মনের মতন মানুষ
লেখক: অনিন্দ্য সেনগুপ্ত
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
“তাহলে আমার সঙ্গে চলো” – অবশেষে বলেই ফেললো রঙ্গন।
“যাবো? কোথায় যাবো?” – হেসে বলে ফেললো রাই।
অনেক সময়েই প্রেমিকের কথা শুনে হেসে ফেলে তরুনীরা। ইতিহাস জুড়েই হেসেছে। সেই হাসি তাচ্ছিল্যের বা ব্যঙ্গের নয়। আমি তোমার জন্য অসম্ভবতমটাও করে ফেলতে পারি – এই উক্তির মধ্যে যে সাহস আর বোকামো আছে, তার সাথে দু’ছটাক অসহায়তা এবং সপ্রতিভ হওয়ার শেষ চেষ্টাও, সেটাই হাসি উদ্রেক করে। কারণ এর পরেই আবেগের সবচাইতে অপ্রতিভ প্রকাশটি ঘটবে – আর কতই বা কথার কারসাজি চালিয়ে যেতে পারে তরুণ মন?
যাওয়া, সঙ্গে, গন্তব্য – ইত্যাদির আগে যে জরুরী শব্দটা ছিল সেটা হল ‘তাহলে’।
‘তাহলে’–র আগে কিছু একটা থাকতে হয়। দেখা যায় এখানেই সেই চিরন্তন হাস্যোদ্রেককারী বোকামিগুলোর আগে ইতিহাস ঢুকে পড়েছে। অর্থাৎ, আজ সেই ‘তাহলে’–র আগে যা আসতে পারে, তিনশো বছর আগে সেগুলো আসতো না, তিনশো বছর পরে সেগুলো আসবে না।
আর পালটে যায় রঙ্গন আর রাইদের পরিচয়।
এই ‘তাহলে’–র আগে গত একশো বছর ধরে রয়েছে একটা পরিস্থিতি – প্রিয়াম কর্পোরেশনের অধীনস্থ কলকাতা থেকে কেউ বেরোতে পারে না, কারুর যোগাযোগ নেই বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে। যারা পারে হয় আইন তাদের সহায়তা করে, নয়তো আইনের বিরুদ্ধে যেতে হয়। এই যে বিরুদ্ধে যেতে হয় আইনের, এতেই প্রমাণিত হয় যে আইন সহায়তাও করে কমসংখ্যক জনেরই।
রাই আর রঙ্গন সেই প্রিভিলেজ্ডদের মধ্যে পড়ে না।
একশো বছর আগে কলকাতার অধিকাংশ মানুষ এই ‘পারমানেন্ট ইনকর্পোরেশন’–এর অবস্থা বেছে নেন। বাকি পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার বিনিময়ে পাওয়া গিয়েছিলে খাদ্য–বাসস্থান–চিকিৎসার ন্যূনতম গ্যারান্টি, চিরদিনের মত। রোজগার না করেই যা পাওয়া যাবে; রোজগার করতে তার অধিক চাহিদা মেটাতে। এই ন্যূনতমর প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে যে একটা অলিখিত দাসখত লিখিয়ে নেওয়া হল সেটাও সবাই জানতো। কিসের এবং কেন, তা কেউ জানতো না। জানতো না কলকাতার মানুষ যে তারা চিরকালের জন্য প্রিয়াম কর্পোরেশনের বিবিধ এক্সপেরিমেন্টের গিনিপিগ হয়ে যাবে, তাদের সন্তান সন্ততিরাও, এমনকি এই শহরের মানুষকে অন্য কর্পোরেশনের কাছে এবং কাজে কিছুদিনের জন্য লিজ দিতেও পারে প্রিয়াম। তার বদলে ন্যূনতম খাদ্য–বাসস্থান–চিকিৎসা নিশ্চিন্ত, আর আপাতভাবে কলকাতার ইতিহাস বিচ্ছিন্ন হয়ে থমকে যাবে সেই একশো বছর আগেকার বিন্দুতেই। সামান্য কিছু মানুষেরই এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি ও পরিত্রাণের তাড়না জেগে ওঠে।
রঙ্গন তাদের মত একজন। তার এই পঁচিশ বছরের জীবনে বেশ কয়েক বছর সে আন্ডারওয়ার্ল্ডের বিভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ ঘটিয়েছে, প্রাপ্ত করেছে বহু গুপ্তজ্ঞান, ভেঙেছে ছোটখাটো আইন, প্রস্তুতি নিয়েছে দীর্ঘ যে সে একদিন পালাবে। এই কলকাতার খাঁচা থেকে।
অতএব – “তাহলে আমার সঙ্গে চলো?”
