মস্তান – স্যার আর্থার কোনান ডয়েল
লেখক: ভাবানুবাদ: ঋজু গাঙ্গুলী
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
লন্ডন, ১৮৭৮।
সাউথ মিডল্যান্ড ইয়োম্যানরির ঘোড়সওয়াররা সেই সময় আসন্ন ইউরোপিয়ান যুদ্ধ নিয়ে নয়, বরং চিন্তিত ছিল ফ্যারিয়ার সার্জেন্ট বার্টনের জন্য একজন প্রতিপক্ষ খুঁজে পাওয়া নিয়ে। বক্সিং রিঙে বিশালদেহী বার্টনকে হারানো তো দূরের কথা, তার সঙ্গে দশ রাউন্ড লড়তে পারে এমন বক্সারের সংখ্যাই কমে আসছিল হু-হু করে। ফলে বার্টনের দু’হাতের জোরের মতো তার ইগোও ফুলে-ফেঁপে উঠছিল।
তাই, তাকে না থামালে আর চলছিল না।
এই প্রতিপক্ষটির সন্ধানে বেরোনো স্যার ফ্রেডরিক মিলবার্নের কাজটা কিন্তু সহজ ছিল না, কারণ বক্সিং-এর জগতে সে বড়ো সুখের সময় নয়। দস্তানা-ছাড়া খালি হাতের মারামারি ততদিনে জোচ্চোর আর গুন্ডাদের ভিড়ে এতটাই ন্যক্কারজনক হয়ে উঠেছে যে মুষ্টিযুদ্ধ জিনিসটাই বে-আইনি বলে ঘোষিত হয়েছে, অথচ গড়পড়তা ব্রাইটনের কাছে উত্তেজনার খোরাক হিসেবে আর কোনো বিকল্পের সন্ধান দেওয়া হয়নি।
বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর, হেভিওয়েট পর্যায়ে না হলেও কেন্টিশ টাউনের মিডল-ওয়েট লড়িয়ে অ্যালফ স্টিভেন্সকে দেখে মিলবার্ন খুশি হলেন। স্টিভেন্স তখনও অবধি কোনো লড়াইয়ে হারেনি। ওজনের দিক দিয়ে প্রতিপক্ষের তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও মিলবার্নের মনে হল, স্টিভেন্সের পেশাদারি অভিজ্ঞতা আর দক্ষতা সেটুকু ঢেকে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।
এক সন্ধ্যায় গোল্ডেন ক্রস আস্তাবল থেকে নেওয়া একটা দু’ঘোড়ায় টানা ডগ-কার্টে নিজের পাশে অ্যালফ স্টিভেন্সকে বসিয়ে গ্রেট নর্থ রোড ধরে সেন্ট অ্যালবান্স হয়ে ফুটনে ইয়োম্যানদের শিবিরের উদ্দেশে রওনা হলেন মিলবার্ন। বেটস নামের ছোটোখাটো চেহারার সহিসটিও তাঁদের সঙ্গী হল।
রওনা হবার আগে, স্টিভেন্সের সঙ্গীরা যখন সমস্বরে “গুড লাক অ্যালফ” বলে স্টিভেন্সকে শুভেচ্ছা জানাল, তখন মিলবার্ন-এর মনে হল, বার্টনের মোকাবিলা করার জন্য স্টিভেন্সের সত্যিই হাতের পাশাপাশি কিছুটা হলেও কপালের জোরও লাগবে।
