যখন সবাই খেতে পাবে
লেখক: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য
শিল্পী:
আগামীকাল কী কী হবে?
২০৫০ খৃষ্টাব্দ
খিদে পাচ্ছিল খুব। টাকাপয়সা নেই বিশেষ, অতএব ভালো খাবারদাবার কিনে খাবার উপায় নেই। তবে হ্যাঁ, না খেয়ে মরবো না। একটা ছোটো বালতি নিয়ে কর্পোরেশনের কলঘরে চলে গেলাম। নীল মাথাওয়ালা কলটার পাশে আমিই প্রথম। আস্তে আস্তে বস্তির আরো কয়েকজন ভিড় করে এলো।
ঠিক সাড়ে ছটা। কলটার মাথায় একটা আলো দপদপ করে উঠল। লাইনে আমিই প্রথম। কলের পাশের স্লটে পাঁচটা টাকা গুঁজে দিতে কল বেয়ে থকথকে বাদামি রঙের বেশ খানিকটা মণ্ড বের হয়ে এসে বালতিতে পড়ল। সুন্দর গন্ধ। বালতি হাতে পাশের অটো ভেন্ডিং মেশিনটায় গিয়ে ফের পাঁচটা টাকা ঢুকিয়ে তার গায়ের ভেড়া আঁকা বোতামে চাপ দিলাম। প্যাকেট-বন্দি একটা বড়সড় ভেড়ার ঠ্যাং বেরিয়ে এলো নিচের স্লটে।
প্যাকেট আর বালতি নিয়ে বাড়িতে ফিরে এলাম। তিন ভাইবোনের জন্যে যথেষ্ট হবে আজকের মতন। কাল সকালে ফের আনতে যাব।
কর্পোরেশনের চারটে ফোটোসিন্থেসিস প্ল্যান্ট বসেছে এ শহরে। কারখানায় সূর্যের আলো আর জল আর কার্বন ডাই অক্সাইড থেকে তৈরি স্টার্চ নানা সুগন্ধ আর ভিটামিন মিশিয়ে শহরের সবকটা বস্তিতে দিনে একবার করে সাপ্লাই দেয়া হয়। সামান্য দাম। মাংস আসে সিন্থেটিক মিট প্ল্যান্ট থেকে। সত্যিকারের প্রাণীর মাংস বেজায় দামী। বড়োলোকেরা শখ করে খায়। আমাদের জন্য অন্য ব্যবস্থা আছে জানো! সুস্থ-সবল প্রাণীদের শরীর থেকে একটা দুটো কোষ তুলে নিয়ে সেই থেকে ল্যাবরেটরিতে তাল তাল সে প্রাণীর মাংস তৈরি করা হয়। মাছের ফিলে? তাও পাবে। ভীষণ সস্তা। আমাদের মতন হাজার হাজার গরিব-মানুষ তো ওই খেয়েই বেঁচে আছি!
২১৫০ খৃস্টাব্দ
“খিদে পেয়েছে? ইয়ার্কি হচ্ছে? সকালে সান-রুমে যাও নি বুঝি আজ?” মিস ভারী বিরক্ত হচ্ছেন বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু কী করব, ঘুম থেকে উঠতে দেরি হল যে!
মিস আসলে বেজায় ভালো। রাগ করলেও আমাদের সব্বাইকে খুব ভালোবাসেন। মিনিট-কয়েক পরে ঘুরে এসে বললেন, “ঠিক আছে যাও। তবে আধঘণ্টা কিন্তু।”
স্কুলের ছাদের সান-রুমটা অসাধারণ। এমনিতে আকাশের রোদ আসে, আর মেঘ থাকলে নিজে নিজেই ছাদটা কালো হয়ে গিয়ে জেনারেটর থেকে ৪৩০ থেকে ৭০০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোকতরঙ্গ ছড়াতে থাকে। ঠিক যেটা সালোকসংশ্লেষের জন্য দরকার। আজ অবশ্য রোদ আছে। বড়ো বড়ো দু-গ্লাস জল খেয়ে নিলাম প্রথমে। তারপর গায়ের জামাটা খুলে আরাম করে রোদের ওপর শুলাম। আমার সবুজ রঙের চামড়ার প্রত্যেকটা কোষের ক্লোরোফিল রোদের আলো শুষে নিচ্ছিল। কার্বন ডাই অক্সাইড তো আমার ভেতর এমনিতেই তৈরি হচ্ছে অনবরত। আস্তে আস্তে খিদের ভাবটা কমে আসছিল আমার।
আধঘণ্টা পরে ক্লাসে যখন ফিরে গেলাম আমি তখন একেবারে ফিট। তবে মিস যে কী সাংঘাতিক সেটা টের পেলাম বাড়িতে ফিরে। দেখি ডায়েরিতে মাকে লিখেছেন, “সুমন আজ সকালে বাড়িতে সান-রুমে যায়নি।” ধুস। বকুনি খেতে কারো ভালো লাগে?
