যতিচিহ্ন
লেখক: সোহম গুহ
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
যতিচিহ্ন
লেখক – সোহম গুহ
অলংকরণ – সুপ্রিয় দাস
ভাষা একটা দুস্তর ব্যবধান হওয়ায় মাওরী সর্দারের কথা ক্যাপ্টেন জেমস কুক বুঝতে পারছিলেন না। কিন্তু গ্রামের মাঝে গোটা রাত জ্বলা অগ্নিকুণ্ডের থেকে উঠে আসা পোড়া মাংসের গন্ধ তাঁকে একটা কথাই বলছিল। এখানে মানুষের মাংস মানুষ খায়। গ্রামের আদিম পরিবেশের থেকেও তাঁর মনোযোগ বেশি আকৃষ্ট করেছিল সর্দারের গায়ের বিচিত্র উল্কি।
‘গোটা পৃথিবী কি এরই সন্ধানে ঘুরেছি আমি?’
সর্দারের হৃদয়ের ঠিক উপরে ডাকিনী ওঝার কালি মাখা সূচ দাগ কেটেছে। এক মড়ার খুলির পানপাত্রে ভেসে এক অদ্ভুত আকারবিহীন জিনিস। রবার্ট হুকের আবিষ্কার করা কোষের সঙ্গে তার যেন কিছু মিল আছে। কিন্তু সর্দারের উল্কিকারের জানার কথা নয় অণুবীক্ষণিক জীবনের গল্প। সর্দারের দিকে তাকিয়ে ইঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন কুক। ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া সর্দারের উত্তর বোঝার জন্য তাঁর দোভাষীর দরকার ছিল না। পৃথিবীর যে কোনায় তিনি আদিম জনজাতিকে এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছেন, কী তাদের বিভিন্ন চিহ্নের মানে, উত্তর ঘুরেফিরে একই পেয়েছেন।
‘‘ঈশ্বর আসছেন।’’
১.
‘‘সমীরণ, আজ আপনি ভিটামিন সি ট্যাবলেটটা খাননি। এবং, কগনিটিভ রেজিস্ট্রেশনও করা নেই আপনার। বিকেল বিকেল অফিস থেকে ফিরে এসে মদ্যপান…’’ ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই সমীরণ চক্রবর্তী তাঁর সুইচ অফ করে দিয়েছেন। ইমপ্ল্যান্টটা মাথার পেছনে সরকারের নির্দেশমতো লাগানো যে বুদ্ধিমানের কাজ হয়নি তিনি তা হাড়ে হাড়ে বুঝছেন। ভেবেছিলেন আধারের মতোই এটাও আরেকটা কর্মযজ্ঞ। কিন্তু মাথার ভেতর উপদেষ্টা এসে বসবেন তিনি যদি জানতেন…
“ভাগ্য ভালো ব্যাটাকে ঘুম পাড়ানো যায়।” হুইস্কির গ্লাসে তিনটে বরফ ঢেলে দিলেন তিনি। এক চুমুক দিয়ে বারান্দায় দাঁড়ানোর পরপরই তাঁর দীর্ঘশ্বাস শুনল নিঃশব্দ ফ্ল্যাট। পায়ের অনেকটা নীচে একতলায় ছলাৎ ছলাৎ করছে সমুদ্রের জল। তাঁর অনলাইন নোটিস বোর্ডে গত দু’মাস ধরে বাড়ি খালির নোটিস ঝুলছে। প্রায় শব্দহীন ক্লিষ্ট হাসির সঙ্গে বারান্দার রেলিংয়ে একটা প্রবল চাপড় পড়ল। সমুদ্রস্নানের জন্য তাঁর আর দিঘা যাওয়ার প্রয়োজন নেই।
ভূতের শহরে তাঁর ফ্ল্যাটের মতো আরও কিছু জায়গায় আলো জ্বলছে। সৌরবিদ্যুতের সেলগুলো এখনও কাজ করছে আটলান্টিস হতে চাওয়া কলকাতায়। তিলতিল করে গড়ে তোলা এই সাম্রাজ্য তাঁর পূর্বসূরিদের জন্য আজ সাগরজলের নীচের সূর্য। একটা ধোঁয়াশার পর্দা তৈরি হয় যখনই তিনি স্মৃতি রোমন্থন করেন। কেন? সমীরণ জানেন না। কেবল জানেন, পৃথিবীটা দশটা বছর আগেও অন্যরকম ছিল। রাস্তার কোলাহল, এমজি রোডের ট্রাফিক জ্যাম, ময়দানের হাওয়া বা বাবুঘাটের সূর্যাস্ত… কিচ্ছু টেকেনি। গলা হিমশৈলের জল সবকিছু ছারখার করে দিয়েছে আজকে। এই শহরে আজ আর কারও ভাইরোলজিস্ট এবং মলিকুলার সেলবায়োলজিস্ট সমীরণ চক্রবর্তীকে প্রয়োজন পড়বে না। মানুষ আজ ব্যস্ত কেবল নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে।
হুইস্কিটা টেবিলে রেখে তিনি অনেকদিন আগে আসা চিঠিটা হাতে তুলে নিলেন। দেখেছিলেন কি তিনি চিঠিটা? সমীরণের মনে পড়ল না। মনে করতে গেলেই সেই ধোঁয়াশার পর্দাটা যেন আরও ঘন হয়ে আসে। কেপটাউন থেকে চিঠি পাঠিয়েছে ছেলে। ওখানকার সর্বসেরা প্লাস্টিক রিসাইকেল সেন্টারে কাজ পেয়েছে সে। দেবতারা যেমন সমুদ্রমন্থন করে তুলে এনেছিলেন অমৃত, বিভাসের কাজও প্রায় তাই। পলিথিন ব্যাগ থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক… সবই সমুদ্র ছেঁকে তুলে আনছে তার পেটেন্ট করা ন্যানোবটগুলো। কে একটা বলেছিল বটে, “আমরা এই পৃথিবী উত্তরাধিকার সুত্রে পাই না, আমাদের সন্তানদের কাছ থেকে বসুন্ধরাকে ধার করি মাত্র।”
ছেলে তাঁর থেকে অনেক প্রাগ্রসর হলেও এই যুগে হাতে লেখা চিঠি কেন পাঠাল সমীরণ ধরতে পারেননি। হয়তো তাই আর একবার চিঠিটা শুরু থেকে আবার পড়া শুরু করলেন তিনি। আর একবার? এর আগে তিনি কবে পড়লেন চিঠিটা?