অক্সফোর্ড স্ট্রিট হয়ে ট্রাফালগার স্কোয়্যার পেরোনো অবধি পথে এতটাই ভিড় সামলাতে হয়েছিল মিলবার্নকে, যে সহযাত্রীকে ভালো করে দেখার সুযোগটাও পাননি তিনি। অবশেষে, হেন্ডনের পর থেকেই দু’ধারের বিরক্তিকর ইঁটের বাড়িগুলোর বদলে যখন মাঠ আর গাছের সারি শুরু হল, তখন তিনি একটু দম ফেলার সুযোগ পেলেন। সন্ধে নামছে তখন। সেই কম আলোতেও সার ফ্রেডরিক বুঝলেন, তাঁর পাশে বসে থাকা মানুষটি লড়িয়ে বটে। ফ্যারিয়ার সার্জেন্টের জন্য যে উপহারটি তিনি নিয়ে যাচ্ছেন, রিঙে দাঁড়িয়ে তার মুখোমুখি হতে বার্টনের কেমন লাগবে ভেবে তাঁর মুখে, অনেকক্ষণ পরে, একটা মুচকি হাসি ফুটে উঠল।
“তাহলে স্টিভেন্স”, অনেকক্ষণ ধরে জমে থাকা নীরবতাটা ভেঙে কথা শুরু করেন মিলবার্ন, “তুমি লড়ার জন্য তৈরি তো?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ”, ভদ্র-অথচ-স্থির গলায় উত্তর দেয় স্টিভেন্স, “আমি জান লড়িয়ে দেওয়ার জন্য তৈরি”।
“তোমাকে দেখেও সেটাই মনে হচ্ছে”, বলেন স্টিভেন্স, “অবশ্য যার সঙ্গে তোমায় লড়তে হবে সে তোমার চেয়ে আড়ে-বহরে অনেকটাই এগিয়ে আছে, এটাও মনে রেখো”।
“আমার কাছে এটা খুব নতুন ব্যাপার নয় স্যার”, অল্প হেসে বলে স্টিভেন্স, “আমি যথাসাধ্য লড়ব, এটা শুধু বলতে পারি”।
বক্সারটির শান্ত, অথচ নিশ্চিন্ত কন্ঠস্বর শুনে ভালো লাগে স্যার ফ্রেডরিকের। হঠাৎ একটা কিছু মনে পড়ে তিনি হো-হো করে হেসে ওঠেন, আর বলেন, “আজ রাতে মস্তানের মুখোমুখি হলে কেমন হবে, তাই ভাবছি!”
“মস্তান?” স্পষ্টতই কৌতূহলী হয় অ্যালফ স্টিভেন্স, “সে কে স্যার?”
“সেটাই তো আসল ব্যাপার”, মুচকি হেসে বলেন মিলবার্ন, “মস্তানকে যারা দেখেনি তারা বলে, সে নাকি একটা গল্প মাত্র। আবার যারা তার মুখোমুখি হয়েছে তারা বলে, সে নাকি একজন সত্যিকারের বড়ো মুষ্টিযোদ্ধা, যে নিজের প্রতিপক্ষকে একেবারে দাগিয়ে দিয়ে যায়”।
“কোথায় পাওয়া যেতে পারে এই মস্তানকে?”, স্টিভেন্সের গলা শুনে, আর একেবারে ঘুরে তাঁর চোখে চোখ রেখে বসা দেখে মিলবার্ন বোঝেন, তরুণ বক্সারটি হঠাৎই একটা নতুন উত্তেজনার খোরাক পেয়েছে।
“এই রাস্তাতেই”, সামনের পথের দিকে তাকিয়ে ঘোড়ার লাগামগুলো আলগা ভাবে ধরে থেকে বলেন মিলবার্ন, “ফিঞ্চলে আর এলস্ট্রির মাঝের জায়গাটায়, পূর্ণিমার রাতে, দু’জন লোক পথচারীদের থামিয়ে পুরোনো মতে লড়তে চ্যালেঞ্জ করে।
একজন লড়ে, সেই মস্তান। অন্যজন তার সঙ্গী।
মস্তান নাকি সাঙ্ঘাতিক লড়িয়ে। তার হাতে মার খেয়ে একেবারে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে বহু লোক”।
অ্যালফ স্টিভেন্সের গলার উত্তেজনাটা আর লুকোনো থাকেনা, “পুরোনো মতে, মানে বিনা-দস্তানায়, স্রেফ খালি হাতে লড়ার শখ আমার অনেক দিনের!”