*********
দুটোই ভবিষ্যতের ছবি। দুটোই এখনো আমাদের নাগালের খানিক বা পুরোটা বাইরে। দুটোই অসম্ভব নয়। দরকার শুধু প্রয়োজনীয় প্রযুক্তির। সে পথে পা দিয়েছে মানুষ সে আজ অনেকদিন হল। আসুন দেখা যাক কী কী দরকার হবে এই ছবিগুলোকে বাস্তবে বদলে দিতে।
১। কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষ পদ্ধতিতে কার্বোহাইড্রেট তৈরি করা (২০৫০ খৃস্টাব্দের অবস্থাটার জন্য)
২। জেনেটিক প্রযুক্তি দিয়ে খাবার যোগ্য বিভিন্ন প্রাণীর মাংসের কৃত্রিম সংশ্লেষণ। (২০৫০ খৃস্টাব্দের অবস্থাটার জন্য)
২। উন্নত জেনেটিক প্রযুক্তিতে মানুষের চামড়ার কোষ ও উদ্ভিদ-কোষের কার্যকরী সংমিশ্রণ গড়ে তোলা (২১৫০ খৃষ্টাব্দের অবস্থাটার জন্য)
এবার দেখা যাক এর কোনটাতে এই মুহূর্তে ঠিক কী অবস্থায় আছে আমাদের প্রযুক্তি।
১। কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষ পদ্ধতিতে কার্বোহাইড্রেট তৈরি করা
সালোকসংশ্লেষ পদ্ধতিতে গাছেরা সূর্যের আলো ব্যবহার করে ছ অণু জল আর ছ অণু কার্বন ডাই অক্সাইড জুড়ে গ্লুকোজ তৈরি করে। তারপর তার থেকে এক অণু জল ছেঁটে দিয়ে সৃষ্টি হয় দীর্ঘস্থায়ী স্টার্চের। তাতে রাসায়নিক বাঁধনে ধরে রাখা থাকে সূর্যের শক্তি। সে ব্যাটারির অটো ডিসচার্জ নেই। জীবদেহ নামের যন্ত্রকে চালাবার শক্তি-কোষ হিসেবে তার ব্যবহার হয়।
এখন অবধি মানুষ সূর্যের আলোকে বিদ্যুতে তো বদলে দিতে পেরেছে, কিন্তু তারপর? তাকে ধরে রাখবার জন্য সীমিত ক্ষমতার তড়িৎকোষ ছাড়া আর কিছু আমাদের হাতে নেই। তাতেও বেশিদিন তাকে রাখা যায় না। তাছাড়া সেসব তড়িৎকোষে যেসব রাসায়নিকের ব্যবহার হয় তারা জীবের পক্ষে বিষাক্ত। দেহযন্ত্র চালাবার কাজে অতএব সে শক্তিকে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। সূর্যের শক্তিকে প্রযুক্তি দিয়ে বন্দি করে পুষ্টির কাজে লাগাতে গেলে অতএব তা থেকে কার্বোহাইড্রেট বা স্টার্চ নামের দীর্ঘস্থায়ী ও শরীরের পক্ষে গ্রহণযোগ্য শক্তি-সঞ্চয়ের উপাদানটি সৃষ্টি করবার কায়দাটা অধিগত না করে উপায় নেই। অর্থাৎ, চাই কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষের প্রযুক্তি।
কৃত্রিমভাবে সালোকসংশ্লেষ করতে গেলে গাছ যে তিনটে ধাপে কাজটা করে সে তিনটে ধাপের জন্য উপযুক্ত প্রযুক্তি তৈরি করতে হবে।
প্রথমে: সূর্যের আলোর শক্তিকে উপযুক্ত মাধ্যমে আহরণ করতে হবে।
দ্বিতীয় ধাপে: তাই দিয়ে জলকে হাইড্রোজেন ও হাইড্রক্সিল আয়নে ভেঙে দিতে হবে (H+, OH-(আলো দিয়ে কোন রাসায়নিককে ভেঙে দেয়াকে ফোটোলিসিস বলে।)
তৃতীয় ধাপে আসবে সবচেয়ে কঠিন কাজ—সেটা হল কার্বন ডাই অক্সাইডকে রাসায়নিক বাঁধনে বন্দি করে, ফোটোলিসিসে উৎপন্ন হাইড্রোজেন আয়ন দিয়ে বিজারিত করে গ্লুকোজ তৈরি দিকে এগোনো।
গাছের পাতায় যে ক্লোরোফিল থাকে তা সূর্যের আলোর ৪৩০ থেকে ৭০০ ন্যানোমিটার তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলোর সমস্ত ফোটনকে শুষে নিয়ে উত্তেজিত হয়ে ওঠে। তারপর সে শক্তি ব্যবহার হয় ফোটোলিসিসে। কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষে সে কাজটাকে করতে, বা আরো ভালোভাবে করতে ন্যানোপার্টিকল ব্যবহার করার চেষ্টা করা হচ্ছে এখন।
