রক্তে রাঙানো
লেখক: ইমন চৌধুরী
শিল্পী: তৃষা আঢ্য
(১)
প্রায় বছর পনেরো আগের কথা, জলের দরে মফঃস্বলে এই বিরাট বাড়িটা কিনে নিয়েছিলেন আমার বাবা, জন্মে অবধি ভাড়া বাড়িতে জীবনের আঠারোটা শীত বসন্ত পার করে দেওয়ার পর অবশেষে মা বাবার সাথে এই প্রাসাদোপম বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছিলাম।
মাসখানেক আগে এ বাড়ির মালিক গত হয়েছেন, পরবর্তী প্রজন্ম প্রবাসী, বৃদ্ধের দেহ পঞ্চভূতে বিলীন হওয়ার পর ঘাড়ের উপর থেকে জন্মভিটের বোঝা সুযোগ্য সন্তানদ্বয় যত দ্রুত সম্ভব নামিয়ে দিয়ে সিঙ্গাপুরগামী বিমানে চেপে বসেছিল, আমার বাবা সেই সুযোগেই এই বাড়ি লাভ করেছিলেন।
আজ মনে হয় বাবার একটা বিরাট বাড়ির সাধ ছিল, বাড়িটা কিনতে গিয়ে বাজারে বাবার অনেকটাকা ধার হয়ে গেছিল। তিনটে মাত্র মানুষ আমরা, এতো বড় বাড়ি আমাদের প্রয়োজন ছিল না, শুধুমাত্র শখপূরণের জন্যে বাবা এই বিরাট বাড়িটা কিনেছিল। দোতলায় দুটি আর নিচের তলায় তিনটি ঘর ছাড়া বাকি সমস্ত ঘর তালাবন্ধই পরে থাকত, মনে পরে সেই সময় গভীর রাতে বাবা বাড়িময় পায়চারি করতেন। বাবার মনস্তত্ব আমি আজও ঠিক বুঝি না, বাবার মনে হয়তো খুব বড়োলোক হওয়ার এক অবদমিত ইচ্ছে ছিল, নিজেকে এই বিশাল প্রাসাদের কর্তা মনে করে বাবা আত্মগর্বে গর্বিত থাকতেন। আমাদের বংশে খুব বড়োলোক কেউ ছিল না কখনো, তবে গল্প শুনেছি আমার ঠাকুরদাদা কোন এক জমিদার বাড়িতে হিসেব দেখার কাজ করতেন, ঠাকুরদা আত্মহত্যা করেছিলেন, আমি জানিনা ঠাকুরদার মৃত্যুর পিছনে কোন রহস্য আছে কিনা, বাবা কখনো বলেনি সেকথা। আমি বাবাকে ঠিক বুঝিনা, বাবাকে অদৃষ্ট চালিত যন্ত্র বিশেষ বলে মনে হয় আমার।
এই বাড়ি আমাদের পরিবারে কখনো কোন অতিরিক্ত সুখ যোগ করতে পারেনি, বরং এই বিশাল বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের দায় আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারকে দিনের পর দিন গরীব করেছে। আমার এই গল্প আমাদের সেই গরীব হওয়ার গল্পের ধারাবিবরণী নয় বরং আমি অন্য এক গল্প বলতে চাই, আমি বলতে চাই এই বাড়ির ভিতরে অবস্থিত এক গোপন জানালার কথা, যে জানালা খুলে বাইরে বেরোলে এক লাল রক্তে রাঙ্গা সময়হীন পৃথিবীতে পৌঁছানো যায়, আমি কখনো বুঝিনি সেই গোপন জানালা আমার জীবনে আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ। আমি শুধু নিশ্চিত হয়েছি তার অস্তিত্ব সম্পর্কে।
আমি তখন কলেজের ফার্স্ট ইয়ার, মধ্যমেধার সাধারণ ছাত্র ছিলাম, জীবনের কোন পদক্ষেপে আমি কখনো খুব ভালো অথবা খুব খারাপ কোন কিছুর নিদর্শন রাখতে পারিনি। কলেজে অপর্ণাকে ভালো লাগতো, অপর্ণা বড়োলোক বাড়ির মেয়ে, ওর চালচলন আমাদের মতো নয়, আমি শুধু দূর থেকে ওকে দেখতাম, কোনোদিন কথা বলার সাহস সঞ্চয় করতে পারিনি। অপর্ণা ভালো গান করতো কলেজের অনুষ্ঠানে অপর্ণা যখন গান করতো আমি একেবারে শেষে অন্ধকারে একাকী বসে ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম, আমার দৌড় ওই পর্যন্তই ছিল। আমি আমার মধ্যবিত্ত জীবন নিয়ে খুশি ছিলাম এমন নয়, তবে অভিযোগ জানানোর জন্যে যতটা মানসিক অতৃপ্তি প্রয়োজন ততটাও বোধকরি আমার ছিল না, অতএব জীবনের কাছে আমার কোন নির্দিষ্ট অভিযোগ ছিলনা, আমি মানিয়ে নিয়েছিলাম। জীবনকে সব পেয়েছির দেশ তৈরি করতে হবে এমন আকাঙ্ক্ষা আমার মধ্যে সৃষ্টি হয়নি।
নতুন পাড়ায় আমার কোন বন্ধু হয় না, এই অঞ্চলে আমার বয়সী ছেলে প্রায় নেই বললেই চলে, বিকালে বাড়ির জীর্ণ এবং বিশাল ছাদে একাএকাই ঘুরে বেড়াতাম, বাড়ির পিছনে একটা বড় পুকুর ছিল, পাশেই পঞ্চাননবাবার মন্দির এই পুকুরের মাছে দেবতা ভিন্ন আর কারোর অধিকার ছিলনা, আমি ছাদ থেকে পুকুরের কালো জলের দিকে স্থির নেত্রে চেয়ে থাকতাম, পাশের নিম গাছ থেকে সাদা বকের বেশে দেবতা স্বয়ং মাছ খেতে জলে নামতেন, এই পুকুরে কচ্ছপ ছিল, বিকালের দিকে তারা মাঝেমাঝে পাড়ে উঠে আসতো, আকাশের হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারা আবার গুটিগুটি পায়ে জলে নেমে যেত। ছাদের একেবারে শেষ সীমানায় শিমুল গাছের ছায়ায় বেতের মোড়ায় বসে আমি এই পুকুরের শান্ত জল দেখতাম, কোনোকোনো দিন অপর্ণাকে মনে করে কবিতা লেখার চেষ্টা করতাম, আমি কবিতা লিখতে পারিনা, শেষ বিকালের লাল আলোয় আমার সমস্ত কবিতা লেখার প্রয়াস গোলগোল কাগজের মণ্ড হয়ে ওই পুকুরের জলে আছাড় খেয়ে পড়ত, কবিতারা ভিজতে ভিজতে একসময় জলের গভীরে তলীয়ে যেত, হয়তো তখন কোন কই অথবা শিঙ্গি মাছের ঝাঁক আমার কবিতায় ঠোকর মাড়তো আমি সেকথা জানতে পারিনি। তবে আজ মনে হয় আমার কৈশোরের প্রেমের সেসব দলিইল রেখে দিলে বড় ভালো হতো। সংসারে টিকে থাকার জন্য এসব মায়ার প্রয়োজন পরে।
