ভাঙ্গা গড়ার খেলা
লেখক: শাহরিয়ার আহমেদ
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
হঠাৎ ছুটতে শুরু করলাম। মহাশূন্যের ভেতর দিয়ে! কেন? জানি না। কোথায় যাচ্ছি তাও জানি না! শুধু এটুকু বুঝতে পারছি, গ্যালাক্সি কেন্দ্রের দিকে ছুটে চলেছি। ছুটছি তো ছুটছিই; অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছুটছি!
এবার শুরু হল এক প্রচণ্ড টান। সোজা ব্ল্যাকহোলের দিকে। কিন্তু সেখানে তো আমাদের প্রবেশ নিষেধ। গ্রন্থে পরিষ্কার নির্দেশ দেওয়া আছে, “তোমরা আমার সৃষ্টির সর্বত্র ভ্রমণ করিতে পারিবে। মুহূর্তে কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরে সরাসরি গমন করিবার ক্ষমতা প্রদান করা হইল। ইহা তোমাদের জন্য আমার কত বড় নেয়ামত–যদি তোমরা জানিতে…
… অতঃপর কিছু বিষয়ে তোমাদিগকে সতর্ক করা হইতেছে। উহাদের একটি হইল কৃষ্ণবিবর। তোমরা কখনও কৃষ্ণবিবরের নিকটবর্তীও হইবে না। ইহা আমার আদেশ…”
কিন্তু এ কি হল আমার? নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ব্ল্যাকহোলের একেবারে কাছে চলে এলাম! টানের তীব্রতা সীমা ছাড়িয়ে গেল। সমগ্র চেতনা যেন সূক্ষ্ম সুতোর মতো হয়ে সুপার ম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলের মধ্যে ঢুকে পড়ল। কিছুই দেখতে পাচ্ছি না আর। নিঃসীম অন্ধকারে চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছি যেন! ভয়ে চিৎকার করে উঠলাম! লুপ্ত হয়ে গেল সমস্ত চেতনা।
যখন চেতনা সক্রিয় হল, চারিদিকে ঘন অন্ধকার। এ কোথায় এলাম! কোথা থেকে কি হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। শুধু অনুভব করতে পারছি, নতুন কোনও জগতে চলে এসেছি! এ জগতে প্রচুর গ্যালাক্সি আর অগণিত নক্ষত্র। তবুও এই মহাশূন্যের প্রায় সবটাই অন্ধকারে ঢাকা। কেন যেন ভয় করতে লাগল। তবে আমি কি স্রষ্টার নির্দেশ অমান্য করলাম?
কিন্তু আমরা তো তা করতে পারি না! সে রকম কোনও ইচ্ছা বা বাসনা তিনি আমাদের দেন নাই।
দূরে মিটিমিটি কিছু তারা দেখতে পেলাম। ওটাও এই জগতের কোনও গ্যালাক্সি! দূরত্ব কেমন হবে? মিলিয়ন মিলিয়ন আলোকবর্ষ। সেটা কোনও সমস্যা নয়। দিলাম ছুট সেদিকেই। অনেকটা চিন্তার গতিতে।
ঢুকে পড়লাম নতুন এক গ্যালাক্সি এলাকায়। দ্রুত বদলাতে থাকল দৃশ্যপট। কোটি কোটি আলোকবর্ষ মুহূর্তে অতিক্রম করে চলেছি। যা কিছু দেখছি সবই সুদূর অতীতের দৃশ্য। এত বিশাল দূরত্ব পাড়ি দিয়ে তো আর বর্তমানের কিছু দেখা সম্ভব নয়। সব কিছুই যেন মায়া। লক্ষ কোটি বছর আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে–দূর থেকে দেখা দৃশ্যের প্রায় সব কিছুই।
