যুগলবন্দি
লেখক: সুমিত বর্ধন
শিল্পী: জটায়ু
অডিটোরিয়ামে আজ তিল ধারণের জায়গা নেই! সমস্ত সিট ভরতি, সিটের সারির মাঝের প্যাসেজের মেঝেতেও লোক বসে রয়েছে ঠাসাঠাসি করে। এমনকী ওপরের ব্যালকনিতে উপচে পড়ছে ভিড়। মানুষের মাথার ওপর দিয়ে রোটরের শব্দ তুলে ওড়ে ক্যামেরা ড্রোনের ঝাঁক, স্টেজের সামনে বকের মতন লম্বা পায়ে হেঁটে পজিশন ঠিকে করে অটো-ক্যামেরার দল।
একসঙ্গে এত মানুষের ভিড় এ শহর বোধহয় বিগত কয়েক দশকে দেখেনি। কারণ যে দুই সঙ্গীত কলাকুশলী আজ একত্রে তাঁদের বাদ্যসঙ্গীত পেশ করবেন তাঁদের দুজনকে একসঙ্গে, একই মঞ্চে, আজ পর্যন্ত কারোর দেখার সৌভাগ্য হয়নি। তাঁদের দুজনকে একত্রে চাক্ষুষ দর্শন করতে আজ তাই অডিটোরিয়ামে ভিড় ভেঙে পড়েছে।
ঘনিয়ে আসে অনুষ্ঠান আরম্ভের সময়। এক-এক করে নিবতে থাকে অডিটোরিয়ামের আলো। থেমে যায় দর্শকদের কথোপকথন, নিস্তব্ধতার মধ্যে শোনা যায় ঘোষিকার কণ্ঠস্বর। মার্জিত উচ্চারণে দর্শকদের দুই শিল্পীর খ্যাতি ও কুশলতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন তিনি।
স্পটলাইটের আলো পড়ে মঞ্চের ওপর, ধীরে ধীরে উঠে যায় যবনিকা। দেখা যায় মঞ্চের একপাশে বসে রয়েছেন নবীন শিল্পী। তুমুল করতালিতে তাঁকে স্বাগত জানায় অডিটোরিয়ামের ভিড়।
মঞ্চের অন্যদিকে থেকে এবার ওপরে উঠে আসেন প্রবীণ শিল্পী, সঙ্গে তবলাবাদক। মানুষের করতালির মনে হয় এবার বুঝি অডিটোরিয়ামের ছাদই না ভেঙে পড়ে।
করতালির শব্দ থেমে যেতে ফের শোনা যায় ঘোষিকার কণ্ঠস্বর, ‘আজ আমরা শুনব রাগ হামীর’।’
দর্শকদের উদ্দেশে করজোড়ে নমস্কার করেন প্রবীণ শিল্পী, মৃদু হেসে তুলে নেন বাদ্যযন্ত্র। তারের ওপর তাঁর হাতের ছোঁয়ায় ছড়িয়ে যায় সুরের মূর্চ্ছনা। এক টানে গান্ধার, তীব্র মধ্যম, নিষাদ পার করে ষড়জ ছোঁয় সুর। উত্তরে রিমঝিম করে বেজে নবীন শিল্পীর যন্ত্রও। গান্ধার থেকে শুরু করে তীব্র মধ্যম, নিষাদ হয়ে ধৈবতে কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে পঞ্চমে নিয়ে আসেন তিনি সুরকে।
শুরু হয় সঙ্গীতের আদানপ্রদান, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে দর্শকেরা।
আলাপ, জোড় পার হয়ে সঙ্গীত এসে পৌঁছয় বন্দিশে। যন্ত্রের সঙ্গে এবারে ত্রিতালে বেজে অঠে তবলা। বন্দিশের অন্তরা শেষ করে বিস্তারের মধ্যে দিয়ে দুই শিল্পী নিপুণভাবে সুরের আল্পনায় ফুটিয়ে তুলতে থাকেন হামীরের রাগরূপ।
তারপর শুরু হয় তানকারি। তারের ওপরে নবীনের হাত ছোটে বিদ্যুতের বেগে। মন্দ্র, মধ্য সপ্তক পেরিয়ে তার সপ্তকে দ্রুতগতিতে ছুটে এসে তান শেষ করেন তিনি বে-দম তেহাইতে। মৃদু হাসেন প্রবীণ, লয়ের উত্তর দেন ছন্দে। তবলার সাথ সঙ্গতে বাজতে থাকা তাঁর বোল তান নর্তকীর ঘুঙুরের মতন গুঞ্জরিত হতে থাকে অডিটোরিয়ামে।
ঝালা ধরেন শিল্পীরা, উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে তাঁদের সঙ্গীতের লয়। কোনও এক অজানা জগতে যেন তাঁরা ভাসিয়ে নিয়ে যান দর্শকদের। তারপর কোনও এক সময়ে, সুরের যাদুতে সম্পূর্ণ ডুবে থাকা দর্শকদের হৃদয় শূন্য করে জটিল এক তেহাইয়ের মধ্যে দিয়ে রাগ হামীর সমাপ্ত করেন শিল্পীরা।
কেবল কয়েক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা। তারপর শুরু হয় দর্শকদের সোল্লাস করতালি। সে আওয়াজ যেন আর থামতেই চায় না।
দু’হাত তুলে ভিড়কে নিরস্ত করেন প্রবীণ বাদক। দুহাত জোড় করে ওপরের ব্যালকনির দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘আপনাদের এই অভিন্দনের বেশির ভাগটাই প্রাপ্য এমন একজনের, যিনি না থাকলে আজকের এই যুগলবন্দি সম্ভব হত না।’
মৃদু ঘাড় নেড়ে সায় দেন নবীন শিল্পীও। দু’হাত জোড় করে তিনিও নমস্কার জানান ব্যালকনির দিকে।
স্পটলাইটের আলোর ফোকাস পড়ে ব্যালকনির এক কোনে। আওয়াজ তুলে সেদিকে ছিটকে যায় ড্রোন ক্যামেরার ঝাঁক।
আলোর বৃত্তের মাঝখানে ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ান একজন মহিলা। ঋজু দেহ, মাথার চুলে শুভ্রতার প্রলেপ।
তাঁকে দেখামাত্র আবার দর্শকের করতালির আওয়াজে মুখরিত হয়ে ওঠে অডিটোরিয়াম।
আওয়াজ ছাপিয়ে ভেসে আসে ঘোষিকার কণ্ঠস্বর, ‘ডক্টর তনিমা দেব, যিনি সময় ভ্রমণের প্যারাডক্সের জটিল অঙ্কের সমাধান সূত্র না বের করলে আমাদের আজ পণ্ডিত অজিতনাথ এবং তাঁর অতীত স্বরূপকে একই সঙ্গে, একই মঞ্চে যুগলবন্দি বাজাতে দেখার সৌভাগ্য হত না।’
Tags: অনুগল্প, জটায়ু, পঞ্চম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, সুমিত বর্ধন
এক কথায় অসাধারণ৷ ৫ টা মিনিট কেটে গেল কী অবিশ্বাস্য দ্রুততায়, মাথায় চিন্তার ঝড়- কোনদিকে গল্পের কাহিনী এগুবে৷ শেষ করে মিনিট দশেক চুপচাপ মুগ্ধতায় বসে থাকা৷
বাহ্ বাহ্। দারুণ লাগল।
এককথায় দারুণ। পূর্ণ মাত্রায় উপভোগ করলাম।