যযাতিয় লালসায়…
লেখক: সুকন্যা দত্ত, বাংলা অনুবাদ - নবপ্রিয়া কুণ্ডু ও অঙ্কিতা
শিল্পী: অঙ্কিতা
সকালের প্রায় সমস্ত কাগজগুলোতেই জ্বলন্ত শিরোনাম।
‘বলিউডের লাস্যময়ী অভিনেত্রী ভিষ্মিকা অগ্নিদগ্ধ। তিনি একটি চলচ্চিত্রের দৃশ্যের শুটিং এর সময় অগ্নিদগ্ধ হন এবং ঐ চলচ্চিত্রের নায়ক তাকে শ্যুটিং কক্ষ থেকে উদ্ধার করেন। উল্লেখ্য ওই দৃশ্যের শুটিং-এর জন্য যাবতীয় সুরক্ষার ব্যাবস্থা নেওয়া হয়েছিল। এতদ সত্ত্বেও অভিনেত্রী ওই ভয়াবহ দুর্ঘটনার শিকার হলেন।’
‘ম্যাডাম তখন সবেমাত্র তার ভ্যানিটি ভ্যান থেকে সেটে এসেছিলেন। কিছুক্ষণ সেখানে বসে পরিচালক এবং লাইট বয়দের সঙ্গে প্রয়োজনীয় কথা বলে নিচ্ছিলেন… ঘেমে নেয়ে একসা তাকে বেশ উজ্জ্বল লালচে লাগছিল। মেক আপের মেয়েটা তাঁর মুখে শেষবারের মতো তুলির টান দিতে চাইছিল, কিন্তু হাতের ইশারায় ম্যাডাম তাকে সরে যেতে বলেন… আর তার পরেই… ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডটা ঘটে গেল।
কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপারটা কি জানেন! আশেপাশে আগুন ধরানোর মতোও কোনও কিছু, এমনকি কোনরকম দাহ্যবস্তুও, কিচ্ছু ছিল না। আমরা সবাই দৌড়ালাম ফায়ার এক্সটিংগুইসার খুঁজতে। কিন্তু ওগুলো ছিল শ্যুটিং জোনের কাছাকাছি কোথাও। অনেকটা দূরে, তবে যাই হোক যে মুহূর্তে ওগুলো পেলাম, তখুনি ব্যবহার করেছিলাম। কিন্তু ততক্ষনে ম্যাডাম মারাত্মকভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়ে গেছেন। আগুন ছিল ভয়াবহ, প্রায় সর্বগ্রাসী।
শুধু এটাই বুঝতে পারলাম না যে, কিভাবে ওইরকম মারাত্মক আগুন লেগে গেল তাঁর গায়ে।’
প্রায় প্রত্যেক প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ানই কমবেশী একইরকম ছিল।
নচিকেতা– মুম্বাই চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম প্রখ্যাত নির্দেশক– তিনিও ওই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে আহত হয়েছেন। অভিনেত্রী ভিষ্মিকার খুব কাছেই পরিচালক বসেছিলেন। উনিই প্রথম আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। তাঁর বয়ান ছিল তুলনামূলক বিভ্রান্তিকর। হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তিনি বলেন, ‘ভিষ্মিকা, হঠাৎ যেন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল।’
***
খ্যাতনামা প্লাস্টিক সার্জেন ডাঃ অরবিন্দ দেশমুখ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কোনওমতে নিজেকে সামলে খবরের কাগজটা টেবিলে নামিয়ে রাখলেন তিনি। টেবিলের উলটো পারের মানুষটা কাশির মাধ্যমে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন।
‘হ্যাঁ, অনন্তনাগ, বল কি ব্যাপার?’ সেক্রেটারির উদ্দেশ্যে তিনি বলে উঠলেন।
‘আপনার গাড়ি তৈরি। আজ আপনার দুটো বড়োসড়ো মিটিং আছে। একজন কোরিয়ান, অন্যজন রাশিয়ান ক্লায়েন্ট। এছাড়াও প্রাইভেট ক্লিনিকে দুটো ‘বোটক্স’ এর কাজ রয়েছে।’
‘ওগুলো বাতিল কর এখুনি। সব কাজ পিছিয়ে দাও।’
‘হ্যাঁ স্যার। তাই ভালো…’ অনন্তনাগ আমতা আমতা করে বলে ওঠে, ‘ভিষ্মিকা ম্যাডাম মারা গেলেন। আর তারপর থেকে যা চলছে… ঠিক আছে স্যর আমি ফোন করে দিচ্ছি।’ অনন্তনাগ চলে যায়।
ডাঃ দেশমুখের সঙ্গে অনন্তনাগের সম্পর্ক বহুদিনের। এখন সে ডক্টরের পরিবারেরই প্রায় একজন হয়ে গেছে। অগুন্তি অভিনেতা অভিনেত্রীর যাওয়া আসা দেখেছেন তিনি… চিরশাশ্বত যৌবনের অন্বেষণে তারা কেমন যেন একমুখী। গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য নিষ্ঠুর।
এরা যৌবনের বাহ্যিক সৌন্দর্য ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। ওষুধপত্র, ইঞ্জেকশন থেকে শুরু করে কাটাছেঁড়াতে পর্যন্ত এদের অনীহা নেই। এমনকি একজন তো জিরো ফিগারের লোভে লোভে ফিতাকৃমিও গিলে ফেলেছিল। অবশ্য ডাঃ দেশমুখের তত্ত্বাবধানেই পুরো ব্যাপারটা ঘটেছিল। তিনি নিজে হাতে ওই পরজীবীকে বার করতে সহায়তাও করেছিলেন। কিন্তু তবুও… ফিতাকৃমির ডিম কেউ জেনে বুঝে গিলছে, এটা ভাবলেই…
ভাবুন একবার, পরজীবীটা আপনার পেটের মধ্যে বাড়ছে। আপনার অন্ত্রে তা বংশবিস্তার করছে… হজমে গোলযোগ ঘটাচ্ছে এবং পুষ্টিতে ভাগীদার হয়ে আপনার ক্ষুধামান্দ্য ঘটাচ্ছে। আর আপনি ক্রমশঃ হচ্ছেন ক্ষীণকায়।
যদি এর নাম হয় সেলেব্রিটি হওয়া, তাহলে অনন্তনাগ মরে গেলেও ওই জীবন পেতে চায় না। যদিও এঁরা টাকাটা দেয় অবিশ্বাস্য রকমের। আর সেটাও এখন ক্রমবর্ধমান। ডাঃ দেশমুখের প্রাইভেট প্র্যাক্টিসের বহু সুলুকসন্ধান ইতিমধ্যেই অনন্তনাগ জানেন।
অবশ্য ডাঃ দেশমুখ অত্যন্ত মিতভাষী ভদ্র ব্যক্তি, আর ততোধিক দক্ষ একজন প্লাস্টিক সার্জেন। এই দক্ষতাই আজ তাকে খ্যাতির শীর্ষে তুলেছে। ‘জরা’-কে ছুঁড়ে ফেলে, শরীরী ক্ষয়কে দূরে সরিয়ে, চিরযৌবন ধরে রাখার সমস্ত অলিগলি আজ তাঁর হাতের মুঠোয়।
অভিনেত্রী ভিষ্মিকা… উনিও ছিলেন তাঁর মক্কেল। অবশ্যই সেটা বেশ কিছুদিন আগের কথা। কয়েকমাসের জন্য ম্যাডাম বিদেশে গেলেন, শ্যুটিংয়ে… সম্ভবত অ্যান্টার্কটিকা। অনন্তনাগ সেকথা কাগজে পড়েছিল। কোনওরকম গন্ডগোল হয়েছিল কী? সে যাই হোক, দীর্ঘ সময় বিদেশে থাকার পরে মাত্র এক সপ্তাহ আগে ভিষ্মিকা দেশে ফিরেছিলেন, কিন্তু তারপরেও তিনি কোনও অ্যাপোয়েনমেন্ট করেননি… চিন্তাগুলো প্রায় ফিতাকৃমির মতোই অনন্তনাগের মানসিক শান্তি চুষে চুষে খাচ্ছিল।
একদিন ভিষ্মিকা তাকে বলেছিলেন, ‘মানুষ আমাকে দেখে বিষ্ময়ে চোখ ফেরাতে পারে না, সেইজন্যই আমি ভিষ্মিকা। ‘বিস্ময়’… আমার মূলধন, সেটাই আমি বিক্রি করি বাজারে। আর সেইজন্যই আমার ছবিগুলো সুপারহিট। আমিই বক্স অফিসের একমাত্র ‘বিস্ময়’।’ অভিনেত্রী ভিষ্মিকা পরম উল্লাসে বলেছিলেন কথাগুলো।
ভিষ্মিকার দুর্দান্ত ক্যারিয়ারের প্রতি ডাঃ দেশমুখও আকর্ষিত হয়েছিলেন। মাত্ৰ ষোলো বছরে পর্দায় প্রথম আবির্ভাব নিজের মায়ের হাত ধরে। তারপরে ভিষ্মিকা মোট সাতাশটি ছবিতে অভিনয় করেন। এরমধ্যে পঁচিশ খানাই ব্লকবাস্টার্স। যদিও শেষ ছবিটা খুব একটা ভালো চলেনি তাঁর… কিন্তু ততদিনে তাঁর হাতে আরও অনেক দারুন দারুন ছবির অফার চলে এসেছে।
কয়েক বছর আগে, মূলতঃ মায়ের মৃত্যুর পর থেকেই, ভিষ্মিকা ছবিতে সই করার সংখ্যা কমিয়ে দেন। বছরে মাত্র দুটো কি একটা সিনেমায় অভিনয় করা ছাড়া, বাকি সময়টা তিনি প্রায় একজন নিঃসঙ্গচারিনীর জীবন কাটাতেন। কৌশলটা বেশ কাজে দিয়েছিল! তাঁর ব্যক্তিত্বের অধরা মাধুরী তাঁকে তাঁর ভক্তদের কাছে আরো বেশি আকর্ষণীয় করে তুলেছিল। এই জন্যেই, তাঁর নামমাত্র কাজের উদ্দেশ্যে সারা বছর জুড়ে ভক্তরা মুখিয়ে থাকতেন।
ডাঃ দেশমুখের মনে পড়ে, একবার সেন্সর বোর্ডের ঝামেলায় ভিষ্মিকার একটা সিনেমার মুক্তির তারিখ পিছিয়ে গিয়েছিল। ভারতের ছোট একটা প্রান্তিক শহরে সেনা নামাতে হয়েছিল ভক্তদের রোষ শান্ত করতে।
ভিষ্মিকার ফোন আসবে এমনটা ডাঃ দেশমুখ আন্দাজই করেছিলেন। আর তারপর ভিষ্মিকা সোজা ইউরোপে ছুটে গিয়েছিলেন, রাশিয়ার কাজকর্ম মেটার আগেই।
নাহ্, অনেকটা সময় নষ্ট হয়েছে। এবার সেন, পন্ডিত অ্যান্ড হোয়াইট ফার্মে ফোন করে আইনজীবীর ব্যবস্থা করা দরকার। তারপর… তারপর… একবার লাকি সোমকেও ফোন করার দরকার।
লাকি সোম, বিখ্যাত প্রাইভেট ডিটেকটিভ। শত্রুজিত সমাজপতি… বিখ্যাত শিল্পপতি, ফাইন্যান্সর, মুম্বাইয়ের গাড়ির ডিলারের চ্যারিটি ডিনারের মৃত্যুর কেসটা শেষমেশ লাকি সোমই সমাধান করেন। ডাঃ দেশমুখ আগে থেকেই চিনতেন মিঃ সমাজপতিকে। বিভিন্ন পার্টিতেই দেখা হতো।
‘সেন, পন্ডিত অ্যান্ড হোয়াইট’-এর মাঝারি মানের আইনজীবী স্যামুয়েল রডরীগস ছিলেন ডাঃ দেশমুখের ‘নিউজ-ব্রোকার’। তিনি প্রায়শই ডাঃ দেশমুখকে দারুণ আকর্ষণীয় খুচরো তথ্য সরবরাহ করতেন। ডাঃ দেশমুখের কাছে ওগুলো খুবই দরকারী ছিল। রডরিগ্সই-এর কাছ থেকেই ডঃ দেশমুখ প্রথম লাকি সোমের কথা জানতে পারেন।
‘সত্যি কি, আমার সোমকে ইনভল্ভ করার দরকার আছে?’ ‘সেন, পন্ডিত অ্যান্ড হোয়াইট’-এর সিনিয়র মোস্ট পার্টনারকে ফোন করতে গিয়ে একবার ভাবলেন ডঃ দেশমুখ। কিন্তু মজার ব্যাপার এই যে ফোনের ওপ্রান্তে যে ব্যাক্তির সঙ্গে তাঁর কথা হল তিনি মোটেই কোনও মিঃ সেন, বা মিঃ পন্ডিত, এমনকি মিঃ হোয়াইটও নন। তাঁর নাম হল হাসমুখ প্যাটেল, সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ। পরের দিন দেশমুখ এবং হাসমুখ ঠিক করলেন গলফ ক্লাবে দেখা করবেন। ব্যক্তিগত আলাপচারিতার জন্য এই স্থানটি দারুণ।
***
ডাঃ দেশমুখের জবাব ধৈর্য্য সহকারে শোনার পরে বৃদ্ধ আইনজীবীর প্রথম প্রশ্নই ছিল, ‘আপনি ভদ্রমহিলাকে শেষ কবে দেখেছিলেন?’
একরাউন্ড গলফ খেলেই স্টিক-বল গুছিয়ে নিয়ে ক্লাব হাউসের দিকে ধীরে ধীরে ফিরছিলেন তারা।
‘তা প্রায় মাস আষ্টেক আগে… রাশিয়ায়… অবশ্য সেই ব্যাপারটা খুব গোপনীয়… অফিসিয়ালি আমি তখন ইউরোপে আছি বলেই সবাই জানে… অবশ্য সেটা খুব একটা মিথ্যা নয়। আমি ইউরোপ থেকে একটা ক্রুজে সমুদ্র ভ্রমণ করছিলাম, যেটা রাশিয়াকে ছুঁয়ে ছিল… আমি….’ – দেশমুখ একটু চুপ করে রইলেন। ‘তখন ভিষ্মিকা যাচ্ছিলেন আন্টার্কটিকার শ্যুটিং-এ। ‘
বৃদ্ধ আইনজীবী শুনে ঘাড় নাড়লেন। তিনি ইতিমধ্যে দেশমুখের ইতঃস্তত করার ভাবখানা খেয়াল করেছেন। ‘আর ভারতে? আন্টার্কটিকা থেকে শুটিং-এর পর ফিরে এসে আপনার সঙ্গে তাঁর একবারও দেখা হয়নি। ওখানে তো রক্ত জমান ঠান্ডা… ভদ্রমহিলা নিশ্চয়ই দেশে ফিরে রোদের তাপে ভীষণ খুশি ছিলেন।’
‘নাহ… একটা ফোনও না… এতটাই অকৃতজ্ঞ…।’
মিঃ প্যাটেল হাত নেড়ে দেশমুখের উত্তেজিত মুখরতাকে থামালেন।
‘এখন কিচ্ছু করবেন না। শুধু দেখে যাওয়া আর অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের কিছু করার নেই। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে আপনার সরাসরি কোনও প্রকার সংশ্রব নেই… আসলে, এটি একটি অগ্নিকান্ডে মৃত্যু ছাড়া আর কিসসু নয়… আর আপনি তো কোনওভাবেই এর ধারে কাছে নেই। মোটিভও নেই কোন। তদন্তে আপনার নাম শুধু শুধু উঠবে কেন? যা-হোক আপনি তো জানেন কিভাবে প্রেসকে হ্যান্ডেল করতে হয়?… তাহলে আর কি… আজ এপর্যন্তই, চলি তাহলে এখন। কিন্তু…’ এক মুহূর্তের জন্য তার চোখের দৃষ্টি শূন্যে হারিয়ে গেল। দেশমুখের দিকে তাকিয়ে থেকেও তিনি যেন কিছুই দেখছিলেন না। তিনি যেন হারিয়ে গেছেন ভবিষ্যতের চিন্তায়।
‘তাহলে আমার এখন কিছু করার নেই।’ বৃদ্ধ আইনজীবির দিকে তাকিয়ে বললেন ডাঃ দেশমুখ। ব্যাপারটা মোটেও তাকে স্বস্তি দিচ্ছিল না। কোনও একটা ব্যাপার তাঁকে অস্বস্তিতে ফেলেছে তা জলের মতোই পরিষ্কার। স্পষ্টতঃই আভাস পাওয়া যাচ্ছিলযে, ভবিষ্যতে কোনও গভীর জটিল আবর্তে জড়িয়ে পড়তে চলেছেন তিনি।
এক অত্যাধুনিক চিকিৎসাবিদ হিসাবে কি দেশমুখের আরও বেশী কিছু জানা উচিত ছিল? ভাবা উচিত ছিল রোগিনীর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ-এর ব্যাপারে?