একটা উজ্জ্বল তারা দেখে দিলাম ছুট। হায়! শুধুই গভীর অন্ধকার, ব্ল্যাকহোল! তারাটা মরে গেছে অনেক আগেই। ওটার ঘটনা দিগন্তের কাছাকাছি থেকে ফিরে এলাম।
এবার একটা মাঝারি সাইজের নক্ষত্রকে টার্গেট করলাম। মুহূর্তে তারাটার একেবারে কাছে এসে পড়লাম! ওর চারদিকে চক্কর দিলাম কয়েকটা। বেশ কয়েকটা গ্রহ আবর্তন করছে নক্ষত্রটাকে। বাহ! অনুভূতি যেন বদলে গেল হঠাৎ! এখন আমি অনেকটাই শান্ত।
খুব সুন্দর তো! একটা ঝকঝকে নীল মার্বেলের মতো গ্রহ দেখে অবাক হয়ে গেলাম। কি সুন্দর! বড় মায়াবী! কিছু চিন্তা না করে নেমে পড়লাম সেখানে।
কোনও লোকজন দেখতে পেলাম না। শুধু বিশাল ফসলের মাঠ। সবুজ গাছপালার ভেতর দিয়ে চলতে থাকলাম। মনটা অজানা পুলকে মশগুল। হঠাৎ একটা অদ্ভুত সুর কানে এল। এত সুন্দর জায়গায় একি বিষণ্ণ সুর! কে গাইছে! এগিয়ে চললাম সেদিকে। আরে! একটা নদী! কলকল করে স্বচ্ছ পানি বয়ে যাচ্ছে। ঠিক আমাদের গ্রহের মতোই। কিন্তু আমরা তো এমন করে গাইতে পারি না!
এবার আরও অবাক হবার পালা। নদীতে একটা কাঠের তৈরি যান ভাসছে। সেখানে বসে একটা প্রাণী। দেখতে একেবারে আমাদের মতোই! হাত, পা, চোখ, মুখ, কান সবই। শুধু চেহারাটা বেশ কঠিন। গায়ে তেমন কোনও পোশাকও নেই। করুণ সুরে গানটা সে-ই গাইছে! ভাষাটা বেশ মিষ্টি! এখানকার কিছু অনুভূতির সঙ্গে সিনক্রোনাইজ করে নিলাম নিজেকে। এ এক অদ্ভুত অনুভুতি! যেমন, দুঃখ-কষ্ট কি আগে জানতাম না; এখন তা অনুভব করতে পারছি। গানের কথাগুলোর সঙ্গে আমি সিঙ্ক করে নিলাম–
এ কুল ভাঙ্গে, ও কুল গড়ে–
এই তো নদীর খেলা…
এর তাৎপর্য কি? এদের কিসের এত কষ্ট! কেনই বা এত দেহ খাটাতে হচ্ছে! আমাদের তো কিছুই করতে হয় না। স্রষ্টার দেওয়া সমস্ত সুযোগসুবিধা এমনিতেই সব পেয়ে থাকি। কাজের মধ্যে শুধু তাঁর গুণগান করা।
লোকটার গানের কথাগুলো আমার মনকে নাড়া দিল। ভিন্ন ধরণের এক অনুভূতি নিয়ে মাঠের দিকে ফিরে গেলাম। সেখানে একই রকম আরও কিছু প্রাণী দেখতে পেলাম। তারা নারী-পুরুষ মিলে ফসল তুলছে। কাজটা কঠিন হলেও আনন্দের গান গাইছে অনেকে; হাসি তামাশাও করছে নিজেদের মধ্যে। কিছু লোক বিলের টলমলে জলে মাছ ধরছে। ঝিরঝিরে হাওয়া বইছে। বেশ শান্ত ও শান্তির পরিবেশ!
গাছের ছায়ায় খেতে বসেছে একজন। পাশে বসে পাতার যন্ত্র দিয়ে বাতাস করছে যে, তাকে দেখে আমার আমার বুকের মধ্যে আলোড়িত হল। জীর্ণ পোশাক। তবু কি যে আকর্ষণীয়! সুন্দর মায়াভরা মুখখানা!
