মাকড়সার জাল
লেখক: সায়ক আমান
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
চোখ খুলতেই প্রথম যে জিনিষটা অনুভব করলাম সেটা হল মাথার ঠিক পিছনে একটানা তীব্র যন্ত্রণা। মনে হল যেন চুলের ফাঁক দিয়ে অজস্র আলপিন ফুটছে। ছটফট করার চেষ্টা করলাম কিন্তু হাত পা নড়ল না। শুধু মাথাটা এপাশ ওপাশ করতে লাগলাম।
মিনিট খানেক পর আচমকাই কমে এলো ব্যথাটা। আমি চারপাশটা ভালো করে দেখার চেষ্টা করলাম। কোথায় আমি? উপরে সাদা ছাদ, অর্থাৎ একটা ঘরে শুয়ে আছি আমি, না, ঘর নয়। হসপিটাল। মাথার পিছন থেকে একটা যান্ত্রিক শব্দ আসছে। ডান দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা খোলা জানলা। বাঁদিকে তাকাতেই মানুষ চোখে পড়ল। আমার বেডের ঠিক পাশেই বিছানায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে আসছে কেউ, একজন মহিলা, জামাকাপড় দেখে অবশ্য হসপিটালের কেউ বলে মনে হল না। সম্ভবত আমার বাড়ির কেউ। সারারাত জেগে থেকে সকাল হতে চেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ব্যাপারটা মাথায় আসতেই অন্য একটা চিন্তা এসে চেপে ধরল আমাকে। কে আমি? আমার নিজের নাম মনে পড়ছে না, এমনকি আমি কিভাবে এই হসপিটালের বেডে এলাম সেটাও বুঝতে পারছি না। এই ঘরটা চেনা চেনা লাগছে। অবশ্য সেটা আশ্চর্যের কিছু নয়, সব হসপিটালের ঘরগুলোই একই রকম দেখতে হয়। আমি হাত নড়ানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু পারলাম না, মনে হল আমার হাতের উপর নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে। আমার অসহায় লাগল।
মিনিট খানেক পরে বাইরে খশখশে জুতোর আওয়াজ পেতে বুঝলাম কেউ ঘরে ঢুকছে। আমি সজাগ হয়ে উঠলাম। আমার কি স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে? তবে কি কোনও অ্যাকসিডেন্টে জ্ঞান হারিয়ে এখানে এসেছি আমি? কিছুই মনে পড়ছে না।
একজন বছর চল্লিশেকের লোক ঘরে ঢুকলেন, সম্ভবত ডাক্তার। আমাকে দেখেই একগাল হেসে বললেন,
“এই যে, সুপ্রভাত। কেমন আছেন?”
আমি বিনিময়ে হাসলাম, কিন্তু উত্তর দিলাম না, আমার নিজের কাছেই অনেক প্রশ্নের উত্তর নেই।
“চিনতে পারছেন না আমাকে?” ভুরুটা কুঁচকে ডাক্তার আমার দিকে এগিয়ে এলেন।
আমি মাথা নাড়ালাম। ভদ্রলোক কিন্তু খুব একটা অবাক হলেন না। মুখে কি যেন বিড়বিড় করতে করতে বললেন, “লবটমিকাল অপারেশনের সাইড এফেক্ট, ও কিছু নয়, আসতে আসতে মেমরি গেন করবেন।”
কথাটা বলে ঘুমন্ত মহিলার দিকে ফিরে তাকে ডাকলেন, “মিসেস দাস… উঠুন…”
আমি জানলা দিয়ে বাইরে তাকালাম, খানিকটা দূরে কতগুলো হাই-রাইজ বিল্ডিং। বড়সড় দৈত্যের মত তারা রোদ আগলে দাঁড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি গলার নিচ থেকে শরীরের উপর আমার নিয়ন্ত্রণ নেই, চাইলেও আমি হাত বা পা নাড়াতে পারব না। ব্যাপারটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামালাম না, এই মুহূর্তে আমার যেটা দরকার সেটা হল পরিচয়, সমস্ত অজানা প্রশ্নগুলো মাথার মধ্যে ভিড় করে আসছে। সেগুলোর মীমাংসা এখুনি না হলে আমার শান্তি হবে না। কপালে একটা মেয়েলি হাতের স্পর্শ পেয়ে আমি ঘুরে তাকালাম। সেই ঘুমন্ত মহিলা, কেমন যেন বিবর্ণ রক্তহীন মুখ তার। চুলগুলো উষ্কখুষ্ক। চোখের তলায় মোটা কালি পড়েছে। উদ্বিগ্ন মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে সে। আমি সেদিকে ফিরতে ভাঙ্গা গলায় প্রশ্ন করল,
“চিনতে পারছিস আমাকে?”
