রবিকিরণ দাশগুপ্তের কেস-ডায়েরি
লেখক: সৌম্য সুন্দর মুখোপাধ্যায়
শিল্পী: সৌরভ ঘোষ
কেস এন্ট্রি: ১৮
মে, ২০৯১
ঘরে ঢুকে দেখলাম কর্নেল আয়ার বসে আছেন মেরুদণ্ড সোজা করে। তাঁর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল তিনি একটু বিরক্ত। সেটা অস্বাভাবিক নয়; উচ্চপদস্থ অফিসার তিনি; আমার জন্য পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করাকেও তিনি সময় নষ্ট মনে করতেই পারেন।
আমাকে দেখে কর্নেল আয়ার বললেন, “এই যে দাশগুপ্তা। মেল পেয়েছেন নিশ্চয়ই। রেডি তো?”
আমি বললাম, “হুঁ, রেডি তো হয়েই আছি। গাড়ি এনেছেন?”
কথাটার সোজা উত্তর না দিয়ে তিনি বললেন, “বাইরে রোদ কিন্তু সাংঘাতিক। তবে আমাদের অভ্যাস আছে। জিপের হুড আছে বটে, কিন্তু রোদের হলকা তাতে আটকাবে না।”
আমি বললাম, “আপনার মতো অনেক না হলেও আমারও এ অঞ্চলে কম দিন হল না, কর্নেল আয়ার। একচল্লিশ ডিগ্রি তো মোটে। চলুন, যাওয়া যাক। বডি কেউ ছোঁয়নি তো?”
কর্নেল বললেন, “না। যেমনটি পাওয়া গেছে, তেমনটিই রাখা আছে। আপনাদের ফরেন্সিক টিম অবশ্য কাজ শুরু করেছে। আমাকে ব্রিগেডিয়ার শর্মা পাঠালেন আপনাকে নিয়ে আসতে।”
গাড়িতে উঠতে যাচ্ছি, এমন সময় কর্নেল আয়ার বললেন, “অস্ত্র নিলেন না?”
আমি হাসলাম, “নাঃ, ওই ফিংগারপ্রিন্ট অ্যাক্টিভেটেড রিভলভার আমার পোষায় না। রোজ সকালে ডিউটিতে এসে চব্বিশ ঘন্টার জন্য সার্ভারে লগ ইন করো, তারপর অ্যাক্টিভেশন পারমিশন নিয়ে বন্দুকের গায়ে আঙুল ঠেকিয়ে নিজের আইডেন্টিটি প্রুফ দাও— অত হ্যাপা আমার ভালো লাগে না। ওপর মহলে দরখাস্ত দিয়েছি আমাকে পুরনো মডেলের, মানে একুশ শতকের শুরুর দিকের একটা ম্যানুয়্যাল অস্ত্র দেওয়ার আবেদন করে। নতুনগুলোর মতো এত নিখুঁত, এত শক্তিশালী না হলেও আমার চলবে। আমাকে তো আর ফিল্ডওয়ার্ক বেশি করতে হয় না।”
কর্নেল একবার তাঁর কোমরের হলস্টারে ঝোলানো বন্দুকটার গায়ে আদর করে হাত বুলিয়ে নিলেন। “যা-ই বলুন দাশগুপ্তা, এই নতুন মডেলগুলোর মতো এত মারাত্মক লেথাল প্রিসিশন কমই দেখেছি। আমাদের অবশ্য রোজ গান-সার্ভারে লগ ইন করার ঝামেলা নেই। একবার করলেই গোটা সপ্তাহের পারমিশন পাওয়া যায়।”
জিপে উঠলাম আমি। কর্নেল ড্রাইভারের আসনে বসে গাড়ি চালাতে শুরু করলেন। থর মরুভূমির একদম গা ঘেঁষে যাব আমরা; উষ্ণতা যেন গা পুড়িয়ে দিচ্ছে। গাড়ির ভেতরটা গরম হয়ে আছে, সিটটাতে বসতেই পেছনটাতে ছ্যাঁকা লাগল।