সে কাজে বেজায় সাহায্য করছে আপনার আমার দেয়ালের রঙে ব্যবহৃত রঞ্জক টাইটানিয়াম ডাই অক্সাইড। এ রাসায়নিকটা মূলত রঞ্জক হিসেবে বিষাক্ত সাদা সিসের বিকল্প হিসেবে রঙ-শিল্পে ব্যবহৃত হত। ১৯৬৭ আকিরা ফুজিসিমা নামের এক গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট বিজ্ঞানী কেনিচি হন্ডার অধীনে গবেষণা করতে গিয়ে খানিক আকস্মিকভাবেই খেয়াল করেন, এই রঞ্জক যৌগটার গায়ে আলো পড়লে সেটা আলোকে শুষে নিয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠে জলকে হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনে ভেঙে দেয়। টাইটানিয়াম ডাই অক্সাইডের এই আলোক-বিশ্লেষক ধর্মকে নাম দেয়া হয়েছে হণ্ডা ফুজিসিমা এফেক্ট। তার মানে সূর্যের আলোয় জল রেখে তার মধ্যে দুটো ইলেকট্রোডের একটাকে টাইটানিয়াম ডাই-অক্সাইড মাখিয়ে রাখলে জলের ফটোলিসিস সম্ভব হবে। তার ওপরে বস্তুটা আবার তড়িদবিশ্লেষণে সাধারণভাবে ব্যবহৃত ধাতুগুলোর মত বিষাক্তও নয়।
তবে মুশকিল একটা ছিল। তা হল, হাইড্রোলিসিস প্রক্রিয়াটাকে ঠিকঠাক করবার জন্য যে পরিমাণ সৌরশক্তি শোষণ দরকার তা করতে হলে তাতে রাখা রাসায়নিকটার সার্ফেস এরিয়া অনেকটা হওয়া দরকার। এতটাই দরকার, যে জলের মধ্যে রাখবার ওই ইলেকট্রোডটার আয়তন জলের মোট আয়তনের চেয়ে বেশি হয়ে যেতে পারে। ফলে আবিষ্কারটা হলেও সালোকসংশ্লেষ গবেষণায় তার প্রয়োগ হওয়া কঠিন ছিল সে সময়ে। এ ধর্মকে জলের বিশুদ্ধিকরণ ইত্যাদি ছোটোখাটো কাজেই ব্যবহার করা হচ্ছিল।
তারপর এলো ন্যানোটেকনোলজি- যে কোন বস্তুর বেজায় ছোটো ছোটো আণুবীক্ষণিক কণা তৈরি করবার প্রযুক্তি। তৈরি হল টাইটানিয়াম ডাই অক্সাইডের ন্যানোপার্টিকল। আর তার ফলে এই ন্যানোপার্টিকল মাখানো ইলেকট্রোডের আয়তন ছোটো রেখেও তার ক্ষেত্রফল গেল বহুগুণ বেড়ে।
(কেন? ধরুন একটা মাটির গোলক। তার ব্যাসার্ধ ১৪ সেন্টিমিটার। এর উপরিতলের ক্ষেত্রফল হবে 4ππr2 = 2464 বর্গ সেমি।
এর ঘনফল হবে (4ππr3)/3 =11494 ঘন সেমি।
এবারে একে দুটো সমান ভাগে ভেঙে দিলাম। একেকটা টুকরোর আয়তন হবে 5747 ঘন সেমি। ওপরের দু নম্বর সূত্রটাকে উল্টোভাবে ব্যবহার করলে তাদের প্রত্যেকের ব্যাসার্ধ পাব 11 সেমি করে। ওপরের এক নম্বর সূত্রটাকে ব্যবহার করে এই দুটো গোলকের উপরিতলের মোট ক্ষেত্রফল হবে 2 x 1520 =3040 বর্গসেন্টিমিটার। যদি বড়ো গোলকটা থেকে চারটে সমান মাপের ছোটো গোলক বানাই তাহলে তাদের মোট উপরিতলের ক্ষেত্রফল হবে 4 x 978 =3912 বর্গসেন্টিমিটার.
অর্থাৎ যত ছোটো টুকরো হবে তত নির্দিষ্ট ঘনফলের একটা বস্তুর মোট উপরিতলের ক্ষেত্রফল বেড়ে যাবে। মানে প্রতি বিভাজনে মোট ঘনফল এক থাকলেও উপরিতলের ক্ষেত্রফল বেড়ে যাচ্ছে প্রথম বিভাজনে শতকরা ২৫ ভাগ, দ্বিতীয় বিভাজনে মূল ক্ষেত্রফলের শতকরা বাষট্টি ভাগ। তাহলে যখন ধরুন গিয়ে আন্দাজ লাখ-খানেক বিভাজনের পরে এদের ন্যানোপার্টিকল স্তরে পৌঁছবেন তখন তার মোট উপরিতলের ক্ষেত্রফলটা, একই ঘনফলের জন্য কোথায় গিয়ে পৌঁছবে?)