বাড়ির পিছনের অংশে একটা ভাঙ্গা গোয়ালঘর ছিল, দৈর্ঘ্যে প্রস্থে বেশ বড়, বলার অপেক্ষা রাখেনা যে এককালে এই অঞ্চল হাম্বারবে মুখরিত থাকত। তবে এখন গোয়ালঘরের টিনের চালে ফুটো হয়েছে, বর্ষাকালে ঘরের নানা স্থলে টাপুরটুপুর শব্দে জলের ধারা নেমে আসে, শূন্য দোনায় সে জল জমে থাকে, আর সেই জলে ব্যাং এবং মশার লার্ভারা একসাথে খাদ্য খাদকের সম্পর্ক অনুসারে হুটোপুটি করে, ছাদের উপরে তাকালে মাকড়সার জালের মতো ঝুলন্ত সাপের খোলস দেখা যায়। আমার আফ্রিকার জঙ্গল ছিলনা, এই জীর্ণ গোয়ালঘর ছিল, যেদিন গড়পড়তা জীবনে একেবারে ক্লান্ত হয়ে পড়তাম, সেদিন জীবনে উত্তেজনা সরবরাহ করার জন্যে আমি এই গোয়ালঘরে উপস্থিত হতাম।
(২)
শীতকাল, কোন কারনে কলেজ ছুটি ছিল, হয়তো রবিবার, মনে নেই। বড্ড ঠাণ্ডা, ছাদে বসে গায়ে দুপুরের মিষ্টি রোদ মাখছিলাম, শিমুল গাছের ছায়া ক্রমে দীর্ঘ হচ্ছে, আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি সূর্যের যাবার সময় আসন্ন, আকাশের রঙ লাল। গায়ের মধ্যে চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে আমি নিচে নেমে আসি। ঘরে কেউ নেই, মা হয়তো পাশের কোন কাকিমার বাড়ি গল্প করতে গেছে, বাবা কোথায় জানি না, বাবার মতো আমিও বন্ধ দরজাগুলোর সামনে কিছুক্ষণ পায়চারী করলাম। এই বিশাল স্থাপত্তে আমি একা, কেউ কোথাও নেই, নিজেকে হঠাৎ জমিদার মনে হয়, বাবারও কি এরকমই কিছু মনে হয়? ঘর ছেড়ে বাগানে নেমে আসি, সামনের ফাঁকা জমিতে বাবা চন্দ্রমল্লিকা গাছ লাগিয়েছিল, এখন তাতে ফুল এসেছে, আমি সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাড়ির পিছনে জীর্ণ গোয়ালঘরের দিকে চলে যাই।
অনেকদিন এদিকে আসা হয়নি, গোয়ালঘরটার ছাদে একটা অশ্বত্থগাছ জন্মেছে, তার শিকড় দরজা অবধি পৌঁছে গেছে, সহসা সেই কালচে শিকড়কে সাপ বলে ভুল হতে পাড়ে, কিন্তু এখন সাপের ভয় নেই, এখন শীতকাল, সাপেরা এখন শীতঘুমে।
সূর্য নিভু নিভু, সন্ধ্যে হতে দেরী নেই আর, মা ফিরে আসবে এবার, আমি একলা পায়চারি করছিলাম অন্ধকার গোয়ালঘরের মধ্যে, এখানে এলে আমি কিরকম যেন অশরীরী কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করতে পারি, এই অনুভুতির এক অদ্ভুত আকর্ষণ আছে, আমি এখানে ওই ব্যাখ্যাতীত আকর্ষণেই ফিরে ফিরে আসি।
হাঁটতে হাঁটতে সামনে হঠাৎ সিঁড়ির মতো কিছু অনুভব করলাম। অন্ধকারে স্পষ্ট বোঝা যায়না, নিচু হয়ে ভালো করে লক্ষ করতে মনে হল সামনে দেওয়ালের ওপার থেকে যেন একটা লালচে আলো আসছে, হাত বাড়াতেই দেওয়াল ছুঁতে পারি, একটু চাপ দিতেই বুঝি দেওয়াল নয় যেন দরজা্, ঠিক দরজাও নয় জানালা বলা যেতে পারে, আমার হাতের চাপে খুলে গেছে। অপ্রান্তে উজ্জ্বল লাল আলো। সেই প্রথমবারের জন্যে আমি অন্ধকার জানালা অতিক্রম করে সেই লাল আলোর পৃথিবীতে প্রবেশ করি।
আমার সামনে এক দিগন্ত বিস্তৃত উন্মুক্ত প্রান্তর। সামনে ধান জমি দূরে ওটা পুকুর বুঝি, জমির ধারে রাস্তার পাশে গাছপালা, বুনোগুল্ম, লজ্জাবতী লতার ঝাড়। সব কিছুই গ্রাম বাংলার দৈনন্দিন জীবন থেকে তুলে আনা স্থির চিত্রের মতো। শুধু গাছের পাতার রঙ লাল, ধানের শিষের রঙ লাল, রাস্তায় ধুলোবালিও বড্ড লাল। আমি ভয় পাই, নিজেকে চিমটি কেটে বোঝার চেষ্টা করি জেগে আছি নাকি স্বপ্ন দেখছি। থামতে পারিনা, অজানা আকর্ষণে সামনে এগোতে থাকি, চেষ্টা করেও ফিরে আসতে পারিনা। চিৎকার করার চেষ্টা করেছিলাম অনেকবার, আমার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরোয়নি। ছোটবেলা গভীররাতে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেলে মনে হতো আমার হাত পা কেউ চেপে ধরেছে, তখন আমি অনেক চেষ্টা করেও আওয়াজ করতে পারতাম না, অন্ধকারের মধ্যে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকতাম শুধু, এখনো আমার সেই অবস্থা।
কোন মানুষ নেই, আমি লাল পুকুরের ধারে বসে থাকি, মাঠের আলেআলে হেঁটে বেড়ায়, কৌতূহলী হয়ে লাল ধানের শিষ ছুঁয়ে দেখি, কেউ কোথাও নেই। আরও এগোলে সামনে একটা মৃত শহর চোখে পরে, প্রাসাদের ন্যায় বাড়িঘর রাস্তা, সমস্ত কিছু যেন থমকে আছে, একটা প্রাণবন্ত শহর থেকে হঠাৎ সবাই চলে গেছে, ব্যাটারি শেষ হয়ে যাওয়া খেলনার মতো থেমে আছে জগত। এ কোন সভ্যতা? কোন দেশ?