“যাবো? কোথায় যাবো?” – রাই হাসবেই; কারণ রাই রঙ্গনের মত নয়। আরো অনেকের মতই রাই এই অবস্থা মেনে নিয়েছে যে কলকাতা থেকে মুক্তি পেতে নেই। তার কারণ এই নয় যে রাই সাধারণ।
তার কারণ এই যে রাই আদপেই সাধারণ নয়।
একশো বছর আগে হলে রাইকে বলা হত এসকর্ট, ভাড়া করা প্রেমিকা, প্রেম ও যৌনতা যার জীবিকা। এখনও তাই বলা হয়। শুধু সামান্য একটু তফাত আছে, যে সামান্য তফাতের মধ্যে প্রবেশ করেছে ইতিহাস। রাই কাস্টমাইজড এস্কর্ট।
কাস্টমাইজড। রাই তিলোত্তমা সুন্দরী, নারীশরীরের প্রায় নিখুঁত নিদর্শন বলা যেতে পারতো – কিন্তু শরীর কি আর একধরণেরই হয়? সেভাবেই রাই তার বডিটাইপের অনুযায়ী নিখুঁত। সেই বডিটাইপ কিরকম? যেরকম শরীরের গঠন রঙ্গনের চোখে নিখুঁত।
কাস্টমাইজড। রঙ্গন এই কম বয়সে কি এক ভাগ্যের ফেরে একটি কার্যক্রমের বিটা টেস্টার হয়ে গিয়েছিল – যে তার কামনা–বাসনা–কল্পনার নারীকে তৈরি করে দেওয়া হবে কৃত্রিমভাবে। রাই অ্যান্ড্রয়েড।
রাই একেবারেই নতুন প্রজন্মের অ্যান্ড্রয়েড। প্রথম অনেকগুলি পর্যায়ে অ্যান্ড্রয়েড তৈরি করা হত যান্ত্রিক গর্ভে ভ্রুণাবস্থা থেকেই, একদম প্রাণের শুরুর বিন্দু থেকে। যথারীতি কোলের শিশুর পর্যায় থেকেই তারা বাড়তে থাকতো। কিন্তু জেনেটিক ও অন্যান্য প্রযুক্তির মেলবন্ধন এখন যে পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে পূর্ণবয়স্ক, কৈশোরাবস্থায়, কার্যত তরুণ পর্যায়ের যে কোনো অবস্থার শরীর থেকেই শুরু করা যেতে পারে অ্যান্ড্রয়েডের জীবন (মধ্যবয়স বা বৃদ্ধাবস্থা থেকে শুরু করার জন্য প্রযুক্তি এখনও তৈরি নয়)।
রঙ্গন জানতো না যে এই কাস্টমাইজড এস্কর্ট সার্ভিসের বিশেষত্ব কি। ডার্ক ওয়েবে বিচরণ করে সে জেনেছে যে অ্যান্ড্রয়েডদের এখনও পৃথিবীতে সাধারণ মানুষের সার্ভিসের জন্য উৎপাদন করা হয়নি। এই সার্ভিসই সেই উদ্দেশ্যে প্রথম পদক্ষেপ হয়তো। এইবার অ্যান্ড্রয়েডদের সাধারণ ক্রেতাদের জন্য তৈরি করা হবে (অবশ্যই অতি ধনীরা ছাড়া কেউ অ্যাফোর্ড করতে পারবে না প্রথম দিকে)।
