মহাদ্রুম
লেখক: সাগরিকা রায়
শিল্পী: সুমন দাস
লেখক – সাগরিকা রায়
অলংকরণ – সুমন দাস
পালঙ্কের সূক্ষ কারুকাজের দিকে তাকিয়ে সময় কেটে যায়। ইদানিং বাড়ির লোকজন সময় পায় না। এ ঘরে এসে তার সঙ্গে দেখা করার মতো সময় কোথায়? সবারই কাজকর্ম আছে। পড়াশোনা আছে। মাঝে মধ্যে বড় ছেলে এসে দেখা করে যায়। ক্লান্ত গলায় কৈফিয়ত দেয়—অফিসে যা কাজের চাপ! বলে পকেট থেকে রুমাল বের করে ‘এঃ হেঃ’ শব্দ করে ঘাড় গলা মুছতে থাকে। দেখে কষ্ট হয়। আহারে, ওদের মা বেঁচে থাকলে আজ ওদের উপর এত চাপ পড়ত না। সে দেখাশোনা করত। পায়ে গরম তেল মালিশ করে দিত। বালিশটা নেমে গেছে। কেউ এসে বালিশটা ঠিকঠাক করে দিলে আরাম হত। কেউ এল না। আসে না। বড় বউমা কবে এসেছিল এ ঘরে? উম্মম, গত পরশু। সকালে। চা নিয়ে এসেছিল অলকা। সঙ্গে এসেছিল বড় বউমা। জানতে চেয়েছিল কেমন আছেন শ্বশুরমশাই। খুব খুশি হয়েছিলেন বড় বউমা আসাতে। সাহস আসে। মনে হয় এই সংসারে তাঁরও গুরুত্ব আছে। তিনি অপাঙতেয় নন। হাঁ করে বউমাকে খুশিটা বোঝাতে যাওয়ার আগেই বউমা চলে গেল ঘর থেকে। প্রশ্নটা করেছিল বউমা, জবাব না শুনেই চলে গেল। অলকা চা নিয়ে এসেছে স্টিলের বাটি করে। চায়ের মধ্যে ভেঙে টুকরো করে দিয়েছে সুগার ফ্রি বিস্কুট। বিস্বাদ চা। দার্জিলিং-টি খাওয়ার অভ্যেস ছিল। এখন বিশ্রি গন্ধ চায়ে। মাঝে মাঝে সুপ্রিয়ার প্রতি অভিমান হয়। আগে ভাগে মরে গেল। ও বেঁচে থাকলে আজ এতটা অবহেলা হত না তাঁর।
ধুপ্। কী এসে পড়ল চাদরের উপর। উঁচু হয়ে দেখার ক্ষমতা নেই। মেরুদন্ডে একটা টিউমার হয়েছিল। ডাক্তার দেখানো হয়। অপারেশন করে লাম্পটা রিমুভও করা হয়। কিন্তু আর উঠে বসে চা খাওয়া হয় না। জানালা দিয়ে সামনের সবুজ মাঠটা দেখা হয় না। অলকা ছাড়া কাউকে দেখেন না সারাদিনে। কিন্তু গায়ের উপর কী এসে পড়ল! কেউ কি ঘরে এসেছে? দরজার পর্দা নড়ে উঠল যেন! কে এসেছে?
—আমার বল! খুব মিষ্টি গলা। বাচ্চা কেউ। কে? নাতি নাতনির কেউ কি? কী নাম ওদের? ভুলে গেছেন।
—আমার বলটা তোমার খাটে পড়েছে। ছোট্ট সুন্দর মুখটা উঁকি দিল পর্দার আড়াল থেকে। বাচ্চা ছেলে। হাত তুলে বাচ্চাটাকে ডাকলেন,—এসো, বল নিয়ে যাও। বাচ্চাটা এগিয়ে এসে তাঁর খাটে উঠে এল। গায়ের উপর থেকে হলুদ বলটা নিতে নিতে একটু হাসল।
—তুমি কে? বুড়োবাবু? ভয় দেখাচ্ছ না তো?