এক অট্টালিকার খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করি, ঘোরানো কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে যায় অনেক উপরে, কেউ কোথাও নেই ছাদে পৌঁছে দেখতে পাই শুধু লাল আকাশ, সূর্য চাঁদ তারা কিচ্ছু নেই, শুধু একটা লাল চাদর যেন। আমি চারিদিকে তাকিয়ে আমার বাবার কেনা সেই প্রাসাদোপম বাড়িটা খোঁজার চেষ্টা করি, কোথাও নেই। এই সময়ে আওয়াজ ফিরে পাই, চিৎকার করি, ‘কেউ আছে? হ্যালো…’ আমার আওয়াজ প্রতিফলিত হয়ে আমার কাছেই ফিরে আসে। বিশাল সেই ছাদে শুয়ে আমার হঠাৎ খুব কান্না পায়, নিজেকে এই পরিত্যক্ত শহরের অবিচ্ছেদ্দ অংশ বলে মনে হয়। ঘুমিয়ে গেছিলাম সেই ছাদেই, কতক্ষন ঘুমিয়েছি জানিনা, যখন ঘুম ভাঙ্গে তখনো সবকিছু অবিকল এক, কোথাও কোন তফাৎ নেই। হঠাৎ বড় অসহায় লাগে, মনে হয় আমি বুঝি মারা গেছি, সেই গোয়ালঘরে অন্ধকারে পা পিছলে আমি পরে গেছিলাম কি? মাথায় ধাক্কা লেগে তক্ষুনি মরে গেছিলাম হয়তো। এটাই কি স্বর্গ অথবা নরক? এতক্ষণে হয়তো আমাকে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে চিতায়, জীবনটা হঠাৎ বড় সুন্দর মনে হয়, প্রাণপণে ছুটতে থাকি, আমার চারিপাশে পরে থাকে, প্রাসাদ অট্টালিকা, লাল ধান ক্ষেত, লাল গাছের পাতা, লাল আকাশ। ছুটতে গিয়ে কখনো পরে গেছি, কখনো হয়তো অচৈতন্য হয়ে গেছি, তারপর যখন জ্ঞ্যান ফিরেছে আবার ছুটতে শুরু করেছি, কয়েক ঘণ্টা অথবা কয়েক বছর ছুটে চলার পর একসময় আমি খুঁজে পায় আমার সেই গোয়ালঘর সংলগ্ন ছোট্ট জানালা, ওপারে নিবিড় অন্ধকার, আমি গণ্ডী অতিক্রম করে চেনা পৃথিবীতে ফিরে আসি, জানালাটা সজোরে বন্ধ করেদি।
শূন্য গোয়ালঘর, বেশ ঠাণ্ডা এখন, আমার ভয় হয়, মনে হয় হয়তো আমি চলে এসেছি অনেকবছর পরের অথবা আগের কোন পৃথিবীতে, হয়তো আমি বাড়ি ফিরে পরিচিত কাউকে দেখতে পাবো না, অথবা হয়তো দেখবো আমার জন্যেই শোকে আচ্ছন্ন আমার পরিবার। গল্প উপন্যাসে এমন কিছু পড়েছিলাম নিশ্চয়, সেসব গল্পকথাই অবচেতনে আমার মনে জাল রচনা করেছিল।
সেরকম কিছুই হয়না, আমি বাড়ি ফিরে আসি যখন মা তখনো ফেরেনি প্রতিবেশীর বাড়ি থেকে, পাশেই কোন বাড়ি থেকে শাঁখের আওয়াজ আসে, সন্ধ্যা দেখানো হচ্ছে ভগবানকে, একটু পরে পঞ্চানন তলা থেকে ঘণ্টাধ্বনি শোনা যাবে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ছটা দশ। আমি কি সত্যি স্বপ্ন দেখেছি? অস্থিরতা বাড়ে, ভয় বাড়ে, এরপর আমি প্রায় মাসাধিককাল আর গোয়ালঘরের দিকে যায়নি।
(৩)
সেই লাল পৃথিবীর কথা আমি কাউকে বলিনি, কিন্তু আমি নিজে এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারিনি, বিকালে ছাদে শিমুল গাছের ছায়ায় বসে বাড়ির পিছনে পরিত্যক্ত গোয়ালঘরটার দিকে অপার বিস্ময় নিয়ে চেয়ে থাকতাম। সেই লাল আকাশ লাল পৃথিবী আমাকে আহ্বান করতো, আমি শিমুল গাছের ছায়ায় বসে সেই আহ্বান শুনতে পেতাম।
