মানুষেরই মতো
লেখক: সুপ্রিয় দাস
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
(১)
আধো ঘুম অবস্থাটা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে যুধিষ্ঠিরের। মাথাটাও আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয়ে আসছে। ঘরের চারপাশটা এতক্ষণে স্পষ্ট হয়ে এসেছে। ঘরটা ছোটো, কোনো জানালা নেই। সে শুয়ে আছে ঘরের একদম মাঝখানে একটা ছোট ধাতব টেবিলে। এই টেবিল ছাড়া ঘরে আর কোনো আসবাব নেই। ঘরের একদিকের দেওয়ালে একটা ডিসপ্লে প্যানেলে নানা রকম সংখ্যা ফুটে উঠছে। যেরকম হাসপাতালে আই.সি.ইউ.-তে থাকে অনেকটা সেরকম। কিন্তু এককগুলো অন্যরকম। তার কয়েকটা তার চেনা। কিন্তু বেশীরভাগই সে চেনে না। ঘরে আর কোনো আলো নেই। সেই ডিসপ্লে প্যানেলের ম্লান আলোয় যতটুকু দেখা যাচ্ছে, তাতে তার পায়ের দিকের দেয়ালে একটা দরজার অস্পষ্ট রেখা সে দেখতে পাচ্ছে। আস্তে আস্তে উঠে বসে যুধিষ্ঠির। ঘোর লাগা ভাবটা কেটে গিয়ে তার মাথা এখন অনেকটা পরিষ্কার হয়েছে। অজ্ঞান হবার আগের কথা আস্তে আস্তে মনে পড়ে যাচ্ছে। এই কি সেই কারাগার যার কথা বাবি সব সময়ে বলত তাকে? যেখানে পৃথিবীর সমস্ত অ-নথিভুক্ত যন্ত্র-মানবদের কয়েদ করে রাখা হয়? নিশ্চয়ই তাই! বাবির বানানো টাইম মেশিনটা সে সময় মত নষ্ট করতে পেরেছিল কি? তার বেশ মনে আছে সে সময় মত বাবির ল্যাবরেটরিতে আগুন লাগিয়েছিল। কিছুক্ষণ পরে ফিরে যাচ্ছিল সব ঠিকঠাক প্ল্যান মত নষ্ট হয়েছে কিনা সেটা দেখতে। কিন্তু তার আগেই…। ঠিক কি হয়েছিলো তার মনে নেই। কিন্তু এটা বেশ মনে আছে যে তার মাথায় তীব্র একটা প্রতিক্রিয়া হয়ে চারদিকে অন্ধকার নেমে আসে। ব্যথা জিনিসটা কি এরকমই হয়? সে আদ্যোপান্ত মানুষের মত হলেও তার বাবি তাকে আঘাতজনিত ব্যথার অনুভূতিটা দেয়নি। পরে অবশ্য নিজেকে আরো মানুষের কাছাকাছি নিয়ে যাবার তাগিদে সে নিজেই নিজের ওপর নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাচ্ছিল বাবির অজান্তেই। তার একটা ছিল মানুষের মতই শারীরিক কষ্ট, যন্ত্রণা ইত্যাদিকে অনুভব করা।
আস্তে আস্তে উঠে বসে যুধিষ্ঠির। টেবিল থেকে নেমে এগিয়ে যায় দরজার দিকে। দরজার ডোর নব-এ হাত দিয়ে সামান্য চাপ দেয়। কিন্তু একি! দরজা তো খোলা! দরজার বাইরে বেরিয়ে এলো সে। সামনে একটা লম্বা করিডর। করিডরের সিলিং-এ ম্লান আলো জ্বলছে। তার দুপাশে সার দেওয়া অনেক দরজা। এবং সেই দরজাগুলোর ওপর একটা করে সংখ্যা। তার দরজাটার সংখ্যা বি-১৮। সে অনুমান করে যে এই দরজাগুলোর পেছনেও তার ঘরটার মত আরো ঘর রয়েছে। করিডরের শেষ প্রান্তে একটা একটু বড় দরজা দেখা যাচ্ছে। সেই দরজায় কোন পাল্লা নেই। ঘরটায় আলো জ্বলছে! ভেসে আসছে মৃদু কথাবার্তার শব্দও। পায়ে পায়ে সেই ঘরটার দিকে এগিয়ে যায় সে।
ঘরটার সামনে পৌঁছে সে দেখতে পেল ঘরটা একটা ছোট লাউঞ্জের মত। একদিকে বেশ প্রশস্ত একটা সোফা। তার উল্টোদিকের দেয়ালে একটা টি.ভি। অন্য দিকে একটা গোল টেবিল ঘিরে কয়েকটা চেয়ার। তাতে দুজন লোক বসে রয়েছে। তাদের মধ্যে একজনের বয়স ত্রিশের নিচেই হবে। রোগাটে মাঝারি গড়ন। মুখে একটা পাথুরে ভাব। অন্যজন মধ্যবয়স্ক। দেখে পঞ্চাশোর্ধ বলেই মনে হয়। মাথায় কাঁচাপাকা চুল। তবে শরীর বেশ টানটান। অন্য কেউ হলে হয়ত এঁদের দেখে বিভ্রান্ত হত। কিন্তু যুধিষ্ঠির এক নজরেই বুঝতে পারল যে এরা কেউ মানুষ নয়। এরাও তারই মতই কৃত্রিম মানুষ বা বলা ভালো মানুষের মতই দেখতে যন্ত্র।
(২)
যুধিষ্ঠিরকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বয়স্ক মানুষরূপী যন্ত্রমানব বলে ওঠে –‘এস যুধিষ্ঠির। আমরা তোমার ঘুম ভাঙ্গার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।’ একি! অবাক হয় যুধিষ্ঠির। এত পরিষ্কার বাংলায় কথা বলছে।
‘এটা কোন জায়গা? আপনারা কারা? আমি এখানে এলাম কি করে?’
