যন্ত্রিনী
লেখক: ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
শিল্পী: তৃষা আঢ্য
কথাটা কানে যাচ্ছে না?
রুবু চুপচাপ।
কি হল? লীনা বলে উঠল।
রুবু একটু ঘুরে ফিরে থেমে গেল মেঝের ওপর।
লীনা রিমোটের বাটন নিয়ে দক্ষ যজ্ঞ বাধিয়ে ফেলার আগেই অতনুর ফোন ঘোরাল। এই দেখ, তোমার রোবট মেইড আমার কোনও কথাই শুনছে না। অতনু বলল, পড় ওর গায়ের মিনি এলসিডি স্ক্রিনে কী লিখছে সে।
লীনা বলল যে প্রথমে স্ক্রিনে ফুটল Error, আমি ম্যানুয়াল খুলে পড়লাম। প্রথমে রেড বাটন টিপে শাটডাউন করে এক মিনিট পর আবার গ্রিন বাটন প্রেস করলাম। তবুও সে সাড়া দিচ্ছে না।
কেবল জানাচ্ছে তার স্টেটাস কোড RC7।
অফিসের কাজে আছি সুইটহার্ট। বাড়ি ফিরে দেখছি। লীনার মাথায় হাত। কিন্তু আজ যে লক্ষ্মীবার। ঘর মোছা হবে না যে! রুবুর মর্জিমাফিক কাজ হবে? এত টাকা দিয়ে মেশিন কিনে শুধু জেদের বশে হিমানীর মাকে জব্দ করা হল আর সেই মেশিন কি না বিট্রে করছে?
প্রথমদিন দেখেই খুব ইম্প্রেশড হয়েছিল লীনা। ঘরময় সর্ষে দানা ছড়িয়েছিল সে। পরখ করেছিল রুবুর কাজ। রুবু চুপচাপ কোণা কোণা থেকে সব সর্ষে দানা একে একে ঘুরে ঘুরে শুষে নিয়েছিল নিজের শরীরে। তারপর সিগন্যাল দিয়ে জানিয়েছিল সেগুলি বের করে নিতে। লীনা মোহিত হয়ে গেছিল। তারপর রুবুর দেহের নীচে স্পিনিং বুরুশ দিয়ে পরিষ্কার করে দেখিয়েছিল লীনার কার্পেট, কম্পিউটারের টেবিলের তলা। রুবুর দেহে অনেকগুলি সেন্সর আছে। সে বুঝতে পারে। মেঝে পরিষ্কারের সময় সে দেওয়ালে ধাক্কা খাওয়ার আগেই ঘুরে যায় স্মার্টভাবে। ঘরের আনাচ-কানাচ মাড়িয়ে ঝাড়াপোছা করে। মুখে রা’টি কাড়ে না। তবে ধুলো শুষতে শুষতে তার ডাস্টবিন ভর্তি হলেই জানান দেয়। তখন রুবুর মালকিন কে দরকার।
রুবুর শরীরময় ইমোজি। সেন্সর জানান দিয়েও যখন মালকিন স্টেপ নেয় না রুবু ইমোজিতে আলো ফেলে জানায় তার অবস্থা।
কিন্তু এতসব লীনা বুঝে উঠতে পারলে তো। অতনু ভাবে। তবে চাপের নাম বাপ। হিমানীর মাকে বরখাস্ত করার সময় মনে ছিল না? নিজের জেদের বশে আমায় হাউজকিপিং রোবট কিনে দাও। মাথা খাচ্ছিল। তার বেলা? এখন শিখতেই হবে লীনা।
শান্তনুদের বাড়ি গিয়ে দেখে আসার পর রোবট মেইডের প্রেমে ফিদা হল সে। নিকুচি করেছে রোজ এই অশান্তির। কাচের বাসন, মেলামিনের বাসন নিজে ধোয়া যায়। কাপড়চোপড় মেশিনে ধোয়া যায়। কিন্তু ঘর ঝাড়ুপোছা? নো ওয়ে! এসব ভদ্রলোকের কাজ? আর এই জন্য হিমানীর মাকে এত তেল মাখানো?
পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে সবুজ আলো জ্বলে হাস্যমুখী ইমোজিতে। আর প্রতিকূলে গেলেই বিপদ সংকেত। লাল আলো জ্বলে ক্রুদ্ধ ইমোজিতে। তাই বলে তুমি এসব খেয়াল রাখবে না? ঝেঁঝে বলে উঠেছিল অতনু সেদিন। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রোবট আনবে ঘরের কাজের জন্য, আর শিখবে না তাকে কী করে রাখতে হয়?
লীনা বলে, সব মানছি কিন্তু এতসব মাথায় রাখতে পারছি না। অটোনমাস রোবট নিজের মনে কাজ করে যাবে। আমাকে আবার তার তদারকি করতে হবে প্রতি মুহূর্তে?
অতনু বলল, টেলিভিশন, ওয়াশিং মেশিন, সেলফোনের প্রযুক্তিটুকু শিখছ না? না শিখলে তোমারই ক্ষতি।
কেন যে কিনতে গেল শান্তনু-শর্মিলার দেখাদেখি। অতনু বলে ওঠে। বেশ ছিল হিমানীর মা। পুরানো কাজের লোক।
কিন্তু শর্মিলার রোব-মেইড-টা আরও ছিমছাম ছিল যেন। আর দামেও কম ছিল। লীনা বলে ওঠে। তুমিই তো শুনলে না। বললে, কিনছ যখন দামীটাই কেনা উচিত।
অতনু বলল, রোবটিক টেকনোলজির দিন দিন উন্নতি হচ্ছে তাই পুরানো মডেল কিছুদিনের মধ্যেই অবসোলিট হয়ে যাবে। তাই বলেছি।
কিন্তু ডেমো দিতে এসে ছেলেটি বলল লেটেস্ট মডেলের রোবটদের সমস্যাও অনেকটাই মানুষদের মতো। যত বেশি অটোনমাস তত ভালো কাজ যেমনি পাবে, তেমনি তাদের মন পড়তে না পারলেই মুশকিল। তারা শুধুই যন্ত্র নয়। লীনা নেল ক্লিপার দিয়ে হাত পায়ের নখ কাটছিল। মাটিতে পড়েছিল নখগুলো।
কাছে গিয়ে আবার রিমোট দিয়ে অন করে আদুরে গলায় বলল, কি হল রে রুবু? আজ কাজ করবি না? ভালো লাগছে না কাজ করতে? রুবুর মাথায় একটা সবুজ আলো ব্লিংক করে উঠল। মানে রুবু সাড়া দিয়েছে।
রুবু গুটি গুটি হেঁটে গিয়ে লীনার সব শুদ্ধ খান কুড়ি নখগুলি একটা একটা করে তুলে আনল।
লীনা বলল। এই তো কেমন কথা শুনলি।
রুবুর গায়ের ট্র্যাশ ডিস্পোজাল বাটন টিপতেই একটি প্ল্যাস্টিকের কাপের মধ্যে নখগুলি জড়ো হল। লীনা বলল, এ আরেক জ্বালা। তুই করবি কাজ আর আমাকে ফেলে আসতে হবে ময়লা?
