বীজ
লেখক: নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত
শিল্পী: অঙ্কিতা
শবনম্ খুব ভালো আদর করে। আনন্দ এই আদরের সময় সব কিছু ভুলে যায়। ওর কাজ, ওর হেরে যাওয়া, রেজাল্ট ভালো না হওয়া, মায়ের মানসিক দুর্বলতা, বাবার বীভৎস মৃত্যু… সব কিছু। কিন্তু বিয়েটা ওদের দুজনের কিছুতেই করা হবে না। শবনম্ আনন্দর গলার কাছে নাক ঘসতে ঘসতে বলে, “তোর বাবা যদি বেঁচে থাকত তাহলে আমি কিছুতেই তোকে ছাড়তাম না।” আনন্দ জানে, মা শবনম্-এর কথা জানতে পারলেই আবার অসুস্থ হয়ে যাবে। শবনম্ জিন নিয়ে গবেষণা করে। সেই কিশোর বেলার বন্ধুনী। কিছুদিনের মধ্যে লন্ডন চলে যাবে। ওর সঙ্গে নাসেরের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। নাসেরের ছবি দেখেছে আনন্দ। হ্যান্ডসাম আর বড়লোক। অথচ শবনম্ আনন্দকে খুব ভালোবাসে। আনন্দ মাকে কষ্ট দিতে চাইছে না। তা ছাড়া ভেতর ভেতর খুব বুঝতে পারে সে শবনম্-এর উপযুক্ত নয়। আজ আদর ভালোবাসার হয়ত শেষ দিন, তাই একটু বেশী সময়ের বরাদ্দ রেখেছে দুজন। তবুও সময় শেষ হল। চোখের জল আর আদর সব কিছু থামিয়ে দুজনে দুদিকে রওনা দিল। কেউ কাউকে পৌঁছে দিল না।
“আপনার ছেলে লোককল্যাণের জন্য পৃথিবীতে এসেছে। কোন পব্লেম নাই। পোচুর টাকা পয়সা হবে, বহু নারী সংসর্গ হবে। কোন পব্লেম নাই। তবে হঠাৎ মিত্তুর একটা যোগ আছে। একটা কবচ দিয়ে রাখলাম। কোন পব্লেম হবে না।” এই নিয়ে ছাব্বিশ বার এই কোষ্ঠী দেখলেন জ্যোতিষ সয়ম্ভু পঞ্চানন মিত্র। সুতপা ঢোঁক গিলে বললেন, “আগে তো কখনও মৃত্যুযোগের কথা বলেননি।” “আরে না না কবচ দিয়ে রাখলাম। আর যদি যজ্ঞ করাতে চান সামনের অমাবস্যাতে ব্যবস্থা করি। হাজার ছয়েক টাকা লাগবে। কোন পব্লেম হবে না।” “তাই করতে হবে তাহলে। আপনি ব্যবস্থা করুন।” সুতপার শরীর অবশ। ছেলের যদি কিছু হয়ে যায়…! তার কী হবে? মা তারা, লোকনাথ বাবা সব্বাইকে ডাকতে লাগলেন। আনন্দকে ফোন করলেন। ব্যস্ত আছে বলছে। মানে কারো সঙ্গে কথা বলছে কোন বিপদ হয়নি। কপালে হাত ঠেকান।
আনন্দ গাড়ি থেকে নেমে আবার অস্বস্তিটা ফিরে পেল। এই নিয়ে তিনবার। কে যেন তাকিয়ে আছে মনে হয়। আজ শান্ত হয়ে চারিদিকে চোখ বোলায়। হাঁটা শুরু করে। নাহ্! ফিরে আবার তাকায়। অনুমান ঠিক। ইয়ং স্টার ক্লাবের পাশের ঝুপ্সি অন্ধকারে একটা মেয়ে। বেশ সুন্দরী। সোজা তাকিয়ে আছে তার দিকে। একটু ধন্দে পরে যায়। সে জানে যে সে মোটেই আকর্ষক নয়। কিন্তু এভাবে তাকিয়ে আছে কেন? প্যান্টের জিপ দেখে তাড়াতাড়ি করে। নাহ্, সব ঠিক আছে। আবার মুখ ফিরিয়ে দেখল। এখনও তাকিয়ে। যাহ্ বাবা! এ আবার কি ফ্যাচাং!
