্যরকম ভাবে চেষ্টা করছি। আপনি কি জানেন যে আমাদের এই বর্তমান দুনিয়া এবং তার সম্পূর্ন ইতিহাস একমাত্র সম্ভাবনা নয়? আরও গননাতীত সম্ভাবনা আছে অতীতে, ভবিষ্যতে নানা ধরনের সম্ভাব্য দুনিয়া এবং তাদের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত ইতিহাসের পাশাপাশি বাস করার।”
“না সেরকম তো……কিন্তু দাঁড়ান, আমার মনে হয় আমি এর আগে এই ধরনের একটা কিছু শুনেছি।” সে অনিশ্চিত ভাবে বলে উঠল, “এই ব্যাপারটা একদম উড়িয়ে দেওয়ার নয়।”
“তাহলেই দেখুন, আপনি যদি নন-ইউক্লিডিয়ান জ্যামিতি পড়েন তাহলে বুঝবেন যে একটা বিন্দুর উপর দিয়ে যদি একটা সরলরেখা যায়, এবং তার সমান্তরালভাবে যদি আরও অসংখ্য সরলরেখা আঁকা হয়, তবে তারা সেই বিন্দুর উপর দিয়ে যাওয়া সরলরেখাটির উপর অবস্থিত হবে না। তাই সময় ভ্রমনের সূচনালগ্নে এরকম অনেক ঘটনা ঘটেছে যেখানে সময় ভ্রমণকারী দেশ-কালের সেই বিন্দুতে ফিরে আসতে পারেনি যেখান থেকে সে যাত্রা শুরু করেছিল। ধরে নেওয়া যাক, আপনি একটা বিন্দু P থেকে যাত্রা শুরু করলেন ভবিষ্যতের A বিন্দুতে। এবার A ভবিষ্যত কিন্তু P এর থেকে বেরোনোর পর একমাত্র সম্ভাবনা নয়। সেখানে A1, A2, A3…..Anএরকম অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। আবার আপনি ধরুন যে কোনো একটা ভবিষ্যতে চলে গেলেন, কিন্তু সময়ের সিঁড়ি বেয়ে কি আপনি সেই ফেলে আসা বিন্দুতে ফিরে আসতে পারবেন যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন? প্রায়ই সেটা সম্ভব হবে না, কারণ আপনার অধুনা ভবিষ্যত A এর অসংখ্য সম্ভাব্য অতীত থাকতে পারে যেমন P1, P2, P3, ……… Pn.
“ওহ, এই ব্যাপার -তারপর?” মনে বিরক্তি চেপে বাইরে বোঝার ভান করে সে বলে উঠল।
“এই সময়ের গোলোকধাঁধা এড়াবার জন্য, দেশ-কাল সুড়ঙ্গ নির্ণায়ক বা টাইম-স্পেস চ্যানেল সিলেক্টর বানানো হয়েছে, যেটা একটা অনুনাদ পদ্ধতিতে কাজ করে থাকে। দেশ-কালের কম্পনের অনুনাদ কে ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট বিন্দু থেকে অপর একটি সম কম্পনের দেশ-কালের বিন্দুকে খুঁজে বের করা হয়। এর ফলে, আপনি যদি দেশ-কালের P বিন্দু থেকে যাত্রা শুরু করে থাকেন, তাহলে সঠিক ভাবেই A বিন্দুতে গিয়ে পৌঁছবেন আবার ঠিকঠাক ফিরেও আসতে পারবেন একটুও এদিক ওদিক না করে। কিন্তু মুশকিলটা হলো গিয়ে, আপনি এরকম ভবিষ্যত বা অতীতে যেতে পারবেন না যেখানে এই দেশ-কালের শাখা প্রশাখা বহুলাংশে বিধৃত। আপনি শুধু দেশ কালের সেই সুড়ঙ্গেই যাত্রা করতে সক্ষম হবেন যেখানে এই অনুনাদী তরঙ্গ কাজ করে, তাও সেটা আবার এই অসিলেটর যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল। মানে, অসিলেটর যত শক্তিশালী হবে, আপনার একাধিক অতীত বা ভবিষ্যত ভ্রমনের সম্ভাবনা ততই বাড়তে থাকবে। আমাদের কাছে যে অসিলেটরটি আছে, তা দিয়ে আপাতত আপনি তিনটে আলাদা আলাদা চ্যানেলে সময় ভ্রমণ করতে পারবেন।”
এতক্ষণে কিছু জিনিস তার কাছে বোধগম্য হতে শুরু করেছে, “তারমানে, আমি আমার ভবিষ্যতের বিকল্পগুলির মধ্যে থেকে বেছে নিতে পারব, এই তো?”
“অনেকটা সেরকমই,” বেঁটে লোকটি মাথা নাড়ল, “আমাদের চ্যানেল সিলেক্টর আজ এইখানে এই পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে আপনার তিনটি সম্ভাব্য ভবিষ্যত নির্দেশ করতে পারে। কিন্তু এটা শুধুই আপনাকে কতকগুলি সম্ভাবনা নির্দেশ করে দেবে, এর বেশি কিছু না। তাই যে ভবিষ্যত আপনি বাছবেন, সেটি সঙ্গে সঙ্গে আপনার চারপাশে প্রতিভাত নাও হতে পারে। আমরা যে ভবিষ্যৎ জগতগুলি আপনাকে দেখাবো, তার থেকে আপনি আপনার পছন্দমতো ভবিষ্যত বেছে নিতে পারেন। এবং সেই মুহুর্তে, সেই বিশেষ বিন্দু থেকে আর যে সমস্ত সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ দুনিয়ায় আমাদের প্রবেশাধিকার আছে, তার মধ্যে ওই একটি নির্দিষ্ট দিকেই আপনি, আপনার পারিপার্শ্ব এবং বিশ্বের সমস্ত ইতিহাস চালিত হতে থাকবে।”
“অন্যভাবে বললে”, শুকনো গলায় ঢোঁক গিলল সে, “এই ঘরের মধ্যেই তিনটে দরজা আছে যা তিনটে আলাদা আলাদা ভবিষ্যতে নিয়ে যেতে পারে, তাই নয় কি?”