কর্নেল আড়চোখে নজর রেখেছিলেন। আমার মুখ হালকা কুঁচকে গেছে দেখে হেসে উঠলেন, “এই ফিলিংটাকে আমরা সৈনিক মহলে বলি, ‘বেবুনের পেছন’। ফিরে গিয়ে খুলে দেখবেন, লাল হয়ে গেছে।”
আমি আরেকটু মুখ বিকৃত করলাম। কর্নেল আয়ার দিলখোলা প্রকৃতির মানুষ; কথায় কথায় হেসে ওঠা তাঁর কথা বলার একটা ধরণের মধ্যেই পড়ে। ওঁর অধীনে কর্মরত একজন বিজ্ঞানী মারা গেছেন, অথচ ভদ্রলোক তা নিয়ে আদৌ চিন্তিত নন, বিষণ্ণতা তো অনেক দূরের কথা।
হয়তো যারা সারা জীবনে যুদ্ধক্ষেত্রে অনেক মানুষের মৃত্যু দেখে, জীবন সম্বন্ধে তাদের এ উদাসীনতা এসেই যায়।
আমি বললাম, “ডক্টর ভূষণ সাক্সেনা, মানে যিনি মারা গেছেন, তাঁর ফাইলটা পড়ছিলাম। বেশ জ্ঞানী মানুষ ছিলেন তো।”
কর্নেল বললেন, “হ্যাঁ, যে ডেজার্ট গ্রিনিং পদ্ধতি চলছে বেশ কয়েক একর জায়গায়, তার পরিকল্পনা অনেকটাই ওঁর ছিল।”
মরুভূমির রিক্ত বালুকাময় প্রান্তদেশ দিয়ে আমাদের গাড়ি চলেছে। রোদের তাপ মুখে লাগছে। বালি উড়ে যাচ্ছে জোরালো বাতাসে হু-হু করে। অনেকটা দূরে দেখা যাচ্ছে এই নিঃসীম, রুক্ষ্ম, হলুদ বালিয়াড়ির সমুদ্রের মাঝখানে সবুজের একটু আভা। ভারত সরকার অবশেষে পরিবেশ রক্ষার গুরুত্ব কিছুটা হলেও বুঝেছেন এতদিনে। থর মরুভূমির কয়েক একর অংশে পরীক্ষামূলকভাবে টেরাফর্মিং-এর কাজ শুরু হয়েছে। অনেক টাকা ইনভেস্ট করা হয়েছে এই ‘গ্রিনথর’ প্রজেক্টে; সরকারি হেলিকপ্টার পর্যন্ত বরাদ্দ হয়েছে দুটি, বিজ্ঞানীদের স্পটে যাওয়া ও বেসক্যাম্পে ফেরার সুবিধার জন্য। নিকটবর্তী একটা গ্রামে কয়েকদিন গিয়ে থেকেও এসেছিলেন নাকি প্রজেক্টের অনেক বিজ্ঞানী সদস্য; তাঁদের সঙ্গে কর্নেল আয়ারও ছিলেন— উনিই চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন একটা হেলিকপ্টার।
আর একজন চেনা লোক আছে আমার এই দলে। ক্যাপ্টেন লক্ষ্মীপতি সাহা— আমার ছোটবেলার বন্ধু। এখন সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার পাইলট— বর্তমানে এই কর্নেল আয়ারই ওর উপরওয়ালা।
এখন অবশ্য ডক্টর ভূষণ সাক্সেনার মৃত্যুর বিষয়টাই ঘুরছে মাথার মধ্যে। গ্রিনথর প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের একটা লিস্ট আমাকে আগেই পাঠিয়ে দিয়েছেন ব্রিগেডিয়ার শর্মা। মোবাইলের চওড়া স্ক্রিনে ব্রাইটনেস বাড়িয়ে সেটাই দেখছিলাম আমি।