মূলত যুবসমাজ, আলোকরোশনাইয়ের জাঁকজমকের কেন্দ্রে থাকতে চাওয়া আত্মপ্রত্যয়হীনরাই ছিল তার মূল রুজিরুটি। ‘তাদের যা চাহিদা আমি সেটাই তাদের দিয়েছিলাম। তাদের কী চাওয়া উচিত তা আমি তাদের কখনো বলি না। আমি কখনোই মূল্যবোধকে চাপিয়ে দিইনি তাদের উপরে। অৰ্থ রোজগার করেছি পেশাদারিত্বের মাধ্যমে, চিকিৎসা করে।’ দেশমুখ নিজেকে প্রবোধ দিলেন। বহু বছর আগে এই কাজে নামার শুরুতে নিজের মনকেই বোঝাতেন তিনি। তবুও; আজও ‘মিনিসা’-র ভূত তাঁকে তাড়া করে বেড়ায়।
অবশ্য হাসমুখ প্যাটেল এতসব ব্যাপার কিছুই জানে না।
হিন্দি ছায়াছবির মক্ষীরানি ছিল মিনিসা। তার হাতেই মিনিসা জিন থেরাপি নিয়েছিলেন। শুধু কেবল অজ্ঞাত এবং অপ্রত্যাশিত সাইড এফেক্টের কারণে সে বাঁচতে চায়নি। মেয়েটার কার্যকলাপের জন্য ডাঃ দেশমুখ মনে মনে বহুবার তাকে গালাগাল করেছেন। আরে চিনির মিষ্টত্ব সে আর বুঝতে পারত না, এটা কি এমন রোগ যে তার জন্যে সারা জীবনের সমস্ত সাফল্য ছুঁড়ে ফেলে আত্মহত্যা করতে হবে? মিনিসা পর্বে তীব্র অনুশোচনা ছাড়া তার পেশাগত দক্ষতা বাইরের লোকের যাবতীয় অনুযোগের উর্দ্ধে ছিল। আসলে সেইসময়ই ভারতে কেউ দেশমুখের সঙ্গে এই ঘটনার সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেনি। পরে পৃথিবীর অন্যান্য দেশে এরকম আরো কিছু ঘটনার পরে কোরিয়ান কোম্পানিটি তাদের জিনের সাপ্লাই আরো নিখুঁত করে। আজই তিনি এমনই একটা অপারেশন ক্যান্সেল করেছেন। নাহ, বিপদজ্জনক বলে নয়, বরং রাশিয়ান ঘটনাটা নিয়ে তিনি কতটা কাদায় পড়েছেন সেটা জানা বেশি দরকার এখন।
ডাঃ দেশমুখ মোটেই কোনও শয়তান মানুষ নন। হাতুড়ে ডাক্তার তো তিনি কখনোই না। তিনি শুধুমাত্র এমন একজন শল্য চিকিৎসক, যিনি নিজেকে রূপোলী জগতের তারকাদের কাছে জাদুকর হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছেন। এটা অনেকটা বাঘের পিঠে চাপার মতো। একবার চড়ে গেলে হাজার ইচ্ছা থাকলেও আর নামা যায় না।
নতুন চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো অগুন্তি ঢেউয়ের মতো ক্রমাগত আছড়ে পড়ছিল জার্ণালে জার্ণালে। গাধার দুধে স্নান করতে ক্লিওপেট্রা যেমন অভ্যস্ত ছিলেন, কিংবা রানী ব্যাথোরি যেমন রক্তপূর্ণ বাথটাবে অবগাহন করতে পছন্দ করতেন… সকলেরই অভীষ্ট আসলে একই। চিরযৌবন প্রাপ্তি।
প্রত্যেক সেলিব্রিটিই তার থেরাপির নমুনা চাখতে ডাঃ দেশমুখের ব্যাক্তিগত চেম্বারে উৎসুক চিত্তে হাজির হতো। মৌমাছির বিষের ফেসিয়াল থেকে শুরু করে নারী গর্ভের গর্ভফুল-এর ফেস মাস্ক, এমনকি চিনামাটিসম শুভ্রতর ত্বকের জন্য স্ফটিক ইঞ্জেকশন… বার্ধক্যহীন চিরকৌমার্যের হাজার রকমের প্রতিশ্রুতি ছিল তখনকার সকল সংবাদ-এর শিরোনামে।
অপ্রচলিত থেরাপিগুলোর প্রতিই তারকাদের আগ্রহ ও বিশ্বাস তখন বাজার গরম করে রেখেছে। জোঁক এবং ফিতাকৃমির প্রয়োগও এর সঙ্গে যুক্ত হয়। কসমেটিক থেরাপির প্রথম যুগেই অণুজীবের ব্যাবহার করা হতো। ডাঃ দেশমুখ তাই সেই পদ্ধতিকে অস্বীকার করতে পারেন না। আত্মপক্ষ সমর্থনে তার ব্যাখ্যা, ‘আমি না করলে, অন্য কেউ অবশ্যই এর প্রয়োগ করতো।’
একজন বুদ্ধিমান মানুষ হিসেবে ডাঃ দেশমুখ জানতেন যে যুগটা হল অপরাজেয়তার। বার্ধক্যকে কখনোই থামিয়ে দেওয়া কিংবা পিছন দিকে ফেরানো শারীরিকভাবে সম্ভব নয়। জরাকেও দীর্ঘদিন উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। তবুও তিনি কখনোই চেষ্টাও করেননি তার ক্লায়েন্টকে সেই কথা বোঝাতে। বরং তিনি তাদের সামনে পেতে দিতেন লোভনীয় অল্টারনেটিভ থেরাপির মেনুকার্ড। যেগুলো বেশিরভাগই বিদেশের মাটিতে অত্যন্ত বিতর্কিত অথবা একেবারে নতুন কিছু। ভিষ্মিকার ওপর প্রয়োগ করা রাশিয়ান থেরাপিটা ছিল অমনই একপ্রকার। তবুও এবারে কোথাও না কোথাও এক গূঢ় আত্মজিজ্ঞাসা তাঁর সুদৃঢ় উচ্চ আকাঙ্খাকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে। এটা তাঁর কাছে একটা বিস্ময়কর অনুভূতি।
অন্যমনস্কভাবে তিনি খেয়াল করলেন যে মিঃ প্যাটেল বলছেন, ‘ঢেউটাকে একটু থিতিয়ে যেতে দিন মশাই। যদিও কলকাতায় আমাদের ফার্মের গোয়েন্দা দপ্তর রয়েছে… কিন্তু আমি আপনাকে পরামর্শ দেব এর থেকে সরে থাকতে… আগুনকে হাওয়া দেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। যখন কোনওপ্রকার স্ফুলিঙ্গের আভাসটুকুও দেখা যাচ্ছে না।’
***
‘আমি মোটেই এটা মানতে পারছি না… এটা মোটেই একটা অ্যাকসিডেন্ট নয়।’ ভিষ্মিকার বাড়িতে তার বোনঝি অনন্তিকাকে সামলানো যাচ্ছিলো না। সোফায় বসে সে নাগাড়ে প্রলাপ বকে চলছিল ‘…কেউ নিশ্চয়ই তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’
পুলিশের কাছেও এর কোনও ব্যাখ্যা নেই। ঘটনাস্থলের বহু সাক্ষী রয়েছে। কাছেপিঠে কোথাও আগুন জ্বলছিল না। সেট-এ কেউ ধূমপান করছিল না। ভিষ্মিকা নচিকেতার সঙ্গে বসেছিলেন ক্যামেরার সামনে, শট এর অপেক্ষায়…’
‘ওটা একটা আগুনের দৃশ্য ছিল… নিশ্চয়ই ওখানে কোনও রাসায়নিক ছিল… হতে পারে তার পোশাক… চেয়ার… লাইটবয়রা… হতে পারে এটা একটা ষড়যন্ত্র। ‘
‘ষড়যন্ত্র?’ পুলিশ অফিসার সামান্য নড়েচড়ে বসলেন। ‘আপনার কি মনে হয়? ওনার কোনও শত্রু ছিল… কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী? কাকে আপনার সন্দেহ হয়?’
‘আমি জানি না… কিন্তু এই ইন্ডাস্ট্রিতে কেউ কারো বন্ধু নয়। আর শুনুন, এটা আপনার কাজ, খুনিকে খুঁজে বার করা… যদি না কেউ আগুন ধরিয়ে দেয় অথবা ধারেকাছে আগুনের শিখা না থাকে… তাহলে কিভাবে … কিভাবে তার গায়ে আগুন লাগলো? আমাকে বলুন তাহলে কোথা থেকে আগুন এলো? ’
পুলিশ অফিসার প্রজ্ঞান মহাপাত্র মাথা চুলকাচ্ছিল… এই প্রশ্নটি অবশ্যই ডিপার্টমেন্টের গোয়েন্দাদেরও ভাবিয়েছে। তারা কোথাও বিন্দুমাত্র রাসায়নিকের উপস্থিতি খুঁজে পায়নি যা দিয়ে আগুন জ্বালান সম্ভব। আগুনের ভয়াবহতাকে বৃদ্ধি করার জন্য অগ্নিসহায়ক কোনওপ্রকার উপাদানের চিহ্নও সেখানে মেলেনি। কেবলমাত্র নচিকেতা-ই তাঁর কাছে বসেছিলেন। পিছন থেকে জনাদুয়েক ফোটোগ্রাফার তাঁদের ছবি তুলছিলেন। সেই ছবিগুলোতে দেখা গেছে ভিষ্মিকা সম্পূর্ণ খালি হাতে নচিকেতার সঙ্গে কথা বলছে।
মেকআপের মেয়েটিকেও দীর্ঘক্ষণ জেরা করা হল। তার সঙ্গে থাকা সমস্ত সাজসজ্জার জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে তদন্তের স্বার্থে। হয়তো এগুলোই শেষ পর্যন্ত ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। প্রসাধনীগুলোঅবশ্যই ভীষণ দামি। কোনওপ্রকার বাজার চলতি জিনিস নয়।
‘কি যা তা বলছেন… নিজে নিজেই মাসিমনির গায়ে আগুন ধরে গেছে! বললেই হল… অমনিই আগুন ধরে গেল?’
এক মুহূর্তের জন্য, প্রজ্ঞান বুঝতে পারছিল না যে, কে তার সামনে বসে আছে, তার বস নাকি, ভিষ্মিকার কমবয়সী বোনঝি? আসল সমস্যা হল যে, সে ইতিমধ্যেই নচিকেতার বক্তব্যটা খানিক মেনে নিয়েছে।। ঘটনাটা তাকে একদমই বোকা করে দিয়েছে। এমনকি সে গুগল করেও দেখেছে, সত্যিই কী হঠাৎ করে কোনও মানুষের গায়ে আগুন লাগতে পারে। এর চাইতে যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা তো আর আসছে না। ভিষ্মিকা হয়তো সত্যিই আগুন হয়ে জ্বলে গিয়েছিল!
অনন্তিকা শোকে অসংলগ্ন কথা বলছিল। কিন্তু তার মনের মধ্যে একটা দৃঢ় ধারণা জন্মাচ্ছিল। নিশ্চয়ই চলচ্চিত্র জগতের-ই কেউ একজন তার মাসিমনির গায়ে আগুন লাগিয়েছে। যতক্ষণ না এই ঘটনার রহস্যটা ভেদ করতে পারে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে না।
যদি দরকার পরে, মুখ্যমন্ত্রীকে ডাকতে হয়, এমনকি প্রধানমন্ত্রীকেও; সে তাই করবে। তার মাসিমনি, ভিষ্মিকা একজন জাতীয়স্তরের ব্যক্তিত্ব আর তাঁর একমাত্র পরিবার বলতে রয়েছে এই অনন্তিকাই। সে কিছুতেই হাল ছাড়বে না। প্রজ্ঞানকে অনন্তিকা বিস্তারিতভাবে এইসব কথাগুলো বুঝিয়ে দিল। প্রজ্ঞান মাটির দিকে তাকিয়ে সেগুলোই একমনে শুনছিলো। অনন্তিকার ঝাঁঝালো হুমকির হাত থেকে বাঁচতে সে বলে উঠল, ‘গুগল বলছে, স্পন্টেনিয়াস হিউম্যান কমবাশচন, বাংলায় হল গিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত মানবদৈহিক প্রজ্বলন। এমনটাও ঘটতে পারে… যে কোনও ব্যক্তি, কোনও অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, এমনকি অগ্নিসহায়ক বাহ্যিক সূত্র ছাড়াও মানুষ অগ্নিদগ্ধ হতে পারে।’
তার কথাগুলো এক মুহূর্তের জন্য অনন্তিকাকে নির্বাক করে দিল। পরক্ষণেই প্রজ্ঞানের উপরে দাঁত খিঁচিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো। ‘বেরিয়ে যান… এখুনি বেরিয়ে যান… আমি আপনাকে এখনই বরখাস্ত করে ছাড়বো। এটা তদন্ত হচ্ছে? পুলিশ ডিপার্টমেন্ট গুগল ঘেঁটে তদন্ত করে?’
