বৃষ্টি যেখানে একা
লেখক: পরীক্ষিৎ দাস
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
লেখক – পরীক্ষিৎ দাস
অলংকরণ – সুপ্রিয় দাস
ল্যান্ড রোভারের ভিতর আমার খুব প্রিয় একটা গান বাজছে। এখানে আসার সময়ে আমার পছন্দের বেশ কিছু গান একটা পেনড্রাইভে ভরে নিয়ে এসেছিলাম। শহর নিয়ে লেখা গানটার এই লাইনগুলো শুনলেই খালি মনে হয় এখানে সবকিছু আছে। নদী, পাহাড়, জঙ্গল, মরুভূমি — সব। শুধু শহরটাই নেই। সেই কাজেই আমার, থুড়ি আমাদের এখানে আসা।
ওরাই পাঠিয়েছে এই ঢাউস গাড়িটা। আর একটা ছোট্ট এরোপ্লেনও। রুমেলা অনায়াসে চালাতে পারে সেই এরোপ্লেন। আমার আর রুমেলার কাজ রোভার আর এরোপ্লেনের সাহায্যে গোটা জায়গাটা চষে ফেলা। কাজ প্রায় শেষের দিকে। ক-মাসের মধ্যে রিপোর্ট পাঠিয়ে দেব ওদের। রিপোর্টে থাকবে শহর গড়ে তোলার উপযুক্ত স্থানগুলোর খুঁটিনাটি বিবরণ আর তার বিস্তারিত মানচিত্র। তারপর ওরা শহর গড়তে প্রয়োজন এমন যাবতীয় সরঞ্জাম আর শহরের বুকে বসবাস করবে এমন অগুনতি মানুষকে দলে দলে পাঠিয়ে দেবে এখানে। তখন অবশ্য আমরা, থুড়ি আমি থাকব না! রুমেলা অবশ্যই থাকবে। কারণ রুমেলা বাইরে থেকে এক অপরূপ সুন্দরী নারী হলেও আসলে সে এক যন্ত্রমানবী। তার খুলির ভিতর মস্তিষ্কের বদলে রয়েছে জটিল সার্কিটের জঙ্গল। মানুষের হাতে তার জন্ম হয়ে থাকলেও, মৃত্যু নেই!
রোভারের ছাতে হঠাৎ জল পড়ার শব্দ পেয়ে চমকে উঠলাম। সামনের কাচেও টুপটাপ শুরু হয়েছে। এতটাই অবাক হলাম যে বাধ্য হলাম ব্রেক কষতে। আমাদের চতুর্দিকে ছড়িয়ে রয়েছে বাদামি রঙের অজস্র পাথুরে ঢিবি। ঝিমঝিমে বৃষ্টিতে সেগুলো নিঝুম হয়ে ভিজছে।
জিন্সের হটপ্যান্ট পরিহিতা রুমেলা ড্যাশবোর্ডের ওপর তার সুমসৃণ পা দুটো তুলে দিয়ে আপনমনে বাঁ হাতের নখ ফাইলিং করছিল। গাড়ি থেমে যেতে চোখ তুলে চাইল আমার দিকে।
—কী হল?
—প্রথমবার বৃষ্টি হচ্ছে এখানে। কী অদ্ভুত না! শেষ কবে বৃষ্টি দেখেছি মনেই নেই।
—প্রথমবার নয় পার্থ। আগেও হয়েছে। এখানে বৃষ্টির কোনও সুনির্দিষ্ট সিজন নেই, এই যা। তবে বায়ুমন্ডলের গঠন হুবহু আমাদের গ্রহের মতই।
আমি ভুরু কুঁচকে ওর দিকে তাকালাম।
—এর আগে কবে বৃষ্টি হল?
—হয়েছে। তুমি তখনও আসনি। ভুলে যেও না, তুমি আসার বহুদিন আগে থেকে আমি আছি এখানে। টু বি স্পেসিফিক, তিনশো পঁয়তাল্লিশ বছর সাত মাস আঠেরো দিন আগে থেকে। আমি এসেই তো ট্রান্সমিট করলাম যে, জায়গাটা মানুষের পক্ষে বাসযোগ্য। আর পশুপাখি তো আগে থেকেই আছে। মানুষই কেবল ছিল না।
—ওহ হ্যাঁ। রাইট… রাইট ইউ আর রু!
সুপারস্লিপ মেশিনের মধ্যে ঘুম পাড়িয়ে অত্যাধুনিক মহাকাশযানের সাহায্যে এখানে পাঠান হয় আমাকে। সেই মেশিনের গুণে ঘুমিয়ে থাকা মানুষের বয়স থেমে থাকে ঘুমিয়ে পড়ার দিনেই। সেদিন আমার বয়স ছিল বত্রিশ। আর আজ তিনশো সাতচল্লিশ বছর পর চৌত্রিশ। রুমেলার শরীর অবশ্য তার জন্মকাল থেকেই পঁচিশে আটকে আছে।
আমি গাড়িতে স্টার্ট দিলাম। বৃষ্টিভেজা রোভার এখন ফিরবে আমাদের ছোট্ট, কিন্তু রুমেলার হাতে সযত্নে সাজানো ফেসিলিটিতে। আমি বললাম,
—আচ্ছা, ওরা কবে অন্যদের পাঠাবে?
