বুদ্ধির্যস্য
লেখক: ঋজু গাঙ্গুলী
শিল্পী: সৌরভ দে
বুদ্ধির্যস্য
লেখক – ঋজু গাঙ্গুলী
অলংকরণ – সৌরভ দে
“দেড় হাজার বছর!” আপ্রাণ চেষ্টা করেও নিজের গলা থেকে রাগ আর হতাশা সরিয়ে রাখতে পারছিলেন না হেম। “দেড় হাজার বছর ধরে চলছে পরীক্ষাটা। সবেমাত্র সেটা কিছু সত্যিকারের ফলাফল দিতে শুরু করেছে। তখনই সেটা এভাবে থামিয়ে দেওয়া যায় না। আপনি এরকম কিছু করতে পারেন না কম্যান্ডার!”
“যায়।” শক্ত গলায় বলেন গোরাম। “এবং আমি পারি।”
“পারেন!” বিষাক্ত গলায় হিসিয়ে ওঠেন হেম, “অবশ্যই পারেন। এই ফ্লিটের সব ক-টা অস্ত্র প্রয়োগ করে স্টেশন সেভেনটিন-কে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারেন আপনি। কিন্তু তার ফল কী হবে সেটা ভেবে দেখেছেন একবারও।”
“একবার নয়, ডক্টর।” গোরাম চিবিয়ে-চিবিয়ে বলেন।
স্ক্রিনে ফুটে উঠেছিল মহাকাশের অন্তহীন কালিমা, আর তার একদম মাঝখানে জমাট বেঁধে থাকা অজস্র তারার একটা জমাট ক্লাস্টার। সেদিকেই ধেয়ে চলেছিল স বক-টা স্পেসশিপ। স্ক্রিনে চোখ থাকলেও অভিযানের দুই মাথা কথা বলছিলেন নজরের বাইরে থাকা একটা সাদামাটা নীলচে গ্রহকে নিয়েই।
“ইম্পিরিয়াল স্টারফ্লিটের একজন কম্যান্ডারকে যখন কোনও দায়িত্ব দেওয়া হয়, তখন তাকে সেটা নিয়ে বারবার ভাবতে হয়।” গোরামের কথাগুলো হেম-এর কানে ধাক্কা মারে।
ভাবনা!
বিতৃষ্ণায় মুখটা বেঁকে ওঠে হেম-এর।
স্টারফ্লিটের দায়িত্ব রয়েছে গোরামের মতো কিছু প্রাগৈতিহাসিক মনোভাবের লোকজনের হাতেই। এদের বুদ্ধিশুদ্ধি কম, কিন্তু সাহস, সহিষ্ণুতা, আর লেগে থাকার ক্ষমতা মারাত্মক। ফলে বুদ্ধিমত্তার পাশাপাশি এদের মতো লোকেদেরও গুরুত্ব দিতে বাধ্য হয় সাম্রাজ্যের প্রশাসন। কিন্তু এদের ভাবনার দৌড় যে কতদূর, তাই নিয়ে হেম, বা তাঁর মতো সাইকোটেকনিশিয়ানদের কোনও সংশয় নেই।
“স্টেশন সেভেনটিন নিয়ে যে খবর রাজধানীতে পৌঁছেছে, সেটা যথেষ্টই উদ্বেগের।” স্থির গলায় বলেন গোরাম, “আমার রিপোর্টের ভিত্তিতে ঠিক করা হবে আপনাদের এই ‘পরীক্ষা-নিরীক্ষা’ আর চালানো উচিত হবে কি না।
আর হ্যাঁ, আপনি অস্ত্রশস্ত্রের কথা তুলছিলেন না একটু আগে? গোটা ফ্লিট নয়, শুধু এই একটা স্পেসশিপের অস্ত্র দিয়েই আমি দরকার পড়লে ওই গ্রহটাকে একটা কাঠকয়লা বানিয়ে দিতে পারি। বিপদ বুঝলে তেমন কিছু করার ক্ষমতাও আমাকে দেওয়া আছে।”
অসহ্য!
কম্যান্ডার নয়, বরং মিলিটারি ইউনিফর্ম পরে ডাঁটসে দাঁড়িয়ে থাকা এই লোকটাকে একটা গোরিলা বললেই ঠিক হয়। গোরামের গাঁট্টাগোট্টা চেহারা, ভাঁজ পড়ে কুঁচকে যাওয়া পোড়খাওয়া চ্যাপ্টা মুখের কুতকুতে চোখের দিকে তাকানো মাত্র বিতৃষ্ণা হয় হেম-এর। কিন্তু আপাতত রাগ গিলে ফেলে তিনি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেন।
“কিন্তু কম্যান্ডার, কী এমন করেছে স্টেশন সেভেনটিন? তারা হাউই উদ্ভাবন করেছে। মিসাইল নয়, রকেট নয়, স্রেফ বারুদ জ্বালিয়ে আকাশে তোলা হাউই! সার্ভেইল্যান্স পোস্টের রিপোর্টে থাকা এইখবরের ভিত্তিতে একটা গোটা গ্রহকে এইভাবে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেওয়ার কথা উঠছে কেন?”
“উত্তরটা আপনি আমার চেয়ে ভালো জানেন ডক্টর।” মিষ্টি সুরে প্রচুর বিষ ঢেলে বলেন গোরাম, “মাত্র দেড় হাজার বছরের মধ্যে একেবারে আদিম অবস্থা থেকে হাউই উদ্ভাবনের ক্ষমতা জন্মেছে এদের মধ্যে। একটা স্থিতিশীল সাম্রাজ্যের পক্ষে এইরকম লোকেরা কতটা বিপজ্জনক, তা নিশ্চয় আপনাদের সবচেয়ে নীচু ক্লাসের ছাত্রও বুঝবে।”
তাহলে এই হল ব্যাপার!