“একদম ঠিক”, বেঁটে লোকটি তার পিছন দিকে আঙুল তুলে দেখাল, “প্রত্যেকটি দরজার পেছনে এক একটা অসিলেটার বসানো রয়েছে। আপনি এক একটা চ্যানেল দরজা দিয়ে ঢুকলেসেখানে ভিন্ন দেশ-কালের আবর্তে এক অন্য ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা করবেন।”
“এই তিনটে ভবিষ্যৎ দুনিয়া কিরকম হবে? আমি কি তার একটা আভাস পেতে পারি?” সে এবার ঝুঁকে এল। উত্তেজনার চরমে পৌঁছে তার গলা এবার কাঁপতে শুরু করেছে।
“নিশ্চয়ই”, বেঁটে মানুষটি তার ডেস্কের নীচে হাত দিল, “আমি চ্যানেলের মধ্যে টাইমস্কোপ চালিয়ে আপনাকে তিনটি ভবিষ্যতের একটা আভাস দিতে পারি।”
ঘরটা হঠাৎ করেই অন্ধকার হয়ে গেল আর তিনটি দরজার উপরিভাগ কেমন যেন একটা হাল্কা আলোর আভায় ভরে উঠল ধীরে ধীরে। “একদম ডানদিকের দরজার থেকে তৃতীয় দরজা অবধি এক, দুই তিন করে নাম্বারিং করা আছে। এগুলি পর পর ভবিষ্যৎ রাস্তার দিক নির্দেশক”, লোকটি বলে উঠল, “দরজার উপরিভাগের অংশটিই হলো টাইমস্কোপ।”
একদম ডানদিকের এক নম্বর দরজার টাইমস্কোপ সক্রিয় হয়ে উঠেছে – হাল্কা আলো এখন অনেক জোরালো। বাকি দরজা গুলি এখনও আধো অন্ধকারে ডুবে রয়েছে। ডানদিকের দরজার দিকে চেয়ে মনে হতে লাগল, ওর ভেতরে যেন কিছু একটা ঘটছে, একটা আলোড়ন দেখা দিয়েছে তার মধ্যে। এবার সেটা আস্তে আস্তে একটা প্রতিকৃতি নিল – অনেকটা ত্রিমাত্রিক ছবির মতো ব্যাপারটা।
ভবিষ্যতের যে ছবিটা ফুটে উঠল, সেখানে একটা শহর তৈরী হচ্ছে – আধুনিক শহর। অবিশ্বাস্য গতিতে তৈরী হয়ে চলেছে ইমারতের পর ইমারত। অদ্ভুত তাদের আকৃতি, কোনোটা গোলাকার শংকু আকৃতি, কোনোটা মৌচাকের মত খোপ খোপ, কোনোটা আবার চোঙের মত লম্বা, গোল বলের মত, ইত্যাদি। এক একটা আকৃতি নিজেই এক একটা স্বয়ংসম্পূর্ন শহর – আর তারা পাইপের মত রাস্তা দিয়ে একে অপরের সঙ্গে এমন ভাবে যুক্ত যে দূর থেকে দেখে মাকড়সার জাল বলে ভুল হতে পারে।
কোনো যন্ত্র ছাড়াই মানুষজন আকাশে উড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে, দেখে মনে হচ্ছে যেন এরা অভিকর্ষবিরোধী যন্ত্র আবিষ্কার করে ফেলেছে। আরো দেখা যাচ্ছে, একটা বিরাট রকেট উড়ে চলেছে এক দূর গ্যালাক্সীর দিকে। রকেট তো নামেই – একটা পুরো শহর যেন মহাশূন্যে ভেসে চলেছে! ভূপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে, বাড়িঘর, কল-কারখানা গজিয়ে উঠেছে – যেন একটা বিশাল কৃত্রিম উপগ্রহকে মানুষের বাসযোগ্য করে তুলেছে এই অত্যাধুনিক দুনিয়ার অধিবাসীরা।
“আর দেখবেন?” লোকটি জিজ্ঞেস করল।
“থাক –যথেষ্ট হয়েছে।” বিড়বিড় করে সে বলে উঠল, “এবার দ্বিতীয়টা দেখান।”
দ্বিতীয় দরজার উপরিভাগ এবারে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে। প্রায় একই দৃশ্য, তবে শহরের ইমারতের স্থাপত্য আগেকার মতো অত জটিল নয়, বেশ সোজাসাপটা। বাড়িগুলিও এখানে আকাশচুম্বী নয়, অথচ চারপাশের অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মধ্যে দিয়ে খুব নিয়মনিষ্ঠভাবে বিন্যস্ত। রাস্তার দুপাশে ফুলের সারি যেন হাওয়ার মাথা ঝুঁকিয়ে পথিককে অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত। গাছের সারি গুলি পরস্পরের থেকে সমদূরত্বে অবস্থান করছে। অভিজাত চেহারার গাড়ির দল অত্যন্ত সুষ্ঠুভাবে রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করছে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার, গাড়ির থেকে কোনোরকম কালো ধোঁয়া বেরিয়ে এসে আকাশ বাতাসকে কালিমালিপ্ত করে পরিবেশ দূষন ঘটাচ্ছে না।
মানুষের জামাকাপড়ও খুব সহজ সরল। পুরুষদের প্রায় সবাইকেই গ্রীক দেবতাদের মতো সুন্দর দেখতে, মহিলাদের চেহারার নিখুঁত গড়ন আর তাদের প্রগলভ ভাবভঙ্গি বেশ চোখে পড়ার মতো। পরিবেশের উষ্ণতা মনে হয় এখন পুরোটাই মনুষ্য নিয়ন্ত্রিত। ওই ওপরে যে সূর্যটা সোনালি আলো বিচ্ছুরণ করছে, দেখে মনে হলো সেটাও কৃত্রিম। যন্ত্রাদি যা কিছু দেখা যাচ্ছে, সবকিছুর মধ্যে একটা অসাধারন অভিজাত্য, নৈপুণ্য এবং সামঞ্জস্যের ভাব স্পষ্ট। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, এই শহর এখন চূড়ান্ত উন্নতির পর্যায়ে এসে উপস্থিত হয়েছে।
