ভুল
লেখক: ঋজু গাঙ্গুলী
শিল্পী: ধ্রবজ্যোতি দাস
ডক্টর ধৃতিমানের কোয়ার্টারের সামনে দাঁড়িয়ে রয়ের একটু নার্ভাসই লাগছিল।
ইউনিভার্সিটি ছাড়ার পর থেকে ধৃতিমানের, বা ওঁর কাজের সঙ্গে রয়ের সরাসরি কোনো যোগাযোগ ছিল না।
একদা প্রিয় ছাত্র যে গবেষণা বা শিক্ষকতা বা নিদেনপক্ষে মহাকাশবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন মেগা-কর্পোরেশনের চাকরি না করে সাংবাদিকতা করছে, এটা ধৃতিমান কোনোমতেই মেনে নিতে পারেন নি। তাই চাকরি পাওয়ার খবরটা ওঁকে দিতেই রয় শেষবারের মতো এই ক্যাম্পাসে এসেছিল। আর তারপর, আজকে।
কলিং বেলটা টিপতে হল না। রয়ের বায়োমেট্রিক ডেটা এই বাড়ির নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সুরক্ষিত আছে। ধৃতিমান তাকে নিয়ে হতাশ বা বিরক্ত হলেও সেই ডেটা যে উড়িয়ে দেননি সেটা রয় বুঝল, যখন দরজার বাইরে পাপোষটায় ও দাঁড়ানো মাত্র দরজার লকটায় সবুজ আলো জ্বলে উঠল, এবং দরজাটা খুলে গেল।
“আসুন মিস্টার রয়”, খ্যানখেনে গলায় রয়কে স্বাগত জানাল ডক্টর ধৃতিমানের রোবো পরিচারক কিউ।
কিউ-এর সঙ্গে অনেকদিন পর দেখা হয়ে ভালো লাগলেও সেটা রয় প্রকাশ করতে পারছিল না, কারণ এর পরের ঘন্টাখানেক কেমন কাটবে, তাই নিয়ে ওর চিন্তা ছিল।
ওর আশংকাটাই সত্যি হল।
কিউ ওকে দস্তুরমতো এসকর্ট করে ধৃতিমানের রিডিং রুমে পৌঁছে দিয়ে সসম্ভ্রমে দরজাটা বন্ধ করে চলে যাওয়ার পর ঘরে একটা অস্বস্তিকর নীরবতা জমে উঠল।
তারপর, ডক্টর ধৃতিমান ভ্রূ কুঁচকে বলে উঠলেন, “আগে থেকে অ্যাপয়েন্টমেন্ট না নিলে আমি সাক্ষাৎকার দিই না, সেটা কি তোমার জানা নেই?”
দিকপাল বিজ্ঞানীর বিরক্ত চোখের সামনে দাঁড়ালে যেকোনো ছাত্র গুটিয়ে যেতে বাধ্য, কিন্তু রয়ের ক্ষেত্রে প্রতিক্রিয়াটা উল্টো হল। ও গলার স্বরটা নম্র অথচ শক্ত রেখে উত্তর দিল,
“আমি আপনার সাক্ষাৎকার নিতে আসিনি প্রফেসর। আমি আপনাকে একটা গল্প শোনাতে এসেছি”।
ধৃতিমান এই উত্তরটা আশা করেননি। ওনার চোখ আর মুখই বলে দিচ্ছিল, বিরক্ত এবং ক্রুদ্ধ হলেও মনে জমতে থাকা বিস্ময়টাকে চাপা দিতে পারছেন না উনি।
“গল্প?”
“হ্যাঁ”, শান্ত গলায় বলে রয়, “যেটা শোনার জন্যে আপনি বেশ কিছুদিন ধরে অপেক্ষা করে আছেন”।
ধৃতিমান যে যারপরনাই বিরক্ত এবং বিস্মিত হচ্ছেন, সেটা বোঝাই যাচ্ছিল। কিন্তু রয়ের আপাত ঢিলেঢালা বাইরেটা, আর নরম গলার মধ্যে থাকা ইস্পাতটার অস্তিত্ব উনি টের পেলেন, এবং বললেন,
“বলো। এই মুহূর্তে আমার তেমন কোন কাজ নেই, তাই সময়টা তোমার গালগল্প শুনেই নষ্ট করি”।
মনে-মনে কথাগুলো গুছিয়ে নেয় রয়।
“এই গল্প এমন এক বিজ্ঞানীর, যিনি সময় যাত্রার পদ্ধতিটা আবিষ্কার করেছিলেন, কিন্তু সেটা তিনি ঘোষণা করার আগেই সময়-ভ্রমণ বেআইনি হয়ে যায়”, প্রায় চোখ বুজে কথাগুলো বলে রয়।
ও জানত, ধৃতিমানের চোখের দিকে তাকিয়ে এই গল্পটা বলতে গেলে গোলমাল হয়ে যাবে।
“এর ফলে বিজ্ঞানী এক মারাত্মক সংকটে পড়েন।এই গবেষণা করার জন্যে তিনি সরকার, বিশ্ববিদ্যালয়, এমনকি কোন কোম্পানির থেকে আর্থিক সাহায্য পাননি। এটাই বলা ভালো যে গবেষণার শেষে তাঁর আবিষ্কার যাতে স্রেফ তাঁরই থাকে সেটা নিশ্চিত করার জন্যে তিনি সেটা কারও হাতে তুলে দিতে চাননি। কিন্তু এখন, জিনিসটা নিষিদ্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে তাঁর কাছে এই গবেষণার ব্যবসায়িক প্রয়োগের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়।