অবিশ্যি তাদের আবাসনের সব কাজের লোকেরা জেহাদ ঘোষণা করেছে অনেকদিন আগেই। বাড়ির ময়লা তারা ছোঁবে না। কতকিছু থাকে সেই ময়লায়। তারা মানুষ বলে কি তাদের ঘেন্নাপিত্তি নেই? বিদেশের মতো বাড়ির মালিকদের নিজেদের হাতেই ফেলতে হবে গার্বেজ ডিসপোজাল কর্নারে। কম্পোস্টারে ধোলাই হবে সারা আবাসনের ট্র্যাশ। অতএব নো ঝামেলা। কাজেই নিজের নখ নিজেকে উঠেই সেই কাপ থেকে ফেলে আসতে হল লীনাকে।
কিন্তু বাংলা তো রুবু বুঝবেই না। কি করে সম্ভব হল? অবিশ্যি দোকানে বলেছিল, মোবাইলের মতো এরও ল্যাঙ্গুয়েজ সেট করা যায়। তবে কি অতনু কিছু কলকাঠি নেড়েছে? অতনু নিজেও টেক স্যাভি। এসবে তার খুব ইন্টারেস্ট। এক নামী সফটওয়্যার কোম্পানির রিসার্চ ল্যাবে কাজ করে সে।
বাড়িতে আসার পর রুবু তো নট নড়নচড়ন অবস্থায় ছিল। ডেমো দেখাতে এল দু’জন। তারপর সব বুঝেসুঝে নিয়ে সেইমতো রুবুকে চালানো হল। কিন্তু মাঝেমাঝেই কী যে হয় তার। এর চেয়ে বুঝি হিমানীর মায়ের কামাই বা মুখঝামটা ভালোই ছিল। ভাবল লীনা।
প্রথম প্রথম বুঝতে একটু অসুবিধে হচ্ছিল লীনার। তবে ওই নতুন মোবাইল ফোনের মতো। দিনকয়েকের মধ্যেই আয়ত্ত্বে এসে গেছিল। ডেমো দিতে এসে টেকনিশিয়ান বলে গেছিল, একটু করে গ্যাপ দেবেন ম্যাম। মানে একটা ঘর ঝাড়পোছার পর একটু থেমে আরেকটা। এভাবেই। ওর মোটর গরম হয়ে গেলে কিন্তু জ্বলে যেতে পারে। আর স্পীড কন্ট্রোল বাটনটাও দিতে ভুলবেন না। বেশি তাড়াহুড়ো করলেও মুশকিল। ঠিক আপনার গ্রাইন্ডার মিক্সারের মতো। বেশি স্পিডে বহুক্ষণ ঘোরালেই সে আপনাআপনি বন্ধ হয়ে যাবে। রোবটেরো সেল্ফ ডিফেন্স মেকানিজম এমনি। আর দামি রোবট যত বেশি অটোনমাস তত বেশি কিন্তু তার মানুষের মতো হাবভাব হবে। মাথায় রাখবেন। সে অনেকটাই নিজে নিজে কাজ করতে পারে। সস্তার রোবটের চেয়ে এর প্রযুক্তি অনেকটাই ইম্প্রুভড।
বাই চান্স যদি বুঝতে ভুল হয় ঘরের ময়লা বেশি শুষে নিয়ে থমকে যায় রুবু। ক’দিন আগেই হল এমন। আবারও ফোন। টেকনিশিয়ান এসে বলল এই বাটনটা জ্বলছে নিভছে মানে অ্যালারজির সিম্পটম।
মানে? তাকে আবার অ্যান্টি-অ্যালারজিক দিতে হবে নাকি?