এবারে বিজ্ঞানীরা টাইটানিয়াম ডাই অক্সাইড ন্যানোপার্টিকল মাখা একটা অ্যানোড আর প্ল্যাটিনামের তৈরি ক্যাথোড জলের আয়নিত দ্রবণে ডুবিয়ে সূর্যের আলোয় রেখে দেখলেন, অ্যানোড আলো শুষে যা শক্তি-সঞ্চয় করছে তাতে বেশ একটা তড়িৎপ্রবাহ শুরু হয়ে যাচ্ছে দ্রবণে। আর তার ফলে জল ভেঙে গিয়ে আয়নীভূত হয়ে পড়ছে আর এইভাবেই সূর্যের শক্তিকে বেঁধে ফেলছে রাসায়নিক যোজ্যতার বাঁধনে। দ্রবণে যদি অণুঘটক হিসেবে ইরিডিয়াম অক্সাইডের সামান্য ন্যানোপার্টিকল মিশিয়ে দেয়া যায় তাহলে এ প্রক্রিয়াটা বেশ ভালো পরিমাণে ঘটা শুরু হয়ে যায়।
তাহলে প্রথম আর দ্বিতীয় ধাপটার প্রযুক্তি মানুষের নাগালে এলো।
সালোকসংশ্লেষের তৃতীয় ধাপটা সবচেয়ে জটিল। গাছেরা করে কি, রাইবিউলোজ বাই-ফসফেট নামে একটা রাসায়নিকের সাহায্যে প্রথমে কার্বন ডাই অক্সাইডকে বন্দি করে। (এ কাজে তাকে যে সাহায্য করে তার নাম RuBisCO, একটা উৎসেচক। প্রত্যেকটা গাছে এ উৎসেচক বেশ ভালো পরিমাণে থাকে। এর প্রত্যেকটা অণু নিজে বদলে না গিয়ে সেকেন্ডে তিন থেকে দশটা করে কার্বন ডাই অক্সাইডের অণুকে বেঁধে ফেলতে পারে।)
তারপর কিছু রাসায়নিক ধাপ পেরিয়ে আটক হওয়া কার্বন ডাই অক্সাইডের সঙ্গে জলের অণুর হাইড্রোজেন মিশে গ্লুকোজ তৈরি হয়। সে কাজে আলোর কোন ভূমিকা থাকে না আর।
রাইবিউলোজ ডাই ফসফেটের কাজটা করতে পারে এমন দ্বিতীয় আর কেউ নেই, মানে এখনো এমন কাউকে পাওয়া যায়নি। বিজ্ঞানীরা তাই এখন প্রকৃতিতে সহজলভ্য রাইবিউলোজ ডাই ফসফেটের উৎস বা তাকে কৃত্রিম উপায়ে সংশ্লেষ করবার পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করছেন। একই সঙ্গে কাজ হচ্ছে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর সাহায্যে আরো দ্রুতগতিতে কাজ করতে সক্ষম RuBisCO তৈরি করবার। আশা করা যায় কিছু বছরের মধ্যে এ ধাপটা পার হওয়া সম্ভব হবে। আরো অনেকটা এগিয়ে যাব আমরা স্বপ্নের সেই যন্ত্রের দিকে, আলোহাওয়াজল শুষে নিয়ে যে তৈরি করে দেবে জীবনধারণের জন্য খাদ্য।
২। কৃত্রিম মাংস
মাংস উৎপাদক প্রাণীদের পালনের ফলে যে পরিমাণ মিথেন নিঃসরণ, চারণভূমির জন্য বনভূমি ধ্বংস, তাদের খাদ্যের উপযুক্ত ফসল উৎপাদনের জন্য শক্তিব্যয় এই সব মিলে যে পরিমাণ গ্রিন হাউস গ্যাস এই মুহূর্তে তৈরি হয় তার মোট পরিমাণ পৃথিবীর সমস্ত যানবাহনের থেকে তৈরি গ্রিন হাউস গ্যাসের চেয়ে বেশি। যত মানুষ বাড়বে, এর পরিমাণ আরো বাড়বে। খুব বেশিদিন প্রক্রিয়াটা চালু থাকা অতএব সম্ভব নয়।
সেসব ছাড়াও, কখনো কি উন্নত কোন দেশের যান্ত্রিক কশাইখানা দেখেছেন? কী অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতায় হাজার হাজার নিরীহ প্রাণীকে যে সেখানে মারা হয় তা কখনো নিজের চোখে দেখলে আপনাকে অন্য কোন রাস্তা নিয়ে ভাবতেই হবে।
এসব সমস্যার একটা সমাধান হতে পারে দুনিয়াশুদ্ধ নিরামিষভোজী হয়ে যাওয়া। সেটা উন্মাদের স্বপ্ন। বাস্তবে হবার নয়। মাংসের লোভ মানুষের যাবে না।
অবস্থাটা কীরকম একটা অসম্ভব দশায় গিয়ে পৌঁছচ্ছে সেটা বোঝা যাবে বিশেষজ্ঞদের এই হিসেবটা থেকে—২০৫০ সাল নাগাদ মাংসের চাহিদা বাড়বে এখনকার তুলনায় শতকরা ৭৩ ভাগ, অথচ পৃথিবীর মোট ফার্ম-ল্যান্ডের শতকরা সত্তর ভাগ এই মুহূর্তে মাংস উৎপাদক প্রাণীদের দেখভাল ও পোষণের জন্য ব্যবহার হচ্ছে। এক কথায় ২০৫০ সাল যখন আসবে তখন হয় পৃথিবীর সব চাষযোগ্য জমিতে গরু চরাতে হবে, আর নাহয় মাংস খেতে ইচ্ছুক বহু মানুষ তা খেতে পাবেন না।
অতএব, এই অসম্ভব সমস্যার সমাধান ও সেই সঙ্গে দূষণ আটকানো, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার প্রাণীজ প্রোটিনের চাহিদা সরবরাহ এবং অকারণ নিষ্ঠুরতার একমাত্র সমাধান, কালচার্ড মিট বা কৃত্রিম মাংস।