আমি মাথা নাড়ালাম, আর সাথে সাথে তার ক্লান্ত বিনিদ্র চোখে যেন আরও অন্ধকার নেমে এলো। সে মাথা নামিয়ে নিল। ডাক্তার ভদ্রলোক পিছন থেকে তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেন,
“এত ভেঙ্গে পড়ার কিছু নেই, প্রথমটা হয় এরকম।”
আমি ব্যাপারটা খানিকটা বুঝলাম। মহিলা সম্ভবত আমার কোন আত্মীয়, আমার স্মৃতিভ্রংশ হওয়ায় অর্থাৎ আমি তাকে চিনতে না পারায় বোধহয় মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। কেমন যেন মায়া হল আমার, তার মাথায় একটা হাত রাখতে ইচ্ছা করল কিন্তু হাত নড়ল না। আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর অবশ্য এখনও পাইনি, জিজ্ঞেস করলাম,
“আচ্ছা, আমার কি কোনও অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল?”
ডাক্তার আমার দিকে মুখ তুলে বললেন, “অ্যাক্সিডেন্ট! না, না বিগত একবছর আপনি এই হসপিটালের এই বেডে শয্যাশায়ী, কাল রাতে আপনার একটা অপারেশন হয়েছে। এই মুহূর্তে আপনার ব্রেন বেশ কিছু মেমোরি হারিয়ে ফেলেছেন, আপনি নিজের নাম বলতে পারবেন?”
“না, কীসের অপারেশন?”
“মাথার। আই মিন নার্ভের।”
আমি আর কিছু বললাম না। অপারেশন বা তার আগের কথা কিছুই মনে পড়ছে না আমার। মহিলা এখনও নিচু স্বরে কেঁদে চলেছেন, তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার কেমন যেন চেনা লাগল। অথচ মহিলা আমার কে হন সেটাও জানিনা। জিজ্ঞেস করলাম, “আমার নাম কি?”
ডাক্তার উত্তর দিতে যাচ্ছিলেন, মহিলা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “ইন্দ্র, ইন্দ্রনাথ দাস।”
ডাক্তার আমার দিকে এগিয়ে এসে একটু হেসে বললেন, “উনি আপনার বোন।”
আমি হাত দুটোকে বুকের উপর জড় করে চোখ বুঝলাম। আগের ঘটনা যতটা সম্ভব মনে করার চেষ্টা করলাম, এই হসপিটালটা আমার চেনা, এমন কি মানুষগুলোও, শুধু ঘটনার কথা কিছুই মনে পড়ছে না। আমি আবার মহিলার মুখের দিকে তাকালাম, চেনা মুখ, আমি আগেও দেখেছি। এই সাদা কোট পড়া ডাক্তারটা এমন কি জানলার বাইরের সব দৃশ্যই আমার চেনা। সেটা হওয়া অবশ্য অস্বাভাবিক কিছু না। আমি যদি এক বছর যাবত এই বেডেই শুয়ে থাকি তাহলে আমার স্মৃতিভ্রংশ হলেও অবচেতন মনে এদের ছবিগুলো থেকে গেছিল হয়ত। সেগুলো যে আসতে আসতে পুরোটাই ফিরে আসছে তা নিয়ে আমার সন্দেহ নেই। কিন্তু আমার শরীরটা? সেটা কি আর ঠিক হবে কোনোদিন? ডাক্তারের কথা শুনে অবশ্য মনে হল খানিকটা সম্ভাবনা আছে। কি জানি। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। একবছর ধরে আমি বিছানায় শুয়ে আছি। আরও কতদিন শুয়ে থাকতে হবে কে জানে।
“এই বইটা চিনতে পারছেন?”
ডাক্তার আমার দিকে একটা বই এগিয়ে ধরেছেন, বেশ রংচঙে, আমি নামটা পড়ার চেষ্টা করলাম, “কাউন্ট অফ মন্টেক্রিস্টো”। আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথা নামিয়ে নিলাম। ডাক্তার হেসে বললেন, “এ বইটা পড়তে ভালোবাসতেন আপনি, ভালোই হল, ভুলে গেছেন যখন তখন আবার নতুন করে পড়ার আনন্দ পাবেন।”
“আমি পড়ব কি করে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“কেউ না কেউ পড়ে শোনাবে আপনাকে। আর কোন বইয়ের কথা মনে পড়ছে?”
আমি মনে মনে ভাবার চেষ্টা করলাম, আর কিছু মনে পড়ছে না, এটুকু বুঝতে পারছি আমি নিজে যতই চেষ্টা করি না কেন কিছুই মনে পড়বে না, যেটুকু নিজে থেকে ধরা দেবে সেটুকুই জানতে পারব।
“এই যে সুতোটা আপনার মুখের কাছে ঝুলছে, কিছু দরকার হলে ওটা মুখ দিয়ে ধরে টান দেবেন, না পারলেও অবশ্য ঘাবড়ানোর কিছু নেই, আপনার রুমটা 24×7 মনিটরিং চলছে।”
“আমার বাড়ি থেকে আর কেউ আসেনি?”
“আসবে হয়ত পরে, আচ্ছা আমি চলি, আবার বিকেলে আসব।”
ডাক্তার ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। বিছানার পাসে বসা মহিলা এখনও একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কেমন যেন শূন্য দৃষ্টি। আমি আগের থেকে একটুও ভালো হয়েছি কিনা এতক্ষণ যেন সেটাই দেখার চেষ্টা করছিল।
“তোর ব্যথা নেই তো কোথাও?”
