যন্ত্রণানিরোধক যন্ত্র
লেখক: যশোধরা রায়চৌধুরী
শিল্পী: চিত্রা মিত্র
হ্যালো, হ্যালো!
হ্যাঁ, কে বলছ।
এই, এই, আমি নন্দিতা বলছি। চাপা গলায় বলল নন্দিতা। মানে স্বাভাবিক গলায় বলবে ভাবল কিন্তু বলাটা হয়ে গেল কেমন ত্রস্ত, ভয়ভীত। চাপা।
নন্দিতার ভয়, বড় ভয়।
হ্যাঁ নন্দিতা, বল বল। হাতের আঙুলে লেগে থাকা জ্যামটুকু চেটে নিল সুনেত্রা। এখুনি দুটো বিস্কুটের মাঝখানে জ্যাম লাগিয়ে খাচ্ছিল। বিন্দাস সুনেত্রা খাওয়া দাওয়ায় দিল দরিয়া।
শোন না, সুনেত্রা, তোমার ছেলে কাল ইস্কুল থেকে পরীক্ষার সিলেবাস টুকে এনেছে, গো?
প-রী-ক্ষা-র সি-লে-বা-স? টেনে টেনে উচ্চারণ করল সুনেত্রা। তার এরকম কিছু মনেই পড়ছে না। তাছাড়া এই তো সবে ফার্স্ট টার্মের পরীক্ষা দিয়ে উঠল বাচ্চারা। আবার এর মধ্যেই পরীক্ষা কী?
কিন্তু সরল ভাবে এই প্রশ্নটা নন্দিতাকে করে ফেলতেও বাধোবাধো ঠেকল। সে জিজ্ঞাসাটা গিলে নিল, নিয়ে বলল, না তো! আমার ছেলেটা আবার যা ট্যালা। পরীক্ষার সিলেবাস, কই না, কিছু আনেনি তো?
গলায় প্রশ্নবোধক ভাবটুকু রাখল জাগিয়ে। তার কিউ ধরেই নন্দিতা প্রবেশ করল বিষয়ে।
আর বলো না। আমার অরুষটাও তো ভীষণ ক্যাবলা। বরং তোমার অগস্ত্য তো অনেক টরটরে গো। একটু বেশি দুষ্টু এই যা, সেবার অরুষকে সেই যে ধাক্কা মেরেছিল এখনও ওর পাঁজর টনটন করে। …
অপমান গিলে নিয়ে সুনেত্রা বলল, ও হো, আর বল না। আজ এই কমপ্লেন তো কাল ওই ঝামেলা, এর শেষ নেই কোন। পরীক্ষার কথাটা কী যেন বলছিলে?
আরে মিড টার্ম। মানে সেপ্টেম্বরে নেক্সট পরীক্ষা যেটা হবে। এখন থেকেই তো তৈরি করতে হবে বাড়িতে একটু একটু করে, তাই না?
সুনেত্রা মনে মনে হো হো করে হেসে ফেলতে চায়। কিন্তু পারে না। সত্যি নন্দিতা পারেও! এখন সবে ফার্স্ট টার্ম শেষ হল, জুনের মাঝামাঝি। এই তো সবে গরমের ছুটি তিনবার গরমের জন্য এক্সটেন্ড হবার পর খুলেছে… তারপর পরই পরীক্ষা। তারপর একটু হাঁপ ছেড়েছে। এক কি দু সপ্তাহ ইস্কুল হয়েছে। এর মধ্যেই মিড টার্মের সিলেবাস। মা গো যাই কোথা।
কিন্তু বলবার সময় আটমোস্ট সিরিয়াস ভাবটুকু রেখে সুনেত্রা বলে, হুঁ, সেই তো। সত্যি কী যে হবে। ওদের তো এবার কালার সিলেবাস দিয়েছিল, সেই থেকে আমি যে কী কষ্ট করে করে সব জিনিসের কালার শেখাচ্ছি। তাও সেদিন অগস্ত্য কুমড়োর ইয়েলো-টাকে অরেঞ্জ লিখে দিয়ে এল… আর অরেঞ্জ, টম্যাটো, ম্যাংগো সব সার দিয়ে সাজিয়ে আমি কত করে পাখিপড়া করিয়েছিলাম। কুমড়ো্র ফালি দেওয়ার কথা তো মাথাতেই আসেনি – কিছুতেই কিছু হবার নয়।
হুঁ, মনে মনে অগস্ত্যর ফেইলিওরে বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে বলল নন্দিতা। এই তো, আমার অরুষ ট্রাইসাইকেলে দুটো চাকা? প্রশ্ন করেছিল, ইয়েস অর নো…। তাইতে ইয়েস লিখে এসেছে। আরে গাধা বাইসাইকেল আর ট্রাইসাইকেলের তফাতটা বুঝিস না এখনও? অগস্ত্য ওটা ঠিক লিখতে পেরেছিল, গো? এসব জান, লোকঠকানো প্রশ্ন।