লক্ষ্মীপতি সাহা, কর্নেল আয়ার এবং স্বয়ং ব্রিগেডিয়ারকে ছাড়া আমি কাউকেই চিনি না। তাও নামগুলো মনে রাখছিলাম— আবদুল হামিদ, অক্ষয় রাও, রেখা সিং, পবন কুমার, সুইটি রাজপুত, শাহজাদ রশিদ। প্রত্যেকের নামের সঙ্গে ছবিও আছে। সেগুলো দেখেই মুখগুলো চিনে নিচ্ছিলাম। আমার স্মৃতিশক্তি বেশ ভালো, আমি জানি। মুখ এবং নাম মনে রয়ে যাবে সবার।
বেসক্যাম্পে পৌঁছতে সময় লাগল আধঘন্টা প্রায়। যেতে যেতে চোখে পড়ল দুটো হেলিকপ্টার দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি একটা অস্থায়ী কন্সট্রাকশনের মাঝে।
ওখানে গিয়ে সবার আগে দেখতে পেলাম ব্রিগেডিয়ার শর্মাকে। আমাকে দেখে গম্ভীর মুখে বললেন, “দাশগুপ্তা, এসে পড়েছ দেখে খুশি হলাম। কর্নেল আয়ার, আপনি ওঁকে ইনভেস্টিগেশনে যথাসাধ্য সাহায্য করবেন।”
আমি বললাম, “কজ অফ ডেথ কী, স্যার?”
ব্রিগেডিয়ার বললেন, “পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হাতে না পেলে বলা কঠিন। আজ সকালে ওঁর ল্যাব অ্যাসিস্ট্যান্ট মিস সুইটি রাজপুত আবিষ্কার করেছেন বডি।”
মৃতদেহ পড়েছিল ল্যাবরেটরির মধ্যে। ইতিমধ্যেই ফরেন্সিক বিভাগের লোকেরা ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ডিএনএ স্যাম্পল ইত্যাদি সংগ্রহ করছে। আমাকে দেখে ফরেন্সিকের ডক্টর নিশান্ত হাজারিকা উঠে দাঁড়ালেন।
“রবিকিরণ, কেমন আছ?”
আমি বললাম, “ভালোই আছি। কী বুঝছেন? মৃত্যুর কারণ কী?”
মৃত ডক্টর ভূষণ সাক্সেনার শরীরের উপর ঝুঁকে পড়ে ডক্টর হাজারিকা বললেন, “মুখের যেরকম নীলচে ভাব আর ডিস্টর্শন দেখছি, আমার আন্দাজ, হঠাৎ মস্তিষ্কে বেশ কিছুক্ষণের জন্য অক্সিজেন কম পড়ায় ব্রেন-ডেথ হয়েছে ভদ্রলোকের।”
আমি নিচুগলায় বললাম, “মার্ডার হতে পারে? কী মনে হয়?”
ডক্টর হাজারিকা মাথা নাড়লেন। “না মনে হচ্ছে। এইরকম অবস্থা হতে পারত মাথায় জোর আঘাত লাগলে বা গলা টিপে ধরলে। কিন্তু কোনও স্ট্রাগলের চিহ্ন নেই; বডিতে কোনওরকমের আঘাতের চিহ্নও নেই। না হে, আমার মনে হচ্ছে, হোমিসাইড কেস এটা নয়। তাও পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা আসুক, তখন নিশ্চিত করে বলা যাবে।”
এর পর একে একে প্রত্যেকের জবানবন্দি নিলাম। ফাইলগুলো নিজের মোবাইলেই স্টোর করে রাখছি আপাতত। আবার ধীরেসুস্থে পড়তে হবে।
সুইটি রাজপুত প্রথম মৃত অবস্থায় দেখেছিলেন ডক্টর সাক্সেনাকে। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, অনেক রাত পর্যন্ত ল্যাবেই কাজ করতেন ডক্টর সাক্সেনা। তিনিও থাকতেন বরাবর ওঁর সঙ্গে। কিন্তু কাল রাতে তাঁর শরীরটা ভালো না লাগায় ডক্টর সাক্সেনা তাঁকে নাইট শিফট থেকে অব্যাহতি দেন।