আমি মাথা নাড়ালাম। ব্যথা থাকলেই হয়ত সে খুশি হত, আমার অসার হাতটা নিজের হাতে চেপে ধরে আমার কাছে খানিকটা ঝুঁকে পরে বলল, “আমাকে একটুও মনে পড়ছে না?”
“খানিকটা… ” আমি তার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলাম।
“তাহলে বল দেখি আমার মুখে কি নেই?” সে আমার দিকে চোখ কুঁচকে তাকাল।
“চশমা।”
“যাহ, ওত নাকের পাশের দাগটা দেখেই বোঝা যায়।”
“তাহলে অন্য কিছু জিজ্ঞেস কর।”
মেয়েটা কি যেন ভাবল, তারপর আবার ভুরু কুঁচকে তাকাল আমার দিকে, “বল দেখি, আমার নাম কি?”
“স্বাতী দাস।”
“বাঃ, আমাদের বাড়ি?”
“একাত্তর, মহিন চৌধুরী লেন।”
এবার একটা চওড়া হাসি স্বাতীর মুখ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল, “আর একটু কঠিনে যাব?”
“যা।”
“ছোটবেলায় দোতলা থেকে পড়ে তোর একটা হাঁটুর মালাইচাকি সরে গেছিল, কোন হাঁটু?”
“হাঁটু নয়, কনুই। বাঁ কনুই।”
স্বাতীর মুখটা ক্রমশ আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠছে, প্রায় লাফিয়ে উঠে সে জিজ্ঞেস করল, “সব মনে পড়ছে তোর? বাড়ির সবার কথা?”
আমি ভাবার চেষ্টা করলাম, হ্যাঁ, আগের থেকে অনেকটা বেশি মনে পড়ছে বটে। আমার মা, বাবা, ছোটপিসি, আমাদের বাড়িটার কথাও, কিন্তু এখনই সেটা বলা উচিৎ হবে না। আমি উল্টে একটা প্রশ্ন করলাম, “আচ্ছা, একটা কথার ঠিকঠাক উত্তর দিবি?”
“কি, বল না” সে উদ্বিগ্ন হয়ে আমার মুখের দিকে তাকাল।
“কালকের অপারেশন নিয়ে ডাক্তারবাবু ঠিক কি বলেছেন?”
“বলেছেন তুই ঠিক হয়ে যাবি, খালি একটু সময় লাগবে।”
“সত্যি তো?”
“আরে বাবা, তোকে ছুঁয়ে বলছি।”
খেয়াল করলাম আমার হাতটা আবার সে মুঠোয় চেপে ধরেছে। কথাটা শুনে যেন খানিকটা শান্ত হল মনটা। এইরকম অসাড় শরীর নিয়ে বিছানায় আজীবন কাটানোর থেকে মৃত্যু অনেক ভালো। তবু যদি সুস্থ হয়ে যাওয়ার খানিকটা আসা থাকে খানিকটা স্বস্তি পাওয়া যায়। স্বাতী আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “কাল যদি পারি চুনিকে নিয়ে আসব।”
“চুনি কে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“ওঃ, এটাই মনে পড়েনি! অবশ্য না পড়াই স্বাভাবিক, এতদিন হসপিটালে তাকে আনতেই দেয়নি। চুনি আমাদের পোষা কুকুর, তোকে একবছর না দেখতে পেয়ে সে প্রায় আধমরা হয়েছে।”
“বেশ, আনিস।” কুকুরটার কথা কিন্তু একদম মনে পড়ছে না।
“দেখি এবারো ঝামেলা করবে হয়ত। আচ্ছা আমি এখন চলি, বাড়িতে খবরটা দিতে হবে, কাউকে পাঠিয়ে দিচ্ছি, গল্প করবে তোর সাথে।”
স্বাতী উঠে পড়ল। ধীর পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। আমিও মাথা ঘুরিয়ে উপরে তাকালাম। পাখাটা বনবন করে ঘুরছে, জানলা দিয়ে বাইরে আমার চেনা দৃশ্যগুলো চোখে পড়ছে, হয়ত আমার মনের ভিতর জমা থাকা স্মৃতির জলছবিগুলো কিছুক্ষণের জন্য ধুলোয় ঢেকে গেছিল। আসতে আসতে পরিষ্কার হচ্ছে, চোখের সাথে মনের ছবিগুলো মিলে গেলেই আমার সব স্মৃতি ফিরে আসবে। আমি আর একবার পা নাড়ানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু নড়ল না, ধুর, এখন শরীরটা তাড়াতাড়ি ঠিক হলে বাঁচি। কত কাজ করতে ইচ্ছা করছে আমার… মনে হচ্ছে প্রচুর কাজ পড়ে আছে আমার জন্য, অথচ আমি একবছর ধরে পড়ে আছি এই বিছানার উপরে। এত কিছু ভাবতে ভাবতে আমার মন শরীর দুটোই ক্লান্ত হয়ে এলো। ধীরে ধীরে ঘুম নামল চোখে।
বিকেলে ঘুম ভাঙল। ভাঙ্গানো হল। এবং চোখ খুলতেই দেখলাম মাঝবয়সী নার্স আমার মুখের উপর ওষুধ ধরে রয়েছেন, “ইন্দ্রদা… খেয়ে নিন।”
আমি ওষুধটা গলায় নিতেই নার্স জল ঢেলে দিল। আমি ঢোঁক গিললাম, আবার তোলার চেষ্টা করলাম, প্রথমে পা তারপর হাত। ডাক্তার আমার বেডের ঠিক পাশেই বসেছিলেন। আমার মুখের উপর প্রায় ঝুঁকে পড়ে কি যেন দেখতে দেখতে বললেন, “শুনলুম আপনি বাড়ির লোকেদের চিনতে পারছেন। তো বাড়ি যাচ্ছেন কবে?”
