মেশিন লার্নিং
লেখক: সায়ক দত্ত চৌধুরী
শিল্পী: সুমন দাস
প্রধান শিক্ষকের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল সহ-শিক্ষকটি। উঁকি মেরে দেখল ভেতরে তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। এই বিদ্যালয়ে একদম নতুন এসেছে সে। আর আজকেই এই বিপত্তি।
‘ভেতরে আসতে পারি স্যার?’ সে বলল।
‘আসুন’ প্রধান শিক্ষকের গম্ভীর স্বর ভেসে এল। ‘কী ব্যাপার?’
কীভাবে ব্যাপারটা বলবে একটু ভেবে নিল সহ-শিক্ষকটি, তারপর বলল, ‘আজ নবম শ্রেণির প্রথম পিরিয়ডটা আমার ছিল।’
‘জানি।’
‘আপনি তো জানেন স্যার, স্মার্ট ক্লাস হলেও উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আমাদের বেশ কিছু লেখা লিখতে হয় বোর্ডে, পুরোনো দিনের মতো।’
‘হ্যাঁ।’
‘আমি তাই করছিলাম, স্বভাবতই ছাত্রদের দিকে পিছন ফিরে। তখনই ঘটনাটা ঘটল। একটা ফ্লাইং অবজেক্ট, ইয়ে, উড়ন্ত বস্তু এসে সজোরে গ্রীনবোর্ডে আছড়ে পড়ল।’
‘আগে টের পাননি?’
‘পেয়েছিলাম, হাওয়ার মৃদু কম্পন আর অস্ফুট বোঁওও করে একটা শব্দ পেয়েছিলাম। ডান চোখের কোনা দিয়ে দেখে বস্তুটার ট্রাজেক্টরি, ইয়ে, গতিপথের শেষ মিটার খানেক দেখতেও পেয়েছি। কাজেই ধাক্কা খাওয়া আটকাতে না পারলেও পড়ার আগেই বস্তুটাকে লুফে নি, তারপর যত দ্রুত সম্ভব পিছন ফিরে তাকালাম ক্লাসের দিকে। বিভিন্ন প্রান্তে খিক খিক আওয়াজ হচ্ছিল। বেশ বুঝতে পারছিলাম ওরা লুকিয়ে হাসতে চেষ্টা করছে। জানেনই তো স্যার রাগ বলে আমার শরীরে কিছু নেই।’
‘তা তো বটেই।’
‘কিন্তু মনে করলাম বিষয়টা খতিয়ে দেখতে হবে। গতিপথ বিশ্লেষণ করে বুঝলাম, ওটা এসেছে ক্লাসের ডান দিকের শেষ তিনটে ডেস্কের রো এর, ইয়ে, সারির যে কোনও একটা থেকে।’
‘কী ছুড়েছিল?’
‘ডেস্ক ডিসপ্লে-র ব্যাটারি।’
চৌকো, কালো, প্রায় পঞ্চাশ গ্রাম ভরের বস্তুটাকে টেবিলের ওপর রাখলেন সহ-শিক্ষক।
প্রধান শিক্ষকের ঠোঁটের কোণে একটু হাসি দেখা গেল কি? ‘তারপর?’
‘যে মেরেছে তার ডিসপ্লে অফ থাকার কথা। কিন্তু গিয়ে দেখি সবার ডিসপ্লে কাজ করছে। নিশ্চয়ই অন্য ডেস্কের কেউ খুলে ওদের দিয়েছে ভেবে সব ডেস্ক চেক করলাম। কিন্তু সব ডিসপ্লে অন! এই মডেলের ব্যাটারি তো ঘরের ডিসপ্লেতে লাগানো থাকে না সচরাচর।’
‘হুঁ।’
‘তখন হিসেব করে দেখলাম, গোটা ক্লাসের ডিসপ্লের অ্যাভারেজ ভোল্টেজ যা হওয়ার কথা, তার থেকে প্রায় 1 ভোল্ট কম। ক্লাসের সব ক-টা ডিসপ্লের জন্যে অন্য ব্যাটারিগুলো সাহায্যে একটা ইউনিফায়েড পাওয়ার সোর্স বানিয়েছে ওরা। কোন ব্যাটারিটা ছুড়ে মারা হল সেটা বার করার একটাই উপায়, ডিসপ্লেগুলো খুলে ব্যাটারি কার্টিজটা দেখা।’
‘তাই করলেন?’