***
প্রজ্ঞান জানতো যে তার সামনের পথ বড়োই বন্ধুর। সে ইতিমধ্যেই এমন রিয়াকশন পেয়েছে বসের থেকে, অবশ্য সেটা আরেকটু ভদ্রজনোচিত ছিল। কিন্তু প্রজ্ঞান হাল ছাড়ার বান্দা নয়। আর যাই হোক গুগলের সহায়তা তো তার সঙ্গেই রয়েছে।
বস কথা বলতে শুরু করতেই সে বস-এর কম্পিউটার-এ গুগল খুলে ফেলল। ‘স্যার, দেখুন আগুন সম্ভবতঃ ভিক্টিম নিজের শরীর থেকেই উৎপাদন করেছিল। এই যে স্যর, ’স্পন্টেনিয়াস হিউম্যান কমবাশচন’। এর প্রথম প্রস্তাব করেছিলেন দার্শনিক ‘পল রোলি’। ১৭৪৬-এ।– তাঁর আর্টিকেলটা প্রকাশিত হয়েছিল ‘দ্য ফিলোজফিক্যাল ট্রানজ্যাকশনে’।
প্রজ্ঞানের বসকে দেখে মনে হচ্ছিল বিস্ময়ে বাকরোধ হয়ে গেছে। প্রজ্ঞান এই সুযোগে ঝটপট বাকি কথাগুলো বলে গেল ।
‘স্যার, যতদূর খবর পাওয়া যায় ১৬৬৩-তেই ড্যানিশ অ্যানাটমিস্ট থমাস বার্থলীন ‘স্পন্টেনিয়াস হিউম্যান কমবাশচন’-এর প্রথম কেসটি লিখেছিলেন। প্যারিসে এক ভদ্রমহিলা অমনভাবে ঘুমের মধ্যেই আগুন জ্বলে মারা যায়। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তার দেহটি ছাই এবং ধোঁয়াতে পরিণত হয়। অথচ তার মাদুরটা পর্যন্ত অক্ষত থেকে যায়। ‘
এতক্ষণে তার বস বাকশক্তি ফিরে পেয়ে, গর্জন করে ওঠেন, ‘কি ননসেন্স-এর মতো কথা বলছ তুমি, প্রজ্ঞান?’ কেসটা সলভ করার জন্য উপরমহল থেকে প্রতিনিয়ত চাপ আসছে তাঁর উপরে। কিন্তু কোনও সূত্র কিংবা সাক্ষীর জবানবন্দী বিন্দুমাত্র আলো পর্যন্ত দেখাতে পারছে না। আর তার সবচাইতে প্রমিসিং জুনিয়ারটি কিনা গুগল ঘেঁটে অশ্বডিম্ব প্রসব করে চলেছে।
‘মোটেও ননসেন্স নয়, স্যার। এগুলো আজ সারা পৃথিবীতে উল্লিখিত… তথ্যভিত্তিক আর তদন্ত দ্বারা পরীক্ষিত। আমাদের খোলা মনে বিচার করা উচিত। বাস্তব হচ্ছে কল্পনার চাইতেও অদ্ভুত, স্যার। আর এটা হল গিয়ে বিজ্ঞান, বুঝলেন স্যার।’ প্রজ্ঞান ইতিমধ্যেই উঠেপড়ে লেগেছ ‘স্পন্টেনিয়াস হিউম্যান কম্বাশচন’ কেই ভিষ্মিকার মৃত্যুর কারণ হিসেবে গ্রহণ করার জন্য। মিডিয়া তাড়িত হয়ে পুলিশ অবশেষে প্রজ্ঞানের গুগল করা তত্ত্বটিই বিবৃত করে বলেছে, যে তারা এই সম্ভাবনাটাকেই গুরুত্ব দিচ্ছে।
ব্যস, খড়ের গাদায় আগুন লাগার মতোই দেশ উত্তাল হয়ে উঠল। দেশের জনগন ইতিমধ্যেই জানতে চায়, এক্ষেত্রে কোথায় গেল বৈজ্ঞানিক চেতনা?
আত্মপক্ষ সমর্থনে পুলিশ বলেছে যে, সারা পৃথিবীব্যাপী দু’শোর বেশি এই ধরণের কেস নথিভুক্ত হয়েছে। অতিসাম্প্রতিক কেসগুলোর মধ্যে একটা হল ৭৬ বছর বয়স্ক মাইকেল ফ্রাহারটির কেস। ২০১০-এ আয়ারল্যান্ড-এ নিজ বাড়িতে তাকে এভাবে দগ্ধ হয়ে মারা যেতে দেখা যায়। শব পরীক্ষকদের বিচারে এটি স্পন্টেনিয়াস হিউম্যান কমবাশচন-এর একটি নমুনা।
কিন্তু এতে করে বিতর্ক বাড়ল বই কমল না।
***
অনন্তিকা রাগের চোটে কুশনটাকে টিভির উপর ছুঁড়ে মারল। ভিষ্মিকার বাড়িতে বসে সে এখন ক্ষোভে ফুটছে। ইতিমধ্যেই ‘স্পন্টেনিয়াস হিউম্যান কমবাশচন’ নিয়ে এক অন্তহীন বিতর্ক টিভিতে সম্প্রচার হয়ে চলেছে। পুরাণ তথা অন্যান্য প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য খুঁড়ে মিডিয়া তুলে আনছে এই অদ্ভুত ঘটনার উপস্থিতির কথা।
পূর্ণিমার দিকে মুখ করে সে বলল, ‘এরা, মাসিমণির মৃত্যুটাকে সার্কাস বানিয়ে ছাড়লো।’ পূর্ণিমা তার অত্যন্ত বিশ্বস্ত নার্স কাম পরিচারিকা। ভিষ্মিকার কাছে আসা ইস্তক, মাত্র দুদিন বয়স থেকে, পূর্ণিমাই অনন্তিকাকে বড় করে তোলেন। অনন্তিকার বাবা মা নার্সিং হোম থেকে ফেরার পথে গাড়ি একসিডেন্ট-এ মারা গিয়েছিলেন।
পূর্ণিমা ছিল ভিষ্মিকা, অনন্তিকা –দুজনেরই মায়ের মতো। তাদের দুজনের জীবনে পূর্নিমাই একমাত্র ব্যাক্তি, যার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক তুচ্ছাতিতুচ্ছ জাগতিক বিষয়ের অনেক ঊর্দ্ধে ছিল। মজার ব্যাপার হল তাদের যথেষ্ট সম্পন্ন অবস্থা হয়ে সত্ত্বেও, তাদের জীবনে পূর্ণিমার ভূমিকা ছিল দাতার। সে তাদের জীবন ভালোবাসা, মমত্ব বোধে ভরিয়ে রাখতো। ওই ঝলমলে রুপোলি জগতের ক্ষণস্থায়ী সফলতায় যা ছিল বড়ই অপ্রতুল।
পূর্ণিমা তার মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করবার চেষ্টা করল। তারপর যেন অনুরোধ করছে, উপদেশ দিচ্ছে না এমন স্বরে বলল। ‘কলকাতায় বিখ্যাত এক গোয়েন্দার সঙ্গে আমার এক ভাই তারিণী কাজ করে। তার নাম, লাকি সোম। কোন গোয়েন্দা ফার্ম-এ যুক্ত না সে। নিজের খেয়ালে কাজ করে… মানুষটা বড়ই ভালো। আমি জানি কারণ সে আমাদের গ্রামটাকে একা হাতেই উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করেছিল।’
অনন্তিকা চোখ মুছতে মুছতে বললো, ‘পাম্মি, তোমার কি মনে হয় লোকটা আমাদের কি সাহায্য করতে পারবে? লোকটার নম্বর আছে তোমার কাছে? ’
মাথা নাড়িয়ে পূর্ণিমা জানালো, ‘আছে। তারিণীদাদার মোবাইল নাম্বরটা আছে আমার কাছে। তারিণী দাদা যা বলেছে তার অর্ধেকটাও যদি সত্যি হয়, তবে… লাকি সোম-ই ঠিক লোক। আর তাছাড়া আমাদের কীই বা করার আছে? কাকেই বা আর ভরসা করবো? দেখো না, পুলিশ কেমন গল্প ফাঁদছে।’
অনন্তিকা ঘাড় দোলাল। ‘এটা যদি মার্ডার-ই হয়, তবে আমার নিশ্চিত মুম্বাই ইন্ডাস্ট্রি-র কেউ না কেউ এর সঙ্গে যুক্ত। প্রাইভেট ডিটেকটিভ ডাকলে মুম্বাই ইন্ডাস্ট্রির বাইরের কোনও লোক-কেই ডাকতে হবে। মনে হচ্ছে লাকি সোমই এক্ষেত্রে সঠিক লোক।’
***
লাকি সোম-এর সঙ্গে অনন্তিকার কথা হবার পর, তিনি তার ডাক্তার বন্ধু অভিরূপ রায়কে ফোন করলেন। চিকিৎসা জনিত যে কোনও বিষয়ে লাকি সোমের কাছে অভিরূপই শেষ কথা।
‘স্পন্টেনিয়াস হিউম্যান কম্বাশচন’-কথাটি লাকি সোমের মুখে শুনে অভিরূপ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। ‘আমি এব্যাপারে একটু হলেও পড়াশুনা করেছি। বিশেষত টিভিতে ‘টক শো’-গুলো দেখার পরে।’
‘… হাতে গোনা এরকম কয়েকটি তথ্যই নথিভুক্ত আছে। কিন্তু তার মধ্যে অধিকাংশই হয় ঘরছাড়া বা একাকী বাস করা মানুষেরা। তারা সবাই বাস করত চরম অসাস্থ্যকর অবস্থার মধ্যে। ভিষ্মিকার ব্যাপারটা আমরা সেভাবে নিতে পারি কি? তাছাড়া সবকটা ক্ষেত্রেই পুড়ে যাওয়া দেহের ছবিতে দেখা যাচ্ছে পাগুলো অক্ষত রয়েছে।’
লাকি সোম আপত্তি জানালো, ‘কিন্তু ভিষ্মিকার ক্ষেত্রে পুরো বডিটাই আগুনে ঝলসে ছাই হয়ে গিয়েছিল, এমনকি তার হাত পা-ও।’
‘এই ব্যাপারটাই তোমাকে ভাবাচ্ছে, তাই তো?’
লাকি সোম জোরালো স্বরে অভিরূপকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘তাহলে তোমার কি মত?’
‘আমি? আমি নিজের মতো করে যেটা ভাবছি, তা বলার সাহস আমার নেই। আমি শুধু ভাবছি যে… ইয়ে মানে… একথা জানাজানি হলে আমি মেডিক্যাল বোর্ড থেকে বাদও পড়তে পারি।’
‘ধুর, ওসব ছাড়… আমি তো আর কোনও প্রেসের লোক নই। বলই না আমাকে।’
‘আচ্ছা… যদি এটাই হয়, কেউ আগুন ধরায়নি তবু তিনি আগুনে পুড়ে গেছেন… তাহলে আমাকে এটা মানতে হবে যে, তিনি নিজেই নিজের গায়ে আগুন লাগিয়েছেন…?’
‘এক্স্যাক্টলি এটাই আমি জিজ্ঞাসা করছিলাম… তুমি আমাকে এব্যাপারে কিছু যুক্তি সম্মত ব্যাখ্যা দিতে পারো? কোন কারণ? কোন হিন্ট বা ক্লু?’
‘হ্যাঁ, পারি। কিন্তু আমি কোনও কিছুই জোর দিয়ে বলতে পারবো না। পুরোটাই অবাস্তব শোনাবে আর আবারও বলছি, তুমি কিন্তু এই কথা কোথাও উদ্ধৃতি হিসেবে চালাতে পারবে না।’
‘ঠিক আছে বাবা! আমি প্রমিস করছি।’
‘কথাটা যেন তোমার মাথায় থাকে।’ অভিরূপ একটু ইতঃস্তত করে বললে, ‘আমার মনে হচ্ছে, তাঁর মেটাবলিজম রেট বেড়ে গিয়েছিল… যার ফলে তাঁর শরীরের ভিতরের তাপমাত্রাও ভয়ানকভাবে বেড়ে গিয়েছিল… সাধারণতঃ, মস্তিস্কের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র দেহের উত্তাপ নিয়ন্ত্রণ করে, কিন্তু এক্ষেত্রে তা ব্যর্থ হয়েছে…।’
‘ব্যাপারটা আরো একটু ভালো করে বোঝাও তো।’
‘তুমি এটা নিশ্চয়ই জান যে আমরা, স্তন্যপায়ী প্রাণীরা, বাহ্যিক তাপকে উপেক্ষা করে দেহের ভিতরের তাপকে সংরক্ষণ করে রাখতে পারি… আর যখন আমাদের শরীর এই কাজে ব্যর্থ হয়, তখন হাইপোথার্মিয়ায় আমাদের মৃত্যু হয়।’
‘আচ্ছা, তাই?’
‘এটা হল মস্তিষ্কে অবস্থিত হাইপোথ্যালামাস গ্রন্থি। যা আমাদের দেহের তাপ নিয়ন্ত্রণ করে… আর এই ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট ভাবে এই গ্রন্থি কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছে।’
‘আর তিনি দাউ দাউ করে জ্বলে গেলেন!’
‘লাকি… আমি আগেই বলেছিলাম এটা তোমার কাছে অবাস্তব শোনাবে।’
লাকি অভিরূপের কাছে ক্ষমা চেয়ে বলল, ‘সরি, তুমি বলতে থাকো।’
‘ভাব, প্রতিটা দিন… প্রতিটা মুহূর্তে… তুমি কি কল্পনা করতে পারো, তোমার শরীরের ভিতরে কত রকমের রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে চলেছে, ঘটেই চলেছে? এর মধ্যে বহু বিক্রিয়া তাপ উৎপাদন করে। তবে শরীরের উৎসেচক চক্রটা অত্যন্ত সুচারুভাবে গঠিত… আমি আসলে বলতে চাইছি বিবর্তন গ্রন্থিগুলিকে এমনভাবে তৈরি করেছে যার ফলে, উৎপাদিত তাপ ঠিক শরীরের বিভিন্ন অংশে প্রয়োজনীয় শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। যেমন, নার্ভ ইমপালস্। এটাই জৈবিক তন্ত্রের অভিনবত্ব।’
‘ওহ, এবার বুঝতে পারলাম… নার্ভ ইমপালস হল আসলে ইলেক্ট্রিকাল ইমপালস। তবে তার জন্যে আমরা কোনওভাবেই শক খাই না, বা শক দিই না। এবার বুঝতে পারছি।’
‘আসলে… আমার মনে হয় তাঁর শরীরের জৈবিক তন্ত্রে কোনও একটা শট সার্কিট ঘটে গিয়ে থাকবে। হয়তো তাঁর শরীরে নিয়মিত তাপ উৎপাদী বিক্রিয়া ঘটতো। তার প্রভাবে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়েছিল আর তাতেই তিনি স্বদগ্ধ হন।মনে হচ্ছে তাঁর সেলুলার রেসপিরেশন কোনও না কোনওভাবে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
কথা বলতে বলতে অভিরূপ হঠাৎ থেমে গেল, তারপর আচমকা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে উঠলো, ‘লাকি, আমি বিশ্বাসই করতে পারছিনা যে আমি টেলিফোনে এসব কথা বলছি। আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না যে এই আমি এইসব কথা বলছি।’
লাকি ভালোই বুঝতে পারছিল যে সে কিছুটা হলেও অভিরূপকে মানসিক চাপ দিচ্ছে। তার কাছে আর বেশি কিছু জানতে চাওয়াটা একদমই ঠিক হবে না। তাই লাকি এবার অভিরূপকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফোনটা কেটে দিল।
সেলুলার রেসপিরেশন বা কোষীয় শ্বসনের ব্যাপারটা ভুলবশতঃ তার মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিল। লাকি সেটাকে আবার মনে করার চেষ্টা করেছিল, আবছা আবছা মনে পরছিল তার। এয়ারপোর্টে বসে ফাঁকা সময়ে গুগলের সাহায্যে ব্যাপারটা আরেকবার ঝালিয়ে নিচ্ছিল। সে রয়াসনের ছাত্র ছিল বটে, কিন্তু জৈব রসায়নও তাকে যথেষ্ট আকৃষ্ট করে।
***
এয়ারপোর্টের বাইরে তার জন্য একটা গাড়ি আপেক্ষা করছিল। মৃতা অভিনেত্রীর বাড়ির জাঁকজমক দেখে তিনি বেশ ভালোই ইমপ্রেসড হলেন। মূল ফটকের দুপাশেই বিশাল আকৃতির দুটো সিংহের মূর্তি। গাড়িটি ভিতরে প্রবেশ করতেই পার্কিং-এর দুপাশে দুটো ফোয়ারা দেখতে পেলেন তিনি।
তার গেস্ট রুমটা অত্যন্ত বিলাসবহুল। এত বিলাসিতা তার কাছে কেমন একটা অস্বাচ্ছন্দ্যকর। এই বাংলোবাড়ির দুই আবাসিক তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছে। এখন তাদের চোখে মুখে কেবলই প্রত্যাশা। আশা ভরসা সবকিছুই এখন লাকি সোমের উপরে।
তিনি পূর্ণিমার সঙ্গে দেখা করে একটা শাড়ি তার হাতে দিয়ে বললেন, ’এটা তারিণীদা আপনার জন্য পাঠিয়েছে।’
পূর্ণিমা মুচকি হেসে উপহারটা গ্রহণ করলেন। ‘তারিণীদা চিরকাল ভীষণ অমায়িক। যাই হোক এখানে আসার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।’
তারপর অনন্তিকা আর পূর্ণিমা দুজনে মিলে তাকে পুরো ঘটনাটা খুলে বলতে লাগলো।
‘এটা বিজ্ঞানসম্মত হোক বা নাই হোক; আমি মোটেই ওসব ‘স্পন্টেনিয়াস কম্বাশচন’-এ বিশ্বাস করি না।’ অনন্তিকা বারবার একই কথা আওড়াতে লাগলো। ‘এটা একটা খুন। আমি শুধু চাই আপনি খুনিকে খুঁজে বার করুন… তার জন্য আপনি যা দাবি করবেন তাই পাবেন…’ পূর্ণিমার ইশারায় অনন্তিকা মাঝপথেই তার কথা থামাল।
লাকি সোম হেসে বললেন, ‘হুট করে কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাবেন না। আর রইলো বাকি আমার ফিস… ওটা নিয়ে আপনাদের ভাবতে হবে না। এটা একটা অত্যন্ত দুরূহ সমস্যা। এই ধরণের সমস্যা সমাধান করাটাই কোনওকিছু প্রাপ্তির উর্দ্ধে।’ তারপর তিনি দুইজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘বোঝাই যাচ্ছে আপনারা চাইছেন আমি এই ব্যাপারটা নিয়ে গোপনীয়ভাবে এগোই। খুব প্রয়োজন নাহলে পুলিশকে না জড়িয়েই…’
অনন্তিকা তাতে সম্মতি জানালো।
‘কিন্তু ব্যাপারটা খুব সহজ হবে না। কোন কেসেই পুলিশ কোনও প্রাইভেট গোয়েন্দাকে সহায়তা করবে বলে তো আমার মনে হয় না… যদিও…’ এই বলে তিনি থামলেন, ‘সত্যিই তাদের হাতে যদি কোনও জোরালো প্রমান থাকত তাহলে তারা এভাবে বিতর্কের মধ্যে জড়াতেন না।’
লাকির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে পূর্ণিমা বলল, ‘একদমই তাই। সোমবাবু আমি আপনার সঙ্গে আছি, শুধু বলুন আপনি কোথা থেকে শুরু করতে চান?’