রঙ্গন অতিধনী তো নয়ই। রঙ্গন বিটাটেস্টার। রঙ্গন একজন সাধারণ মাপের ডেলিঙ্কুয়েন্ট, অপরাধপ্রবণ যুবক, একজন প্রাথমিক স্তরের হ্যাকার। কিন্তু তার প্রবণতা কেবলই নিয়ম ভাঙার আমোদের। আরো অনেক হ্যাকার আছে যারা রাজনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন, যাদের পড়াশোনা গভীর; কিন্তু রঙ্গন জানে যে তাদের চাইতে অনেক বেশি সাহস তার থাকলেও তাদের ধৈর্য্য তার নেই। সে স্রেফ একদিন কলকাতা থেকে পালাতে চায়। তাই জন্যই হ্যাকিং কমিউনিটিতে তার গোপনে আসা–যাওয়া, যোগাযোগ। তাই জন্যই সে অনেক বুদ্ধিজীবি রেজিস্ট্যান্স কর্মীদের ডানহাত, কিন্তু কখনোই অন্যতম ব্রিলিয়ান্ট কর্মী নয়। সে পালাতে চায়, একমাত্র অপরাধজগত আর রাজনৈতিক রেজিস্টান্সের নিষিদ্ধ গোষ্ঠীগুলির লোকজন তাকে সাহায্য করতে পারে, তাই জন্যেই তার গোপনে, ঝুঁকি নিয়ে এইসব দলে নাম লেখানো। তাই জনেই ডার্ক ওয়েবে তার আনাগোনা, যেখান থেকে হঠাতই একটি গোপন প্রোগ্রামের বিটা টেস্টিং–এর অন্তর্গত হয়ে পড়লো সে।
সে জানে সে একা নয়, শহরের অনেকেই তার মত বিটা–টেস্টার। অর্থাৎ শহরের অনেককেই ইদানিং দেখা যাচ্ছে অতীব সুন্দর পুরুষ এবং অতীব সুন্দরী নারীর সাহচর্যে – এতই সুন্দর এদের সঙ্গীরা যে চোখ ফিরতে বাধ্য। এদের অনেকেই রঙ্গনের মত বিটাটেস্টার, অনেকের সঙ্গী আসলে অ্যান্ড্রয়েড। এই বিটাটেস্টিং সীমিত সময়ের, মূলত কয়েক মাসের, কিন্তু ফলাফলের উপর বাড়তে থাকে সময়সীমা। সপ্তাহে দুইদিন এরকম সাহচর্য চলে বেশ কিছু ঘন্টা, তারপর এস্কর্ট ফিরে যায় কোথাও; এস্কর্টের সঙ্গে লিভ–ইন করা যায় না।
এই বিটাটেস্টিং চলছে, আপাতভাবে প্রিয়াম কর্পোরেশনের গোপন খদ্দের হল রঙ্গন। এদিকে তলে তলে চলছে পালাবার প্রস্তুতি। ইতিমধ্যে যা অবধারিত ছিল তাই হল – স্বপ্নের মত নারীর প্রেমে পড়লো রঙ্গন।
তাই আজ রাইকে ও বললো – যে ও পালাবে – রাইও চলুক ওর সঙ্গে – মুক্তির উদ্দেশ্যে। আজকেই বললো, কারণ পালাবার অভিযান শুরু হবে আর কয়েক ঘন্টার মধ্যে।
“কলকাতার বাইরে – আমরা আর এদের নজরে থাকবো না – আমরা আমাদের মত কাটাবো বাকিটা জীবন! চলো!”
“হয় নাকি এরকম ভাবে? তুমি বোঝো না আমার শরীরে জিপিএস চিপ আছে, ওরা ট্রেস করে ফেলবে!” – রাই বুঝলো কথোপকথন সিরিয়াস করে ফেলাই ভালো।
“তুমি কি ভেবেছো আমি তা জানি না? আমি তার উপায় বের করিনি? সামান্য কিছু সার্জারি করতে হবে। শরীরে নতুন কিছু চিপ ইমপ্লান্ট করে দেবো। আমি না! লোক আছে, প্রফেশনাল!”