সেনাবাহিনীর লোকেরা তাঁর মতো সাইকোটেকনিশিয়ানদের দু’চোখে দেখতে পারে না, এটা হেম বোঝেন। ছায়াপথ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা সাম্রাজ্যকে অজস্র হানাদার, শত্রু সাম্রাজ্য, দস্যু, বিদ্রোহী, এসবের সঙ্গে নিরন্তর লড়াই করে সুরক্ষিত রাখে সেনাবাহিনী। রাজধানীর নিরাপদ আরামের বদলে সীমান্তের বিপজ্জনক পরিবেশে জীবনের বেশিরভাগটাই কাটিয়েছেন গোরাম, এবং তাঁর মতো অধিকাংশ কম্যান্ডার। অন্যদিকে হেম-এর মতো বিজ্ঞানীদের কাজ হল পর্যবেক্ষণ, ন্যূনতম হস্তক্ষেপ, এবং মনস্তত্ত্ব আর প্রযুক্তির মিশেল দিয়ে শাসনের পদ্ধতি ঠিক করা। এই দুয়ের মধ্যে একটা শ্রেণি-সংঘাত লেগেই থাকে।
তাহলে কি স্টেশন সেভেন্টিনকে তছনছ করে গোরাম বুঝিয়ে দিতে চাইছেন, সাইকোটেকনিশিয়ান বিজ্ঞানীদের ‘স্যাকরার ঠুকঠাক’ বরবাদ করে দেওয়ার জন্য সেনাবাহিনীর‘কামারের এক ঘা’-ই যথেষ্ট?
“দয়া করে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করুন কম্যান্ডার।” যথাসম্ভব সংযতভাবে বলেন হেম, “তিন হাজার বছর ধরে টিকে রয়েছে এই সাম্রাজ্য। কিন্তু এই অবস্থা চিরকাল চলতে পারে না। আমরা জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, এসবের সঙ্গে মনস্তত্ত্ব মিশিয়ে একটা বেশ ভালো মডেল খাড়া করেছি যেখানে লোকের জীবনযাত্রা, বিনোদন, ওঠা-নামা, সব মিলিয়ে সুন্দরভাবে কাজ চলে যায়।
কিন্তু কাজ চালানো জিনিস এক-না-একদিন ভেঙে পড়েই। তাই আমাদের দরকার একটা পরিবর্তন। এমন একটা পরিবর্তন যা স্থিতাবস্থা ভেঙে সাম্রাজ্যকে বাধ্য করবে এগিয়ে যেতে। কিছু একটা… কিছু একটা নতুন করতে!
এই মধ্যমেধা, এই ‘কাজ-চালানো’ ব্যবস্থা আর নেওয়া যাচ্ছে না। সেজন্যই স্টেশন সেভেন্টিনের জন্ম, যাতে এই দুষ্টচক্র থেকে সাম্রাজ্যকে বের করা যায়। যাতে কিছু বুদ্ধিমান মানুষ এই চক্রের বাইরে নিজের মতো করে ভাববার, করবার, গড়বার সুযোগ পায়।”
“তিন। হাজার। বছর।” কেটে-কেটে বলেন গোরাম, “আপনার জ্ঞানত মানুষের ইতিহাসে আর কোনও সাম্রাজ্য এতদিন টিকেছে?”
“না।” মেনে নিতে বাধ্য হন হেম। “কিন্তু এই ব্যবস্থাও ভেঙে পড়বে একদিন। পড়বেই। সাম্রাজ্য বিপন্ন। সেটা বোঝার মতো বুদ্ধি কারও থাকুক বা না-থাকুক।”
“আপনার কথাগুলো রাষ্ট্রদ্রোহের একেবারে গা-ঘেঁসে যাচ্ছে কিন্তু।” নীচু স্বরে বলেন গোরাম, “তাছাড়া সাম্রাজ্য যে বিপন্ন সেটা আমাদের মতো লোকেরা সবচেয়ে ভালো বোঝে ডক্টর। আমরাই রক্ত-ঘাম-অশ্রু ঝড়িয়ে মানুষ বা না-মানুষ শত্রুদের হাত থেকে নাগরিকদের বাঁচাই। কিন্তু আপনাদের এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা যে নতুন শত্রুদের জন্ম দিচ্ছে, তারা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে লোকের মনে সাম্রাজ্যের স্থিতিশীল অবস্থার বিরুদ্ধে একটা প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে। মেধার ভিত্তিতে জীবনশৈলী নির্বাচন, একটা নরম-সরম ধর্ম সবার ওপর চাপিয়ে দেওয়া, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে বিশেষ কিছু প্রযুক্তি সবার হাতের নাগালে না আনা, শেষে সম্রাট ও তাঁর ইম্পিরিয়াম, এই সবকিছুই লোকের কাছে অপ্রয়োজনীয়, বা পুরোনো বলে মনে হবে।
তখন কী হবে, সেটা ভেবে দেখেছেন?”