—ভয় দেখাব কেন সোনাভাই? মা বলেছে এ ঘরে না আসতে। বুড়োবাবু ভয় দেখাবে। আমি যাচ্ছি। বাট ইউ আর সো গুড। বাচ্চাটা চলে গেল। কিন্তু সারাদিনের জন্য খুশির বার্তা দিয়ে গেল। ইউ আর সো গুড, ইউ আর সো গুড…। সুপ্রিয়া শুনেছ, নাতি আমাকে ঠিক চিনেছে।
রোজ সকাল হলেই দরজার দিকে তাকিয়ে থাকেন। পর্দাটা নড়ে উঠল না? আড়ালে কেউ আছে কি? অলকা বিরক্ত হয়—তোমাকে ভূতে পেয়েছে। কে থাকবে পর্দার পেছনে? কেউ আসে এ ঘরে? বারবার উঠে দেখতে পারব না। ইচ্ছে হলে নিজে উঠে যাও দেখতে।
বাচ্চাটা আর এ ঘরে আসেনি। ও কোথায় বল খেলে? বলটা এ ঘরে চলে আসতে পারে না? তাহলে বাচ্চাটা আসত। খুব দেখতে ইচ্ছে করে নাতিকে। অলকা এসে পাশ ফিরিয়ে দিয়ে যায়। বকাবকি করে—নিজে তো চেষ্টা করতে পার। পারলে কি করতেন না? সোজাসুজি তাকিয়ে পালঙ্কের কারুকাজ দেখেন। কতদিনের পালঙ্ক। মেহগনি কাঠের। চমতকার লতাপাতার কাজ। যেন রূপকথার দেশ। এমন সুন্দর লতাপাতা কোথায় আছে? কোন দেশে? খুব ইচ্ছে করে সেদেশে যেতে। কিন্তু যাবেন কী করে! শরীরের ভগ্নদশা। মনেরও। তবু আর তো কিছু নেই জীবনে এই পালঙ্কের কারুকাজ ছাড়া! মাঝে মাঝে আকাশ ঘন করে মেঘ আসে। সারাক্ষণ ঘুম ঘুম ভাব থাকে বর্ষার দিনে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলেন কবিতা পড়ছেন—কোনও দেশেতে তরুলতা, সকল দেশের চাইতে শ্যামল… পালঙ্কের লতাপাতা সেই তরুলতা যেন। কি সবুজ, কি সবুজ! ঘুম ভাঙতেই ঘরে ক্লোরোফিলের গন্ধ পেলেন। বুক ভরে শ্বাস নিতে গেলে হাঁপ ধরে গেল। অলকা চোখ মুখ মুছিয়ে দিতে এসে গজগজ করে—কি এত ঘুমোও বল দিকিনি?
আজ কি কেউ এসেছে বাড়িতে? অনেক লোক মিলে কথা বলছে। বাড়িতে জন্মদিন হলে এরকম হইচই হয়। কার জন্মদিন? বড় ছেলের জন্মদিন আশ্বিন মাসে। এটা কি মাস? অলকা বলতে পারবে কি?
—না গো। কেউ আসেনি। ও ঘরে টিভি চলছে। ছিরিয়াল হচ্ছে। তুমি দেখবে? এ ঘরে একটা টিভি দিলে পারে বড় বউদি। তাহলে তোমার সময় কাটবে ভালো। কত রকম ছিরিয়াল হয় জান। তোমাকে দেখাশোনা করতে হয় বলে আমিও ছিরিয়ালগুলো দেখতে পাই না। বল না গো বউদিকে। বদ্দাকেও বলতে পারো। খুব ভালো হয়। বলবে?
বকবক করে যাচ্ছে অলকা। কিছুই বুঝতে পারলেন না। এই মেয়েটা এখানে কতদিন ধরে আছে? কোথায় এর বাড়ি? ও কি আয়া সেন্টার থেকে এসেছে? চেহারাটা শুকনো। শাঁসে জলের নয়। যেমন ছিল সুপ্রিয়া। কোথায় সুপ্রিয়া? ইদানিং ইচ্ছে করে সুপ্রিয়াকে স্পর্শ করে দেখতে। এসব কেন হচ্ছে এই বয়সে এসে? প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগে জ্বলে উঠতে চায়?