“সে তো আপনাদের দয়া।” আমি হাসলাম।
“আরে বলেন কি দাদা, সুস্থ মানুষকে হসপিটালে আটকে রাখে নাকি।”
“তাহলে রেখেছেন কেন?”
ডাক্তার কি যেন ভেবে বললেন, “দেখুন ওষুধ খাইয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের তো আর কাজ নেই। সেটা আপনার বাড়ির লোকেরাও পারবে, তারপর তো খালি একটু সময়ের ব্যাপার।”
“তাহলে তাই বলুন, আমার আর এখানে ভালো লাগছে না।”
ওষুধের প্লেট নিয়ে নার্স চলে গেল, বাইরে শহরের আওয়াজ খুব ক্ষীণ হয়ে শোনা যাচ্ছে, এখানে একা একা শুয়ে থাকতে থাকতে বুঝি সবকিছুরই বোধহয় বিশেষ শব্দ আছে, বাচ্চারা সন্ধ্যের মাঠ ছেড়ে সেরে, মধ্যবিত্তের বাড়িতে রাতের খাবার বানানোর তোড়জোড়, আটা মাখা, কি ভাত বসানো, ভিড়ে ভরা রাস্তার একপাশে ভিখারির ঝুলিতে পয়সা পড়ার শব্দ, এই সবকিছুই যেন এখান থেকে শুনতে পাই আমি। মনে হয় আমাকে বাদ দিয়ে বাইরের পৃথিবীটা বেশ নিজের মত করেই গড়াচ্ছে, ভালমন্দ মিশিয়ে, সুখদুঃখের মধ্যে জাগলিং করতে করতে ইচ্ছামত এগিয়ে চলেছে। বাদ পড়েছি শুধু আমি। কতদিন এই নগর জীবন থেকে দূরে থাকতে হবে জানি না। ডাক্তার অনেকক্ষণ একটানা আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, এবার একটু দম নিয়ে বললেন, “স্টিফেন হকিং-এর নাম শুনেছেন?”
আমি নিজের ভাবনায় মসগুল ছিলাম, কথাটা ভালো করে শুনতে পাইনি, মাথা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
“কে?”
“আরে হকিং, সেই বিজ্ঞানী, শরীরের প্রায় সমস্তটাই অকেজো, খালি মাথা আর হাতের একটা আঙ্গুল ছাড়া।”
“হুম, শুনেছিলাম বটে।”
ডাক্তার মাথা দুলিয়ে বললেন, “আপনার থেকেও খারাপ অবস্থা তার, তাও বছর কয়েক আগে বলেছেন কে তিনি বিশ্বাস করেন ঈশ্বর বলে কিছু নেই।”
“হুম, তো?”
“কতটা সাহস বলুন তো, আমরা একটু কঠিন রোগ হলেই ঠাকুর-ঠাকুর করি।”
“আপনিও করেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“করি বই কি, ডাক্তার বলে কি সব জেনে গেছি?”
আমার এই প্রথম হাসি পেল, বললাম, “সব যখন জানেন না তখন বিশ্বাসটাই বা করছেন কি করে?”
আমার কথা শুনে ডাক্তারও হেসে ফেললেন, “আপনি দেখছি দিব্যি তর্ক করতে শিখেছেন, এটা তো আগে ছিল না।”
আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলাম, বিছানার পাশের টেবিলে কয়েকটা ওষুধ রাখা আছে, তার সাথে দুটো ইনজেকশনের সিরিঞ্জ। ছোটবেলায় ইনজেকশন নেওয়াটা আমার কাছে বেশ ভয়ের ছিল। সেটা এখনও রয়ে গেছে। যদিও ব্যথাটা আর লাগে না। আমার চোখের দৃষ্টি লক্ষ্য করে ডাক্তার প্রশ্ন করলেন, “ওটা কীসের ওষুধ জানেন?”