‘আমাকে ভিষ্মিকার খুব কাছের লোকদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। আচ্ছা তার কি কোনও সেক্রেটারি ছিল?’
পূর্ণিমা জানালো, ‘নাহ, তার মা-ই তার সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি তো প্রায় চার বছর আগেই মারা গেছেন… তারপর থেকে অনন্তিকা-ই তার সমস্ত প্রয়োজনীয় বিষয়গুলি সামলাতো। যদিও একজন ফাইন্যান্সিয়াল আডভাইসর ছিল। এছাড়াও একজন ল’ইয়ার আর একটি কোম্পানি ছিল যারা তার মিডিয়া সংক্রান্ত বিষয়গুলো হ্যান্ডল করত।’
‘করতো, মানে… তারা কি এখন আর করে না?’
‘না… প্রায় আট মাস আগে ভিষ্মিকা দিদি কিছুদিনের জন্য কাজ থেকে ছুটি নিয়েছিলেন। মিডিয়া কোম্পানিকে তখন তিনি কাজ বন্ধ রাখার কথা বলেছিলেন, কিন্তু তারা ব্যাপারটা নিয়ে উল্টে খোশ গল্প তৈরি করতে শুরু করলো… তাকে মানুষের চোখে জিইয়ে রাখার জন্য’, পূর্ণিমা বলল।
অনন্তিকাও বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, মাসিমনি বিষয়টা নিয়ে খুব বিরক্ত ছিল… আমি জানি না ঠিক কেন, কিন্তু মাসিমনি তো সবসময় খবরের শিরোনামে থাকতে পছন্দ করতেন। তিনি রাশিয়া থেকে ফিল্ম শ্যুট করে ফিরে এসে খবরের কাগজ থেকে জানতে পারলেন যে, তিনি কিভাবে তার জাত খুইয়ে তার প্রেমিকের সঙ্গে চলে যান। তারপর তিনি তাদেরকে খারিজ করে দেন।’
পূর্ণিমা লজ্জায় পড়ে গিয়ে বললেন, ‘সোমবাবু, এইসব গল্প বানানো, মিথ্যে। ভিষ্মিকারও অন্যান্য যেকোন সাধারণ মেয়ের মতো প্রণয়ঘটিত ব্যাপার ছিল। তাই বলে তার কখনোই কোনও গোপন সম্পর্ক ছিল না। তিনি অসুস্থ ছিলেন এবং কিছুদিনের জন্য চিকিৎসাধীনও ছিলেন। যখন মিডিয়াতে নিজের সম্পর্কে এসব বানানো মিথ্যে খবরগুলো জানতে পারলেন তখন স্বাভাবিকভাবেই তিনি খুব রেগে গিয়েছিলেন। এটা কোনও আশ্চর্যের কথা নয়।’ কথাটা বলে তিনি অনন্তিকার দিকে খানিকক্ষন অসন্তোষের চোখে তাকিয়ে রইলেন।
‘ওই মিডিয়া এক্সপোজার হ্যান্ডলারদের নাম কি? বা ওরা কি নামে পরিচিত? ’
‘ইমেজ কনসাল্ট্যান্টস বলে ওদেরকে,’ অনন্তিকা বিদ্রুপের স্বরে বলল। সে যেন তার মাসিমনিরই কমবয়সী কার্বন কপি। কয়েক মুহূর্তের জন্য লাকি সোম যেন অনন্তিকার মধ্যে ভিসমিকার ছায়া দেখতে পেলেন, ‘ওই কোম্পানিটার নাম আইকনিক ইমপ্রেশনস।’
‘ফিনান্সিয়াল কনসালট্যান্ট ও ল’ইয়ার ছিলেন কারা?’
‘ফিনান্সিয়াল কনসালট্যান্ট ছিল বেইন এন্ড এমসিকেইন। আর একজন পার্সোনাল এ্যাডভাইসর ছিল…নাম মি. ডিনশ… যার খ্যাতি ছিল আইসক্রিম কোম্পানির মতো।’
অনন্তিকাকে বেশ রিল্যাক্সেড দেখচ্ছিলো। তাকে সামান্য উৎসাহীও লাগছিলো। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিলো লাকির জিজ্ঞাসাবাদের ভঙ্গিমা তাকে বেশ ভালোই প্রভাবিত করেছে।
‘আর ল’ইয়ার?’
‘সেন, পন্ডিত এন্ড হোয়াইট ফার্ম-এর শ্রী পুরুষোত্তম দাস ছিলেন তার ল’ইয়ার। ‘
এর আগে লাকি ‘সেন, পন্ডিত এন্ড হোয়াইট’ ফার্ম-এর সঙ্গে কাজ করেছে। এমনকি মি. প্যাটেল আর রডরিগস-এর সঙ্গে তার ভালোই আলাপ আছে। কিন্তু সে আগে কখনো পুরুষোত্তম দাসের কথা শোনেনি। সে নিশ্চিত হতে পারছিল না যে রডরিগস আর প্যাটেল ওখানে এখনও কাজ করে কিনা; বা করলেও আগেই তাদের কাছে যাওয়া তার উচিত হবে কিনা। ‘সেন, পন্ডিত এন্ড হোয়াইট’ ফার্মটি একটি সম্ভ্রান্ত প্রতিষ্ঠান এবং এব্যাপারে সে নিশ্চিত ছিল যে প্রয়োজনে এখান থেকেই তদন্ত শুরু করা যেতে পারে।
‘আর তার বন্ধুদের সঙ্গে তার সম্পর্ক কমন ছিল?’
‘ইন্ডাস্ট্রিতে তার খুব বেশি বন্ধু ছিল না। তিনি খুব কম বয়সেই অভিনয় জগতে এসেছিলেন। এবং তার মা ছিল তার সর্বক্ষণের ছায়াসঙ্গী। যতদূর আমি জানি… তার মায়ের উপস্থিতিও নিতান্ত অসহায় ছিল ইন্ডাস্ট্রির লোভাতুর দৃষ্টির সামনে… ওই অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি কখনোই খোলাখুলি কিছু বলেননি। তাই এখন তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করতেন বাইরের লোকদের আমাদের বাড়িতে না আনার জন্য। সবসময় প্রেসের সঙ্গে হোটেলে, অফিসে বা বাইরে অন্য কোথাও গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করতেন। তার অফিসটা পুলিশ সিল করে দিয়েছে।’
‘মাসিমনি বলত, কাউকে বিশ্বাস করার আগে তাকে পরখ করা প্রয়োজন।’ অনন্তিকা বলল। ‘আমার মনে হয় মাসিমনি, ডাক্তার আর ফিনান্সিয়াল অ্যাডভাইসরকে সবচেয়ে বেশি ভরসা করতেন। তারা অনেকদিন ধরে তার সঙ্গে রয়েছে। ডাঃ দেশমুখ তো আমার ঠাকুমারও চিকিৎসা করতেন।’
‘হ্যাঁ! আমি আর ডিনশ্ তো একসঙ্গেই বড় হলাম প্রায়।’ পূর্ণিমা হাসতে হাসতে বলল। ‘তার একমাথা ঘন কালো চুলের কথাও আমার মনে আছে। এখন তো পুরোপুরি টাক পড়ে গেছে। ভিষ্মিকার সম্পত্তির দেখাশোনা করতে গিয়ে তার এই হাল হয়েছে।’
লাকি বলে উঠলো, ’ভিষ্মিকা দেখছি খুবই নিয়মনিষ্ঠ আর ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। শুধু তাই নয় পরিবারের প্রতিও খুবই যত্নশীল।’
এতেই পূর্ণিমা আর অনন্তিকার চোখ ছলছল করে উঠল। তারপর পূর্ণিমা বলল, ‘চলুন আপনাকে দিদির ঘরগুলো দেখাই। দিদি ঐদিকের তিনটে ঘরই ব্যাবহার করতেন। চাইলে দিদির সব নথিপত্র, ডেস্ক, যা আছে সব খুঁজে দেখতে পারেন। যদিও পুলিশ একবার পুরো ঘরটার তল্লাশি করে গেছে, কিন্তু তারা নাকি কিছুই খুঁজে পায় নি।’
‘তদন্ত আরম্ভ করার এটাই আদর্শ জায়গা।’ লাকিও পূর্ণিমার সঙ্গে সহমত পোষণ করল, ‘তুমি কি আমাকে ইমেজ কনসালটেন্ট, ল’ইয়ার ও ফিনান্সিয়াল অ্যাডভাইসরের সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে দিতে পারো? যদি সম্ভব হয় তো পারিবারিক ডাক্তারকেও ডেকে নিও একবারে। কিন্তু ভুলেও এটা বলবে না যে আমি আসলে একজন গোয়েন্দা।’
‘আমরা ফোন ওদেরকে ডেকে নেব।’
***
দেখা গেল আইকনিক এক্সপ্রেসনের কনসালট্যান্টরা কথা বলতে বেশ ইচ্ছুক। তার একটা বড় কারণ হল যখন ভিষ্মিকা তাদেরকে খারিজ করে দেয়, মিডিয়া জগতে তাদের বাজার বেশ পড়ে গিয়েছিল।
লাকি একটা মনগড়া গল্প কোম্পানিটাকে খাওয়াচ্ছিল। সে অনন্তিকার নতুন ম্যানেজার। কিছুদিন পরেই অনন্তিকা চলচ্চিত্র জগতে ঢুকতে চলছে… প্রায় তার মাসিমনির মতোই। শুধু ওই রহস্যময় সমাপ্তিটা বাদ দিয়ে। লাকি সোম বলল।
এখন লাকি সোম ম্যানেজার হিসাবে চায় যে অনন্তিকা আইকনিক ইম্প্রেশনের সঙ্গে কাজ করুক। কিন্তু ভিষ্মিকার সঙ্গে অতীতের ওই জলঘোলা হওয়ার জন্যে অনন্তিকা নিজে বিশ্বাস রাখতে পারছে না কোম্পানির উপরে। এখন কোম্পানি যদি ভিষ্মিকার ব্যাপারগুলো আদতে কি ঘটেছিল সব খুলে বলে… তাহলে লাকি সোম দ্বিতীয়বার অনন্তিকাকে ভেবে দেখার অনুরোধ করতে পারে।
টোপটা কাজ করল।
‘ভিষ্মিকা দেবী তখন সবে ‘পেয়ারী রুশী’ ছবিটির শুটিং শেষ করেছেন। কয়েকদিন মাত্র কন্টিনিউটি শট-এর জন্য দরকার ছিল। এমন সময় তার বয়ফ্রেন্ড এলেন রাশিয়াতে। ব্যস, তারপরেই দুজন গায়েব। আমরা এই তথ্য বিশ্বস্ত সূত্র থেকে পেয়েছি।’ ওই অফিসের এক মহিলা বলে উঠলেন।
‘কার কাছে থেকে?’ লাকি জিজ্ঞাসা করলো।
‘কনফিডেনশিয়াল সোর্স। আমাদের সূত্রগুলো চিরকালই ভীষণ কনফিডেনশিয়াল।’ আইকনিক ইমপ্রেশন জোরালো যুক্তি দিয়ে বোঝাতে চেষ্টা করল।
কঠোর স্বরে লাকি পুনরায় বলল, ‘কার কাছ থেকে? ’
মহিলা হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘স্পট বয়েজ?’
‘তারা কি লোকটাকে চিনতে পেরেছিল? তিনি কি কোনও অভিনেতা?’
‘নাহ। তিনি কোনও অভিনেতা নন। কিন্তু স্পট বয়দের মধ্যে একজন বলেছিল সে ওই লোকটির ছবি খবরের কাগজে দেখেছে। তিনি কোনও একটা হাসপাতাল উদ্বোধন করছিলেন। হতে পারে লোকটা কোন একজন ডাক্তার বা রাজনীতিবিদ… কেউকেটা তো হবেনই। আমরা অনুমান করেছিলাম লোকটা কোনও রাজনীতিবিদ-ই হবে। ভিষ্মিকা একবার বলেছিলেন যে, তাঁর ক্যারিয়ার যদি মনোমত না চলে, তাহলে রাজনীতিই তার পরবর্তী ক্ষেত্র হতে চলেছে।‘
‘তারপর?’
‘তারপর, ভিষ্মিকা আর তার বয়ফ্রেন্ড তো উধাও। এরপর সরাসরি তিনি ভারতে ফিরলেন না। সোজা পরের মুভিতে শ্যুটিং-এর জন্য অ্যান্টার্কটিকায় গিয়ে উপস্থিত হলেন। শ্যুটটা ছিল টানা তিনমাসের। তারপর তিনি ছুটি কাটাতে ইউরোপ গেলেন।’
আইকনিক ইমপ্রেশন-এর দুই পার্টনারের কথাই লাকি মনোযোগ দিয়ে শুনলো।
‘তাহলে ইন্ডিয়ায় তিনি ফিরলেন কবে?’
‘আমরা যা জানি, তিনি ফিরেছেন হপ্তা তিনেক বা বড়জোর মাসখানেক আগে। তবে তার পরের মুভির জন্য প্রথম মূহরত শট তোলা হয়েছিল ওই অগ্নিকাণ্ডের দিনই। তাঁর আগে তাঁকে জনসমক্ষে দেখা যায়নি।’
***
ওইদিন সন্ধ্যাবেলায়, লাকি পূর্ণিমার সঙ্গে কথা বললেন, ‘আপনার কী মনে হয়? পলিটিক্স এ নামার কথা ভাবছিলেন তিনি?’