“সেটাই সবচেয়ে আগে ভাবা হয়েছিল।” আর ধৈর্য রাখতে পারেন না হেম, “দেড় হাজার বছর আগে সাইকোটেকনিশিয়ান বিজ্ঞানীরা যখন জিনের ভিতিতে গড়পড়তা মানুষের থেকে বুদ্ধিমান মানুষদের আলাদা করতে সফল হন, তখন তাঁদের মাথায় প্রথমেই এই চিন্তা, বা দুশ্চিন্তাটা এসেছিল।
যদি শুধুমাত্র বুদ্ধিমান মানুষদের নিয়েই কোনও জনগোষ্ঠী গড়ে ওঠে, তাহলে তার পরিণতি কী হবে, সেটা জানার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষাও তখনই শুরু হয়। এবং এখন অবধি সেটা এটাই প্রমাণ করেছে যে এমন মানুষেরা অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় হয়। ন্যূনতম চাহিদাগুলো মেটানোর পর তাদের হাতে যে সময় থাকে তাই নিয়ে তারা প্রচুর উদ্ভাবন করে ঠিকই, কিন্তু সামগ্রিকভাবে তার কোনও চিহ্ন সমাজে পড়ে না।”
“কেন?” গোরাম কৌতূহলী হন।
“কারণ একটা উদ্ভাবনকে বড়ো আকারে, প্রায় ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কেলে রূপায়িত করতে গেলে যে রকম অর্থনীতি দরকার, যেরকম সংখ্যায় শ্রমিক বা কাঁচামাল চাই, সেসবের কোনও জোগান নেই এই সমাজে।”
“তাহলে” হতভম্ব হয়ে বলেন গোরাম, “এই ‘পরীক্ষা’ থেকে আপনারা কী পেতে চাইছেন?”
“শুধু আমরা নয় কম্যান্ডার।” হেম-এর গলায় একটু গর্ব মাথা তোলে। “প্রশাসন, এবং তার মাধ্যমে সব নাগরিক ইতিমধ্যেই স্টেশন সেভেন্টিনের সুফল পেয়েছে। যেহেতু এই গ্রহের বাসিন্দারা বুদ্ধিমান, তাই যুদ্ধ ব্যাপারটা যে কত অর্থহীন, সেটা তাদের মাথায় ঢোকাতে আমাদের খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি। তার ফলে তাদের মধ্যে যে আচার-আচরণ তৈরি হয়েছে, সেগুলো দেখে সাইকোটেকনিশয়ানরা ইতিমধ্যেই অনেক কিছু শিখেছে। সেইসব মডেল কাজে লাগিয়ে প্রশাসনকে আরও গতিময়, আরো সংবেদী করে তোলা গেছে।”
“আর সেটাই এই গ্রহটাকে ল্যাবরেটরি বানানোর একমাত্র ফল?” গোরামের গলায় বিস্ময় আর ব্যঙ্গ সামনে আসার জন্য ঠেলাঠেলি করে।
“আপনার..” ‘মাথায় বাকি ফলগুলো ঢুকবে না’ কথাটাকে চেপে যান হেম। বরং বেশ কষ্ট করে বলেন, “আপনার সামনে তো এই গ্রহের বাসিন্দাদের বিবর্তন-উদ্বর্তনের পুরো ছবিটাই রাখা হয়েছে কম্যান্ডার। আপনার কি মনে হয় না, কাজ-চালানো আর টিকে থাকার অন্তহীন সংগ্রাম থেকে সাম্রাজ্যকে বের করে আনার মতো কিছুই করতে পারে না স্টেশন সেভেন্টিনের বাসিন্দারা?”
“কাগুজে ছবিতে আমার ভরসা নেই ডক্টর।” গম্ভীর গলায় বলেন গোরাম, “কাগুজে রিপোর্টের ভিত্তিতে যুদ্ধ করতে গিয়ে অজস্রবার আমরা বিপদে পড়েছি। তখন আপনাদের পরামর্শ মেনে চলা প্রশাসন আমাদের যুদ্ধজাহাজের বদলে কম্বল আর খাবার পাঠিয়ে শত্রু গ্রহে নামতে পরামর্শ দিয়েছে। তাই ওইসব রেকর্ড আপনি তুলে রাখুন।
স্টেশন সেভেন্টিন থাকবে কি না, সেই ব্যাপারে ফয়সলা আমি ওখানে নেমেই করব।”
হতাশভাবে স্ক্রিনের দিকে তাকান হেম।
রিপোর্টে যে জিনিসগুলো চেপে যাওয়া হয়েছিল, ওখানে নেমে সেগুলো নিজের চোখে দেখতে পেলে গোরাম আর দ্বিধা করবেন না। আকাশ থেকে মৃত্যু নেমে এসে শ্মশান করে দেবে গোটা গ্রহটাকে।
“ওখানে আপনাদের সার্ভেইল্যান্স পোস্টেই নামব তো আমরা?”
গোরামের প্রশ্নে চটকা ভেঙে, ছবি, নানা রিপোর্টের সংখ্যা, বিবরণ, তত্ত্ব, এসবের জট ছাড়িয়ে নিজেকে পোর্টে ফিরিয়ে আনেন হেম।
“ওখানে আমাদের কোনও সার্ভেইল্যান্স পোস্ট নেই।”
“তার মানে?” হেম-এর শুকনো গলায় বলা কথাটা শুনে গোরাম যে কতটা অবাক হয়েছেন, তা তাঁর কথা শুনেই বোঝা যায়।
“এটা অনেক আগেই প্রমাণিত” একটু কেশে গলাটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করেন হেম, “যে এমন জনগোষ্ঠী যদি একবার টের পায় যে তাদের ওপর নজরদারি, এমনকি মাস্টারি করা হচ্ছে, তাহলে তাদের বিবর্তন প্রত্যাশীত পথে হয় না। তাই স্টেশন সেভেন্টিনে আমাদের কোনও পোস্ট নেই।”
“তাহলে কোথায় আছে?”
