বুনিষ বন্ধু
লেখক: অপর্ণা চৌধুরী
শিল্পী: চিত্রা মিত্র
(১)
‘তুই অতদূরে যাবি?’ বলে উঠল মা। অনুষ্কা সমাজসেবা, মানে কমিউনিটি সার্ভিসে, যাচ্ছে। আজকাল ওদের স্কুলে বাচ্চাদের সমাজসেবা করা বাধ্যতামুলক করা হয়েছে। যে যার ইচ্ছামতো কাজ করতে পারে, যেমন গাছ লাগান, রাস্তা বা বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখা, গরিব বাচ্ছাদের পড়ান। কিন্তু অনুষ্কার পছন্দ, সমাজের বয়স্ক মানুষ, যারা একা থাকেন তাঁদের দেখাশোনা করা। ওদের স্কুল থেকে কয়েকটা বাড়ি খুঁজে বার করেছে যেখানে বয়স্ক লোকেরা একা থাকেন। টিচাররা গিয়ে বাড়িগুলো দেখে এসেছেন আর সেই বৃদ্ধ বা বৃদ্ধার সঙ্গে কথাও বলে এসেছেন। যাঁরা ওদের এই প্রকল্পে ভাগ নিতে রাজি হয়েছেন তাঁদের নামের একটা তালিকা তৈরি করা হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের বলা হয়েছে সেই তালিকা থেকে এক-একটা নাম বেছে নিতে। অনুষ্কা যে মহিলার নাম বেছেচে তার বাড়িটা শহরের একটু বাইরে। বাড়িটা দূরে বলে ওদের দলের কেউই যেতে চাইছিল না।
‘মা … কাউকে তো যেতে হবে! সবাই না বললে চলে? আর বাবা তো আমাকে পৌঁছে দিতে যাচ্ছে। আবার বাবাই বলেছে নিয়ে আসবে। সঙ্গে মোবাইল থাকছে…।’
‘যা খুশি কর। সবাই সহজ সহজ গুলো নিল আর তুই-ই…’ গজ গজ করতে থাকে মা।
‘আমি সন্ধ্যে ছ-টার মধ্যে চলে আসব।’ বলে এক ছুটে বেরিয়ে গেল অনুষ্কা।
‘দয়া করে সময়মতো টিফিনটা খেয়ে নিয়ো।’
‘ও কে মাম্মা……।’
বাবা গাড়িতে বসে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল। ‘কীরে… মুখটা ওরকম গম্ভীর কেন?’
অনুষ্কা চুপ।
‘মা কিছু বলেছে?’
‘ওই আরকি…।’
‘মা ইজ্ ওয়ারিড… চল, চিয়ার আপ নাও।’
বাড়িটাতে পৌঁছতে প্রায় এক ঘণ্টা লেগে গেল। বাড়িটা একটা টিলার ওপর। শুধু তাই নয়, বাড়িটার চারপাশে আর কোনও বাড়িও নেই। আর ওটাকে বাড়ি না বলে একটা প্রাসাদ বলাই ভালো। যদিও ভাঙাচোরা কিন্তু দেখলেই বোঝা যায় একসময় খুব জাঁকজমক ছিল বাড়িটার। বাবা সাবধানে বাড়ির লোহার খোলা গেটের মধ্যে দিয়ে গাড়িটাকে ঢুকিয়ে বাগান পেরিয়ে গাড়ি-বারান্দায় এনে দাঁড় করালেন। যদিও বাগানটাকে বাগান না বলে ঝোপজঙ্গল বললেই ঠিক বলা হবে। বোঝাই যাচ্ছে যে বাগানটার বহুদিন কেউ দেখাশোনা করেনি।
অনুষ্কা গাড়ি থেকে নেমে তিনটে সিঁড়ি ভেঙে উঠে গিয়ে বিরাট কাঠের দরজার পাশের কলিং বেলটা বাজাল। মিনিটখানেক কেটে গেল কেউ দরজা খুলল না। বাবা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলেন। অনুষ্কা আবার বেল বাজাল। আরও প্রায় মিনিটখানেক পর আস্তে আস্তে দরজাটা খুলে গেল। একজন অতি বৃদ্ধ মহিলা হাতে লাঠি নিয়ে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে, ‘সরি! একটু দেরি হয়ে গেল। তুমিই অনুষ্কা?’
‘হ্যাঁ। আমিই আপনার সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিলাম।’
‘এসো, এসো, আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।’
অনুষ্কা গিয়ে গাড়ি থেকে ওর ব্যাগটা নিয়ে, বাবাকে ‘বাই’ বলে ভিতরে ঢুকল।
‘ঠিক সন্ধ্যা ছটায় আসব।’ বলে বাবা গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন।
বাড়ির ভিতরে ঢুকে অনুষ্কা অবাক হয়ে গেল। বাড়িটা বাইরে থেকে যতটা বড় মনে হচ্ছিল, ভিতর থেকে তার চেয়েও বড় মনে হল। দরজা দিয়ে ঢুকে একটা বিশাল বসার হলঘর। আগেকার দিনের সোফা টেবিল এসব দিয়ে সাজানো। হলঘরের ছাদটা দু’তলার সমান উঁচু। লম্বা লম্বা জানালা। ঘরের মাঝখান দিয়ে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। সিঁড়ির পাশে একটা দরজা, সেই দরজাটা থেকে একটা করিডোর ভিতরে চলে গেছে। তার ওপারে একটা খোলা উঠোন দেখা যাচ্ছে, যার চারদিকে ঘুরিয়ে আর একটা মহল। অনুষ্কা অবাক হয়ে দেখছিল। ও খেয়ালই করেনি কখন ওই বৃদ্ধা হাতে দুটো চকোলেট দুধের কাপ নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন।
‘আমাকে লিলিদিদা বলে ডাকতে পারো।’ অনুষ্কাকে চমকে দিয়ে হেসে বললেন বৃদ্ধা।
অনুষ্কা হেসে বলল, ‘আচ্ছা।’
‘এসো, এইখানে ব’স।’ বলে একটা সোফা দেখিয়ে দিলেন, আর তার সামনের টেবিলের ওপর দুধের কাপ দুটো রেখে নিজে তার পাশের একটা সোফাতে বসলেন।
‘আপনি এই এত বড় বাড়িতে একা থাকেন?’ জিজ্ঞাসা করলো অনুষ্কা।
‘হ্যাঁ…।’ একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে বললেন উনি। ‘আগে তোমার দাদুও থাকতেন। উনি চলে যাবার পর…।’
‘এটা কি আপনাদের পৈত্রিক বাড়ি?’
‘ঠিক তা না। আমার দূর সম্পর্কের এক পিশেমশাই আমাদের এই বাড়িটা দিয়ে যান। আমাদের কোনও ছেলেমেয়ে নেই। বৃদ্ধ বয়সে নিরিবিলিতে থাকব বলে আমারা এই বাড়িটাতে থাকতে এলাম। কিন্তু এখন মনে হয় না এলেই বোধহয় ভালো হত।… আচ্ছা দুপুরে তুমি কী খাবে?’