হ্যাঁ হ্যাঁ ওটা তো পেরেছিল – সুনেত্রা ঢোঁক গিলল। এই কম্পিটিশনে সে কিছুতেই নন্দিতার কাছে হারবে না। কিন্তু নন্দিতা যে এত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ছেলের পেট থেকে কথা বার করে নেয়। সুনেত্রা পারেই না। ও যার ফলে জানতই না যে বাইসাইকেল ট্রাইসাইকেলের চক্কর আছে একটা। আজ ফিরুক অগস্ত্য, ওর হচ্ছে। জেনে তবেই থামবে সুনেত্রা।
প্রেপ -টু তে পড়া ছ বছরের ছেলের মা হিসেবে যে ডিটেকটিভগিরি নেমেছিল নন্দিতা, গত চার পাঁচবছরে সে পেশায় আরো ধারালো হয়ে উঠেছে সে। এখন তার আওতায় আরো অনেক মায়ের টেলিফোন। গত ক বছরে ওয়াটস্যাপের দু-দুটো গ্রুপ চালু হয়েছে। একটা পেরেন্টস অব ক্লাস ফাইভ গ্রুপ। আর একটা ক্লাস ফাইভ অব হোলি গড অ্যান্ড দ্য এরান্ট চাইল্ড।
পবিত্র ঈশ্বর আর দুষ্ট শিশু। চিরটাকাল ঈশ্বর ও মানুষের এই সম্পর্ক ছিল। দুষ্ট মানবশিশুকে শায়েস্তা করে এক একজন মহাপুরুষ তৈরিটাই এই ইস্কুলের ইউ এস পি। হোলি গড এরান্ট চাইল্ড। সংক্ষেপে এইচ জি ই সি।
বটতলার মোড়ে জমজমাট ইংরেজি মাধ্যম ইশকুল। প্রচুর স্টুডেন্ট। রমরমিয়ে বিজনেস।
(২)
নন্দিতার ছেলে, অরুষ, মাত্র দশ বছর বয়স। নন্দিতা গত ছ সাত বছর ধরে অরুষের জন্য নানাকারণে ভয় পেয়ে এসেছে। ভয় পাবে নাই বা কেন? সবাই সবকিছু নিয়ে তো ভয়ে আছে। ভয়ের বালিশে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। ভয়ের সাবানে কাপড় কাচছে। প্রতি মুহূর্ত প্রতিটি বিপদের থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে হবে। দোকান থেকে ফিরলে হাতে স্যানিটাইজার মাখতে হবে। রাস্তায় হেঁটে ফিরলে জুতো আলট্রা ভায়োলেট রে দিয়ে ধুতে হবে। পুরো জীবনটাই তো এইভাবে শুদ্ধিকরণ চালিয়ে যেতে হবে। বিষিয়ে আছে পৃথিবী, তার আবহাওয়া। কোথাও কোন পরিত্রাণ নেই।
আর ছোট ছেলেমেয়েদের বাবা-মায়েদের তো ভয়ের সাক্ষাৎ কারণ ই রয়েছে।
জন্মানোর আগে থেকে ভয়। বিগত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে বাতাসে ভাসমান তেজস্ক্রিয়তা। হবু মায়েদের শরীরে কখন ঝাঁপিয়ে পড়বে কে জানে। বাচ্চা বোকা হাবা ঠুঁটো ব্যাঁকা অর্ধেক হয়ে জন্মালে কোথায় যাবে তুমি? অবিরত জিনগত সমস্যার ভয়।
ঠিকঠাক সর্বাঙ্গসুন্দর শিশুকে জন্ম দেবার অনিশ্চয়তা, ভয়।
তা একবার না হয় ঠিকঠাক জন্মালো। জন্মানোর পর বাঁচিয়ে রাখা। সে এক চ্যালেঞ্জ। বড় হতে থাকল, তখন ভাল আলো বাতাসে বড় করার জন্য এক্সট্রা খরচ আবার। যে যে ইশকুলে স্পেশাল অক্সিজেনের জোন আছে। সেই সব দামি ইশকুলে পাঠানো। অক্সিজেনের বলয়ে তাকে সারাদিন রাখো। পুষ্টিকর খাদ্য, সঠিক তাপমাত্রা…। এয়ার কন্ডিশন করা ইশকুল না হলে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর জমানায় তো এমনিই হয় গরমে সেদ্ধ হয়ে যাবে নয় ঠান্ডায় জমে যাবে ছেলেপিলে।
এত সব কান্ড করেও তারপর তো আছেই অরুষের মতো বাচ্চার অন্য হ্যাপা। বন্ধুদের সঙ্গে খেলবে। হাতে পায়ে আজ আঁচড় তো কাল কালশিটে। বন্ধুদের সঙ্গে টিফিন ভাগ করে খাবে। অন্যের বাড়ির স্যান্ড উইচ কেন তোর ভাল লাগে রে বাবু? আমি যে এত কষ্ট করে তোকে গ্রিন ভেজিটেবিলের সারাৎসারের সঙ্গে চিকেন প্রোটিনের সারমর্ম মিশিয়ে কাটলেট বানিয়ে পাঠালাম, সেটি তুই বন্ধুকে দান করে এলি কেন, কেন, কেন?