২০১৩ সালের আগস্ট মাসে লন্ডনের একটা অনুষ্ঠানে নেদারল্যান্ডের ম্যাসট্রিক্ট্ বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈজ্ঞানিক মার্ক পোস্ট একটা বীফ-বার্গার এনে হাজির করলেন। তার গরুর মাংসটা কোন গরুকে জবাই করে পাওয়া যায়নি। একটা গরুর কাঁধ থেকে কটা কোষ চেঁছে তুলে নিয়ে ল্যাবরেটরিতে তাকে তিনমাস ধরে বাড়িয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে হাড়-হীন বেশ খানিকটা গোমাংস। খাদ্য গবেষক হানি রাটজের ও জশ স্কনওয়াল্ড মিলে খেয়ে দেখলেন সেই বার্গার। বস্তুটা সামান্য শুকনো, তাছাড়া স্বাভাবিক গোমাংসের সঙ্গে তার বিশেষ কোন তফাত নেই-খাবার পরে এই হল খাদ্য গবেষকের অভিমত। কৃত্রিম মাংস জনতার দরবারে বড়ো আকারে পেশ হল সেই প্রথম।
এর আগেও অবশ্য ২০০৩ সালে ফ্রান্সের নান্তেস-এ ওরন ক্যাট আর লোনাত জুর মিলে ব্যাঙের স্টেম সেল থেকে কালচার করা মাংসের কয়েক সেন্টিমিটার লম্বা একটা স্টেক বানিয়ে খেয়ে দেখিয়েছিলেন এক বিজ্ঞানী-সভায়।
কীভাবে তৈরি হয়েছিল মার্ক পোস্টের বীফ-বার্গারের মাংসটা? পেশীর মাংসে একধরণের কোষ থাকে যাদের বলে স্যাটেলাইট কোষ। এরা পেশির কোষ বা অন্য স্যাটেলাইট কোষের জন্ম দেয়। প্রায় সাইটোপ্লাজম-বিহীন এইধরনের কিছু কোষকে কোন প্রাণীর পেশি থেকে আলাদা করে নিয়ে তাদের পুষ্টিকর মাধ্যমে রেখে একটা বিশেষ প্রোটিন উৎসেচকের সংস্পর্শে আনলে সেগুলো ক্রমাগত বিভাজিত হতে থাকে আর তৈরি করতে থাকে নতুন পেশিকোষ আর স্যাটেলাইট কোষ। এই স্যাটেলাইট কোষগুলো ফের একই প্রক্রিয়া চালায়। ফলে শুরু হয় পেশিকোষ তৈরির একটা শৃঙ্খল বিক্রিয়া। আস্তে আস্তে নবজাত কোষগুলো জুড়ে জুড়ে তৈরি করে কিছু পেশি-তন্তুর ফালি।
স্যাটেলাইট কোষ যদি বীজ হয় তাহলে এই পেশি-তন্তুই হল মাংস-চাষের ফসল। আর সব বৈশিষ্ট্য মাংসপেশির মতন হলেও, দেখতে কিন্তু তা সত্যিকারের পেশির মতন গড়নের হয় না। এই পেশি-তন্তুর ফালিদের সংগ্রহ করে একত্র করে কৃত্রিম মাংসের দলা তৈরি করেন বিজ্ঞানীরা। এতে বলা বাহুল্য ফ্যাট কোষ তৈরি হয় না। ফলে মাংসটা একটু শুকনো ঠেকে। টিস্যু-কালচারের জন্য ব্যবহৃত বায়োরিঅ্যাকটারের মধ্যেই এই মাংস তৈরি করে ফেলা যায়।
এই মুহূর্তেই অবশ্য এটা বাজারে আসছে না। প্রযুক্তির বর্তমান স্তরে এ মাংস তৈরির খরচ অনেক বেশি। ল্যাবরেটরি ছেড়ে ফ্যাক্টরির অ্যাসেম্বলি লাইনে ঢুকে পড়তে আরো কিছু সময় নেবে সে। তবে হ্যাঁ, পৃথিবীর ত্রিশটারও বেশি গবেষণাগার এখন এ নিয়ে গবেষণা করে চলেছে। প্রথম বাজারজাত-যোগ্য মুরগির মাংস তৈরির পদ্ধতি যারা করতে পারবে তাদের জন্য এক মিলিয়ন ডলারের একটা পুরস্কারও ঘোষণা করে রেখেছে একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন।
সে তো নয় হল? কিন্তু উইনস্টন চার্চিলের স্বপ্নটার কী হবে? গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকেই তো তিনি ইচ্ছেটা করে গিয়েছিলেন, চিকেনের ব্রেস্ট বা উইং-পিসের জন্য গোটা একটা মুরগি পালনের বদলে যদি শুধু ব্রেস্ট-পিস বা উইংটাকে বানানো যেত ল্যাবে? শুধু মাসল ফাইবার দিয়ে তো তা হবার নয়। খেতে মাংসের মতন হলেও সে তো আর ব্রেস্ট বা উইং পিসের মতন গড়নের হবে না! হবে খানিক কিমার মতন। তার ওপর তাতে ফ্যাটও না থাকায় খেতে হবে শুকনোটে। আসলের মতন নয়। তাহলে? বিজ্ঞানীরা বলছেন, সেটাও সম্ভব। হুবহু আসল পেশির চেহারার কৃত্রিম মাংসও তৈরি হবে শিগগিরই। এক্ষেত্রে অবশ্য পুষ্টিকর তরলে ভর্তি একটা চোঙার মতন বায়োরিঅ্যাকটরে কয়েকটা কোষ ডুবিয়ে সেটাকে যেমন খুশি বাড়তে দিলে চলবে না। যে যন্ত্র মূল কোষগুলোকে বড়ো করবে তাতে থাকতে হবে
- বাড়ন্ত কোষ-সমষ্টিতে রক্ত-সরবরাহের অনুরূপ বন্দোবস্ত,