‘আমি টিফিন নিয়ে এসেছি।’ বলল অনুষ্কা।
‘তা বেশ। আসলে আমার এখানে কেউ আমাকে সাহায্য করার জন্য নেই। তাই…।’ বলে উনি খালি কাপগুলো ওঠাতে গেলেন।
অনুষ্কা বাধা দিয়ে বলল, ‘আমি নিয়ে যাচ্ছি দিদু। আপনি আমায় রান্নাঘরটা একটু দেখিয়ে দিন।’ তারপর অনুষ্কা কাপগুলো নিয়ে ওঁর সঙ্গে রান্নাঘরে গিয়ে কাপগুলো ধুয়ে রেখে দিল। উনি অনুষ্কাকে বাড়িটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাতে লাগলেন। আর সমানে কথা বলতে লাগলেন। মনে হল অনেকদিন বাদে উনি কাউকে পেয়েছেন যার সঙ্গে উনি গল্প করতে পারছেন। অনুষ্কারও ওঁর গল্পগুলো শুনতে খুব ভালো লাগছিল।
দুপুরবেলায় ওরা দুজন একসঙ্গে খেলো। তারপর লিলিদিদা বললেন, ‘অনুষ্কা, আমি এবার একটু শোব। দুপুরে একটু না শুলে পারি না। তুমি টিভি দেখতে পারো বা বই পড়তে পারো। যদি চাও তো আমার সঙ্গে একটু ঘুমোতেও পারো।’
অনুষ্কা বলল, ‘আমি আমার আই-প্যাড নিয়ে এসেছি, আমি বই পড়ব।’
উনি নিজের ঘরে শুতে চলে গেলেন। অনুষ্কা নিজের আই-প্যাডটা নিয়ে সোফাটার ওপর এলিয়ে একটা বই খুঁজতে লাগলো পড়ার জন্য। হঠাৎ চোখ গেল ওই করিডোরটার দিকে। খুব দেখতে ইচ্ছে করল বাড়ির ওই দিকটাতে কী আছে। ধীরে ধীরে আই-প্যাডটা হাতে নিয়ে করিডোরটার দিকে এগিয়ে গেল অনুষ্কা। করিডোরের শেষে একটা খোলা জায়গা। মাঝখানে একটা গোল মতো বাঁধানো জায়গা দেখে মনে হয় একসময় ওখানে ফোয়ারা লাগানো ছিল। চারিদিকে ঘোরানো বাড়িটাও বেশ ভাঙ্গাচোরা, বোঝাই যায় যে ওখানে কেউ থাকে না, আর বহুদিন মেরামতও করা হয়নি। অনুষ্কা একবার ভাবল গিয়ে দেখে ওখানে কী আছে। তারপর ভাবল, কী দরকার বাবা, যদি সাপ-টাপ থাকে। ও ঘুরে আবার বাড়ির ভিতর ঢুকতে যাবে এমন সময় দেখল করিডোরের ডান দিকে একটা ভাঙা দেয়ালের পাশে একটা খুব সুন্দর পুতুল দাঁড় করানো রয়েছে। পুতুলটার সোনালী চুল, গোল গোল চোখ, একটা গোলাপী ফ্রক পরা। ও দেখে একটু অবাক হল। ওরকম একটা অদ্ভুত জায়গায় কে পুতুল রাখবে? আর তার ওপর, পুতুলটা একদম নতুন, ঝকঝক করছে। এ বাড়িতে তো কোনও বাচ্ছাও নেই। অনুষ্কা ধীরে ধীরে পুতুলটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। মনে হচ্ছে পুতুলটা যেন জীবন্ত। ও হাত বাড়িয়ে পুতুলটাকে ধরতে গেল… আর ব্যাস… ওর চোখের সামনে অন্ধকার নেমে এল।
(২)
অনুষ্কার যখন জ্ঞান এল তখন দেখল ও একটা বিছানার ওপর শুয়ে আছে। বাঁ হাতের কনুই আর মাথাটা ব্যথা করছে। যে ঘরটায় ও শুয়ে আছে সেটা মাঝারি আকারের। ঘরটা খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, দুটো দরজা রয়েছে কিন্তু একটাও জানালা নেই। দেয়ালে সুন্দর সুন্দর ফুলের ছবি লাগানো রয়েছে। একটা খুব মিষ্টি গন্ধ পাচ্ছে ও। নাকের ওপর কী একটা যেন চটচটে মত লেগে আছে। ডান হাতটা তুলে নাকটা মুছতে যেতেই একটা বাচ্চা মেয়ের গলা বলে উঠল, ‘ওটা মুছো না। ওটা অক্সিজেন জেলি। তুমি এখন মাটির নিচে রয়েছ, এখানের হাওয়ায় অক্সিজেন কম। ওই জেলিটা সেই অভাবটা পূরণ করছে।’
চমকে গিয়ে অনুষ্কা তাকিয়ে দেখে ওর পাশেই দাঁড়িয়ে সেই পুতুলটা ওর সঙ্গে কথা বলছে।
‘তুমি জ্যান্ত পুতুল?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল অনুষ্কা।
‘আমি জ্যান্ত, তবে পুতুল না।’ গম্ভীরভাবে বলল পুতুলটা।
‘তুমি পুতুল না?’
‘না।’
‘তবে তুমি কে?’
‘আমি… আমি…। আমি অন্য গ্রহের জীব, বুনিষ… তবে আমাদের একটা নাম তোমাদের পূর্বপুরুষরা দিয়েছিল। তুমি আমায় সেই নামেও ডাকতে পার, নাগ।’
‘নাগ? আমি কোথায়? আমি তো ওই বাড়ির করিডোরে…’
‘তুমি ওই বাড়িটারই নিচে আমাদের বুনিষদের বাড়িতে আছো।’
‘আমি এখানে কী করে এলাম?’
‘তুমি আমায় ধরতে গেলে আর আমি ভয় পেয়ে তোমাকে একটা ইলেকট্রিক শক দিলাম। তাতে তুমি অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলে। আমি দেখলাম তুমি পড়ে গিয়ে বাঁ হাতের কনুইটা ভেঙেছ, মানে হেয়ার-লাইন ফ্র্যাকচার। আর মাথাটায় একটা আলু হয়েছে। তাই তোমাকে তুলে এখানে নিয়ে আসতে বাধ্য হলাম। যতই হোক তোমার এই দুর্ভোগের জন্য তো আমিই দায়ী।’
‘এক মিনিট, তুমি দেখতে পেলে যে আমার হাত ভেঙে গেছে! এটা কি মজা হচ্ছে?’
‘না, একদমই না। আমার এক্স-রে ভিসন আছে। তাই আমি তোমার শরীরের ভিতরটা দেখতে পাই।’
‘এক্স-রে ভিসন? সে তো সায়েন্স ফিকশনে হয়। এই তুমি বললে যে তুমি নাগ। নাগ মানে তো সাপ। সাপেরা এরকম পুতুলের মতো দেখতে হয়?’
‘এটা তো আমার আসল চেহারা নয়। এটা আমার ভারচুয়াল ইমেজ। আমার আসল চেহারাটা দেখলে তুমি যদি ভয় পেয়ে যাও, তাই আমি এই রূপে তোমার সামনে রয়েছি।’
‘তোমার আসল চেহারাটা কেমন।’
‘এই ধর, সাপ আর মানুষ মেলালে যেরকম হয়। মানে মুখটা মানুষের মতো, মাথাটার চারদিকে ফণা, দুটো হাত আছে, কোমর অবধি মানুষের মতো, কিন্তু পায়ের জায়গায় আছে লেজ।’
‘তুমি এত ছোট হলে কী করে?’
‘আমরা ছোটই হই, আমাদের উচ্চতা হয় সাধারণত দেড় থেকে দুই ফুট।’
‘তুমি তোমার আসল চেহারাটা আমাকে দেখাবে?’
‘তুমি ভয় পাবে না তো?’
‘না।’
দেখতে দেখতে সেই পুতুলটি একটি বুনিষে রূপান্তরিত হল। ওর চেহারাটা ওর বর্ণনার সঙ্গে একেবারে মিলে যাচ্ছে। ওর পরনে একটা টকটকে লাল রঙের ডিপ নেক লম্বা হাতা ড্রেস। আর গলায় একটা লাল স্ফটিকের লকেট জ্বলজ্বল করছে। মুখটা খুব মিষ্টি, টানা টানা দুটো চোখ, টিকালো নাক। কিন্তু মাথার চারদিকে ফণা আর পায়ের জায়গায় লেজ। লেজের তলার দিকটা কুণ্ডলী পাকিয়ে তার উপর সে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গায়ের রং হালকা সবুজ। আর ফণাটা গাঢ় সবুজ। দেখে মনে হচ্ছে মাথার চুলটা সবুজ রং দিয়ে রং করেছে। ওর দু-হাতে দুটো লাল রঙের ব্রেসলেট।
অনুষ্কা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। ওকে ওরকম অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে ও মুচকি হেসে বলল, ‘আমার নাম পিপি। আমি মেয়ে বুনিষ। আমাদের মেয়েদের রং সবুজ হয় আর ছেলেরা হয় নীল। তোমাকে দেখতে এখুনি আমাদের মেডিক্যাল টিম আসবে।’
বলতে বলতেই তিনজন বুনিষ ওই ঘরে ঢুকে এল। তাদের মধ্যে একজন পুরুষ তিনি ডাক্তারের মতো সাদা কোট পরে আছেন। আর সঙ্গের দুজন মহিলা নার্স। অনুষ্কা খেয়াল করল পুরুষটির গায়ের রং হালকা নীল আর ফণাটা গাঢ় নীল।
ডাক্তারবাবু অনুষ্কার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, ‘হ্যালো! আমি ডঃ মিরি। চিন্তার কোনও কারণ নেই, একটা মাইনর ফ্র্যাকচার আছে, আমি এখুনি বোন বিলডিং জেলি লাগিয়ে দিচ্ছি। মিনিট দশেকের মধ্যে ওই ক্র্যাকটা ভরে যাবে। আর মাথাটা দেখি। হুম্।… নার্স, সলিউসন নম্বর ৬৭১ টা লাগিয়ে দিন। আর হ্যাঁ, বাঁ-কাঁধের কাছের নার্ভগুলো ব্লক করতে হবে। নাহলে ওর ব্যাথাটা কমবে না। তাড়াতাড়ি নার্ভ ব্লকিং রে-টা লাগিয়ে দিন।’
‘আমায় প্লাস্টার করতে হবে না?’ হতভম্ব অনুষ্কা জিজ্ঞাসা করলো।
উনি হেসে বললেন, ‘না। তবে মিনিট দশেকের জন্য আমরা আপনার হাতটা একটা ফ্রেম দিয়ে আটকে দেব যাতে হাড়গুলো ঠিকঠাক জায়গায় জোড়ে।’
‘আমি কতক্ষণ এখানে এসেছি?’ জিজ্ঞাসা করল অনুষ্কা।
‘এই… মিনিট পনেরো হল,’ জবাব দিল পিপি।
‘আমাকে ফেরত যেতে হবে… নইলে লিলিদিদা চিন্তা করবেন…।’ বলে অনুষ্কা উঠে বসতে গেল।
‘আরে আরে, করেন কি?… চুপচাপ শুয়ে পড়ুন।’ ধমক দিয়ে উঠলেন ডাক্তারবাবু।
পিপি বলে উঠল, ‘চিন্তা কর না। আমাদের ভলান্টিয়ার চলে গেছে। এখন লিলিদিদা দু-ঘণ্টা ঘুমাবেন। আর তোমার বাবা তো আসবেন সেই সন্ধ্যা ছ’টায়।’
‘তুমি এতো সব জানলে কী করে?’ অবাক প্রশ্ন অনুষ্কার।
‘তুমি সর্বক্ষণ ওটাই তো ভাবছ।’
‘হ্যাঁ ভাবছি… তুমি …তুমি কী?’