“ওরা ট্রেস করতে পারবে না?” রাই জিগ্যেস করে। রাইয়ের চোখেমুখে নতুন ভাবনার সিঞ্চন ঘটার চিহ্ন দেখে কামনায় অস্থির হয়ে গেল রঙ্গন। জাপটে ধরলো ওকে।
“কেউ তোমাকে ট্রেস করতে পারবে না! বরং কনফিউজড হয়ে যাবে জিপিএস। তুমি আর কত ক্রীতদাসী হয়ে থাকবে?”
রঙ্গনের আদরকে একটু একটু করে নিরস্ত করতে করতে রাই আবার হাসে – “আমি আবার কার ক্রীতদাসী? আমি তো তোমার জন্যেই তৈরি; তুমি কি ভেবেছো সপ্তাহে বাকি দিন আমি অন্য কাউকে সার্ভিস দিই?”
সে যে দেয় না তার প্রমাণ রঙ্গনের কাছে আছে, স্রেফ বিশ্বাস নয়। রাইয়ের শরীরে ত্বক, মাংস, মজ্জা, রক্ত ইত্যাদি যাবতীয় জৈবিকের সঙ্গে প্রচুর ন্যানোপ্রযুক্তির নেটওয়ার্ক আছে, সব এক এক করে সব হ্যাক করতে শিখে গেছে রঙ্গন। সে জানে রাইয়ের শরীর স্পর্শ করেনি কোনো দ্বিতীয় পুরুষ। রাই তার জন্য কাস্টমাইজড, বিটা টেস্টিং–এর আগে প্রিলিমিনারি স্টেজে প্রচুর প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে রঙ্গন, একের পর এক যৌন ফ্যান্টাসির বিবরণ দিয়ে গেছে, তার ভিত্তিতে প্রচুর প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে – এই সব কিছুর ফসল হচ্ছে রাই।
কিন্তু এই প্রেমের গল্পের বিষাদের অংশ সেখানেই। আর কয়েক সপ্তাহ পরে বিটা স্টেজ শেষ হচ্ছে। রাই যে উদ্দেশ্যে তৈরি তা সফল সার্টিফায়েড হলে হয় প্রচুর অর্থের বিনিময়ে রাইকে কিনতে হবে, নয়তো রাইয়ের মগজ করে ফেলা হবে রিফরমাট, রঙ্গনের স্মৃতির চিহ্নমাত্র সেখানে থাকবে না। গত একমাস সেই অসম্ভবটাও চেষ্টা করেছিল রঙ্গন – প্রচুর প্রচুর রোজগার করা। কিন্তু এইটুকু সময়ের মধ্যে অত টাকা যোগাড় করাও সম্ভব নয়। অতএব পন্থা একটাই – রাইকে নিয়ে পালাও! পাঁচজনের একটা টিম প্রিয়াম কর্পোরেশনের শহরঘেরা দুর্ভেদ্য দেওয়াল ছিন্ন করে পালাবে, রাই সেখানে তেমন বাড়তি বোঝা হবে না। বরং তার নিখুঁত শারীরিকতা অনেক কঠিন বাধা সহজেই পরাস্ত করে ফেলবে। রঙ্গনের হিসেবে আজকের দিনটাতেই রাইকে বলা যেত। কারণ আর কয়েক ঘন্টার মধ্যে তাদের পালানো শুরু করতে হবে, সতীর্থরা অপেক্ষা করছে।
“আমি কি তোমাকে সেইভাবে ক্রীতদাসী বলেছি? বলছি যে তুমি তো আখেরে কর্পোরেশনের সম্পত্তি – কেন তুমি স্রেফ একটা প্রোডাক্ট হয়ে থাকবে?”