টেকনিশিয়ান বলেছিল কাজ হয়ে গেলে ভালো করে ব্লেডগুলি মুছে রাখবেন ম্যাম। যন্ত্রেরও শরীর আছে। সেখানে যা সওয়াবেন তা সয় না। মানুষ মুখ বুজে কাজ করে। যন্ত্র আরও সেনসিটিভ। এই অ্যাপটা ডাউনলোড করে নিন আপনার ফোনে। এতে সব পাবেন।
মানে? কাজের লোকের পায়ে তেল মালিশও করতে হবে? এ তো আচ্ছা যন্ত্রণায় পড়া গেল! রক্ষে কর বাপু।
যেদিন প্রথম ঘরে আনা হল রুবুকে সেদিন কী উত্তেজনা বাড়িতে। বাঁচা গেল। হিমানীর মার হাত তোলা হয়ে থাকতে হবে না আর লীনাকে। তবে ভালোবেসে রুবুর নাম দেওয়ার পরেও সে যেন ঠিক এই বাড়িটাকে ভালোবাসতে পারছিল না। দেহাত বা গ্রাম থেকে গাঁইয়া কাজের মেয়ে শহরে প্রথমে এলে যেমন হয় আর কি। রুবুর মনখারাপ হয়েছিল। টেকনিশিয়ানকে ফোন করতে সে বলেছিল, যতই যন্ত্র হোক স্যার, ওদেরও মন আছে। আমি রোবো-সাইকলজিষ্ট পাঠাচ্ছি আপনার বাড়িতে। রুবুর চেক আপ করতে অভিজ্ঞ রোবো-সাইকোলজিস্ট এসেই নিজের অ্যান্ড্রয়েড ফোন থেকেই রুবুর মধ্যে একটি প্রোগ্রাম রান করালেন ঘন্টাখানেক।
তারপর শাট ডাউন আর রিস্টার্ট করতেই রুবু চনমনে হয়ে উঠেছিল। মনোবিজ্ঞানীর সামনেই উচ্ছল হয়ে লীনার ড্রইংরুমখানা ঝকঝকে করে ঝাঁট দিয়ে, থামছিল না। তার ভাবখানা যেন কই তোমাদের সোয়াব লাগাও। জল ঢেলে দাও। লিক্যুইড সোপ ঢাল। আমি ঘর মুছব যে। কী এনার্জি দেখেছিল সেদিন রুবুর। লীনার মনে পড়ে গেছিল হিমানীর মায়ের তাদের বাড়িতে জয়েন করার প্রথম দিনটার কথা। খাট, সোফা, আলমারীর তলা, কোণা কোণা থেকে গুচ্ছের ময়লা, ঝুল কালি বের করে দেখিয়ে বলেছিল, এই দেখো বৌদি। আগে যে কাজ করত সে কী করে রেখেছে। তবে রুবু কথা বলেনি, কিন্তু নিঃসাড়ে তার গতিবিধি আর কাজের পরিধিতে আজ বুঝিয়ে দিয়েছে সে কত এক্সপার্ট। লীনা খুশিতে ডগমগ হয়ে বলেছিল, ঝামা ঘষে দিতে হয় হিমানীর মায়ের মুখে। কী পরিষ্কার কাজ! মুখে রা’টি নেই রুবুর। আমার সোনা রে! কী যে দেবে সে রুবু কে! কী করে যে খুশি করবে তাকে! এ তো আর হিমানীর মায়ের মতো পুরানো কাপড় বা শীতের চাদর নেবে না। অথবা রোজ সকালের জলখাবারের জন্যও হাপিত্যেশ করবে না। আগের দিনের খাবার খেতে দিলে হিমানীর মায়ের মুখ বেঁকানো? কী করে ভোলে সে? সেদিক থেকে রুবুর কোনও দাবী দাওয়া নেই। বাঁচা গেছে একদিক থেকে।
রুবুকে ঘরে আনার পর থেকেই অতনু ভাবছিল একটা কথা। উন্নতমানের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর কৃপায় আধুনিক প্রযুক্তির রোবট বুঝতে পারে মালকিনের পছন্দ, অপছন্দ। তায় আবার লীনার ফোনের সঙ্গে লিংক করা রুবুর টেকনলজি। অতএব ফেসবুকে ঢুকে বা ওয়েবে গিয়ে লীনা যা কিছু দেখছে রুবু তা বুঝতে পারছে। তাই জন্য তার কাজ না করার ইচ্ছেটা বাড়ছে না তো? অফিসে বসে বসে অতনু ভাবছিল এইসব। তারপর লীনার বাঙালি স্টাইল অ্যাকসেন্টটা ঠিক বোঝে না রুবু। তাই ভয়েস রেকগনিশনে অসুবিধে হচ্ছে বুঝি। তার চেয়ে বেঙ্গলি ইউনিকোড টাইপ মোডে লীনাকে বলতে হবে কাজের অর্ডার করতে। লীনা হোয়াটস্যাপ, ফেসবুকে যে ভাবে বাংলা লেখে তেমন আর কি। কিন্তু রুবু কি বুঝতে পেরে সেইমত লীনার অর্ডার এক্সিকিউট করতে পারবে?