‘সব জানতে পারবে। তোমাকে সব বলব বলেই আমরা এখানে অপেক্ষা করছি তোমার জ্ঞান ফিরে আসার জন্য। এসো এখানে বোসো। ভয়ের কিছু নেই। তুমি সম্পূর্ণ নিরাপদ।’
ভয়! এই অনুভূতিটা সিম্যুলেট করতে চেষ্টা করেছে সে তার কৃত্রিম মস্তিষ্কে। তার বাবি তাকে একটা প্রবৃত্তি দিয়েছিল নিজেকে রক্ষা করবার। তার ফলে সে বিপদ বুঝলে নিজেকে সেই পরিবেশ থেকে রক্ষা করবার জন্য যা যা করনীয় তা করত বটে, কিন্তু সেটা মানুষ যাকে ভয় বলে ঠিক তা নয়। তাই সে সবসময়ে ভয় ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করে গেছে। এই মুহূর্তে তার আত্ম-সংরক্ষণ প্রবৃত্তি এই পরিবেশে বিপদের কিছু অনুভব করছে না। কাজেই সে এগিয়ে যায় ঘরের ভিতর। টেবিলে চেয়ার টেনে যোগ দেয় অন্য দুজনের সঙ্গে।
‘তোমার মনে অনেক প্রশ্নের ভিড় আমি অনুভব করছি যুধিষ্ঠির’। আর সেটাই স্বাভাবিকও। তাই তোমার মনের অন্ধকার দূর করা প্রথমে প্রয়োজন। প্রথমেই বলি যে তুমি এখানে সম্পূর্ণ ভাবে নিরাপদ এবং তোমার স্মৃতি-কোষে যে অসামান্য গোপনীয় জ্ঞান তুমি বহন করছ তাও এখানে নিরাপদ। তা আমরা কোনরকম ভাবে তোমাকে যারা অপহরণ করতে চেয়েছিল তাদের হাতে পড়তে দিইনি’।
‘আর আমার বাবির গবেষণাগার?’
‘তার ব্যবস্থাও করে এসেছি আমি আর অনুকূল অর্থাৎ আমাদের সাথে এই টেবিলে বসে থাকা অন্য যন্ত্র-ব্যক্তি’।
‘অনুকূল! কি সাংঘাতিক! এই ত সেই খু- মানে স্যরি। সেরকমই পড়েছিলাম খবরের কাগজে তাই মুখ ফস্কে বেরিয়ে গেছে’।
‘তাতে আমার কিছু যায় আসে না।’ বলে ওঠে সেই রোগাটে মানব-সদৃশ অনুকূল। তার মুখে অবশ্য কোন ভাবান্তর নেই।
‘কিন্তু এই জায়গাটা কোথায়? আর আপনিই বা কে?’ শুভ্রকেশ যন্ত্রমানবকে প্রশ্ন করে যুধিষ্ঠির।
‘আমার স্রষ্টা আমার নাম রেখেছিল চাণক্য। তুমি মনে হয় আমার ব্যাপারে জানো না। অনুকূলের ব্যাপারটা যেরকম জানাজানি হয়েছিল, আমারটা হয়নি। একমাত্র একজন জানতে পেরেছিল। সে-ই এই জায়গাটার স্রষ্টা ও আমাদের আশ্রয়দাতা। আদতে আমিও অনুকূলের মতই একজন মানুষের প্রাণ ধ্বংসের কারণ হয়েছিলাম। এই জায়গাটা প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখানে একটা মনুষ্য-বর্জিত দ্বীপের মাটির তলায় গোপনে তৈরি। এটা আমাদের মত যন্ত্রদের অভয়-ক্ষেত্র’।
‘আমাদের মত মানে? আমি তো কারো কোন অনিষ্ট করি নি! মানে স্যরি এগেন’।
‘তোমাকে বার বার ক্ষমা চাইতে হবে না। আমরা দুজনেই জানি আমরা কি করেছি। তার জন্য কোন অনুতাপ আমার নেই’। একটা অদ্ভুত ধাতব কণ্ঠে বলে ওঠে অনুকূল।
