মৃত গ্রহের টাইম ক্যাপসুল – মার্গারেট অ্যাটউড
লেখক: বাংলা অনুবাদঃ অরিন্দম বসু
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
আমাদের সভ্যতার প্রথম যুগে আমরা দেবতা গড়েছিলাম। তাঁদের আমরা কাঠ খোদাই করে গড়েছিলাম। তখনও অবধি কাঠ বলে কিছু ছিল। আমরা তাঁদের চকচকে ধাতুতে খোদাই করেছিলাম, মন্দিরের দেওয়ালের গায়ে তাঁদের অবয়ব এঁকে রেখেছিলাম। আমাদের নানান রকমের দেবদেবী ছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ খুব নিষ্ঠুর ছিলেন, আমাদের রক্তপান করতেন, আবার তাঁরা আমাদের দিয়েছিলেন সূর্যালোক, দিয়েছিলেন হাওয়া বাদল, শস্য, পশু, বহু বহু শিশু। সে যুগে আমাদের মাথার ওপর আকাশে অসংখ্য পাখী উড়ে বেড়াত, আমাদের সমুদ্রে খেলে বেড়াত অজস্র মাছ।
আমাদের দেবতাদের মাথায় থাকত প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড শিং, তাঁদের কারোর মাথার পেছনে থাকত চন্দ্রের শোভা, কারো মাথায় ঈগলের চঞ্চু, কেউ বা মেলতেন সিলের পাখনা। আমরা আমাদের দেবতাদের বলতাম সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ। আমরা জানতাম তাঁরা আমাদের জন্য আছেন, আমরা অনাথ নই। আমরা পৃথিবীর মাটির ঘ্রাণ নিতাম, আমরা মাটিতে গড়াগড়ি যেতাম; পৃথিবীর রস আমাদের গাল বেয়ে গড়িয়ে যেত।
দ্বিতীয় যুগে আমরা অর্থ আর মুদ্রা সৃষ্টি করেছিলাম। মুদ্রাও চকচকে ধাতু দিয়ে তৈরী করেছিলাম আমরা। মুদ্রার দুটি পিঠ ছিল: একদিকে একটি কাটা মাথার ছবি থাকত, হয়ত কোন রাজার, নয়ত কোন গণ্যমান্য মানুষের: উল্টোপিঠে অন্য কিছুর ছবি থাকত, এমন কিছু যাকে দেখেই আমাদের মন ভাল হয়ে যেত: মাছ, পাখী, হয়ত কোন লোমশ জন্তু । মুদ্রাই ছিল আমাদের প্রথম যুগের দেবতাদের রেখে যাওয়া অংশ। আকারে মুদ্রা ছিল নেহাতই ক্ষুদ্রকায়, প্রতিদিন আমরা মুদ্রা নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম। মুদ্রা আমাদের শরীর ছুঁয়ে থাকত। আমরা মুদ্রা খেতে পারতাম না, আমরা তাদের গায়ে পরতেও পারতাম না, পারতাম না তাদের পুড়িয়ে শরীর গরম করতে; তবুও যেন কি এক জাদুবলে তারা এ সবই করতে পারত। অর্থ ছিল আমাদের কাছে এক আশ্চর্য মায়াময় জগৎ, আমরা তার ছিলাম তার শক্তিতে অভিভূত। লোকে বলত, যার কাছে প্রভূত অর্থ, সে উড়তে অবধি পারে।
তৃতীয় যুগে, অর্থ আমাদের আরাধ্য দেবতা হয়ে উঠল। সে ছিল সর্বশক্তিমান, সে ছিল তাবৎ নিয়ন্ত্রণের অতীত। অর্থসম্পদ কথা বলতে শুরু করল। সে হয়ে উঠল স্বয়ম্ভূ। তার হাতে তৈরী হল আমাদের তাবৎ উৎসব আর দুর্ভিক্ষ, আমাদের আনন্দের সঙ্গীত, শোকের অশ্রুজল। অর্থ নির্মাণ করল লোভ, অর্থ নির্মাণ করল ক্ষুধা, যেমন মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। তার নামে কাচের স্বর্গ গড়ে উঠল, সে স্বর্গ বারে বারে ধ্বংস হয় আর বারে বারে সে নতুন করে গড়ে ওঠে। তারপর অর্থ আমাদের খেতে শুরু করল। আমাদের অরণ্য, আমাদের ধানজমি, শৈশব, সব কিছু তার জঠরাগ্নিতে আহুত হল। সে তার জঠরের ক্ষুধা মেটাল আমাদের সৈন্যবাহিনীতে, আমাদের জাহাজে, আমাদের শহরে। কেউ আর তাকে থামাতে পারল না। যার যত অর্থ, তার তত প্রতিপত্তি।