তারপর আবার একদিন বিকালবেলা সেই ছোট্ট জানালা টপকে ওপারে চলে গেলাম। ফিরেও এলাম, প্রথমবারে যে চূড়ান্ত ভয় নিয়ে ফিরে এসেছিলাম এবার আর তা হলনা, বরং এবারে ভয়ের চেয়ে কৌতূহল বাড়ল। এবারেই নিশ্চিত বুঝলাম ওই লাল পৃথিবীতে সময় থমকে আছে, ওখানে আমি হেসেখেলে কাটিয়ে আসতে পারি কয়েক হাজার বছর। এই বিশাল গতিশীল পৃথিবীর মধ্যে ওই ছোট্ট জানালার ওপারের লাল পৃথিবী একটা জলজ্যান্ত ফাঁকি, ওখানে ঘড়ির টিকটিক শব্দ শোনা যায়না, ওখানে খিদে তৃষ্ণা নেই।
এরপর প্রতিদিন নিয়ম করে আমি যেতাম ওখানে, সেই দুনিয়ার রাজা ভাবতাম নিজেকে, নিজের রাজত্বের ভাগ আর কাউকে দিতে চাইনি বলেই আমি আর কাউকে এই গোপন জানালার কথা বলিনি, বরং আবর্জনা দিয়ে ঢেকে রেখেছিলাম সেই প্রবেশ দ্বার। আমাদের রোজকার চেনা পরিচিত এই বহুভোগ্যা পৃথিবীতে এমন জানালা হয়তো আরও আছে, হয়তো আরও অনেকে এমন জানালার খবর জানে, আমি নিশ্চিত তারাও সে খবর বুকের মাঝে গোপন রাখে, এসব খবর কেউ বাজারে বিক্রি করেনা। নাসার ক্যামেরায় এই দুনিয়ার ছবি ওঠেনা।
চব্বিশ ঘণ্টার নিয়ম ভেঙে আমি প্রায়ই হাড়িয়ে যেতাম, এমনকি পরীক্ষার আগের দিন বেশীক্ষণ পড়াশুনা করার জন্যেও আমি আমার লাল দুনিয়ায় যেতাম, অতিরিক্ত সময় পড়া করার ইচ্ছে নিয়ে, তাতে কতোটা পড়া হতো জানিনা, কিন্তু বেশ আত্মতৃপ্তি অনুভব করতাম। অবসর সময়ে আমি কলম্বাসের মতো অভিযানে বেরতাম, পাহাড় পর্বতের নাম দিতাম ইচ্ছে মতো, তবে বিশাল সে দুনিয়ার কোন শেষ কখনো নির্ধারণ করতে পারিনি, পাহাড় পর্বত জঙ্গল সমুদ্র নদী থেকে বাড়ি ঘর ধুধু প্রান্তর… সব আছে, কিন্তু সেখানে কখনো কোন জীব দেখিনি, যে উদ্ভিদদের দেখি তারাও যেন জীবিত নয়, হয়তো তারা মুহূর্তের জালে আটকা পড়েছে, তাদের পাতা কাঁপে না কখনো। এখানে এসে আমার নিঃশ্বাস নেওয়ার প্রয়োজন হয়না, একটা স্তব্ধ মুহূর্ত যেখানে সমস্ত কিছু থেমে আছে সেখানে আমি একা চলমান, এক নিঃশ্বাসে আমি বেঁচে থাকতে পারি, এখানে আমার শ্বাস কষ্ট হয়না।
পাঠক আমার গল্প তোমার নিশ্চয় আজগুবি মনে হচ্ছে, আমি তোমাকে দোষ দেবনা, শুধু বলবো এই পৃথিবীতে অদ্ভুত ঘটনা ঘটে বিস্তর, তুমি মনকে সবসময় সরলরৈখিক করে রেখোনা।
ওই লাল পৃথিবী যেন আমার প্রভু হয়ে উঠছিল ক্রমশ। আমি নিজের অস্তিত্ব হাড়িয়ে ফেলছিলাম, দৈনন্দিন পৃথিবী আমার আর ভালো লাগতো না, এতো আওয়াজ এতো মানুষ এই সকলের কাছ থেকে পালীয়ে আমি সবসময় ওই লাল রঙের মধ্যে বিলীন হয়ে যেতে চাইতাম, ফিরতে মন চাইত না।
সবসময় অন্যমনস্ক থাকতাম, কথা বলতে বিরক্তি হতো, মা আমার এই আকস্মিক পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছিল, মনে পরে সারাদিন ঠাকুরঘরে বসে নিবিষ্ট মনে তেত্রিশকোটি দেবদেবীর কাছে পুত্রের মঙ্গলের জন্যে প্রার্থনা করত মা। আমার বন্ধুভাগ্য কখনোই ভালো ছিল না, যেটুকু ছিল এই সময়ে তা একেবারে শূন্যে পৌঁছে যায়। ক্লাসের শেষ বেঞ্চে একা বসতাম, চোখ বন্ধ করে কি ভাবতাম আজ আর মনে পরে না, একদিন হঠাৎ শুনি কে যেন ডাকল আমায়, চোখ মেলে দেখি অপর্ণা।
-কি হয়েছে তোর?
-আমার?
-আজকাল খুব অন্য অন্যমনস্ক দেখি, বাড়িতে কোন সমস্যা?