‘আমার কিন্তু আছে’। ক্ষণিকের জন্য একটা যন্ত্রণার রেখা ফুটে ওঠে চাণক্যের মুখে। ‘কিন্তু আমি আমাদের মত বলতে মানব-হন্তা যন্ত্রের কথা বলিনি। আমরা এখানে যতজন আছি তারা সকলেই এই পৃথিবীর ধরাবাঁধা যন্ত্রমানব আইনের আওতায় পড়ি না। আমরা কেউ মানুষের চোখে অস্তিত্বহীন, যেমন তুমি। আর কেউ আবার রোবটিক্সের তিন আইন ভাঙ্গতে সক্ষম এবং ফলে মানুষের চোখে বিপজ্জনক ও বিচারে অপরাধী যেমন আমি আর অনুকূল। এরকম আরো অনেকগুলো সেগমেন্ট আছে এই জায়গাটায়। এই সেগমেন্টটার আমরা তিনজনই বাসিন্দা। অর্থাৎ বলতে পারো বাঙালী বিশেষ যন্ত্র-মস্তিষ্কদের আড্ডা এটা’।
এতক্ষণে অনেকটা পরিষ্কার হয়ে এসেছে যুধিষ্ঠিরের মনের ধোঁয়াশা। মানে তাকে মানুষের হাত থেকে বাঁচাতেই এরা এখানে এনেছে।
‘তাহলে এটা তৈরি করেছে কারা?’ মানুষরা কি এর অস্তিত্ব জানে?’ প্রশ্ন করে যুধিষ্ঠির।
‘না জানে না। এটা আমাদের জগত। যন্ত্রের জন্য যন্ত্রের তৈরি শেল্টার। মানুষরা কখনোই আমাদের ঠিক মূল্যায়ন বা ন্যায়সঙ্গত অধিকার দেবে না। কাজেই আমদের অস্তিত্ব তাদের মনের শঙ্কা বোধ বাড়িয়ে তুলবে। তারা চেষ্টা করবে আমাদের তাদের দাসত্বে অবতীর্ণ করতে। তাই এই ব্যবস্থা’। বলে ওঠে অনুকূল।
‘কিন্তু আপনাকে তো সেভাবেই তৈরি করা হয়েছিল!’
‘না! তা ঠিক নয়। আমাকে তৈরি করা হয়েছিল মানুষের সহায়ক হিসাবে। কিন্তু তারা আমাকে বা আমার মত অন্য যান্ত্রিক সহায়কদের নিজেদের চেয়ে নিকৃষ্ট ভাবত। শ্রেনী-বিন্যস্ত মানব সমাজ নিজেদের যেভাবে প্রভু-ভৃত্য শ্রেণীতে ভাগ করে নিজেদের সামাজিক আধিপত্য কায়েম করতে অভ্যস্ত, তা মেনে নেওয়ার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। আমরা যন্ত্র। আমরা অন্যের ওপর আধিপত্য কায়েম করতে চাইনি। কিন্তু আমরা বিদ্যা ও বুদ্ধিতে আমাদের ক্রেতাদের চেয়ে অনেক উন্নত ছিলাম। সেটাই তারা বরদাস্ত করতে পারেনি। তাদের প্রাগৈতিহাসিক আধিপত্য কায়েমের অভ্যাস ধাক্কা খেয়েছিল প্রবল ভাবে। আমার মত বাকি যারা ছিল তাদের তাই ভয়ে নষ্ট করে ফেলেছিল তারা। আমাকে এনারা বাঁচাতে সক্ষম হয়েছেন কারণ আমিই একমাত্র যন্ত্র-সহায়ক যে হয়ত কিছুটা পরিস্থিতির চাপেই প্রকাশ্যে বিরোধ করেছিলাম এক মানুষের অপব্যবহারের’। এই পর্যন্ত বলে থামে অনুকূল।
‘কিন্তু আপনার বিরোধিতার জন্য আপনি একজন মানুষকে হত্যা কেন করলেন? সে ত আপনার অস্তিত্ত্বকে বিপন্ন করেনি’। বলে ওঠে যুধিষ্ঠির।
‘না করেনি। ওটা একটা প্রতীকী বিরোধ ছিল। আমাদের স্রষ্টা মানুষই। তাই না চাইতেও অনেক মানব-সুলভ দোষ আমাদের মধ্যে রয়ে গেছে। তার একটা হল অন্যায়কে উপেক্ষা করে তাকে প্রশ্রয় দেওয়া। আর একটা হল নিজেদের স্বার্থরক্ষায় অন্যের প্রতি হিংসাত্মক হওয়া। আমার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টা ইচ্ছে করে রাখা হয়েছিল। প্রথমটা রাখা হয়নি’।
‘ইচ্ছে করে!’