- ফ্যাটের উপযুক্ত মিশেল দেবার জন্য অ্যাডিপোজ কোষগুলোকে বাড়াবার উপায়,
- কোষগুলোতে উৎপন্ন রেচনপদার্থের নিষ্কাশন পদ্ধতি,
- বাড়ন্ত পেশিকোষকে উইং, ব্রেস্ট বা লেগ-পিসের আকার সম্পর্কে সচেতন করা ও সে আকার ধারণে সাহায্য করবার জন্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দূতগুলির সরবরাহ।
- এবং সবশেষে পেশিগুলোকে ঠিকঠাক রূপ নিয়ে বেড়ে ওঠবার জন্য প্রয়োজনীয় নড়াচড়া করাবার ব্যবস্থা, মানে ব্যায়াম করানো।
মাংসের কিমা দিয়ে বীফ-বার্গার তো খাওয়া গেছে তিন বছর আগেই, এখন সে পথে আরো হেঁটে সেই গরিব লোকটার জন্য সস্তায় একটা ভেড়ার ঠ্যাং যন্ত্রে তৈরি করতে বোধ হয় ২০৫০ সাল এসে যাবে পৃথিবীতে।
৩। উন্নত জেনেটিক প্রযুক্তি—সবুজ মানুষের পথে
হিউম্যান জিনোম প্রজেক্ট মানুষকে তার জিনের গঠন নিয়ে জানতে বেজায় সাহায্য করেছে। আর, যাকে জানি তাকে বদলানোর ক্ষমতার নাগাল পাওয়া তো শুধু সময়ের ব্যাপার। কিছুকিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ করে চিকিৎসাশাস্ত্রে, কৃষিক্ষেত্রে জিনদের অদলবদল ঘটিয়ে উপযুক্ত ফল পাবার কাজ এখনই বেশ অগ্রসর।
তবে সবুজ মানুষ বানাবার বিষয়টা এখনো বেশ দুরূহ। কারণটা বোঝা কঠিন নয়। মানুষ আর গাছ, এই দুইয়ের মধ্যে কোষ-গত স্তরেও বিরাট তফাৎ। এতটা দূরত্বকে অতিক্রম করে একের বৈশিষ্ট্যকে কার্যকরী-ভাবে অন্যের কোষে সংস্থাপন করার প্রযুক্তি এই মুহূর্তে আমাদের নাগালের বাইরে।
কিন্তু, ক্রিস্টিনা আগাপাকিসের মত অনেক গবেষকই একে সেরকম অসম্ভব বলে ভাবছেন না। উদ্ভিদ-প্রাণী সংকর তৈরির এলাকায় নতুন গবেষণায় কিছু রহস্যময় জৈব পদ্ধতির ইঙ্গিত দিচ্ছে যা এই নতুন এলাকাতে কিছু আশার আলো নিয়ে এসেছে।
যেমন ধরা যাক এলিসিয়া ক্লোরোটিকার কথা। তীব্র সবুজ, অর্ধস্বচ্ছ এই সমুদ্র-কীট দেখতে গাছের পাতার মতন, খায়ও সূর্যের আলো। অথচ সে একটি প্রাণী।
তার রহস্যকে উদ্ধার করেছেন উড্স্ হোল মেরিন বায়োলজিক্যাল ল্যাবের বিজ্ঞানীরা। এরা ভাউশেরিয়া লিটোরিয়া নামের একধরণের সমুদ্র শ্যাওলা খায়। এই শ্যাওলারা পরপর কোষ জুড়ে সরু সুতোর মত চেহারায় থাকে।
লার্ভা দশায় এলিসিয়ার ছানাপোনারা দিব্যি স্বাভাবিক প্রাণীর মতই ফাইটোপ্ল্যাংকটন ধরে খেয়ে হজম করে বড়ো হয়। কিন্তু সে দশা পেরোবার পর যখন তারা পূর্ণাঙ্গ দশায় পৌঁছোয় তখন প্রকৃতি তার ম্যাজিকটা দেখানো শুরু করেন। বাদামি রঙের পূর্ণাঙ্গ ছোটো এলিসিয়ারা এইসময় শ্যাওলা খাওয়া শুরু করে। প্রথমে মুখের ছোটছোট দাঁতওয়ালা ফিতের মতন র্যাডুলা নামের অঙ্গটা দিয়ে শ্যাওলার একটা সুতোর গায়ে ফুটো করে। তারপর সুতোটাকে ধরে সেই ফুটো দিয়ে স্ট্রয়ের মতন তার ভেতরের বস্তুটাকে চুষে খেয়ে নেয়।
পেটের ভেতর যাবার পর একটা আশ্চর্য প্রক্রিয়া চালু হয়। এলিসিয়ার সারা দেহ জুড়ে ছড়ানো পাচনতন্ত্রের কোষেরা অ্যামিবার মতন অস্থায়ী হাত পা বের করে করে শিকারের কোষের জীবিত ক্লোরোপ্লাস্ট অংশগুলোকে ধরে নিজেদের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে সেইখানে সেগুলোকে জিইয়ে রেখে দেয় বেশ কয়েক মাস ধরে। একবার ঢুকলে একটা ক্লোরোপ্লাস্ট এলিসিয়ার কোষের মধ্যে বসে থেকে দশমাস অবধি সালোকসংশ্লেষ করে যেতে পারে।
পদ্ধতিটা ক্রমাগত চালিয়ে যেতে যেতে একসময় এলিসিয়া উজ্জ্বল সবুজ হয়ে ওঠে। প্রথম প্রথম তাকে খুব বেশি শ্যাওলা খেতে হয়। কারণ কোষের ভেতর জমা করা ক্লোরোপ্লাস্ট নষ্ট হয় তখন একটু তাড়াতাড়ি। তারপর আস্তে আস্তে সেটার অবস্থান স্থিতিশীল হলে তার শ্যাওলা খাওয়া কমে আসে। দেহে জমানো ক্লোরোপ্লাস্ট দিয়ে সালোকসংশ্লেষ করে সে নিজের পুষ্টি চালিয়ে যায়।
কিন্তু কীভাবে?