—আমার বাড়ি কোথায়? বাহ, এই তো, কেমন সুন্দর কথা কইছো। আমার বাড়ি বকখালি। স্টেশনে গিয়ে তুমি নামখানা লোকালে চেপে নামখানা স্টেশনে নামবে। তাপ্পরে তুমি ভ্যানে করে খেয়াঘাটে যাবে। বুঝলে? সেখানে নৌকোয় উঠে হাতানিয়া দোয়ানিয়া নদী পেরিয়ে ফের তুমি ভ্যানে চাপবে। বাস ধরতে হবে তো! এরপর বকখালি, আমার বাড়ি। সাগর আছে গো। অলকার কথা শুনতে শুনতে ঘোর লাগে। অলকা টমেটো সুপ নিয়ে এসেছে। গরম নেই সুপ। ঠান্ডা সুপ ভালো লাগে না। কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। কতদিন কিছু বলতে ভালো লাগে না। ঘরে ছায়া ছায়া স্মৃতিগুলো ঘুরে বেড়ায়। কিছু স্মৃতি খুব চেনা। কিছু ঝাপসা। কারা আসে ঘরে? কথা বলতে ইচ্ছে করে তাদের সঙ্গে।
—দেখ গো, পাত্তবাবু এসেছে।
চোখের ঘোর ঘোর ভাবটা খানিকটা কাটে। এই ছেলেটা ম্যাসাজ করতে আসে। হাত পা টিপে দেয়। ব্যায়াম করায়। শুয়ে শুয়ে যতটুকু হয়। ছেলেরা বাবার জন্য খুব করে। নিজের হাতে না পারুক, লোক লাগিয়ে দিয়েছে। সবসময়ের জন্য আছে অলকা। পার্থ আছে। ফিজিওথেরাপিস্ট। কিন্তু আর কেউ আসে না। আস্তে আস্তে তিনি কি পাথর হয়ে যাবেন? জ্যান্ত কিন্তু অসাড় পদার্থ! কথা না বলতে বলতে একদিন তাঁর জিভ কাজ করবে না। মধুসূদন কতদিন আসেনি। আজ সকালে কোলিগ মধুসূদনের কথা মনে পড়ল। ডাকাডাকি করতে অলকা এল। এসেই ভ্রু তুলল—বু বু করছ কেন? জল খাবে?
সেদিন অলকা খাওয়ানো ফেলে তাড়াহুড়ো করে জানালা বন্ধ করে দিল। তাঁর চোখ দেখে বুঝতে পারে অলকা— বৃষ্টি শুরু হয়েছে গো। এই চলে এল বর্ষা। দেখ, বিছানাপত্র ভিজিয়ে ফেল না কিন্তু। শুকোতে অসুবিধে হবে।
মাথায় তরঙ্গ ছুটে এল। বর্ষা এসেছে। বর্ষা মানে বৃষ্টি। ঝমর ঝমর বৃষ্টি নামবে এবারে। খুব ভিজতে হয় এখন। অনেকদিন পরে কোন সুদূর থেকে মাটির গন্ধ ভেসে এল। ভেজা মাটির গন্ধ। মনে হল ভেসে ভেসে চলে যাচ্ছেন অনেক দূরে। মেঘের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে ভিজে যাচ্ছেন যেন। ঠান্ডা ঠান্ডা জলের স্পর্শে ভারি আরাম হল।
সকালে অলকা চেঁচামেচি লাগিয়ে দিল—এ মাগো! ছাদ ফুঁড়ে জল পড়ছে যে! ও বউদিরা, এসে দেখ, জ্যাডামশাই এর বিছানাপত্র ভিজে গেছে গো। কি গো, তোমার গায়েও জল পড়েছে। ভিজ্জে গেছ।
খুব হুজ্জোতি গেল অলকার। ভেজা বিছানা, চাদর পালটে দিল ও। তাঁর গায়ের জল মুছে দিল। খবর পেল ছেলেরা। বড় ছেলে এসে হুকুম দিয়ে গেল খাট ঘুরিয়ে রাখতে। অত বড় পালঙ্ক ঘুরিয়ে রাখা কি যার তার কাজ? বিছানাটা গুটিয়ে তাঁকে টেনে একধারে এনে রাখল অলকা। পালঙ্ক যেখানে ছিল, সেখানেই থাকল।
রাতে ঘুম হল না। কপাল ব্যথা করছে। সুপ্রিয়া এসে কপাল টিপে দেবে কি? রাতে ফের বৃষ্টি এল। খাটের একপাশ খুব ভিজেছে কাল থেকেই। কতকালের খাট। জলে ভিজে ফুলে উঠবে কাঠ। ঘুমহীন চোখে খাটের গায়ে হাত বুলিয়ে দেন আদর করে। আদর করে কথা বলেন। সেই সব পুরানো দিনের কথা মনে হয়। খাটের কাঠ মন দিয়ে কথা শোনে। এটা তাঁর বিয়ের খাট। নতুন সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল একদিন এই খাটে। সে রোমাঞ্চ আজও মনে আছে। আশ্চর্য! সেসব রোমন্থন করলে নিজেকে সেই বয়সে ফিরে যেতে দেখেন কেন?