নাহ্, কোথায় কী? এ তো কেবল সাধারণ কুশলবার্তা। ভাবতে ভাবতে হটাৎই কারেন্ট চলে গিয়ে চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঢেকে গেল। প্রায়ই হচ্ছে এমন। গত সপ্তাহে ছাদে উঠে জোড়াতাপ্পি মেরেছিলেন বটে, কিন্তু সৌরসেলগুলোর আয়ুও তো সীমিত।
সমীরণ অন্ধকারে কিছুক্ষণ বসে বুঝতে পারলেন বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। হয়তো কাকতালীয়, কিন্তু তাঁর সামনে খোলা চিঠির যতিচিহ্নগুলো রাতের অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে। ফ্লুরোসেন্ট আলো! গোলাপি এবং বেগুনি মিঠে আলো তাঁর বিস্ফোরিত চোখের মণিতে প্রতিফলিত হচ্ছিল। এই আলো তিনি চেনেন। এই রং তিনি চেনেন। এই আলোর উদ্ভাবক যে তিনিই।
মাইক্রোস্কোপ টেনে বের করার সময় তাঁর ঠোঁট বিড়বিড় করে উঠল, “গ্রাম পজিটিভ, গ্রাম নেগেটিভ।’’
২.
“আরে, আপনি?” নতুন দিল্লির সিএসআইআর কার্যালয়ে তাঁর কেবিনে সমীরণ চক্রবর্তীকে ঢুকতে দেখে ডিরেক্টর নিজেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর আগে এই চেয়ারে সমীরণের অধিকার ছিল যে। ভাগীরথ নায়েক বহুবার বলা সত্ত্বেও সমীরণ ষাট পার হওয়ার পর এক বছরও আর সিএসআইআর-এ থাকেননি। ফিরে গিয়েছিলেন তখনকার সদ্য ডুবতে শুরু করা কলকাতায়, ভালবাসার শহরে। যেখানে তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা, যার অলিগলিতে জমে আছে বহু স্মৃতি, তাকে তিনি ত্যাগ করেন কীভাবে? ভাবলেও চিনচিনে একটা কষ্ট জমে বুকে। তার পর পৃথিবী সূর্যকে প্রদক্ষিণ করেছে আরও ন’বার, কিন্তু ভাবনার ফলে জমা কষ্টটা এখনও একই রয়ে গেছে।
ভাগীরথ চা আর খাবার আনার অর্ডার দিলেন। কেমন যেন ভূতগ্রস্ত লাগছে সমীরণকে। চোখের তলায় কালি, আরও যেন ঝুঁকে পরেছেন সামনের দিকে। বয়সের ভারে? না, ডক্টর সমীরণ চক্রবর্তীর বয়স শরীরের বাড়ে, মনের নয়। এটা মনের বয়সের প্রতিচ্ছবি; কোনও কিছু তাঁকে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন করে তুলেছে যেন বিগত তিন চার দিন ধরে।
“সমুদ্রের তলায় কিছু ঘটছে ভাগীরথ, আমার তোমার চোখের আড়ালে।” চেয়ারটার মধ্যে যেন তলিয়ে গেলেন সমীরণ।
“কী হয়েছে, সমীরণদা?” তাঁর দিকে চা এবং স্যান্ডউইচ এগিয়ে দিয়ে ভাগীরথ জিজ্ঞেস করলেন। সিএসআইআর ছাড়ার পর ভদ্রলোকের যে মস্তিষ্ক বিকৃতি দেখা দিয়েছে ভাগীরথ শুনেছিলেন। হয়তো ছেলের অকালমৃত্যুই এর কারণ। সহযোগিতা করেছিল ভূতের শহরের অসহ্য একাকিত্ব।
“এটা দেখো।” চিঠিটা ফাইল থেকে বের করে এগিয়ে দিলেন সমীরণ। তারিখ ঠিক তিন মাস আগের। বিভাসের মৃত্যুর ঠিক একদিন আগে ডাকে ফেলা হয়েছিল এই চিঠি। ভাগীরথ চিঠিটা সম্পর্কে যথেষ্ট অবহিত। ইমেলের যুগে পাঠানো এ যেন এক সুপ্রাচীন জীবাশ্ম।
সন্তানের মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি সমীরণ। টানা কিছুদিন অজ্ঞান থাকার পর তাঁর মাথা থেকে মুছে গিয়েছে সম্পূর্ণ ঘটনাটা। ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্টটি না থাকলে হয়তো ওই ঘরে একদিন পড়ে থাকত তাঁর নিষ্প্রাণ দেহটা। চার দিন পর জ্ঞান ফিরলেও সমীরণ আর আগের মানুষটি ছিলেন না। চিঠি পাওয়ার আগের চব্বিশ ঘণ্টার যাবতীয় বিবরণ তাঁর মনের স্লেট থেকে মুছে গিয়েছে। স্রষ্টা সমীরণকে হয়তো স্নেহ করেন খুব, সমস্ত ক্ষমতাবলে সন্তান হারানোর দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছেন। তাঁর চোখে এখনও বিভাস জীবিত। ভাগীরথ ইচ্ছা করেই সেই ভুলটা আর ভাঙলেন না, বরং তাঁর হাত থেকে টেনে নিলেন চিঠিটা। সমীরণ উঠে ঘরের লাইট বন্ধ করতেই যতি চিহ্নগুলো যেন জেগে উঠল।
“এতো আপনার আবিষ্কার করা গ্রাম পজিটিভ-নেগেটিভ ফ্লুরোসেন্ট স্টেন। এটাকে এভাবে…”
“আপনার কাছে এমনি লাইট মাইক্রোস্কোপ আছে? থাকলে ওর নীচে ফেলে দেখুন।“
চমক বোধহয় ভাগীরথের জন্য অপেক্ষা করছিল। “এ কী! এ তো…”
“দাঁড়িগুলো প্রত্যেকটা সালমোনেলা প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া, কমাগুলো ভিব্রিও, আর ফুলস্টপগুলো কক্কাস। আপনি দেখলেন, কিন্তু তাও আপনার যুক্তিবাদী মন বলেবে, ‘সে তো আণুবীক্ষণিক!’ জানি আণুবীক্ষণিক। কিন্তু আসল চমক এদের ডাইনোসর টাইপের সাইজে নয়। এনজাইম আর স্পেশাল সেরামিক গ্রোথ মিডিয়ামে যে এটা সম্ভব তাও আমি জানি, আমার একটা আনপাবলিশড পেপার ছিল এই নিয়ে। গণ্ডগোলটা অন্য জায়গায়।”
সিএসআইআর-এর ল্যাবের গবেষকরা প্রতিষ্ঠানটির ভূতপূর্ব এবং বর্তমান ডিরেক্টরকে একসঙ্গে নেমে আসতে দেখে একটু অবাকই হল। উৎসেচক দিয়ে কাগজ থেকে একটা দাঁড়ি বা সালমোনেলাকে আলাদা করে আরেক ধরনের উৎসেচক দিয়ে তার থেকে সেন্ট্রিফিউজ করে পাওয়া ডিএনএ-কে আলাদা করে ভাগীরথ একজনকে হোল জিনোম সিকোয়েন্সের চালাতে বললেন। দশ মিনিট পর মনিটরে রেজাল্ট ফুটে উঠতে সমীরণ বলে উঠলেন, আমি ঠিক ধরেছিলাম। আমি ঠিক…” কথাটা শেষ করতে গিয়ে ভাগীরথের কপালে ভ্রুকুটি দেখে চুপ করে গেলেন। “কী হয়েছে ভাগীরথ?”