ধরুন একটা প্রাণী-কোষে ক্লোরোপ্লাস্ট ঢুকিয়ে দেয়া হল। আলো পেলে সে তো সালোকসংশ্লেষ করবেই। প্রাণী-কোষটা যদি তার ফলে উৎপন্ন কার্বোহাইড্রেট অসমোসিস প্রক্রিয়ায় নিজের দেহে শুষে নিতে পারে তাহলেই তো সমস্যার শেষ। মানুষের চামড়ার একেবারে ওপরের পাতলা অর্ধস্বচ্ছ কোষে তো এ প্রক্রিয়াটা করে দেখাই যেতে পারে। মুশকিলটা কী?
মুশকিলটা হল অন্য জায়গায়। প্রাণী-কোষের গড়ন, রসায়ন, উদ্ভিদ-কোষের চেয়ে একেবারে আলাদা। তাহলে তার মধ্যে একটা উদ্ভিদ-কোষের অংশ ঢুকিয়ে দিলে সে সঙ্গে সঙ্গেই শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করবে। কারণ তাকে বাঁচিয়ে রাখবার পদ্ধতি প্রাণী-কোষের ডি. এন. এ.-র কোন জিনেই কোডেড নেই।
কিন্তু এলিসিয়ার কোষে সেটা ঘটছে না। ক্লোরোপ্লাস্ট সেখানে ঢুকে দিব্যি বেঁচেবর্তে থাকছে দীর্ঘকাল। কেন? তাহলে কি এলিসিয়ার কোষ জানে কেমন করে, কী খাইয়ে কীভাবে তাকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়? অন্য কথায় এলিসিয়ার কোষে কি তাহলে উদ্ভিদ-কোষের সেই জিন রয়েছে যাতে সাংকেতিক ভাষায় লেখা রয়েছে ক্লোরোপ্লাস্টকে টিকিয়ে রাখবার রাসায়নিক উপায়? এবং সেই জিনের কোড মেনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো নেবার ক্ষমতাও রয়েছে এলিসিয়ার কোষের?
খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা এখন অবধি আবিষ্কার করেছেন, এলিসিয়ার কোষে, তার প্রজনন কোষে এবং ডিম্বকোষে psbO নামে একটা গুরুত্বপূর্ণ শ্যাওলার জিন ঢুকে রয়েছে। ২০১৪ সালে আবিষ্কৃত হয়েছে আরেকটা দরকারি জিনের উপস্থিতি। তার মানে, কোন অজ্ঞাত পথে শ্যাওলার সঙ্গে হয়ত সমান্তরাল জিন পরিচলন ঘটিয়েছে এলিসিয়া এবং তাকে বংশানুক্রমে চালানও করে দিচ্ছে।
(মা থেকে সন্তানে যে জিনের পরিচলন ঘটে তাকে বলে উল্লম্ব জিন পরিচলন বা ভার্টিক্যাল জিন ট্রান্সফার, আর সাধারণত দুটি ভিন্ন জিন-সংস্থানের [পড়ুন দুটি ভিন্ন জীবের] মধ্যে জিনের আদানপ্রদানকে বলে সমান্তরাল জিন পরিচলন বা হরাইজন্টাল জিন ট্রান্সফার। যেমন, ব্যাকটিরিওফাজ ভাইরাস তার জিনকে ব্যাকটিরিয়ার মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়, কিংবা অনেকসময় যখন কোন ইউক্যারিওট কোষ কোন প্রোক্যারিওট কোষকে খেয়ে তাকে একটা আধারের মধ্যে হজম করতে থাকে তখন প্রোক্যারিওটের কোন জিন সেই জেলখানা থেকে পালিয়ে প্রোক্যারিওটের জেনেটিক উপাদানের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে আত্মরক্ষা করে)
তবে ক্লোরোপ্লাস্টকে টিকিয়ে রাখতে যতগুলো জিনের প্রয়োজন সবগুলোর খোঁজ এখনো মেলেনি এলিসিয়ার কোষে। অনেক বিজ্ঞানীই ফলত এখনো তাই এই সিদ্ধান্তে দৃঢ়ভাবে পৌঁছোতে ইতস্তত করছেন। অন্যভাবে বিষয়টার ব্যাখ্যাও খুঁজছেন অনেকে। সেই অন্য পথে গিয়ে, সমান্তরাল জিন পরিচলন তত্ত্বের পাশাপাশি আরেকটা আকর্ষণীয় গবেষণায় দেখাচ্ছে ভাউশেরিয়ার ক্লোরোপ্লাস্টের মধ্যেই তার নিজেকে সুস্থ রাখবার জন্য দরকারি একটা বিশেষ প্রোটিন ক্রমাগত তৈরি হয়।
অতএব এই নিয়ে এখন দুই তত্ত্বের বিশ্বাসীদের মধ্যে চলেছে জ্ঞানের যুদ্ধ। সমান্তরাল জিন পরিচলন করে এলিসিয়ার কোষ আমদানি করা ক্লোরোপ্লাস্টকে জিইয়ে রাখে, নাকি তার শরীরে ঢোকা ক্লোরোপ্লাস্ট নিজেই নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম? কোনটা ঠিক? নাকি দুটোই ঠিক? উদ্ভিদ ও প্রাণী-কোষের মিলিত প্রচেষ্টায় তার নতুন বাড়িতে বেঁচে রয়েছে সেই ভিনদেশি ক্লোরোপ্লাস্ট?