গোরামের অবাক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ঘেমে ওঠেন হেম, “ওই গ্রহের একটা উপগ্রহে। ওখান থেকে পুরো গ্রহের ওপর খুব সহজে নজরদারি করা যায়, দরকারমতো ছদ্মবেশী বিজ্ঞানীদের নামিয়ে দেওয়া যায়, আর…”
“আর?”
“ওরা রকেট ব্যবহার করে গ্রহের বাইরে বেরোলে পোস্টটাকে খুব সহজে গুটিয়ে গ্রহাণুপুঞ্জের কাছে নিয়ে যাওয়া যাবে। তারপর সেখান থেকে, দরকার হলে, আরও দূরে।”
গোরামকে এতটা অবাক হতে কখনও দেখেননি হেম। ক্রুদ্ধ সৈন্যটির চোখে তার চেনা, রাগে জ্বলে ওঠা ভাবটা খুব শিগগিরি ফিরে এল অবশ্য।
“চমৎকার! তার মানে আপনারা গোড়া থেকেই জানতেন যে এই গ্রহের বাসিন্দারা বেশ চটপট আকাশে পাড়ি জমাবার জায়গায় চলে যাবে। এমনকি এও ভেবে রেখেছেন যে ওরা ওদের সৌরজগতের ভেতরে ঘোরাঘুরিও করতে পারে।
আপনাদের এই রিপোর্টে আমি কেন বিশ্বাস রাখতে পারছি না, এবার বুঝতে পারছেন ডক্টর?”
গোরামের রাগে কাঁপতে থাকা গলার সামনে হেম কিছু বলতে পারলেন না। তবে তিনি হালও ছাড়লেন না।
“এই গোরিলা শুধু কথায় বুঝবে না!” নিজের কেবিনের দিকে আসার সময় দাঁতে দাঁত ঘষছিলেন হেম, “একে অন্যভাবে কব্জা করতে হবে।”
“আপনি নিশ্চিত, যে আমাদের অস্ত্র আনার কোনও দরকার ছিল না?” গোরামের সন্দিগ্ধ গলাটা শুনে অতি কষ্টে নিজের মাথা ঠান্ডা রাখেন হেম।
“আর কতবার বলব আপনাকে? এই গ্রহের মানুষেরা খুবই শান্তিপ্রিয়। তাছাড়া আমাদের পোশাক-পরিচ্ছদ একেবারেই এখানকার মতো। তাই আমাদের কথা বলার ভঙ্গি শুনে এরা আমাদের বড়োজোর অন্য দেশের লোক ভাববে। অন্য গ্রহ-টহ এদের মাথায় আসবে না।”
আড়চোখে পাশের মানুষটিকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন হেম।
নাহ্! অনেক চেষ্টা করেও গোরামের ময়লা আলখাল্লা আর কোলকুঁজো ভাবের মধ্যে মিলিটারি ঔদ্ধত্য আর গায়ের জোর পুরোপুরি লুকোনো যায়নি। নেহাত এই গ্রহের ভাষা গোরাম জানেন না, তাই কথা বলতে গিয়ে তাঁর আসল পরিচয়টা প্রকাশ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু সেটা আবার অন্য একটা ঝামেলা তৈরি করবে!
“এদের বাড়িঘর দেখে তো খুব একটা সভ্য জায়গায় এসেছি বলে মনে হচ্ছে না।”
গোরামের কথাটা শুনে হেম ভাবেন, মিলিটারি অ্যাকাডেমিগুলোতে কি মানবসভ্যতার ইতিহাস বলতে শুধু গুলতি থেকে মিসাইল অবধিই পড়ানো হয়?
“এথেনিয়ান সভ্যতা, এবং তারপর বহু ক্ষেত্রেই এটা দেখা গেছে।” কম বুদ্ধির ছাত্রকে বোঝানোর মতো ধীরে-ধীরে বলেন হেম, “মগজ ও মনের বিকাশ হলেই জীবনযাত্রায় তার প্রভাব দেখা যায় না। ইনফ্যাক্ট বুদ্ধি বেশি হলে ভালো ঘর, পাকা রাস্তা, বিনোদন, এসবের বদলে মানুষ আরও উঁচু চিন্তাভাবনায় মেতে ওঠে।”
“কতটা উঁচু?” গোরামের গলাটা আবার সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে, “আকাশের ওপাশে কী আছে, বা সেখানে কীভাবে যাওয়া যায়, সেগুলো জানার মতো উঁচু?”
“আচ্ছা…!” রেগে গোরামের দিকে ফেরেন হেম, “আপনি কি কিছুক্ষণের জন্যেও এই ভয়টা কাটিয়ে উঠে গ্রহটাকে খোলা চোখে, সাদা মনে দেখতে পারছেন না?”