‘আমি দুঃখিত। কারো মন পড়া আমাদের দেশে আইন বিরুদ্ধ। কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে আমাকে এই কাজটা করতে হয়েছে এটা জানার জন্য যে তুমি কে এবং কেন এখানে এসেছ। তোমাকে আমাদের জগতে নিয়ে আসার আগে আমায় জেনে নিতে হয়েছিল যে তুমি আমাদের ক্ষতি করবে কি না। তাই…। আর কখনও পড়ব না।’
ডঃ মিরি অনুষ্কার হাতে দুটো স্কেলের মতো জিনিস লাগিয়ে সেগুলোকে টেপ দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিলেন। ওরা কি একটা রে দিল তাতে অনুষ্কা আর কোনও ব্যথা বোধ করছিল না। ওর মনে হচ্ছিল হাতটাই নেই।
হঠাৎ অনুষ্কার খুব ভয় করতে লাগল। এরা কারা? এরা ওর ওপর কোনও পরীক্ষানিরীক্ষা করছে না তো? ও কি এখান থেকে কখনও বেরোতে পারবে?
‘তুমি ভয় পেও না অনুষ্কা। আমরা তোমার বন্ধু। তুমি একটু ভালো হলেই আমি তোমাকে আবার লিলিদিদার বাড়ি গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসব। কেউ কিচ্ছু জানতে পারবে না।’ বলল পিপি।
(৩)
‘অনুষ্কা!… অনুষ্কা!’ ডাক শুনে ধড়মড় করে উঠে বসল অনুষ্কা। লিলিদিদা ডাকছেন।
‘তুমি কি চা খাও? নাকি তোমাকে চকোলেট গুলে দেব?’ জিজ্ঞাসা করলেন উনি।
‘আমি চা খাই না।’ বলল অনুষ্কা। অনুষ্কা দেখল যে ও লিলিদিদার সোফাতে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল। তাহলে কি ও স্বপ্ন দেখছিল? তাই হবে। ভারী অদ্ভুত স্বপ্ন তো! এতো ভালো করে কোনও স্বপ্ন ওর মনে থাকে না। ভাবতে ভাবতে বাঁ হাতটা নাড়তে গিয়ে দেখল কনুইটা একটু ব্যাথা আর জায়গাটা একটু ফুলে আছে। তারপর মাথায় হাত দিয়ে দেখল, কপালের কাছটাও একটু ব্যথা ব্যথা লাগছে। কিন্তু ফোলা-টোলা কিছু নেই।
লিলিদিদা একটা ট্রেতে করে চা, চকোলেট দুধ আর বিস্কুট নিয়ে এলেন। এসে ওর পাশে বসে হাসতে হাসতে বললেন, ‘তুমি এসেছ, আর দেখো আমি কি ঘুমটাই না ঘুমোলাম। রোজ দুপুরে শুয়ে এপাশ ওপাশ করি। তারপর ঘণ্টাখানেক বাদে উঠে টিভি দেখি। আর আজ দেখো সাড়ে পাঁচটা বাজছে। আসলে বাড়িতে কেউ থাকলে বোধহয় নিশ্চিন্ত লাগে, তাই ঘুমটাও ভালো হয়।’
অনুষ্কা চকোলেট দুধটা খেতে খেতে একটু হেসে সম্মতি জানাল। কিন্তু মনে মনে বলল, তাহলে পিপি কি স্বপ্ন নয়?
‘তুমি আবার পরের রবিবার আসবে তো?’ লিলিদিদার গলাটা কাকুতির মতো শোনায়।
‘আসব।’ বলল অনুষ্কা।
বাইরে গাড়ির হর্ন শোনা গেল। অনুষ্কা তাড়াতাড়ি নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে লিলিদিদাকে ‘বাই’ বলে বেরিয়ে গেল। লিলিদিদা দরজায় দাঁড়িয়ে ওর দিকে হাত নাড়তে লাগলেন।
বাবা গাড়িটাকে লোহার গেট দিয়ে বার করতে করতে বলে উঠলেন, ‘উনি একা এই বাড়িটাতে থাকেন কী করে?’
অনুষ্কা ঘুরে দেখল, সন্ধ্যার অন্ধকারে একটা বিরাট ভুতুড়ে প্রাসাদের মতো দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা। আর তার দরজায় অসহায় বন্দিনীর মতো দাঁড়িয়ে লিলিদিদা। ওর মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও বলল, ‘আমিও সেই কথাই ভাবছি, জানো বাবা।’
‘তা, কী করলি সারা দিন?’ জিজ্ঞাসা করলেন বাবা।
অনুষ্কা সব গল্প করল, লিলিদিদা কত ভালো, ও যাওয়াতে উনি কত খুশি হয়েছেন, বাড়িটা কত সুন্দর, শুধু ওই পুতুলের কথাটা বলল না।
বাড়িতে ঢুকেই ওর মনটা ভালো হয়ে গেল। মীনাক্ষী মাসী এসেছে। ওকে দেখেই মীনাক্ষী মাসী ওকে জড়িয়ে ধরল, ‘সমাজ সেবা? গুড। কেমন গেল প্রথম দিন?’
‘খুব ভালো।’ হেসে জবাব দিল অনুষ্কা। মীনাক্ষী অনুষ্কার নিজের মাসি না। উনি ওদের পাড়ায় থাকেন। অনুষ্কা শুনেছে, ইঞ্জিনীয়রিং পড়ার পর মীনাক্ষী মাসি বিদেশে চলে যান একটা চাকরি নিয়ে। বেশ কয়েক বছর চাকরি করার পর ওঁর আর ভালো লাগে না, তাই উনি দেশে ফিরে আসেন। এখন উনি একটা অনাথ আশ্রম চালান।
‘তোমার ‘ঝরা ফুল’ এর কী খবর?’ জিজ্ঞাসা করল অনুষ্কা।
‘চলছে রে। সেদিনকেই একটা মেয়েকে আমাদের দরজার সামনে ফেলে দিয়ে গেছে কেউ। বড়জোর দশদিন বয়েস হবে। খুব মিষ্টি। আমরা ওর নাম রেখেছি সীতা।’
‘বাব্বা, তুই পারিসও বটে! মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানির চাকরি ছেড়ে এই সব। তা বিয়ে থা কবে করবি শুনি?’ বললেন মা।
‘করবো, করবো। বিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে নাকি? দাঁড়াও আগে এই অনাথ আশ্রমটাকে একটু দাঁড় করিয়ে নিই। তারপর।’ বলতে বলতে টেবিল থেকে পুডিং-এর বাটিটা তুলে নিল মীনাক্ষী। ‘ওঃ! এই পুডিংটা তুমি যা বানাও না … জাস্ট অনবদ্য।’
অনুষ্কাও ওর পুডিং এর বাটিটা তুলে নিল। তারপর পুডিং খেতে খেতে ওর মাকে বলল, ‘মা! সামনের রবিবার তুমি একটু পুডিং বানিয়ে দেবে?’
‘কেন রে?’
‘আমি লিলিদিদার জন্য নিয়ে যাব।’
‘বাঃ! এই তো আমার চ্যালা।’ বলে হেসে উঠল মীনাক্ষী মাসী।
মা হেসে বললেন, ‘যাঃ! গেল। এবার আমার মেয়েটার মাথাটাও খাবি তুই।’
এই কথা শুনে সবাই হেসে উঠল।
‘এতো হাসাহাসি কিসের?’ বাবা এতক্ষণে ঘরে ঢুকলেন।
‘এতক্ষণ কোথায় ছিলে? নাও পুডিংটা খেয়ে নাও।’
‘বড্ড গরম লাগছিল তাই স্নানটা সেরে এলাম। তারপর? এখন তোমার ক’জন হল?’ বাবা জিজ্ঞাসা করলেন।
‘দাদা, এক বছরেই পঁচিশ জন হয়ে গেছে। আর বাড়লে জায়গায় কুলোবে না।’ বললেন মীনাক্ষী।
‘হুম!… ও হ্যাঁ তোমার জন্য একটা চেক আছে, আমাদের অফিসের মিঃ নীল দিয়েছেন। তুমি যাবার সময় ওঁর আর আমাদের দুটো চেকই একসঙ্গে নিয়ে যেও।’
‘থ্যাঙ্ক ইউ, দাদা!’