“তার মানে,” সস্নেহে স্টিভেন্সকে কিছুটা প্রশ্রয় দিয়েই বলেন মিলবার্ন, “মস্তান তোমাকে চ্যালেঞ্জ করলে তুমি তাকে প্রত্যাখ্যান করবে না, তাই তো?”
“প্রত্যাখ্যান!”, প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে স্টিভেন্স, “এই মস্তানের সঙ্গে লড়ার জন্য আমি যেখানে যেতে বলবেন, সেখানেই যেতে রাজি”।
“কিন্তু এমন একজন বক্সারের কথা রিঙের সঙ্গে যুক্ত সব্বার জানার কথা”, কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে তারপর চিন্তিত স্বরে বলে স্টিভেন্স, “যদি না সে অ্যামেচার হয়”।
“হতে পারে”, মেনে নেন মিলবার্ন, “কেউ-কেউ বলে যে এ তল্লাটে ছড়িয়ে থাকা অনেক আস্তাবলের মধ্যে কোনোটাতে কাজ করে মস্তান। তবে তার হাবভাবের মধ্যে একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে, এটাই আমার বরাবর মনে হয়েছে।
অবশ্য আজ পূর্ণিমার রাত। তাই মস্তান কে, বা কী, সে ব্যাপারে একটা নিষ্পত্তি আজ হতেই পারে।”
আরো কিছুক্ষণ গাড়িটা চলার পরেই হঠাৎ ভয়ার্ত আর ক্রুদ্ধ কন্ঠে বলে ওঠেন মিলবার্ন, “আরে! এই…, কী করছ! সরে যাও, সরে যাও শিগগির!”
রাস্তাটা এখানে কিছুটা নিচু হয়েছে। তার একদিকে গাছে ঢাকা একটা সরু আর আগাছায় ভরা পথের অন্য প্রান্তে রয়েছে ব্রোকা পরিবারের একদা আভিজাত্যপূর্ণ, এখন প্রায় পরিত্যক্ত পুরোনো প্রাসাদ। সেই পথ থেকেই হঠাৎ বেরিয়ে এসে ঘোড়াগুলোর সামনে দাঁড়িয়েছে একটি লোক। নিরুপায় হয়ে ডগ-কার্টটা থামিয়ে দিয়ে অসহায় রাগে আস্ফালন করছিলেন মিলবার্ন।
“লাগামটা ধরো জো”, ছায়াঘেরা পথটা থেকে ততক্ষণে বেরিয়ে আসা নিজের সঙ্গীর উদ্দেশে কথাটা বলে লোকটি, “এই ভদ্দরলোকটি হুশ করে বেরিয়ে যাওয়ার আগে তেনার সঙ্গে দুটো প্রাণের কথা কয়ে নিই”।
ডগ-কার্টের পাশের আলোয় জো নামের লোকটিকে স্পষ্ট দেখা যায়। গোমড়া আর মাংসল মুখ। নিচের ঠোঁটটা বেঁকা। মোটাসোটা চেহারার ওপরে অপেক্ষাকৃত ছোটো আকারের মাথায় বেখাপ্পা টুপি।
পা-দানিতে লাফিয়ে উঠে দুজন সওয়ারিকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখে প্রথম লোকটি। এবার আলোতে তাকেও স্পষ্ট দেখা যায়। মিলবার্ন আর স্টিভেন্স, দুজনেই লোকটার মুখেচোখে একটা শয়তানির ছাপ দেখে কিছুটা পিছিয়ে যান।
কপালের ওপর অনেকটা নেমে আসা টুপির তলাতেও লোকটার জ্বলন্ত চোখজোড়া, দৃঢ় চোয়াল, উন্নত নাসা, মুখের ভাবে একটা নির্দয় নৃশংসতা বোঝা যায়। তার বয়স আন্দাজ করা যায়না, তবে এটুকু বোঝা যায় যে লড়ার মতো যৌবন, আর দুনিয়াদারিতে পোড়-খাওয়া মনোভাব, দুটোই তার রয়েছে ভরপুর মাত্রায়।