আর এই সময়েই তিনি জানতে পারেন যে তাঁর মেয়ের এমন এক অসুখ হয়েছে, যেটার চিকিৎসা প্রচুর ব্যয়সাপেক্ষ, এবং ওই মুহূর্তে তাঁর পক্ষে সেই পরিমাণ অর্থের ব্যবস্থা করা অসম্ভব”।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে রয় নিজের গলাটা থেকে আবেগ সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে, তারপর তার ‘গল্প’ জারি রাখে।
“আত্মসম্মানবোধ ব্যাপারটা সেই বিজ্ঞানীর বরাবরই খুব প্রখর ছিল। তাই নিজের এই একান্ত ব্যক্তিগত সংকটে তিনি কারও কাছে হাত পাততে চাননি। বিভিন্ন কর্পোরেশন, যারা বহুমাত্রিক স্থান-কাল নিয়ে তাঁর নানা আবিষ্কারের পেটেন্ট কিনে নেওয়ার জন্যে মুখিয়ে ছিল, তাদের হাতেও তিনি সেই গবেষণা তুলে দিতে চাননি, কারণ তিনি জানতেন, ওগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটা আবিষ্কার সেই সব সংস্থার লাভ-সর্বস্ব শেয়ারহোল্ডারদের হাতে মারণাস্ত্রের রূপ নেবে।
তার বদলে, তিনি একটা সহজ অথচ অনৈতিক কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি ঠিক করেন, প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে ধর্মোন্মাদ জনতার আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যাওয়া এক জনগোষ্ঠীর শিল্প-কীর্তির একটি নমুনা তিনি নিয়ে আসবেন অতীত থেকে, আর সেটি বেচে দেবেন এক কালেক্টরকে। তারপর, সেই অর্থে, তিনি তাঁর মেয়ের চিকিৎসা করাবেন”।
রয় দেখে, ধৃতিমান দু’হাত দিয়ে শক্তভাবে চেয়ারের হাতলদুটো চেপে ধরেছেন। তাঁর কপালে জমে উঠেছে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। মনে-মনে নিজেকে প্রস্তুত করে ও অবধারিত প্রশ্নটার জন্যে।
“কোনো প্রমাণ আছে তোমার কাছে?” হিসহিসিয়ে বলে ওঠেন ধৃতিমান।
“আছে প্রফেসর,” নরম গলায় বলে রয়, “স্প্যানিশ গায়ানা-র ওপরে স্ট্রাটোস্ফিয়ারের উচ্চতায় একটা অবজার্ভেশন টাওয়ার আপনার গবেষণার প্রয়োজনে পর্যবেক্ষণলব্ধ তথ্য সংগ্রহ করার জন্যেই বসানো আছে, এটা সবাই জানে। সেখানে যে বহুমাত্রিক টপোলজি নিয়ে ব্যবহারিক গবেষণার জন্যে আপনি একটা গোপন গবেষণাগার স্থাপন করেছেন বছর পাঁচেক আগেই, সেটা আমি জানতাম। সেখানে…”
রয়কে থামিয়ে দিয়ে বলে ওঠেন ধৃতিমান, “কীভাবে জানতে?”
“সেটা আমি বলব না, তবে আপনি আন্দাজ করতে পারেন”, শক্ত গলায় বলে ওঠে রয়, “ঠিক যেমন আপনি আন্দাজ করে নিতে পারেন, কেন আমি আপনার অধীনে গবেষণা না করে এই পেশায় এসেছিলাম”।
উত্তর দেন না ধৃতিমান, চোখ বন্ধ করে বসে থাকেন।
ঘরের নীরবতাটা বাড়তে থাকে। তারপর রয় আবার মুখ খোলে।
“আপনার ওই ল্যাবে ট্যাকিয়ন, মানে আলোর চেয়ে দ্রুতগামী কণার উপস্থিতি স্বাভাবিকের চেয়ে প্রায় একশো গুণ বেশি বলে ব্যাপারটা পরিবেশের ওপর নজর রাখা একটা রোবো ফিডের নজরে পড়েছিল। সাংবাদিকদের কাজের অনেকটাই সেই পুরনো ‘যেখানে দেখিবে ছাই’
কথার সঙ্গে মেলে। এই বিশেষ তথ্যটা আমাদের সায়েন্স সেকশনে আর পাঁচটা তথ্যের মতোই ফাইল হয়ে যেত, যদিনা ওটা আমার নজরে পড়ত।
স্থান আমার চেনা, কাল… ওয়েল, আপনি কেন সেই সময় সময়-ভ্রমণ নিয়ে গবেষণায় মেতেছিলেন সেটা আমি জানতাম, আর পাত্রকেও আমি বিলক্ষণ চিনতাম।
তাই আর কেউ বোঝার আগেই আমি বুঝতে পারি, আপনি অবশেষে কালযাত্রী হয়ে উঠেছেন।
তবে রুচিরার ব্যাপারটা আমি তখনও জানতাম না”।
“আমার গল্প আমাকে শোনাচ্ছ কেন রয়?”, ক্লান্ত স্বরে বলেন ধৃতিমান, “তুমি কি প্রমাণ করতে চাইছ যে তুমি এমনই এক দক্ষ সাংবাদিক, যে তার প্রাক্তন অধ্যাপকের দুর্বল অবস্থায় তাঁকে তাঁর ব্যর্থতার নিখুঁত বিবরণ শোনাতে চায়?”