বাড়ির গেটে ঢুকতেই শবনমের ভিডিয়ো কল। চুল কেটেছে। বিয়ের পোশাক কিনছে। মনটা দমে গেল। মা যে কেন বুঝতে চায় না। এর মধ্যে অমন সুন্দরী মেয়ে কেন তার দিকে তাকিয়ে আছে! একটু গুলিয়ে গেল সব কিছু। সুতপার মন খারাপ। একা একা মানুষ করেছেন ছেলেকে। ছেলে ছাড়া আর কেউ নেই তার। ছেলে ফিরতেই কেঁদে ফেল্লেন। জ্যোতিষ সয়ম্ভু পঞ্চানন মিত্রকে একেবারে দেখতে পারে না আনন্দ। এমনিতেই তার মাথায় সব গুলিয়ে যাওয়া অবস্থা। মায়ের অযৌক্তিক ঘ্যান ঘ্যান তার স্থৈর্য ভেঙে দিল। বেশ চিৎকার করে ফেলল সে। আবার সব কিছু একটু থিতিয়ে যেতে মনটা খারাপ হলো। মাকে জড়িয়ে ধরে আদর করলো। মা তার স্নেহের কাছে সব ভুলে যান। রাতে খাওয়া হয়। টিভি সিরিয়াল হয়। পরের দিন সকালে যাবার প্রস্তুতি হয়। ছোটবেলার ছবি দেখা, ফেসবুক করা। নেইমারের চোট নিয়ে ফিচার পড়া হয়। শবনমের কাছ থেকে চুমু আর হার্ট সাইন আসা হোয়াটসঅ্যাপে কিছু লাইফ সংক্রান্ত মেসেজ ফরোয়ার্ড করা হয়। ফোন বন্ধ করে বালিশে এবার মাথা নামালেই হয়। বিছানা থেকে একতলার গেটটা দেখতে পাওয়া যায়।
চমকে যায় আনন্দ। একী সেই মেয়েটা! এই অন্ধকারে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে ওর জানালার দিকে তাকিয়ে। এই অল্প আলোতেও চোখটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। মুখ থেকে অস্ফুট কিছু আওয়াজ বার হয় আনন্দর। আরও শিহরিত হয়ে যায় সে। খুব ধীরে ধীরে যেন ভেসে ভেসে মেয়েটা তার জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়। গলা শুকিয়ে কাঠ আনন্দর। ভূত! নাকি মাথা খারাপ হয়েছে তার? হ্যালুসিনেশান হচ্ছে? মেয়েটির চোখের পাতা পড়ে না।
“হ্যালো, আনন্দ আমি একটু তোমার সঙ্গে কথা বলতে পারি?”
আনন্দ হ্যাঁ না কিছু বলতে পারছে না। গোঁ গোঁ করছে। মেয়েটি কেমন বাতাসের মতন জানালা দিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। মেঝেতে পা দিয়ে নয়। একটু ওপরে সে ভেসে আছে। শান্ত হল আনন্দ। নিজেকে নিজে সামলাল। জিভ দিয়ে ঠোঁট মুছে জিজ্ঞেস করে, “তুমি কে?”
“আমি ডি-মারথা, মনিকা বলতে পারো, মাশা বলতে পারো। আমরা প্রায় তিন মাস ধরে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি।”
“কেন?”
“তোমাকে আমার খুব দরকার, তোমার সঙ্গে ঠিক কি ভাবে যোগাযোগ করা যাবে বোঝা যাচ্ছিল না। আমরা জানি তুমি খুব মানবিক আর বুদ্ধিমান। আর কেমন চেহারা পছন্দ সেটাও জানা দরকার।”
নিজের বাম হাতে জোরে চিমটি কাটে আনন্দ। না, স্বপ্ন নয়। কিন্তু এই ভয়ঙ্কর লেবেলের হ্যালুশিনেসান। “না না সব ঠিক আছে। আপনি কোন মস্তিষ্ক বিকারে ভুগছেন না। আপনি সম্পূর্ণ সুস্থ।”
মেয়েটি নিস্পলক চোখে নিপাট বাংলায় বলে চলে। “আনন্দ, আপনি সত্যি আমাকে দেখতে পাচ্ছেন।”
আনন্দ বলে, “আপনি আমার মনের কথা কি করে বুঝতে পারছেন?”