সেদিন এক কান্ড হল। খাটের গায়ের কারুকাজের মধ্যে জল পড়েছে। বৃষ্টি থামার লক্ষণ নেই। ঘুম চোখে দেখলেন একটা সবুজ পাতা উঁকি দিচ্ছে পালঙ্কের কারুকাজের ভেতর থেকে। লতা পাতার ভেতর থেকে। কোথা থেকে এল পাতাটা? পাখার হাওয়ায় নড়াচড়া করছে। মনে হচ্ছে ও কথা বলতে চাইছে। এই পুরানো, ক্লান্তিকর ঘরে এক ঝলক তাজা হাওয়া নিয়ে এল পাতাটা। কতদিন পর সবুজ তাজা পাতা দেখলেন! ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। অলকার ডাকাডাকিতে ঘুম ভেঙে গেল। অলকা কপালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে—ওঠো গো, দেখ, তোমার খাটের উপর কে এসে কতগুলো কি সব পাতা রেখে গেছে। বলেই পাতাগুলো তুলে ফেলে দিতে গেল। আশ্চর্য ঘটনা হল, পাতা গুলো তুলে ফেলা যাচ্ছে না। ওরা খাটের কাঠের সঙ্গে আটকে আছে। খাটের কাঠ থেকে জন্ম হয়েছে ওদের।
অলকার চিল্লামিল্লিতে ছোট বড় যে যেখানে ছিল এল চলে। অনেকদিন পর সবাইকে একসঙ্গে দেখতে পেলেন! দুটো বাচ্চা আছে এই গ্রুপে। নাতির ছেলেরা। কী নাম ওদের?
—ছাড়ুন ফালতু কথা। খাটে গাছ গজাচ্ছে এটাতে অবাক হলেন না? ওটা কার বাচ্চা, এটা কার বউ…। এই অলকা, কবে থেকে এগুলো দেখছিস?
—আজই বউদি। এই এখনই।
—পুরানো কাঠ। জল পেয়ে নড়ে উঠেছে। বীজ ছিল লুকিয়ে। একটু কেরোসিন ঢেলে দিস। মরে যাবে। আগাছার বৃদ্ধি বেশি বলে একটা কথা আছে। এ হল তাই। দুমদাম করে চলে গেল বর-বউ। পেছন পেছন সাঙ্গো পাঙ্গোরাও। মনে মনে হাসেন।
অলকা কেরোসিন নিয়ে এসেছে। ঢালতে যাচ্ছে, বাধা দিলেন—থাক না অলকা। কোনও অসুবিধে তো করছে না! কতদিন গাছপালা দেখি না বল? থাক ওরা। বউদিকে বলিস না ওদের কথা।
ওরা রয়ে গেল। শুধু রয়েই গেল তাই নয়, হুবহু খাটের সূক্ষ্ণ লতাপাতার কারুকাজগুলোই জ্যান্ত হয়ে উঠতে লাগল! চেয়ে চেয়ে আর আশ মেটে না তাঁর। অলকা ভারি খুশি—কেমন সুন্দর বাগান হচ্ছে দেখ। বউদি বোঝেই না। কিন্তু বীজটা কোথায় লুকিয়েছিল এতগুলো বছর? তিনি বা সুপ্রিয়া দুজনের কেউ বুঝতে পারেননি?