“যা ভেবেছিলাম”, ঘাড় ঘুরিয়ে নিজের সঙ্গীকে বলে লোকটা, “ভদ্দরলোকই বটে। তবে তার স্যাঙাৎটি কিন্তু বেশ। দেখা যাক, ক’দান টিঁকতে পারে ছোকরা”।
“তুমি কে তা আমি জানিনা।”, আর নিজেকে চুপ করিয়ে রাখতে পারেন না মিলবার্ন, “তবে তোমার কিঞ্চিৎ সহবত-শিক্ষা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। চাবকে তোমায় আমি…”
“মুখ সামলে কথা বলবেন স্যার”, ব্যঙ্গ মেশানো ঠাণ্ডা গলায় বলে লোকটা, “আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলাটা কিন্তু আপনার স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক হতে পারে”।
“তোমার কথা আমি আগেও শুনেছি”, রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলেন মিলবার্ন, “বড়ো রাস্তায় আমার ঘোড়া থামিয়ে তুমি কত বড়ো ভুল করেছ, সেটা এবার বুঝবে”।
“হতে পারে”, মাথা হেলিয়ে বলে লোকটা, “হতেই পারে যে আমাদের ছাড়াছাড়ি হওয়ার আগে আমি-আপনি দুজনেই হয়তো অনেক কিছু বুঝব, জানব”।
“তবে আপনাদের মধ্যে যেকোনো একজনকে এই উচ্চাসন থেকে নামতে হবে, আর আমার সঙ্গে লড়তে হবে। নইলে আপনারা যেতে পারবেন না”, বলে লোকটা।
লাফিয়ে ওঠে স্টিভেন্স।
“একেবারে ঠিক জায়গায় ঢুঁ মেরেছ ভাইটি”, বলে সে, “লড়াইটাই আমার পেশা। তাই পরে বোলোনা যে তোমায় সাবধান করা হয়নি”।
“অবশেষে!”, স্টিভেন্সের কথাটা শুনে লোকটার মুখে গভীর তৃপ্তি ফুটে ওঠে।
“আলতু-ফালতু পাবলিক নয়,”, তৃপ্ত গলায় বলে লোকটা, “একেবারে আসলে জিনিস পাচ্ছি আজ রাতে।
তা এমন চাঁদনি রাতটা কি আমরা এসব কথাতেই নষ্ট করব? চলো ওস্তাদ, চলো। আমাদের লড়ার জন্য একটা ফার্স্ট ক্লাস জায়গায় তোমাদের নিয়ে যাই”।
মস্তান, আর তার সঙ্গীর ইশারায় গাছের ছায়ায় অন্ধকার হয়ে থাকা সরু পথটা ধরে ঘোড়াগুলোকে হাঁটায় বেটস। তাদের আগে হেঁটে চলে ওরা চারজন।
“রাস্তায় লড়তেও আমার আপত্তি ছিল না”, বলে স্টিভেন্স।
“রাস্তা হেঁজিপেঁজিদের লড়ার পক্ষে ঠিক আছে”, বলে লোকটা, “কিন্তু তোমার-আমার মতো লড়িয়ের জন্য দরকার আরো বড়ো, আরো ভালো মঞ্চ।
অবশ্য তুমি ভয় পেলে আলাদা কথা…”
“তোমাকে ভয়?” কথাটার মধ্যে মাপমতো রাগ আর ব্যঙ্গ মিশিয়ে দেয় স্টিভেন্স।
ছায়াঘেরা পথটা ধরে বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর ওরা চারজন একটা গোল জায়গায় এসে পৌঁছল, যেটা চাঁদের আলোয় ঝকঝক করছিল।