অন্যের বাড়ির মায়েরা রাঁধুনিরা না জানি কত ময়লা হাতে রাঁধে। স্যানিটাইজার ব্যবহার করেনা। কত না জার্মস আছে… সেসব জার্মস পেটে চলে যাচ্ছে অরুষের।
রাতে ঘুম হয় না নন্দিতার।
(৩)
এমনই এক সময়ে সে খুঁজে পায় এক পত্রিকার পাতায় একটি বিজ্ঞাপন। খুব চমকে ওঠার মতো বিজ্ঞাপন। যেন ঈশ্বর নন্দিতার নালিশ শুনেছেন, মনের বেদনা জেনেছেন, নন্দিতার দুষ্ট শিশুর জন্যই ঐ বিজ্ঞাপন সংস্থা এই প্রডাক্ট টি তৈরি করেছে। সংস্থার নাম, চাইল্ড মনিটরিং ডট কম।
বিজ্ঞাপনটা ঠিক বাংলায় লেখা নয় তবে ওই আর কি, ২০৬৫ সালের বিধি অনুযায়ী এমন এক ভাষায় লেখা যাকে বাংলাও বলা যায় আবার তাদের রাষ্ট্রভাষা হত্তুকিও বলা যায়।
“হে দুষ্ট শিশুর পিতামাতাগণ! আপনাদিগের সমস্যার নিমিত্ত উপলব্ধ হইয়াছে। শিশু-পর্যবেক্ষণ -যন্ত্র। সম্পূর্ণ অ্যাপ বেসড। সুক্ষ্ম নিউরো মনিটরের সহায়তায় শিশুর সকল গতিবিধির উপর নজরদারি করিবার ট্যাবলেটাকৃতি পর্যবেক্ষক। মাত্র এক লক্ষ রুপিয়া দাম। “
দামটা একটু বেশি পড়ে গেল। সারা বছর জামাকাপড় না কিনে, পুরনো জামাকে এদিক ওদিক করে চালাবে নন্দিতা। কিন্তু এই যন্ত্র তার চাইই চাই।
ডাক্তারখানা গোত্রীয় এক জায়গায় যেতে হল। ট্যাবলেট মনিটর থাকবে নন্দিতার হাতে আর সূক্ষ্ণ এক যন্ত্র সন্নিবিষ্ট হবে অরুষের শরীরে। ছোট একটা গোল যন্ত্র আঠা দিয়ে আটকে দেওয়া হবে তার কানের পাশে, কপালে। সেই যন্ত্র নিউরো মনিটরিং করবে। স্নায়ুতন্ত্রের নানা ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া তুলে নেবে মনোযোগ দিয়ে। তাছাড়া ওতে ক্যামেরাও আছে। অরুষ যা দেখছে মোটামুটি সবই দেখতে পাবে নন্দিতা।
তারপর আর নন্দিতাকে পায় কে? সারাদিন নন্দিতা দেখবে কীভাবে অরুষ ইশকুল যায়। ইশকুল বাসে কেউ ওর সঙ্গে মারপিট করে কিনা। মাস্টার কী পড়ায়, কবার পানিশমেন্ট দেয়। টিফিনে ও কী খায়। মাঠে বড় দাদারা এসে ওকে বুলি করে কিনা। এমনকি সারাদিনে কবার জল খেল অরুষ, কবার হিসি করল তাও জানতে পারবে সে।
প্রথম কয়েকদিন বাড়ির সব কাজ ফেলে সারাদিন অরুষের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে ব্যাপৃত রইল নন্দিতা। আহা কী আনন্দ। সব দেখে ফেলা যাচ্ছে। অরুষের চোখ দিয়ে যেন সে পৃথিবীটাকে দেখছে। প্রথম দু সপ্তাহ সব ঠিক ঠাক চলল। রোজ অরুষ নিজের টিফিন নিজে খেল। নিজের পড়া পারল। বন্ধুদের সঙ্গে হাসি মজা সবই নিরপরাধ ভাবে চলল।
তিন সপ্তাহের মাথায় একটা অঘটন ঘটল। খেলার মাঠে হঠাৎ ফুটবল খেলতে খেলতে অরুষের মাথায় এসে লাগল বল। আর সে কয়েক সেকেন্ডের জন্য অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।