“না প্রফেসর”, বলে রয়, “আমি গল্পটা আগে শেষ করি?”
“করো”, মৃদু হেসে বলেন ধৃতিমান, “তাহলে নামধাম না নিয়েই বলো। ভাবব, এটা অন্য কারও গল্প। আর আশা করব, এই গল্পটার শেষটা অন্য রকম হবে”।
একটা বড়ো শ্বাস নেয় রয়। ঘড়িটা একবার দেখে নেয় ও, তারপর, এখনও হাতে বেশ কিছুটা সময় আছে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে ও গল্পটার খেই ধরে আবার।
“বিজ্ঞানী ঠিক কীভাবে সময়-ভ্রমণ করেছিলেন তা আমি জানিনা, তবে পুরনো জ্ঞান থেকে মনে হয়, তিনি নিজে কোথাও যাননি। বরং, স্থান-কাল ফেব্রিকের ভাঁজ কাজে লাগিয়ে উনি একটাই জায়গায় পাঁচ হাজার বছর আগের সময়ের কাছে বর্তমান সময়কে নিয়ে গেছিলেন, যার ফলে সেই সময়ের বেশ কিছু জিনিস চলে এসেছিল এই সময়ে।
আর তাদের মধ্যেই ছিল ওঁর বাছাই করা সেই শিল্পকীর্তিটা, যেটা তিনি কালেক্টরটির কাছে বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
এমনিতে কোন গণ্ডগোল হয়নি। দুটো সময়ের মধ্যে টানেলটা একেবারে ঠিকঠাক সময়ে খুলে যায়। শিল্পকীর্তি হস্তগত করে তিনি ফিরে আসেন নিজের জায়গায়।
কিন্তু ওনার হিসেবে যে একটা ভুল ছিল, সেটা উনি বোঝেন এর পরেই।
“মেসো-আমেরিকান কনফেডারেশনের যে বিশেষ জায়গা থেকে উনি ওই শিল্পকীর্তি তথা অন্যান্য কিছু আর্টিফ্যাক্ট সংগ্রহ করেছিলেন, সেটা পাঁচ হাজার বছর আগে গভীর জঙ্গলের মধ্যে এক ভুলে-যাওয়া উপজাতিদের শহর হলেও আজ কোবাল্টের বিশাল খনি।
সেই খনিতে নিরাপত্তার খাতিরে লাগানো ক্যামেরায় যে বিজ্ঞানীর এই ‘অ্যাডভেঞ্চার’ ধরা পড়ে গেছে, সেটা তিনি জানতেন না। ব্যাপারটা প্রথমে আবিষ্কার করে একজন টেকনিশিয়ান।
সে ব্যাপারটার প্রতি কয়েকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সবাই এটা ধরে নেয় যে কোন যান্ত্রিক ত্রুটির ফলে একটা ন্যাড়া জায়গায় হঠাৎ করে সবুজ বন, জ্বলন্ত শহর, কিছু ইতস্তত বিক্ষিপ্ত দেহ; এসবের ফটো ফুটে উঠেছে।
ব্যতিক্রম ছিল কোম্পানির মালিক আলবের্তো, যে আবার একসময় সেই বিজ্ঞানীর ছাত্রও ছিল।
ফুটেজের মধ্যে দৃশ্যমান কিছু ঝাপসা চেহারার মধ্যে সে বিজ্ঞানীকে, সেই শিল্পকীর্তি হাতে, খুঁজে পায়। বিজ্ঞানীর গবেষণা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল থাকায় সে ব্যাপারটার আসল অর্থ বুঝে ফেলে।
তাই কোয়ার্টারে ফিরে আসার পর বিজ্ঞানী দেখেন যে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে সেই লোকটি। ফুটেজের সুবাদে তার হাতে এখন বিজ্ঞানীর দু-দুটো অপরাধ প্রমাণ করার মতো মালমশলা এসে গেছে। প্রথমত, চুরি; দ্বিতীয়ত, এবং অনেক বেশি গুরুতর অপরাধ, সময়-ভ্রমণ”।
চুপ করে যায় রয়। জানলা দিয়ে ক্যাম্পাসের নিজস্ব শব্দগুলো ভেসে আসে। দূরে হোভার-কারের আওয়াজ, পাখির ডাক, ছেলেমেয়েদের গলার কলকাকলি, লন আর মাঠে জল ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যে স্প্রিংকলারের উঠে আসা আর নেমে যাওয়া: এই শব্দগুলো শুনতে-শুনতে জীবনের ফেলে আসা সবুজ দিনগুলোর জন্যে একটা অন্য রকমের মন খারাপ হয় ওর।
তারপরেই ওর নজর পড়ে সামনের চেয়ারে ধ্বংসস্তূপের মতো বসে থাকা এই সময়ের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানীর প্রতি।
নিজেকে ঝাঁকিয়ে আবার ন্যারেটিভে ফিরে যায় রয়।
“সেই কথোপকথনের ফল একটাই হতে পারত, এবং সেটাই হয়।