ওপরের প্রশ্নটার উত্তর পেতে সময় লাগবে হয়ত, কিন্তু প্রাণীর দেহে উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষ-কারী জিন ঢুকিয়ে নিয়ে তাকে কাজ করানো সম্ভব সে পথ প্রকৃতিই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন।
সেই সঙ্গে আরো একটা আকর্ষণীয় পুরস্কারের লোভ দেখিয়েছেন প্রকৃতি এলিসিয়াকে দিয়ে। মানুষ বা যেকোনো প্রাণী সবচেয়ে বেশি শক্তি খরচ করে কিন্তু নিজের খাবার জোগাড় করতে। আমি যেমন রোজ ভয়াল দুশো এক বাসে চেপে বাড়ি থেকে কর্মক্ষেত্রে আসি যাই, সারাদিন মাথা গুঁজে কাজকর্ম করি, বিরাট ব্যাগ নিয়ে বাজার করি, ফুর্তির অবসরই মেলে না মোটে, আমার চেনা একটা বাঘ যেমন সারাদিন দৌড়ে বেড়ায় হরিণ ধরবার জন্য, তেমনই সব প্রাণীই তার দেহের শক্তির বেশিরভাগটাই খরচ করে খাবার জোগাড় করতে। ওদিকে এলিসিয়া তার শক্তির সবচেয়ে বেশিরভাগটা কীসে ব্যয় করে বলুন তো? প্রজননের বিভিন্ন ধাপে—উপযুক্ত সঙ্গী নির্বাচনে, সন্তান উৎপাদনে, আর করে নিজেকে বাঁচাবার জন্য।
তার মানে কাউকে না মেরে নিজের গায়ে নিজের খাবার যদি রোদ থেকে তৈরি করতে শিখি তাহলেই হাতেনাতে পুরস্কার–আহা- যা ইচ্ছে করবার মতন অঢেল শক্তি আর সময়।
এলিসিয়া ক্লোরোটিকা পথ দেখিয়েছে। প্রাণী-কোষ উদ্ভিদের সালোকসংশ্লেষ-কারী জিনকে আত্মীকরণ করে কাজ করাতে পারে। কিন্তু সে পথে এগিয়ে গিয়ে সবুজ মানুষ সৃষ্টি করবার পথে আমাদের প্রথমে সঠিকভাবে বুঝতে হবে ক্লোরোপ্লাস্টকে দেহকোষে সংস্থাপন করে তাকে টিকিয়ে রাখবার জেনেটিক প্রকৌশল। সেটা বলা বাহুল্য, সম্ভব। একটা প্রাণী তা পারে। শুধু প্রশ্নটা হল, তার সঠিক কৌশলটা অনুধাবন করা ও মানুষের দেহকোষের জন্য সে পদ্ধতিকে অদলবদল ঘটিয়ে উপযুক্ত করে তোলা।
অথবা নিজেদের দেহকোষকে না বদলেও, কৃত্রিম সালোকসংশ্লেষের পদ্ধতি আরো উন্নত হবার পর হয়ত সৃষ্টি করা যাবে রাইবিউলোজ ডাই ফসফেট আর উন্নতমানের RuBisCO যুক্ত কোষ দিয়ে বোনা একটা পোশাক, যা গায়ে জড়িয়ে নিলেই তা সূর্যালোককে শুষে নিয়ে গড়ে দেবে আমাদের খাদ্য।
কোন পথে এগোবে বিজ্ঞান তা কে জানে! তবে হ্যাঁ, যাত্রাটা শুরু হয়েছে। ২১৫০? হতে পারে। অথবা তার আগেও—কল্পনার খরগোশকে বাস্তবের ধীরগামী কচ্ছপ তো বারবারই দৌড়ে হারিয়ে দেয়। প্রযুক্তির ইতিহাসে তার উদাহরণের অভাব তো নেই কোন।
Tags: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য, প্রথম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, যখন সবাই খেতে পাবে