বিরাট বড় কোনো স্টেডিয়ামে কোনো ক্রীড়া অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছে। সুইমিং পুলে সাঁতার প্রতিযোগিতা চলছে। অন্যদিকে এক বিরাট মঞ্চে গান বেজে চলেছে, বিভিন্ন জনসমাবেশে কবিতা পড়া, আবৃত্তি চলছে। যে কেউ চলতে চলতে দাঁড়িয়ে গিয়ে সেখানে অংশগ্রহন করতে পারে। ওদিকে আকাশের ঘন নীলিমায় ভেসে আছে একটি বিমানপোত, তাকে দেখাচ্ছে ঠিক যেন দীঘির জলে ভাসমান সরসীর মতো।
“সনাতনী সৌন্দর্যময় সম্প্রীতি” নিজের মনেই বলল সে, “খুব সাহসী কিছু কৃত্রিম পরিবর্তন করেছে এরা যাহোক।”
“আমরা কি পরেরটা দেখতে পারি?” লোকটি জিজ্ঞেস করল।
“নিশ্চই।” সে উত্তর দিল।
তিন নম্বর দরজার প্যানেলের আলো কিন্তু তখনই উজ্জ্বল হয়ে উঠল না। একটু সময় নিয়ে আস্তে আস্তে আলোর তীব্রতা বাড়তে থাকল। কিন্তু যেন মনে হলো, ঐ হাল্কা আলোর পিছনে কিছু একটা জিনিস বেশ জোরে জোরে নাড়াচাড়া করছে। পরের মুহুর্তেই একটি বিরাট শহর দৃশ্যমান হলো, যার অধিবাসীরা কেমন যেন হতভম্ব ভাবে এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছে। দেখে মনে হল, এই শহরটির সঙ্গে বর্তমান পৃথিবীর শহরগুলির যথেষ্ট মিল আছে। ধুলো, ধোঁয়া, রাস্তার যানজট, চেঁচামেচি, শ্যাওলাধরা বড় বড় অট্টালিকা, ঘিঞ্জি বস্তি অঞ্চল, সব মিলিয়ে একান্তভাবেই আজকের দুনিয়ার যে কোন একটি শহরের ছবিই চোখের সামনে ভেসে উঠেছে।
কিন্তু শহরের উপরিভাগে এমন কিছু ঘটছে, যাতে শহরের মধ্যে কিরকম যেন একটা থমথমে ভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। চোখেমুখে একটা গভীর উৎকণ্ঠা এবং ভীতি নিয়ে, শহরের মানুষ অধীরভাবে এদিকওদিক ছোটাছুটি করছে। রাস্তার একটা কোন থেকে, হঠাৎ একজন আকাশের দিকে দেখিয়ে চিৎকার করে কি বলে উঠল। অন্যান্য উৎকণ্ঠিত মুখগুলি নিমেষে সেদিকে ঘুরে গেল।
পরমুহুর্তেই পর্দাজুড়ে একটা সুতীব্র আলোর ঝলকানিতে তার চোখ প্রায় ধাঁধিয়ে গেল। এত তীক্ষ্ণ এবং ভয়ানক সেই আলোর বিচ্ছুরণ, যে চোখ ফিরিয়ে নেবার কিছুক্ষণ পরও সে চারপাশে সব কিছুতেই আবছা লাল এবং সবুজের বর্ণাভা দেখতে থাকল।
“শুধু এইটুকুই?” সে জিজ্ঞেস করল।
“আরও কিছুটা আছে” বেঁটে লোকটির গলা অন্ধকারের মধ্যে থেকে শোনা গেল, “বাকিটা ঐ দেখুন।”
প্রথমে সে কিছুই বুঝতে পারল না। এক ঝলক দেখে যেন মনে হয় একটা গভীর কালো দাগের মতো কিছু একটা। ভালো করে নজর করার পর সে বুঝতে পারল, দাগ নয় – সারা শহর জুড়ে একটা প্রকান্ড কালো গর্ত তৈরী হয়েছে। পোড়া শহরের সেই বীভৎস ধ্বংসস্তুপের আশে পাশে ছিড়িয়ে ছিটিয়ে আছে গলে যাওয়া কাঁচের দাগ – যা প্রায় মাইলখানেক বিস্তৃত। এমনকি দূরের পাহাড়্গুলো অবধি প্রচন্ড তাপে গলে কালো পাথরের স্তুপে পরিনত হয়েছে। ঐ বিরাট গর্তের শ’খানেক মাইলের মধ্যে, গাছপালা পশু পাখি তো দুরের কথা, মনে হয় কোনো ব্যাকটিরিয়া অব্ধি বেঁচে নেই। দূর আকাশে লালচে-খয়েরী রঙের তেজস্ক্রিয় ধূলোর মেঘ ভেসে চলেছে বাতাসের তাড়নায়।
উত্তাল ঢেউ এবং মত্ত টাইফুন উপকূলে আছড়ে পড়েছে। কোনোদিকে মানুষের কোনো চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট নেই – দেখে মনেই হচ্ছে না মনুষ্যপ্রজাতির কোনো অস্তিত্বএই অঞ্চলে কোনকালে ছিলবলে।কিছুক্ষন আগে অবধি থিকথিকে ভিড় জমিয়ে রাখা মানুষগুলির নশ্বর দেহ হয় এখন রাস্তার ওপর জমে থাকা সাদা ছাই এর স্তুপে পরিনত হয়েছে, নাহলে বাতাসে ভাসমান তেজস্ক্রিয় কনায় রূপান্তরিত হয়ে স্থানান্তরে উড়ে বেড়াচ্ছে।
ঘরের আলো জ্বলে ওঠায়, পর্দার আলোগুলো ম্লান হয়ে এল।
“বেশ”, সেই একঘেয়ে গলায় বলে উঠল লোকটি, “এই হলো সেই তিনটি ভবিষ্যত, যা আমাদের টাইম-স্পেস চ্যানেল সিলেক্টর এখনও অবধি সংবদ্ধ করতে পেরেছে। দেখুন, এদের মধ্যে যেটা পছন্দ হয়, সেটি বেছে নিন।”
খসখসে গলায় বলে উঠল সে, “একটা প্রশ্ন ছিল। জানতে চাইছিলাম যে, সময়ের নিরীখে এই তিনটি ভবিষ্যত আমাদের বর্তমানকাল থেকে ঠিক কতটা দূরে?”