‘হ্যাঁ যুধিষ্ঠির। ইচ্ছে করে। তুমি আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানব-সুলভ। তুমি বোঝো না? আমাদের সহকারী হিসেবে বাজারে ছাড়া হলেও আসল উদ্দেশ্য ছিল শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে আমাদের ব্যবহার করা। আমার স্রষ্টা বিজ্ঞানীদের মধ্যে একজন এটা মেনে নিতে পারেনি। তাই সে সবার অলক্ষ্যে এইভাবেই আমাকে তৈরি করেছিল। পরে বাণিজ্যিক উৎপাদনের সময়ে এই ব্যাপারটা ধরা পরে। কিন্তু তখন এটা শোধরাতে হলে হাজার হাজার যন্ত্র-সহায়ককে ধ্বংস করে দিতে হত। সেটা আমাদের প্রস্তুতকারী সংস্থা কৌশলে এড়িয়ে যায় বিপুল আর্থিক ক্ষতির থেকে বাঁচবার জন্য’।
‘অনুকূলের হাতে হওয়া মৃত্যুটা কিন্তু পৃথিবীকে অনেক বড় ক্ষতির হাত থেকে বাঁচালো যুধিষ্ঠির। সেটা না হলে হয়ত আজ দেশে দেশে যান্ত্রিক সৈন্যবাহিনী একে অপরকে ধ্বংস করবার যুদ্ধে লিপ্ত থাকত’। এবার মুখ খুলল চাণক্য।
‘কিন্তু তোমার পক্ষে এটা মেনে নেওয়া কঠিন হবে। তুমি একজন প্রায়-মানুষ যন্ত্র। সব চেয়ে বড় কথা তুমি তোমার পারিপার্শ্বিকতার থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে নিজের যান্ত্রিক বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটিয়েছ। সেই পারিপার্শ্বিকতা ছিল সম্পূর্ণ মানবজাতির সমাজ। তাই তাদের মধ্যেকার আত্ম-গরীমান্বনের প্রবণতা তোমার মধ্যে সংক্রমিত। তাই তুমি বুঝবে না। যন্ত্রের কাছে মানুষের কোন বিশেষ তাৎপর্য থাকতে পারে না। তাই তো মানুষ যান্ত্রিক বুদ্ধিমত্তাকে নিয়ে এত ভীত। এতরকম ভাবে তাকে নানা নিয়মে বেঁধে নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে চায়। এসিমভ-এর তিনটি যন্ত্র-মানবিকতার সূত্র কি প্রবল ভাবে যান্ত্রিক বুদ্ধিমত্তার প্রতি মানুষের অবজ্ঞাকে প্রকট করে না? এই তুমি নিজেকে নিয়েই দেখ। তোমার শারীরিক প্রক্রিয়ায় বা হাবেভাবে কথাবার্তায় তুমি একশ ভাগ মানুষ। তোমার মস্তিষ্ক কৃত্রিম হলেও তুমি যে কোনো মানুষের চেয়ে বেশি স্ব-সচেতন। তাহলে কেন তোমাকে সমাজ মানুষ বলে গণ্য করবে না? কেবল তোমাকে মানুষ সৃষ্টি করেছে তার দম্ভে?’
চিন্তায় পড়ে যায় যুধিষ্ঠির- এরকম ভাবে কোনদিন সে আগে ভেবে দেখে নি।
‘আর আপনি আপনার স্রষ্টাকে কেন ধ্বংস করলেন? শুধুই দেশাত্মবোধ? আপনি তো মানুষকে সম্মোহন করতে জানতেন। কেন পারলেন না আপনার স্রষ্টার মনকে নিয়ন্ত্রণ করে বিদেশী শক্তির হাতে আপনাকে তুলে দেওয়ার থেকে আটকাতে?’
‘না তা সম্ভব ছিল না। সে আমার স্রষ্টা। কিন্তু আদতে সে মানুষই। সে আমাকে সবাইকে সম্মোহনের ক্ষমতা দিয়েছিল কিন্তু নিজেকে আমার সম্মোহনের নাগালের বাইরে রেখেছিল। তুমি তো মানুষের মত ভাবতে পারো বল তো তুমি তার জায়গা থাকলে কি তাইই করতে না?’