আমি শিশির উপরে লেবেলটা পড়ার চেষ্টা করলাম, “সোডিয়াম থায়োপেন্টাল, নামটা শুনেছি কোথাও।”
“কোথায়?” ডাক্তারের গলাটা উৎসুক শোনাল।
“সম্ভবত এনালজেসিক, তীব্র ব্যথা কমাবার ইনজেকশন, কিন্তু ওভারডোজ হলে আর রক্ষে নেই।”
“হুম, একসময় ইউ.এস.এ.-তে ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট হিসেবে ব্যবহার হত, নাহ, আজই ওটা সরিয়ে নিতে হবে।”
“কেন বলুন তো?” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
ডাক্তার আমার কাছে আর একটু সরে এসে বললেন, “এই অপারেশনটা হওয়ার আগে আপনার মাথায় এক ভুত চেপেছিল।”
“কি?”
“আপনি বাঁচতে চাইছিলেন না।”
আমি আর কিছু উত্তর দিলাম না। ডাক্তারও চুপ করলেন। বাইরের করিডোর দিয়ে লোকজন যাতায়াত করছে, ঘরের ভিতর যন্ত্রপাতির একটানা শব্দ। মাথার উপর একই বনবনের পাখা, জানলা দিয়ে একই দৃশ্য। কোন বৈচিত্র্য নেই, আমার চোখ ফেরানর মত পাঁচটা দিক আছে, তার বাইরে কিচ্ছু নেই, গোটা পৃথিবীটা যেন চার দেওয়ালে আটকে গেছে। এভাবে কতদিন শুয়ে থাকা যায়? আমি যদি আর ঠিক না হই, একটা নারকীয় আশঙ্কা এসে আমায় চেপে ধরল।
“অত ঘাবড়াবেন না, এ ধরনের রোগে পেশেন্টকে সব থেকে বেশি লড়াই করতে হয় নিজের সাথে, যখন খুব কষ্ট হবে তখন খালি মনে রাখবেন, এ রোগে মনোবলটাই হল আসল। ওটা হারিয়ে ফেললে আর সেরে ওঠার চান্স নেই।”
ডাক্তারের কথা শেষ হতেই বাইরে থেকে নার্স আবার ঘরে ঢুকল, তারপর আমার দিকে এগিয়ে এসে মাথার কাছের যন্ত্রটায় নজর রাখতে রাখতে বলল, “আপনার বাড়ি থেকে লোক এসেছে।”
“কে লোক?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“তা তো জানিনা, তবে…”
“তবে কি?” আমি উদগ্রীব হয়ে উঠলাম, কেন জানিনা মনে হচ্ছে বাড়ির সব মানুষকে আমি আবার ভুলে যাচ্ছি, এরকম হচ্ছে কেন? আবার কি তবে…
“একটা ছোট কুকুরও আছে।”
“কি যেন নাম বলেছিল… চিনু…” আমি মনে করার চেষ্টা করলাম।
“কথা বলবেন তো?”
আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম, নার্সের সাথে ডাক্তারও বেরিয়ে গেল। বোধহয় বাইরে আমার বাড়ির লোকজনের সাথে কথা বলতে গেল। আমি চুপ করে শুয়ে থাকলাম, কিছু একটা গণ্ডগোল হচ্ছে। আমারই বাড়ির লোক কিন্তু তাও দেখা করতে ইচ্ছা করছে না আমার। উফ, কেন যে হ্যাঁ বললাম। বাইরে থেকে এতক্ষণ একটা কুকুরের ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম। এতক্ষণে সেটা একটু একটু করে কাছে আসছে। বুঝলাম তারা আমার কেবিনের দিকেই আসছে। আমি তটস্থ হয়ে শুয়ে থাকলাম। বড় করে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিলাম। মাথাটা ব্যথা করছে।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দুজন মাঝবয়সী মহিলা আমার ঘরে ঢুকলেন, দুজনকেই আমি চিনতে পারলাম, লম্বা ফর্সা ছোট-চুলের মহিলা আমার মা আর তার পাশেই আমার ছোটমাসি। প্রায় দৌড়ে তারা আমার বেডের কাছে চলে এলেন, দুজনেরই চোখে জল। আমার অস্বস্তিটা আরও বেড়ে গেল, এবার হয়ত কান্নাকাটি হবে। আমি কি উত্তর দেব? কিছুই তো তেমন মনে পড়ছে না। ছোটমাসি হাতের ব্যাগ থেকে একটা জবাফুল বের করে আমার কপালে চেপে ধরে কি যেন বিড়বিড় করতে লাগলেন, মা আমার মাথায় একটা হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ব্যথা নেই তো বাবা?”