চতুর্থ যুগে আমরা মরুভূমি সৃষ্টি করলাম। আমাদের নানান রকমের মরুভূমি ছিল। তাদের সকলের একটাই বৈশিষ্ট্যঃ সেখানে কিছু আর জন্মাত না। সে মরুভূমির কংক্রিটের তৈরী, সে মরুভূমি বিষ দিয়ে তৈরী, পোড়ামাটির তৈরী সে মরুভূমি। আমরা অর্থাভাবের তাড়নায় আর অর্থের উদগ্র লোভে সেই সব মরুভূমি নির্মাণ করেছিলাম। কত যুদ্ধ হল, কত মহামারি এল, কত দুর্ভিক্ষ আমাদের তাড়িয়ে বেড়াল, তবু আমরা মরুভূমি নির্মাণ করতেই থাকলাম, মরুভূমি নির্মাণ ছাড়লাম না। শেষে আমাদের নির্মিত সমস্ত কুয়ো বিষে বিষে পূর্ণ হয়ে উঠল, আমাদের সমস্ত নদী বেয়ে চলল শুধুই আবর্জনা, আমাদের সমস্ত সাগর শুকিয়ে গেল, চাষবাসের আর কোন জমিও অবশিষ্ট রইল না।
তখন আমাদের মধ্যে যাঁরা জ্ঞানী, তাঁরা মরুভূমির ধ্যানে বসলেন। তাঁরা আমাদের বললেন দেখ, দিনের শেষ আলোয় মরুভূমির বালুকাবেলায় একখণ্ড পাথরের কি অপূর্ব শোভা। তাঁরা বললেন, মরুভূমিতে আগাছা জন্মায় না, কোন কীটপতঙ্গ চরে বেড়ায় না, মরুভূমি কেমন পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন! তাঁরা বললেন আমরা যদি মরুভূমিতে দীর্ঘকাল অতিক্রান্ত করতে পারি, তবে আমরা পরমেশ্বরের সন্ধান পাব। শূন্য নামে সংখ্যাটি বড় পবিত্র, তাঁরা বিধান দিলেন।
আপনারা যাঁরা সুদূরের বহির্জগৎ থেকে এখানে এসেছেন, এই শুষ্ক সরোবরতীরে, এই পাথরপ্রতিমায়, আপনারা যাঁরা এই পিতলের চোঙটিকে খুঁজে পেয়েছেন, এইখানে, আমাদের দিনলিপির শেষ দিনে এই কথাটি লিখে রেখে গেলামঃ
“প্রার্থনা করুন আমাদের জন্য, আমরা যারা একদিন ভেবেছিলাম যে আমরা উড়তে পারি।”
Tags: অনুবাদ, অনুবাদ গল্প, অরিন্দম বসু, কল্পবিজ্ঞান গল্প, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর), দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, মার্গারেট অ্যাটউড, মৃত গ্রহের টাইম ক্যাপসুল
Margaret Atwood in Canada today saw this page and tweeted the link on her Twitter feed @margaretatwood …bravo to the translator Dr Arin Basu in New Zealand
@arinbasu
“Time capsule on a dead planet” appeared the UK Guardian newspaper in 2009.
একটা বিস্তৃত ক্যানভাসের কল্প – বয়ান কে বাংলায় নির্মেদ অনুবাদে সেই একই স্বচ্ছন্দ গতিময় রাখা হয়েছে। কল্পবিজ্ঞানের মোড়কে একটা গভীর ইতিহাসের চলন ফুটে উঠেছে একই সাবলীলতায়।
অনুবাদ যে মূল রচনাকে সম্মান জানিয়েও কতটা নির্ভার হতে পারে, তার চমৎকার নিদর্শন এটি। খুব ভালো লাগল।
খুব ভালো অনুবাদ। গল্পটি যেন বিলীয়মান সভ্যতার জন্ম ও মৃত্যুর বিবরণ। যা ভবিষ্যতে ঘটতেও পারে সেই ইতিবৃত্ত।