‘করলাম। সেকেন্ড রো এর রোল নম্বর 27। রোহিত সেন। কিন্তু ওটা বার করতে গিয়ে পনেরো মিনিট সময় নষ্ট হল। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং হল রোহিত ওর ডিসপ্লে খুলেছিল কেবলমাত্র নিজের নখের সাহায্যে। ও ব্যাটারিটা খুলে পিছনে সাপ্লাই করেছিল। এখন প্রশ্ন হল, এই ইনস্টিটিউশনের রুল অনুযায়ী আমি ওকে ইন্টারোগেট করতে পারি কি না। তাহলে ঠিক কে কাণ্ডটা করেছে তা জানতে পারি।’
‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দিষ্ট করা নিয়মানুযায়ী ওকে আপনি প্রশ্ন করতে পারেন। আপনাকে অনুমতি দেওয়া হল। কিন্তু তাতে একটা নাম জানা যাবে। তারপর?’
‘প্রয়োজনীয় স্টেপ নিতে হবে এটা বন্ধ করার জন্য। ব্যাটারিটা যথেষ্ট ভারী। কেউ যদি ওটা কোনও ছাত্রকে টার্গেট করে মারে, তাহলে ইনজুরি হতেই পারে।’
‘না। ওরা নিজেদের মধ্যে এটা ছোড়াছুড়ি করবে না।’
‘মানে?’
‘মানে হল ওটা আপনাকে লক্ষ্য করে ছোঁড়া হয়েছিল। আরও ভালোভাবে বলতে গেলে আপনার মাথা লক্ষ্য করে। বস্তুটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে।’
‘অ্যাঁ?’
‘হ্যাঁ। না হলে ওরা সকলে এত পরিশ্রম করত না। এটা আগেও হয়েছে। তবে সমন্বিত শক্তি উৎস নির্মাণের ঘটনাটা আগে ঘটেনি। এটা একটা নতুন মাত্রা যোগ করল।’
‘কিন্তু আমার মাথা লক্ষ্য করে ব্যাটারি ছুড়বে কেন?’
‘এটা ওদের একটা বিচিত্র দুষ্টুমি মিশ্রিত ক্রীড়া ভাবতে পারেন। আপনি পদবর্তুলের কদলীসদৃশ ক্ষেপন দেখেছেন?’
‘অ্যাঁ? ক্ কী?’
‘ফুটবলের ব্যানানা শট।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ।’ হাঁফ ছাড়লেন সহ-শিক্ষক। ‘ফুটবলের একটা নির্দিষ্ট অংশে ফোর্স অ্যাপ্লাই করলে একটা টর্কের ফলে ঘুরতে থাকে। ফলে বাতাসের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় সেটার ট্রাজেক্টরি ব্যানানার শেপে বেঁকে যায়। টুয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরিতে কয়েকজন প্লেয়ার এর সাহায্যে বেশ কিছু দারুণ গোল করেছেন…’
‘হ্যাঁ। যে ছুড়েছে সে তেমনি কিছু করার চেষ্টা করছিল।’
‘বুঝলাম না।’
‘এই ব্যাটারিগুলো দীর্ঘদিন ব্যবহৃত হলে একটা বিচিত্র ধর্মে আবিষ্ট হয়। ঘুরিয়ে ছুড়লে বেশ শক্তিশালী চুম্বকে পরিণত হয় সেগুলো। একটা নির্দিষ্ট গতিবেগে ছুড়তে পারলে কোনও চৌম্বক পদার্থের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সেটি বেঁকে গিয়ে পদার্থটিকে আঘাত করতে পারে। সঠিক গতিবেগে গেলে চৌম্বক পদার্থে আটকেও যায়।’
এবার যেন বিষয়টা কিছুটা স্পষ্ট হচ্ছে সহ-শিক্ষকের কাছে।
‘আপনাদের মস্তিষ্ক আচ্ছাদন এর উপরের পুরু নিকেল আস্তরণের কথা জানার পর থেকে এই ঘটনাটা শুরু হয়েছে গত বছর দুয়েক। ওরা চেষ্টা করে একটা বাঁকা গতিপথের সৃষ্টি করে আপনাদের মাথায় ব্যাটারিটা লাগাতে। ওটা মাথায় আটকাতে পারলে সেটাই নাকি সর্বশ্রেষ্ঠ ক্ষেপন। এর ফলে যে আপনাদের কোনও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই তা তো সর্বজনবিদিত।’
‘কেন এমন করে ওরা?’