রাইয়ের কল্পনাতেও স্থান পায় না কর্পোরেশনের ঘেরাটোপের বাইরে অস্তিত্ব, রাই ভাবেইনি সেটা কিরকম হতে পারে। ইতিমধ্যে রঙ্গনের হঠাৎ উদ্রেক হওয়া কামনাকে নিভিয়ে দিয়েছে সে, রঙ্গনের নিঃশেষিত কাম ভারি নিঃশ্বাস হয়ে তার গ্রীবায় ঘন হচ্ছে, রাই বললো –
“জানো, প্রথম যখন আমাদের স্পেসিমেনগুলো তৈরি হল, ওরা আমাদের – আমাকে নয় – রাত্রিবেলায় মাঝরাস্তায় ছেড়ে দিত।”
“জানি” – ফিসফিস করে বললো রঙ্গন – “তারপর তাদের কি হত তাও জানি।”
“হঠাৎ একটা মেয়েকে রাস্তায় দেখে হামলে পড়তো লোকেরা, অন্ধকারে টেনে নিয়ে যেত।”
“মেরেও ফেলতো”।
“মেরেও ফেলতো অনেকে” – রাই বললো – “ভোগ করে, ছিবড়ে করে, তিনচারজন মিলে। একবার একটা স্পেসিমেনকে প্রোগ্রাম করে দেওয়া হল; মেয়েটা নাকি পাঁচটা রেপিস্টকে ওখানেই মার্ডার করে দিয়েছিল তিন মিনিটের মধ্যে। কি আশ্চর্য! আগের সবাইকে প্রোগ্রাম করে দেওয়া যেত তো!”
“ওই ম্যাসাকারটা শহরের সমস্ত ধর্ষকের মধ্যে আতংক ছড়িয়ে দিয়েছিল। খালি হাতে ওদের যা করেছিল মেয়েটা।”
“হ্যাঁ” – রাই ভাবছে – “কিন্তু সেই ডিফেন্সের স্কিল আর কারুর প্রোগ্রামের অন্তর্গত করা হল না। এরপর ওরা ওরকম রাস্তায় ছেড়ে দেওয়াটা বন্ধ করে দিলো। যেন ওরা জানতো একদিন এই ম্যাসাকারটা হবে; এভাবেই একটা পর্যায়ের পরীক্ষা শেষ হবে। রাস্তার ওই রেপিস্টগুলো জানতেও পারলো না যে একরকম ভাবে ওরাও – তোমার মত – একটা ফেজের বিটাটেস্টারই ছিল।”
“সবকিছু নির্ধারণ করে কর্পোরেশন। এটাই বন্দীত্ব!”
“আচ্ছা ধরো এমনও তো হতে পারে” – রাই রঙ্গনের চোখে চোখ রেখে বললো – “যে এই পর্যায়ে বিটাটেস্টিং–এর কমপ্লিশনের পুরষ্কার হল মুক্তি?”
“মানে?”
“মানে তুমি প্রিভিলেজড সিটিজেন হয়ে যাবে। এই যে এত চুপিচুপি ব্যবস্থা করছো তা হাতে পেয়ে যাবে আইনিভাবেই – তুমি সেই হাতে গোনা কয়েকটা লোকের অন্তর্গত হয়ে যাবে যারা শহর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে পারে লিগালি?”
“আর তুমি?”
“আমাকে হয়তো রিবুট করে দেবে।”
“আমি কি শুধু আমার মুক্তি চাইছি? আমি চাইছি আমাদের দুজনের মুক্তি হোক। তোমাকে কিনে ফেলার টাকা আমার নেই!”
“জানি তো।”
“আর শোনো, যদি টাকাও যোগাড় হয়ে যায়, যদি তোমাকে কিনে ফেলতে পারি, যদি আমি প্রিভিলেজড হয়ে যাই – তাতে আরো বেশি করে এদের বশ্যতার অধীন হয়ে যাওয়া। তোমার মনে হয় আমাদের আর কোনো প্রাইভেসি থাকবে তারপর?”
“সামাজিক স্বীকৃতি তো পাবো? তুমি – না চেয়েও – আর আমি – জানো একসময়ে আমাদের কি বলতো রাস্তার লোকে?”
“কি?”