“কী হে, কী বলেছিলাম?” জো নামের মোটা লোকটা বলে, “শহরের বিশ মাইলের মধ্যে এমন একখানা জায়গা বের করে দেখাও দেখি”।
একদিকে একটা পুরোনো এক-কামরার বাড়ি, আর অন্যদিকে উঁচু ঘাসজমির মাঝে জায়গাটা সত্যিই রিং হওয়ার পক্ষে আদর্শ ঠেকছিল। কিন্তু ওসব না দেখে মিলবার্ন বরং এটাই দেখছিলেন যে লোকদু’টোর শুধু কথায় নয়, জামাকাপড়েও বহু-বহু পুরোনো যুগের ছাপ, যেটা তাদের বাকি আচরণের সঙ্গে মিশে গিয়ে পুরো ব্যাপারটাকে কেমন যেন অদ্ভুত চেহারা দিচ্ছে।
“তাহলে টম”, জো বলে, “এবার তুমি দেখাও তোমার হাতের কাজ, আর আমরা দেখি”।
টম, মানে মিলবার্ন আর স্টিভেন্স অন্তত যাকে লোকমুখে মস্তান নামেই চিনেছে, ধীরেসুস্থে নিজের টুপি, কোট, শার্ট খুলে তৈরি হচ্ছিল। অন্য দিকে মুখ করে স্টিভেন্সও প্রস্তুত হচ্ছিল লড়াইয়ের জন্য।
কিন্তু নিজের প্রতিপক্ষের দিকে ঘুরে তাকে ভালো ভাবে দেখার সঙ্গে-সঙ্গে ভীষণভাবে চমকে উঠলে স্টিভেন্স।
“এ কী!”
চাঁদের আলোয় তখন স্টিভেন্স আর টম, দুজনের চেহারাই একেবারে ভাস্কর্যের মতো ফুটে উঠেছে। কিন্তু টমের মাথা থেকে টুপিটা খোলার ফলে তার চওড়া বুক, ছড়ানো কাঁধ, আর পেশিবহুল লম্বা হাতের থেকেও আগে নজর কেড়ে নিচ্ছে তার মাথাটা, যেখানে কপালের ওপরের অংশটা একেবারে থেঁতলে গেছে!
“কী সাঙ্ঘাতিক!”, বলে ওঠে অ্যালফ স্টিভেন্স, “তোমার মাথায় কী হয়েছে?”
উত্তরে তার প্রতিপক্ষের চোখ জ্বলে ওঠে শীতল ক্রোধে, “নিজের মাথাটা আগে সামলাও দেখি ওস্তাদ”।
প্রতিপক্ষের নিষ্ঠুর চোখজোড়া আর বেঁকাতেড়া ঠোঁটের কোণে স্থির হাসিটা স্টিভেন্সকে বুঝিয়ে দেয়, সামনে কঠিন ঠাঁই। তবু, কখনও হার-না-মানা বক্সারটি এগিয়ে যায় লড়ার জন্য।
শুরু হয় এক আশ্চর্য লড়াই, আর তারপর তা চলতে থাকে রাউন্ডের পর রাউন্ড ধরে।
মস্তান, ওরফে টম, এক সম্পূর্ণ নাম-না-জানা প্রতিপক্ষ হলেও তার ক্ষিপ্রতা, গায়ের জোর, আর অকল্পনীয় সহ্যশক্তির সামনে মিডল-ওয়েট লড়িয়েটি একটু-একটু করে কাবু হয়ে আসছিল।
অবশেষে টমের একটা ভয়ংকর আপার-কাট স্টিভেন্সকে শুইয়ে দিল।
“অ্যালফ”, কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন মিলবার্ন, “তোমাকে এভাবে রেজিমেন্টের সামনে নিয়ে গেলে আমাকে হাস্যস্পদ হতে হবে। খেলাটা এবার থামালে হয়না? হ্যান্ড-শেক করে ম্যাচটা ছেড়ে দাও, নইলে তুমি সার্জেন্ট বার্টনের সামনে দাঁড়ানোর অবস্থায় থাকবে না”।
“কী?”, ক্রুদ্ধভাবে গর্জে ওঠে স্টিভেন্স, “এই লোককে ম্যাচ ছেড়ে দেব?”