কোনও এক দুর্বার আকর্ষণে ওদের খুব কাছে চলে এলাম। কথা শুনতে চাই ওদের।
লোকটা বলছে,
– ইশ! তোর শাড়িডা এক্কেবারে ছিঁড়ে গেছে। ইবার পাট বেচে তোর একখান শাড়ি কিনতি হবি; আর…
– আর কি?
– লাল ফিতে।
আনন্দে মেয়েটার মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল। বলল, – তুমার জন্যি তবন আর…
– আর কি?
– একখান লাল গামছা।
দু’জনেই এক সঙ্গে হেসে উঠল তারা। তবু এদের খুব কষ্ট! কি যেন একটা অশুভ ভার চেপে বসে আছে এদের ওপর। অজান্তে সে ভার বহন করতে হচ্ছে এদের সবাইকে। তাও মনে হল, বেশ সুখেই আছে এরা। মমতাময়ী চেহারার স্ত্রীলোকটি যত্ন করে ঘাম মুছিয়ে দিল পুরুষটির। আমার জন্য এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। অদ্ভুত এক মায়া-মমতার জগত যেন এটা!
এদের বিষয়ে সব কিছু জানতে চাই আমি। এই স্নিগ্ধ আলো বাতাস, এত সুন্দর নদী, সবুজ গাছপালা, নানা রঙের ফুল, ফল আর… আর এমন মমতাময়ী নারীর বাস যেখানে, সেখানে ওই বিষাদে ভরা গানের ব্যাখ্যা কি? স্রষ্টা কেন এত নিষ্ঠুর এদের প্রতি!
এদের পুরানো বইপত্র ঘাঁটতে হবে। এই গাঁয়ে বই পাব কোথায়! তবে খুব বেশি খুঁজতে হল না। সহজেই পেয়ে গেলাম মোটা বই একখানা। প্রায় সবার ঘরেই রয়েছে। একখণ্ড কাপড়ে যত্ন করে মোড়া। একজন সুর করে পড়ছে সেটা। এরা তো দেখি খুব সুরের ভক্ত!
বইটা নিজের ভাষায় তরজমা করে নিলাম। এটা আগাগোড়া পড়ে ফেলতে কয়েক মুহূর্ত লাগল। আর জানতে পারলাম, এক অদ্ভুত কাহিনি। সবই দেখছি আমাদের আদি পুরুষের কাহিনির মতোই। শুধু একটি জায়গায় এসে ভিন্ন দিকে মোড় নিল ঘটনাটা! অন্য রকম হয়ে গেল। এদের আদি পিতার নাম অ্যাডাম। সে কোনও অশুভ প্ররোচনায় স্বর্গরাজ্যের নিষিদ্ধ ফল খেয়ে ফেলল। হায়! নিজের সৃষ্টিকর্তার নির্দেশ অমান্য করল! বড় অদ্ভুত কাণ্ড তো!
আর সেই দুঃসাহসী আদি মানব-মানবীকে শাস্তিও দিলেন স্রষ্টা। এ কেমন শাস্তি, বুঝতে পারলাম না! তিনি বললেন, “তোমরা উভয়ে নামিয়া যাও…”
এত সুন্দর একটা গ্রহে জায়গা দিলেন; তা শাস্তি হয় কি করে!
শিগ্রিই ধরতে পারলাম কারণটা; সেই অশুভ প্ররোচনাকারীকেও এদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এরা যাকে দেখতে পায় না! তাই এত সুন্দর জায়গা অথচ এর বাসিন্দাদের জীবন এত কঠিন।
আমাদের বাসস্থানে জীবন সহজ। কোনও অশুভ প্রভাব নেই। অপরাধ কাকে বলে কেউ জানেই না। তবে এদের জীবনে অনেক স্বাধীনতা আছে। নানা উদ্ভাবনী ক্ষমতাও আছে এদের। যার দ্বারা এরা নিজেদের চেষ্টায় খেটে-পিটে বেঁচে থাকে। জীবন যত কঠিনই হোক, এদের আমার ভাল লাগল। মায়াও লাগল বেচারাদের জন্য। মনে হল, এরা সর্বদাই কারো সঙ্গে যুদ্ধ করছে! সে আর কেউ নয়, সেই অশুভ শক্তি–স্বয়ং ইবলিশ!