“খুব একটা বেশি দূরে নয়। আমাদের টাইমস্কোপ যে ভবিষ্যত তিনটি দেখালো, সেগুলি মোটামুটি একই দূরত্বে বলা যেতে পারে, যদিও সবসময় টাইমস্কোপ যে সমদূরত্বের ভবিষ্যত দেখাবে এমনটা নয়, তবে খুব একটা এদিক ওদিক হয় না। ধরে নিন, তবুও মোটামুটি এক যুগের থেকে কিছু বছর এগিয়ে – মানে ঐ বছর কুড়ি পরের ঘটনা।”
“আর একটা প্রশ্ন। একবার ভবিষ্যতে যাবার পর, আমি কি আর এখানে, এই সময়ে ফিরে আসতে পারব?”
“সেটা সম্ভব না। একই সময়ে ফিরতে গেলে এরকমই একটা সময় ভ্রমন পদ্ধতির দরকার পড়বে।” বেঁটে লোকটি একটা হাই তুললো – “নিন, এবার তাড়াতাড়ি আপনার পছন্দটা বলে ফেলুন – ”
কয়েক মুহুর্ত চিন্তা করার পর সে বলল, “দ্বিতীয় বিকল্পটি মনে হচ্ছে সব দিক দিয়ে ভালো।”
“বেশ – তাহলে মূল্য ওটাই পড়বে। খরচটা বেশি মনে হতে পারে, কিন্তু মনে করুন না এটা আপনার একটা দান – ভবিষ্যতের দুনিয়ার কিছু বিপ্লবীদের জন্য কিছু অর্থ সাহায্য।”
সে পকেট থেকে পেটমোটা মানিব্যাগটা বের করে, বেঁটে লোকটির হাতে উপযুক্ত অর্থ তুলে দিল।
“আচ্ছা, এবার আমি চ্যানেল দুই এর দরজা খুলতে যাচ্ছি………” লোকটি টাকাগুলো ড্রয়ারে রেখে উঠে দাঁড়ালো, “আপনার পছন্দের ভবিষ্যত দুনিয়ার পা রাখার আগে, কিছু জিনিস আপনাকে জানানো দরকার।”
সে বুঝতে পারল, তার কপালে ঘাম দেখা দিয়েছে। হাতের পেছনটা দিয়ে সেটা মুছে সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তিনটি দরজার দিকে তাকিয়ে রইল – মনে মনে সে যেন তুলনা করছে তার দেখা ভবিষ্যত ত্রয়ীর।
“আপনাকে আগেও বলেছি, এসবই আপনাকে আপনার পছন্দের ভবিষ্যতের দিকে একটা নির্দিষ্ট পথ নির্দেশ দেবে। তারমানে এই নয়, যে দরজা অতিক্রম করার পরেই আপনার দেখা ভবিষ্যতে গিয়ে পড়বেন আপনি। এই ব্যাপারটা ভালো করে খেয়াল করুন। এই বিশেষ কারনের জন্যই, দরজার ওপাশে যখন যাবেন, তখন দেখবেন দুনিয়াটা বর্তমানকালের দুনিয়ারই মতো – আপনার পারিপার্শ্ব, মানুষ, বন্ধু বান্ধব, আত্মীয় স্বজন, সবাই একই রকম থাকবে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সবেতেই পরিবর্তন আসবে। যত সময় এগোবে, আপনার ভবিষ্যত অন্যরকম হতে থাকবে, এবং ধীরে ধীরে আপনার পছন্দের ভবিষ্যতের দিকে এগোতে থাকবে। এবং…………”
“ক্ষমা করবেন………” একটু ইতস্তত করে সে বলে উঠল।
“আপনি কিন্তু একটা শপথ নেবেন – এখনই এই মুহুর্তে। অন্য দুনিয়ায় পদার্পন করে কিন্তু আপনি এই ব্যাপারে কোনো কথা বলবেন না – মানে আপনি যে এক পূর্ববর্তী দুনিয়া থেকে এসেছেন, এ ব্যপারে সম্পূর্ন মন্ত্রগুপ্তি রাখবেন। এতে আপনার কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা নেই যদিও, কিন্তু এসব গল্প বলে কোনো লাভও নেই আপনার। কিন্তু আমরা বিপদে পড়ে যেতে পারি। আমি আপনাকে আগেই বলেছি, আমরা যেখান থেকে এসেছি, সেখানকার সময়-ভ্রমন আধিকারিকেরা মাঝে মাঝেই বিভিন্ন দুনিয়ায় টহল দেয়। যদি সেরকম কেউ আপনার কথা শুনে ফেলে, তাহলে আমাদের সমূহ বিপদ। আপনি ওদের হয়ত চিনতে পারবেন না, কারন সাধারন মানুষের ভিড়েই মিশে থাকে ওরা, কিন্তু ওরা আপনাকে ঠিক চিনে নেবে। দয়া করে প্রতিজ্ঞা করুন যে এসব কথা কাউকে বলবেন না, শপথ নিন………”
“একটু দাঁড়ান……” সে বলে উঠল, “আমি কি আমার পছন্দ বদলাতে পারি?”