“অসম্ভব”, মাটি ছেড়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে-করতে বলে স্টিভেন্স, “আমি দরকার হলে এখান থেকে লন্ডনে ফিরে যাব, কিন্তু ওই লোকটাকে আমি এত সহজে ছেড়ে দেবনা”।
“বাবুর বিশ্রাম নেওয়া হল?”, ব্যঙ্গ আর হাসি মেশানো গলায় কথাটা ভেসে আসে স্টিভেন্সের দিকে, “না কি শখ মিটে গেছে লড়াইয়ের?”
অন্ধ আক্রোশে প্রতিপক্ষের দিকে ছুটে যায় স্টিভেন্স, আর নিজের যেটুকু শক্তি তখনও বাকি ছিল, তার সবটুকু কাজে লাগিয়ে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে।
গোটা একটা মিনিট ধরে তার দু’হাতের হিংস্র আদর মস্তানকে পিছু হটতে বাধ্য করে।
কিন্তু স্টিভেন্সের এই লড়াই যে তার শক্তির প্রদীপ নেভার আগের শেষ দপদপানি মাত্র, সেটা বোঝার মতো অভিজ্ঞতা ছিল তার প্রতিদ্বন্দ্বীর। স্টিভেন্সের হাত যখন শিথিল হয়ে আসছে, তখনই আবার শুরু হল টমের মার। তার আপার-কাটগুলো বিষাক্ত সাপের মতো ছোবলের পর ছোবল মেরে দুর্বল করে দিচ্ছিল তরুণ বক্সারটিকে।
হাঁটু গেড়ে বসে পড়া স্টিভেন্স আপ্রাণ চেষ্টা করেও তার ওপর নেমে আসা মারের স্রোত ঠেকাতে পারছিল না। কিন্তু ঠিক সেই সময়ে লড়াইয়ের জায়গাটার পাশে গাছের ছায়া আর ঝোপঝাড়ে অন্ধকার জায়গাটা থেকে একটা কুকুরের যন্ত্রণাকাতর কান্নার আওয়াজ ভেসে এল।
আওয়াজটা পাওয়া মাত্র নিশ্চিত জয়ের মুখে দাঁড়ানো বক্সারটির মুখ থেকে হাসি মুছে গিয়ে ফুটে উঠল নিঃসীম আতঙ্ক।
নিজের সঙ্গীর দিকে তাকিয়ে সে বলে উঠল, “ওটা আবার আমার পিছু নিয়েছে!”
“মন শক্ত রাখো টম”, চেঁচিয়ে বলে জো, “তুমি খেল-খতম করেই এনেছ। এখন সেটা শেষ করো। ওটা তোমার কী করতে পারবে?”