“সমীরণদা, ব্যাকটেরিয়াগুলোর ডিএনএতে যে মলিকিউলার প্লাস্টিক লুকিয়ে বসে আপনি বুঝেছিলেন। মানছি, এই লেভেলে প্লাস্টিক ইনভলভমেন্ট, সত্যি আতঙ্কের। কিন্তু দাদা, আমার চিন্তার বিষয় অন্য। এই সালমোনেলা প্রজাতি কেবলমাত্র স্পার্ম তিমির শরীরেই মেলে, তাও খুব কম। আমি বাজি রেখে বলতে পারি, বাকি দুই ধরনের মাইক্রোবের উৎসও তিমি বা অন্য কোনও সামুদ্রিক প্রাণী। সমস্যা সেটাও না। সমস্যা হল…” সিকোয়েন্সের একজায়গায় আঙুল দেখিয়ে বললেন তিনি, “দেখতে পাচ্ছেন কীভাবে মিথোজীবী প্লাস্টিকটা তলোয়ারের মতো ডিএনএ-র ভেতর বসেছে?”
যেন বিস্ফোরণে ভাঙা ধাতুর টুকরোর মতো যত্রতত্র বসে গেছে প্লাস্টিকগুলো। ভ্রুকুটি এবার সমীরণের কপালেও দেখা দিল। সবই যেন বড্ড চেনা, ঘোরাফেরা করছে ওই ধোঁয়াশার পর্দার ওদিকে। বিভাসকে নিয়ে বহুকাল আগে কোথায় যেন একটা দেখেছিলেন এটা। জাদুঘরে কি? সঙ্গে সঙ্গে যেন ধোঁয়াশার পর্দারওপাশ থেকে কেউ একজন সমীরণের হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিল। লেখাটা দেখে তিনি বুঝলেন তাঁর অনুমান সঠিক। তাও,ভাগীরথের দিকে ঘুরে জিজ্ঞেস করলেন, “কিউনিফরম?” লক্ষ করলেন কনকনে ঠান্ডা এসিতেও তাঁর উত্তরসূরির কপালে ঘাম।
“হ্যাঁ। কিউনিফরম।”
“জিন এডিটিং করে লেখা? কিন্তু তা কী করে সম্ভব?” সমীরণের চোখে তখন একগাদা প্রশ্ন।
‘‘এটার কথা জানার জন্য…” বলতে গিয়েও থেমে গেলেন সমীরণ, “তুমি জানো কি লেখা আছে এতে।”
ল্যাবের বাকিদের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলতে অস্বস্তি বোধ করছিলেন ভাগীরথ। ইতস্তত করে সমীরণকে ফেরত নিয়ে গেলেন নিজের কেবিনে।
“তুমি কেবল লেখাটা পাওনি সমীরণদা। বাইরের দুনিয়ার তো কিছুই খবর রাখো না, জলের মধ্যে একা একা থাকো। আমাদের যখন তরুণ রক্ত, সেই সময় ‘নেচার’-এ বেরোনো রিপোর্টটার কথা তোমার কি মনে আছে?”