‘রাজনীতি? না, না, ওটা ঠাট্টা। ও তো বলতই রাজনীতি হল বেকার অভিনেতাদের পেশা। এখন তার প্রচুর অফার ছিল।’
হঠাৎ অত্যন্ত রূঢ়স্বরে অনন্তিকা বলে উঠেছিল। ‘হ্যাঁ, তবে এটা ঠিক যে মাসিমনি ভীষণ ভীত হয়ে পড়ছিলেন। বয়স বেড়ে যাওয়া আর কাজ হারাবার ভয় তাঁকে চেপে ধরেছিল। বার্ধক্য আর জরায় কুঁকড়ে যাওয়া… ওটাই ছিল তার আসল আতঙ্ক। ‘বৃদ্ধ’ শব্দটার প্রতি তীব্র ঘৃণা ছিল তাঁর। আর এটাও সত্যি যে তিনি ক্রমশঃ ‘বুড়ো’ হচ্ছিলেন। এই কারণেই এখন বেশিরভাগ সময়েই তিনি নিজের মেক আপ নিজেই করতেন। সেই কারণেই ছবি তোলার সময়ও সার্টেন কিছু অ্যাঙ্গেল থেকেই কিংবা শর্তাধীন নিয়ন্ত্রণেই ছবি তুললেন তিনি। তাও আবার প্রপার অ্যাপয়েনমেন্ট-এর মাধ্যমে।’ অনন্তিকা পূর্ণিমার দিকে তাকালো। ‘মি. সোমের কাছে কিছু গোপন কোরো না।’
লাকির মনে হচ্ছিল ভিষ্মিকার ভয়টা সম্পূর্ণ মানসিকভাবেই ছিল। যে তিনখানা রুম ভিষ্মিকার ব্যাক্তিগত ব্যবহারের জন্য ছিল, তার মধ্যে একটা পুরোটাই ছিল ‘ড্রেসিং এর। ‘
শুধুমাত্র জুতোর এমন একখানা ওয়ার্ডরোব থাকতে পারে! লাকি এর আগে এরকম কখনোই দেখেনি। এমন সুসজ্জিত কসমেটিক্স-এর ভাঁড়ার সে ইতিপূর্বে দেখেছে বলে মনে করতে পারল না। প্রায় প্রত্যেক কন্টেনার এর গায়েই ইয়ং, অ্যান্টি এজিং ইত্যাদি লেখা। ভিষ্মিকা মোটেই কচি খুকি নন। নিশ্চিতভাবেই তিনি চল্লিশোর্ধ… আর ক্যামেরা মোটেই তার বয়সটাকে উপেক্ষা করতে পারছিল না। তার ফ্রিজ উপছে পড়ছিল বিদেশী বিউটি প্রোডাক্টস-এ। সুদৃশ্য গ্লাস কনটেনার-এ ছিল ‘চিল্ড ওয়াটার’।
পূর্ণিমা লাকির অভিব্যক্তি লক্ষ্য করে বলল, ‘ ভিষ্মিকা একদমই মদ খেত না। তবে রোজ আট গ্লাস জল পান করতো। তিনি বলতেন, এটা হল সেরা ডিটক্স। অ্যাকোয়া অ্যান্টিকা হল পরিশুদ্ধ পানীয়ের একটি ইম্পোর্টেড ব্র্যান্ড।’
এরপর কফিনের মতো এক অদ্ভুত দর্শন একটা বাক্সকে দেখে পূর্ণিমার দিকে কৌতূহলী চোখে তাকালো লাকি।
পূর্ণিমাকে ঈষৎ লজ্জিত দেখালো। গভীর শ্বাস নিয়ে সে বলল, ‘সব অভিনেতারাই ইনসিকিওর। তারা বুড়ো হয়ে যাবার ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। ক্যামেরা আর আলো প্রতিটা রিংকেলকেও তুলে ধরে। ওটাই, একদিন ভিষ্মিকা আমাকে বলেছিল। তার শেষ মুভিটা… অন্যগুলোর মতো ঠিক চলেনি… যদিও ছবিটা হিট ছিল, তবে ততটাও না।’
ভিষ্মিকা কি মনে করছিল তাঁর অভিনেত্রী ক্যারিয়ারের পতন শুরু হয়ে গেল, লাকি ভাবল।
‘রিসেন্টলি এই নতুন ডিভাইসটা ভিষ্মিকা কিনেছিল। এটা একটা আন্ডার প্রেসার অক্সিজেন চেম্বার।’ সমর্থনের জন্য অনন্তিকার দিকে তাকিয়ে বলল পূর্ণিমা।
‘দেখুন, পলিউশনের জন্য বাতাসে অক্সিজেন-এর পরিমান একুশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে সতেরো শতাংশ… আমাদের শরীরের কোষগুলি আর পর্যাপ্ত অক্সিজেন পাচ্ছে না। মাসিমনি এভরি অল্টারনেটিভ ডে-তে এই চেম্বারে অক্সিজেন-এর জন্য বিশেষ সিটিং নিতেন।’
‘হাইপারবেরিক অক্সিজেন চেম্বার…’ লাকির মনে পড়ল যে মাইকেল জ্যাকসনও এমন এক থেরাপি নিতেন।
অনন্তিকা তখনো কথা শেষ করেননি। ‘আমার মাসিমনি বলতেন, বুড়িয়ে যাওয়াটা আসলে জৈবিক প্রক্রিয়া। এটাকে অবশ্যই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে দেখা উচিত। আর তারপর কন্ট্রোল মেকানিজম আমাদের আনুকূল্যে ব্যবহার করা উচিত। তিনি কেবলই অর্গানিক আর ভেজিটেরিয়ান ফুড খেতেন। এমন কি তার জলটুকুও ছিল স্পেশালি ইম্পোর্টেড। তুষার গলা জল।’ অনন্তিকার স্বরে আত্মতুষ্টি ঝরে পড়ছিল।
লাকি শ্বাস ছাড়ল। তার ভঙ্গিমা থেকে স্পষ্ট যে অনন্তিকার কথা শুনতে তাঁর বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছিল।
অনন্তিকা বলে চলল। ‘আপনি জানেন কি সিনড্রোম এক্স বলে এক কন্ডিশন আছে যেখানে রুগীদের বয়স বাড়ে না। বিজ্ঞানীরা মেয়েদের উপরে নিরীক্ষা চালিয়ে দেখেছে… তাদের একজনের নাম বেটি। আমার মনে আছে নামটা কারণ আমি আর্চির কমিক্স-এ পড়েছি। …বেটি আর ভেরোনিকা… যাই হোক আমার মাসিমনি বলতেন, বুড়িয়ে যাওয়াকে রুখে দেওয়ার উপায়টা লুকিয়ে আছে।’
লাকি কে একথা মানতে হল যে, সে এমন অবস্থার কথা এর আগে শোনেনি। ব্যাপারটা তার খুব একটা ভালো লাগছে না। সিনড্রোম এক্স, গ্লোবালি ‘এক্স’ আসলে অজানা প্রতীক হিসেবে পরিচিত। সিনড্রোম এক্স একটা ইন্টারনেট ঘটিত তঞ্চকতা নয় কি? সে ঠিক করল পরে ব্যাপারটা নিয়ে পড়াশুনো করতে হবে।
ভিষ্মিকার ডেস্কে রাখা ফ্রেমে বাঁধাই একটা ফটোতে চোখ আটকে গেল লাকির। ছবিটাতে ভিষ্মিকাকে প্রথম ফেয়ারলী ফিল্মি অ্যাওয়ার্ড নিতে দেখা যাচ্ছে। এরপরে পনেরোখানা পুরস্কার সে গ্রহণ করেছে। ছবিটিকে গভীরভাবে দেখলে তাঁর অসাধারণ জীবনযাপনের কিছুই আঁচ পাওয়া যায় না। সামান্যতম কাদার ছিটে গায়ে না লাগিয়ে, সফলতার শীর্ষে বিরাজমান থাকা লাকির কাছে অভাবনীয় মিরাকেল বলেই মনে হচ্ছিল। এই পেশায় শুধু সাদা টাকা উপার্জন, সত্যিই অবিশ্বাস্য!
এটা কি আদৌ সত্যি?
পূর্ণিমা এখনও তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।
ভিষ্মিকার স্যুটে তার একা থাকবার অনুমতি নেই। লাকি এসিটা চালিয়ে দিল। সতেরো ডিগ্রি সেট করা, ওটাই লোয়েস্ট। পূর্ণিমা তার হাত থেকে রিমোটটা নিয়ে চব্বিশ ডিগ্রিতে স্টে করলো। কম্ফোর্টেবল।
‘শেষের দিকে ভিষ্মিকার সারাক্ষণ গরম বোধ হতো… ঘেমে নেয়ে সে সবসময় লালচে হয়ে থাকতো।’
প্রায় চল্লিশ ছুঁইছুঁই বয়সে এত উষ্ণতা মোটেই খুব ভালো খবর নয়। চিন্তাটা ব্যাঙ্গাত্মকভাবে লাকির মনের মধ্যে ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল।
টেবিলের পাশে একটা বড় বাস্কেটের মতো জিনিস। দারুন নকশা করা সেটা। শোকজ্ঞাপন ইত্যাদি যাবতীয় চিঠি ওটার মধ্যে জমানো। অনন্তিকা আর পূর্ণিমা মোটেই মন থেকে সায় দেয় নি এটাকে স্থানান্তরিত করার ব্যাপারে। শোকাভিভূত ফ্যানদের পাঠানো ফুলের বুকের গন্ধ এখনও বাতাসে ছড়িয়ে রয়েছে। পূর্ণিমা হাতে একগুচ্ছ চিঠি তুলে নিয়ে বলল, ’আপনি ওনার ঘরের চারপাশটা দেখতেই পারেন। আমি জাস্ট তার টুকিটাকি চিঠি চাপাটিগুলো ঝাড়াই বাছাই করি।’
বাস্কেটের সবার উপরে রাখা একটা চিঠিতে তার চোখ আটকে গেল। চিঠিটার লেটার হেডটা অদ্ভুত ধরণের। তাতে দুটো সিংহ একটা ঝরনাকে পাহারা দিচ্ছে। সোনালী অক্ষরে নিচে লেখা ‘অ্যাগারিসিয়া’।
চিঠিটা হাতে নিয়ে পূর্ণিমা বলে উঠল, ‘ওহো! এটা তো ডাঃ দেশমুখকে দিতে হবে।’
লাকি বলল, ‘ওটা দেখি একটু।’
সিলভার পেপার কাটারটা তুলে নিয়ে সে অতি যত্ন করে এনভেলপটি খুলল। একটা শক্ত কার্ড ভেতর থেকে বেরিয়ে এল। এটা ছিল একটা প্রবীণ অবসরপ্রাপ্ত অভিনেতাদের কল্যানের জন্য একটা চ্যারিটি ইনভিটেশন। লাকি পূর্বেই শুনেছে ফিল্ম জগতের মানুষেরা অতীত দিনের সিনেমা অ্যাক্টরদের কঠিন সময়ে পাশে দাঁড়াবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ‘অ্যাগারেসিয়া’ হল একটি এনজিও যারা এই ফিল্ডে কাজ করে গেল। কার্ডটা এনভেলপে ঢুকিয়ে পূর্নিমাকে ফেরৎ দেয় লাকি।
অন্যদিকে, সাম্প্রতিকতম ফটোফ্রেমে ভিষ্মিকা তার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। এই ছবিটা অ্যান্টার্কটিকায় তোলা। তিনি ইন্ডিয়ায় ফেরার পূর্বে রাশিয়া থেকে সেখানে পৌঁছান। দুটোই দারুন ঠান্ডার জায়গা। কিন্তু যিনি বেডরুমের এসিতে সতেরো ডিগ্রি ব্যাবহার করতেন, তিনি হয়তো ওই জায়গাগুলোতে কম্ফর্টেবল ছিলেন।
এরপর ওই ঘরটার বাকি অংশে তদন্ত করতে মনোনিবেশ করলেন লাকি। তবুও অ্যাগারেসিয়ার লোগোটা সম্পর্কে কি একটা ব্যাপার তার মনে তখনও খচখচ করছে। তারপর ফটোটাতেও একটা ব্যাপার তার অদ্ভুত লাগলো। সবাই কিছু না কিছু গরম কাপড়চোপর ব্যাবহার করেছেন। কেবলমাত্র ভিষ্মিকাই নন। কিসের গুমোর… ভয়ংকর ঠান্ডার মধ্যেও ভিষ্মিকার গায়ে কোন গরম পোশাকের লেশমাত্র নেই।
পরে যখন তিনি গোটা বিষয়টা জানতে পারবেন, লাকিকে ভিষ্মিকার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হতে হবে।
***
লাকি যেমনটা অনুমান করেছিল, প্রৌঢ় মি. দিনশ্ এক্কেবারেই ঠিক তাই। ভিষ্মিকার প্রশংসা ছাড়া তার মুখে অন্য কোনও কথা নেই। যাইহোক, বছরখানেক ধরে তিনি ভিষ্মিকাকে বেশকিছু পরামর্শ দিয়েছিলেন, আর ভিষ্মিকাও তার সাজেশনগুলো চূড়ান্তভাবে ইগনোর করেছিল। বেশ কয়েকবার ভিষ্মিকা তাকে এড়িয়েও চলেছে। লাকিকে দ্রুত আশ্বস্ত করতে মি. দিনশ্ বলেন, ‘না,না, তেমন বড় সড় কিছু নয়। জাস্ট বিদেশে কিছু ইনভেস্টমেন্টের ব্যাপার।’
তিনি বললেন যে তিনি ইতিমধ্যেই পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন আর লাকির কানে পুলিশের কাছে বলা কথাগুলি উগরে দিলেন। তার সমস্ত কাগজপত্রই যথাযথ ছিল। বেন এন্ড ম্যাকেইন বেশ বিখ্যাত ফার্ম।
***
মি. পুরষোত্তম দাস মাঝবয়সী একজন গোলগাল, তীক্ষ্ণ চোখের, নরম ও মনভোলানো কথার মানুষ। তার চোখের দিকে তাকাতেই লাকির গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠছে। এটা একটা অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া। তার কাছ থেকে পূর্ণিমা, অনন্তিকা থাকা সত্ত্বেও লাকি কোনও কথাই বার করতে পারলেন না। লাকির মনে হল ব্যাপারটা ইন্টাররেস্টিং, বেশ অস্বাভাবিকও। যদি ভিষ্মিকার কিছু গোপন করার নাই-ই থাকে তাহলে পুরুষোত্তমবাবু কেন একেবারেই মুখ খুলতে চাইছেন না।
***
এরপরে লাকি ঠিক করলো ডঃ দেশমুখের সঙ্গে তার চেম্বারে মিট করবে। অনন্তনাগকে ফোন করে অ্যাপয়েনমেন্ট ফিক্সড করল অনন্তিকা। প্রখ্যাত ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার আগে লাকি ‘স্পনটেনিয়াস হিউম্যান কম্বাশচন’ সম্পর্কে যা যা জানতো, আর একবার ঝালিয়ে নিল। হাতে অনেকটা সময় থাকায় ডঃ দেশমুখের ক্রেডেনশিয়াল সম্পর্কেও ভালোভাবে জেনে নিল।
কলকাতার গোয়েন্দারা অতি সম্প্রতি উন্মোচিত করেছে ভন্ড চিকিৎসকদের প্রতারণা চক্র। লাকির মনের গভীরে ডঃ দেশমুখ সম্পর্কে ঈষৎ সন্দেহের অবকাশ রয়ে গেছে। যাইহোক, ইন্টারনেটের একটা ভাসা ভাসা নিরীক্ষায় তার ভয় প্রশমিত হল। বিশ্বের চিকিৎসা জগতে তিনি হলেন সেরার সেরা। তিনি কসমেটিক সার্জারি ও এজেইং রিডাকশান থেরাপি ক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ ছিলেন।
হঠাৎই লাকির মাথায় বিদ্যুতের চমক খেলে গেল, সে যেন ধরতে পেরেছে অ্যাগারেসিয়ার লোগোর পিছনে থাকা অর্থটুকু। একটা ঝর্ণার দুইপাশে প্রহরারত দুই সিংহ। ঝর্ণাটি হল যৌবনের কিংবদন্তি ঝর্ণা। এটা আরব্য রজনীর একটি গল্প।
অলস ভঙ্গিমাতে সে নামটা নিয়ে ভাবছিল। ’অ্যাগারেসিয়া’ গুগলে তার অর্থ পাওয়া গেল ‘বুড়িয়ে না যাওয়ার গুণাবলী।’ গুগল তাকে আরো জানালো এই নামে একটি ক্লিনিকের কথা যেখানে বয়সবৃদ্ধি সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে চর্চা করা হত। লাকি এরকম কিছু কেসের কথা পড়েছে। সে আপ্লুত হল এমন দুটো মেয়ের কথা জেনে যারা বিজ্ঞানীদের হতবাক করে দিয়েছিল বুড়িয়ে যাওয়াকে থামিয়ে দিয়ে। ব্রুক মেগ্যান গ্রিনবারগ হলেন এমনই একজন যার মৃত্যু হয়েছে অতি সম্প্রতি। দ্বিতীয় জন হলেন গ্যাবি উলিয়ামস। এদের দুজনেই জিনগত বিকৃতির শিকার ছিল।
যাইহোক, ভিষ্মিকা ছিলেন একদম পারফেক্ট। তার বাগানে সিংহ আর ঝর্ণা দুইই ছিল। সিংহগুলি ট্রাডিশনালি রহস্যময় যৌবন ঝর্ণার প্রহরায় থাকে। অভিভাবকের মতোই।
ঝর্ণাস্বরূপ যুবতী ভিষ্মিকার অবিভাবক কে ছিল?