“হ্যাঁ …মানে তা পারেন……কিন্তু……”
“আমাকে ভবিষ্যত গুলো আর একবার দেখাবেন কি?”
বেঁটে লোকটি ঘর অন্ধকার করে দিলে, পুনরায় তিনটি দরজার পর্দায় আলো ফুটে উঠল। ছায়াছবির মতো ভবিষ্যত ঘটনাবলী ফুটে উঠতে লাগল একের পর এক।
সে একটা ঢোঁক গিলল।
“ঠিক আছে – আমি প্রস্তুত। আমি তিন নম্বর ভবিষ্যতে যেতে চাই।”
“তিন নম্বর? ঠিক শুনছি তো?” লোকটি অবাক ভাবে বলে উঠল। “আশ্চর্য লোক তো আপনি!! শেষে কিনা আপনি তিন নম্বর পছন্দ করলেন?”
“আমি জানি” – মুখে জমে থাকা ঘামের বিন্দুকে মুছে নিতে নিতে সে বলল, “অন্য দুটো ভবিষ্যত খুব চেনা ছকের। আজ না হয় কাল, সেগুলো হবেই – সেখানে পৌঁছানোর জন্য এত টাকা খরচ করার দরকার নেই।”
“তিন নম্বরটাও তো কতকটা তাই – একদিন তো আসবেই শেষের সে দিন, নয় কি?”
“না……” যন্ত্রনাভরা কন্ঠস্বরে সে বলে চলল, “আমরা এখন এমন একটা দুনিয়াতে বাস করছি বা হয়ত ভবিষ্যতেও করব, যেখানে আমি হয়ত শেষের সে দিনের কথা জানি – কিন্তু কবে কিভাবে সে আসবে সে ব্যাপারে নিশ্চিত নই। সম্ভাবনাময় সেই উপলব্ধির মধ্যে চিরন্তন উৎকণ্ঠায় বেঁচে থাকার চেয়ে, এমন দুনিয়ায় যাওয়া ভালো নয় কি, যেখানে অন্তিমকাল বড় নিশ্চিত। আমার মনে হয়, এই ভবিষ্যতটা এত সহজে পাওয়া সম্ভব নয় অন্য কোথাও। এ এমন এক ভবিষ্যত যেখানে আমি নিশ্চিন্ত এই ভেবে, যে সেটা একদিন সম্পূর্ন ধ্বংস হয়ে যাবে, আর আমি তার সাক্ষী থাকব – এমন একটা দুনিয়া……”
“যা ভালো বোঝেন………” লোকটি কাঁধ ঝাকালো। “এখানকার কিছু খদ্দেরও কিন্তু আপনারই মত চিন্তাধারা পোষন করেন। যা হোক, এবার তিননম্বর দরজার দিকে এগিয়ে চলুন।”
দরজার দিকে এগোতে এগোতেই সে বুঝতে পারল, তার মুখের ভেতরটা কেমন শুকিয়ে আসছে।
প্রতি পদক্ষেপে আর মনে হতে লাগল, সে কিছু ভুল করছে। একবার ঢুকে গেলে তার আর ফেরার রাস্তা নেই – “ফিরে যা, ফিরে যা – পাগলামি করিস না”, তার অন্তরাত্মা বলে উঠল, “এখনও বেশি দেরী হয়নি, ফিরে যা।” তার সমস্ত শরীর, দেহের প্রতিটি জীবন্ত কোষ, প্রত্যেকটা পেশি তাকে বাধা দিতে লাগল, যেন সে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে স্ব-ইচ্ছায় না এগিয়ে যায়। তা সত্ত্বেও কিছুক্ষন পর সে নিজেকে আবিষ্কার করল, তিন নম্বর দরজার সামনে। সেখানে দাঁড়িয়ে সে উত্তেজনায় কিছুক্ষন হাত ঘষে নিল – তার সমস্ত শরীর এখন ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে।
“দয়া করে আসুন” – বেঁটে লোকটি আগের মতোই অনুত্তেজক ভাবে বলে উঠল, “এই দরজার পিছনে একটা প্যাসেজ আছে। আপনি যখন সেটা দিয়ে অতিক্রম করবেন, অর্থাৎ টাইম-স্পেস চ্যানেলের মধ্যে দিয়ে যাবেন, তখন কিছু শারীরিক অস্বস্তি অনুভব করবেন। কিন্তু সেটা অসহ্যকর কিছু না, সে ব্যাপারে আমি আপনাকে নিশ্চিন্ত করছি। সোজা এগিয়ে যাবেন। প্যাসেজ যেখানে শেষ হচ্ছে, সেখানে আরো একটা দরজা আছে, সেটা পেরোলেই ঠিক এরকমই একটা ঘর পাবেন। কিন্তু সেটা এই ঘর নয় – ততক্ষনে আপনি অন্য জগতে পৌঁছে গেছেন। চিন্তা করবেন না, সেখানেও আপনি যেভাবে আছেন, সেরকমই থাকবেন – এখানেও যতদিন বাঁচতেন সেখানেও………অবশ্য হ্যাঁ, আপাতত কিছুদিন তো বেঁচে থাকবেনই। যান, শুভযাত্রা।”