খুব কাজের খবর বাকিদের কারও কাছ থেকেও পেলাম না। এইটুকু শুধু জানলাম, ডক্টর সাক্সেনা সবার সঙ্গেই গল্পগুজব করতে ভালোবাসতেন। সবাইকে ডেকে ডেকে শোনাতেন ওঁর গ্রিনথর প্রজেক্টের গল্প, গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর ফলে সমুদ্রতল বৃদ্ধির গল্প, গ্রিনহাউস গ্যাসের মারাত্মক হারে বৃদ্ধি পাওয়ার গল্প। সেনাবাহিনীরও অনেকেই আসত ওঁর কাছে— ব্রিগেডিয়ার শর্মা, কর্নেল আয়ার, আমার বন্ধু ক্যাপ্টেন সাহা, আরও অনেকে এসে দু-দন্ড গল্প করে যেত।
বাইরে ব্রিগেডিয়ার শর্মা অপেক্ষা করছিলেন। কিছুটা দূরে কর্নেল আয়ার আর লক্ষ্মীপতি দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। আমাকে দেখে লক্ষ্মী হাত নাড়ল।
ব্রিগেডিয়ার আমাকে ডেকে নিলেন কাছে, “ডক্টর সাক্সেনার মৃত্যু অত্যন্ত দুঃখজনক, কিন্তু শুধু তার তদন্ত করার জন্য তোমাকে ডেকে পাঠাইনি, দাশগুপ্তা। অন্য একটা ব্যাপার আছে।”
আমি একটু অবাক হয়েই বললাম, “কী ব্যাপার বলুন না।”
“আদিল খানের নাম শুনেছ?”
“না তো। কে সে?”
“টেররিস্ট। খুব অ্যাক্টিভ ছিল একসময়, এখন ক-দিন হাইবারনেশনে আছে। সিরিয়ার একটা সংগঠনের স্লিপার সেলের লোক। র-এর হাতে পড়তে পড়তেও পালিয়েছে বেশ কিছুদিন আগে। একটা খবর কানে এসেছে, আদিল খান এইসব অঞ্চলে গা ঢাকা দিয়ে আছে।”
“কিন্তু স্যার, এর সঙ্গে…”
“ঠিক সেই কথাটা বলব বলেই তোমাকে ডেকেছি এখানে। গতকাল সন্ধ্যায় ডক্টর সাক্সেনার সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল। তখন হঠাৎ উনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, ‘আদিল খান নামে কাউকে চেনেন?’”
“সে কী! তারপর?”
“তারপর বুঝতেই পারছ, আমি ওঁকে চেপে ধরলাম। অনেক জোরাজোরি করে শুধু এইটুকু স্বীকার করাতে পারলাম, আদিল খানের খবর ওঁর কাছে আছে। সম্ভবত সে কোথায় লুকিয়ে আছে, সে খবরও উনি জানেন।”
আমি বললাম, “আপনি ওঁকে ভয় দেখালেন না?”
ব্রিগেডিয়ার হেসে বললেন, “ডক্টর সাক্সেনা ভারত সরকারের গ্রিনথর প্রজেক্টের এত বড় সম্মানিত বিজ্ঞানী। তাঁর সঙ্গে অনেক মেপে কথা বলতে হয়। তবে তিনি এইটুকু বলেছিলেন, আদিলের সঙ্গে সম্ভবত আমাদের ভেতরের লোকের গোপন যোগ আছে।”
আমি চমকে উঠে বললাম, “এ তো ভয়ংকর ব্যাপার!”