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরছিল অতনু। শান্তনু আর শর্মিলাদের দেখাদেখি এই রোবট মেইডকে ঘরে এনে এক যন্ত্রণা হয়েছে। শান্তি নেই। যন্ত্রের যন্ত্রণা। থুড়ি যন্ত্রিনীর যন্ত্রণা। আর এই অটোনোমাস রোবটগুলো এতটাই উন্নত যে এরা নিজেদের মধ্যে প্রোগ্রাম লিখে ফেলে কমান্ড লিখে ফেলে ওয়েবের মধ্যে দিয়ে অন্য রোবটের সঙ্গে মতামত বিনিময় করে। আর মাঝেমাঝেই পরিস্থিতি বুঝে জেহাদ ঘোষণা করে। তাহলে আর কি তফাত কাজের লোক আর রোবটের মধ্যে? অবিশ্যি এসব জটিল তথ্য আর লীনার মাথায় ঢুকিয়ে লাভ নেই। সে এমনিতেইও রুবুকে নিয়ে খুব হ্যাসলড।
বৃহস্পতিবারে অন্ততঃ ঠাকুরঘরখানি মোছা হোক, এই ভেবে রুবুকে আজ বেশ কড়া কড়া দুচার কথা শুনিয়েছে লীনা। তারপর যেন আরও ক্ষতি হল। রুবু একটু একটু যাও বা ঘষটে ঘষটে চলছিল তাও হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল। হাতের মোবাইল ফোনখানি নিয়ে রুবুর সার্ভিস সেন্টারের ওয়েবসাইটে ঘুরেছে অপারগ লীনা। ইউটিউবে ভিডিও দেখেছে। কিন্তু লীনা বুঝছে না যে সে যেখানে যাচ্ছে তা রুবুর নখদর্পণে। রুবু বুঝতে পারছে লীনা ঝামেলায় পড়েছে। লীনা ওয়েবসাইট ঘেঁটে রুবুকে বদল করার ডিল দেখছে।
এ যেন হিমানীর মা থাকাকালীন পাশের ফ্ল্যাটের কাজের লোককে কাজ বুঝিয়ে কত মাইনে নেবে তা জানতেই হাতেনাতে বামাল সমেত গ্রেফতার। হিমানীর মা জানতে পেরেই তিনদিন কামাই। রিভেঞ্জ নিয়েছিল। রুবুও কি সেদিকেই এগুচ্ছে নাকি?
অতনু ফিরল। লীনা ব্যাজার মুখে বসে আছে। ভাল্লাগেনা। এক আপদ হয়েছে এই রুবু। অতনু বলল, টেকনোলজি বেসড জিনিসপত্র এমনি হয় ডার্লিং। একটু ধৈর্য ধর প্লিজ। তুমি কড়া করে এক কাপ চা দেবে? আমি দেখছি রুবুর কী হয়েছে। অতনু নিজের স্টাডি টেবলে বসে রুবুকে নিয়ে নাড়াচাড়া করে। তার নিজের কাজকর্মও রোবোটিক্স নিয়ে। অতএব উল্লসিত সে। পছন্দের কাজ। নিজের কম্পিউটারে কানেক্ট করে ফেলে রুবুকে। এবার তার রোগ ধরার পালা। আজ অফিসে বসে বসে সারাদিন ধরে একটা প্রোগ্রাম লিখেছে অতনু। কি করে রোবোটদের মনের ভাষা পড়তে হয় তা নিয়ে। এবার সেই প্রোগ্রামকে রুবুর মধ্যে রান করানোর পালা। যদি রুবু রেসপন্ড করে তাহলে বুঝতে হবে অতনু সফল হয়েছে। সিস্টেম ডায়গনস্টিক প্রোগ্রাম চালিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে সে। অর্থাৎ রুবুর কী অসুবিধে হচ্ছে? অবশেষে বুঝতে পারে