সমীরণ চুপ করে গেলেন। ভাগীরথের মতো কম বয়স তাঁর নাহলেওতিনিও তখন তরুণ। সদ্য জেআরএফ পেয়ে আইআইসিবির ল্যাবে ঢুকেছেন। রক্ত তখন তাঁর গরম, আর স্বপ্নালু চোখে পৃথিবী বদলানোর প্রয়াস। পৃথিবী বদলায়নি। তাঁর স্বপ্ন কেটে গেছে বরং তাঁর গাইডের পেসিমিস্টিক ব্যবহারে। তখনই ‘নেচার’-এ বেরিয়েছিল সেই রিপোর্ট যা গোটা দুনিয়াকে নাড়িয়ে দিয়েছিল।
‘আগামী তিরিশ বছরের মধ্যে সমুদ্রে মাছের থেকে প্লাস্টিক বেশি থাকবে। মানুষের লোভ…’
সেদিনকার সেই ভবিষ্যৎ আজকের বর্তমান।
“মনে আছে ভাগীরথ, কিন্তু তার সঙ্গে এর…”
“গোটা পৃথিবীর জায়গায় জায়গায় ডি-কমিশন করা সামুদ্রিক তৈলকূপগুলোকে তো প্লাস্টিক রিসাইকেল কেন্দ্র হিসাবে ইউজ করা হচ্ছে জানোই। কিন্তু সেখানে তার সঙ্গে সঙ্গে প্লাস্টিক জীবজগতের কী কী ক্ষতি করছে বা করেছে তা জানার গবেষণাও চলছে। সত্যি বলতে কী, পৃথিবীর কোনও জায়গাই আর প্লাস্টিকমুক্ত নয়। সেই গবেষণায় উঠে আসে এমন কিছু সামুদ্রিক জীবের কথা যাদের মধ্যে প্লাস্টিক ঢোকার কথাই নয়, কিন্তু ঢুকেছে। একটা প্রমাণ আমাদের চোখের সামনেই। এরকম অসংখ্য স্পেসিমেন পাওয়া গেছে গোটা পৃথিবীজুড়ে। আর সমীরণদা, সবার ডিএনএ-তেই এই লুপ্ত ভাষায় একই কথা লেখা, ‘ঈশ্বর আসছেন। লেখাটা খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ সালের এক আনুনাকি ট্যাবলেটের শেষ বাক্য।’’
***
সিএসআইআর-এর বিশাল খোয়াফেলা ছাদে একটা প্রায় জুড়িয়ে যাওয়া কফির মগ নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলেন সমীরণ। না, ইচ্ছা করছে না তার চুমুক দিতে। পৃথিবীটা বড্ড পালটে গেছে। এত লোভ মানুষের? নিজের প্রজাতির প্রতি যে এই বিতৃষ্ণার জন্ম হয়েছে তাঁর মনে, এর শিকড় মনের আরও গভীরে কোথাও প্রোথিত নয় তো? সেই ধোঁয়াশার চাদরটা আবার কেউ যেন পেতে দিচ্ছে তাঁর সামনে। কেউ যেন সেই চাদরের ওধারে দাঁড়িয়ে। হাত বাড়িয়ে তাঁকে সাবধান করছে। বক্তার দৈহিক আকৃতি এবং গলার স্বর তাঁর যেন খুব চেনা।
“এক দেবতার মৃত্যু ঘটলে আর এক দেবতার জন্ম হয়। আমরা স্রষ্টাকে মেরেছি তিলে তিলে। সংহার তো আসবেন এবার। কল্কি যুগ। বাঁচব কী করে, বাবা?”
সমীরণের হাত থেকে ধুপ করে পড়ে যাওয়া কফির মগটা অনেকখানি খোয়াকে হালকা ভিজিয়ে দিল।
মনে পড়েছে তাঁর। সব কিছু মনে পড়েছে। যে চব্বিশ ঘণ্টা তাঁর কাছ থেকে চলে গেছিল তার পুরোটাই। রিসাইকেল সেন্টারে কাজের সময় অনেকগুলো ঘুঁটিকে এক সুতোয় গেঁথে ফেলেছিল বিভাস। বাবাকে ফোনে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়েওছিল। ব্যাপারটার বিশালতা এবং ভয়াবহতা নাড়িয়ে দিয়েছিল সমীরণকে। ছেলে প্রমাণ হিসেবে গোপনীয়তা রক্ষা করতে পাঠিয়েছিল অনেকদিন পর ডাকে ফেলা একটা চিঠি। সেই চিঠি যাকে তিনি ভুলে গেছিলেন… তাঁর ছেলের শেষ আঁচর কাটা হস্তাক্ষর। চোখ থেকে টপটপ করে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো তাঁর। কোন সন্তানেরই এভাবে তার বাবাকে একলা কলে চলে যাওয়া ঠিক নয়। একদম ঠিক নয়।
‘‘ভাল করলি না বিভাস।’’
না, তাঁর ছেলের কাজে তিনি গর্বিত। হ্যাঁ, সে চলে গেছে চিরকালের মতো, কিন্তু তার কাজ মানুষদের আরও কিছুদিন হয়তো নিশ্বাস নিতে সাহায্য করবে। তাঁর ছেলে আজ পৃথিবীর স্বার্থে শহিদ। এর থেকে বড় সম্মানের আর কী হতে পারে সমীরণের কাছে! দ্রুত পায়ে তিনি সিঁড়ির দিকে এগোলেন। ভাগীরথের সবটুকু জানা খুব জরুরি। মাথার মধ্যে তখন তাঁর ওই কথাটাই ঘুরছে। “ঈশ্বর আসছেন। A God is coming.”
“কম্পিউটারটা একটু হবে?” ভাগীরথ হটাৎ সমীরণের এরকম হন্তদন্ত হয়ে আসার অর্থ বুঝতে পারলেন না। কেবল দেখলেন সেই বুড়ো লোকটা হটাৎ যেন একটু জোয়ান হয়ে গেছে। ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে তিনি ল্যাপটপটা এগিয়ে দিলেন।
“তুমি জানোই, তাও বলছি। ২০১২ সালে একটা কিউনিফরম ট্যাবলেট পাওয়া যায়, যার বক্তব্যের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার গসফর্ড হাইরগ্লিফসের বক্তব্যের অদ্ভুত মিল। সেখানে বলা আছে কিছু দেবতার কথা, যাদের সঙ্গে আমাদের প্রচলিত কোনও ধর্মের কোনও দেবতার কোনও রকম মিল নেই। এরা সবাই নিচু স্তরের দেবতা। এদেরকে উঁচুস্তরের দেবতারা শাসন করেন, দমিয়ে রাখেন। কিন্তু, যখন উচ্চ দেবতারা মারা যান, এরা জেগে ওঠে।’’