ব্রিগেডিয়ার বললেন, “এই যে প্রজেক্ট গ্রিনথর, এতে আমাদের সেনাবাহিনীর লোকেদের উপস্থিতি দরকার ছিল কি? তাও আমরা কেন আছি, ভেবে দেখো। অ্যান্টি-টেররিজম ইন্টেলিজেন্স আমাদের নিশ্চিত করেছে, এই অঞ্চলেই আছে সে। এদিকে আরও ভয়ংকর ব্যাপার হল, কাল সন্ধ্যায় উনি ওই কথা আমাকে বললেন, আর সকালে ওঁর মৃতদেহ পাওয়া গেল। এ ঘটনা কো-ইন্সিডেন্স হতে পারে না, কিছুতেই না। এদিকে আমার পক্ষে খুব বেশি ইনভেস্টিগেশন চালানো সম্ভব নয়, বুঝতেই পারছ। সে কাজটা তুমি আমার চেয়ে ভালো পারবে।”
আমি বললাম, “আপনি কাউকে সন্দেহ করেন? কার সঙ্গে যোগ থাকতে পারে আদিলের?”
ব্রিগেডিয়ারের মুখ হঠাৎ কঠিন হয়ে উঠল। তিনি বললেন, “সে কথা বলা আমার উচিত হবে না। কিন্তু তুমি এখানে এসে পৌঁছবার আগে আমি প্রাথমিক কিছু জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়েছি। ডক্টর সাক্সেনার সঙ্গে অনেক রাতে, প্রায় বারোটার দিকে, দেখা করতে এসেছিল তোমার বন্ধু ক্যাপ্টেন সাহা। তাঁকে শেষবার জীবিত সে-ই দেখেছে। কিন্তু মনে রেখো দাশগুপ্ত, স্রেফ সন্দেহের বশে আমার সেনাদের কাউকে তুমি কিছু বলতে পারবে না। তোমার যা কিছু বলার, বলবে আমাকে। তারপর উপরমহলের সঙ্গে কথা বলে আমি যা ব্যবস্থা নেবার নেব।”
আর কিছু না বলে ভেতরে ঢুকে গেলেন ব্রিগেডিয়ার। ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সাহা আমাকে ফাঁকা পেয়ে এতক্ষণে এগিয়ে এল।
আমি সোজা কাজের কথা পাড়লাম, “কাল অত রাতে ডক্টর সাক্সেনার ল্যাবে গিয়েছিলি কেন?”
লক্ষ্মী হেসে বলল, “বাব্বা! শুট অ্যাট সাইট শুরু করলি যে!”
আমি বললাম, “লক্ষ্মী, কাল ওঁর সঙ্গে কী কথা হল, বল আমাকে।”
লক্ষ্মী বলল, “আরে দূর, সেরকম কিছুই না। আমি তো মাঝেমধ্যেই যাই ওঁর কাছে। গল্পটল্প করি। কালও গিয়েছিলাম। তখন তো দিব্যি সুস্থ স্বাভাবিক দেখে এলাম।”
আমি বললাম, “অত রাতে? দরকার তো কিছু একটা ছিলই।”
লক্ষ্মী হাসল, “তোকে বললে ক্ষতি নেই, তাই বলছি। ব্রিগেডিয়ারকে বলিস না। ডক্টর সাক্সেনার কাছে ভালো হুইস্কির স্টক থাকত। আমাদের ফোর্সের কেউ গেলেই উনি খাওয়াতেন। মুফ্ত-এর দারু বড় নেশার জিনিস, দোস্ত। কাল রাতে আমার খেতে ইচ্ছা হয়েছিল, তাই গিয়েছিলাম। তবে আমরা কেউই মাল খেয়ে মাতাল হই না, পরিমিতই খাই। কালও হুইস্কি টানা হল, আড্ডা হল। অবশ্য উনি খাননি, বললেন, ‘তুমি খাও— আমি একটু আগেই খেয়েছি, আর খাবনা।’ তারপর আমি সাড়ে বারোটার দিকে ফিরে এলাম। সেই শেষ দেখা ওঁর সঙ্গে।”
আমি বললাম, “আর আদিল খান? তাকে নিয়ে কথা হয়নি?”
স্পষ্টতই চমকে উঠল সে। তারপর সামলে নিয়ে বলল, “তুই এই নাম কোথায় শুনলি, রবি?”