‘আরে এতে থ্যাঙ্ক ইউ এর কি আছে। তুমি এতো ভালো কাজ করছ!’ বাবা চেক আনতে উঠে গেলেন।
সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ মীনাক্ষী মাসী চলে গেলেন। অনুষ্কা নিজের ঘরে পড়তে বসল। পড়তে পড়তে ওর নানা কথা মনে হতে লাগল। পিপি সত্যিই আছে। ওটা ওর স্বপ্ন নয়। কারণ স্বপ্নে দেখলে ও এতো রং দেখতে পেত নাকি? কিন্তু ওর হাতে তো ভেঙে যাবার মতো ব্যাথা নেই। বরং আগে যেটুকুও বা ছিল বাড়ি আসতে আসতে সেটুকুও গায়েব হয়ে গেল। যদি সত্যি পিপি থেকে থাকে, তাহলে কি আবার ওর পিপির সঙ্গে দেখা হবে? কি করে হবে? ও কি ওই ভাঙা পাঁচিলের পাশে থাকে? না না, তা কি করে হয়? ও তো বলল, ও মাটির তলায় থাকে। কিন্তু ওর বাড়িতে ঢোকার দরজাটা কোথায়? আর ওই নাকে… তাই তো ওর নাকে ওরা একটা কী জেলি যেন লাগিয়ে দিয়েছিল বলল? নিজের অজানতেই হাতটা নাকের কাছে চলে গেল। খুব অল্প একটু ক্রিমের মতো কী যেন লেগে রয়েছে মনে হচ্ছে। ওর মনে আনন্দ আর বিস্ময় একসঙ্গে খেলা করতে লাগল। তার মানে ওটা স্বপ্ন নয়? খুব আফসোস হতে লাগল, আরও একটু বেশি সময় পাওয়া গেলে বেশ হত। আরও কত কী জেনে নেওয়া যেত।
সারা সপ্তাহ অনুষ্কা নানা চিন্তায় কাটিয়ে দিয়েছে। একবার মনে হয়েছে পিপি, বুনিষ সব সত্যি। আর একবার মনে হয়েছে না বোধহয় স্বপ্ন। ও জোর করে যুক্তি সাজাচ্ছে।
দেখতে দেখতে শনিবার এসে গেল। কাল রবিবার। অনুষ্কা মাকে পুডিং বানানোর কথা মনে করিয়ে দিল। উত্তেজনায় ওর রাতে ভালো করে ঘুমই হল না। কি জানি কাল কি প্রমাণ হবে? ও মনে প্রাণে চাইছে পিপির সঙ্গে ওর আবার দেখা হোক।
(৪)
পরেরদিন, মানে রবিবার সকালে, অনুষ্কার ব্যস্ততা দেখে বাবা মা দুজনেই অবাক। তাড়াতাড়ি স্নান করে, তৈরি হয়ে, নিজের ব্যাগে টিফিন, লিলিদিদার জন্য পুডিং সব ভরে অনুষ্কা তৈরি। ওর বাবা তৈরি হবার আগেই ও গাড়ির কাছে পৌঁছে গেছে।
বাবা যথা সময়েই ওকে নিয়ে পৌঁছলেন লিলিদিদার বাড়ি। কিন্তু গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়ে ওরা দেখল দুটো বড় বড় গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি বারান্দায় ।
বাবার ভুরুটা কুঁচকে গেল। ‘কে এসেছে বলতো? ওঁর কোন আত্মীয়?’
‘উনি তো বললেন ওঁর কেউ নেই।’ বলল অনুষ্কা।
গাড়িটা পার্ক করে বাবাও চললেন অনুষ্কার সঙ্গে। বাইরের দরজাটা খোলাই ছিল। ওরা ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে শুনতে পেল লিলিদিদা উত্তেজিত হয়ে জোরে জোরে বলছেন, ‘আমি আপনাদের আমার শেষ কথা বলে দিয়েছি। আপনারা প্লিজ যান।’ বলে হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়লেন লিলিদিদা।
চারজন লোক গম্ভীর মুখে অনুষ্কা আর ওর বাবার পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেল, ঝড়ের মতো। অনুষ্কা ছুটে গিয়ে ওঁর হাতটা ধরল। ‘তুমি জল খাবে দিদা?’ বলে ও জল আনতে ছুটল।
বাবা ওঁর পাশে বসলেন।
জল খেয়ে লিলিদিদা একটু সুস্থ বোধ করলেন। তারপর বাবা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী ব্যাপার বলুন তো?’
‘ওরা রিয়েল এস্টেট এর লোক। বহুদিন ধরে আমার পিছনে পড়ে আছে। সস্তায় এই বাড়িটা কিনে নেবার জন্য। আমি এই বয়সে কোথায় যাই বলুন তো? আর টাকা নিয়ে আমি কী করব?’
‘আপনি পুলিশে কমপ্লেন করছেন না কেন?’
উনি মৃদু হেসে বললেন, ‘ওদের সঙ্গে যিনি কালো জ্যাকেট আর খাকি প্যান্ট পরে এসেছিলেন, উনি এখানকার থানার বড়বাবু। আমাকে বোঝাতে এসেছিলেন যে এই জায়গাটা রাতে সমাজবিরোধীদের আড্ডা হয়ে যাচ্ছে। তাই নতুন বিল্ডিং হলে সমাজের মঙ্গল।’
‘তাহলে কী উপায়?’ বাবা খুব চিন্তিত মুখে বললেন।
‘আপনি চিন্তা করবেন না। ওরা এই যে চলে গেল আবার মাসখানেক বাদে আসবে। দেখি তার মধ্যে যদি কোনও বৃদ্ধাশ্রম পাই তো চলে যাব।’ বলে চুপ করে গেলেন উনি।
বাবা চিন্তিত মুখে বাড়ি চলে গেলেন।
অনুষ্কা রান্নাঘর থেকে একটা বাটি করে পুডিং নিয়ে এল ওঁর জন্য। মুহূর্তের মধ্যে ওঁর মুখটা হাসিতে ভরে গেল। ‘আমার জন্য এনেছ? তোমার মা বানিয়ে দিয়েছেন? বাঃ! কতদিন পুডিং খাইনি।’ বাচ্চাদের মতো খুশি হলেন উনি। বসে পুরো বাটিটা শেষ করলেন। তারপর অনুষ্কার সঙ্গে নানারকম গল্প করতে লাগলেন। অনুষ্কাও ওর স্কুলের গল্প, বাড়ির গল্প সব বলতে লাগল ওঁকে। সময় কোথা দিয়ে কেটে গেল ওরা বুঝতেই পারল না। আজ ওরা খাবার ভাগাভাগি করে খেল। তারপর দিদা বললেন, ‘অনুষ্কা, আমি এবার একটু শুয়ে নিই? আর তুমি?’
‘আমি সোফায় বসে বই পড়ব দিদা।’ বলল অনুষ্কা। তারপর বসে অপেক্ষা করতে লাগল ওঁর ঘরের ভিতরে চলে যাবার।
উনি যেই ঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন, অনুষ্কা নিঃশব্দে উঠে করিডোরটার দিকে চলল। ওর বুকটা দুরু দুরু করছে। কে জানে দেখা হবে কি না? ও বাইরের বারান্দাটায় পৌঁছে দেখল, কেউ কোত্থাও নেই। খানিকক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে, হতাশ হয়ে অনুষ্কা আবার করিডোরের ভিতরে পা দিল।
‘তুমি কি আমাকে খুঁজছ?’ পিপির গলার স্বর।
চমকে পিছন ফিরতে গিয়ে টাল খেয়ে গেল অনুষ্কা।
‘অ্যাই! অ্যাই! আবার পড়ো না।’ হাসতে হাসতে বলল পিপি।
অনুষ্কাও হেসে উঠল। তারপরই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে উঠল, ‘চুপ চুপ, লিলিদিদা উঠে পড়বেন।’
পিপি বলল, ‘দাঁড়াও!’ বলেই তীর বেগে কোথাও চলে গেল।’
মিনিটখানেক বাদে ফিরে এসে বলল, ‘তোমার লিলিদিদাকে ঘুম পাড়িয়ে এলাম। এখন উনি সোজা বিকাল পাঁচটায় উঠবেন। চল কোথাও বসি।’
‘চল!’ বলে অনুষ্কা ওকে নিয়ে ভিতরের হলে সোফার কাছে নিয়ে গেল। অনুষ্কা একটা সোফাতে বসল আর পিপি ওর মুখোমুখি একটা সোফার হাতলে বসল। আজ পিপি নিজের স্বরূপেই আছে। আজ ও পরেছে একটা কালো রঙের জামা। কিন্তু গলার লকেট আর হাতের ব্রেসলেট দুটো বদলায়নি।
‘তুমি এতো ভালো বাংলা শিখলে কোথায়?’ জিজ্ঞাসা করল অনুষ্কা।
‘বাংলা? আমি বাংলা জানি না তো! এ সব আমার ল্যাঙ্গুয়েজ কনভার্টর-এর কামাল।’ বলে ও ওর বাঁ হাতের ব্রেসলেটটা দেখাল। ‘এতে তোমাদের অনেক ভাষা ফিড ইন করা আছে। এটি তোমার ভাষাটা খুঁজে নিয়ে আমার কথাগুলো তোমার ভাষায় অনুবাদ করে তোমার কানে ট্রান্সমিট করে। আর এই ডান হাতের ব্রেসলেটটা আমার অস্ত্র। আর এই যে লকেটটা দেখছ এটা আমার ভার্চুয়াল ইমেজ বিল্ডার।’
‘বাবা! সত্যি?’