—আমরা রিপোর্ট ট্রান্সমিট করার ক-মাসের ভিতর। মানে ওখানকার সময় অনুযায়ী বলছি। আলোর গতিবেগেও যদি ট্রাভেল করে, এখানে পৌঁছতে লেগে যাবে, তা ধরো আরও তিনশো পঁয়তাল্লিশ বছর। ভাগ্যিস সুপারস্লিপ ছিল! কিন্তু এ প্রশ্ন হঠাৎ?
আমি নিরাশ গলায় বললাম,
—কিছু না। আসলে খুব প্রেম করতে ইচ্ছে করছে, মধুরিমাকে দেখতেও। এই অসময়ের বৃষ্টিটাই কালপ্রিট মনে হয়!
চলন্ত গাড়িতে রুমেলা ঝুঁকে আসে আমার কাঁধের কাছে। ফিসফিস করে বলে,
—আমি আছি তো! আই লাভ ইউ পার্থ!
আমি জানি ওর সিন্থেটিক মস্তিষ্কের প্রোগ্রামিং-এ ওকে এমনটাই করতে বলা আছে। আমার মুড-ইনপুট, আর তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ওর ভঙ্গি বা কথা-আউটপুট!
আমি হেসে বলি,
—আবার ভুল করলে রু, প্রেম খুব জটিল বস্তু!
ফেসিলিটির ভিতর ঢুকে পড়ে আমাদের রোভার। ফেসিলিটিতে আমরা দুজন ছাড়া কেউ নেই। এই গোটা গ্রহটায় আমরা দুজন ছাড়া আর কেউ কোথাও নেই। আর মানুষ বলতে শুধু আমি!
কোল্ড স্টোরেজে রাখা বিস্বাদ খাবারের খানিকটা গরম করে দেয় রুমেলা। সে নিজে অবশ্য খায় না। খাওয়া, ঘুম, প্রাতঃক্রিয়া—এসবের প্রয়োজন পড়ে না তার। তাকে শুধু সপ্তাহে একবার সাত ঘন্টার জন্য চার্জ দিতে হয়। তবে আমার পাশ ছেড়েও যায় না খাওয়া শেষ হওয়া অবধি। সে সত্যিই আমার খেয়াল রাখে। কখনও আমার চোখে চোখও রেখে ফেলে। তবে আমি কখনও ভুলি না যে সে কেবল একটা যন্ত্র। তার শরীরে লুকানো একটা বিশেষ সুইচ স্পর্শ করলে সেই যন্ত্র আমাকে যৌনতৃপ্তি দিতেও সক্ষম। কিন্তু আমি কোনওদিন ওই সুইচে হাত দিই না। রোজ মাঝরাতে মধুরিমাকে যখন ভীষণভাবে চায় আমার শরীর, তখন শুধু ভাবি, কেন ওই সুইচটায় হাত ছোঁয়াচ্ছি না আজ রাতটুকুর জন্য! তারপর পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়ি যথারীতি। আর স্বপ্ন দেখি—নতুন এক শহরে বাস করছি আমি, মধুরিমা এবং আরও অনেকে। স্বপ্নের সেই শহরে বৃষ্টি পড়ে সারা বছর ধরে!
মনের গভীরে সত্যের বীজ বপন হয়েছে সেই দিন, যেদিন জানতে পারি যে এখান থেকে আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনও বন্দোবস্ত নেই। এ-ও আমি জানি যে আমার এখানে পৌঁছনোর আগেই নিঃশেষ হয়ে গেছে মধুরিমা। কারণ তিনশো পঁয়তাল্লিশ বছর তো রক্তমাংসের মানুষ বাঁচে না। আর আমিও শহর তৈরি হওয়ার বহু বছর আগেই শেষ হয়ে যাব। থাকবে শুধু রুমেলা। তাই স্বপ্ন আমার স্বপ্নই থেকে যায় আর কাকভোরে ঘুম ভাঙে রুমেলার মিষ্টি ডাকে। আমি ঘোলাটে চোখে রুমেলাকে দেখি। সেও চেয়ে থাকে এই অচেনা গ্রহে পৃথিবী থেকে পাঠানো রক্তমাংসের প্রথম টেস্ট-সাবজেক্টের দিকে। আমি আবিষ্কার করি, প্রেমের মতই জটিল রুমেলা নামক অদ্ভুত এই যন্ত্রের চোখদুটো!
Tags: অনুগল্প, কল্পবিজ্ঞান গল্প, তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পরীক্ষিৎ দাস, পূজাবার্ষিকী, সুপ্রিয় দাস
দারুণ লাগলো । চরিত্রের টানাপোড়েন আর কল্পবিজ্ঞান সমানুপাতে বর্তমান ।
Darun. Ektu vablei ga seure other…