ভাগীরথকে বোকার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে সমীরণ ল্যাপটপটা তাঁর দিকে ঘুরিয়ে দিলেন। ভাগীরথ থতমত খেয়ে ল্যাপটপের দিকে তাকালেন। মনে তাঁর তখন ঈশান কোণের মেঘের মতো প্রশ্ন জমছে। আনুনাকি ট্যাবলেটটার সম্পর্কে তিনি প্রায় সবই জানেন, কিন্তু সেই তথ্যগুলো কীভাবে তাঁর সামনের জন পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও জানলেন? সমীরণ ভাগীরথের অবাক দৃষ্টিকে পাত্তা দিলেন না। বলে চললেন, “পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি কোণের যে কোনও জনজাতির লোককথায় উল্লেখ আছে মহাপ্রলয়ের, সেই বন্যা সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। সেই প্রলয়ের জন্য দায়ী…” ভাগীরথের দিকে তাকিয়ে কথাটা অর্ধসমাপ্ত রাখলেন সমীরণ। তাঁর নিজের চোখের সামনে গোটা জীবনটা ভেসে উঠল।
২০০১ সাল। হঠাৎ এক সকালে উঠে চোদ্দো বছরের সমীরণ বুঝতেপারল যে অনেকদিন মা-বাবা আর তাকে ঘুম পাড়ায় না। কেন, সে বুঝতে পারেনি কলকাতার দাদুর বাড়িতে বসে। পর্দার আড়াল দিয়ে দেখেছিল স্থানু হয়ে বসে থাকা এক বৃদ্ধ মানুষ চলতে থাকা টিভির দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদছেন। কেন? সামনের টিভিতে খবর চলছে। টিভিটা মিউট করা। নিউইয়র্কে দুটো স্কাইস্ক্র্যাপারে প্লেন ভেঙে পড়েছে। অনেক বাড়ি না ফেরা মানুষের মতো সেটা ছিল তাঁর বাবা-মায়েরও সেদিনের কর্মস্থল। কলকাতা থেকে একটা বিজনেস ডিল করতে কয়েকদিন আগেই সেখানে উড়ে গেছিলেন মিস্টার ও মিসেস চক্রবর্তী। উন্মাদ ধর্মান্ধতা এবং মিথ্যা প্রোপাগান্ডার বলি হয়েছিল সেদিন অনেকে। বড় হয়ে তিনি বুঝতে পারেন দেয়ালে কতটা পিঠ ঠেকে গেলে, কতটা বেপরোয়া এবং নৃশংস হলে, কতটা ব্রেনওয়াশড হয়ে কেউ স্থিরচিত্তে এমন সন্ত্রাস করতে পারে। সেইদিন মানুষের ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে একটাই উপলব্ধি হয়েছিল সমীরণের। একটা বিবর্তনের পথে অচ্ছুৎ বানর আজ দুনিয়ার রাজা। নিজের ইচ্ছেমতো পৃথিবীকে পালটাচ্ছে সে।
‘‘ষষ্ঠ মহা বিলুপ্তি? ধুস, সে আবার কী? তার আগে আছে পইসা।’
অর্থনর্থম।
কিন্তু কোনও নশ্বর ঈশ্বর হতে চাইলে তাকে ইকারাসের মতো গলতে শুরু করা ডানায় পুড়িয়ে মেরে বোঝাতে হয় তার আসল স্থান কোথায়। পায়ের নীচে। আর সেই জন্য…’’
কথাটা শেষ করলেন সমীরণ, “তিনি আসছেন।”
“কে?”
“ব্রুকলিন মিউজিয়ামে কাজের সময় একজন ভাষা বিশারদ একটা নাম খুঁজে পান। কাথুল্কিচ, একজন সাইকোপম্প, আদি সাইকোপম্প (Psychopomp)। কোন টেক্সট থেকে নামটা তিনি উদ্ধার করেন জানো? ‘rwnwprt m hrw’ বা বুক অফ ডেড। এই আদিতম সাইকোপম্পের উৎপত্তি আমাদের ভারতবর্ষে, মানুষের প্রতি সে তার ক্রোধ বর্ষণ করেছিল যখন তারা এখানে আসে। সবাই ভুলে গেছে তাঁর কথা, একটা জনগোষ্ঠী বাদে। ৫০০০০ বছর একটা বিরাটকালখণ্ড, কোনও মানবগোষ্ঠীর ভয়ে কুঁকড়ে থাকার জন্য। কিন্তু মানুষ ভুলে গেল সেইদিনের কথা, যেদিন তাদের প্রজাতির ঘরে শিবরাত্রির সলতে বানানোর জন্য মাত্র ৪০০০ জন টিকে ছিল। ভুলে গেল তারা, ছড়িয়ে পড়ল গোটা পৃথিবীতে। ভুলে গেল তারা, কিন্তু একটা চোরা ভয় রয়েই গেল। ইতিহাসের ভগ্নাংশ রয়ে গেল শ্রুতি হিসেবে। তারপর অনেক পরে, সভ্যতা ও ভাষা গড়ে উঠলে সাইকোকম্পের পূজা শুরু হয় গোটা পৃথিবী জুড়ে। মিশরে সে আনুবিস, গ্রিসে চারণ, রোমে মার্কারি, আর আমাদের সিন্ধু এবং এরিয়ান সভ্যতায় সে পূজিত হয় কল্কি নামে। কিছু ঘটেছিল আজ থেকে ৫০০০০ বছর আগে। তার ফলে হোমো স্যাপিয়েন্সের ঘরে বাতি জ্বালানোরও লোক কেউ প্রায় ছিল না। আমরা বিলুপ্তই হয়ে যেতাম। হইনি। সেই ঘটনার কথা আমরা ভুলে গেছি। কেবল খাপছাড়া ভাবে লেখা আমাদের পুরাণ এবং আমাদের ক্রমবিবর্তনশীল ভাষায় তার চিহ্ন রয়ে গেছে। শব্দ পালটায়, হারিয়ে যায়, কালের নিয়মে ভাষাও। কিন্তু যতিচিহ্ন কন্সট্যান্ট। যতিচিহ্ন। নামের মধ্যেই লুকিয়ে তার উৎপত্তি। সে শেষের অগ্রদূত।’’
“জনজাতি? কোন জনজাতি?”
“সব আদিম জনজাতিই, ভাগীরথ। আমাদেরও হয়েছিল। আমরা ভুলে গেছি, কেবল লিখে রেখেছি পুরাণে। না হলে মহাভারত থেকে বাইবেল, সব জায়গায় একই প্রলয়ের বর্ণনা থাকত না। ইউরোপীয়রা ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের সময় এর কথা জানতে পারে। আমাজনের মাসচ-পির থেকে নিউগিনির ডানি উপজাতি, সবাই জানে কী হতে পারে, কিন্তু তাদের সঙ্গে আমাদের মেলবন্ধনের ফলে তারা ভুলতে বসেছে। সভ্যতার ‘দান’ কি একে বলা যায়?”
“আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না, দাদা।’’
“মানুষ সবসময় বিশ্বাস করত তাদের উপরে কেউ আছে, যতদিন না বিজ্ঞান সেই বিশ্বাস ভেঙেচুরে দেয়। না, এলিয়ান নয়। ভিনগ্রহী তাদেরই বলা যায় যারা অন্য গ্রহের হলেও এই মহাবিশ্বের অংশ। যারা ঘুমিয়ে আছে এতদিন ধরে, যারা পারমিয়ান এক্সটিঙ্কশন করিয়েছিল, তারা আর যাই হোক, ভিনগ্রহী নয়। বরং তারা ছিল এক আদিম জান্তব সত্তা। আমাদের ভাবনায়… ঈশ্বর।”
“কারা?” ভাগীরথের গলায় এবার অধৈর্যের সুর।
“যাদের বয়স আমাদের মহাবিশ্বের থেকেও বেশি। যারা এতদিন ধরে ঘুমিয়ে আছে আর একবার আমাদের ধ্বংস করার জন্য। ঈশ্বর, অন্ধকারের ঈশ্বর। আমাদের যেতে হবে। ওরাই একমাত্র জানে ওঁর প্রকৃত রূপ এবং যদি ভাগ্য সহায় হয়, তাহলে তাঁকে আটকানোর উপায়ও।”
সমীরণের ব্যাখ্যা এবং যাবতীয় কথা দিল্লির এসি ঘরে বসে শুনতে আজগুবি লাগছিল ভাগীরথের। কিন্তু কিউনিফরম এবং ডিএনএ-র ফটো তাঁর চোখের সামনে। তারা তো আর কল্পনা নয়! গতকালের খবরের কাগজের হেডলাইনও তাঁর মনের জানলায় টাঙানো। কোন অজানা কারণে দলে দলে তিমি এসে আত্মহত্যা করছে গোটা পৃথিবীর প্রায় সব সৈকতে। পেটে তাদের ভর্তি মানুষের বানানো বর্জ্য। কেন? ভাগীরথ জানেন না। কিন্তু তিনি বুঝতে পারছেন, অজানা কিছু একটা আসছে। আসছে। সেই না জানার আতঙ্ক তার শিরদাঁড়া বেয়ে একা সুমেরু সাগরের স্রোত নামিয়ে দিল। জিজ্ঞেস করলেন, “কারা জানে?”
“যারা এখনও বাইরের দুনিয়ার মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। তোমায় কিছু কল করতে হবে। পারমিশন যদি পাও, দেখো। গোটা দুনিয়া যখন প্রশ্নের মুখে।”
৩.
“এবার?” দ্বীপটার দিকে তাকিয়ে ভাগীরথ জিজ্ঞেস করলেন। কীসের জন্য আজ তিনি এখানে স্পষ্ট নয়। একটা আলেয়ার পেছনে যেন তাঁকে ছোটাচ্ছেন সমীরণ। ভদ্রলোকের নিজের ছেলের মৃত্যুর কথা মনে পড়েছে, কিন্তু তা নিয়ে তিনি শোকস্তব্ধ নন। যেন তিনি জানতেন ওর মৃত্যু হতেই পারে। অনিবার্য নয়, কিন্তু সম্ভাব্য। ভাগীরথ শুনেছিলেন বিভাস আত্মহত্যা করেছিল। সাগরের বুকে জেগে থাকা ওই রিকমিশনড তৈলস্টেশনে ওর দেহটা আবিষ্কার করেন ওর একমাত্র সহকর্মী, বদ্ধ জায়গায় বুলেটের আওয়াজ পেয়ে ছুটে এসে। একটা হাতে লেখা চিঠি থেকে স্পষ্ট নয় ঠিক কী খুঁজে পেয়েছিল সে। কাথুল্কিচ নামটাও সেরকম। প্রথমবার শুনলেও মনে হচ্ছে যেন কোথায় শুনেছেন বা পড়েছেন। না, কোনও রিপোর্টে নয়, যেন কোনও লাইব্রেরিতে অলস অবসর কাটানোর সময়। Kathulkich… Kathulkich… মাথা ঝিমঝিম করে উঠল ভাগীরথের। বয়স বাড়ছে। রাতও। সমীরণের দিকে মন না দিয়ে তিনি অপলকে তাকিয়ে রইলেন দ্বীপটার দিকে। এখনও তাঁরা ভারতের মধ্যে। কিন্তু এই দুনিয়া সভ্য মানুষের জন্য নয়। নির্মেঘ তারার আলোর নীচে বিরাট তিমির পিঠের মতো জেগে আছে ছোট্ট দ্বীপটা। সাগর উপরে উঠে আসার ফলে যাকে বলে তার আগের রূপের ভগ্নাংশ। নর্থসেন্টিনেলিশ। সমীরণের কথা ঠিক হলে তাঁর সব প্রশ্নের উত্তর ওই ঘন জঙ্গলের ভিতরে। কিন্তু যারা বাইরের মানুষকে যুগপৎ ভয় ও ঘৃণা করে, তাদের কাছ থেকে কীভাবে কিছু জানা যাবে? মানব সভ্যতার ইতিহাসে একজন বাদে তো কেউ পারেওনি।
বহু বছর আগে, কাকতালীয় ভাবে দিল্লিতে এক সেমিনারে সমীরণের সঙ্গে দেখা হয়ে গেছিল ডঃ টিএন পণ্ডিতের। কেন জানি না, হয়তো স্থানমাহাত্ম্যে সেই সাক্ষাৎ তাঁর মনে পড়ল। দিল্লিতে এক স্কাইস্ক্র্যাপারের একটি তলায় হচ্ছিল জেনেটিক্সের সেমিনার। আর তার ঠিক উপরের তলায় ট্রাইবাল অ্যানথ্রোপলজির। লাউঞ্জে হঠাৎ ছাত্র সমীরণের সঙ্গে ধাক্কা লেগে যায় এক বৃদ্ধ মানুষের। মানুষটি বৃদ্ধ, কিন্তু তাঁর চোখের জ্যোতি সকালের সূর্যের মতো। ক্ষমা চাওয়া থেকে আলাপ এবং সেই সম্পর্ক টিকে থাকে পণ্ডিতের মৃত্যু অবধি। না, কাথুল্কিচ নামটা তিনি বলেননি, তিনি কেবল বলেছেন কাপড়জামা পরা সভ্য মানুষ ওদের কাছে এলিয়েনই। এবং ওরা বিশ্বাস করে সভ্যতা আসলে পাপ, সেই পাপের বিষ যাতে তাদের ক্ষুদ্র জনজাতিকে সংক্রামিত না করে, তাই তাদের দ্বীপে ‘সভ্য’ মানুষের পা রাখার অধিকার নেই।