তিনি চমকে ওঠেন—নারে অলকা! বউদিকে বলিস না। সে এসে মেরে ফেলবে সব গাছ। দেখ, ওরা কেমন চমৎকার তরতরে হয়েছে! বুঝলি, গাছের বীজ কাঠের কোথাও আটকে ছিল। বৃষ্টির জল পেয়ে জেগে উঠেছে।
একথা তিনি নিজেই বিশ্বাস করেন। নাহলে শুকনো প্রাচীন কাঠ ফের কি প্রাণের সৃষ্টি করতে পারে? এখন সারাদিন লতাপাতার দিকে তাকিয়ে সময় কেটে যায়। প্রত্যেকদিন একটি করে নতুন পাতার জন্ম হচ্ছে। ক্রমশ লতাপাতার চেহারায় পরিবর্তন আসছে। আগে ছিল সূক্ষ্ম, যেন পেনসিলে আঁকা। এত সরু, এতটাই হালকা। পরীর ভ্রুর মতো। ধীরে ধীরে স্বাস্থ্য ভালো হচ্ছে। সোমবার ঘুম ভেঙে দেখলেন একটা ছোট্ট কুঁড়ি এসেছে ফুলের। কী ফুল এটা? গাছটা পুরোই অচেনা তাঁর কাছে। ফুলটা দেখলে বুঝবেন কী জাতের উদ্ভিদ এটা। খুব আনন্দ হল যেমন, ভয়ও হল। বাড়ির লোকেরা জানতে পারলে কেরোসিন ঢালবেই এবারে। ভুল করবে না। অলকা খুশি ঘরের ভেতরে বাগান দেখে। ও ভালোবেসেছে এই বাগানকে। বাইরে কারও কাছে অলকা মুখ খুলবে না। কিন্তু সকাল আটটার দুধ নিয়ে এল যখন, অলকার মুখ দেখে অস্থির হলেন—কি হল অলকা? বকেছে নাকি কেউ? অলকা দুধের বাটি সাবধানে বেডসাইড টেবিলের উপর রাখে—আজ শুনছি বউদি এ ঘরে আসবে। তোমাকে দেখতে।
অন্যদিন হলে এই খবরে খুশি হতেন। আজ অন্যসময় চলছে। খবরটা শুনে চমকে উঠলেন। সর্বনাশ! বউরা যদি আসে, তাহলে তো…! কোনভাবেই কি ওদের এ ঘরে আসা রুখে দেওয়া যায় না? অলকা মন দিয়ে দুধ ঠান্ডা হল কি না পরখ করে। তিনি ভীত চোখে খাটের লতাপাতার দিকে তাকিয়ে থাকেন। আর মাত্র কিছুক্ষণ! তারপরেই…। দু-চোখ জলে ভরে গেল। এমনই অক্ষম তিনি, যে উঠে ওদের গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে পারেন না! বউদের বাধা দিতে পারেন না। অন্যের উপর নির্ভরশীল হলে যা হয়। পাতাগুলো দুলছিল। পাখা বন্ধ। হয়তো জানালা দিয়ে বাতাস আসছে! সবুজ পাতার মাঝে রামধনু রঙের ফুল উঁকি দিচ্ছে, যেন ও-ও ভয় পেয়েছে বউদি এ ঘরে আসবে শুনে! মন খুব খারাপ হল বলেই হয়তো রাগ হল। ক্ষোভ হল। তিনি কি নিজের পছন্দের কাউকে বাঁচতে দিতে পারেন না? বউরা আসুক, এমন ধমক দেবেন!