ডি-মার্থা নির্লিপ্ত গলায় বলে ওঠে, “আমরা বহুদিন থেকে আপনাকে জানবার চেষ্টা করছি। এখন আমি বেশ কিছুটা বুঝতে পারি। আপনি যদি একটু শান্ত হন তাহলে গোটা ব্যাপারটা আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারি।”
সাধারণ লেগিংস আর টিশার্ট পরা ডি-মার্থা থম মেরে বসে থাকা আনন্দকে বলতে থাকে। “আমরা খুব বিপদের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আপনার বীজ আমাদের চাই। আপনি জেনে অবাক হবেন আপনি যে পৃথিবীতে এখন বাস করছেন সেটা এখন মানে আমাদের সময়ে ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলছে। “সম্পূর্ণ” মানব বা মানবী এখন নেই। জল ব্যবহারের অযোগ্য। বাতাস খুব গরম। আমাদের সম্পূর্ণ মানুষ তৈরি করতে আপনার বীজ লাগবে।”
আনন্দ মুখ হাঁ করে শুনছিল। অতিকষ্টে বলল, “টাইম ট্রাভেল সম্ভব?”
“হ্যাঁ আর এক দশকের মধ্যে… আমি ডি-মারথা কিন্তু আমার ছায়া পাঠিয়েছি। যেমন ছবি পাঠাতে পারেন আপনারা। তবে মহাজলোচ্ছ্বাস এর আর দেরী নেই…”
আনন্দ একটু সাহস নিয়ে বলে, “আপনি এতো শুদ্ধ বাংলা বলেন কি করে? বাঙালীরা বেঁচে আছে?”
“না না কোনও ভাষা আর নেই আপনি যেটা ভাবছেন সেটা আওয়াজে পরিবর্তন করে আমি বলছি। মহাজলোচ্ছ্বাসের আগে বিজ্ঞানীরা লুকিয়ে সব সুপার-কম্পিউটারগুলোকে রক্ষা করেছিল। কিন্তু মানুষ তার সম্পূর্ণতা হারিয়ে ফেলেছে। আপনার যেমন পাঁচটা ইন্দ্রিয় আছে। এখন খুব কম মানুষের সেটা আছে।”
কথা শেষ করে ডি-মার্থা তার নীল আলো জ্বলা চোখ একবার বন্ধ করল। আনন্দের বুকে শিরশিরে অনুভুতি হল।
“আপনি আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। আপনি প্রতিশোধ পরায়ণ নন। ভালবাসতে জানেন। দায়িত্বশীল। শরীর আপনার নিখুঁত। আমরা তাই ‘বীজ’ চাইছি। গর্ভধারণের যোগ্য কয়েকজন মানবী আমাদের আছে। তাদের মধ্যে আপনার যাকে ভালো লাগে…।”
“মানুষের স্বাভাবিক জীবন সত্যি নষ্ট হয়ে গিয়েছে!” মনে মনে ভাবল আনন্দ। এরকম আরও অজস্র প্রশ্ন মনে ভাবতেই উত্তর দিতে থাকে ডি-মারথা।
“আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে আপনি রাজী?”
আনন্দ কিছু বলে না। ডি-মারথা বলে ওঠে, “আপনি মজা পাচ্ছেন।”
ডি–মার্থা ইতিবাচক সিগন্যাল পাঠায়। কাল দুপুরের মধ্যে তারা বীজ নেবার ব্যবস্থা শুরু করতে পারবে। আনন্দ ক্লান্ত শরীরে এতো উত্তেজক ঘটনার অংশ হয়েও কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পরে। ডি-মার্থার কাছে আরও একটা সিগন্যাল আসে।
“প্রজেক্ট শেষ হলে ছেলেটি সম্ভবত বাঁচবে না। ওর পক্ষে এই পরিবেশ খুব কষ্টকর, সেটা নিয়ে কী ভাবছ?” ডি-মার্থা চোখের নীল আলোটা নিভিয়ে দেয়, “কিছু করার নেই। ‘বীজ’ তো লাগবে।” প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা হয়ে গেল শবনম্ আনন্দের কাছ থেকে কোন ফোন বা মেসেজ পায়নি। খুব মানসিক অস্বস্তির মধ্যে পড়েছে সে। হঠাৎ আনন্দের ফোন। ওপারে আনন্দর মা, “তুমি আমাকে চেন না। আমি আনন্দের মা। কাল থেকে আনন্দ কোথায় গেল? ফোন টাকার ব্যাগ সব ঘরে। কিন্তু আনন্দ কোথায়? তুমি কিছু জানো?” শবনম্ ধপ করে সোফায় বসে পরে। ওর হাতে ধরা প্রেগন্যান্সি কিটে দুটো লাল লাইন জ্বলজ্বল করছে।
Tags: অঙ্কিতা, কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, নিবেদিতা ঘোষ মার্জিত
খুব ভালো লাগল।
সুন্দর গল্প।
দারুণ লাগল!
দারুণ গল্প