‘নিছকই এক দুষ্টুমি মিশ্রিত ফাজলামি। ওদের জৈব মস্তিষ্কে নিশ্চয়ই এক বিচিত্র অনুভূতির সৃষ্টি হয় এতে। মনুষ্য মনোবিজ্ঞানের যথেষ্ট তথ্য আপনার মস্তিষ্ক ভান্ডারে সঞ্চিত আছে। তা প্রয়োগ করে আপনি ওদের ব্যবহার বিশ্লেষণ করুন ও পরবর্তী পদক্ষেপ কী নেবেন ভাবুন।’
এক মুহূর্ত থমকালো সহ-শিক্ষকটি, তারপর বলল, ‘আমি কিছুটা সময় চাই স্যার।’
আমার মাথার নিকেল আস্তরণে ব্যাটারি আটকানোর জন্য এই কাণ্ড! ভাবল AT-2507 সিরিজের রোবটটি। সে জানে নতুন শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের মুখোমুখি হলে তাদের মধ্যে এক অতি উৎসাহের সৃষ্টি হয় বেশির ভাগ সময়। ছাত্ররা সেই উৎসাহের ফলে নতুন শিক্ষকের দিকে একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে তাকে যাচাই করে নেওয়ার চেষ্টা করে। এক্ষেত্রে সে যদি কোনও শাস্তিমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে গোটা ক্লাসের গ্রেডের উপর কিছুটা প্রভাব পড়বে। যদিও এ ধরনের ঘটনার বেলায় এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার উদাহরণই রয়েছে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু তার মনে পড়ে গেল অতি প্রাচীন কালে তৈরি হওয়া দুটি সিনেমার কথা। “সাউন্ড অব মিউজিক” আর তাকে অনুসরণ করে সৃষ্টি হওয়া একটি বাংলা সিনেমা “জয়জয়ন্তী”। তার মস্তিষ্ক ভান্ডারে যা এক আদর্শ শিক্ষক কেমন হওয়া উচিত সেটা জানানোর জন্যই যেন সজ্জিত করা হয়েছিল। দুষ্টু ছাত্রদের ক্ষমা, ভালোবাসা আর আনন্দের মধ্যে দিয়ে আপন করে নেওয়ার যে নিদর্শন রয়েছে, সেই পথেই সে হাঁটবে। দেখি না তোমাদের বাঁকা দুষ্টুমিকে উন্নতির সোজা পথে আনা যায় কিনা। চ্যালেঞ্জ অ্যাক্সেপ্টেড, ইয়ে, চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলাম। মনে মনে বলল সে। এই সময় তার পাশ দিয়ে যদি কেউ হেঁটে যেত সে শুনতে পেত রোবটটি বিড়বিড় করে আবৃত্তি করছে—
‘মহাজ্ঞানী মহাজন / যে পথে করে গমন / হয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয়…’
Tags: অনুগল্প, পঞ্চম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সায়ক দত্ত চৌধুরী, সুমন দাস
এত ধৈর্য আর সহনশীলতা মানুষ শিক্ষকের থাকাটা প্রায় অসম্ভব এই অসহিষ্ণু সময়ে।
মনে পড়েগেল এক শিক্ষক ডাস্টার ছুড়ে মারতেন । যাক, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম প্রতিশোধ নিলো তাহলে । 🙂
বেশ মজার লেখা। সাউন্ড অফ মিউজিকের মুভিটা অনেক পছন্দের। মারিয়ার মতো এমন গভর্নেস, তাও রবোটিক! দারুন চিন্তা। শুভেচ্ছা রইল।
ছোটবেলার আনন্দঘন দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল
রোবট বলেই এমন সহিষ্ণু আচরণ। মানুষ হলে পেঁদিয়ে… যাইহোক, গল্পখানা খাসা।