হাল্কা একটা ক্যাঁচকোঁচ শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। যেন জ্বরের ঘোরে কাঁপতে কাঁপতে সে দরজার পেছনে অপেক্ষমান অন্ধকারের দিকে এগিয়ে গেল – কি এক অদৃশ্য বাঁধন তাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল অমোঘ নিয়তির দিকে।
“ফিরে যা।” সেই শব্দগুলো আবার ঘুরেফিরে তার মাথায় অনুরণিত হতে লাগল বারংবার। কিন্তু সেসব অগ্রাহ্য করে সে হেঁটে যেতে লাগল একভাবে। নিজের চিন্তার মধ্যে ডুবে থেকে সে খেয়ালই করেনি যে কখন দরজা পেরিয়ে ঢুকে সে হাঁটতে শুরু করে দিয়েছে প্যাসেজে। পেছনের দরজা বন্ধ হওয়ার গম্ভীর ধাতব শব্দে সে সম্বিৎ ফিরে পেল, আর নিজেকে আবিষ্কার করল নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে। পাগলের মতো সে সেই নিবিড় আঁধার হাতড়ে এগিয়ে চলতে লাগল, আর অন্ধকারের মধ্যে বৃথাই ফিরে তাকাতে লাগল তার পেছনে ফেলে আসা দরজার দিকে।
পিচকালো আঁধার পরিবেষ্টিত থাকার জন্য সে জায়গাটা সম্বন্ধে কোন ধারণাই করতে পারছিল না। খুব ধীরে ধীরে এক পা এক পা করে সে অগ্রসর হতে থাকল। প্যাসেজটা একটু ঢালু হয়ে সামনের দিকে নেমে গেছে। যতই সে এগোতে থাকল, মেঝেটা কিরকম যেন শক্ত থেকে হঠাৎ করে জেলির মতো নরম হয়ে গেল। পরিবর্তনটা এতটাই আকস্মিক যে সে ভারসাম্য হারিয়ে দেওয়ালে একটা জোর ধাক্কা খেল। বুঝতে পারল, তার চারপাশে সবকিছু কিরকম যেন কাঁপছে, আর তার শরীরের মধ্যেও কিরকম একটা অস্বস্তি শুরু হয়েছে – তীব্র মাথা যন্ত্রনা করছে, ঘুম ঘুম লাগছে।
তার মনে হলো, চারপাশের অন্ধকার যেন কিরকম ঘুরতে শুরু করে দিয়েছে – সোজা ভাবে হেঁটে চলা দায় হয়ে পড়ছে। তবুও সে দাঁতে দাঁত চেপে এগিয়ে যেতে লাগল শরীরের তুমুল অস্বস্তি এবং এদিক ওদিক দেওয়ালের ঠোক্কর অগ্রাহ্য করে।
পথের শেষ হলো একসময়। ঠান্ডা কিছু একটা জিনিসের সংস্পর্শে এসে সে হাত বুলিয়ে অনুভব করল যে সেটা একটা লোহার দরজা। তার মানে সে অন্যদিকে পৌঁছে গেছে। তাকে যতবার বলা হয়েছিল, দরজার ওপর সে ততবার আঘাত করল। কোনো শব্দ না করে খুলে গেল দরজাটা। ভিতরে প্রবেশ করার পর কিছুক্ষণের জন্য ঘরের ভেতর তীব্র আলোর সুবাদে সে প্রায় অন্ধ হয়ে গেল। ক্রমে আলোয় চোখে সয়ে গেলে সে দেখতে পেল, দরজার পিছনে ঠিক আগের মতোই দেখতে একটা বেঁটে লোক দাঁড়িয়ে আছে, ঠিক যেমনটা তাকে বলা হয়েছিল।
প্রথমে তার মনে হলো, যে ঘর দিয়ে সে প্যাসেজে ঢুকেছিল, আবার সেই ঘরেই ফিরে এসেছে। কিন্তু পরক্ষনেই সে দেখল, এই ঘরে কেবলমাত্র একটাই দরজা, আগের ঘরের মতো তিনটে দরজা নেই। নিশ্চিন্ত হলো সে। এর অর্থ, সে এখন অন্য দুনিয়ায় এসে উপস্থিত হয়েছে।
“ভবিষ্যত পৃথিবীতে আপনাকে স্বাগত।” এই বেঁটে লোকটি বলে উঠল, আগের লোকটারই মতো একঘেয়ে সুরে। যদিও নিশ্চিতভাবেই এটা আগের লোকটা নয়, এই লোকটি ভবিষ্যত পৃথিবীর বাসিন্দা।
“এদিক দিয়ে বেরিয়ে আসুন”।
“যাবার আগে একটা প্রশ্ন ছিল” কিছুটা কষ্ট করেই যেন সে কথাগুলো বলল, “আমি এইমাত্র অন্য এক জগতের থেকে সময়ের সীমারেখা অতিক্রম করে এদিকে এলাম। কিন্তু আমার যে সত্তাটা, মানে যে “আমি” টা এই জগতে আছে, তার কি হবে? যদি আমাদের কোনোদিন দেখা হয়ে যায়?”