“ব্লাডি হোর – হোর মানে তো জানোই – ” রাই বললো –“ব্লাডি মানে কিন্তু রক্তাক্ত নয়, ব্লাডি মানে রক্তসূত্রে, জন্মসূত্রে হোর।”
রঙ্গন বুঝতে পারছেনা এইসব প্রসঙ্গ কেন আসছে।
“জানো, এই যে মেয়েগুলো মরলো, মনে আছে একটা মেয়েকে কীভাবে মিউটিলেট করার চেষ্টা করেছিল? তখনই ওরা জানতে পেরে গিয়েছিল যে আমরা কৃত্রিম, আমাদের শরীরের ভিতর যন্ত্র–টন্ত্র আছে। সার্কিট, চিপ্স। ওরা যে জেনারেশনের তার চাইতে আমাদের মধ্যে যন্ত্র অনেক কম যদিও …।”
রঙ্গন বুঝলো যে প্রসঙ্গ থেকে কথাটা সরে যাচ্ছে, আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে।
“তারপর থেকেই ওরা এরকম বেওয়ারিশ গোলমেলেদের নিয়ে আর যেরকম নামই চালু করুক না কেন, ওই ব্লাডি শব্দটা আর ব্যবহার করে না। কেন বলো তো?”
“কেন?”
“যাদের জন্মই কৃত্রিম, যাদের মা নেই, বাবা নেই – তাদের আবার জন্মসূত্র, রক্তসূত্র কি? এখন ওরা মানুষ এসকর্ট দেখলেও ভাবে ও হয়তো অ্যান্ড্রয়েড।”
রাই হাসে।
রঙ্গন হাসে না।
“তুমি জানো এইসব গুজব আর আর্বান লেজেন্ডস অনেকক্ষেত্রে কর্পোরেশনই তৈরি করে ছড়ায়?”
“হয়তো। কিন্তু আমাদের মা–বাবা নেই, তাই আমরা আর ব্লাডি রইলাম না।”
রঙ্গন প্রসঙ্গটা আবার ফেরত নিয়ে আসার চেষ্টা করলো – “আমরা এমন জায়গায় চলে যাবো যেখানে তোমাকে বানানোর উদ্দেশ্য, জন্মসূত্র, রক্তসূত্র এই নিয়ে কেউ পরোয়া করবে না।”
“এটাই ভাবছিলাম। জানো মানুষ আর আমাদের একটা তফাত কি? তোমার আর আমার মধ্যে?”
রঙ্গন এতটা বুঝলো যে যেসব জবাব মাথায় আসছে সেগুলি জবাব নয়।
“তোমাদের – মানুষদের – জন্মের, জীবনের, অস্তিত্বের কোনো উদ্দেশ্য নেই। আমাদের – কৃত্রিম মানুষদের – আছে। আমরা প্রোগ্রামড।”
“সেটাই তো দাসত্বের চাবিকাঠি!” – রঙ্গন রাইয়ের দু’বাহু আঁকড়ে ধরলো – “সেখান থেকেই তো মুক্তি চাই! তোমার প্রোগ্রাম থেকে! নাকি তুমি ওই প্রোগ্রামটাকে একটা, একটা বিশাল কিছু ভাবছো?”
রাই তাকিয়ে থাকে রঙ্গনের দিকে। তারপর কিছুক্ষণ বাদে বলে, আবার সেরকম সরল বোকা প্রশ্নের প্রতিক্রিয়ায় হেসে – “মুক্তি কীভাবে হবে?”
“আমি জানি না তুমি কোথায় ফেরত যাও, আমি কখনো জিগ্যেস করিনি তোমাকে নিয়ে ওরা কি করে, কিন্তু আমি জানি অ্যান্ড্রয়েডদের নিয়ে ওরা কি করে। এই শহর জুড়ে ওদের ফিল্ড, কিন্তু শহরের বাইরে সেই ফিল্ড কার্যকরী নয়! ওরা তোমাকে খুঁজেও পাবে না!”
“হ্যাঁ, পাবে না” – হাসিটা বাষ্পে লেখা আখরের মত মিলিয়ে গেল রাইয়ের মুখ থেকে – “রঙ্গন তোমার কি মনে হয়? আমি কেন তোমার জন্য পার্ফেক্ট? শুধুই শরীরের জন্য? ওরা তোমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে জেনেছিল তোমার স্বপ্নের নারী কিরকম হতে পারে – তাই জন্য? এই যে আমার মুখটা তোমার ছোটবেলায় সেই রোল–প্লেইং গেমের চরিত্রটার মত অবিকল দেখতে বলে?”