তবু সব মিলে এদের জীবন যাপন খুব খারাপ মনে হল না আমার। অনেক বৈচিত্র্যময়। কঠোর, কঠিন আর বেপরোয়া জীবন!
এরা আমাকে দেখতে পাচ্ছে না। সেটা আমার জন্য সুবিধাই হল। চেতনায় ভ্রমণের বিষয়টি এদের জানা নেই। আমি যেমন দেহের বোঝাটাকে শক্তিক্ষেত্রে ছড়িয়ে দিয়ে পূর্ণ সচেতনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এই বিষয়টিতে এরা অনেক পেছনে। এখানে চেতনার ব্যবহার তেমন একটা নেই বললেই চলে! শুধু নিজের চেষ্টায় বস্তুগত উৎকর্ষতা লাভ করেছে এই গ্রহের বাসিন্দারা।
এদের সম্পর্কে জানার আগ্রহ বাড়তে থাকল আমার। কয়েক মুহূর্তে ঘুরে দেখলাম পুরো গ্রহটাকে। পেন্টাগন, ক্রেমলিন, ভ্যাটিকান, জেরুজালেম, মক্কা। একি ভয়ংকর অবস্থা! প্রায় সর্বত্রই মারাত্মক সব অস্ত্রের মহড়া। ঘৃণা, বিদ্বেষ, অবিশ্বাস, অশান্তি আর হানাহানি! কি ভয়াবহ অস্থিরতা! আতঙ্কে হিম হয়ে গেলাম একেবারে। এরা তো আত্মঘাতী সম্প্রদায়!
ভবিষ্যৎ কি এদের? সময়টাকে সামান্য ফরওয়ার্ড করে নিলাম।
২০২০ সাল। গরম ছ্যাকা অনুভব করলাম। সর্বনাশ! একি করেছে এরা! সেই সুন্দর নদীটার এই দুরবস্থা! সেই সবুজ সুন্দরের অনেকটাই উধাও। এত অল্প সময়ে এত নির্মল প্রকৃতিকে একেবারে শেষ ফেলেছে দেখছি! নানা দূষণে জর্জরিত আর বিকট সব যন্ত্রের আওয়াজ। সেই কৃষক বধুটার কথা মনে পড়ে গেল; কি শান্ত সুন্দর মমতাভরা মুখখানা। কিছু একটা করতে হবে। রক্ষা করতে হবে এই সুন্দর গ্রহটাকে।
দ্রুত ফিরে এলাম আগের অবস্থানে। আগে এদের একজন জ্ঞানী লোকের সঙ্গে কথা বলতে চাই আমি। তেমন কাউকে খুঁজতে শুরু করলাম।
ততক্ষণে রাত্রি নেমেছে। একটা ঘরে আলো জ্বলছে। ঢুকে পড়লাম সেখানে। ঘর ভর্তি বই। একজন লোক খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছেন।
অধ্যয়নরত লোকটার মগজের সঙ্গে আমি টেলিপ্যাথিক সিঙ্ক করে নিলাম। লোকটা খুব একটা বিচলিত হল না। শুধু বলল, – আহ! কি হইল রে বাবা! ভুতে পাইল নাকি!
– না। ভয় পাবেন না। আমি কিছু তথ্য জানতে আপনার কাছে এসেছি।
– কিন্তু তোমারে তো আমি দেখতে পাচ্ছি না!
– দেখা দিচ্ছি না তাই। তবে আমি আপনাকে দেখতে পাচ্ছি।
– দেখতে পারছ! চোখ ছাড়াই?