ঠিক তার আগের মুহূর্তেই নন্দিতা কয়েক সপ্তাহ টানা গোয়েন্দাগিরি করার পরে নেহাত বোর হয়ে গিয়েই, ট্যাব ছেড়ে অন্যদিকে মন দিয়েছিল। নিজের জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে টিভি খুলে বসেছিল। হঠাৎ ট্যাবটা অ্যাম্বুলেন্সের মতো প্যাঁ পোঁ তীক্ষ্ণ গগনবিদারী আওয়াজে নন্দিতার আত্মারাম খাঁচাছাড়া করে দিল। পড়ি কি মরি নন্দিতা মেশিনটা নিয়ে ঝাঁকাতে লাগল। মেশিন স্পষ্ট দেখাতে লাগল অরুষের হার্টবিট, তার রক্তচাপ। সামনে শিক্ষক শিক্ষিকাদের চীৎকার, সবাই ঝুঁকে পড়ে তাকে দেখতে আসা, এসব দেখে নন্দিতা পাগল হয়ে গেল প্রায়। দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা ট্যাক্সি ডেকে নিল নিজের ট্যাক্সি অ্যাপ দিয়ে। ইস্কুলে পৌঁছে জানল, ছেলেকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে গিয়ে জানল, ছেলে ভাল আছে।
বুক থেকে পাষাণ নেমে গেলেও পর পর কয়েকদিন আর ছেলেকে স্কুল পাঠাল না নন্দিতা। আর মেশিনটার দিকে তাকাতেও তার বুক দুরুদুরু করছিল। কয়েকদিন ছেলের কাছাকাছি থাকল। যন্ত্রটার দিকে আর তাকাল না। যেন ঈশ্বরে অবিশ্বাস এসেছে। না অবিশ্বাস আর কই। যন্ত্রটা ছিল বলেই না সে এত দ্রুত ছেলের অজ্ঞান হয়ে যাবার কথাটা জানতে পেরেছে। মনে মনে আবার কৃতজ্ঞই হয়ে উঠল নন্দিতা।
তারপর একদিন তার ইমেইলে চাইল্ড মনিটরিং ডট কম থেকে মেইল এল।
“সদ্য আপনার সন্তান ব্যথাবেদনাপ্রাপ্ত হইয়াছিল দেখা গেছে। এইরকম ব্যথার দ্বারা আর আক্রান্ত হইবেন না। আগেভাগেই ইহার জন্য প্রস্তুত থাকুন। ব্যথানিরোধক অ্যাপ গ্রহণ করুন। মূল্য দুই লক্ষ টাকা”
নন্দিতা লাফিয়ে উঠল। এবার নিজের লুকানো সেভিংসের ওপর আর ভরসা করতে পারল না। বরকে বলল, ব্যাংক থেকে লোন নিতে। তারপর ট্যাবলেটে জানান দিয়ে মেসেজ এল, টুং টুং।
সে জানতে পারল, তার আগের অ্যাপের সঙ্গেই এই ব্যথা নিরোধক এনহ্যান্সমেন্ট যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে চাইল্ড মনিটরিং এর তরফ থেকে।
দু লক্ষ টাকা ব্যাঙ্ক থেকে চলে গেল টুং টুং শব্দ করে জানান দিয়ে।
পরের টুং টুং এ এল ডিসক্লেইমার বা সাবধান বাণী।
ব্যথা এক ধরনের জীবন রক্ষাকারী প্রক্রিয়া। ইহার উদ্দেশ্য শরীরকে রক্ষা করা। ইহা অসন্তোষজনক, অসুবিধাজনক, কিন্তু ইহাই মস্তিষ্কের প্রক্রিয়া যাহা দ্বারা মস্তিষ্ক জানান দেয় যে শরীরের কোন অংশে আঘাত প্রাপ্ত হইয়াছে। যন্ত্রণা বা ব্যথা বাহ্য বহিঃপ্রকাশ মাত্র। শরীরের বাহ্যস্থিত বা অন্তঃস্থিত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সুস্থতার মাপক। ব্যথা না হইলেও ক্ষত হইতে পারে। আশা করি এই তথ্য জানিয়াই আপনি ব্যথানিরোধক অ্যাপ উপলব্ধ করিয়াছেন। অতএব নিজ দায়িত্বে ইহার ব্যবহার করিবেন।