“ওহ – না না সে ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকুন”, সেই লোকটি ক্লান্তস্বরে বলল, “এটা একটা অনেক জটিল ব্যাখ্যা, শুধু জেনে রাখুন, আপনাকে যেমন ও জগত থেকে এখানে পাঠালাম, ঠিক সেরকম ভাবেই আপনার এই জগতের সত্তাটিকেও আমরা আপনার ফেলে আসা দুনিয়ায় পাঠানোর ব্যাবস্থা করেছি, সুতরাং কোনো সমস্যা নেই।”
“কিন্তু আপনারা কিভাবে………”
“দয়া করে এদিক দিয়ে বেরিয়ে যান – বিদায়।”
সে বুঝতে পারল, এর বেশি ব্যাখ্যা পাওয়ার আর কোনো আশা নেই। তাই আর কথা না বাড়িয়ে সে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। সেই এক করিডোর পেরিয়ে, সিঁড়ি দিয়ে উঠে, একই ধরনের দোকানের মধ্যে দিয়ে ঢুকে সে রাস্তায় এসে নামল। একদম সেরকমই ঘিঞ্জি রাস্তা, যেটা ফেলে সে ঢুকে এসেছিল দোকানের ভেতরে।
জায়গাটার কিন্তু কোনো পরিবর্তন ঘটেনি নতুন দুনিয়ায় এসে। সব কিছু যেমন দেখে এসেছিল, ঠিক তেমনটাই রয়েছে। কাঠের বেড়ার উপর আচঁড়ের দাগ থেকে শুরু করে, আকাশে মেঘের আকার পর্যন্ত অপরিবর্তিত আছে।
কিন্তু সে জানে যে এই জগত এক অন্তিম সময়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। যে কোনো মুহুর্তে এক বিপুল বিধ্বংসী ক্রিয়ায় এ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এই ব্যাপারটা এখন কেবল সে জানে, আর জানে কিছু মুষ্টিমেয় সময় ভ্রমনকারী, যারা তারই মতো তিন নম্বর দরজার বিকল্পটি বেছে নিয়েছিল। এই দুনিয়ার বাকি অধিবাসীদের কাছে এ রহস্য স্বপ্নেরও অতীত।
আমিই একমাত্র জানি, কালো ধোঁয়ায় পূর্ণ আকাশের দিকে তাকিয়ে সে নিজের মনেই বলে চলল, আমি ছাড়া এই দুনিয়ার ভবিতব্য কেউ জানে না। বেশ কিছু বছর পরে, হতে পারে এক যুগ পরে– আমি ঐ আকাশের প্রান্তে এক তীব্র আলোর ঝলকানি দেখতে পাবো, এবং তারপর – তারপর সবকিছু শেষ হয়ে যাবে। আহ্, কি নিবিড় নিশ্চয়তা।
বাকি দুই দুনিয়ার মতো, এই দুনিয়ার কোনো ভবিষ্যত নেই। বছরের পর বছর ধরে কষ্টকর, প্রলম্বিত, ক্ষয়িষ্ণু এবং একঘেয়ে জীবন চিরটাকাল এখানে টেনে নিয়ে যেতে হবে না। সে চারপাশটা ভালো করে দেখল – অবিন্যস্তভাবে ছড়িয়ে থাকা জিনিসপত্র, বেয়াড়া ছেলের দল, রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো ঘেয়ো কুকুর এমনকি ঝলমলে সাইনবোর্ডগুলোও যেন এক করুন পরিলেখায় বিধৃত হয়ে আছে। তার মনে হতে লাগল, পারিপার্শ্বের সবকিছুই যেন চলমান আঁকা ছবির দল, মৃত্যু এবং ধ্বংসের চড়া এবং উজ্জ্বল বর্নে রঞ্জিত। গত দশ বছরের মধ্যে এই প্রথম তার মন এত স্বচ্ছ, প্রানবন্ত, এবং এক বিষাদময় প্রাপ্তিতে পূর্ন হয়ে উঠল।
শিরদাঁড়া সোজা করে সে এগিয়ে গেল শহরের মধ্যে – যে শহর জানে না, জানতেও পারবে না যে কি নিশ্চিত নিয়তির দিকে সে এগিয়ে চলেছে প্রতি মুহুর্তে – এক সর্বব্যাপী ধ্বংসের ভবিতব্য মাথায় নিয়ে।
*****
“কি কপাল মাইরি আমাদের – টাকায় যে সিন্দুক উপচে পড়ছে ভায়া।“ সেই বেঁটে লোকটি ড্রয়ার খুলে কিছু নোট বের করে শূন্যে তুলে নাড়াতে লাগল। “প্রায় কোটি খানেক কামিয়ে ফেললাম। আর এসব করার দরকার আছে কি?”
“নিশ্চই” অন্য লোকটি, অর্থাৎ “বন্ধু” বলে উঠল, “আমাদের বস খুব খুশী। টাকা কামানোর এর থেকে ভালো ফিকির কি হতে পারে? টাইম মেশিন, টাইম চ্যানেল – বুদ্ধিটা ভাবো একবার! এরকম একটা গপ্প ফেঁদে টাকা কামানোর কথা কে কবে মাথায় আনতে পেরেছে বলো দিকি? একটা বড় নিকাশী পাইপকে ব্যাবহার করে কাজ চলে যাচ্ছে। কেউ কিছু টের পেলে, নিমেষে গায়েব, কেউ টিকিটিও ছুঁতে পারবে না। কিন্তু আমার মনে হয়, এটা চলুক আরো কিছুদিনের জন্য।”
“ঠিক কথা” বেঁটে লোকটি অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠল। “খদ্দের আরো বাড়বে অদূর ভবিষ্যতে, আর এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে কেউ ধরতেও পারবে না। কারন, সবাই বিশ্বাস করে নিচ্ছে যে সে অন্য এক জগতে পৌঁছে গেছে, তাই কেউ আর মুখ খুলবে না। আসল কথাটা হলো, এসব গল্প অন্যের কাছে বললে যে তাকে নিয়ে চরম খিল্লি হবে, সেই বোধটুকু তো আছে।”
“টাইম-স্পেস চ্যানেল” – হাসতে হাসতে সেই “বন্ধু” বলে উঠল। পাতি চ্যালাকাঠের দরজা, সায়েন্স ফিকশন সিনেমার কিছু ক্লিপিং – তোমার কি মনে হয়না, এটা একটা দুর্দান্ত আইডিয়া? দরজার সামনে গুরুত্ব সহকারে দাঁড় করানো – অজ্ঞান করার একটা গ্যাস আর একটা কম্পমান যন্ত্র ব্যাবহার করে প্যাসেজের মধ্যে একটা অদ্ভুত অবস্থার সৃষ্টি করা, আর যখন তারা অন্য দরজাটা দিয়ে বেরিয়ে আসে, তখন ভেবে নেয় অন্য দুনিয়ায় গিয়ে হাজির হয়েছে। কি সব লোক মাইরি। সেই ঘুরে ফিরে একই ঘরে ঢুকছে আর এদিকে কিস্যু বুঝতে পারছে না। আরে বুঝবেটাই বা কি করে, তিনটে দরজার দুটো তো ততক্ষনে পর্দা দিয়ে ঢেকে ফেলেছি আমরা। আর শুধু এইটুকুই চাই তাদের বিশ্বাস অর্জন করতে যে তারা অন্য ঘরে দাঁড়িয়ে আছে। না কেউ সন্দেহ করে, না কেউ নজর করে।”
“কিন্তু বন্ধু”, চাপা স্বরে সেই বেঁটে লোকটি অন্যমনষ্ক ভাবে বলে উঠল, “একটা জিনিস আমাকে একটু ভাবাচ্ছে……”
“আরে, বস বলেছে এরকম আরও শাখা সে পৃথিবী জুড়ে খুলতে চায়।” “বন্ধু” বেশ ভারিক্কি চালে বলে উঠল, “যতদিন খদ্দের আসছে, ততদিন ডলার। এখন সারা দুনিয়া জুড়ে চারশ’ এর ওপর শাখা আছে, এবং আরো আসবে। কিসের অ্যাতো চিন্তা তোমার?”