– হ্যাঁ। আপনার মাথায় চুল কম। চোখে পুরু লেন্স। খুব বিস্মিত চেহারা। দেখুন স্যার, আমাদের চেয়ে অনেক বেশি বিস্ময়কর আপনারা। আপনার কোনও ক্ষতি করতে আসিনি আমি।
– হা হা হা! যার শরীরই নাই সে আর কি ক্ষতি করবে। কিন্তু আমি কি স্বপ্ন দেখছি!
সহজ হতে চেষ্টা করছেন তিনি। ওঁর কথা শুনে হেসে ফেললাম আমি। বললাম,
– যাকে আপনারা দেখতে পান না, সেই তো আপনাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে। তবে আমি সেরকম কিছু নই।
– মানে!
– ইবলিশের কথা বলছি। দেখতে পান তাকে?
লোকটা ভ্রু কুঁচকে ভাবতে থাকল। এবার আমি নিজের পরিচয়টা দিলাম;
– জনাব, আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সবই আছে। একেবারেই আপনাদের মতো একজন। শুধু আমরা প্রায় সব খানে চলাচল করতে পারি। আমি নিজের জগৎ ছেড়ে নিষিদ্ধ অঞ্চল ভেদ করে আপনাদের এলাকায় এসে পড়েছি।
– জ্বীন! নাকি এলিয়েন! ওয়ার্মহোল দিয়ে আইছ? তাইলে অদৃশ্য কেন!
– দেহ মিশে আছে শক্তিক্ষেত্রের সঙ্গে।
– শক্তি কণিকা হয়ে!
– ওয়েভ বা পারটিকেল যে ভাবেই ভাবুন, সে আছে। আর আমি ইচ্ছে করলেই তাকে নিজের আকৃতিতে পুনর্গঠন করে নিতে পারি।
– বুঝলাম, তোমরা বহুত এলেমদার! সময়কেও পরাজিত করতে পারছ!
অদ্ভুতদর্শন লোকটার মুখটা হা হয়ে গেল। এবার তাকে আসল ঘটনাটা বললাম। আমাদের আদিপিতার কাহিনি; যিনি শয়তানের প্ররোচনায় ভোলেননি। কোনও নিষিদ্ধ ফলও খাননি। তাই স্রষ্টা তাঁকে পুরষ্কৃত করলেন, বললেন, “তোমাদের একটি নিজস্ব জগৎ প্রদান করা হইল। তোমরা উহাতে আরোহণ করো। সেখানে শুধুই শান্তি। কোনও প্রকার কষ্ট তোমাদেরকে স্পর্শ করিবে না…”
– দুই আদম!
– হ্যাঁ। ভিন্ন স্থান-কালে। কেউ কাউকে দেখেনি।
– তোমরা নকল! মানে, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স?
– জ্বি হাঁ। আপনারাও তাই। আপনাদের অ্যাডাম যখন স্রষ্টার নির্দেশ অমান্য করে পৃথিবীতে এসে ক্ষুধার তাড়নায় পশুর পেছনে ছুটছে, আমাদের আদিপিতা তখন সঙ্গিনীকে নিয়ে ফুল বাগানে ঘুরছেন, ইচ্ছেমতো বেহেস্তের ফল-মূল খাচ্ছেন, আনন্দ ফুর্তি করছেন। সেখানকার সুখ শান্তির কথা আপনারা জানেন। আপনাদের কিতাবে আছে।
– হুম। বুঝতে পারলাম, আমাদের আংকেল মানে, তোমাদের অ্যাডামের কোন শাস্তি হয় নাই। স্বর্গেই আছো তোমরা। আর আমরা সব পাপী তাপী, এইতো?
– আপনাদের এই গ্রহ তো স্বর্গের চেয়েও সুন্দর! আপনাদের কাব্য, সাহিত্য, ভালোবাসা আমাকে দারুণভাবে স্পর্শ করেছে। অথচ আপনারা নিজেরাই সব ধ্বংস করতে যাচ্ছেন কেন!