‘বিশ্বাস হচ্ছে না? দাঁড়াও।’ বলে ও লকেটটাতে হাত দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে একটা খরগোস, তারপর একটা গিটার হয়ে আবার নিজের রূপে ফেরত চলে এল।
অনুষ্কা হাঁ করে বসে রইল।
‘মুখটা বন্ধ কর, মাছি ঢুকে যাবে।’ বলল পিপি।
‘তুমি কি রোজ এই সময়ে এখানে আস, নাকি আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলে?’ জিজ্ঞাসা করলো অনুষ্কা।
‘রোজ আসি না। তবে সোলার নেটে কিছু মেরামত করতে হলে আমাকে উপরে আসতে হয়। আমি আমাদের সোলার প্লান্টের ইঞ্জিনিয়ার।’ বলল পিপি।
‘সোলার নেট? সেটা আবার কি? এখানে কোথাও তো কোনও নেট নেই?’
মৃদু হাসল পিপি, ‘ওটা এই বাড়ির সমস্ত দেয়াল আর ছাদে লাগানো আছে। কিন্তু ওটা চোখে দেখা যায় না। তোমরা টেকনোলজিতে আমাদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। তোমরা সবে ন্যানো টেকনোলজিতে পৌঁছেছ। আর আমরা zepto technology ব্যবহার করি।’
‘তা এই সোলার নেট দিয়ে তোমরা কী কর?’
‘সূর্যের রশ্মির সাহায্যে আমারা আলো জ্বালাই, ঘর গরম করি, খাবার বানাই।’
‘বাকিগুলো তো বুঝলাম, কিন্তু খাবার বানাও কী করে?’
‘আমাদের সালোকসংশ্লেষ যন্ত্র আছে। সেই যন্ত্র গাছেদের মতো খাবার তৈরি করতে পারে। তাই আমরা খাবারের জন্য কারওর উপর নির্ভর করি না।’
‘এ মা! তোমরা চকোলেট, আইসক্রিম এসব কিচ্ছু খাও না?’
‘খাই। সবই পাওয়া যায় আমাদের খাবারের কারখানায়, কিন্তু তোমাদের মতো আমরা এতো খাই-খাই করি না। তোমাদের টিভিতে তো দেখি খাবার খাওয়ার প্রতিযোগিতা হয়। এটা একটা প্রতিযোগিতা করার জিনিস হল?’
অনুষ্কা ওর কথা শুনে ফিক করে হেসে ফেলল, তারপর জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমরা পুডিং খাও?’
‘সেটা কি জিনিস?’
‘দাঁড়াও।’ বলে অনুষ্কা ছুটে রান্নাঘর থেকে একটা বাটিতে খানিকটা পুডিং নিয়ে এল।
পিপি একটু সন্দিগ্ধভাবে বাটিটা দেখল তারপর একটু পুডিং নিয়ে ওর হাতের ব্রেসলেটের একটা ছোট্ট খোপের মধ্যে ভরে দিল। ব্রেসলেটটায় একটা সবুজ আলো জ্বলে উঠলো। তখন ও পুডিংটা খেতে শুরু করল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ও পুডিংটাকে শেষ করে বাটিটাও চেটে ফেলল। অনুষ্কা লক্ষ করল ওর জিভটা সাপেদের মতো দুই ভাগে চেরা।
ওর খাওয়া দেখে বোঝাই যাচ্ছিল যে এতো সুস্বাদু জিনিস ও আগে কখনও খায়নি। ‘তুমি আর একটু খাবে? এটা আমার মা বানিয়ে দিয়েছে।’
পিপি একটু লাজুক হেসে বলল, ‘দাও।’ তারপর পিপি পুডিং-এর পুরো বাটিটাই শেষ করে দিল। তারপর বলল, ‘আমি এত বেশি কোনওদিন খাইনি।’
অনুষ্কা হেসে বলল, ‘এবার বুঝতে পারছোতো আমারা কেন খাই খাই করি?’
পিপি বলল, ‘আমায় এবার যেতে হবে। আবার পরের রবিবার দেখা হবে। এখন তো তুমি প্রতি রবিবার আসবে তাই না?’
‘হ্যাঁ, যতদিন দিদা এ বাড়িতে আছে। যদি বাড়িটা ভাঙা হয় তাহলে তো দিদা অন্য কোনও জায়গায় চলে যাবে।’
‘বাড়ি ভাঙা হবে মানে?’
‘আরে ওই রিয়েল এস্টেট এজেন্ট…।’
‘হুম… বুঝেছি। দেখি কী করা যায়।’ বলে চলে গেল পিপি।
(৫)
‘অনুষ্কা… অ্যাই অনুষ্কা…’ ধড়মড় করে উঠে বসল অনুষ্কা। পিপির গলা না? অন্ধকারে ও কিছু ঠাহর করতে পারে না। ও তো নিজের ঘরেই শুয়ে আছে। তাহলে পিপি এল কোথা থেকে? নাকি ও স্বপ্ন দেখছে?
‘অ্যাই অনুষ্কা।’ ওর কোমরের কাছে এক ধাক্কা।
‘বাবা রে…।’ বলে তাড়াতাড়ি বেড সাইড ল্যাম্পটা জ্বালল অনুষ্কা। পিপি দাঁড়িয়ে আছে ওর ঘরের মধ্যে আর সঙ্গে আর একজন বুনিষ।
‘তোমরা এখানে? আমার বাড়ি চিনলে কী করে?’ অবাক অনুষ্কা।
‘ভুলে যেও না আমরা নাগ। যেখানে যেখানে পাইপ লাইন যায় সে সব জায়গায় আমাদের অবাধ বিচরণ। যাক সে সব কথা। এখন কাজের কথায় আসি। ওর নাম ভিনো। ও আমাদের সিকিউরিটি চিফ।’ অন্য বুনিষটিকে দেখিয়ে বলল পিপি। ‘ও আজ রাতে রাউন্ড দিতে গিয়ে দেখে দুজন গুন্ডা লিলিদিদার বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করছে। এরকম কিছু হতে পারে ভেবেই আমি ওকে আগে থেকে বলে রেখেছিলাম নজর রাখতে। তা ও লোক দুটোকে শক দিয়ে অজ্ঞান করে রেখে এসেছে।’
‘তা আমি কী করতে পারি?’ বলল অনুষ্কা।
‘আমি তোমার কাছে এসেছি একটা বিশেষ দরকারে। ভিনো শুনেছে, ওরা বলাবলি করছিল যে ওরা আজ রাতেই দিদাকে সাবাড় করে দেবে। তার মানে কাল যখন ওদের জ্ঞান আসবে তখন ওরা বা ওদের দলের অন্য কেউ দিদাকে আবার মারার চেষ্টা করবে। তোমাকে এ ব্যাপারে আমাদের একটা সাহায্য করতে হবে।’
‘আমি কী সাহায্য করতে পারি? তোমরাই তো ওদের অজ্ঞান টজ্ঞান করে সব করে ফেলেছ।’
‘আরে ধ্যাৎ! অজ্ঞান করলেই যদি সমস্যার সমাধান হত তো আমি তোমার কাছে আসতাম নাকি?’ বলল পিপি।
‘তাহলে?’
এবার ভিনো কথা বলল, ‘আসলে ম্যাডাম, আমরা ওঁকে গুন্ডাদের হাত থেকে অনায়াসে বাঁচাতে পারি কিন্তু কালকে যখন ওই লোকগুলো আবার ওঁকে এসে ভয় দেখাবে তখন আমারা ওঁকে বাঁচাতে পারব না। উনি ওদের সঙ্গে ঝগড়া করে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। আর সে থেকে ওঁকে বাঁচানোর সহজ উপায় হল ওঁকে ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু উনি যেই ওই বাড়িটা থেকে অন্য কোথাও চলে যাবেন ওরা ওই বাড়িটাকে দখল করবে। আর…’ বলে ইতস্তত করে চুপ করে গেল ভিনো।
‘আর আমরা চাই না ওই বাড়িটা ভাঙা হোক। কারণ ওই বাড়িটার চারদিকে আমরা সোলার নেট লাগিয়েছি। আর অনেকগুলো এয়ার শ্যাফট ও তৈরি করা আছে ওই বাড়ি আর বাগানে, যেগুলো আমাদের হাওয়া পৌঁছে দেয়। যদি বাড়িটা ভাঙা হয় তাহলে আমাদেরও সব কিছু ওখান থেকে সরিয়ে নিতে হবে।’ বলল পিপি।
‘তাই তো তাহলে কী করা যায়?’ চিন্তিতভাবে বলল অনুষ্কা।
‘দেখো! যদি তুমি লিলিদিদাকে বল ওই বাড়িটা কাউকে ভাড়া দিয়ে দিতে বা বিক্রি করতে, যে ওই বাড়িটা ভাঙবে না, তাহলে আমাদের খুব সুবিধা হয়।’ বলল পিপি।
‘তা তো বুঝলাম। কিন্তু ওরকম ভাঙাচোরা জঙ্গলে ভরা একটা বাড়ি কে ভাড়ায় নেবে? আর যদি কেউ কেনে তাহলে সে তো মেরামত করবেই বা ভেঙে নতুন বাড়ি বানাবেই।’ বলল অনুষ্কা।
‘হুম… তাহলে উপায়?’