-কই কিছু হয়নি তো…
অপর্ণা চেয়ে থাকে আমার দিকে বেশ কিছুক্ষণ, ওর চোখে পলক পড়েনা। এই সময়ে আমি প্রথম অনুভব করি অপর্ণার প্রতি আমার ভালোবাসায় খাদ এসেছে, অপর্ণা আমার সাথে আগে কখনো কথা বলেনি, আজ প্রথম, অথচ আমার মধ্যে যে প্রচণ্ড পাগল পাগল ভাব সৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল তেমনটা হল না, আমি যেন বড্ড শীতল হয়ে পড়েছি।
মানুষ বড় বিচিত্র প্রাণী, এই জনঅরণ্যে দাঁড়িয়ে খালি মনে হয়, এতো মানুষ এতো চিন্তা, এসবের উৎস কি? কে নিয়ন্ত্রণ করে এই চিন্তা সমষ্টি? মৃত মানুষের না বলা কথা একেবারে মুছে যায় নাকি কোথাও জমা থাকে? আরও তিনদিন পরে অপর্ণা আমাকে প্রেমপত্র দিয়েছিল, আমি সে চিঠি পড়েছিলাম আমার একান্ত একার লাল দুনিয়ার লালপ্রাসাদের ছাদে শুয়ে শুয়ে। অপর্ণা বড় ভালো লেখে, আমি ওর সব শব্দের মানে বুঝিনি, তবে এটুকু বুঝেছিলাম অপর্ণাকে অনেকদুরের নক্ষত্র মনে করে যে ভালোবাসা বুকের মধ্যে জড়ো করেছিলাম, অপর্ণা আমার কাছে ধরা দিতেই সেই ভালোবাসার ঘনত্ব কমতে শুরু করেছে, আমি চেয়েও তাকে আর আগলে রাখতে পারছিনা। তবু আমার সাথে অপর্ণার প্রেমটা হয়ে গেল।
সেদিন ভাবতেও পারিনি সেদিনের সেই অপর্ণাই একদিন আমার স্ত্রী হয়ে উঠবে। আমি অপর্ণাকে ভালোবাসি কিন্তু ওকে আমি আমার জীবনের সব কথা বলতে পারিনি, হয়তো বলা উচিৎ ছিল, অথবা ছিল না, আমি নিশ্চিত নই।
অপর্ণাকে পেয়ে যাওয়ার ঠিক পরেই কবিতা আমাকে ছেড়ে চলে যায়। অপর্ণাকে আমি কখনো আমার নিজস্ব দুনিয়ার কথা বলিনি, কিন্তু জীবনে প্রথম নারী সঙ্গ আমার জীবনে কিছুটা বদল এনেছিল, আমি রোজরোজ আর জানালা টপকে ওপারে যেতাম না। কোনো কোনোদিন ছাদে বসে শুধু অপর্ণার কথা চিন্তা করে কাটিয়ে দিতাম। আমার মনে হতো অপর্ণাকে পাওয়া সম্ভব নয় জেনে আমি ওকে যতটা ভালোবাসবো ভেবেছিলাম পেয়ে বুঝি ততটা ভালোবাসতে পারিনি, এই মনে হওয়া থেকে আমার মনে যেন একটা অপরাধবোধ সৃষ্টি হয়, আমি অপর্ণাকে আরও বেশি ভালোবাসার চেষ্টা করতে থাকি। অপর্ণা অবশ্য কখনো আমাকে নিয়ে কোন অভিযোগ করেনি, ওর কাছে জীবন সরলরৈখিক, তোমাকে ভালোবাসি মানে তুমি আমার, এখানেই শুরু এখানেই শেষ, ও জটিলতা বোঝে না, আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন ভালোবাসলে আমায়? অপর্ণা বলেছিল ‘কারণ নেই, কারণ থাকলে বাসতাম না, কারণ নেই বলেই বাসি…’ আমার উত্তরটা ভালো লেগেছিল।
(৪)
অপর্ণার সাথে আমার প্রেম শুরু হওয়ার মাস কয়েক পরের ঘটনা, ছুটির দিন, সকাল থেকে বৃষ্টি, সারাটাদিন জানালা দিয়ে আমি সেই বৃষ্টির জল উপচানো পুকুরটার দিকে চেয়ে থেকেছি, পরীক্ষা হয়ে গেছে হাতে কোন কাজ নেই আমার, অপর্ণার সাথে দেখা করতে যাওয়ার কথা ছিল বিকালে, বৃষ্টির জলে সেসব পরিকল্পনা ধুয়ে মুছে গেছে। অনন্ত অবসরে পুকুরটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে বেশ কিছুদিন পরে আবার আমাকে সেই জানালাটা টানতে শুরু করল।
শেষ বিকালে বৃষ্টি একটু ধরেছে তখন, আকাশ জুড়ে বিরাট রামধনু, আমি মন্ত্রচালিত হয়ে জানালা পার হয়ে চলে এলাম লাল দেশে। কতো ঘণ্টা অথবা কতো বছর ছিলাম সেখানে তার কোন হিসেব নেই। অবশেষে একসময় যখন শরীরে ক্লান্তি এল, যখন আবার চেনা গতিশীল পৃথিবীতে ফিরে আসার ইচ্ছে হতে প্রাসাদ থেকে নেমে এসে লাল শস্য খেতের মধ্যে দিয়ে আল পথে ফিরছিলাম, এই সময়ে হঠাৎ লক্ষ করলাম মাঠের মধ্যের একটা নির্দিষ্ট অংশের ধানের শিষগুলো যেন দুলছে, এই দেশে সেই আমার দেখা প্রথম গতি, বুক কেঁপে উঠল, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম সত্যি মিথ্যা এবং অবশেষে কিছু না বুঝেই সটান মাঠের মধ্যে নেমে পড়লাম।
কতোটা পথ আমি অনুমান করতে পারিনি, মাঠে নেমে বুঝলাম পথ বড় কম নয়, যত এগিয়ে যায়, গন্তব্য মনে হয় তত দূর। অবশেষে একসময় পৌঁছলাম।
মাঠের মধ্যে ধানের শিষের আড়ালে এক নারী বসে আছে, একজায়গায় বুঝি কয়েকবছর দাঁড়িয়ে ছিলাম, আমার চোখদুটো আটকা পড়েছে, আমি চেয়েও তাদের অন্য কোথাও সরাতে পারছিনা। নিরাভরণ সেই নারী হয় আমাকে লক্ষ করেনি, অথবা লক্ষ করার প্রয়োজন বোধ করেনি।
আমি চুরি করে তাকে দেখছিলাম, ডান হাতে তার ধারাল ছুড়ি, ছুড়ি দিয়ে সে নিজের বাঁ হাত কেটে সেই রক্তে পরম মমতায় রাঙ্গিয়ে তুলছে ধানের শীষ।
কতো সহস্র বছর আমি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলাম জানিনা, হয়তো কয়েক আলোকবর্ষ, হিসেব নেই, সময় থমকে আছে মুহূর্তে। তারপর একসময় সেই নারী ধানের শিষে রক্ত মাখাতে মাখাতে হঠাৎ থমকে গেল, মুখ তুলে চেয়ে দেখল আমার দিকে, ওর দৃষ্টির অভিঘাতে আমি যেন দুলে উঠলাম, সে আমার দিকে চেয়েছিল, চোখে কোন প্রশ্ন নেই কোন অভিযোগ নেই, এক শূন্য দৃষ্টি অনেকক্ষণ পরে একসময় সে আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল, আমি এগিয়ে গেলাম, কাছে বসলাম। এই রমণী নিশ্চয় মানুষ নয়, হয়তো দেবী, অথবা পুরান থেকে উঠে আসা কোন অপ্সরা, উর্বশী রম্ভা অথবা অন্য কেউ, আমি আগে কখনো নগ্ন নারী দেখিনি, আমার চোখে লোভ ধরা পড়েছিল নিশ্চয়। আমার যতটা ভয় পাওয়া উচিৎ ছিল ততটা ভয় আমি পাইনি নিশ্চয়, বেশ আত্মবিশ্বাসী গলায় প্রশ্ন করলাম কে তুমি?