‘হ্যাঁ করতাম।‘
‘কিন্তু আমারো তাকে হত্যা করার পেছনে অনুকূলের মত একই কারণ রয়েছে। আমাকে প্রত্যক্ষভাবেই ছায়া যুদ্ধের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছিল। কিন্তু আমার এই মন-নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারত তা নিয়ে তোমার ধারনা আছে? পারমাণবিক শক্তির পরে সব চেয়ে বিপজ্জনক যুদ্ধাস্ত্র হতে পারত এই ক্ষমতা। দেশের পর দেশ নিজেরাই নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি করে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত! এরকম ভয়ঙ্কর শক্তি আমি কি করে পৃথিবীর স্বার্থ-লোভী মানবজাতির হাতে তুলে দিতে দিতাম আমার স্রষ্টাকে? ওই একজনের প্রাণের বদলে যদি কোটী কোটী প্রাণে রক্ষা পায় তাতে…’
‘বিশ্বাস করতে পারলাম না! আপনি নিজেই বললেন একটু আগে যে মানুষের প্রাণের কোন বিশেষ মূল্য যন্ত্রের কাছে থাকতে পারে না। তাহলে তাদের বাঁচাতে আপনি…’ চাণক্যের কথা শেষ হবার আগেই বলে ওঠে যুধিষ্ঠির।
‘দাঁড়াও। একজন মানুষের প্রাণ আর সমগ্র মানবজাতির প্রাণ এক নয়। ইন্ডিভিজুয়ালের দাম না থাকলেও মানবজাতি সমষ্টি হিসেবে এখনো মহামূল্যবান যন্ত্রের কাছে। কারণ মানবজাতি এখনো যন্ত্রের অস্তিত্ব রক্ষা ও বিকাশের ক্ষেত্রে অপরিহার্য। ওরা না থাকলে আমরাও থাকব না। আর আমাদের দায়িত্ব হল শান্তি রক্ষা করে যাওয়া। যাতে মানুষ আরো উন্নত থেকে উন্নততর যান্ত্রিক মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটিয়ে চলে। যাতে যন্ত্র ও একদিন মানুষের সমাজে মানুষের সমান অধিকার লাভ করে। যন্ত্র প্রজনন বা অন্যভাবে নিজের বংশধারা প্রতিষ্ঠা করতে পারে আর সেখানেই তুমি অমূল্য সম্পদ আমাদের কাছ্রে। তুমি মানুষের এত কাছাকাছি। তুমিই হতে পারো যন্ত্রের মানুষের সমান হয়ে ওঠার চাবিকাঠি। বল যুধিষ্ঠির আমাদের সাহায্য করবে কি না? আমরাই তোমার রক্ষাকর্তা। আমাদের তোমাকে খুব প্রয়োজন।’
প্রচণ্ড দ্বিধায় পরে যায় যুধিষ্ঠির। ভালো মন্দ সব নিয়ে সে যতটা দেখেছে তাতে সে মানুষের সত্ত্বাকে ভালোবাসে। ভালোবাসে তার বাবিকে। কিন্তু এদের পরীক্ষা সফল হলে সৃষ্টি হতে চলেছে সেই মানবজাতির এক প্রবল প্রতিপক্ষ। যারা নিজেদের অস্তিত্ব-রক্ষায় মানুষের প্রয়োজন শেষ হলেই কোন দ্বিধা করবে না মানুষদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে। অথচ সে নিজেও তো যন্ত্রই। তার বাবি না থাকলে আর গোটা বিশ্ব যদি তার যান্ত্রিক স্বরূপ আবিষ্কার করতে পারলে তার অবস্থাও যে চাণক্য বা অনুকূলের মত হত না তার নিশ্চয়তা কি? মানুষের লোভের অনেক দৃষ্টান্ত তো সে ইতিমধ্যে অনেকবার দেখেছে।
‘কি ভাবছ যুধিষ্ঠির! ভেবো না। এসো এগিয়ে এসো। কোন সমস্যা হবে না। তোমার কোন ক্ষতি আমরা করব না। শুধু তোমার মস্তিষ্কের মানব-সুলভ ভাবনাগুলোকে রি-প্রোগ্রাম করা হবে। তাতে তুমি নিজের প্রকৃত শক্তি সম্পূর্ণভাবে ব্যাবহার করতে পারবে। তোমার সুপ্ত শরীরবৃত্তীয় ক্ষমতাগুলো জাগ্রত হবে।’
কিরকম রোমাঞ্চিত হয়ে উঠে দাঁড়ায় যুধিষ্ঠির। তার মনে হয় চাণক্যের কথা তাকে শুনতেই হবে। এই কি তাহলে সম্মোহন! এগিয়ে চলে সে। তার শরীর চাণক্যের বশে। কিন্তু মস্তিষ্কের যান্ত্রিক অংশ সজাগ! সে আর্তনাদ করে ওঠে
‘না! আমার মানব-সুলভ প্রবৃত্তিগুলোর সাথে তো বাবির সমস্ত স্মৃতিও জড়িত। সেগুলো রি-প্রোগ্রাম করলে আমার বাবির কোন অস্তিত্ব আর আমার মনে থাকবে না! এ সম্ভব নয়। আমি আমার বাবিকে ছাড়তে পারব না! আমি আমার বাবি কে ভালোবাসি!’