ডঃ দেশমুখের জন্য তাকে সামান্য সময়ই অপেক্ষা করতে হল। অনন্তনাগ তাকে ডেকে বসাল। তিনি তাকে একটা অ্যালবাম ধরিয়ে দিলেন যাতে ডঃ দেশমুখের বিশ্বজোড়া খ্যাতিময় উপস্থিতির ক্লিপিং রয়েছে এবং একইসঙ্গে আশস্ত করলেন ডাঃ দেশমুখ শীঘ্রই সেখানে উপস্থিত হবেন। লেবেলে দেখা গেল অ্যালবামটি গত বছরের। অলস ভঙ্গিতে পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে হঠাৎই একটা ছবিতে লাকির চোখ আটকে গেল। ছবিটিতে দেশমুখ একটি হাসপাতালের উদ্বোধন করছেন। তার মনে পড়ে গেল আইকনিক ইমপ্রেশনের লোকদুটির বলা কথাটি।
… স্পট বয়দের একজন বলেছিল লোকটির ছবি একবার সে একটি নিউসপেপারে দেখেছিল। লোকটি সেখানে হাসপাতাল উদ্বোধন করছিল… হতে পারে লোকটি ডাক্তার কিংবা রাজনীতিবিদ… বিখ্যাত কেউ তো নিশ্চয়ই।
তাহলে রাশিয়াতে ভিষ্মিকার সঙ্গে ওই ব্যক্তি কি ডঃ দেশমুখ ?
যাইহোক লাকি এ বিষয়ে বেশি ভেবে সময় নষ্ট করলো না। প্রাথমিক সৌজন্য বিনিময়ের পরে ডাক্তার ও ডিটেক্টিভের মধ্যে আলাপচারিতা জমে উঠলো।
লাকি এই বলে শুরু করলো, ‘আচ্ছা, আপনি তাহলে এদের পারিবারিক ডাক্তার? ’
‘না না ঠিক তা নয়, সেই অর্থে আমি ফ্যামিলি ডক্টর নই।’
লাকি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘আমাকে বলা হয়েছিল আপনি ভিষ্মিকার মায়েরও চিকিৎসা করতেন।’
ডাঃ দেশমুখ হাসলেন, ‘হুম। কসমেটিক সার্জারির চিকিৎসা যাতে, তাকে তার বয়সের তুলনায় কমবয়সী দেখায়।’
তিনি লাকিকে গ্রীন টি অফার করলেন ও হালকা স্বরে মন্তব্য করলেন, ‘চলচ্চিত্র জগৎ সৌন্দর্যকে ঘিরে আবর্তিত হয়। এখানেই আমার অধিকাংশ রুজি রোজগার। তিনি এখানে বি ভেনম ফেসিয়াল বা ডিটক্স করতে আসতেন।’
লাকি কোনরকমে মুখে হাসি রেখে, গ্রীন টিতে চুমুক দিলেন। একেবারেই ফালতু জিনিস। একইসঙ্গে তার মনে পড়ল গ্রীন টি তে বয়স প্রতিরোধী গুণাবলী আছে। আস্তে আস্তে তিনি ডাক্তারের সঙ্গে আলাপচারিতায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এবং ডাক্তারও বিষয়ের গভীরে ঢুকে পড়ছিলেন। লাকির মনে হচ্ছিল তিনি সন্দেহের উর্দ্ধে। তিনি একান্তভাবে যৌবনের স্থায়িত্ববৃদ্ধির প্রক্রিয়াগুলির পক্ষে বিপক্ষে মতপ্রকাশ করছিলেন।
‘বুড়িয়ে যাওয়া হল আমাদের দেহকোষের ধীর ক্রমিক ক্ষয়। এই কোষীয় ক্ষয় কুঞ্চিত ত্বক, ভঙ্গুর হাড়, তরুণাস্থি, ধূসর চুল, ক্ষীণদৃষ্টি এবং বিস্মৃতির মাধ্যমে প্রকাশ পায়। এটা শরীরের ক্ষয়কে নির্দেশ করে।’ লাকি একজন সহকারীর মতো তার মুখের কথা ধরে নিয়ে বলল, ‘বয়সের সঙ্গে সঙ্গে শরীরে ডি এন এ-এর ক্ষয় পূরণ করার ক্ষমতা কমে যায়।’
‘হ্যাঁ, বর্তমানে আমরা বয়সবৃদ্ধির গতিকে ধীর করে দিতে পারি।’ দেশমুখ বললেন ‘এমনকি আমরা নতুন জিন নির্মাণ বা পুরানো জিনের ক্ষয় পূরণ করতে পারি। এটা উদ্দীপকের ন্যায় কাজ করে।’
‘কিছুই কি ভুল হতে পারে না? জিনের সঙ্গে ছেলেখেলা করা ভয়ঙ্কর হতে পারে তো!’
‘খুবই কম, এই প্রক্রিয়াগুলি আগে বিদেশে ত্রুটিহীনভাবে পরীক্ষা করা হয়… একমাত্র তবেই আমরা ভারতে তা প্রয়োগ করি… আর তুমি কি জান বয়স প্রতিরোধী প্রক্রিয়াগুলির ব্যাপারে আমরা অনেকটাই পিছিয়ে। এইগুলি এতই ব্যয়বহুল হয় যে খুব সংখ্যক লোকেই তা বহন করতে সক্ষম হয়… তাই আমারা শুধুই বোটক্স জবস ও সিরাম প্রয়োগেই আটকে থাকি।’
কথাগুলো বলার সঙ্গে সঙ্গে ডঃ দেশমুখের মনের মধ্যে মিনিসার ছবিটা ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল।
লাকি জোর দিয়ে বলল, ’হ্যাঁ, কিন্তু ধরা যাক কিছু গন্ডগোল হল… আমি বলতে চাইছি কাস্টমারের মনঃপুত হল না… যেমন আপনার করা রাইনোপ্লাস্টিক বা জিন ইঞ্জেকশন প্রত্যাশামত কাজ করল না তবে তো আপনার বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে…’
‘না, এ ব্যাপারে আইনি কাগজপত্র সংরক্ষণ করা হয় ডাক্তারকে নিরাপদ রাখতে। আপনি ঠিকই বলেছেন, জিনের চিকিৎসা যে কোন মানুষের ব্যাক্তিগত জেনোটাইপের জন্য প্রভাবিত হতে পারে। তাই আমি কোন আশ্বাসিত অবয়বের ক্যাটালগ দেখতে পারি না, যার সঙ্গে ‘চিকিৎসা পরবর্তী’ অবয়ব মিলিয়ে দেখা যায়।’ ডাঃ দেশমুখ তার কাঁধটা একবার ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘জিন পরিবর্তন সর্বদাই ঝুঁকিপূর্ন হয়।’
‘ভিষ্মিকা কি কোনও উদ্দীপনামূলক… বিশেষতঃ বয়ঃবৃদ্ধি প্রতিরোধী কিছু করিয়েছিলেন?’
ডাঃ দেশমুখ চোখ পিট্ পিট্ করে বললেন, ‘বয়সপ্রতিরোধী… উদ্দীপনামূলক… কেন জিজ্ঞাসা করছেন বলুন তো? ’
প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন করা, সরাসরি উত্তর না দেওয়া, থেমে যাওয়া– এই সবই– সময় নেওয়া ও কথা সাজিয়ে নেওয়ার বহু পুরানো কৌশল– লাকি তা ভালোভাবেই বুঝতে পারলেন। তিনি উপলব্ধি করলেন এতক্ষণে তিনি ডক্টরের একটা স্পর্শকাতর জায়গা খুঁজে পেয়েছেন।
আত্মবিশ্বাসে লাকি প্রায় দ্বিগুণ জোরের সঙ্গে বললেন, ‘কারণ আছে।’
‘পেশেন্ট-ডাক্তারের কন্ফিডেন্টশিয়ালিটি নিয়ে আমি আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারি না… যদি না পুলিশ আমায় বাধ্য করে ঐ ধরণের প্রশ্ন-এর উত্তর দিতে… কিন্তু কেনই বা আপনি আমায় এই বিষয়ে প্রশ্ন করছেন? ভিষ্মিকার মৃত্যুর সঙ্গে কসমেটিক প্রসিডিউর-এর কোনও যোগসূত্র রয়েছে নাকি?’
লাকি লক্ষ্য করল ডাক্তার দেশমুখ এই বিষয়ে মুখ না খুলতে চাইলেও আংশিক স্বীকারোক্তি করেও ফেললেন।
‘যতদূর আমার জানা, পুলিশ আপনাকে এখনও কন্ট্যাক্ট করেনি। যদি তারা করেও… তা হলে… যখন তারা যোগাযোগ করবে…’
লাকি তার কথায় ‘যখন’ শব্দটিতে জোর দিয়ে বোঝাতে চাইলো, যেন ব্যাপারটায় শুধু সময়ের অপেক্ষা। ‘…তারা নিশ্চিতভাবেই এই প্রশ্নটাই জিজ্ঞাসা করবে। ভিষ্মিকা মৃত। তার মৃত্যু হয়েছে অত্যন্ত রহস্যজনকভাবে। আমার মনে হয়, কেউ যদি এই বিষয়ে সামান্যতম সূত্রও জানতে পারে, তার তৎক্ষণাৎ স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসা উচিত রহস্য উন্মোচন করতে। যাইহোক, আপনি ঠিকই বলেছেন, আমি পেশেন্ট -ডাক্তারের কনফিডেনশিয়ালিটি নিয় প্রশ্ন তুলতে পারি না। অপেক্ষায় থাকুন, পুলিশ কমিশনারের একটা ফোন আসতে পারে। চলি। ধন্যবাদ, এতটা সময় দেবার জন্য।’
লাকি উঠে পড়ার ভান করল।
ডাঃ দেশমুখ সামান্য ঝুঁকে তাকে উঠতে বাধা দিলেন।
‘দাঁড়ান, দাঁড়ান। এত তাড়ার কি আছে। ভিষ্মিকার সঙ্গে আমার এগ্রিমেন্টটা আপনাকে দেখাতে পারি।’
তিনি ঘরটা ছেড়ে তার অ্যান্টি চেম্বারে প্রবেশ করলেন। লাকি বুঝতে পারল ডাঃ দেশমুখ দ্রুত একটা ফোন করে নিচ্ছেন, যদিও তিনি শুনতে পারলেন না কি কথা হল। যখন ডাক্তার ফিরলেন, মুখে অনাবিল হাসি। ‘আপনি আমায় বলেননি কেন যে আপনি মিঃ প্যাটেলের ওখানে কাজ করছেন? -এই নিন ভিষ্মিকার সই করা আইনি কাগজগুলোর একটা।’
লাকি বুঝলো, ডাঃ দেশমুখ ফোনটা ‘সেন, পন্ডিত এন্ড হোয়াইট’-এই করছিলেন। সে বলল, ’আমি কাজ করেছি মিঃ প্যাটেল-এর হয়ে একবার। তাও অনেক আগে। আমি জানতাম না যে, উনি আপনার চেনা। আমি এই ডকুমেন্টটা রাখতে পারি… আমার তো মনে হচ্ছে এটার সঙ্গে অক্সিজেন চেম্বার-এর কোথাও যোগসূত্র আছে… আমাকে একটা কথা বলুন ডক্টর, অফ দ্য রেকর্ড… এই থেরাপিগুলি সত্যিই কি কার্যকর?’
‘কিছু কাজ করে, কিছু করে না। আপনাকে বললাম না, রোগীর জেনোটাইপের উপর নির্ভর করে… আমি বিচার করতে চাই না। আমি চিকিৎসক হিসাবে জাস্ট পদ্ধতিটা যথাযথ নির্বাহ হচ্ছে কিনা তার তত্ত্বাবধান করি। এটা কাস্টমারের জন্যই, আগেভাগে দেখে নেওয়া।’
‘ভিষ্মিকাকে কোন কোন প্রসিডিওরের মধ্যে দিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন?’