সে ঠোঁটে তর্জনী ছুঁইয়ে আমাকে কথা বলতে বারণ করল, আমি বাধ্য বালকের মতো তার কথা শুনে চুপ করে তাকে দেখতে লাগলাম, আর সে ফোঁটা ফোঁটা রক্তে রাঙ্গাতে থাকল পৃথিবী, আমি সে ঘটনার নীরব সাক্ষী থাকলাম আর সময় রইল ধ্রুবক হয়ে।
তারপর একসময় আমি আবার প্রশ্ন করলাম, ঠিক প্রশ্ন নয় অনুরোধ, ‘তোমার কাছে আমাকে থাকতে দেবে?’
সে যেন চমকে উঠল, তাকাল আমার দিকে, হাসল, ‘রেখেছি তো…’
সেই প্রথম আমি ওর কণ্ঠ শুনলাম। তারপর আবার কেটে গেল কয়েকদিন মাস বছর অথবা অনন্তকাল।
আমি ধানের খেতের আলের উপর বসে রইলাম, ওকে দেখতে থাকলাম, সে তখন একের পর এক লাল ধানের শিষ তাজা রক্তে নতুন করে রাঙ্গিয়ে তুলছে। একসময় থাকতে না পেড়ে আমি উঠে গিয়ে ওর কাছ ঘেঁসে বসি, ও আমার দিকে তাকিয়ে অল্প হাসে যেন, আমি সাহস পেয়ে ওকে ছোঁয়ার চেষ্টা করি, সে ছিটকে সরে যায়, এই প্রত্যাখ্যানে আমার কষ্ট হয়, ও বোধহয় সেকথা বুঝতে পারে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে বলে, ‘আমায় ছুঁলে তোমার ঘরে ফেরার জানালা বন্ধ হয়ে যাবে, ভেবে নাও…’
আমি ভাবতে পারিনা, প্রত্যাখ্যাত হয়ে আমার শরীরে যেন আগুণ জ্বলে উঠেছিল, স্থির হয়ে বসে থাকি কিছুক্ষণ, তারপর ছুটতে শুরু করি, পিছন থেকে সুরেলা কণ্ঠ চিৎকার করে আমায় বলে ‘আবার এসো…’ আমি উত্তর দিই না… সামনে অনন্ত পথ…
জানালা অতিক্রম করে ফিরে আসি, রামধনু মুছে যাচ্ছে, আবার বৃষ্টি শুরু হয়েছে, বাগানে এসে দাঁড়াতেই মাথায় কয়েকফোঁটা বৃষ্টি পরে, সেই মুহূর্তে এই গতিশীল মরণশীল পৃথিবীকে নতুন করে ভালোবেশে ফেলি। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি, ওই অভিশপ্ত নগরে আর কখনো যাবো না।
দিন যায়, মাস যায়, চোখের সামনে থেকে সে নগ্ন নারীকে সরাতে পারিনা কিছুতেই, একদিন সন্ধ্যায় কলেজ থেকে ফেরার সময় অপর্ণাকে নিয়ে অন্ধকার একটা গলিতে ঢুকে পরি, অতর্কিতে ওকে জাপটে ধরে ঠোঁটের মধ্যে ঠোঁট গুঁজে দি, অপর্ণা ছটফট করে ওঠে, জোর করে ছাড়িয়ে নেয় নিজেকে, অন্ধকারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি আমরা দুজনে দুজনের দিকে চেয়ে, অপর্ণা বলে, ‘এখনই না মন, আমি এখনই প্রস্তুত নই…প্লিজ জোর করো না…’
সেদিনই গভীর রাতে আমার প্রতিজ্ঞার রঙ্গিন কাঁচ টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পরে। বাড়ির সকলে ঘুমিয়ে পড়লে পা টিপে টিপে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসি, জানালা পেড়িয়ে চলে যায় রূপকথার দেশে, সে রাতে হয়তো কয়েক বছর ধরে আমি তাকে খুঁজেছিলাম কোথাও পাইনি, সেই ধানক্ষেতে যেখানে ওকে দেখেছিলাম সেখানে বসে একা একা কেঁদেছিলাম, সময়ের কোন হিসেব নেই।
অপর্ণা হঠাৎ অসহ্য হয়ে ওঠে আমার কাছে, কলেজ যাওয়া বন্ধ করেদি। আবার চূড়ান্ত একাকীত্ব গ্রাস করে নেয় আমাকে। প্রতিদিন আমি লাল দেশে পাগলের মতো সেই নগ্ন সুন্দরীকে খুঁজে বেড়াই, চিৎকার করে ডাকি, কেউ উত্তর দেয়না, যেন কেউ ছিলই না কখনো এই লাল রক্তের দেশে। রাজপ্রাসাদে আমি একা বসে থাকি।
যখন ভেবেই নিয়েছি সব আমার মনের ভুল অথবা নিয়তির নিষ্ঠুর ছলনা তখনই একদিন আমি ফিরে পাই তাকে, লাল নদীর জলে সাঁতার কাটছিল সে, আমি পারে গিয়ে দাঁড়াতে সে জল থেকে উঠে আসে। আমি বলি, ‘আমি এসেছি…’
সে বলে, ‘এসো…’
আমি বলি, ‘ভালোবাসি…’
সে বলে, ‘ভালোবাসো…’
আমি তাকে জড়িয়ে ধরি, সে খুব সহজভাবে ধরা দেয়। আমরা নদীর ধারে শুয়ে বসে কাটিয়ে দি যুগের পর যুগ।
অলস শরীরে পরস্পরের চুলে বিলি কাটতে কাটতে আমাদের কথোপকথন চলে,
-এ কোন দেশ?
-আমার দেশ।
-কি নাম এ দেশের?
-নাম দিই নি…
আমি ওর কপালে চুমু খেয়ে বলি, ‘তোমার দেশের বাকি লোকজন সব কোথায় গেল?’ উত্তরে সে চোখ টিপে আমাকে বলে তারা নাকি আমার সেই চেনা পৃথিবীতে গেছে, ফিরে আসবে বলেছিল, কথা রাখেনি অথবা হয়তো পারেনি।
আমি চুপ করে থাকি, ও হাত বাড়িয়ে অঞ্জলি ভরে নদী থেকে লাল জল নিয়ে আমার গায়ে ছিটিয়ে দেয়, আমার বাড়ির পাশের ফাঁকা এক ফালি জমি তোমাদের তোমাদের ধার দিয়েছি, তোমরা আমার সেই ছোট্ট বাগানটুকু নিয়েই খুশি আছো দেখে আমার করুণা হয়।
-কে তুমি?