সবাই এটাই জিজ্ঞেস করে কেন? আমি দুদিকে মাথা নেড়ে দিলাম। তিনি আর কিছু বললেন না, মাসি একমনে মন্ত্র পড়ে চলেছেন। হঠাৎ আমার মনে হল ঘরে চতুর্থ কেউ ঢুকছে। চতুষ্পদ। আমি দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা ছোট কুকুরের গলার চেন ধরে দাঁড়িয়ে আছে স্বাতী। কুকুরটা ছোট। জাতে মালতিস। বেশ বুঝতে পারলাম স্বাতীর পক্ষে কুকুরটাকে ধরে রাখা আর সম্ভব হবে না। সেটা কিন্তু আমার দিকে এখনও তাকায়নি, বরঞ্চ আমার উল্টোদিকে মুখ করে তারস্বরে ডেকে চলেছে। স্বাতী দুহাতে সেটাকে কোলে তুলে নিয়ে আমার পাশে এনে রাখল। এমনিতে মালতিস শান্ত জাতের কুকুর, কিন্তু এখন কেন জানিনা সেটা অস্থির হয়ে উঠেছে। আমি আবার হাত ওঠানোর চেষ্টা করলাম। মা কুকুরটাকে আমার দিকে ঠেলে দিতে সেটা মুখ ফিরিয়ে আমার দিকে তাকাল। তারপর সেভাবেই একটানা তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। তার লোমে ঢাকা চোখ দুটো কি যেন খুঁজছে আমার মুখে। আমি কি করব বুঝতে পারলাম না। হঠাৎ খুব হালকা স্বরে ডেকে উঠল কুকুরটা, তারপর একটু জোরে, তারপর আরও জোরে। গলার দড়িটা স্বাতীর হাতে ধরা না থাকলে হয়ত আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত। সেটা করতে না পেরে আচমকা আমার হাতের কাছটা কামড়ে ধরল। আমি অবাক হয়ে গেছিলাম। তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার বুকটা ভয়ে দুরুদুরু করতে লাগল। হঠাৎ কুকুরটা এত হিংস্র হয়ে উঠল কেন? এতক্ষণে তাকে ছাড়িয়ে নেওয়া হয়েছে। আমি নিজের হাতের দিকে তাকালাম। হাতটা কেটে রক্ত পড়ছে। অবশ্য কোন যন্ত্রণা হচ্ছে না আমার। কুকুরটার গলায় হাত বোলাতে বোলাতে স্বাতী বলল, “ এতদিন দেখেনি, তোকে ভুলে গেছে বোধহয়।”
আমার মনটা কিন্তু খচখচ করতে লাগল। কুকুর তো এত সহজে ভুলে যায় না। আমার অবশ্য তাকে মনে পড়ছে না কিন্তু একবছর আগে পর্যন্ত সে যদি আমাকে দেখে থাকে তাহলে আজও সে আমাকে চিনতে পারবে, সেটা তো হলই না উল্টো আমাকেই কামড়ে বসল সে। মা এতক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন, আমি সেদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “এরা তো বলছে ছেড়ে দেবে, আমি বাড়ি যাব কবে?”
মায়ের মুখটা একবারের জন্য গম্ভীর হয়ে উঠল। তারপর আবার জোর করে হাসি ফুটিয়ে বললেন, “এই তো কাল পরশুর মধ্যেই নিয়ে যাব, হ্যাঁ রে, বাড়ির কথা মনে পড়ে তোর?”
আমি মাথা নাড়ালাম। অবশ্য বাড়ির বাইরেটুকুই মনে পড়ে আমার। ভিতরের ঘর বা অন্যকিছুর কথা মনে পড়ে না। যাইহোক সেসব এখন আর বলতে ইচ্ছা করল না। স্বাতী আমার পায়ের কাছে বসেছিল, সে বলল, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, তোকে আর এখানে থাকতে হবে না, ডাক্তার দত্ত বলছিলেন উনি নিজেই মাঝেমাঝে গিয়ে চেক আপ করে আসবেন।”
একটা অদ্ভুত সন্দেহ আমার মনে দানা বাঁধছে। আমি ইশারায় স্বাতীকে কাছে ডাকলাম। সে আমার মুখের উপর ঝুঁকে পড়তে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “আমার হাইট কত?” প্রশ্নটা শুনে সে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর ঠোঁট উল্টিয়ে বলল, “আমি কি জানি।”
“কত মনে হয়?”