এবার অদ্ভুত মানুষটি সুর করে গেয়ে উঠলেন;
‘হাকিম হইয়া হুকুম করো, পুলিশ হইয়া ধরো-
সর্প হইয়া দংশন করো ওঝা হইয়া ঝাড়ো… ’
এ সময় দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ হল। বাইরে কর্কশ নারী কণ্ঠ, ‘এত রাইতে কোন মাইয়ার লগে রঙ্গতামশা করো!’
সন্ত্রস্ত হয়ে দরজাটা খুলে দিলেন লোকটা। এক মহিলা ঢুকে কটমট চোখে তাকালেন চারদিকে। ‘হুহ! আকাম্মা পন্ডিত!’ বলে বিরক্ত মুখে চলে গেলেন তিনি।
‘উনি কে? রাগ করলেন কেন!’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
– সে আমার বউ। এসব বুঝবানা তুমি। তোমাদের স্বর্গে তো হুর পরীর অভাব নাই। তাই সন্দেহও নাই। মৃত্যু নেই, জরা নেই। কোনও গবেষণা নেই, আবিষ্কারও নেই।
– হ্যাঁ। তার কোনও প্রয়োজনও নেই আমাদের। তবে একটা জিনিস লক্ষ করেছি,
এখানকার মাঠে এক কৃষকের স্ত্রী; কি শান্ত! সুন্দর…
– অ্যাঁ, আসলে কে তুমি, কও তো! কি নাম তোমার? হারুত মারুত না তো!
এবার হাসি পেল আমার। প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম,
– আপনাদের দেখছি, খাদ্য-বস্ত্র-বাসস্থানের জন্য প্রাণান্ত পরিশ্রম করে যেতে হচ্ছে। এর পরও আপনাদের ভবিষ্যৎ অতি ভয়ঙ্কর… আপনি জানেন না, আপনাদের অতিরিক্ত লোভ এই পৃথিবীর কি হাল করতে যাচ্ছে…
– বুঝলাম। কিন্তু তুমি এত কিছু জানলে কীভাবে?
– কিছুটা নিজ চোখে দেখে এসেছি। তা ছাড়া আপনার এখানে বইপত্রগুলোও সব পড়ে নিয়েছি ইতিমধ্যে।
– কও কি! এত বই পইড়া ফালাইলা! তুমি তো এক ঘণ্টায় আইনস্টাইন বইনা গেছ হে!
কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ।
এবার আমি আমার ইচ্ছার কথা তাঁকে জানালাম।
– শুনুন, আপনাদের অবস্থা সত্যিই সংকটাপন্ন। আমি বোধহয় ফিরিয়ে আনতে পারি এখানকার প্রকৃতির ভারসাম্য, আপনাদের জন্য শান্তি…
– খাইছে! আবার মহাপুরুষ আইলো নাকি! নাকি স্বয়ং অবতারের?
– জানি না। তবে শয়তানের প্ররোচনায় আপনারা লোভ লালসার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। এই সুন্দর গ্রহটাকে একেবারে শেষ করে ফেলছেন। স্বাভাবিক কেউ নিজের বাসস্থানকে এভাবে ধ্বংস করে! না না, এ হতে দেওয়া যায় না। তিনিই হয়তো আমাকে মনোনিত করে পাঠিয়েছেন।
– হা হা হা! মর্তে আবার মহাপুরুষের আবির্ভাব! নাকি, এলিয়েনদের ক্ষমতা দখলের পাঁয়তারা!