সমীরণ বুঝতে পারেননি কীসের এই সতর্কতা, কীসের ভয়। পণ্ডিত বেশি ভাঙেননি। তাঁর গোটা জীবনের কাজ সম্পর্কে এর থেকে বেশি কিছু বলে যাননি। কেবল একটা ছবি দেখিয়েছিলেন, ওদের পূজিত ঈশ্বরের। জেমস কুকের ডাইরির একটা পাতায় আঁকা ছবির সঙ্গে তার আশ্চর্য রকমের সাদৃশ্য। না, এই দুই মানবগোষ্ঠী – মাওরি এবং সেন্টিনেলিশ – কখনও একে অপরকে দেখেনি। সঙ্গে আর একটা ছবি দেখিয়েছিলেন পণ্ডিত। সেন্টিনেলিশদের বানানো সেই মেঝে জুড়ে আঁকা ভবিষ্যদ্বাণীর কথা মনে পড়তেই সমীরণ একটু কেঁপে উঠলেন। না, সেগুলো এখন না মনে করলেই হতো।
মধ্যরাত হতে তিনি দেখলেন মেঘ জমছে আকাশে। ক্যাপ্টেনকে বললেন তিনি, “চালাও প্রজেক্টর।”
দ্বীপের উপরে মেঘের গায়ে ফুটে উঠল নারকেল মালার উপর ভাসমান একটা বিজাতীয় কোষের ছবি। ওদের ঈশ্বর। নাইট ভিশন দূরবিন দিয়ে কেবিনে বসে ভাগীরথ দেখতে পেলেন জঙ্গলের মধ্যে সঞ্চারমান অনেকগুলো ছায়া। কপাল ঘেমে উঠল তাঁর। নিজের কেবিনে বসে ওই অতগুলো ফোন তাঁর কীসের পরিচয় ছিল? নিজের দূরদৃষ্টির, নাকি সমীরণের কথা শুনে নেছে ওঠার অবিমিশ্রকারিতা? ভাগীরথ ক্লিষ্ট হেসে ফেললেন। এখন ওসব ভাবার পক্ষে কিঞ্চিৎ দেরি হয়ে গেছে যে।
মেঘের মধ্যে ভাসানো ছবির উত্তরে জাহাজের গায়ে এসে লাগল একটা বর্শা। তারপর পরপর আরও কয়েকটা।
“ওরা আমাদের চলে যেতে বলছে। আমাদের এক্ষুনি যেতে হবে।”
“আপনি সামান্য বর্শায় ভয় পাচ্ছেন?” হন্তদন্ত করে আসা ক্যাপ্টেনকে জিজ্ঞেস করলেন সমীরণ।
“না স্যার। আমি জানি আপনারা অনেক উপর তলা থেকে এখানে আসার অনুমতি যোগাড় করেছেন, কিন্তু আমি এখানে থাকতে পারব না। আর একদণ্ডও না। ওরা আগে কেবল বর্শা ছুঁড়ত, কিন্তু আপনার মেঘবার্তার পর এটা দিয়েছে বর্শার সঙ্গে বেঁধে, আমার জানা এটা প্রথম,” বলে একটা মোড়ানো নারকেলপাতা তাঁদের সামনে রেখে জাহাজ ছাড়তে বললেন ক্যাপ্টেন। ভাগীরথ বিপর্যস্ত সমীরণের দিকে তাকিয়ে নারকেল পাতাটা সাবধানে খুললেন।
“আমরা বড্ড দেরি করে ফেলেছি সমীরণদা,” বলে পাতাটা তাঁর দিকে এগিয়ে দিলেন। উপরের ডেকে চেঁচামেচি হচ্ছে, হয়তো জাহাজ ছাড়ানোর তৎপরতা। কিন্তু এত গণ্ডগোল হবে কেন? পাতাটা সমীরণের সামনে হাট করে খোলা, তাতে সুনিপুণভাবে দিগন্তের সঙ্গে গ্রহ-নক্ষত্রের সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। সেই পাতায় গাছের সাদা আঠা দিয়ে আঁকা সেন্টিনেলিশদের ভবিষ্যদ্বাণী। পণ্ডিতের কম রেজোলিউশনের ফোটোয় সমীরণ বুঝতে পারেননি তখন। এখন পারলেন। বিভাস শিখিয়েছিল তাঁকে। তিথিটা আজকের এবং তা নির্ধারণের সমীকরণ অত্যন্ত প্রাচীন। যে মাপজোকের ভরসাতেই এককালে আফ্রিকা থেকে সুদূর পূর্বের দিকে পাড়ি দিয়েছিল কিছু মানুষ। যদিও তারপরে আর ‘সভ্য’ হয়ে ওঠা হয়নি তাদের। সভ্য? মানুষ কি আদৌ তা? যারা ধর্মের জন্য দেশকে বিক্রি করে, স্বপ্রজাতিকে খুন করে, বিভেদ বানায় অর্থলোভে, তারা কি সভ্য? নাকি প্রকৃত সভ্য এই সেন্টিনেলিশরা, যারা এসবের একেবারেই উর্ধ্বে? সমীরণ জানেন না। কেবল জানেন ছবিটার মানে। ক্যাপ্টেনের কাছে সেক্সট্যান্টে দেখে এসেছেন, দ্বীপের কাছে নোঙর ফেলার আগে।
“দিনটা আজকের।” হঠাৎ সচকিত হয়ে ভাগীরথকে জিজ্ঞেস করলেন সমীরণ, “জাহাজ থেমে গেছে কেন? উপরের হট্টগোলই বা কীসের?”