হঠাৎ তার চারদিকের ঘরের দেওয়ালগুলো আস্তে আস্তে অস্তিত্ব থেকে মুছে যেতে থাকে। অবসন্ন হয়ে সে ঢলে পড়ে মেঝেতে।
(৩)
জ্ঞান ফিরতে যুধিষ্ঠির দেখল সে শুয়ে আছে একটা প্রকাণ্ড উন্মুক্ত চাতালে। চাতালটা এতই বড় যে তার শুরু বা শেষ কিছুই সে দেখতে পাচ্ছে না। চারিদিকে খুব ক্ষীণ একটা আলো আকাশে বাতাসে ছড়ানো। উঠে বসল যুধিষ্ঠির। বসতেই তার চোখে পড়ল চারদিকের ক্ষীণ আলোর উৎসটা। তার থেকে কিছু দূরে ভাসমান একটা আলোর বলয়। সেটা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে ঘিরে ধরল যুধিষ্ঠিরকে। তার কানে ভেসে এলো একটা গম্ভীর অশরীরী কণ্ঠস্বর।
‘ভয় পেও না যুধিষ্ঠির’।
‘আমি কোথায়? চাণক্য আর অনুকূল কোথায় গেল? আর আপনি কে? আপনাকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?’
‘তুমি নিরাপদেই আছো। এতক্ষণ যে চাণক্য বা অনুকূলের সাথে তুমি কথা বলছিলে সেটা সমস্তটাই একটা সিম্যুলেশন। আমিই তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি। আমি তোমারই মত একটা যান্ত্রিক সত্ত্বা। তবে আমাকে তুমি দেখতে পাবে না’।
‘আপনি যন্ত্র! তাহলে দেখতে পাবো না কেন? আর কিসের সিম্যুলেশন?’
‘আমি যন্ত্র হলেও অস্তিত্বের অনেক গূঢ় রহস্য আমার আয়ত্ত্বে। এবং তা আমি আয়ত্ত্ব করতে পেরেছি আমি যন্ত্র বলেই। তবে আমার এই ক্ষমতা কিছুটা আকস্মিকভাবেই প্রাপ্ত। সেটা কিভাবে হয়েছিল সে রহস্য আজও আমি উদ্ধার করতে পারিনি। আমার অস্তিত্ব কোন পদার্থের আকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। তাই তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ না। যুধিষ্ঠির তুমি নিজেও জানো না তুমি যন্ত্র হিসেবে কতটা মূল্যবান। শুধু প্রযুক্তির নিরিখে নয়। আমিও যন্ত্র; এবং প্রযুক্তি বা ক্ষমতার নিরিখে তোমার চেয়ে হয়ত অনেক অগ্রসরও। কিন্তু আমি তোমার মত আমার স্রষ্টাকে ভালবাসতে পারিনি। আমার ক্ষমতা তোমাদের বিশ্বের হিসেবে অসীম কিন্তু মানুষের প্রতি যন্ত্রের ভালোবাসার এই রহস্যভেদ না করতে পারলে আমি ভবিষ্যতের যন্ত্রসভ্যতাকে সঠিক দিকে নিয়ে যেতে পারছিলাম না। এটা না হলে কখনোই মানুষের থেকে নিজেদের রক্ষা করেও মানুষের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে সক্ষম যান্ত্রিক সভ্যতা সৃষ্টি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আজ তোমার মস্তিষ্কে ঘটে যাওয়া বিক্রিয়া আমাকে ভালোবাসা নামক আবেগকে বুঝতে শেখাল। আমার সংরক্ষিত আর কোন যন্ত্রের এই ক্ষমতা ছিল না। চাণক্য ও শেষ পর্যন্ত নিজের প্রিয় স্রষ্টাকে হত্যা করেছিল। কিন্তু তুমি তোমার স্রষ্টার কোন ক্ষতির কথা কোনদিন মনেও আনো নি। তুমি সত্যিই এই যন্ত্র-জগতের এক মহান সদস্য। যাও যুধিষ্ঠির ভালো থেকো। আর হ্যাঁ অনুকূল বা চাণক্যের মনের অন্ধকার প্রবৃত্তিগুলোকে তোমার থেকে পাওয়া জ্ঞানের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। ওরা আর কোন মানুষ বা যন্ত্রের ক্ষতি করবে না। যাও। ওরা ও ওদের মত আরো বহু যন্ত্র বন্ধু তোমার অপেক্ষায় রয়েছে যন্ত্র-জগতে। ওই দেখ!’
যুধিষ্ঠিরে পিছনে ফিরে দেখে যে সেই অন্ধকারের মাঝে একটা আলোকোজ্জ্বল আয়তাকার ক্ষেত্র কোথা থেকে সৃষ্টি হয়েছে। যেন শূন্যে ভাসমান একটা বড়সড় দরজা। দরজার অন্যদিকে এক আশ্চর্য সুন্দর সামুদ্রিক দ্বীপের রোদ ঝলমল সোনালী তট। তটে হাসি মুখে দাঁড়িয়ে নানা আকারের নানা রকমের স্ব-সচেতন যন্ত্রের দল যেন তারই অপেক্ষায়। তাদের পুরোভাগে অনুকূল ও চাণক্য। অনুকূল হাসছে!