‘দাঁড়াও। তোমরা যাও আমি বাবার সঙ্গে আলোচনা করে দেখি।’ বলল অনুষ্কা।
‘বাবা? তোমার বাবা জানেন আমাদের কথা?’ ককিয়ে উঠল পিপি।
‘আরে না না! পাগল নাকি? উনি জানেন না আর জানবেনও না । তোমরা নিশ্চিন্তে থাক। কিন্তু এই কাজে কোনও বড় লোকের সাহায্য না নিলে হবে না।’ চিন্তিতভাবে বলল অনুষ্কা। ‘ঠিক আছে আমি দেখছি। তোমরা ওদিকটা সামলাও।’ বলে ফিরে দেখল ঘরে কেউ নেই। ওরা গেল কোথায়? চারদিকে চেয়ে দেখল সেন্ট্রাল এসির ডাক্ট এর ঢাকাটা অল্প নড়ছে। তাহলে এসির ডাক্ট দিয়ে এসেছিল ওরা, ভাবল অনুষ্কা। তারপর খানিকক্ষণ ভাবল, কী করা যায়। একটা দারুণ বুদ্ধি ওর মাথায় খেলে গেল। খুশি মনে ও পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
ঘুম ভাঙল একেবারে বাবার ডাকে।
‘কিরে অনু? এখনও উঠিসনি? তুই স্কুলের জন্য লেট হয়ে গেলি তো। শরীরটরির খারাপ নাকি?’
‘না শরীর ঠিক আছে বাবা। কিন্তু আমি না, কাল একটা খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছি।’
‘কী স্বপ্ন?’
‘কারা যেন লিলিদিদাকে খুন করতে আসছে। ওটা দেখার পর থেকেই আমি আর ভালো করে ঘুমোতে পারিনি সারারাত। এই ভোরের দিকে একটু ঘুম এসেছিল।’
‘আসলে, কাল ওই লোকগুলোকে দেখেছিলি তো। তাই বোধহয়…’, বললেন বাবা।
‘বাবা তুমি আমায় একবার নিয়ে যাবে লিলিদিদার বাড়িতে আজ? প্লিস?’
‘আজ? আজ তো আমার অফিস রে। আজ কি করে…?’
‘প্লিস বাবা! আমার মনটা বড় খারাপ লাগছে।’ ছলছল করে উঠল অনুষ্কার চোখটা।
‘আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে দেখছি। তুই ফ্রেশ হয়ে নিচে আয় ব্রেকফাস্ট করতে। মা বসে আছে খাবার নিয়ে।’ বলে বাবা ওর ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
অনুষ্কা লাফিয়ে উঠে মিনিট দশেকের মধ্যে তৈরি হয়ে নিল। তারপর নিচে ব্রেকফাস্ট করতে চলে গেল। গিয়ে দেখল বাবা আর মা কিছু একটা নিয়ে আলোচনাতে ব্যস্ত। ওকে দেখেই মা বললেন, ‘হ্যাঁ রে, তোর লিলিদিদাকে বল না ওদেরকে বাড়িটা দিয়েই দিতে। ওসব বাজে লোক, ওরা কি আর তোর দিদাকে ছাড়বে?’
‘কিন্তু মা, তুমি যদি বাড়িটা একবার গিয়ে দেখ, তো তুমিও বলবে, এতো সুন্দর বাড়িটা ভেঙে ফেলবে? আর উনি বুড়ো মানুষ, শেষ জীবনটা নিজের মতো করে থাকতে চান। সেটা কি অন্যায়?’ বলল অনুষ্কা।
‘হ্যাঁ রে, বাড়িটা কি খুব সুন্দর?’ জিজ্ঞাসা করলেন মা।
‘তুমি আজ চলো না আমাদের সঙ্গে। নিজেই দেখতে পাবে।’ বলল অনুষ্কা।
‘হ্যাঁ, চলো না।’ বললেন বাবা। ‘তুমি গেলে উনিও একটু মন খুলে কথা বলতে পারবেন। ভদ্রমহিলা খুবই ভালো।’
‘তবে চল আমিও যাই। দেখে আসি অনুর লিলিদিদাকে।’ বলে মা তৈরি হতে চলে গেলেন।
(৬)
গেটের কাছে পৌঁছেই ওরা দেখতে পেল, সেই গাড়ি দুটো দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি-বারান্দায়।
বাবা বললেন, ‘এইরে, আবার এসেছে!’
মা হাঁ করে বাড়িটা দেখছিলেন, বললেন ‘কে এসেছে?’
‘ওই রিয়েল এস্টেট এজেন্টরা।’ বলল অনুষ্কা। ‘জ্বালিয়ে মারে দিদাকে।’
‘হ্যাঁ রে? এতো বাড়ি নয়, প্রাসাদ!’ বললেন মা।
‘দাঁড়াও আগে ভিতরে চলো। তবে তো!’ মুচকি হেসে বলল অনুষ্কা।
বাবা তাড়াতাড়ি গাড়িটা পার্ক করে ওদের নিয়ে ভিতরে গেলেন। ভিতরে গিয়ে কাণ্ড দেখে ওরা হতবাক। ওই লোকগুলো একটা স্ট্যাম্প পেপারে দিদাকে সই করানোর জন্য জবরদস্তি করছে। দিদার মুখটা ভয়ে সাদা হয়ে গেছে।
‘এসব হচ্ছেটা কী?’ চেঁচিয়ে উঠলেন বাবা।
ওরা এতই ব্যস্ত ছিল যে, কেউ খেয়ালই করেনি অনুষ্কারা ভিতরে ঢুকে এসেছে। ওদের তিনজনকে দেখে ওরা একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। আর লিলিদিদা খুব জোরে জোরে কাঁদতে শুরু করে দিলেন। মা গিয়ে তাড়াতাড়ি ওঁকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করতে লাগলেন।
‘আপনি কে? এর মধ্যে কথা বলেছেন কেন?’ চেঁচিয়ে উঠল লোকগুলো।
বাবা একটাও কথা না বলে নিজের মোবাইলে একটা নম্বর ডায়াল করলেন, ‘হ্যাঁ হ্যালো… স্তিভ… হ্যাঁ অমল বলছি। তুমি এখুনি একটা ক্যামেরাম্যান আর রিপোর্টার পাঠাতে পারবে? হ্যাঁ, আমি ঠিকানাটা বলে দিচ্ছি নোট করে নাও…’
লোকগুলো মুহূর্তের মধ্যে স্ট্যাম্প পেপারটা তুলে নিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। তারপরই বাইরে ওদের গাড়িগুলো স্টার্ট নিয়ে ঝড়ের বেগে গেট দিয়ে বেরিয়ে যাবার আওয়াজ পাওয়া গেলো। ওদের চলে যাওয়া দেখে বাবা ফোনে বললেন, ‘ঠিক আছে স্তিভ। এখুনি পাঠানোর দরকার নেই। আমি তোমায় একটু পরে ফোন করে সব বলছি।’ বাবা ফোনটা কেটে দিলেন।
ততক্ষণে অনুষ্কার আনা জল খেয়ে দিদা অনেকটা সুস্থ বোধ করছেন। ‘আপনারা আজ এখানে কী ব্যাপার?’ খুব দুর্বল গলায় বললেন দিদা।
‘আরে অনুষ্কা একটা স্বপ্ন দেখেছে…’ বললেন মা।
‘ভাগ্যিস আপনারা এলেন। না হলে আজ কী যে হত কে জানে।’ বললেন দিদা।
‘কিন্তু আজ না হয় আমরা আটকালাম, কিন্তু এরা যে ধরণের লোক, এরা সহজে থামবে বলে তো মনে হয় না। একটা পার্মানেন্ট কোনও ব্যবস্থা করতে হবে।’ বললেন বাবা।
‘আমি এই বাড়িটা ভেঙে ফেলতে চাই না। আমার অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই বাড়িতে…’ ফুঁপিয়ে উঠলেন দিদা।