আলবের্তোর ব্ল্যাকমেলের শিকার হয়ে বিজ্ঞানী তাঁর সময়-ভ্রমণের যন্ত্রকে এক জঘন্য অপরাধে ব্যবহৃত হতে দিতে বাধ্য হন। প্রযুক্তিটা পুরোপুরি তার হাতে তিনি তুলে দেননি এই যুক্তি দেখিয়ে, যে এর প্রত্যেক ব্যবহারে স্থান-কাল ফেব্রিকে এমন টানাপোড়েন চলবে, যে তিনি ছাড়া কেউই শেষরক্ষা করতে পারবে না। যেহেতু অসীম মাত্রার টপোলজিতে সেই বিজ্ঞানীর চেয়ে বেশি জ্ঞানী এবং দক্ষ মানুষ পৃথিবীতে আর কেউ নেই, তাই লোকটা সেটা মানতে বাধ্য হয়।
আলবের্তো এটাও জানত যে বিজ্ঞানী নিজে এই বেআইনি কাজটা যতবার করবেন, তত বেশি করে তিনি ফেঁসে যাবেন, এবং ভবিষ্যতে তাঁর বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর মতো আরও উপকরণ জমা হবে”।
এবার নড়ে ওঠেন ধৃতিমান। তাঁর তিক্ত কণ্ঠটা আবার শোনা যায় ঘরে।
“এরও কি প্রমাণ যোগাড় করেছ তুমি?”
“হ্যাঁ”, দৃঢ় স্বরে বলে রয়, “আলবের্তো আপনার সঙ্গে তার কথাবার্তার ভয়েস-রেকর্ডিং নিজের কাছে রেখেছিল, পরে আপনাকে আরও গুছিয়ে তার জালে জড়াবে বলে। সেটার কপি আমার কাছে আছে। সঙ্গে আছে আপনার সঙ্গে তার দেখা করতে আসার রেকর্ড, এবং তার পরে আপনার গতিবিধির রেকর্ড”।
“তুমি কি আমাকে পুলিশের হাতে তুলে দিতে চাও?” ধৃতিমানের গলাটা ভাঙা শোনায়, “যদি সেটাই করতে হয় তাহলে আমাকে এসব কথা আর না শুনিয়ে বরং পুলিশকে চটপট খবর দাও”।
“না প্রফেসর”, শান্ত গলায় বলে রয়, “আপনাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার কোন ইচ্ছে নেই আমার। আর সেটা করে কোন লাভ হত না, কারণ গত ক’দিন ধরে আপনি অনুশোচনায় দগ্ধ হয়েছেন এই নিয়ে।
তবে আপনার এই ছলে-বলে-কৌশলে কার্যসিদ্ধির মানসিকতাটা আপনার প্রতিভার সঙ্গে যোগ দিয়ে আপনাকে এই যুগের সেরা আবিষ্কারক বানালেও, সেটা যে কতটা সর্বনাশা সেটা নিশ্চই এই ক’দিনে বুঝতে পেরেছেন”।
“বড়ো বড়ো কথা বলা সহজ রয়”, ভাঙা গলায় বলেন ধৃতিমান, “তুমি আমার জায়গায় থাকলে…”
“আমি আপনার জায়গায় থাকলে সেই মানুষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করতাম” ধৃতিমানকে বাধা দিয়ে জোর গলায় বলে ওঠে রয়, “যারা আপনাকে শ্রদ্ধা করে, ভালোবাসে, আপনার থেকে অনেক দূরের মানুষ হয়েও আপনার পাশে দাঁড়াতে চায়।
আর অবশ্যই যোগাযোগ করতাম সেই লোকটির সঙ্গে, যার হৃদয়ে রুচিরার নাম লেখা হয়ে রয়েছে আজ এতগুলো বছর ধরে”। শেষের কথাগুলো শান্তভাবে বললেও ওর ভেতরে জমে ওঠা রাগ আর অভিমানটা পুরোপুরি চেপে রাখতে পারেনা রয়।
সেটা ধৃতিমানও উপলব্ধি করেন।
“আলবের্তো আমাকে বলেছিল, ও এমন কয়েকটা জিনিস পাঁচ হাজার বছর আগের পৃথিবীতে রেখে আসতে চায়, যাতে প্রমাণ হবে যে ওর পূর্বপুরুষেরা অন্তত পাঁচ হাজার বছর আগে এই দেশে এসেছিলেন।”, খুব নিচু সুরে বলতে থাকেন ধৃতিমান। “বংশ-গৌরব নিয়ে মানুষের অস্বাস্থ্যকর মাতামাতি নতুন নয়, আর আলবের্তোর মধ্যে এটা আমি আগেও দেখেছি, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ওকে ছাত্র হিসেবে পাওয়ার দুর্ভাগ্য আমার হয়েছিল”।
ধৃতিমানের গলায়, একটু-একটু করে পুরনো ধার ও ভার ফিরে আসছিল।