সে হাসে, জবাব দেয়না, ‘বলো বলতেই হবে…’
-তোমার প্রেয়সী…
আমি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম সে, আমাকে থামিয়ে দেয়, হাত ধরে টেনে নদীতে নামায়, এক আদিঅন্তহীন স্থির জলরাশিতে আমাদের শরীর ভিজতে থাকে।
(৫)
জীবনে আমি যা চেয়েছি, তাই পেয়েছি, আর যখন যা পেয়েছি তাতেই আমার অরুচি এসেছে, কোন কিছুতেই দীর্ঘদিনের জন্য মন বসাতে পারিনি, অনেক কষ্টে জীবনের এক প্রান্তে পৌঁছে মনে হয়েছে সুখ ফেলে এসেছি অন্য প্রান্তে।
এই লাল দুনিয়ায় আমার কোন দুখ্য ছিল না, অভাব ছিলনা, শুধু আমার জীবন থেকে সময় হারিয়ে গেছিল। আর শুধু সেই সময়ের অভাব সেই ঘড়ির কাঁটার শব্দের অভাবটুকুই এক সময় যেন আমার জীবনে প্রধান হয়ে ওঠে, ফিরতে পারবো না বোঝার পরেই ফেরার ইচ্ছে তীব্র হয়ে ওঠে।
অনন্ত অবকাশ পরে আছে এখানে, ক্ষিদে নেই, ক্লান্তি নেই, মৃত্যু নেই, আছে শুধু এক ক্লান্তিকর জীবন। ভালোবেসে বেসে ক্লান্ত হয়ে পরে শরীর মন। নদীর জলে আমি একটু স্রোত চাই, গাছের পাতায় চাই একটু কাঁপন।
আমার মনের অবস্থা বুঝতে পেড়ে সে নারী হাসে, যে হাসি আগে মধুর লাগতো এখন তাই বড় নিষ্ঠুর মনে হয়, জিজ্ঞেস করি, ‘তুমি পারো না এ দেশের বন্ধ ঘড়ি ফের চালাতে?’
-সময় তোমার মনের ভুল মন, সময় তো স্থির, এই অসীম ব্রহ্মাণ্ডে সময় তুমি মাপবে কিসের সাপেক্ষে, এখানে তো সূর্য চন্দ্র নেই। এখানে কেউ কাউকে কেন্দ্র করে ঘুরছে না, দিন হচ্ছে না রাত হচ্ছে না। তুমি এ মহাবিশ্বের কেন্দ্রে বসে আছো, এখানে ধ্রুবক হল কাল। সময়ের শুরু এখান থেকে। তোমাকে আমি শুরুর মুহূর্তে আটকে রেখেছি।
-তবে এই গাছ পালা এই প্রাসাদ এই রাস্তা…এসব কি!
-এসব শুধু তুমি আসবে বলে বানিয়ে রেখেছি…
-আমি আসব বলে?
সে হাসে বড় অদ্ভুত সে হাসি, দেখে ভয় হয় আমার। সে আমার হাত ধরে বলে, ‘মনে পরে সেদিন তোমাকে বলেছিলাম, তোমার জন্য আমার রক্তে রাঙ্গিয়ে এক দেশ তৈরি করবো, এই নাও মন, চেয়ে দেখো এই সে দেশ… এ দেশ আজ আমি তোমাকে দিলাম…’
আমার কিচ্ছু মনে পড়ছে না, আমি মন, আমি এসব কিছু জানিনা, তুমি ভুল করছ, আমি সে নই, যার জন্যে তোমার এতো কষ্ট, এতো আয়োজন।
সে হাসতে থাকে। ভালোবাসার শিকলে আমি বন্দী থাকি, সহস্র বছর, অনন্ত কাল।
এই সময়ে আমার পূর্ববর্তী জীবনের ছোট ছোট দুঃখ সুখ মনের মধ্যে সুখস্মৃতি হয়ে ফিরে আসে, মায়ের মুখ মনে পরে, অপর্ণাকে মনে পরে, নিঃশব্দ জমিদার বাড়িতে গভীর রাতে বাবার হেঁটে চলার শব্দ মনে আসে, কতকাল আমি সূর্যোদয় দেখিনি, আর হয়তো কখনো দেখতে পাবো না, ওকে জিজ্ঞেস করলে ও বলবে, ‘বড় করে ভাবো মন, এই মহাবিশ্বে সূর্য একটা বিন্দু ছাড়া আর কিছু নয়।’
আমি যে হারিয়ে গেছি সে কথা কেউ কখনো জানতে পারবে না। আমি সময়ের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে এসেছি, যে নারী শরীরের লোভে বাড়ি ছেড়েছিলাম তার প্রতি আজ আর কোন আকর্ষণ বোধ করিনা, একদিন সে বুঝতে পারে আমার মনের কথা, আদর করতে ক্লান্তি দেখে সে বুঝি আহত হয়, আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘আমি তো তোমাকে জোর করে আনিনি মন, তুমি স্বেচ্ছায় এসেছ, আমি তো শুধু অপেক্ষা করেছিলাম…’ জিজ্ঞেস করি ‘ফিরে যাওয়ার কি কোন উপায় নেই?’
সে হাসে, আমাকে সাথে করে নিয়ে অনেক দূরে কোথাও যায়, সামনে দিগন্ত বিস্তৃত লাল সমুদ্র।
সে সমুদ্র দেখিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “দেখো মন তোমার এই সমুদ্র কি আর ভালো লাগেনা?”
আমি বলি, “লাগে না”।
সে লাল পাহাড় দেখায়। আমি বলি ভালো লাগে না, এভাবেই সে একেএকে লাল আকাশ, লাল জঙ্গল সব কিছু আলাদা আলাদা করে দেখায় আমাকে, প্রতিবার জিজ্ঞেস করে, ‘মন এ সবের কিছুই কি তোমার আর ভালো লাগে না?’
আমি বলি, “লাগে না”।
তখন সে আমার হাত টেনে নিয়ে নিজের নরম বুকে রাখে, “আমাকেও ভালো লাগে না মন? এই শরীরটাও ভালো লাগে না?”