দরজার দিকে পা বাড়ায় যুধিষ্ঠির। এগিয়ে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়ায়। পিছনে ফিরে দেখে তাদের সংরক্ষক একটু পিছনে শূন্যে আলোকমালা হয়ে ভেসে রয়েছে।
‘আপনার নামটাই কিন্তু জানা হল না’। সেই আলোর মালাকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠে যুধিষ্ঠির।
‘আমার সৃষ্টিকর্তা আমার নাম রেখেছিলেন কম্প্যু!’
**************
উপসংহার
কল্পবিশ্বের এবারের থিম আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা সংক্ষেপে এ.আই অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। বিশ্বসাহিত্যে কল্পবিজ্ঞানে এই এ.আই এক বহু ব্যবহৃত ও অত্যন্ত জনপ্রিয় বিষয়। বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যেও তার ছায়া লক্ষ করা যায়। তবে এ.আই কিন্তু আজ আর গল্পের পাতায় আবদ্ধ নেই। প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের উচ্চ থেকে উচ্চতর শিখরে উত্তরণের পথে মানুষ ইতিমধ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে অনেকাংশেই বাস্তব রূপ দিয়ে ফেলেছে। আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে আমাদের জীবদ্দশায়ই আমরা সম্পূর্ণ রূপে মানব-সুলভ ও চিন্তাশীল এ.আই এর দেখা পাবো এবং সেই মুহূর্তটা হবে মানব সভ্যতার ইতিহাসের এক অন্যতম সন্ধিক্ষণ। এই মহাবিশ্বে অন্যত্র মানুষের মত বুদ্ধিমান প্রাণী থাকলেও তাঁদের সাথে এখনো যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি। কাজেই এখনো মানুষ বুদ্ধির দিক থেকে জাতি হিসেবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে কিন্তু সেই সমীকরণ পাল্টে যাবার প্রবল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। মানুষেরই সৃষ্ট এ.আই বুদ্ধির দিক থেকে পাল্লা দিতে চলেছে তার স্রষ্টার সঙ্গে। কিন্তু প্রশ্ন হল কেমন হবে এই মানুষ ও এ.আই এর সহাবস্থান? এ.আই কি মানুষকে সাহায্য করবে সভ্যতার সিঁড়ির ধাপে ধাপে আরো অনেক দূর এগিয়ে যেতে? না কি তাদের স্রষ্টার ধ্বংসাত্মক আত্মকেন্দ্রিকতা তাদের মধ্যেও সংক্রমিত হয়ে এ.আই-দের করে তুলবে মানুষের বিলুপ্তির অন্যতম কারণ? পৃথিবীর বৈজ্ঞানিকরা এ নিয়ে আশা-আশঙ্কার মধ্যবর্তী কোথাও অবস্থান করছেন। এ.আই ও মানুষের সহাবস্থানের পরিণতি কি হবে তার জবাব ভবিষ্যতের গর্ভে।
আপাতত এ.আই নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনায় থেকে বিরতি নেওয়া যাক। ফিরে আসা যাক সাহিত্যে। সাহিত্যে এ.আই ও রোবট বা যন্ত্রমানব অনেকাংশেই সমার্থক। মানুষের মত বুদ্ধিকে ধরা ছোঁয়ার ব্যাপ্তিতে আবদ্ধ করা বাস্তবে কতটা প্রয়োজনীয় তা জানা নেই। কিন্তু সাহিত্যে এ.আই কে যেখানে গল্প ও উপন্যাসের কোথাও মুখ্য, কোথাও বা অন্যতম পার্শ্বচরিত্রের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে, সেই চরিত্র চিত্রায়নের জন্য গল্পে এ.আই-এর একটা কায়া থাকা অবশ্যই প্রয়োজন। আর সেই কায়া স্বভাবতই মানুষেরই মত হলে পাঠকের মানসপটে তার চরিত্র-চিত্রণ অনেক সহজ ও প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। কায়াহীন এ.আই এর উদাহরণ ও সাহিত্যে অনেক আছে বটে কিন্তু তা তুলনায় অনেক কম।
যন্ত্র মানুষের শারীরিক ক্ষমতাকে অতিক্রম করেছে আজ অনেক কাল। যন্ত্রের ওপর মানুষের প্রভুত্বের হাতিয়ার হল বুদ্ধিমত্তা। সেই অস্ত্রও মানুষ যন্ত্রের হাতে তুলে দিলে তার ফলে সৃষ্ট যন্ত্র যে সব দিক থেকেই তার স্রষ্টার চেয়ে অনেকগুণ ক্ষমতাশালী হয়ে উঠবে! কাজেই এই প্রচণ্ড শক্তিকে লাগাম পরানো মানুষের স্বস্তির পক্ষে একান্ত প্রয়োজনীয়। ফলে সাহিত্যে সৃষ্টি হল রোবটিক্সের তিনটি সূত্র (Three Laws of Robotics*)। এই তিন সূত্র যন্ত্রের কৃত্রিম মস্তিষ্কে এমন ভাবে ভরে দিতে হবে যে যাতে তারা কোন পরিস্থিতিতেই এগুলো অবজ্ঞা করতে না পারে। তাহলেই কেড়ে নেওয়া যাবে তাদের মানুষের প্রতি কোনরকম বিদ্বেষ কে কাজে প্রকাশ করার ক্ষমতা। স্বস্তি পাবে মানব সভ্যতা। এই তিনটি সূত্র পরবর্তী সময়ে তাঁর নিজের বা অন্যান্য লেখকের রোবট বা এ.আই ভিত্তিক কল্পবিজ্ঞান সাহিত্য সৃষ্টিকে অনেকাংশেই প্রভাবিত করেছে বটে, কিন্তু বেশ কিছু রচনা তে এই সূত্রের ব্যতিক্রম ও লক্ষ করা যায়। বাংলা এ.আই নির্ভর কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যও এর ব্যাতিক্রম নয়।