ল্যাঙ্গুয়েজটা ডিফল্ট সেট হয়ে গেছে আমেরিকান ইংরেজিতে। সেই কোডটা চটপট সে চেঞ্জ করে দেয় বাংলায় মানে যাকে কম্পিউটারের পরিভাষায় বলে BN। রুবুকে কাছে টেনে নিয়ে অতনু বলে, ওরে আমার সোনা রে! এই কথা! কী বাটন টিপতে গিয়ে কী টিপেছে লীনা। তুই তোর মায়ের কথা এতক্ষণ বুঝতে পারছিলি না? রুবুর শরীরের একটি ইমোজিতে চোখের জল। মানে রুবু পড়তে পেরেছে অতনুর মন। সেন্সিটিভিটি টু দ্যা হায়েস্ট অর্ডার। জিও! অতনু ভাবে।
বহুদিন নিঃসন্তান এই দম্পতি। অতনু-লীনা। রুবু তাদের বাড়িতে আসাতে তারা দুজনেই খুশির মুখ দেখেছিল। অতনুর মনে হত এই যন্ত্রিনীকে দিয়ে সারাদিন কাজ না করিয়ে বিছানায় নিয়ে শুলে মন্দ হয় না। লীনাকে অফিস যাবার সময় বলেছিল, এবার হল তো? থাকো তোমার মেয়ে রুবুকে নিয়ে। কিন্তু মেয়েকে দিয়ে কেউ কাজ করায়? না করায় না। তবে সত্যি কথা বলতে কি রুবুকে তো কাজের জন্যেই নিয়ে আসা। এত দাম দিয়ে কিনে আনা। কাজের লোকের খরচা বাঁচানোটা বড় নয়। অঙ্ক কষে দেখেছে অতনু বরং বেশি খরচাই করে ফেলেছে সে এই অটোনমাস রোবট কিনে ফেলে। তবে হিমানীর মায়ের লাগাতর কামাই আর মুখে মুখে জবাব দেওয়ার হাত থেকে বেঁচেছে তারা। যন্ত্রিনীর যন্ত্রণা থাকবেই যদি মোডাস অপারেন্ডি বিষয়ে ওয়াকিবহাল না থাকে। আর ঠিক তাই হচ্ছে। লীনা ঠিকমতো চালাতে পারছে না কিংবা ভয়েস রেকগনিশন হচ্ছে না আর সর্বোপরি রোবটের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ধরে ফেলছে, তাই বুঝি রুবুর একিউট ডিপ্রেশন এর স্বীকার হচ্ছে রুবু। অতনু ভাবে এতদিন শুধু কাজের লোকের সমস্যা ছিল। এখন কাজের লোকের রোগ সারানোর সমস্যাটাও তাকে দেখভাল করতে হবে।
রুবু মেঝের ওপর দিয়ে কার্পেট ডিঙিয়ে উলের নরম জমি মাড়িয়ে চুপচাপ এক মনে তখন ধুলো তুলছে। ঘরের কোনে লীনা এসে দাঁড়িয়েছে। তার এক হাতে নতুন ঘর পোঁছার ন্যাতা। আরেক হাতে ফ্লোর ক্লিনিং লিকুইডের সুদৃশ্য বোতল। রুবু আওয়াজ দিলেই ধুলো ফেলে তার কাপড় আর সাবান ঢেলে দেবার অপেক্ষায়। লীনা কেবল দেখতে চায় রুবুর শরীরে ঝটিতি জ্বলে ওঠা হাসির ইমোটিকন। ঠিক যেমন হিমানীর মা কাজ করতে করতে এক গাল হেসে বলত, বৌদি, আজ চচ্চড়িটা যা হয়েছে না!
Tags: ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়, কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, তৃষা আঢ্য
খুব ভালো লাগলো।
বাহ! সুন্দর লাগল।