“ন্না – শুধু তা তো নয়” – রঙ্গন বুঝতে পারছেনা উত্তরটা কোনদিকে যাবে – “আমি কি কখনো বলেছি শুধুই শরীর?”
“মন, কথা বলার ধরণ, এমনকি মানসিকতা, কোন কথার প্রতিক্রিয়া কীভাবে দিই – সবই কেমন আইডিয়াল না – যেমন হওয়ার কথা ছিল? ঠিক যেমন হতে পারতো – তুমিও জানতে না এতটা নিখুঁত!”
“সেই জন্যই তো!”
“কি করে হল এটা?” – রাইয়ের মুখে আবার চিলতে হাসির আখর – “বিটা টেস্টিং–এর আগে তোমার ইন্টারভিউয়ের ফলে?”
“ক্কি তাহলে?”
“আমাদের যখন আদর হয় তখন শরীরে যে অনুভূতিগুলো হয় রঙ্গন – জানো সেটা মানুষে মানুষের মধ্যে হয় না?”
“জানি তো! আমি তো মানুষের সঙ্গেও করে দেখেছি! হয় না!”
“জানো – বডি ফ্লুইডসের সাথে আমার শরীর থেকে ডিজপোজেবেল ন্যানোচিপ্স প্রবেশ করে তোমার শরীরে, রক্তে, স্নায়ুতে ছড়িয়ে যায় – সক্রিয় থাকে কয়েক ঘন্টার জন্য?”
এটা জানতো না রঙ্গন।
“জানো আমার শিৎকারের সঙ্গে কিছুটা যন্ত্রণাও থাকে – মাইল্ড – কারণ তখন আমার মগজে লেখা হতে থাকে।”
“লেখা!”
“তোমার স্মৃতি, তোমার আবেগ, তোমার অবচেতন পড়তে থাকে চিপ্স, লিখতে থাকে আমার শরীরে। এই আধঘন্টা আগেও লিখেছে। এখনও লিখছে।”
রঙ্গনের মুখে কথা সরছে না।
“আমার মন বলে যা কিছু থাকতে পারে তার উপর ওভাররাইটিং হতে থাকে; কারণ সেই ডেটা অনুযায়ী আমার মনকে ফের গড়ে পিটে নেওয়া হয় – একদম তোমার মনের মত হয়ে যেতে হবে যে!”
রঙ্গনের মনে হত, গত কয়েক মাস ধরে যে রাই একটা স্পাই প্রোগ্রামও হতে পারে। তাই কখনো রাইয়ের সঙ্গে তার গোপন নাশকতার রাজনীতির আলোচনা সে করেনি, একবারও নিয়ে যায়নি তার টিমটিমে আলোর বেসমেন্টের বাসস্থানে। আজকের আগে কখনো বলেনি যে সে পালাতে চায় শহর ছেড়ে। আজ বলেছে কারণ রাইয়ের ফেরত যাওয়ার সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে সে। তার সতীর্থরা বলেছিল – কনসেন্ট না দিলে রাইকে অন্তত দিন পাঁচেকের জন্য তারা বন্দী করে রাখবে কোথাও, যতদিনে না তারা পগার পার হয়ে গেছে, বা ধরা পড়ে ততদিনে কারারুদ্ধ কর্পোরেশনের জেলে। রঙ্গন বলেছিল এসবের প্রয়োজন নেই, রাইকে সে রাজি করাবেই। কিন্তু রাইয়ের ক্ষমতা ছিল তার মন, অবচেতন পড়ে ফেলার?