নন্দিতা কিছু বুঝল না, মন ও দিল না। ছেলেকে নিশ্চিন্তে স্কুলে পাঠিয়ে দিল। আজ থেকে ছেলের আর ব্যথা লাগবে না। বন্ধুরা ভুল করে ঠেলা দিয়ে ফেলে দিলেও না, বড় দাদারা ঘুঁষি মেরে নাক ফাটিয়ে দিলেও না।
আবার মাস কয়েক দিব্যি কেটে গেল। মধ্যে একবার, একবারই শুধু, বাড়িতেই, পেনসিল ছুঁচলো করতে গিয়ে আঙুলে বিঁধে গেছিল তার পেনসিলের শিষ। এখন নন্দিতা আর অরুষের কাছে কাছে থাকে না, নিজের ঘরে থাকে বা রান্নাঘরে থাকে। টিভি দেখে অথবা নতুন রান্নার যন্ত্রকে নানারকম কম্যান্ড দিয়ে রান্না করায়। ঘর্মহীন, কষ্টহীন রান্নার উপায় এটা। ঠিক যেমন দূর থেকে ছেলেকে মনিটরিং। সে ট্যাবলেটে দেখতে পায় ছেলের রক্তক্ষরণ হচ্ছে এমন এক মেসেজ এসেছে। ছেলের ঘরে গিয়ে দেখে ছেলে নিশ্চিন্তে রয়েছে। চেহারায়, মুখেচোখে কষ্ট বা যন্ত্রণার চিহ্ন নেই। চটপট ছেলের ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে নিশ্চিন্তমনে নিজের কাজে ফিরে আসে নন্দিতা। হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। এই ব্যথা নিরোধক… যন্ত্রণানাশক যন্ত্রটি কী যে ভাল হয়েছে। পয়সা উশুল!!!
তিন মাস পরে, একদিন ইস্কুল থেকে ডেকে পাঠানো হল নন্দিতা ও তার বরকে।
প্রিন্সিপাল সাহেব দরদর করে ঘামতে ঘামতে বললেন, আপনাদের ছেলে গত তিনমাস ধরে একটি নররাক্ষসে পরিণত হয়েছে। একে বাড়ি নিয়ে যান, আর ইস্কুলে আনার দরকার নেই। সবাইকে মারধোর করে। ব্লেড দিয়ে হাত চিরে দিয়েছে চারজনের। ঘুঁষি মেরে চোখ কাল করে দিয়েছে ছ জনের। আর নিজের আজ কী অবস্থা হয়েছে দেখুন। সবাই রোজ মার খাবে আর ওকে ছেড়ে কথা বলবে নাকি? ওরাও আজ বদলা নিয়েছে।
ছেলের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল নন্দিতা।
চোখ কালো হয়ে গিয়েছে। কপালে বিশাল ফোলা, ডানদিকের চোখ সে ফোলার নিচে প্রায় ঢেকে গিয়েছে।
নাক থেঁতলে গেছে। নাকের তলায় রক্ত জমাট বেঁধে রয়েছে।
অরুষ হাসছে তাও। হি হি করে হাসছে।
ঠিক দুষ্টু শিশু আর নয়, পিশাচের মতো দেখাচ্ছে তাকে।
অরুষ গত তিনমাস ধরে একটু একটু করে পরখ করে দেখেছে, তার তো কিছুতেই আর ব্যথা লাগে না। অন্যদের লাগে। এ মজা উপভোগ করে করে আজ এই অবস্থা। মাঠে তার হাতে অত্যাচারিত হতে হতে হতে অতিষ্ঠ হয়ে সব্বাই মিলে তাকে মেরেছে।
হা হা হা, তার একটুও ব্যথা লাগেনি। একটুও ব্যথা লাগে না তার আজকাল। ঠিক সুপারম্যানদের কার্টুনে যেমন দেখায়। কখনও কখনও হয়তো হেঁচকি ওঠে, দম বন্ধ হয়ে আসে। রক্ত পড়ে, ফুলে যায়। কিন্তু ব্যথা লাগে না।
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, চিত্রা মিত্র, যশোধরা রায়চৌধুরী
অদ্ভুত সুন্দর লেখা। ভাবতে বসিয়ে দিল।
ভালবাসা গো আইভিদি।