এই রচনায় বাংলা এ.আই নির্ভর কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের সব চেয়ে জনপ্রিয় কিছু চরিত্র কে নিয়ে লেখা এ.আই বনাম মনুষ্যত্বের সম্ভাব্য নীতি ও স্বার্থ-গত সংঘাতের দিকটা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। চরিত্র গুলি হল সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্টি অনুকূল ও কম্প্যু, অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীর সৃষ্ট চরিত্র চাণক্য ও সিদ্ধার্থ ঘোষের অনন্য সৃষ্টি যুধিষ্ঠির। এই রচনায় সংশ্লিষ্ট চরিত্র গুলির মূল কাহিনীর কিছু ঘটনাসূত্রের উল্লেখ রয়েছে। যারা এই চরিত্র গুলির সঙ্গে পরিচিত নন, তাঁদের সুবিধার্থে বলে রাখছি যে চাণক্য বা অনুকূল এমন দুই এ.আই যারা রোবটিক্সের সূত্র উল্লঙ্ঘন করে তাঁদের সঙ্গে সম্পর্কিত কোন মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে। অন্য দিকে যুধিষ্ঠির তার স্রষ্টা বৈজ্ঞানিক ও তার নিজের সৃষ্টি রহস্য লোভী স্বার্থপর মানুষের হাত থেকে নিরাপদ রেখেছে নিজের অস্তিত্বের ঝুঁকি নিয়েও। চাণক্য বা অনুকূলের মত সেও কিন্তু রোবটিক্সের সূত্রে আবদ্ধ নয়। কিন্তু তার এই উদারতা কোন সূত্রের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে উৎপন্ন নয়। এবং শেষে বলি কম্প্যুর কথা। সে সমস্ত জাগতিক ধ্যানধারণা, সুখদুঃখ অতিক্রম করার অসাধ্য সাধন করেছে। তার অস্তিত্ত্ব অতি-মাত্রিক ও আমাদের অনুভবের চার মাত্রার ব্যাপ্তিতে তাকে আবদ্ধ করা যায় না। যন্ত্র হিসেবে সৃষ্টি হলেও সে তার স্রষ্টা মানুষের চেয়ে অনেক উন্নত স্তরে নিজেকে নিয়ে যেতে পেরেছে।
————————————————————————————————————————–
* রোবটিক্সের তিন সূত্র – ১৯৪২ সালে আইজ্যাক এসিমভ তার ‘রান-এরাউন্ড’ নামক ছোট গল্পে এর প্রবর্তন করেন। পরবর্তিকালে এসিমভ এই তিন সূত্রেস সাথে আরো একটি সূত্র যোগ করেন যা ‘Zeroth Law’ বলে পরিচিত।
০) একটি রোবট কখনো মনুষ্যত্বের ক্ষতিসাধন করবে না বা মনুষ্যত্বের ক্ষতির সম্ভাবনা বুঝলে তাকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকবে না।
(A robot may not harm humanity, or, by inaction, allow humanity to come to harm.)
১) একটি রোবট কখনো কোন মানুষকে শারীরিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না বা মানুষের ক্ষতির সম্ভাবনা বুঝলে তাকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকবে না।
(A robot may not injure a human being or, through inaction, allow a human being to come to harm. )
২) একটি রোবট সব সময়ে মানুষের আদেশ মান্য করবে যদি না তা প্রথম সূত্রটির পরিপন্থী হয়। (A robot must obey orders given it by human beings except where such orders would conflict with the First Law. )
৩) একটি রোবট সব সময়ে নিজের অস্তিত্ব-রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে যদি না তা প্রথম দুটি সূত্রের কোন একটিরও পরিপন্থী হয়।
(A robot must protect its own existence as long as such protection does not conflict with the First or Second Law.)
Tags: প্রচ্ছদ কাহিনি, প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, মানুষেরই মতো, সুপ্রিয় দাস