“মানুষ আর প্রকৃতির লুণ্ঠন করে বড়োলোক হওয়ার রেওয়াজটা পাঁচ হাজার বছর আগে এদেশে আসা স্প্যানিয়ার্ডদের অনেকের মধ্যে থাকলেও আলবের্তোর পরিবারের কোন অস্তিত্বই তখন ছিল না, এবং থাকতে পারে না। আদিতে যে ওদের পরিবার মুলাটো, মানে বর্ণ-সংকর ছিল, সেটা সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফে সব ছাত্রের জেনেটিক প্রোফাইল বানানোর আদ্যন্ত বে-আইনি পরীক্ষাতেই ধরা পড়েছিল। আলবের্তো নিজেও সেটা জানত।তাই ও ওর কুচুটে বুদ্ধি দিয়ে একটা প্ল্যান করেছিল। ও পাঁচ হাজার বছর আগের সেই মেসো-আমেরিকায় ওর বংশের প্রতীকের একটা অমার্জিত-অথচ-চেনা যায় এমন নিদর্শন ছড়িয়ে রাখতে চেয়েছিল।
এতে একে তো এদেশে আসা প্রথম স্প্যানিয়ার্ডদের মধ্যে ওদের পরিবার অন্যতম বলে গণ্য হবে। এছাড়া, এই জায়গাটার মানুষ ও প্রকৃতিকে অবাধে শোষণ করার মতো একটা লাইসেন্সও ওর হাতে এসে যাবে স্রেফ এখানকার জঘন্য ভূসম্পদ আইনের সুবাদে, যেটা পুরোপুরি বহিরাগত লুঠেরাদের কথা ভেবে বানানো”।
“এটা বাস্তবায়িত হলে শুধু যে স্থানীয় মানুষ ও প্রকৃতির সঙ্গে নয়, মানব সভ্যতার ইতিহাসের সঙ্গেই বেইমানি করা হবে, এই ভাবনাটা আপনাকে কষ্ট দেয়নি?”, প্রশ্ন করা থেকে নিজেকে আটকাতে পারেনা রয়।
“দিয়েছিল রয়”, ক্লান্ত স্বরে বলেন ধৃতিমান, “কিন্তু তখন হাতি কাদায় পড়েছে। আমি কী করতে পারতাম বল? প্রতিবাদ করলে জেলে যাওয়া অবধারিত ছিল। আর সেটা ঠেকাতে চাইলে গোটা পদ্ধতিটাই সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিতে হত, যার পরিণাম হত মারাত্মক। তাই বাধ্য হয়ে আমাকে রাজি হতে হল।
আমি শুধু একটা ব্যাপারে ওকে রাজি করাতে পেরেছিলাম, যেটা ওর ভাড়া করা ‘বিশেষজ্ঞরাও’ ওকে নির্ঘাৎ বুঝিয়েছিল। পোড়ামাটির ওই জিনিসগুলো আমি ওকে, রীতিমতো কারিগর ডাকিয়ে, আমার ল্যাবরেটরির যে লুপ-হোলটা দিয়ে অতীতের সঙ্গে বর্তমানের যোগসূত্র হিসেবে টানেলটা খোলে, তার ওপরেই বানাতে বলেছিলাম।
যুক্তি হিসেবে বলেছিলাম, সম্পূর্ণ অন্য জায়গায় বানানো জিনিস নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে টানেল সেটাকে ‘ফরেন অবজেক্ট’ হিসেবে রিজেক্ট করবে। একমাত্র ওই লুপ-হোল দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে দুই সময়ের মধ্যে যাতায়াত করা মহাজাগতিক রশ্মি, আর প্রকৃতির নিজস্ব খেয়ালে কিছু-কিছু জিনিস ওই টানেল রিজেক্ট করবে না। আমি নিজে, প্রায় পাঁচ বছর ধরে ওই টানেলের সঙ্গে জড়িত বলেই একবার অতীতে, এবং পর মুহূর্তেই বর্তমানে যেতে পেরেছিলাম।
সেটাই হল। আলবের্তো আমাকে দিয়েই মেসো-আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় জিনিসগুলো এমনভাবে ছড়ানোর ব্যবস্থা করল যাতে ওই কৃত্রিম আর্টিফ্যাক্টগুলো প্রাকৃতিক উপায়ে নষ্ট না হয়ে বরং লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে যায়, যতদিন না প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে সেগুলো বাইরে আসে। তার চেয়েও বড়ো কথা, আমার নিয়ে আসা শিল্প-কীর্তিটাও ও এই বলে বাজেয়াপ্ত করল, যে ওটা ওর খনি-এলাকার মধ্য থেকে আমি নাকি, না-বলে, নিয়েছি।
রুচিরার চিকিৎসার জন্যে কিছু টাকা অবশ্য ও দিতে চেয়েছিল, কিন্তু ততক্ষণে আমি আমার ভুলটা বুঝতে পেরেছি।
হ্যাঁ, রয়।
আজ থেকে পাঁচ বছর আগে দুর্ঘটনায় আমার স্ত্রীর মৃত্যুর পর থেকে আমি মনে-মনে রুচিরাকে দোষ দিয়ে এসেছি, কারণ সেই মুহূর্তে স্টিয়ারিং ছিল ওর হাতে, আর ব্রেকের বদলে অ্যাক্সিলারেটরে চাপ দিয়ে হোভার-কারকে ট্যাংকারের সামনে ফেলে দেওয়ার জন্য দায়ী ছিল ওর অন্যমনস্ক স্বভাব। কিন্তু এটা আমি ঠিক করিনি।