“পাঁচ আট।”
আমি আর কিছু বললাম না। পরিষ্কার মনে আছে আমার হাইট ঠিক ছফুট। কিন্তু তা কি করে হয়? আমার স্মৃতি কি আমার সাথে রসিকতা করছে? সব কিছু এত ঝাপসা, এত ছাড়াছাড়া, তাও কোথায় যেন কি একটা যোগসূত্র আছে। কিছু একটা মেলাতে পারলেই সব কিছু মিলে যাবে। ঠিক মাকড়সার জালের মত। সব কিছু ছাপিয়ে অন্য একটা ব্যাপার আমার মনে এলো। এ ঘরের সব কিছু আমার চেনা। এই পাখাটা, এই ডাক্তার, নার্স, এদের সবাইকে আমি আগে দেখেছি। কিন্তু ঠিক এইভাবেই কি? নাকি একটু অন্যভাবে। আমি চোখ বুজে আমার স্মৃতির সমুদ্রে ভাসতে থাকা ছবিগুলো খুঁটিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। হ্যাঁ, স্বাতীকে দেখতে পাচ্ছি আমি, মাকে, ছোটমাসিকে, ডাক্তার, নার্স কোথাও কোন ভুল নেই। মনের অন্ধকার ভেদ করে সব কটা ছবি পরিষ্কার ফুটে উঠছে। আমি চোখ খুলতে গিয়েও খুললাম না, আশ্চর্য! এ ব্যাপারটা এতক্ষণ মনে আসেনি! ছবিগুলোতে সবার মুখই আমি দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু তারা সবাই আমার সামনে দাঁড়িয়ে। এদের কথামত আমি একবছর ধরে শয্যাশায়ী। তবে আমার মনে যে ছবিগুলো তৈরি হয়েছে সেগুলোও তো নিচ থেকে উপরে তাকিয়ে থাকবে, অথচ সবাই যেন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তা কি করে হয়? আমি নিজেই তো একবছর হল উঠে দাঁড়াই নি। চোখ খুলে দেখলাম আমার চারপাশে সবাই বসে গল্প করছে, খোলা জানলার দিকে তাকালাম, আর সাথে সাথে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর আমার সামনে পরিষ্কার হয়ে গেল। এই জানলা দিয়ে আমি আগেও তাকিয়েছি। তবে ঠিক এই ফ্রেমে নয়, এই বেডে শুয়ে নয়। দাঁড়িয়ে… মাথার যন্ত্রণা শুরু হয়েছে… মাথার পিছনে কেউ যেন ধারালো নখ সজোরে ফুটিয়ে দিচ্ছে। আমি চীৎকার করে উঠলাম… আমি জ্ঞান হারাচ্ছি… কে আমি? আমার ক্ষীণ হয়ে আসা চিন্তাশক্তির স্তর ভেদ করে কে যেন উত্তর দিল…
রাত্রিবেলা যখন জ্ঞান ফিরল তখন ঘরটা অন্ধকার। মনে হচ্ছে কেউ যেন মাথার ভিতরের সব কিছু বের করে নিয়েছে, ফাঁকা, ভিতরে কিচ্ছু নেই। পা দুটো নাড়ানোর চেষ্টা করলাম, সাথে হাত দুটো। নড়ল না। ঘরে কেউ বসে আছে। আমার ঠিক সামনেই। অন্ধকারের ভিতর আমি ছায়ামূর্তিটা খানিকটা দেখতে পেলাম, “তোমাকে একটা কথা জানানোর আছে সোমনাথ।”
ডাক্তারের গলা। আমি চীৎকার করে উঠলাম, “কে সোমনাথ? আমার নাম ইন্দ্রনাথ দাস”
“ও হ্যাঁ, ইন্দ্রনাথ, তোমার শরীরটা ঠিক হওয়ার কোন আশা নেই।” ডাক্তারের গলা আশ্চর্য রকম শান্ত। একখণ্ড বরফের মত কথাগুলো আমার বুকের উপর আছড়ে পড়ল।
“কে বলছে?”
“বলার কিছু নেই, সবাই জানে।”
আমি চারপাশ ভালো করে ঠাউর করার চেষ্টা করলাম, ডাক্তার এখনও একই ভাবে সেই চেয়ারটায় বসে আছে, অন্ধকারে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। এবার তিনি উঠে দাঁড়ালেন, এক-পা এক-পা করে এগিয়ে এলেন আমার দিকে, আগের মতই ঠাণ্ডা গলায় বলে চললেন, “তুমি আমায় স্টিফেন হকিং-এর কথা বলেছিলে—
“আমি! শালা আপনি আমায় বলেছিলেন।” আমার গলা ফেটে উন্মত্ত চীৎকার বেরিয়ে এলো।
“তো আমি তোমাকে অন্য একটা গল্প বলি? এটা অবশ্য ওই যাকে বলে ফ্যান্টাসি নয়, একদম পাশের বাড়ির গল্প, রগরগে, নৃশংস, মানে যেমনটা হয় আর কি। স্পেনে এক ভদ্রলোক থাকতেন জান? তার নাম রামন সাম্পেদ্র। পেশায় জেলে, নেশায় কবি।
“এসব আমাকে বলছেন কেন?”