‘হমম্ …দেখুন। বি ভেনম ফেসিয়ালস, ভ্যাম্পায়ার ফেসিয়ালস, প্ল্যাসেন্টাল ফেসিয়ালস, হাইপারবারিক অক্সিজেন চেম্বার, আর হ্যাঁ মাইক্রোবিয়াল থেরাপি।’
লাকি জানত যে মাইক্রোবস থেকে টক্সিন ইনজেক্ট করাটা নিতান্ত সাধারণ একটা কসমেটিক প্রসিডিওর।
‘আর বোটক্স?’চোখ সরু করে লাকি জানতে চাইলে, ডা. দেশমুখ সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বললেন ‘হ্যাঁ।’
‘আর ‘মেল্টিং স্নো’-এর ব্যাপারটা কি? যা ভিষ্মিকা ইদানিং পান করছিলেন।’
ডাক্তার দেশমুখ তার চোখেমুখে প্রকাশিত আতঙ্ককে চেপে রাখতে পারলো না।
‘ওটা, ওটা… কোনও পদ্ধতি নয়। উনি স্বাস্থ্যকর খাওয়া দাওয়ার মধ্যেই ছিলেন… উনি কোনওদিনও মদ্যপান পর্যন্ত করেন নি…’ দেশমুখ আমতা আমতা করে বললেন।
লাকি তাকে ভেঙে ফেলতে চাইছিল। এই ডাক্তার এর মধ্যে কিছু একটা তো রয়েইছে যা বড়ই অদ্ভুত… ডাক্তার যা স্বীকার করেছেন তার চাইতেও বেশি কিছু তার ঝুলিতে রয়েছে। যদিও সব তথ্য বলছে ভিষ্মিকার মৃত্যুর পূর্বে ডাক্তার-এর সঙ্গে তার দীর্ঘ কয়েক মাস দেখাই হয়নি। এমনকি পূর্ণিমা -অনন্তিকারও এই ব্যাপারে সাক্ষী… যদি না… যদি না ব্যাপারটা ভীষণ গোপনীয় রাখার গভীর প্রয়াস করা হয়।
সামান্য ঠাট্টাচ্ছলে সে ডাক্তারকে বাধা দিয়ে বলল, ‘ আপনি বলছেন, উনি কখনও পান করেননি… স্নো মেল্ট ছাড়া… আর সেটাও আবার বিদেশ থেকে আনা। অ্যাকোয়া অ্যান্টিকা, আমি লেবেলটা পড়েছি…তার ফ্রিজে অনেক বোতল ছিল। অ্যান্টিক ওয়াটার… হুম… এটাই তো ঐ শব্দটির অর্থ, তাই না ? ’
ডাক্তার দেশমুখ দ্রুত নিজেকে সামলে নিলেন। ‘হ্যাঁ… ওল্ড ওয়াটার, ওই জল সাইবেরিয়ার ভূ গর্ভস্থ চির হিমায়িত বরফ গলিয়ে প্রস্তুত। এটা বাস্তবিকই অতি প্রাচীন জল… বিশুদ্ধ-এর মধ্যে বিশুদ্ধতম। ‘
লাকি তার চেয়ারে গিয়ে বসলো। ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং। অনেকদিন আগে কোথাও এক জায়গায় সে পড়েছিল যে একজন ফেমাস হিন্দি মুভির অভিনেতা একবার ‘ইভিয়ান মিনারেল ওয়াটার’-এ স্নান করেছিলেন। ক্রিশ্চিনা ওনাসিসও প্রতিদিন কোকাকোলার অবগাহন করতেন, যাতে এর বুদবুদ তাকে সর্বাপেক্ষা উৎফুল্ল থাকতে সহায়তা করে… কিন্তু গলিত ভূগর্ভস্থ চিরহিমায়িত জল। নিশ্চিতভাবেই ব্যাপারটা অভাবনীয়। যদিও ব্যাপারটার মধ্যে কিছু যুক্তিও রয়েছে… পার্মাফ্রস্ট হল বরফ… প্রাকঐতিহাসিক যুগের জমা জলই হল এই পার্মাফ্রস্ট। যদি আদিম বলে কিছু হয় তবে তা হল পার্মাফ্রস্ট মেল্ট। তবুও অনর্থক অপচয়কারী সেলিব্রিটিরা এভাবে পয়সা উড়িয়ে থাকে।
ইতিমধ্যেই ডা. দেশমুখ সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে ব্যাপারটাকে ঘোরানোর চেষ্টা করেছিলেন।
‘আপনি সাইবেরিয়ার আবিষ্কৃত পশমি ম্যামথ ইউকার কথা শুনছেন?’
লাকি খানিকটা বিভ্রান্ত স্বরে বললো, ‘হ্যাঁ।’ ভিষ্মিকার কসমেটিক প্রসিডিউর-এর সঙ্গে একটা পশমী ম্যামথ এর সরাসরি কোন যোগসূত্র সে খুঁজে পাচ্ছিল না… শুধুমাত্র উভয়ের সঙ্গেই পার্মাফ্রস্ট-এর যোগ ছাড়া। তার মনে পড়ে গেল সেই উন্মাদনার কথা যখন চল্লিশ হাজার বছরের পুরানো প্রাগৈতিহাসিক হাতির পূর্বসূরী আবিষ্কৃত হয়েছিল অবিকৃত মস্তিষ্ক সহ যার কারণ ছিল পার্মাফ্রস্ট। সহস্রব্দ ধরে মস্তিষ্ক আবিষ্কৃত থাকার রহস্য ছিল এই পার্মাফ্রস্ট।
‘ওয়েল, সাইবেরিয়ার বৃহত্তম অঞ্চল শাখা ‘রিপাবলিক’, যার আরেক নাম ইয়াকুটিয়া। সেখানে অবস্থিত ম্যামথ মাউন্টেন নামক জায়গায় ‘ইউকা’ আবিষ্কৃত হয়েছিল। ‘
‘তারপর?’
‘ওয়েল, যখন বিজ্ঞানীরা বরফের মধ্যে সংরক্ষিত মমিকৃত দেহাবশেষ তুলে এনেছিল, তখন তারা সেই গলিত জলও পরীক্ষা করেছিল… যা বরফের আশেপাশে পাওয়া গেছিল।’ এই বলে ডঃ দেশমুখ নাটকীয়ভাবে থেমে বললেন, ‘জানেন তারা কি পেয়েছিলেন? ’
জাগতিক অস্তিত্বকে অস্বীকার করে লাকি আত্মমগ্ন হয়ে ভাবছিল… উললি ম্যামথ, সুন্দরী অভিনেত্রী, স্পনটেনিয়াস কম্বাশন… ব্যাপারগুলো সব সাইবেরিয়ার দিকে ইঙ্গিত করছে না… ভিষ্মিকা শুটিং-এর জন্য সাইবেরিয়া গেছিল… তা কি শুধুমাত্র কিছু আড়াল করতে?
মস্তিষ্কে একটা তুমুল আলোড়ন চলা সত্ত্বেও সে মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করল, ’কি পেয়েছিল তারা?’
‘বিজ্ঞানীরা ব্যাক্টেরিয়ার একধরণের অদ্ভুত প্রজাতি পেয়েছিল। তারা এর নামকরণ করেছিল ব্যাসিলাস এফ। ২০১৫ সালে যে দলটি এদের DNA সংকেতের পাঠোদ্ধার করেছিল, তারা উল্লেখ করেছিল যে প্রকৃতির অন্যান্য কোষের মতো, ব্যাসিলাস এফ-এর বুড়িয়ে যাওয়ার কোন চিহ্ন ছিল না।’ এইটুকু বলে ডাঃ দেশমুখ বসে পড়ে আঙ্গুলগুলো এমনভাবে নাড়তে লাগলেন যাতে বোঝা গেল তিনি খুবই তৃপ্ত হয়েছেন এইগুলো বলে।
সাধারণত লাকি কখনোই খুব রূঢ় আচরণ করে না, কিন্তু এখন তার মুখ থেকে কথাটা বেরিয়েই গেল।
‘তাহলে, পার্মাফ্রস্ট মেল্ট যা আসলে ব্যাক্টেরিয়ার নির্যাস সেটা পান করাই হল মানুষের আয়ুকে প্রলম্বিত করার চাবিকাঠি। এটা কি ধরণের সিদ্ধান্ত? কিন্তু ব্যাক্টেরিয়ার কোনও বয়স হয় না… তাদের কখনো মৃত্যু হয় না। তারা শুধুমাত্র বিভাজিত হয়ে তাদের প্রতিরূপ তৈরি করে। ব্যাক্টেরিয়ারা শুধুমাত্র চিরসজীব নয়… তারা অমরও হয়ে থাকে… এবং আপনি একজন ডাক্তার হিসাবে এটাকে উপেক্ষা করে… মানুষকে ব্যাক্টেরিয়ার নির্যাস পান করায় উৎসাহ দিতেন? আপনি এটা কিভাবে করতে পারেন?’
‘এটা আমি বলছি না… এইটা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় প্রমানিত হয়েছে। আপনি এসম্পর্কে ডাঃ ব্রুসকোভির লেখা পেপারটি পড়ে পারেন। তিনি মস্কোর কোমার্দ ইউনিভার্সটির জিওক্রায়োলজির বিভাগীয় প্রধান। আমি আপনাকে রিপ্রিন্ট কপিগুলো দিতে পারি। তিনি বলেছেন, ওই অঞ্চলের সুদূর উত্তরে বসবাসকারী মানুষেরা পার্মাফ্রস্ট গলে গেলে সেই জলে যখন ওই অণুজীবগুলো চলে আসে, তখন সেই জল তারা পান করে। প্রকৃতপক্ষে এই ব্যাপারটি তখনই নজরে আসে যখন ওখানকার মানুষদের প্রত্যাশিত আয়ুষ্কালের উল্লেখ্য পরিবর্তন আসে। ডাঃ ব্রুসকোভির টিম এই ঘটনাটির সঙ্গে ব্যাক্টেরিয়ার মাত্রা বৃদ্ধির যোগসূত্র আছে বলে মনে করেন, কারণ বিশ্ব ঊষ্ণায়নের ফলে পার্মাফ্রস্ট গলনের পরিমান দিন দিন বেড়ে চলেছে।’
হঠাৎ লাকির মাথায় বিদ্যুৎ চমক খেলে গেল। সে বলে উঠলো, ‘অ্যাগেরেসিয়া। এটা কি সেই আন্টিএজিং ক্লিনিক।’
তখন ডাঃ দেশমুখের মুখটা দেখার মতো হল… তৎপরতার সঙ্গে উত্তর দিতে গিয়ে আতঙ্ক, বিস্ময়, খুশির ঝলক খেলে গেল সেই মুখে।
‘ওহ, হ্যাঁ… তার মানে এটা আপনি জানেন। যদিও মি.প্যাটেল বলছিলেন আপনি খুব ভালো গোয়েন্দা। আপনার কাছ থেকে কিছু লুকাবার চেষ্টা বৃথা। আপনি কিভাবে অ্যাগেরেসিয়া সম্পর্কে জানলেন?’
অ্যাগেরেসিয়া সম্পর্কে সামান্য যেটুকু তথ্য তার জানা রয়েছে সে সম্পর্কে উচ্চবাচ্য না করে লাকি বলল, ’কিছু মনে করবেন না।’
সে এটা ভেবে মনেমনে খুশি হচ্ছিল যে সে সঠিক অনুমানই করেছিল, ডাক্তারটি কারুর কাছে খোঁজ খবর নিয়েছে…অদ্ভুতভাবে তিনিই হলেন মি.প্যাটেল। তারপরেই ভাবল কেনই বা হবে না ? প্যাটেলের ফার্মটাই বোধ হয় এব্যাপারে অ্যাগেরেসিয়া বা ডাঃ দেশমুখের সঙ্গে ভিষ্মিকাকে আইনি চুক্তির করতে বাধ্য করেছিলেন। তিনি ডাক্তারের দিকে ঘুরে তাকালেন।
‘আমার মনে হচ্ছে এই পদ্ধতিতে গলিত পার্মাফ্রস্ট পানের থেকেও বেশি কোনও ব্যাপার জড়িত আছে।’
ডাঃ দেশমুখ সামান্য উসখুস করে উঠলেন, কয়েক মুহূর্ত তার নখগুলিকে একঝলক দেখে নিলেন। তারপর তিনি সোজা হয়ে বসে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, ‘না। ভিষ্মিকা ডাঃ ব্রুসকোভির তত্ত্বাবধায়নে ওই ব্যাক্টেরিয়া প্রজাতিটির থেকে তৈরি ইঞ্জেকশনও নিত। আমার কাছে রাশিয়ান ক্লিনিকের সঙ্গে তাঁর চুক্তির একটি কপিও আছে। আমি সেখান ছিলাম। কিন্তু আমি পদ্ধতিটি কখনো প্রয়োগ করে দেখিনি।’
‘ওহ, তাহলে আপনি অ্যাগেরেসিয়ার হয়ে দালালি করেন। কতদিন ধরে এসব চলছে?’
‘ভারতবর্ষে ভিষ্মিকার ঘটনাটি প্রথম, কিন্তু অ্যাগেরেসিয়ার ক্ষেত্রে তা নয়। আমি এতটুকুই জানি। আর আপনার জিজ্ঞাসাবাদের আগেই কোনওভাবেই তার মৃত্যুর সঙ্গে এই পদ্ধতিটির সম্পর্ক জানা ছিল না… চিকিৎসার এই পর্যায়টা ঘটেছিল আট মাস আগে। সাধারণত অধিকতর তাপ অনুভব করা ছাড়া তিনি কখনোই এর কোনও সাইড এফেক্ট-এর কথা ডা. ব্রুসকোভিকে রিপোর্ট করেননি। প্রায়শই জিনের অতিসক্রিয়তা এমনসব ক্ষ্যাপা বিপাকীয় ক্রিয়া শুরু করে। ঐটুকু সাইড এফেক্টস তো হয়েই থাকে। এটা পার্সেন টু পার্সেন ভ্যারিও করে।’
‘আর একখানাই প্রশ্ন… কিভাবে ব্যাক্টেরিয়া যৌবনের উৎকর্ষ সাধন করে?’
‘এটা এখনও চর্চার বিষয়। কিন্তু মানুষের রক্তকোষের ওপর, ইঁদুর, ফলের মাছি আর শস্যের উপর ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালিয়ে দেখা গেছে কোষগুলি এবং প্রাণীরা দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়। বয়সোচিত ছাপ তাদের কোষে পড়ে না। রাশিয়ানরা দাবি করেন মানুষের উপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে যে, তাদের ত্বক শিশুর পদতলের ন্যায় নরম হয়ে থাকে আর এক্ষেত্রে আমরা পঞ্চাশ কিংবা ষাট বছর বয়সী মহিলাদের কথা বলছি।’
‘তাহলে আপনার জানা নেই। আপনার কি অন্তত এইটুকু জানা রয়েছে যে, রাশিয়ান ক্লিনিকগুলোর মানুষের উপর ট্রায়াল দেওয়ার জন্য যথাযথ মেডিকো লিগ্যাল ক্লিয়ারেন্স আছে কিনা?’
লাকির স্বরটা অত্যন্ত কঠোর শোনালো।
ডাঃ দেশমুখ আমতা আমতা করে বলল, ’হ্যাঁ।’
***
এদিকে ভিষ্মিকার ম্যানসনে লাকি গভীর চিন্তায় মগ্ন। এই ‘এফ’ ব্যাসিলাসটি প্রায় পঁয়ত্রিশ লক্ষ বছর আগের পুরানো, যদি কিনা গুগলকে বিশ্বাসযোগ্য বলে ধরা হয়। অ্যাগেরেসিয়ার এক্ষেত্রে খুব সীমিত অনুমতি ছিল মানুষের উপরে এটা প্রয়োগ করার। এখনও পর্যন্ত চার জন ক্লায়েন্টের মধ্যে তিননম্বর হলেন ভিষ্মিকা। প্রাচীন ব্যাক্টেরিয়াগুলি প্রোটোজিনগঠিত হতে পারে… শরীরে ইনজেক্ট করানোর ফলে… কিভাবে এগুলি আধুনিক ডিএনএ-এর সঙ্গে রিয়্যাক্ট করতে পারে?
ডিএনএ হল ডিএনএ। কিন্তু তাদের কেমিক্যাল বেসের গঠন যা ডিএনএ সূত্রের সজ্জার উপরে নির্ভর করে। যার প্রভাবে জিন এমনভাবে আচরণ করতে পারে। ব্যাকটেরিয়াল জিন কি এভাবে কোন মানুষকে মৃত্যুমুখে ঠেলে দিতে পারে যখন তারা ইন্টিগ্ৰেটেড হয়ে জিনোম গঠন করে!
সে সবেমাত্র অভিরূপকে ফোন করতে যাচ্ছিল কিন্তু তার যাওয়ার আগেই ফোনটা বেজে উঠল। প্রবীণ মি. প্যাটেলের ফোন, পরেরদিন ভদ্রলোক তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চান, লাকি রাজি হল।
***
‘এত রাতে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত, তবে আমি তোর কাছে কিছু জানতে চাই।’ লাকি তার বন্ধুকে বলল।
বিরক্তি গিলে নিয়ে অভিরূপ ঠাট্টার স্বরে বলল, ‘শুধু মানুষের স্পন্টেনিয়াস কম্ববাশচন ছাড়া।’
‘আমার ব্যাখ্যায় এটি একটি হাইপোথিটিক্যাল সিচুয়েশন। তুই অবশ্যই এটাকে লজিক্যালি কিংবা আধিভৌতিক যেকোনও ভাবে দেখতে পারিস।’
‘আধিভৌতিক লজিক… হুম… ওকে, বল।’
‘আচ্ছা, ধর… যদি ধমনীতে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে কিংবা গলাধঃকরণের মাধ্যমে পাকস্থলীতে কোন প্রাচীন ব্যাক্টেরিয়া প্রবেশ করানো হয়, তাহলে কি ঘটতে পারে?’