নিজে থেকেই মরমে মরে থাকা একটা মেয়েকে এই শাস্তি দেওয়া, আমার বিরাট ভুল ছিল।
তোমার প্রতি ওর দুর্বলতা বাড়ছে, আর তুমিও ওর প্রতি দুর্বল হচ্ছ এটা বুঝে, তোমার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করতে, রুচিরাকে হস্টেলে পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল।
তুমি আমার ওপর রাগে আর অভিমানে গবেষণা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছ এটা বুঝেও নিজের ভুল স্বীকার করতে না পারা, আমার ভুল ছিল।
কিন্তু রয়, মেয়েকে বাঁচানোর জন্যে আমার করা আর একটা ভুল আচরণের মাশুল এই অঞ্চলের মানুষ ও প্রকৃতি দিক, সেটা আমি চাইনি”।
চুপ করে যান ধৃতিমান।
“টাকাটা আপনি নিয়েছিলেন?” প্রশ্ন করে রয়।
“নিয়েছিলাম”, হতাশ স্বরে বলেন ধৃতিমান, “কিন্তু কেন জানি না, মেয়ের চিকিৎসায় সেই টাকাটা ব্যবহার করতে পারিনি। টাকাটা স্প্যানিয়ার্ডদের আক্রমণে নিহত স্থানীয় মানুষদের স্মৃতি-রক্ষার্থে গড়ে ওঠা মিউজিয়ামে দিয়ে দিয়েছিলাম।
গতকাল রুচিরাকে দেখতে গেছিলাম।
এসবের বিন্দুমাত্রও ওর জানার কথা নয়। কিন্তু তবু, ওর চোখে যেটা নিত্য দেখি সেই অভিমান নয়, বরং একটা গভীর দুঃখ দেখেছিলাম।
ওর চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য যতদিন থাকবে, ততদিন করব, কিন্তু ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর মতো মনের জোরটা খুঁজে পাচ্ছিনা আমি”।
(২)
ইতিমধ্যে কিউ কয়েকবার দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছিল, সচরাচর কোন অতিথি এসে বসলেই যে জিনিসের জন্যে ফরমায়েশ হয়, সেই চা আর জলখাবারের জন্য এখনও কোন আদেশ দেওয়া হল না কেন। কিন্তু থমথমে মুখে দু’জনকে বসে থাকতে দেখে ওর রোবো মস্তিষ্কও বুঝতে পেরেছিল যে পরিবেশটা ঠিক স্বাভাবিক নয়।
তবে এবার কিউ দরজা দিয়ে আর উঁকি দিল না, বরং সেটা একেবারে হাট করে সেখানে দাঁড়াল।
ধৃতিমান সেটা খেয়াল করলেন না, বরং ক্লান্ত স্বরে বললেন, “তোমার ‘গল্প’-টা তাহলে অন্য রকম কিছু হল না, তাইতো রয়? আমার আরও একটা ভুল দিয়েই সেটা শেষ হল এই গল্পটাও”।
রয় উঠে দাঁড়ায়। কিউ-এর দাঁড়ানোর ভঙ্গি থেকে ও বুঝতে পেরেছিল, সময় হয়ে গেছে।
“আমার গল্পটা শেষ হয়নি প্রফেসর”, ও বলে, “আরেকজন শ্রোতার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম আমি। এবার তিনি এসে গেছেন”।
চমকে ওঠেন ধৃতিমান, “আরেকজন শ্রোতা?”, সবিস্ময়ে বলেন তিনি, “কে? কে এসেছে?”
ধৃতিমানর ল্যাবে কাজ করা দু’জন ছাত্রের সাহায্য নিয়ে ঘরে ঢোকে রুচিরা।
ওর ক্লান্ত, এবং অসুস্থতার আক্রমণে অনেকটাই ক্ষয়ে যাওয়া শরীরের দুর্বলতা কিন্তু ঢেকে দিচ্ছিল একজোড়া বুদ্ধিদীপ্ত চোখের ঔজ্জ্বল্য।
“হ্যাঁ বাবা, গল্পের শেষটা কালকে তুমি অমন করে পালিয়ে না এলে আমি তোমাকেই জিজ্ঞেস করতাম, সব রাগ-অভিমান ভুলেই। কিন্তু এখন আমার প্রতিনিধি এখানে রয়েছে, তাই আমি তাকেই সব দায়িত্ব দিলাম”, সোফায় গুছিয়ে বসা রুচিরার গলার ছেলেমানুষির তলায় বয়ে যাওয়া ক্লান্তির চোরাস্রোতটাকে উপেক্ষা করে ধৃতিমান ওর আঙুল অনুসরণ করে রয়ের দিকে তাকান।
“তাহলে গল্পটা আমি বলতে থাকি?”