“পারবে! পারবে! ওটাই আমায় শেষ করবে”, বলে চিৎকার করে খেলার জায়গাটা ছেড়ে দৌড়ে পালিয়ে যায় টম।
দাঁতে দাঁত ঘষে, একপ্রস্থ গালাগাল দিয়ে, ফেলে যাওয়া পোশাক তুলে নিয়ে, তার পেছনে ছোটে জো।
ঝোপের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসে একটা ছোট্ট সাদা টেরিয়ার। তার পিঠটা দুমড়ে গেছে নিচের দিকে, আর গায়ে লেগে আছে রক্ত।
কোনো রকমে মাথা তোলা স্টিভেন্স, আর তার মাথাটা কোলে নিয়ে ব্রান্ডির ছোটো ফ্লাস্কটা তার মুখের সামনে ধরা মিলবার্নকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে দুই পলাতকের গন্ধ শুঁকে তাদের পিছু নেয় কুকুরটা।
কী হচ্ছে তা না বুঝেও, দারুণ ভয় চেপে বসে তরুণ বক্সারটির বুকে। স্যার ফ্রেডরিকও যে ভয় পেয়েছিলেন তা তাঁর মুখ দেখে বোঝা যায়।
প্রায় রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে তাঁরা দুজনেই ডগ-কার্টে চড়ে বসেন। ঘোড়াদুটো ওই জায়গা থেকে প্রায় মাইল দুয়েক এলে তবেই কথা বলার অবস্থা ফিরে পান তাঁরা।
“কুকুরটা …”, শুকনো গলায় বলেন মিলবার্ন, “তুমি ওটাকে দেখেছিলে?”
“দেখেছিলাম”, সভয়ে বলে তরুণ মুষ্টিযোদ্ধাটি, “তবে আর দেখতে চাইনা”।
শেষ রাতে, হারপেনডেন কমনের সোয়ান ইন-এ আশ্রয় নিল ক্লান্ত পথিকেরা। সরাইখানার মালিক জো হর্নার স্যার ফ্রেডরিকের পুরোনো আলাপি বলে পানাহারের সুবন্দোবস্ত হতে অসুবিধা হল না।
হর্নার বক্সিং-এর ভক্ত, তায় অ্যালফ স্টিভেন্সের সুনামের সঙ্গে পরিচিত। তাই নিজের অতিথি হিসেবে তাকে পেয়ে, এবং তার মুখচোখের অবস্থা দেখে, হর্নারের বিস্মিত প্রশ্নই ছিল, “আপনি লড়ে এলেন বুঝি? কিন্তু কোনো ম্যাচের খবর তো কাগজে দেয়নি”।
“প্লিজ”, ক্লান্তভাবে হর্নারকে নিরস্ত করতে চায় স্টিভেন্স, “এই নিয়ে কিছু জানতে চাইবেন না”।
“বুঝলাম, কিন্তু…”, হঠাৎ থেমে যান হর্নার। তাঁর চোখজোড়া জ্বলজ্বলিয়ে ওঠে পরের প্রশ্নটা করতে গিয়ে।
“আপনারা তো লন্ডন ছেড়ে গ্রেট নর্থ রোড ধরে এলেন”, গম্ভীর গলায় বলেন হর্নার, “মস্তানের সঙ্গে আপনাদের মোলাকাত হয়নি তো?”
“যদি হয়েই থাকে, তাতে কী?”, জানতে চান মিলবার্ন।
“কী বলছেন স্যার!”, উত্তেজিত হয়ে ওঠেন হর্নার, “ব্রোকা পরিবারের পুরোনো প্রাসাদের সামনে বব মিডোজ, আর তার মতো আরো কত উঠতি লড়িয়ে থেকে শুরু করে পাক্কা পেশাদার ওই মস্তানের মার খেয়ে ছাতু হয়ে গেছে, তা জানেন কি আপনারা?”
“হ্যাঁ”, তিক্ত কন্ঠে বলে স্টিভেন্স, “আপনার মস্তানের সঙ্গে আমাদের মোলাকাত হয়েছে বৈকি”।
“একটা কথা বলুন তাহলে”, গলার আওয়াজ অনেকখানি নামিয়ে এনে শুধোন হর্নার, “লোকের মুখে শুনেছি, মস্তান, আর তার সঙ্গের লোকটার পোশাক নাকি একেবারে মান্ধাতার বাবার আমলের। কথাটা কি ঠিক?”