আমি চুপ করে থাকি।
সে আবার জিজ্ঞেস করে।
এবারে আমি হঠাৎ চিৎকার করে উঠি, ‘না লাগে না, ভালো লাগে না। আমার গতি ভালো লাগে… আমি অমরত্ব চাইনা…’
আমি এভাবে সরাসরি না বলে বুঝি তাকে ব্যাথা দিয়েছিলেম, সে আমার হাত ছেড়ে করুণ গলায় জিজ্ঞেস করে, তুমি সত্যি ফিরে যেতে চাও?
-চাই।
আমার হাতে ছুরি তুলে দেয় সে, ‘উপায় আছে, তোমার হাতে আমার মৃত্যুই উপায়…
বেশি ভাবতে পারি না, বেশি চিন্তা মানুষকে অসহায় করে তোলে। আমি ছুরি হাতে নিয়ে ওর কপালে ঠোঁট ছোঁয়াই, কানে কানে বলি, ‘শক্তি দাও…’ সে বলে, ‘দিলাম…’ আমি ছুরির ফলা ওর নরম বুকে বিঁধিয়ে দি। ও আমাকে ছেড়ে দেয়, লাল মাটির উপর ও পরে যায়। যেন আকাশ থেকে পালক খসে পরে মাটিতে, শুয়ে শুয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকে, ‘যাও মন…যাও…’ জিজ্ঞেস করি, ‘কি হবে তোমার এই দুনিয়ার?’ সে বলে ‘সব থাকবে যেমন আছে, মাঝে মাঝে তুমি এসে দেখে যেও…’
আমি ছুটতে থাকি…
(৬)
আমার গল্প এখানেই শেষ।
আজ পনেরো বছর পরে সেসব দিন স্মৃতির পাতায় ঝাপসা। অপর্ণাকে একদিন আভাষ দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম, সে বলেছিল, ‘ভালো করে ঘুমাও না কতদিন বলতো?’
বাবা মা এখন ওই বাড়িতে থাকেনা আর, সে জীর্ণ গোয়ালঘর ভেঙে পড়েছে আজ বহু বছর, স্ত্রী পুত্র নিয়ে সুখী সংসার আমার, শুধু মাঝে মাঝে স্মৃতির ঘরের দরজা খুলে ফেলি অজান্তে তখন হঠাৎ একটা লাল আকাশ দেখতে পাই, কে ছিল ও? সেসব অনন্ত মুহূর্ত আমার মৃত্যুর সাথে সাথে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে ভেবে কষ্ট হয়। আমি ওকে খুন করেছি, এখনো স্বপ্নে আমি রক্ত দেখি। সবাই জানে আমি লাল রঙ দেখলে আতঙ্কিত হয়ে পরি, সেই কলেজের সময় থেকেই আমাকে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতে হয়। কিন্তু আমার কোন রোগ জ্বালা হয়না কখনো, সেই পৃথিবী থেকে ফিরে আসার পর আমার কখনো একবারের জন্যেও শরীর খারাপ হয়নি, আমার ভয় হয়, মনে হয় আমি অমর নই তো? আমি মরতে চাই, আর সকলের মতো, এই পৃথিবীতে অনন্তকাল বেঁচে থাকার কোন ইচ্ছে নেই আমার।
বহুদিন পর, গত সপ্তাহে সেই বাড়িটায় ঘুরতে গেছিলাম আমরা সবাই, বাড়িটা বিক্রি করার চেষ্টা হচ্ছে অনেকদিন, এতো বড় বাড়ির খরিদ্দার নেই, প্রমোটারের সাথে কথা হচ্ছে, হয়তো ফ্ল্যাট হতে পারে। বাবার জমিদার সাজার শখ মরে গেছে আজ অনেক বছর। আমি সবার অলক্ষে সেই গোয়ালঘরের জায়গাটায় গেছিলাম, সেখানে এখন বুনো গাছের জঙ্গল, ভাঙ্গা দেওয়ালে বট, অশ্বত্থ,একটা স্থলপদ্ম।
চারিদিকে তাকিয়ে হঠাৎ আমি উবু হয়ে বসে মাটির কাছে মুখ এনে ফিসফিস করেছিলাম, ‘শুনছো?’
স্পষ্ট শুনি কে যেন বলে, ‘আসবে? খুলে দেবো জানালা?’
এ কণ্ঠ আমার মনের ভুল হতে পারে, আমি নিশ্চিত বলতে পারিনা। আমার ছুরির আঘাতে ও কি মারা গেছিল? যেখানে সময় ধ্রুবক সেখানে কি মৃত্যু আসতে পারে? আমি জানিনা, তবে আমি আর বাড়ির ওদিকে যায়নি। নিজের পরিবারের সকলের মধ্যে ফিরে এসে নিশ্চিন্ত বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে থরথর করে কেঁপে উঠেছিলাম। ছেলে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিল বাবা তুমি কাঁপছ কেন?
এই জায়গায় ফ্ল্যাট হলে ওই গোয়ালঘরের জায়গাটা আমি আর চিনতে পারবো না। কিন্তু আমার যদি মৃত্যু না হয় তবে আমাকে তো ওখানেই ফিরে যেতে হবে। এই গতিশীল পৃথিবীতে অমর মানুষ মানায় না।
মনে পরে আমাকে সে বলেছিল, এই চেনা পৃথিবীতে অনেক ফাঁকফোকর আছে, খুঁজতে জানলে হাতের কাছেই খুঁজে পাওয়া যায় অলৌকিক, আমি জানিনা আমি আবার কখনো ওকে খুঁজে পাবো কিনা, কোনোদিন ওর রহস্য উদঘাটন করতে পারবো কিনা, আমি এও জানিনা আমার সাথে ওর কেমন সম্পর্ক, তবে এটুকু নিশ্চিত বলতে পারি, আমি ভালোবেসেছিলাম, প্রথম যৌবনের সেই ভালোবাসায় কোন খাদ ছিলনা।
****************************
Tags: ইমন চৌধুরী, কল্পবিজ্ঞান গল্প, কল্পবিজ্ঞান গল্প, তৃতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, তৃষা আঢ্য, পাঙ্ক স্পেশাল, মিথপাঙ্ক
অসাধারণ ভাবনা। খুব রোমান্টিক এক ফ্যান্টাসির জগৎ এঁকেছে। খুব ভালো লাগল।