“কিন্তু”, ধৃতিমানের গলায় বিস্ময়টা অন্য সব ভাবনাকে ছাপিয়ে ফুটে ওঠে, “তোর তো এখন নার্সিং হোমে থাকার কথা। তুই এখানে…”
“আমার চিকিৎসা এখানেই হতে পারে বাবা”, বলে রুচিরা, “আমরা তো অনেকগুলো দিন আলাদা-আলাদা আর একা-একা কাটালাম। এখন একসঙ্গে থাকি না, বাকি ক’টা দিন”।
হই-হই করে ওঠে রয়, “ওর কথা শুনে ভুলভাল ভাববেন না প্রফেসর। ও এখনও অনেকদিন বাঁচবে, আর আমি কিন্তু নিজের ফ্ল্যাট ছেড়ে এখানে এসে থাকতে পারব না”।
সব গুলিয়ে যেতে থাকে ধৃতিমানের।
এদের চোখের এই দ্যুতি, গলার এই উষ্ণতা, এই আশা; এসবের উৎস কী?
ধৃতিমানের ভাবনাটা পড়ে ফেলতে অসুবিধে হয়না রয়ের।
“আমার গল্পটা এখনও বাকি ছিল প্রফেসর, আর আমরা সবাই সেই গল্পের শেষে আপনি কি বলেন সেটা জানতেই বেশি আগ্রহী ছিলাম,” চেষ্টা-কৃত, এবং অবশ্যই মেকি হতাশা মুখে ফুটিয়ে বলে রয়, “তবে আপনার মুখ দেখে বুঝতে পারছি, রুচিরার গল্পটা না বললে আপনি অন্য কিছু শুনবেন না।
প্রথমত, রুচিরার চিকিৎসার জন্যে আপনি কি করতে চেয়েছিলেন, এবং করে ফেলেছিলেন, সেটা জানার পর থেকে ওর মনে আর আপনার প্রতি ততটা রাগ নেই। অভিমান আছে, কষ্ট আছে, তবে সেগুলো নিয়ে যাতে আপনারা দুজনেই কথা চালিয়ে যেতে পারেন, সেজন্যে ও এখন থেকে আপনার সঙ্গেই থাকবে বলে ঠিক করেছে।
দ্বিতীয়ত, আলবের্তোর সঙ্গে আপনার কথোপকথনের রেকর্ডিং শুনতে গিয়ে আমি বুঝতে পেরেছিলাম, মূল শিল্প-কীর্তিটার পাশাপাশি এমন একটা জিনিস আপনার কাছে, সেই প্রথম সফরের সময়েই, এসে পড়েছিল, যেটার মর্মোদ্ধার করতে আপনি আর আলবের্তো, দুজনেই ব্যর্থ হয়েছিলেন। সেটা ছিল একটা টোটেম।
ওই টোটেম-টা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিউজিয়ামে আপনার তরফে উপহার দেওয়ার জন্যে আমি যোগাযোগ করি। জিনিসটা আপনি কীভাবে পেলেন সেটা নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলেনি, কারণ মেসো-আমেরিকার ওই জায়গায় যে আপনি নিয়মিত যান, সেটা সবাই জানে। জিনিসটা যে আসল, পরীক্ষা করে সে ব্যাপারে নিশ্চিত হলেই মিউজিয়াম সেটা সাদরে গ্রহণ করবে, এবং তাদের তরফে রুচিরার চিকিৎসার ব্যয় যথাসম্ভব বহন করবে।
এবার আমি কি আমার ‘গল্প’-টা বলতে পারি?”
রয়ের অধৈর্য মুখটা দেখে ঘরের সবাই হেসে ওঠে। ধৃতিমান প্রথমে একটু সংকুচিত হলেও বুঝতে পারেন, যে মানুষগুলো তাঁর চারপাশে রয়েছে, তারা প্রত্যেকে তাঁর, এবং রুচিরার শুভানুধ্যায়ী। তাই সহজ ভাবেই মাথা নেড়ে সম্মতি দেন তিনি।
‘গল্প’-তে ফিরে যায় রয়।
“আলবের্তোর পরিকল্পনার প্রথম ধাপ সফল হয়।
বিভিন্ন জায়গায় খোঁড়াখুঁড়ি করতে থাকা টিম সেই ‘নিদর্শন’-গুলো পায়, যেগুলো আপাতভাবে এটাই বোঝায় যে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগেই ওই দেশের বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে ওর পরিবার প্রবল প্রতাপে বিরাজমান ছিল। সেগুলোর মাধ্যমে, দেশের আইন মেনে, আলবের্তো কিছু-কিছু বিশেষ অধিকার দাবিও করে।
আর তারপরেই আসে আসল চমক।
গতকাল রাতে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল জানিয়েছে যে সন্দেহাতীত ভাবে প্রমাণ হয়ে গেছে, ওই আর্টিফ্যাক্টগুলো জাল, অর্থাৎ আদৌ প্রাচীন নয়, বরং সমকালীন। এতে শুধু যে আলবের্তোর দাবি খারিজ হয়েছে তাই নয়, একগাদা আইনের ফাঁসে ফেঁসে আলবের্তো এখন জেলে, এবং বেশ কিছুদিনের জন্যে জেল-ই ওর বাড়িঘর হতে চলেছে”।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে রয়। তারপর আবার বলে, “আপনার উপস্থিতি-ধন্য সেই বিশেষ ফুটেজ, এবং আপনার সঙ্গে হওয়া ওর বিভিন্ন কথোপকথন এখনও আমি নিজের হাতে আনতে পারিনি, তবে সাপোর্টিং এভিডেন্স ছাড়া ওগুলো দিয়ে এমনিতেও কিছু প্রমাণ করা যাবে না।
সাপোর্টিং এভিডেন্স যে পাওয়া যাবেনা, সেটা নিশ্চিত, যেহেতু কাল রাতের এক উল্কাপাতে ওই অবজার্ভেশন স্টেশন তথা ল্যাব নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
কিন্তু প্রফেসর”, ঘরের মধ্যে জমে ওঠা টেনশনটাকে আরেকটু ঘন করে তুলে আবার প্রশ্ন করে রয়, “এসব হল কীভাবে?”