“সেদিন হেড অফিসে গিয়ে একটু সংখ্যাতত্ত্বে চোখ বোলাচ্ছিলাম”, সেই বেঁটে লোকটি ভুরু কুঁচকে বলল, “একটার পর একটা খদ্দের কেবল তিন নম্বর দরজাটাই পছন্দ করেছে। কিন্তু কেন? এখানেও সেই এক গল্প – সবাই একটু ইতস্তত করে তিন নম্বরেই যেতে চায়।”
বন্ধু হেসে বলল, “তাতে এটাই প্রমান হয়, যে, লোকে যাই বলুক, ধ্বংসের দিকে মানুষের একটা স্বভাবসিদ্ধ ঝোঁক আছে। যতই তারা মুখে বিশ্বশান্তি, মনুষ্যত্বের বুকনি দিক না কেন, মনে মনে সবাই এই পৃথিবীর ধ্বংসই দেখতে চায়, সাক্ষী থাকতে চায় সেই নাটকীয় অন্তিম মুহুর্তের। সেই একভাবে জীবনের জোয়াল টানার থেকে, সবার সঙ্গে যন্ত্রনাহীন ভাবে বিলুপ্ত হয়ে যেতে চায়। মানুষ শালা ভেতর ভেতর হেবী লুচ্চা – উঁকি মারার স্বভাবটা ছাড়তে পারে না। নিজের এই কামুক ইচ্ছে চরিতার্থ করতে, অন্যের জীবনে উঁকি সে মারবেই, তাতে দুনিয়া রসাতলে যাক। তা – সে যা ইচ্ছে করুক, আমাদের কি? ব্যাটারা বহুদিন পর, মানে বছর দশ বারো পর বুঝবে যে এসব ফাঁকি – তাই না?”
“কিন্তু বন্ধু”, শূন্য দৃষ্টিতে বেঁটে লোকটি বলে চলল, “শুধু আমাদের এই দোকান থেকেই, প্রায় হাজার খানেক লোক বেরিয়েছে, যারা সবাই ঐ তিননম্বর দরজা দিয়েই গেছে। আগামী বছর গুলোতেও এই সংখ্যা বাড়বে বই কমবে না। কিন্তু এই হারে এদের সংখ্যা বাড়তে থাকলে দুনিয়ার কি হবে ভেবে দেখেছো? যারা বিশ্বাস করে যে এক যুগের কিছু বেশি সময়ের মধ্যে দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যাবে, এরকম লোকের সংখ্যা যদি এভাবে ক্রমশই বেড়ে চলে? জানো, আমাদের খদ্দেরের মধ্যে, কত অফিসার, সরকারী কর্মচারী, এবং রাজনীতিবিদ আছেন………”
লেখক পরিচিতিঃ সাকিয়ো কোমাৎসু – (১৯৩১ – ২০১১)
জাপানের অন্যতম বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান গল্পকার। ভদ্রলোক জাপানের ওসাকাতে জন্মগ্রহন করেন, এবং কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতালিয়ান সাহিত্যে স্নাতক হন। তাঁর লেখালেখি মূলত শুরু হয় ১৯৬০ এর দশক থেকে কোবো আবে- এর রচনা এবং ইতালিয়ান সাহিত্য পড়াশোনা করে। ক্রমশ কোমাৎসুর ধারণা জন্মায়, যে আধুনিক সাহিত্য এবং কল্পবিজ্ঞান একে অপরের পরিপূরক। কোমাৎসু সারা জীবন লিখেছেন প্রচুর, কিন্তু তাঁর লেখার মধ্যে বার বার ফিরে ফিরে এসেছে জাপানের ওপর পারমাণবিক আক্রমণের অভিশাপ। তিনি নৈরাশ্যবাদী ছিলেন না, ঐ ধ্বংসের পরে লুটিয়ে পড়া জাপান যে একসময় উন্নতির মহাশিখরে উঠবে তাই নিয়ে তিনি লিখে গেছেন তাঁর কল্পবিজ্ঞান। জীবনে বহু সম্মান তিনি পেয়েছেন, তার মধ্যে ১৯৮৫ সালে Nihon SF Taisho Award তাছাড়া ২০০৭ সালে ইয়োকোহমাতে অনুষ্ঠিত ৬৫ তম বিশ্ব কল্পবিজ্ঞান সম্মেলনে তিনি জাপানের প্রতিনিধিত্ব করেন। ২০১১ সালে, আশি বছর বয়সে, নিউমোনিয়াতে আক্রান্ত হয়ে তিনি মারা যান।
ইংরেজি অনুবাদ – সিরো তোমুরা ও গ্রানিয়া ডেভিস
বাংলা অনুবাদ – সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
Tags: জাপানি গল্পের অনুবাদ, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর), দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা, বিকল্প, সাকিয়ো কোমাৎসু