ইচ্ছে ছিল না। কিছুটা খেয়ে মুখ সরিয়ে নিলেন। অলকা বুঝেছিল তাঁর মনের অবস্থা। সে উঠে গেল বাটি রেখে আসতে। আর তখনই বড় বউ নাক কুঁচকে এসে ঢুকল। যেন এ ঘরে কতই না দুর্গন্ধ! নাকে রুমাল চাপা দিয়ে বড় বউ জিজ্ঞাসা করল—কেমন আছেন? তিনি চোখ বুজে ফেলেন। এখনই লতাপাতার দিকে নজর যাবে! আর সঙ্গে সঙ্গে চিল চিতকার দিয়ে উঠবে—অল কাআআ! হয়তো অলকার আসতে দেরি দেখে নিজেই ছিঁড়ে ফেলবে গাছটাকে! মুখ আজ খুলতেই হবে। চুপ করে থাকার দিন শেষ। কিন্তু কোনও কথাই বলছেনা বউ। ও কি গাছটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে? ত্রাসে চোখ খুলেই স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। বড় বউ চলে যাচ্ছে ঘর ছেড়ে। খাটের লতাপাতার চিহ্নমাত্র নেই। ছিঁড়ে ফেলেছে চুপচাপ? কিন্তু বউয়ের হাত খালি দেখছেন। মুখ স্বাভাবিক। তাহলে? অলকা এখনও আসেনি। বড় বউ তিনি কেমন আছে জানতে চেয়েছে, জবাব চায়নি। সে চলে গেল। খাটের পায়ের দিকের সবুজ হারিয়ে গেছে। কী করে কী হল বুঝতে পারেননি। কিন্তু সব শেষ তো হল।
মন বিষাদে ভরে গেছে। চোখ খুলে খাটের কারুকাজের দিকে তাকালেন। সব স্বপ্ন ছিল যেন। ভাবতেই দেখলেন কোথায় কী? যেমন লতাপাতায় আচ্ছন্ন ছিল পালঙ্ক, তেমনই আছে। এমনকি সেই আধ-ফোটা ফুলটা পর্যন্ত! তাহলে বড় বউ দেখতে পেল না কেন? তিনি নিজেও দেখতে পাননি! ওরা কি নিজেদের অদৃশ্য করে ফেলতে জানে? মানে হল তাঁর দুশ্চিন্তা গাছেরা পড়তে পেরেছিল? আর তাই বড় বউ ঢুকতেই নিজেদের লুকিয়ে ফেলল? আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। এতদিনে মনের মতো বন্ধু পেয়েছেন। সেই কবে স্কুলে থাকতে জগন্নাথকে পেয়েছিলেন বন্ধু হিসেবে। প্রাণের বন্ধু ছিল সে। আর এই পেলেন। ঠিক জগন্নাথের মতোই তাঁর মনের কথা বুঝতে পারে এরা! খুশিতে হাত নাড়লেন—খুব ভালো কাজ করেছ তোমরা। গাছের পাতাগুলো খুব জোরে দুলে উঠল। বড় বউকে ঠকিয়ে ওরাও মজা পেয়েছে যেন! আর তাঁর কথার জবাব দিল দুলে উঠে।
বন্ধুত্ব গাঢ় হচ্ছে ক্রমশ। আগে পায়ের দিকের কারুকাজে ওদের জন্মাতে দেখেছেন, এখন সমস্ত খাট জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে ওরা। সেদিন কানের কাছে সুড়সুড়ি লাগতেই হাত চলে গেল। না দেখেই কেবল অনুভবে বুঝে ফেললেন একটা পাতা। কিছু বলবে কি? বলল না। মুখে মাথায় বুলিয়ে দিল ওর স্পর্শ। অনেকদিন পর কেউ তাঁকে আদর করল। আহ্লাদে চোখ বুজে এল। মনে পড়ল সুপ্রিয়া এভাবে আদর করত। ভীষণ আদর! ঠিক সেই অনুভূতি জেগে উঠছে শরীর জুড়ে! লতাটা আশ্লেষে জড়িয়ে ধরেছে তাঁকে! নিবিড় হয়ে গেলেন লতার পরশের সঙ্গে। একীভূত যেন। নারী হয়ে উঠেছে লতা। রক্তমাংসের নারীর সঙ্গে সহাবস্থানের অনুভূতি হচ্ছে কেন! এই বয়সে রক্ত কণিকারা এমন তপ্ত হল কী করে! জেগে উঠছে শরীর! দৃঢ় হচ্ছে!
জানালা খোলা ছিল। আজ একটু রোদ উঠেছে। পুবের জানালা দিয়ে এক কুচি রোদ এসে বিছানায় পড়ছে। গাছের পাতাগুলো রি রি করে এগিয়ে গেল রোদটুকুর দিকে। রোদের উপর ছড়িয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে রোদটুকু মুছে যেতে লাগল। পাতাগুলো ফের রি রি করে নিজেদের জায়গায় গিয়ে সেট হয়ে গেল। আশ্চর্য হয়ে গেলেন। ওরা রোদ খেল! রোদ ওদের দরকার হয়, তিনি জানেন। তাহলে অলকাকে বলতে হবে দক্ষিণের জানালাটা দুপুরের পর খুলে রাখতে। ওই সময় একটু রোদ আসে ঘরে, বিছানায়।
অলকা কথামতো দক্ষিণের জানালা খুলে রেখেছে। বিকেলের দিকে চড়া রোদ এসে পড়ল। লতাপাতারা ভারি খুশি। সবাই রি রি করে এগিয়ে গেল। রোদ খেয়ে নিল চেটেপুটে। এমন তৃপ্তির শ্বাস ফেলল, দেখে তিনি ভাবলেন একদিন একটুখানি রোদ খাওয়া যেতে পারে। ওরা খাচ্ছে, তিনি কেন পারবেন না?