দু’জনের নীরব মাথা নাড়া থেকে উত্তর পেয়ে যান হর্নার। “অবিশ্বাস্য!”, চেঁচিয়ে ওঠেন তিনি।
“১৮২২ সালের এক চাঁদনি রাতে”, থেমে-থেমে বলেন হর্নার, “ব্রোকাদের প্রাসাদে ঢোকার সরু রাস্তাটার মুখে, মাতাল অবস্থায়, একটা ভারী ওয়াগনের পাশ দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি ছোটাতে গিয়ে মারা যায় সেই সময়ের দুর্ধর্ষ, আর প্রায় অপরাজেয় মুষ্টিযোদ্ধা টম হিকম্যান। সেই সময় তার সঙ্গে ছিল তার বন্ধু জো রো।
ওয়াগনের চাকাটা হিকম্যানের মাথার ওপর দিয়ে চলে গেছিল”।
“আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে” বলে উঠে দাঁড়ায় স্টিভেন্স, “একটু খোলা আকাশের নিচে হেঁটে আসি বরং”।
“মাথা উঁচু করে হেঁটো হে”, সস্নেহে বলেন হর্নার, “তুমিই আমার জানা প্রথম বক্সার যে মস্তানের সঙ্গে লড়াইয়ের পরেও হেঁটে বেড়ানোর অবস্থায় আছে”।
“টম হিকম্যান যে কতটা নিষ্ঠুর লোক ছিল, সেটা একটা ঘটনা শুনলেই আপনারা বুঝতে পারবেন”, ফায়ারপ্লেসের মধ্যে লাফাতে থাকা আগুনের দিকে তাকিয়ে বলেন হর্নার।
“যে রাতে টম মারা যায়, সেই রাতেই সে ওই ফায়ারপ্লেসটার সামনে ঘুমোনো একটা টেরিয়ারকে পিটিয়ে মেরেছিল নেশার ঘোরে, আর অন্ধ আক্রোশে।
আজ রাতে তুমি একার জন্য লড়ছিলে না স্টিভেন্স। তুমি লড়ছিলে আরো অনেকের হয়ে”, অ্যালফ স্টিভেন্স আর স্যার ফ্রেডরিক মিলবার্নের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে সহাস্যে বলেন হর্নার, “তাই, মস্তানের সঙ্গে মোকাবিলা করার সময় তার অন্য এক হতভাগ্য শিকারকেও তুমি হয়তো দেখেছ, তাই না?”
“হয়তো”, ভাঙা গলায় বলে স্টিভেন্স, “তবে আমার পক্ষে ওই ফ্যারিয়ার সার্জেন্টই ভালো।
সে আপনারা যাই বলুন”।
অনুবাদ প্রসঙ্গেঃ গল্পটি স্যার আর্থার কোনান ডয়েল এর লেখা ছোটগল্প “দ্য বুলি অফ ব্রোকা’জ কোর্ট” এর ভাবানুবাদ। মূল গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘দ্য স্ট্র্যান্ড’ পত্রিকার নভেম্বর ১৯২১ সংখ্যায়। অলংকরণে স্ট্যান্ড ম্যাগাজিনে প্রকাশিত স্টিভেন স্পুরিয়ারের আঁকা ছবিই ব্যবহার করা হল।
খুব ভাল হয়েছে অনুবাদ।
খুব sundor ভাবানুবাদ
এক লহমায় সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর আলোছায়া অলিন্দে মানস ভ্রমণ করে এলাম। নির্মেদ অনুবাদের বিন্যাস মূল গল্পের স্বাদকে অক্ষুন্ন রেখেছে।
খুব ভাল লাগল। আপনাকে অনুরোধ করব ডয়ালের আরো বেশী বাংলায় এখনো অনুবাদ হয় নি এমন গল্পের অনুবাদ করুন। আর্থার কোন্যান ডয়াল মানেই শার্লক হোমস আর চ্যালেঞ্জার নয়। এখনো হাউণ্ড অফ বাস্কারভিলের নতুন অনুবাদ হচ্ছে দেখে খুব মাথা গরম হয়ে যায়।