সমীরণের শুকনো মুখ দেখে ভাগীরথ বুঝতে পারলেন তিনি জানেন উত্তর, কেবল ভাগীরথকে কনফার্ম হতে উপরে পাঠাচ্ছেন।
ডেকে উঠে ভাগীরথ নায়েক কিচ্ছু বুঝতে পারলেন না। কেবল দেখলেন সবাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছে। জাহাজ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। সমুদ্রও তেমনই স্থির। কোথাও একফোঁটা হাওয়া দিচ্ছে না। দূরের ওই সেন্টিনেলিশ দ্বীপ নিস্তব্ধ হয়ে কীসের যেন প্রহর গুনছে। ভাগীরথের ভ্রাম্যমাণ চোখ উত্তর দিগন্তের দিকে আটকে গেল। দিগন্ত জুড়ে কোথাও কোনও মেঘ নেই। তাহলে ওগুলো? ওগুলো কী?
শান্ত সমুদ্রে বহুদূরে যেন সমুদ্র-ঝড় হ্যারিকেন নেমেছে। বিক্ষুব্ধ ঝঞ্ঝার ডাকে দিকচক্রবালের কাছে অসংখ্য জলস্তম্ভ পাক খেয়ে খেয়ে নীচে নামছে। ভাল করে লক্ষ করে ভাগীরথ বুঝলেন ওগুলো জলস্তম্ভ নয়। ওগুলো শুঁড়, অতিকায় শুঁড়। সেই নাগপাশের মতো পৃথিবীজোড়া শুঁড়গুলোর আদি নেই, অন্ত নেই। কেবল আছে ভয়ানক উপস্থিতি। ফ্রন্ট ডেকে তিনি তখন স্থবির। পা যেন চুম্বক হয়ে আটকে গেছে ডেকের সঙ্গে। তাঁর মনে পড়ল কেন কাথুল্কিচ নামটা ইংরাজিতে লেখার পর খুব চেনা চেনা লাগছিল। ওই নাম তিনি পড়েছেন, বহুদিন লাগে দিল্লির এক লাইব্রেরিতে বসে, মাথার ভেতরে চলা ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্ট নামটা রেফারেন্স ঘেঁটে বের করে দিল। লাভক্র্যাফট, তিনি কিছু জানতে পেরেছিলেন।
বহুবছর আগে রবারটা কান নামক ভদ্রমহিলা কেন ব্রুকলিন থেকে এসে কল্কি পুরাণ অনুবাদ করেছিলেন, তাও এখন পরিষ্কার তাঁর কাছে। সব বুড়িসুতো এক হয়ে এখন প্রাচীন বটের ঝুরি। ‘ঈশ্বর আসছেন’, কথাটা মনে পড়ল তাঁর। এই বিরাটাকায় ভয়ঙ্করের কাছে নিজেকে খুব নগণ্য মনে হল। তিনি জানেন একে আটকানোর কোন উপায় মানুষের কাছে নেই, তারা নিজেরাই পরিবেশের, পৃথিবীর প্রভূত ক্ষতিসাধন করে একে ডেকে এনেছে। ফিজিক্সের কোনও নিয়ম বলবৎ কি হবে এই ক্ষুধার্ত ঈশ্বরের উপর, নাকি মানুষ পিষে মরবে এর পায়ের নীচে?
দুরাপাব সংসার সঙ্ঘাবকারি
ভবত্যশ্বচার কৃপাণ প্রহারী।
মুরারের্দশবতার ধারীহ কল্কীঃ
করতু’ দ্বিষাং ধ্বংসনং বঃ স কল্কী।।
উত্তর দিগন্তে জন্ম নেওয়া অগুন্তি শুঁড়ের উপরের নির্মেঘ আকাশের নক্ষত্রগুলো এক বিশেষ পরিধি জুড়ে দ্রুত মুছে যাচ্ছে, সেই অন্ধকারের মাঝে উজ্জ্বল হয়ে জ্বলছে দুটো লাল তারা, ঈশ্বরের দুই চোখ।
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, গল্প, তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, সোহম গুহ
aha aha aha … lovecraft er chorasrot j e golper sira uposiray boye jacche seta kichukkhoner vetorei dhorte perechilam… naam ta na likhleo cholto baingite chere dilei bodhhoy aro jome jeto … erawcom aro golpo porar opekkhay roilam …
ধন্যবাদ, প্রীতম দাস
আগামী ধ্বংসের ছায়া ওই আণবিক যতিচিহ্নের অবয়বে গল্পের শরীরে ফুটে উঠেছে … খুব ভালো। এই ধরণের নিরীক্ষা মূলক রচনা আরো চাই তোমার কলম থেকে।
ধন্যবাদ, সন্দীপনদা।
এটি একটি অসাধারণ গল্প। একাধিকবার পড়লাম। এতোই অসাধারণ লাগল গল্পটি যে জানতে ইচ্ছে করছে এটি কি কোনো নামী বিদেশী গল্পের ছায়ায় লেখা? please don’t mind. I’m confused.
এটি সম্পূর্ণ মৌলিক গল্প দীপঙ্কর দা।
দীপঙ্করবাবু, নামি বিদেশি গল্পের মত পড়তে লেগেছে জেনে খুবই আনন্দিত হলাম। কিন্তু না, এটা কিছু বাস্তবের তথ্য, কিছুটা ভবিষ্যদর্শন আর কিছুটা লাভক্রফটের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য বলতে পারেন। ধন্যবাদ।
mone holo dekhlam jeno ekta darun cinema.khub bhalo laglo.ar ei galpo ta ekdin sotyi e ghot te pare.katotukui ba amra jani.
prosenjit
মার্ভেলাস! এই মুহূর্তে একটি মিথোস-বিষয়ক সংকলনই পড়ছি। তবে এই গল্প ধারে, ভারে, নতুনত্বে সেই তথাকথিত আন্তর্জাতিক সংকলনকে বলে-বলে গোল দেবে।
prai abishasyo holeo sotti je IICB r genomics lab e bosei golpota porchilam atokkhn. real time DNA sequencing kore base calling er samay microplastic khuje paoa ta technically samvab noi, kolpobiswe hoito samvab. Onno kono vabe microplastic er provabe DNA code change korale besi buiswasjogyo hoto. Eto chomotkar akta concept diye golpota suru hoechilo, kintu prochur totthyo, prochur sutro jurte gie anek jaigai golper goti ruddho hoeche | Link mone rakha ta kastokor hoe jacchilo|
Tobuo ato sundor akta prochestar jonnekurnish roilo lekhok ke |