পরদিন পুবের জানালার রোদের উপর হাত রাখলেন। সেই রোদটুকুর কাছে মুখ এগিয়ে নিলেন। চেটে চেটে খেয়ে নিলেন রোদ। খুব তাজা লাগল। তাকিয়ে দেখেন পাতারা খাড়া হয়ে তাঁর দিকে দেখছে যেন।
এখন খাটজুড়ে গাছ, পাতা লতা, ফুলে ভরে যাচ্ছে। ক্লোরোফিলের গন্ধে ভরে থাকে ঘর। রাতে লতা পাতারা এসে পাশে শুয়ে থাকে। সেদিন অলকা একটা অবাক করা কথা বলল—তোমার গায়ের ফর্সা রঙে সবুজ সবুজ ভাব লেগেছে। শুনে খুশি হলেন। বন্ধুত্বের একটা রঙ থাকেই। সেটা সবুজ হলেই বা কি?
ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুম ভাঙল ছেলেদের কথাবার্তায়। এই খাটখানা সরিয়ে ফেলা হবে। পুরানো দিনের জিনিস। বিক্রি করে দেওয়া হবে। বদলে কাস্ট আয়রণের খাট আনা হবে তাঁর জন্য।
চুপচাপ শুনে গেলেন। সারারাত মনের কথা বলাবলি করলেন গাছের সঙ্গে। গাছের ডালপালা তাঁর গায়ের উপর আলতো পরশ রাখল। সেই স্পর্শে সহানুভূতির সঙ্গে আশ্বাসের ছোঁয়া পাচ্ছিলেন তিনি। অনেক রাতে কান্নায় ভেসে যাচ্ছেন ছেলেবেলা ভেবে, মাকে ভেবে, সুপ্রিয়াকে ভেবে! সবাই তাঁকে একা ফেলে চলে গেল! জগন্নাথ কবে মরে গেছে জলে ডুবে! মাঠ জুড়ে খেলার দিন শেষ করে চলে গেল জগন্নাথ। নতুন খেলাটা শুরু হতে না হতেই শেষ করে দিচ্ছে ছেলেরা। অন্ধকার ঘরে কেউ তাঁর কান্না দেখতে পাবে না। বুকের সব বেদনা বৃষ্টি হয়ে নেমে এল। সেই বর্ষার জল তাঁর বুক থেকে শুষে নিতে এগিয়ে এল খাটের গায়ের লতাপাতা, ডালপালা, ফুল! অনুভব করলেন গাছ ক্রমশ পোক্ত হচ্ছে। আদর করে জাপটে ধরেছে তাঁকে। যেন বলতে চাইছে ‘ভয় কী? ’সবুজের মধ্যে আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছিলেন তিনি। পরদিন সকালে অলকা ঘরে ঢুকে চমকে উঠেছে—বাবু তো ঘরে নেই গো! খাটটাই বা কোথায়?। পুরো খাটটাই গাছ হয়ে গেছে! ঘর ভরে গেছে লতাপাতায়, ফুলে! বাবু নেই!
ছুটে এসেছে পরিজন। আত্মজন। গাছের গুঁড়ি বেশ চওড়া। মোটা। তা থেকে ডালপালা বেরিয়ে আসছে। ক্রমশ ছাদ ফুঁড়ে বেরিয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে। একটা বাচ্চা, বোধহয় বড় নাতির ছেলে হবে, চেঁচিয়ে উঠল—গাছের গোড়ায় দুটো চোখের মতো দেখেছ?
ঠিক। যেন বাচ্চা ছেলের চোখ। কৌতুকে ভরা। কী ওটা? ত্রাসে চেয়ে থাকে ওরা।
কঃ সঃ লেখাটি পূর্বে একটি লিটিল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছিল।
Tags: তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, মহাদ্রুম, সাগরিকা রায়, সুমন দাস