‘যদি বাক্টেরিয়াগুলো প্যাথোজেনিক হয়, তবে অদ্ভুত সব রোগের প্রবল সম্ভাবনা তো থেকেই যায়… তবে প্রাচীন ব্যাক্টেরিয়া বলতে তুই কি বোঝাতে চাইছিস? কতটা প্রাচীন?’
‘ধর, পঁয়ত্রিশ লক্ষ বছরের পুরানো। তুই কিভাবে ধরে নিবি যে ব্যাক্টেরিয়াটি প্যাথোজেনিকই হবে? ফ্রেন্ডলীও তো হতে পারে? যেমনটা ধর গাট ব্যাক্টেরিয়া যা আমাদের ভিটামিনের কাজ করে।’
অভিরূপ হাসলো। ‘তোর কথায় যুক্তি আছে। ব্যাক্টেরিয়াগুলো তো ফ্রেন্ডলীও তো হতে পারে। আর আসলে এই কথার জোরালো যুক্তিও আছে। আমাদের শরীরের কোষের মাইটোকন্ড্রিয়া হল একটা প্রোটোব্যাক্টেরিয়া যার সঙ্গে আমাদের কোষগুলির একটা বহু পুরানো রিলেশনশিপ রয়েছে। তাই তোমার প্রাচীন ব্যাক্টেরিয়া কোন জরুরি ভূমিকা নিলেও নিতে পারে… আর যদি এখন কোন তোমার হাইপোথিটিক্যাল প্রশ্ন না থাকে… তবে আমি ঘুমোতে গেলাম। প্রায় মাঝরাত হল।’
***
লাকি ওই রাতে ঘুমাতে পারলো না।
ভিষ্মিকার কম্পিউটারটিতে উন্মত্তের ন্যায় বিভিন্ন সাইন্টিফিক সাইটগুলোতে তথ্যের জন্য সার্চ করে চলল আর বিভিন্ন অসম সূত্রগুলোতে একসঙ্গে বাঁধবার চেষ্টা করে চলল।
সে জানত যে, মাইটোকন্ড্রিয়া হচ্ছে কোষের ব্যাটারির মতো। সে যেটা আবিষ্কার করল সেটা হল মাইটোকন্ড্রিয়া তাদের নিজস্ব ডিএনএ ধারণ করে। যেটি কোষীয় জিনোমিক ডিএনএ থেকে আলাদা এবং যেটি শরীরের প্রপার জিনোম। মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ হল চক্রাকার ঠিক যেমন ব্যাকটেরিয়াল ডিএনএ আর এর নিজেকে সক্রিয় রাখবার জন্য নিজের যান্ত্রিক ব্যবস্থাও বর্তমান। এর চাইতেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যাপারটি সে দেখতে পেল তা হল ১৯৭০ তে ডাঃ লিন মারগুলিশ মাইটোকন্ড্রিয়ার একটি অতিরিক্ত কোষীয় সূত্র সম্পর্কে প্রথম প্রস্তাবনা করেন। এই ধারার তত্ত্বটি সাজেস্ট করে যে মাইটোকন্ড্রিয়া হল যেকোনও প্রাচীন ব্যাক্টেরিয়ার উত্তরসূরী। যেটা কোনওভাবে কোষের মধ্যে সারভাইভ করে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগুলি শরীরের কোষগুলিতে জরুরি উপাদান হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।
বিছানায় শুতে যাওয়ার সময় তখন প্রায় ভোর।
মিঃ প্যাটেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ-এর আগে স্নান করার সময় তার মাথাটা দপদপ করছিল। কিন্তু তার পূর্বে ইনস্টিটিউট অফ মইক্রোবায়োলজির ডাঃ সুদীপ্তা চ্যাটার্জির সঙ্গে তার সাক্ষাৎ করা দরকার। সুদীপ্তা তার বহু পুরানো বান্ধবী, অতি সম্প্রতি তাকে একটা ব্যাক্টেরিয়া প্রজাতি আইডেন্টিফাই করতে ভীষণ সাহায্য করেছে। তারিণীদার পৈত্রিক গ্রামের বাড়ির একটা গর্ত থেকে ওই ব্যাক্টেরিয়ার প্রজাতিটা সে সংগ্রহ করেছিল। সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার যে সুদীপ্তা এই মুহূর্তে শহরে রয়েছে আর সাগ্রহে তার সঙ্গে দেখা করার বিষয়ে রাজি হয়েছে।
***
ডাঃ চ্যাটার্জি এক সেকেন্ডেই বুঝে গেলেন লাকি তার ‘হাইপোথেটিক্যাল সিচুয়েশন’-এর পর্দার আড়ালে আসলে কী বোঝাতে চাইছে।
‘ঠিক বলেছ লাকি। প্রোটোব্যাক্টেরিয়া যা ফাইন্যালি আমাদের মাইটোকন্ড্রিয়াকে হেল্প করতে থাকে কোষীয় শ্বসন প্রক্রিয়া চালনায়… এর ফলে বিবর্তনের দারুন এডভ্যান্টেজ পাওয়া যায়। ঠিক যেমন প্রোটোব্যাক্টেরিয়া যা ক্লোরোপ্লাস্টে পরিণত হয়ে থাকে উদ্ভিদের ক্ষেত্রে। আর সালোকসংশ্লেষে যার কার্যকারিতা দানে দারুণ সহায়ক।’
লাকি মাথা নাড়ল… তার কাছে তখনও লক্ষাধিক প্রশ্ন রয়েছে কি, কেন ইত্যাদি। ‘কি হতে পারে যদি’… তবে সে জানে তার শুধুমাত্র দরকার বেসিক ইনফরমেশন, কি হতে পারে শব্দটি জিজ্ঞাসা করার পূর্বে। তাই ডাঃ চ্যাটার্জি যখন কথা বলছিলেন সে মনোযোগ সহকারে তা শুনছিল।
‘আজ মাইটোকন্ড্রিয়ার রিলেটিভলি বহু জিন রয়েছে… বিবর্তনে সে তার স্বাধীন অস্তিত্ব হারিয়েছে। কোনওভাবেই এটা প্রমান করা সম্ভব নয় যে সহায়ক অথবা মিথোজীবী ব্যাক্টেরিয়া বা প্যাথোজেনিক নয়, এটি পরিবর্তিত হয় মাইটোকন্ড্রিয়ায় তবে ঘটনাপ্রবাহ সূত্র যেগুলি এভেইলেবল এই তত্ত্বটির পক্ষে ঘটনাপ্রবাহ সূত্র যেগুলি সাক্ষ্য দেয়।’
‘হাইপোথিটিক্যাল স্পিকিং… কি হতে পারে যদি ডাইনোসরের আমলের কোনও প্রাচীন ব্যাক্টেরিয়া যদি কারোর শরীরে ধারাবাহিকভাবে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে কিংবা খাওয়ার মাধ্যমে প্রবেশ করানো হয়।’
প্রশ্নটা এমন সুন্দরভাবে করায় লাকির দিকে তাকিয়ে ডাঃ সুদীপ্তা চ্যাটার্জি মুচকি হাসলেন।
‘তুমি আসলে ক্রায়ো-মাইক্রবায়োলজির কথা বলছ… কোন জীবাশ্ম থেকে অথবা গভীর সমুদ্রে অধঃক্ষেপ থেকে অথবা গলানো পার্মাফ্রস্ট থেকে পুনরুথ্থিত ব্যাক্টেরিয়া … অথবা আর কোথা থেকে তুমি এধরণের ব্যাক্টেরিয়া পেতে পারো?’
লাকি সবলে মাথা নাড়ল। পরক্ষণেই মাথার খুলিতে মধ্যে সূঁচ বেঁধার মতো যন্ত্রণা অনুভব করল।
ডাঃ চ্যাটার্জি ব্যাপারটা খেয়াল করেনি। তিনি তখনও বলে চলেছেন, ‘হুম, আমি জানি না কিভাবে প্রাচীন কোনও ব্যাক্টেরিয়া আমাদের ইমিউন সিস্টেমের সঙ্গে রিয়াক্ট করে। কিন্তু আমার মনে হয়, যদি এটিকে ইমিউন সিস্টেম নষ্ট না করে, তার একমাত্র কারণ অরিজিনাল মাইটোকন্ড্রিয়ার সঙ্গে এর সাযুজ্য আছে; তাহলে শেষমেশ এটি মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনপুলে মিশে যাবে।’
লাকি আগ্রহের সঙ্গে বলল, ‘তাহলে এটি মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিনএ-কে দ্রবীভূত করতে পারে… মাইটোকন্ড্রিয়া জিনকে উদ্দিপিত করতে পারে? এটাই কি তুমি বলতে চাইছ।‘
‘এটি হতে পারে, এই একটা সম্ভাবনা আছে। আরেকটা সম্ভাবনা হল, যদি খাওয়ার মাধ্যমে গ্রহণ করা হয় তবে এই বাক্টেরিয়াগুলি সরাসরি ডাইজেস্টিভ সিস্টেমে প্রবেশ করতে পারে।’
‘কিন্তু পাকস্থলীর অ্যাসিড তার অন্ত্রের উৎসেচকগুলো এই বাক্টেরিয়াগুলোকে মেরে ফেলতে পারে না?’
‘মারতে পারে, কিন্তু সব ব্যাক্টেরিয়া এভাবে মারা যায় না। কিছু তো নিশ্চিতভাবেই বেঁচে যায়। তখন যে চান্সগুলি থাকে সেইগুলি হল যেমন শ্বেতরক্তকনিকা। ব্যাক্টেরিয়াটি তখন কৈশিক জালিকার সূক্ষ্ম পথ দিয়ে পৌঁছায় অন্ত্রের এপিথেলিয়াল কোষগুলিতে আর অবশেষে সমস্ত কোষে অনুপ্রবেশ করে; এমনকি কোষীয় ডিএনএ এর সঙ্গে ইন্টার্যাক্ট করে।’
‘একইসঙ্গে সব কোষেই অনুপ্রবেশ করে! কোষীয় ডিএনএ এর সঙ্গে ইন্টার্যাক্ট করে।’
‘একইসঙ্গে সব কোষেই অনুপ্রবেশ করে! কোষীয় ডিএনএ কে সংক্রমণ করে!’
লাকি বজ্রাহত হল। ‘তবে তো সেটি আমাদের শরীরের কোষীয় ব্যাবস্থাকে শর্টসার্কিটও করতে পারে।’ ডাঃ চ্যাটার্জি হেলায় কাঁধ ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানালেন।
‘প্রোটোব্যাক্টেরিয়া অভাবিতভাবে আচরণ করতে পারে… আমার ভয় হল যে যদি এটি মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনোমে একত্রীভূত করা হয়, তখন এটি কোষীয় ব্যাবস্থায় এনার্জি মেকানিজমে ইন্টারফেয়ার করতে পারে। ‘
‘তুমি আসলে তাহলে বলতে চাও প্রোটোব্যাক্টেরিয়া কোষীয় ব্যাটারির শর্টসার্কিটের কারণ হতে পারে। ‘
‘তুমি এমনভাবে ব্যাপারটাকে নিতেই পারো…’
ডাঃ চ্যাটার্জি দম নেওয়ার জন্য থামলেন। জানালার দিকে একপলক তাকিয়ে বাইরের দিকটা দেখে নিলেন। তারপর লাকির বিষয়ের ওপরেই পুনরায় আলোকপাত করলেন এবং ফের বলতে শুরু করলেন, ‘আসলে জান তো, শরীরের উৎসেচকচক্রগুলো জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। প্রকৃতিতে সবক্ষেত্রেই একটা ক্যাসকেড মেকানিজম রয়েছে। একটি চক্র যা নিয়ন্ত্রিত পথে সমস্ত কোষীয় কার্যকলাপকে চালিত করে। কোনকিছুই অস্বাভাবিক নয়। সমস্তকিছুই নিয়ন্ত্রিত। ক্রম হল একটি সর্বপ্রধান গুরুত্ব। জিনেরাই এর নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় থাকে।’
‘জিনগত প্রতিরূপকে পরিবর্তিত করা আর নিয়ন্ত্রিত করা, ধাপে ধাপে চক্রকে ছুটন্ত ঘোড়ায় পরিণত করার সামিল।’—- লাকি এইভাবে রূপকাশ্রিত হয়ে কথাটি বলল বটে, তবে কথাটা ভেবেই সে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল।।
ডাঃ চ্যাটার্জি মাথা নাড়লেন। ‘আর এভাবে প্রত্যেক ধাপে প্রচুর পরিমানে শক্তি উৎপন্ন হতে থাকে। পরমাণুগুলোও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় শক্তি উৎপন্ন করতে গিয়ে, যা অবশেষরূপে অন্যভাবে শরীরে থেকে যায়।’
‘কতদিন…?’ লাকি বলতে শুরু করল। কিন্তু ড.চ্যাটার্জি তখনও না থেমে বলছেন, ‘মাসের পর মাস লাগতে পারে সমস্ত কোষগুলোতে… প্রাচীন জিনগুলিতে সংক্রামিত হতে… আমার মনে হয় খুব ভালোভাবে এর ব্যাখ্যার প্রয়োজন। এই ধাপগুলি রাতারাতি হয় না। প্রথমদিকে, আমার ধারণা, কোন ব্যক্তির অস্বাভাবিক গরম বোধ হতে থাকে… একবার যদি সকল কোষীয় মাইটোকন্ড্রিয়াগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হয়; তবে তখন গোটা কোষীয় তন্ত্র -ই কোলাপ্স করবে। তখনই ভীষণ তাপ উৎপন্ন হওয়া শুরু হবে… অনিয়ন্ত্রিত থার্মোজেনেসিস ঘটবে।’
লাকি চিৎকার করে বলে উঠলো, ’স্পন্টেনিয়াস কম্বাশচন’!
ডাঃ সুদীপ্তা চ্যাটার্জির চোখ দুটো বিস্ফারিত হয়ে উঠল।
একজন মুম্বাইবাসী হয়ে তিনি এর যোগসূত্র খুঁজতে মোটেই ব্যর্থ হলেন না।
লাকি ছুটলো ফোনে করতে। সে তখন মি.প্যাটেল আর ডাঃ দেশমুখকে ফোন করে অনন্তিকা আর পূর্ণিমার সঙ্গে ভিষ্মিকার ম্যানসনে ওইদিন সন্ধ্যায় দেখা করার সংবাদ দিল।
অবশ্য ডাঃ সুদীপ্তা চ্যাটার্জিকেও সেখানে থাকতে হবে।
Tags: অঙ্কিতা, অনুবাদ উপন্যাস, কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস, চতুর্থ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, নবপ্রিয়া কুণ্ডু, সুকন্যা দত্ত
অসাধারণ গল্প,মুগ্ধ ও মোহিত হয়ে গেলাম।
দুর্দান্ত গল্প। বাংলা অনুবাদে এমন একটি বৈজ্ঞানিক রহস্য আমাদের কাছে পেশ করার জন্য আমরা কল্পবিশ্ব টিম, এবং মূল কাহিনির লেখকের কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে রইলাম।
নতুনত্বের জন্য বেশী ভালো লাগলো। ঝরঝরে ভাষা, বোঝাই গেলো না এটা অন্য কোন ভাষা থেকে অনুবাদ করা হয়েছে। দারুন…