“আমি যথেষ্ট খোলা মনেই সব দেখছি।” গম্ভীর গলায় বলেন গোরাম, “আর সেনাবাহিনী কাউকেই ভয় পায় না। কিন্তু তা বলে অসতর্ক হওয়াটা বোকামির লক্ষণ।”
খেত, মাঠ, ঘাসজমি, কাদায় ভরা রাস্তা ঠেলে গোরাম আর হেম যখন গ্রামটায় ঢুকলেন, তখন হেম ক্লান্ত। যাতে কেউ টের না পায় সেজন্য তাঁদের শাটল গ্রাম থেকে বেশ কিছুটা দূরে নেমেছিল। গবেষণাগারের পরিবেশে অভ্যস্ত হেম কাদা ঠেলে, ভনভন করা পোকাদের তাড়িয়ে এতটা পথ হাঁটার ধকল নিতে পারছিলেন না।
গ্রামের ভেতরে একটা মোটামুটি বড়ো বাড়ির চেহারা দেখে দু’জনেরই মনে হল, এটা একটা সরাইখানা হতে পারে। সেখানেই গেলেন হেম আর গোরাম। ভেতরে সহজ ভিড় দেখে, গল্প আর হাসির শব্দ শুনে, সর্বোপরি খাবারের গন্ধ শুঁকে গোরামও যে কিছুটা সহজ হয়েছেন সেটা বোঝা যাচ্ছিল।
যেখান থেকে খাবার দেওয়া হচ্ছিল, সেখানে গিয়ে হেম বলেছিলেন, তাঁরা পাশের দেশ থেকে আসা ব্যবসায়ী। ক’দিন থাকার মতো একটা ঘর চাই তাঁদের।
ব্যাপারটা অবিশ্বাস করার মতো নয়। স্টেশন সেভেন্টিন একটা আস্ত গ্রহ, যার জনসংখ্যা এখনও অবধি প্রায় আশি লাখ। মোটামুটি দূরে-দূরে গড়ে ওঠা জনবসতিগুলোই সেখানে ভাষা আর জীবনযাত্রায় অল্পস্বল্প বদলের ভিত্তিতে আলাদা-আলাদা দেশ হয়ে গেছে।
তাঁদের দু’জনকে খুঁটিয়ে দেখে, সঙ্গে চামড়ার ছোটো থলে ছাড়া কিছুই নেই দেখে আশ্বস্ত হয়েছিলেন সরাইখানার মালিক। ঘরও পাওয়া গেছিল।
ঘরে গিয়ে চাপা গলাতেও বোমার মতো ফেটে পড়েছিলেন গোরাম!
“সাবাশ! ইম্পিরিয়ামকে লুকিয়ে আর কী-কী হতে দিয়েছেন এখানে আপনারা?”
বিস্ফোরণটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। তবু হেম পালটা প্রশ্ন করেন, “আমরা আবার কী করলাম?”
“সাম্রাজ্যের সর্বত্র একটাই ভাষা চালু থাকবে, এই নির্দেশটা যে অলঙ্ঘ্য, সেটা বুঝি আপনাদের খেয়াল ছিল না?” রাগে গোরামের গলাটা খসখসে, আরও জান্তব হয়ে ওঠে। “নাকি জেনেবুঝেও আপনারা এখানে যেমন-খুশি-তেমন ভাষার বিকাশ হতে দিয়েছেন?”
চুপ করে থাকেন হেম, কারণ উনি জানতেন, অন্য জিনিসগুলোও গোরামের নজর এড়ায়নি।
“তাছাড়া, যা মনে হচ্ছে তাতে, সাম্রাজ্যের একমাত্র ধর্মটিকেও এখানে কেউ মানে না। অর্থাৎ সাম্রাজ্যের মূল দুটো নিয়মকেই ভাঙা হয়েছে এখানে।” চিবিয়ে-চিবিয়ে বলে চলেন গোরাম, “অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে এদের সম্পূর্ণ স্বাধীন করেই রাখা হয়েছে, সে তো আপনাদের রিপোর্টেই বলা আছে।”
“কিন্তু এগুলো ভেবেচিন্তেই করা হয়েছে।” ক্লান্ত গলায় গোরামকে বোঝানোর চেষ্টা করেন হেম, “আমরা দেখেছিলাম, আদিম অবস্থায় ভাষা, বিশ্বাস, লেনদেনের ব্যবস্থা এসব জায়গায় হাত দিলে বিকাশটা স্বাভাবিক হয় না। তাই এগুলো চাপানো হয়নি ইচ্ছে করেই।”
“সে তো বোঝাই যাচ্ছে।” উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারি শুরু করেন গোরাম। তারপর চোয়াল শক্ত করে বলেন, “আমি ঠিক করে ফেলেছি ডক্টর। যখন সাম্রাজ্যের কোনও নিয়মই এই গ্রহের ওপর প্রযোজ্য নয়, তখন সাম্রাজ্যের সম্পদ কাজে লাগিয়ে এই স্টেশন সেভেন্টিনকে পালন করার কোনও মানে হয় না।”
“তার মানে?” হেম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান।
“আপনাদের এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা কতটা বিপজ্জনক, সেটা আপনাদের রিপোর্ট থেকে পুরোপুরি বোঝা যায়নি। কিন্তু এখানে এসে আমি বুঝতে পারছি, স্টেশন সেভেন্টিন একটি টাইম বম্ব। এখানকার লোকজন, যারা সবাই আপনাদের রিপোর্টমাফিক সাংঘাতিক বুদ্ধিমানও বটে, একবার গ্রহের ঘেরাটোপ পেরিয়ে বাইরে বেরোতে পারলে লোকে তাদের দেখে ভাববে, যেভাবে খুশি সেভাবে চললেই ভালো থাকা যাবে। সাম্রাজ্যও ভেতর থেকেই ক্ষয়ে যাবে।
আমাদের এখান থেকে চটপট বেরোতে হবে। আর দেরি করা যাবে না।”
“কিন্তু…” হেম-এর গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়, “এখানকার বয়স্ক মানুষদের সঙ্গে একবার দেখা করবেন না? কাছ থেকে একবার দেখবেন না, এরা কত নিরীহ, কতটা…!” গলা বুঁজে আসে হেম-এর।
“দেখে কী লাভ?” থমথমে মুখে জানলার কাছে গিয়ে বাইরের ধানখেত, কাদামাঠ, খোড়ো ঘরের দিকে তাকান গোরাম। তারপর দুঃখিত গলায় বলেন, “আপনারা পুরো ছবিটা একবারও দেখলেন না ডক্টর? একবারও ভাবার চেষ্টা করলেন না যে প্রগতি মানেও চালু ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটানো? একবারও ভাবলেন না, চালু ব্যবস্থায় এদিক-ওদিক হওয়াটা ইম্পিরিয়াম আদৌ মেনে নেবে কি না?”