“আরে শোনোই না, জ্ঞান বাড়বে, তা একদিন হল কি রামন গেল মাছ ধরতে ক্ষীর নদীর কুলে আর উঁচু পাহাড়ের উপর থেকে পড়ে তার ঘাড় গেল মটকে, ডাক্তার বলল যে বাকি জীবনটা তার গলার নিচ থেকে শরীরটা আর নড়বে না, স্রেফ ল্যাদ খেয়ে পড়ে থাকা ছাড়া আর কিচ্ছু করতে পারবে না। মানে একদম হাগু মুতু পর্যন্ত লোকে করিয়ে দেবে, গালে মশা কামড়ালে লোকে মেরে দেবে, এমনকি কানে কেঁচো ঢুকতে দেখলেও দাঁত কেলিয়ে চুপচাপ দেখা ছাড়া উপায় নেই। ফলে রামনের হল দুক্ষু, এত দুঃখ হল যে সে বলল তাকে বিষ খাইয়ে মেরে দিতে। কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘণ্টি বাঁধবে কে, কারণ বেঁচে থাকাটা যত কষ্টেরই হোক না কেন মানুষের পক্ষে মানুষ মারাটা ঘোর অন্যায়। নরকবাস। ব্যাস! ফলে রামনকে আর কেউ মারল না, রামন বাঁচিয়া প্রমাণ করিল সে বাঁচে নাই। কিন্তু সে হাল ছাড়ল না। লড়াই চালিয়ে গেল, ওই বিছানায় হাগুমুতু করতে করতেই, তিরিশ, হ্যাঁ, তিরিশ বছর ধরে। কীসের লড়াই জান? তেমন বড় কিছু দাবি নয়। রোটি, কাপরা, মাকান কিস্যু নয়, শুধু এক ছিলিম বিষ পাশের টেবিল থেকে তুলে তার শরীরে পুশ করে দিতে হবে। বেচারা! হাত পা অসাড় হয় গেলে শহীদ পর্যন্ত হওয়া মুশকিল। যাই হোক তা তিরিশ বছর লড়াই করে শেষ পর্যন্ত বিষ খেয়ে রামন পৃথিবীর এথিকাল চিন্তাবিদদের কলা দেখিয়ে ড্যাং ড্যাং করে স্বর্গে গেল…”
ডাক্তার থামলেন। বোধহয় একটু নিঃশ্বাস নিলেন। আমি কিছু বললাম না। জানি কিছু বলেই লাভ নেই, কারণ কথা বলাটুকুই আছে আমার। এই মুহূর্তে তাতে কোন লাভ হবে না। ডাক্তার আমার হাতটা চেপে ধরলেন, “মনে পড়ছে ডাক্তার? দুদিন আগে ঠিক এই বেডটায় আমি শুয়ে ছিলাম। মরতে চেয়েছিলাম। না হয় আমার ঘুমের মধ্যেই একদলা থায়োপেন্টাল ঢুকিয়ে দিতেন মুখে, আমি সারারাত চীৎকার করেছি, যদি হাত দুটো কাজ করত তাহলে আপনার পায়েও ধরতাম। এতদিন ধরে শুধু একটাই কথা বলতে চেয়েছিলাম আপনাকে, ‘আমি বাঁচতে চাই না, ডাক্তারবাবু আমায় মেরে ফেলুন, আর পারি না, আর পারি না’। কিন্তু না, আপনি আমায় বলেছিলেন মনের জোর রাখতে, ভগবান আছে, নিশ্চয়ই কিছু ব্যবস্থা করে দেবেন, তারপর পরশু রাতের কথা মনে পড়ে ডাক্তার? শেষ প্রশ্ন করেছিলাম আপনাকে, ‘আমার জায়গায় থাকলে আপনি কি করতেন’। আপনি কি উত্তর দিয়েছিলেন মনে পড়ে? হেহে হেহে…। এখন ভাবলেও ভীষণ আনন্দ হচ্ছে জানেন? আপনিও খুশি, আমিও খুশি, কেমন অদলবদল হয়ে গেল বলুন দিকিনি, অ্যাঁ? হেঁ হেঁ… সারারাত ভগবানের কাছে শুধু এটাই চেয়েছিলাম, হয় আমাকে কাল সকালের আলো দেখিও না, না হলে ওই ডাক্তারের শরীরটা দিয়ে দাও আমাকে, আমারটা ওকে। আপনাকে কি বলব মাইরি, সকালে উঠে যখন দেখলাম আমার হাত পা নড়ছে, ভাবলাম আপনার পা চেটে ধুলো খাব, তারপর আয়নায় চোখ পড়তেই ভিরমি খাচ্ছিলাম, একটু পরে বুঝলাম শালা ভগবান আমার দ্বিতীয় ইচ্ছাটাই শুনেছেন, ভগার আজব রসিকতা মাইরি, অ্যাঁয়? হেঁহেঁ, কি বলুন?”
আমার কথা বলার শক্তিটাও যেন নিভে আসছে, শেষ চোখ পড়ল ওষুধের শিশিগুলোর দিকে, থায়োপেন্টাল। আমি সমস্ত জোর একত্র করেও হাতটা নাড়াতে পারলাম না। মুখ দিয়ে চীৎকার বেরল না। ডাক্তার একটা শয়তানি হাসি হেঁসে ওষুধের শিশিটা টেবিলের উপর একবার নাড়িয়ে আবার রেখে দিয়ে বললেন, “ভাবছি ডাক্তারি ছেড়ে অন্য কিছু করব, এই পেশাটা আর পোষাচ্ছে না, ধুসসস… এই রইল আপনার ওষুধ, এই রইল সিরিঞ্জ, নিজগুণে নিয়ে নেবেন। আমি চলি, হ্যাঁ? ও হরি, আমার নামটাই তো বলা হয়নি আপনাকে, নমস্কার, আমি ডাক্তার সোমনাথ ঘোষ।”
ডাক্তার ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আমি স্থির চোখে তাকালাম ফ্যানের ব্লেডগুলোর দিকে। তার ঠিক উপরেই প্রবল হাওয়ার দাপতে ছটফট করছে একটা মাকড়সার জাল। মাকড়সাটা কোথায়? ও হ্যাঁ, সেটা ধীরে ধীরে জাল বেয়ে নেমে আসছে আমার মুখের উপর। আমি হাত নড়ানোর চেষ্টা করলাম…
Tags: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর), প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, মাকড়সার জাল, সায়ক আমান