হেসে ওঠেন ধৃতিমান।
হেরে যাওয়া মানুষের নয়, বিজয়ীর হাসি।
“আলবের্তো সব ঠিকঠাক করেছিল। তবে ওর হিসেবে একটা ভুল থেকে গেছিল।
আমার ল্যাবটা বায়ুমণ্ডলের অতটা উঁচুতে করা হয়েছিল, যাতে মহাজাগতিক রশ্মির আঘাতে চতুর্মাত্রিক জগতের কণা আর বস্তুর পরিবর্তনটা আমি লক্ষ্য করতে পারি।
সেখানে ও যে ‘প্রত্ন’ বস্তুগুলো বানাচ্ছিল, সেগুলোর বাকি সব উপাদানের ব্যাপারে স্থানিক বিশুদ্ধতা বজায় রাখা গেলেও, মানে মালমশলা একেবারে কঠোরভাবে ওই জায়গার হলেও, আদতে সেটা বানানো হয়েছিল আমার ল্যাবেই। আর এইখানেই ও সব চেয়ে বড় ভুলটা করে বসল।
একটা জিনিস নতুন না পুরনো, আর পুরনো হলে কতটা পুরনো, সেটা জানার উপায় হল রেডিও-কার্বন ডেটিং, যাতে এটা দেখা হয় যে জিনিসটায় উপস্থিত কার্বন-১৪ কতটা ক্ষয় পেয়েছে।
যেহেতু কার্বন-১৪ মোটামুটি ৫৭৩০ বছরে অর্ধেকটা ক্ষয়ে যায়, আর ওই জিনিসগুলো যেহেতু প্রায় অতটা পেছনেই নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাই এখন পাওয়া যাওয়ার পর সেই জিনিসগুলোয় কার্বন-১৪ স্বাভাবিকের তুলনায় অর্ধেক পরিমাণে থাকবে; এটাই স্বাভাবিক।
অত্যধিক মহাজাগতিক রশ্মির ধাক্কায় আমার ল্যাবের বাইরের, ও ভেতরের, বাতাসে প্রাকৃতিক নাইট্রোজেন বদলে গিয়ে কার্বন-১৪ হওয়ার হার স্বাভাবিকের তুলনায় দ্বিগুণ।
তাই, আমার ল্যাবে জিনিসগুলো তৈরি হওয়ার সময়ে তাতে স্বাভাবিকের তুলনায় দ্বিগুণ পরিমাণে কার্বন-১৪ ঢুকে গেছিল ওর অজান্তেই।
এত বছর পর জিনিসগুলোর বিশ্লেষণ করতে গিয়ে কার্বন-১৪ সেজন্যে প্রায় ততটাই পাওয়া গেল, যা এখন একেবারে টাটকা জিনিসে পাওয়া যায়”।
চুপ করে যান ধৃতিমান, তবে তাঁর চোখ হাসতে থাকে।
“তার মানে আপনি সব জেনে-বুঝেই…” বলে ওঠে রয়।
রুচিরাই উত্তরটা দেয়, “সব প্রশ্নের উত্তর জানা ভালো না। যেমন এটা জানতে চাওয়াও উচিত নয় যে অবজার্ভেশন স্টেশনটা এমনিতে জিও-ষ্টেশনারী, অর্থাৎ নিচের অবস্থানের বিচারে অনড় হলেও কাল রাতেই কেন সেটা অনেকটা রাস্তা সরে গিয়ে উল্কা-খণ্ডটার সামনে প্রায় বুক পেতে দিয়েছিল। তাই না বাবা?”
হো-হো করে হেসে ওঠেন ধৃতিমান।
আর ঠিক সেই সময়েই খ্যানখেনে সুরে কিউ বলে ওঠে, “আপনি চা-র জন্যে আমাকে বলতে ভুলে গেছিলেন প্রফেসর। এখন কি আমি দু’কাপ চা নিয়ে আসব?”
হতাশ-ভাবে রয়ের দিকে তাকিয়ে বলেন ধৃতিমান, “অবস্থা দেখেছ? কিউ-ও আমার ভুল ধরছে”।
রুচিরার হাতটা নিজের শক্ত মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলে রয়, “ওর নিজের ব্যাপারটা দেখলেন না? ঘরে আমরা এতজন আছি, তাও ও বলল শুধু দু’কাপ চা আনার কথা।
মানুষ, এমনকি যন্ত্র হলেও, ভুল করেই”।
Tags: ঋজু গাঙ্গুলী, কল্পবিজ্ঞান গল্প, ধ্রুবজ্যোতি দাস, প্রথম বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, ভুল