হেম-এর চোখের সামনে একটা লাল পর্দা নেমে আসে। বাকি সব কথা, সব অনুভূতি মুছে যায়। রাগের একটা লেলিহান শিখা তাঁর চিন্তা, বুদ্ধি, বিবেক, সবকিছু জ্বালিয়ে দেয়।
হাতের কাছে থাকা ভারী মোমদানটা তুলে নিয়ে কখন যে হেম গোরামের পেছনে পৌঁছে গেছেন, কখন সেটা সজোরে নামিয়ে এসেছেন গোরামের মাথা লক্ষ্য করে, আর কখন পেছন থেকে মাথায় পড়া একটা মারের ঘায়ে চোখে অন্ধকার দেখে তিনি লুটিয়ে পড়েছেন মেঝেতে, এসবের কিছুই তাঁর মনে নেই।
“আপনি ঠিক আছেন তো?”
ব্যথার কুয়াশার মধ্য দিয়ে উদ্বিগ্ন গলাটা হেম-এর কানে ভেসে আসে। কার যেন গলাটা? ও হ্যাঁ, সরাইখানার মালিকের গলা এটা।
মাথা নেড়ে সায় দিতে গিয়ে যন্ত্রণায় মুখ বিকৃত করেন হেম। তারপর তিনি শুনতে পান ক্লিষ্ট গলায় গোরাম বলছেন, “আছি। ব্যথা আছে ভালোই। তবে আর ইঞ্চিখানেক নীচে মারটা পড়লে রগের কাছে চোটটা লাগত, আর তাহলে মুশকিল ছিল!”
গোরিলাটা বেঁচে গেছে! ভীষণ হতাশ লাগে হেম-এর।
“ওঁর কী অবস্থা?”
ফিসফিসিয়ে কেউ কথাটা বলল। হেম আন্দাজ করেন, নীচে মদের গ্লাস হাতে হল্লা করা ছাত্রগোছের কারও গলা এটা।
“আমি ঠিক আছি।” শুকনো গলা দিয়ে কোনওক্রমে কথাগুলো বের করেন হেম।
পরমুহূর্তে তাঁর একটা জিনিস খেয়াল হয়। সেটার ধাক্কা এতই জোরালো ছিল যে ঘরের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেলেও তিনি বড়ো-বড়ো চোখে সামনে তাকান।
গোরাম স্টেশন সেভেন্টিনের ভাষায় কথা বলছিলেন!
সামনে তাকিয়ে দেখেন হেম, গোরাম একদৃষ্টে তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছেন।
এতদিন মিলিটারি ইউনিফর্ম, লম্বাচওড়া চেহারা, চিবিয়ে-চিবিয়ে কথা বলার ভঙ্গি, আর মুখময় বলিরেখা বা কাঁটাছেঁড়া দাগের আড়ালে লুকিয়ে থাকা যেদুটো জিনিস কখনও দেখেননি হেম, সেই মুহূর্তে তাদেরই দিকে তাঁর নজর পড়ে।
এক আশ্চর্য বুদ্ধির দীপ্তিতে ভাস্বর হয়ে আছে গোরামের চোখজোড়া।
“আহ্!” মৃদু হাসি ফুটে ওঠে গোরামের মুখে, “ডক্টর হেম আমার অভিনয়টা ধরে ফেলেছেন মনে হচ্ছে। আসলে হঠাৎ হওয়া ব্যথা আর উত্তেজনার ধাক্কায় মাতৃভাষায় কথা বলাটাই কাল হল বলে মনে হচ্ছে।”
“আপনি…” হেম কী বলবে বুঝতে পারেন না। “আপনি এখানকার মানুষ?”
“মানুষ।” ঠোঁট ওলটান গোরাম, “যাক। আপনি আমাকে গোরিলা না ভেবে অন্তত মানুষ ভাবেন তাহলে। হ্যাঁ ডক্টর, আমি এই স্টেশন সেভেন্টিনের মানুষ!”