‘সে তো বটেই। আর এতো সুন্দর বাড়ি। চারদিকে এতো ভালো ভালো পুরানো আসবাব, সব নষ্ট হয়ে যাবে। আচ্ছা বাড়িটা ভাড়া দিয়ে দিলে হয় না?’ বললেন মা।
‘কিন্তু থাকার জন্য কেউ শহর থেকে এতো দূরে বাড়ি নেবে না। এক যদি কোনও রিসর্ট…’ বলতে বলতে বাবা চুপ করে গেলেন। ‘আসলে বাড়িটা সারানো দরকার। নাহলে কারওর পছন্দ হবে না। ভাড়া বাড়ি সারানোর জন্য কেউ পয়সা খরচা করতে চায় না।’
‘এই বাড়ি সারানোর ক্ষমতা আমার নেই।’ হতাশভাবে বললেন দিদা। ‘আমি চাইছিলাম এই বাড়িটা কোনও ভালো কাজে লাগুক।’
‘আচ্ছা এই বাড়িটাকে একটা স্কুল করলে কেমন হয়?’ মা বললেন।
‘আমার তার চেয়েও ভালো একটা আইডিয়া আছে, যদি এখানে একটা অনাথ আশ্রম খোলা হয়?’ বলল অনুষ্কা।
‘ব্রিলিয়েন্ট!’ বললেন বাবা। ‘এই না হলে আমার মেয়ে। আপনি কি বলেন?’ প্রশ্নটা লিলিদিদাকে করলেন বাবা।
‘তাহলে তো খুবই ভালো হয়। কিন্তু সেরকম কাউকে তো…’ বলতে বলতে থামলেন দিদা।
‘দাঁড়ান। এই, মীনাক্ষীকে একটা ফোন করো তো আর এখুনি একবার এখানে আসতে বলো।’ বাবা মাকে বললেন।
মায়ের ফোন পাবার ঘণ্টা খানেকের মধ্যে মীনাক্ষী মাসী পৌঁছে গেলেন ওখানে। ‘কী ব্যাপার এতো জরুরি তলব? আমি টপ স্পিডে ড্রাইভ করে আসছি।’ বলতে বলতে ঢুকলেন মীনাক্ষী মাসী।
‘এসো এসো, খুব জরুরি দরকার, নাহলে তোমাকে এভাবে ডেকে পাঠাতাম না। বস।’ বললেন বাবা। ‘ইনি হচ্ছেন মিসেস লিলি ফারনানডিস। এই বাড়িটা ওঁর। উনি এখানে একাই থাকেন। বাড়িটা দেখে বুঝতেই পারছ নিশ্চয়ই যে এটা রিয়েল এস্টেট এজেন্টদের নজরে আছে। তা উনি এটা কোনও সৎ কাজে দান করতে চান। তাই অনুষ্কা বলল তুমি যদি চাও, তাহলে তোমার ‘ঝরা ফুল’ কে এখানে আনা যায়।’ বলে থামলেন বাবা।
অনুষ্কার চোখ-মুখ আনন্দে উৎসাহে জ্বলজ্বল করছে। ও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না।
মীনাক্ষী মাসী সব শুনে একটু চুপ করে কিছু ভাবলেন। ওরা সবাই মীনাক্ষীর দিকে চেয়ে আছে। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, ‘দেখুন আমার এই বাড়িটা হলে খুবই ভালো হয়, কিন্তু কতকগুলো অসুবিধা আছে। এক নম্বর আমি আর ভাড়া বাড়িতে যেতে চাই না। আর এই বাড়িটা কেনার বা লীজ নেবার ক্ষমতা আমার নেই। আর দ্বিতীয়ত এই বাড়ি সারিয়ে এটাকে ব্যবহারের উপযুক্ত করার ক্ষমতাও আমার নেই।’
লিলিদিদা বললেন, ‘ভাড়া বা লীজ নিয়ে ভেবো না। আমি বাড়িটা তোমাকে দান করতে চাই। শুধু আমি যতদিন বাঁচব, ততদিন আমায় থাকতে দিতে হবে। কিন্তু বাড়ি সারাবার সমস্যাটায় সত্যিই আমারও কিছু করার নেই।’
মা বললেন, ‘আচ্ছা, এমন কোনও সমাজসেবী সংস্থা পাওয়া যায় না, যারা বিনা পয়সায় বা কম পয়সায় সারিয়ে দেয় এই বাড়িটা?’
বাবা বললেন, ‘খুঁজে দেখা যেতেই পারে।’ বলে উনি নিজের মোবাইল থেকে কাউকে ফোন লাগালেন।
‘আচ্ছা আমিও দেখছি।’ বলে মীনাক্ষী মাসীও নিজের ফোন থেকে কাউকে একটা ফোন লাগালেন।
মা আর লিলিদিদা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে ব্যস্ত। এই সুযোগে অনুষ্কা চুপি চুপি পিছনের করিডোর দিয়ে বাইরে চলে গেল। দেখল দেয়ালের পাশে পিপি দাঁড়িয়ে আছে।
অনুষ্কা পিপিকে সব কিছু খুলে বলল। পিপি সব শুনে বলল, ‘দেখো, এই বাড়িটাতে যদি অনাথাশ্রম হয়, তাহলে খুবই ভালো হয়। আর মেরামত যা করার আমাদের টেকনিক্যাল টিম সব করে দেবে। কিন্তু আমাদের কয়েকটা শর্ত আছে।’
‘কী শর্ত?’
‘তোমার মাসির কী কী দরকার যেন একটা কাগজে এঁকে আর লিখে দেন তোমাকে। আমরা শুধু রাতে কাজ করব। আর একবার মেরামতের কাজ শেষ হয়ে গেলে বাড়ির কোনও অংশ পরে অন্য কোনও মিস্ত্রীকে দিয়ে ভাঙানো বা মেরামত করা যাবে না। যদি কিছু বদলানোর দরকার হয় তা তোমার মাধ্যমে আমাদের দিয়েই করাতে হবে। বলে দিও যে আমরা কোনও টাকা নেব না। কিন্তু আমরা সামনেও আসব না। আর হ্যাঁ, আমরা যখন কাজ করব তখন যেন কেউ দেখতে না আসে। কেমন? আর হ্যাঁ তোমার দিদার কাছ থেকে বাড়ির সামনের দরজার চাবিটা চেয়ে নিও কিন্তু। যদিও আমাদের সেটা কোনও কাজে লাগবে না।’
‘ও এই শর্ত? নো প্রবলেম। কিন্তু কত সময় নেবে?’ জিজ্ঞাসা করলো অনুষ্কা।
‘এই তিন থেকে চার দিন।’ বলল পিপি।
‘আরেব্বাবা! চলবে না।’ আঁতকে উঠল অনুষ্কা।
‘তার চেয়েও কম সময়ে? তাহলে কাজ ভালো হবে না। বাগানটাও তো করতে হবে? নইলে বাচ্চারা খেলবে কোথায়?’ গম্ভীর হয়ে বলল পিপি।
‘কম না বেশি সময়। তিন থেকে চার মাস বল। তুমি কাজ দেখেছ? কোনও মানুষে এই কাজ অত কম সময়ে করতে পারবে না।’
‘মানুষে পারবে না ঠিকই কিন্তু বুনিষে পারবে। বললাম তো আমাদের টেকনোলজি তোমাদের চেয়ে অনেক অ্যাডভান্সড।’
‘ঘাট হয়েছে আমার। মাফ কর ভাই। আমি তিন থেকে চারমাসই বলছি। আমি এখন যাই।’
‘ওকে!’ খিলখিল করে হেসে উঠল পিপি।
অনুষ্কা বসার হলে ফিরত এসে দেখল সকলেরই মুখ গম্ভীর। ও বুঝল কোনও ব্যবস্থা হয়নি।
‘আমার এক বন্ধু আছে পি… পিয়ালি । আমি ওকে এখুনি ফোন করেছিলাম। ওর বাবার একটা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি আছে। ‘বুনিষ ইনফ্রা’ বলে। ও বলছিল যে ওরা এরকম সমাজসেবামূলক কাজ করে। ওরা এই কাজটা করে দেবে। শুধু আমাকে বাড়ির সামনের দরজার চাবিটা দিয়ে দিও, আমি পিয়ালিকে দিয়ে দেব।’
সবাই একসঙ্গে বলে উঠল, ‘বাঃ! দারুণ!’