আমি তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ‘দেখুন, আমি স্বেচ্ছায় এখানে আসিনি। হয়তো তিনি আপনাদেরকে রক্ষা করতে চান, শয়তানের কুমন্ত্রণা থেকে। তাই আমাকে পাঠিয়েছেন। তিনি হয়তো সুন্দর গ্রহটাকে বাঁচাতে চান। আপনাদের ভার লাঘব করতে চান। আমার কোনও লোভ নেই, চাওয়া পাওয়ারও কোন আকাঙ্ক্ষা নেই। আশা করি বুঝতে পারছেন।’
লোকটা যথেষ্ট বুদ্ধিমান। সে বলল, ‘তা বুঝলাম। তয়, নতুন কোনও মতবাদ চাপানোর চেষ্টা কইরো না যেন। এমনিতেই নানা দর্শন আর মতবাদে আমরা জর্জরিত। হাজারো মতে বিভক্ত পৃথিবীর মানুষ। তুমি যদি দেহ ধারণ কইরা এসব কইতে আসো, তাইলে কপালে দুর্ভোগ নাইমা আইতে পারে তোমারও। ’
চমকে উঠলাম আমি।
– হ্যাঁ, তাই তো! যখনই এখানে কোনও সংস্কারক পাঠানো হয়েছে, তাদেরকে এরা অবিশ্বাস করেছে, অথবা হত্যা করেছে। আপনাদের গ্রন্থেই তো পড়েছি।
– দেখ ভাই, তুমি অবতার বা অতিমানব যাই হও, এখানে আইয়া ভালো থাকতে পারবা না। শয়তানের পাল্লায় পরতেই হবে। ‘এ বিশ্ব পাপস্থান- অর্ধেক এর ভগবান আর অর্ধেক শয়তান!’
– সে বুঝেছি।
– কিচ্ছু বোঝ নাই! তোমাদের তো আর কাব্য সাহিত্য নাই। শয়তানও নাই ঘাড়ে।
কিছুটা বিদ্রুপের সুরে বললেন তিনি।
এবার কিছুটা অপূর্ণই মনে হল নিজেকে। কিছুক্ষণ কোনও কথাই বলতে পারলাম না। শুধু ভাবছি, কীভাবে এই গ্রহটির নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিব। আর ক্ষমতার সঙ্গে বিচিত্র এই পার্থিব ভালোবাসা উপভোগ করব।
হঠাৎ তিনি বললেন,
– তোমাদের রোগ-শোক, মৃত্যু-জরা নেই। কোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ নেই। ঝড় জলোচ্ছ্বাস ধ্বংস নেই। কোনও দুঃখ-কষ্ট নেই। সৃজনশীলতাও নেই।
– জ্বি হ্যাঁ। স্বর্গবাসীদের মগজে ওসব প্রোগ্রামিং দেওয়াই হয়নি। আমি আপনাদের সমস্ত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেব। আপনি আমায় সাহায্য করুন।
বিকট শব্দ করে হেসে উঠল মর্তের প্রাণী। বলল, ‘তুমি জান না, কেন তোমাকে এই শয়তানের রাজত্বে পাঠানো হয়েছে! শোনো স্বর্গের জীব, তোমাদেরও সময় শেষ। লোভ! লোভে পাইছে তোমার। ক্ষমতা আর পার্থিব লোভ লালসা! ঠিক এই মুহূর্তে একটা কালোছায়া দেখতে পাচ্ছি আমি। শিঙঅলা! মানে, ইবলিশ ভর করছে তোমার উপরও!’
‘না… এ হতে পারে না!’ আর্তনাদ করে উঠলাম আমি।
– এইডা ঠিক যে, তোমার কোনও দোষ নেই। কেউ তোমাকে পাঠাইছে এই শয়তানের রাজত্বে। এ সব তাঁরই কেরামতি। তোমাদের স্বর্গেরও পতন আসন্ন। হয়তো এই ভাঙ্গা-গড়ার খেলাতেই তাঁর আনন্দ।
– এবার সব কিছু পরিষ্কার বুঝতে পারলাম আমি। ভয়ে শিহরে উঠলাম! আর তখনই আবার ছুটতে শুরু করলাম। অনিচ্ছা সত্বেও। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের দিকে।
ফিরে চললাম। নিজেদের জগতে। ঘাড়ে নতুন সঙ্গী!
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, শাহরিয়ার আহমেদ, সুপ্রিয় দাস