“কিন্তু তাহলে…?” কিচ্ছু বুঝতে পারেন না হেম। চারপাশে তাকিয়ে তিনি দেখেন, ঘর ভর্তি হয়ে গেছে বয়স্ক স্থানীয় মানুষে। তাঁরা ওঁর দিকে তাকান কিছুটা বিস্ময়, কিছুটা করুণা মিশিয়ে।
“বুদ্ধিমান ব্যক্তিদের নিয়ে আপনাদের চিন্তাভাবনাগুলো বড়োই শিশুসুলভ ডক্টর।” মাথার পেছন দিকে একটা ভেজা কাপড় চেপে, ধীরে-ধীরে বলেন গোরাম। “আপনারা নিজেরা বুদ্ধিমান। উচ্চনীচ নির্বিশেষে সবার জন্য সুষম ব্যবস্থা চান আপনারা। কিন্তু সেজন্যই, আপনারা যখন স্বাধীনতা দেন, তার অন্তিম লক্ষ্য হয় পরাধীনতা। আপনারা যখন নিজস্ব চিন্তা ও মনন বিকাশের সুযোগ দেন, তখন ছোট্ট-ছোট্ট ধাক্কা দিয়ে, সেই চিন্তাভাবনাকে আপনারা যা চাইছেন, সেই দিকে চালিত করতে চান। আপনাদের মতে সেগুলো সবই মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে করা, কিন্তু এই গ্রহের বাসিন্দারা তা মনে করে না।”
“কিন্তু তারা কী করে জানছে এসব?” উদ্ভ্রান্ত হয়ে বলেন হেম।
“আপনাদের চেয়ে এই গ্রহের বাসিন্দারা বেশি বুদ্ধিমান ডক্টর।” এতক্ষণ চুপচাপ থাকা এক বৃদ্ধ এবার মুখ খোলেন।
“সেটা কীভাবে সম্ভব?” হেম স্তম্ভিত হয়ে জানতে চান।
“বুদ্ধিমত্তা জিনিসটা সহজ বুদ্ধির অগম্য ডক্টর হেম।” শান্ত গলায় বলেন আর একজন স্থানীয় বাসিন্দা, “একটা নির্দিষ্ট সংখ্যার বেশি বুদ্ধিমান মানুষকে এক জায়গায় নিয়ে এলে যে অবস্থাটা তৈরি হয় সেটা ঠিক একে একে দুই নয়, একে একে এগারো বললেই ঠিক হবে।”
“সভ্যতার দিকে হাঁটতে শুরু করার শ’পাঁচেক বছরের মধ্যেই আমাদের পূর্বপুরুষেরা বুঝে ফেলেন, তাঁদের মধ্যে এমন কেউ-কেউ হেঁটে চলে বেড়াচ্ছেন যাঁদের কথা, ভাবনা, পরিশ্রম, এসবের একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে।” মৃদু হেসে বলেন গোরাম। “অন্য কোথাও হলে তাঁদের দেবতা ভাবা হত, কিন্তু এই গ্রহের বাসিন্দারা চটপট বুঝে ফেলেন, তাঁদের ওপর মাস্টারি করা হচ্ছে। তাই…”
“তাই?” ভয়টা বিন্দু থেকে পিণ্ড হয়ে উঠতে থাকে হেম-এর মধ্যে।
“তাই ছলে, বলে, কৌশলে তাঁদের ধরে ফেলা হয়। নরমে-গরমে তাঁদের কাছ থেকে জেনে নেওয়া হয়, কী তাঁদের উদ্দেশ্য। তাঁদের কাছ থেকেই স্টেশন সেভেন্টিনের বাসিন্দারা বুঝে ফেলেন, তাঁরা কোথায়, কেন আছেন। তারপর তাঁদের মন থেকে সেই… প্রশ্নোত্তরের স্মৃতি সযত্নে মুছে তাঁদের ফেরত পাঠানো হয়।
কখনও কখনও তাঁদের বদলে এখানকার বাসিন্দারাও যেতে শুরু করেন।”
বিস্ময়ে হেম-এর মুখটা হাঁ হয়ে গেছিল। সেদিকে তাকিয়ে হেসে ওঠেন ঘরের মানুষেরা। একজন সকৌতুকে বলেন, “বিশ্বাস করুন হেম, আপনাদের মধ্যে মিশে যাওয়ার মতো বুদ্ধিশুদ্ধি এই গ্রহের লোকেদের ছিল।”
“সেটা করতে গিয়েই আমরা ছায়াপথ-জোড়া সাম্রাজ্য, আর তার অবস্থাটা বুঝতে পেরেছিলাম।” একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন গোরাম।
“আমরা শত্রুতা করতে চাইনি হেম।” শান্ত গলায় বলেন প্রথমে মুখ খোলা বৃদ্ধ মানুষটি, “কিন্তু একবার এই সাম্রাজ্যের মানুষ, অমানুষ, না-মানু্ষ লোকেদের কথা জেনে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, এই স্থিতাবস্থা চালিয়ে যাওয়া ব্যবস্থা মানা যায় না।”
“সেজন্যই তো!” নিজের মাথার যন্ত্রণা ভুলে চেঁচিয়ে ওঠেন হেম। “সেজন্যই তো আপনাদের আলাদা করে রাখা, যাতে আপনাদের বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে সাম্রাজ্যকে এগিয়ে…”
সামনের মানুষগুলোর চোখের শীতল দৃষ্টি দেখে হেম বোঝেন, কিছু একটা ভুল হয়ে গেছে তাঁর ভাবনায়। কী ভুল?