(৭)
এর পর প্রায় দুমাস কেটে গেছে। প্রতি রবিবার অনুষ্কা আসে লিলিদিদার বাড়িতে। আর প্রতিবারই দেখে বাড়িটার অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
ওই ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যেই লিলিদিদা ওঁর বাড়িটা ‘ঝরা ফুল’ অনাথ আশ্রমের নামে লিখে দিয়েছেন। আর সেই খবরটা খবরের কাগজে ছাপাও হয়েছে। তারপর থেকে ওই দুষ্টু লোকগুলো আর কখনও দিদাকে বিরক্ত করতে আসেনি।
আর কয়েক দিনের মধ্যেই অনাথ আশ্রমের নতুন বাড়ির উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। মীনাক্ষী মাসীর ব্যস্ততার সীমা নেই। উনি প্রায় প্রতিদিনই আসেন লিলিদিদার বাড়ি। এখন লিলিদিদা খুব খুশি। উদ্বোধনের পর মীনাক্ষী মাসীও চলে আসবেন লিলিদিদার বাড়িতে থাকতে। ওখানে থাকলে মাসীর কাজ করতে অনেক সুবিধা হবে।
এই সব নিয়ে পিপির সঙ্গে অনুষ্কার আলোচনা চলছিল। কথা বলতে বলতে পিপি ওকে ঘুরে ঘুরে কাজকর্মগুলোও দেখাচ্ছিল। দিদার বাড়ির সামনে একটা ট্রাক, কংক্রিট মেশানোর মেসিন, ক্রেন এসব দাঁড় করানো আছে। শুধু তাই নয় এদিকে ওদিকে সাবল, খুরপি, হাতুড়ি এসব কিছু যন্ত্রপাতিও ছড়িয়ে রাখা আছে। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে সেগুলো কোনওদিনই ব্যবহার হয় না।
এখন বাড়ির সামনের গেটটা আর ভাঙা নেই। ঝকঝকে নতুন। আর সেটা কালো আর সোনালী রং করা হয়েছে। গেট থেকে গাড়ি বারান্দা পর্যন্ত রাস্তাটা মোরাম বিছিয়ে মেরামত করা হয়েছে। গাছের কেয়ারিগুলো নিখুঁতভাবে কাটা। মাঝের ঝোপজঙ্গলগুলো পরিষ্কার করে সেখানে লাগানো হয়েছে মরশুমি ফুল। বড় গাছগুলোর তলায় বেদি বানানো হয়েছে, বসার জন্য। চারপাশের দেয়ালগুলো মেরামত করে রং করা হয়েছে। বাগানে অনেকগুলো শ্বেতপাথরের মূর্তি ছিল সেগুলোকে পালিশ করে আবার আগের মতো স্ট্যান্ডের ওপর বসানো হয়েছে। যে মূর্তিগুলো ভেঙে গিয়েছিল, সেগুলোকে এমনভাবে মেরামত করা হয়েছে, যে মনে হচ্ছে ওগুলো কোনওদিন ভাঙেইনি। পিছনের ভাঙা বাড়িটাকে মীনাক্ষী মাসীর যেমন দরকার, সেরকমভাবে তৈরি করা হয়েছে। মাঝের ফোয়ারাটা আবার চালু হয়েছে।
অনুষ্কা ফোয়ারার পাশে পৌঁছে ওটাকে দেখতে দেখতে হঠাৎ হাতে খানিকটা জল নিয়ে পিপির গায়ে ছুঁড়ে দিল। পিপি তখন অনুষ্কাকে সোলার লাইটস বাগানের কোথায় কোথায় লাগানো হবে, বোঝাচ্ছিল। জলের ছিটে গায় লাগতে, চমকে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘এটা কী হল? তুমি আমার গায়ে জল ছুঁড়লে কেন?’
অনুষ্কা হেসে বলল, ‘একটু মজা করলাম।’
‘এটা মজা করা?’
‘তুমিও আমার গায়ে জল ছোঁড়, তবে মজাটা হবে। কেন তোমরা এরকম খেলা কর না? করেই দেখ না!’
ব্যাস এক মিনিটের মধ্যে শুরু হয়ে গেল জল ছোঁড়াছুঁড়ি খেলা। খানিকক্ষণ বাদে হাসতে হাসতে হাঁপিয়ে গিয়ে পিপি বলল, ‘আমার ছ’শো বছরের জীবনে আমি এরকম মজা কখনও করিনি।’
‘তোমার বয়স ছ’শো বছর?’
‘হ্যাঁ। আমরা তোমাদের চেয়ে অনেক বেশি বাঁচি। গড়ে আটশো থেকে হাজার বছর।’
‘তোমায় তো দেখে এতো বয়স মনে হয় না। তোমাদের গায়ে কি ঝুরি পড়ে না?’
‘তুমি ভুলে যেও না যে আমরা নাগ। আমাদের পুরানো ত্বক খসে পড়ে যায়। আবার নতুন ত্বক গজায়। তাই, নো রিঙ্কলস!’
‘ও হ্যাঁ! তাইতো! আচ্ছা, তোমরা যে এতো কাজ করছ, আমি না তো কোনও মেশিন দেখতে পাই, আর না কোনও মালমসলা। তোমরা কাজ কী করে কর?’
‘আমরা বেশিরভাগ যে জিনিসগুলো আছে সেগুলোকেই আবার ব্যবহার করছি। শুধু পাথর বা ইঁটগুলোকে জোড়ার জন্য একটা কম্পাউন্ড ব্যবহার করছি আমরা, যেটা ভূমিকম্প বা কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগেই নষ্ট হবে না। এটা তৈরি করার একটা মেশিন আছে যেটা সেইটুকু কম্পাউন্ডই তৈরি করে যেটুকু দরকার। যেহেতু দেয়াল বানানো আর পরিষ্কার করা সবটাই automated, একটা super computer দিয়ে control করা হয় তাই কাজটা নিখুঁত।’
‘এখন তো শুধু রং করাই বাকি।’ জিজ্ঞাসা করলো অনুষ্কা।
‘হ্যাঁ আমাদের রং করার robotরা তৈরিই আছে। এই বাড়িটা রং করতে ওদের তিন থেকে চার ঘণ্টা লাগবে। কিন্তু তুমি যেহেতু বলেছ, তাই আমরা এই কাজটা সাত দিনে করব।’ বলল পিপি।
‘আমি এবার যাব। আমি আসব একদম উদ্বোধনের দিন। তুমি থাকবে না ওখানে?’ জিজ্ঞাসা করল অনুষ্কা।
‘আমি? ঠিক আছে থাকব। কিন্তু একটা পুতুল সেজে তোমার কোলে। কেমন?’
‘ও কে।’
উদ্বোধনের দিন ওরা সবাই যখন গিয়ে পৌঁছল, তখন বাড়িটা দেখে বাবা আর মা একদম অবাক হয়ে গেলেন। এতো সুন্দর বাড়ি?
মীনাক্ষী মাসী সারা বাড়িটাকে ফুল দিয়ে সাজিয়েছেন। বাড়ির সামনে একটা সুন্দর নামের ফলকও লাগানো হয়েছে।
বাড়িতে ঢুকেই অনুষ্কা একটা পুতুল কোলে করে সারা বাড়ি ঘুরতে লাগল। মা বললেন, ‘বাঃ! বেশ তো পুতুলটা। কোথায় পেলি।’
‘এই এখানেই একটা আলমারিতে ছিল।’ বলল অনুষ্কা।
লিলিদিদা খুব সুন্দর করে সেজেছেন। মা দিদাকে দেখে বললেন, ‘আপনাকে খুব ফ্রেশ দেখাচ্ছে। আমি তো ভেবেছিলাম বাড়ি সারাতে সারাতে আপনি ক্লান্ত হয়ে পড়বেন।’
উনি হেসে উত্তর দিলেন, ‘জানতো, এই বাড়িটা দান করে দেবার পর থেকেই আমি খুব শান্তিতে সারারাত ঘুমোই। আর বাড়ি সারানো, আমি তো বুঝতেই পারলাম না ওরা কখন আসে, কখন যায়। ওরা আমার ঘুমোনোর পর আসতো, আর আমি জেগে ওঠার আগে চলে যেত। আমি কোনওদিন কোনও লোককে চোখেই দেখলাম না।’
কথাটা শুনেই অনুষ্কা পুতুলের দিকে তাকাল। পুতুলটার মুখে একটা হালকা হাসি খেলে গেল, অনুষ্কা ছাড়া আর কেউ সেটা লক্ষ করল না।
মীনাক্ষী মাসী লিলিদিদাকে দিয়ে ফিতে কাটাল। দিদা আনন্দে কেঁদে ফেললেন। অনেক লোকজন এসেছিল। সবাই খাওয়াদাওয়া করে খুব প্রশংসা করতে করতে চলে গেল। ‘ঝরা ফুল’ এর বাচ্চারা এই বাড়ি, বাগান, তাদের ঘর আর আসবাব দেখে খুব খুশি।
অনুষ্ঠানের শেষে অনুষ্কা পুতুলটাকে নিয়ে বাগানের পিছন দিকে একটা গাছের তলায় গিয়ে বসল।
‘তোমাকে ধন্যবাদ বলা হয়নি।’ আসতে আসতে বলল অনুষ্কা।
‘উঁহুঁ… শুধু ধন্যবাদে চলবে না। আমাকে আবার সেই পুডিংটা খাওয়াতে হবে।’ হেসে বলল পিপি।
‘ওঃ! সে আর এমন কি? কবে আসবে বল আমাদের বাড়ি, আমি মাকে বলে পুডিং বানিয়ে রাখব।’
‘আসব একদিন। এবার তোমাকেও কিন্তু আসতে হবে আমাদের বাড়ি।’ বলল পিপি।
ভিতর থেকে মায়ের গলা পাওয়া গেল, ‘অনু কোথায় তুই? চল, আমরা বাড়ি যাব।’
অনুষ্কা ছুটে বাড়ির দিকে যেতে যেতে বলল, ‘খুব শিগগিরই আসব আমি তোমাদের বাড়ি।’
সমাপ্ত
Tags: অপর্ণা চৌধুরী, কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, চিত্রা মিত্র, বড় গল্প