“আমার মনের মধ্যে পুষে রাখা ডেটা রিট্রিভ করার ক্ষমতা কারুরই নেই রঙ্গন, কর্পোরেশনেরও নয়” – রাই বললো, যেন রঙ্গনের মনের কথা পড়ে ফেলেই।
“না – তা বলিনি –।”
“এটাই আমার – যতদিন অ্যাক্টিভ রাখবে ওরা – ততদিনের প্রোগ্রাম – তোমার মন পড়তে পড়তে তোমার মনের মত হতে থাকা। এইজন্যই আমি তোমার স্বপ্নের নারী।”
রঙ্গনের চুলে আঙুল প্রবেশ করে রাই তার চোখের দিকে বলে – “আমার মুক্তি কীভাবে হতে পারে জানো রঙ্গন? তোমার মন নামক জিনিসটা যদি নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় তাহলেই; তাহলেই আমার প্রোগ্রাম থেকে আমার মুক্তি, তাহলেই রোজ রোজ রক্তে–কণিকায়–স্নায়ুতে মন পড়া আর মন লেখার কাজটা থামে; থেমে যায় চিরতরে। তুমি একা পালালে ওরা আমাকে রিবুট করে দেবে, নাহলে তোমার মনের বোঝা নিয়ে কীভাবে আমি আরেকজনের মনের মত হয়ে উঠবো? আমি তোমার সঙ্গে পালালে এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে – আজীবন – তোমার মন পড়ে তোমার মনের মত হতে থাকা। আমার একমাত্র মুক্তি পালিয়ে যাওয়ার পরে যদি তোমার মৃত্যু হয় – অকস্মাৎ বা আমার হাতে – তাহলেই তোমার মনের ফিকে হতে থাকা অবশেষ নিয়ে আমার মনটা যদি আমার মত হয়ে উঠতে পারে, কর্পোরেশনের নাগালের বাইরে। আমাদের তো মা নেই, বাবা নেই – স্মৃতি নেই, ঐতিহ্য নেই – আমাদের স্বকীয় একাকী মনটা যে কেমন হতে পারে কে জানে!”
হাত–পা ঠান্ডা হয়ে যায় রঙ্গনের। এক লহমা মনে হয় এই মুহূর্তে, এইখানেই –
“যে ফুলকে কোন মানুষের চোখ দেখতে পায়না, এমন দূর্গম প্রকৃতিতে দুদিনের জন্য ফোটে যারা – সেই ফুল কি সদর্থে স্বাধীন রঙ্গন? নাকি সেই সেরকম স্বাধীন যেরকম কোনো ফুলই হতে পারে না?”
রঙ্গনের হাতে আর সত্যিই বেশি সময় নেই।
“ভেবো না রঙ্গন। তোমাকে হত্যা করা আমার প্রোগ্রামের অন্তর্গত নয় – ওটা আমার দ্বারা হবে না” – রাতের শহরের দিকে তাকিয়ে বললো রাই – কাস্টমাইজড অ্যান্ড্রয়েড এস্কর্ট।
Tags: অনিন্দ্য সেনগুপ্ত, কল্পবিজ্ঞান গল্প, কল্পবিজ্ঞান গল্প, দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, মনের মতন মানুষ
মুক্ত বাজারের আঘাটায় এই সাধের সভ্যতার তরী ডোবার আগে ভেতর ঘরের ঠুনকো মূল্যবোধের পোগ্রামের মধ্যে অজস্র ‘বাগ’ পড়ে ফেললাম কল্পবিজ্ঞানের মোড়কে এই শব্দের ওডিসির মধ্যে দিয়ে। অজস্র দ্বন্দ্ব নতুন করে জন্ম নিল। যে চিন্তা কিবোর্ডে এই ম্যানিফেস্টো লিখেছে তাকে কুর্নিস।
দারুন, আমার পড়া অন্যতম ভালো গল্প, মনে থেকে যাবে এটা , যেমন Ex Machina সিনেমাটা রয়ে গেছে .
অপার্থিব-তে বর্ণিত এই ভীষণ রকম সম্ভাব্য ভবিষ্যতের পৃথিবী থেকে যেন বয়ে এল কিছুটা বাতাস, যাতে মিশে আছে সেই সময়ের কিছু ন্যানোচিপ, কিছু আর্তনাদ, কিছু কষ্ট, আর জীবনের সংজ্ঞা, স্বাধীনতার সংজ্ঞা, ‘মানুষ’-এর সংজ্ঞা নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন।
শাবাশ অনিন্দ্য।