“এই স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে একটা ছোট্ট গ্রহ একা লড়তে পারে না বুঝে আমাদের পূর্বপুরুষেরা একটা পরিকল্পনা করেছিলেন ডক্টর।” শান্ত গলায় বলেন গোরাম। উজ্জ্বল সেই চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে হেম-এর বড়ো অদ্ভুত লাগে।
“তাঁদের পরিকল্পনায় প্রথম ধাপ ছিল এমন বেশ কিছু গবেষণাগার ও যন্ত্রপাতি বানানো, যা আপনাদের সেন্সর আর মনিটরে ধরা পড়বে না।
পরের ধাপ ছিল,এই গ্রহের বাসিন্দাদের শৈশবকাল শেষ হওয়া মাত্র প্রশিক্ষণ, যাতে তারা নিজেদের বুদ্ধিকে লুকিয়ে রাখতে শেখে। তারপর সীমান্ত এলাকায় নানা জায়গায়, একেবারে পাকাপোক্ত দলিল-দস্তাবেজের সাহায্যে তাদের রেখে আসা হয়, যাতে তারা সেখানকার নানা জনগোষ্ঠীতে ঢুকে, একেবারে মিশে যেতে পারে।
আমাকেও সেভাবেই রেখে আসা হয়েছিল। আমার মতো অসংখ্য মানুষ ইতিমধ্যেই ঢুকে পড়েছে সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীতে। ছায়াপথ জোড়া সাম্রাজ্যের অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে এখন রয়েছে স্টেশন সেভেন্টিনের সন্তানেরা।
এই গ্রহ নিয়ে রিপোর্টটা রাজধানীতে এক ক্ষমতাধর ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী মন্ত্রীর নজরে পড়ে। তাঁর সন্দেহ ঘোচানোর জন্য আমাদের এই মিশন। আমার মতো রক্ষণশীল এবং কড়া এক কম্যান্ডার যদি রিপোর্ট দিত যে এই গ্রহ একেবারেই ঘাস-ফুল-পাতা স্তরের, তাহলে তিনি ঠান্ডা হতেন। তাঁর পরে ওই পদে বসবে এই গ্রহের একজন। সে স্টেশন সেভেন্টিনের অস্তিত্বই খাতাকলম থেকে মুছে দেবে।”
“তাহলে আপনি যে… আপনি তো গ্রহটা ধ্বংস করে দিচ্ছিলেন!”
মুচকি হাসেন গোরাম। অন্যরাও হাসেন। “ও অভিনয়টা ভালোই করে ডক্টর।” বলেন একজন, “কিন্তু ও ভেবেছিল, আপনি আমাদের মতো বুড়ো বা আরও কয়েকজনকে ওর সঙ্গে ‘কথা বলিয়ে’ ওকে বোঝানোর চেষ্টা করবেন। আপনি যে ওকে মারতে যাবেন সেটা…!”
“আমারই বোকামি।” সখেদে বলেন গোরাম, “বোকা বলেই আমি এখানকার ভাষায় কথা বলে ফেলেছিলাম, আর সেজন্যই ডক্টর হেম স্টেশন সেভেন্টিনের সত্যিটা জেনে গেলেন।”
“কিন্তু তাতে ক্ষতি কীসের?” উত্তেজিত হয়ে ওঠেন হেম, “আমি তো চাই এই গ্রহের মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ হোক স্বাধীনভাবে।”
“চান।” মাথা দুলিয়ে বলেন গোরাম, “আপনি আমাদের সাম্রাজ্যের ইঞ্জিন হিসেবে ব্যবহার করতে চান। কিন্তু আমরা যে গাড়িটা চালাতে চাই ডক্টর।”
স্তব্ধবাক হয়ে বসে থাকেন হেম। তাঁর আবার ভয় করতে থাকে।
“আপনি বুদ্ধিমান, বিবেকবান, এবং সাম্রাজ্যের প্রতি অনুগত।” ধীরলয়ে বলেন গোরাম, “তাই আপনি এটা কিছুতেই চেপে রাখতে পারবেন না যে এই গ্রহের বাসিন্দারা একটু-একটু করে, নিঃশব্দে, ইম্পিরিয়াম দখল করছে। তাই আপনাকে তো ছেড়ে দেওয়া যাবে না। আপনাকে এখানেই থাকতে হবে, এই গ্রহে।
আমি রিপোর্ট দেব, দুর্ঘটনায় আপনার মৃত্যু হয়েছে। আর তারপর নিজের কাজ চালিয়ে যাব।”
“মন খারাপ করবেন না হেম।” হেম-এর চুপসে যাওয়া মুখটার দিকে তাকিয়ে শান্তভাবে বলেন এক বৃদ্ধ, “আপনাদের পুরোনো রেকর্ডে আমরা দুটো প্রবাদ পড়েছি। একটাতে বলা হয়েছে ‘বীরভোগ্যা বসুন্ধরা’। অন্যটাতে এই বীর বলতে আসলে কাদের বোঝায়, সেটাও বলা হয়েছিল। এই গ্রহেই থাকুন। ঘর-সংসার করুন। আপনার সন্তান-সন্ততিরাই একদিন আসল ফোর্সের মালিক হবে। ইম্পিরিয়াল ফ্লিট কোথায় লাগে তার কাছে?”
-*-
মূল কাহিনি: ‘জিনিয়াস’, লেখক: পল অ্যান্ডারসন, প্রথম প্রকাশ: ‘অ্যাস্টাউন্ডিং’ ডিসেম্বর ১৯৪৮
Tags: অনুবাদ গল্প, ঋজু গাঙ্গুলী, কল্পবিজ্ঞান গল্প, তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, বুদ্ধির্যস্য, সৌরভ দে
অসাধারণ গল্প! তার সঙ্গে মানান সই অনুবাদ! খুব ভাল লাগল। খুব সহজ বুদ্ধিমত্তার গল্প।
আমি ভাবছিলাম এটা মৌলিক গল্প, পড়া শেষ করে নিচে এসে দেখলাম অনুবাদ। অসাধারণ! 👌
দারুণ গল্প! অনুবাদ ও যথাযত। ফাউন্ডেশনের আইডিয়ার সাথে বেশ মিল আছে।
Sabolil onubad.
না বললে বুঝতেও পারতাম না যে এটা অনুবাদ!
তুখোড়, যথারীতি!