আমি বললাম, “সে কথা অপ্রাসঙ্গিক। তার মানে আদিল খানকে নিয়ে ওঁর সঙ্গে কথা হয়েছে তোর?”
লক্ষ্মী বলল, “এসব নিয়ে মাথা ঘামাস না তুই। কত বড় ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বি, তোর কোনও আইডিয়াই নেই।”
আমি বললাম, “না, আইডিয়া নেই। তুই আইডিয়া দে। আদিলকে নিয়ে কী বললেন, ডক্টর সাক্সেনা?”
“আরে, উনি কোথা থেকে নাকি জেনেছিলেন, আদিল খান এখানের কোন একটা গ্রামে গা ঢাকা দিয়ে আছে আজ বেশ কিছুদিন। এসব কথা মদ পেটে পড়লে উনি প্রায়শই বলতেন। কালও তেমনই বলছিলেন। তবে হ্যাঁ, আদিলের নাম উনি কীভাবে জানলেন, তা আমি জানি না, ভাই।”
লক্ষ্মীর কাছ থেকে আর কোনও তথ্য বার করা গেল না।
আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে ফিরে এলাম। কর্নেল আয়ার জিপে করে ছেড়ে দিয়ে গেলেন।
অদ্ভুত খবরটা এল বিকেলবেলা। এবং ভীষণ খারাপ খবর।
ব্রিগেডিয়ার শর্মা ফোন করেছিলেন। প্রজেক্ট গ্রিনথরের কয়েক মাইল উত্তরে যে গ্রামটা ছিল, পঁচিশ-তিরিশ ঘর লোক থাকত সেখানে। আজ বিকেলে আবিষ্কার হয়েছে, সেই গ্রামের প্রত্যেকে মরে পড়ে আছে রাস্তার উপর, ঘরের দাওয়ায়। মুখ নীলচে হয়ে গেছে সকলের। ঠিক ডক্টর সাক্সেনার মতো।
যেন মড়ক লেগেছে ওখানে!
আমরা ভুল ভাবছিলাম। ডক্টর ভূষণ সাক্সেনাও তাহলে খুন হননি। কোনওভাবে সংক্রমিত হয়েছিলেন ওই অজানা জীবাণুর দ্বারা।
আরও একটা ভয়ংকর খবর দিলেন ব্রিগেডিয়ার শর্মা। আদিল খান লুকিয়ে ছিল ওই গ্রামেই। তারও কোনও খবর আর পাওয়া যাচ্ছে না।
***
“আমাদের ইনফর্মার শেষ খবর পাঠিয়েছিল, ওই গ্রামেই ছদ্মবেশে ছিল আদিল, সদ্য জানতে পেরেছিল সে। কাল সন্ধ্যায় ওই খবরটুকু আসে। তারপর আজ দেখা যাচ্ছে সবাই মৃত।”
ব্রিগেডিয়ারের কন্ঠস্বর বেশ উত্তেজিত শোনাচ্ছিল।
আমি বললাম, “কাল কখন এক্স্যাক্টলি খবরটা পেলেন? কীভাবে পেলেন?”
ব্রিগেডিয়ার বললেন, “আমাদের রেডিও রুমের অপারেটরের কাছে সংকেতটা আসে। অনেকেই ছিলাম আমরা তখন ওখানে। তোমার বন্ধু ক্যাপ্টেন সাহাও ছিল। কর্নেল আয়ারও ছিলেন। উনিই যোগাযোগ রাখেন আমাদের লোকাল ইনফর্মারদের সঙ্গে। ইনফর্মার খবর দেয়, রাজানা গ্রামের কাছে একটা লোককে সন্দেহ হওয়ায় সে নজর রাখছিল ক-দিন ধরে। আজ সে নিশ্চিত প্রমাণ পেয়েছে, লোকটা আদিল খান।”
আমি বললাম, “কিন্তু তারপর থেকে আর সে যোগাযোগ করেনি?”
“না। ওর উপর ইন্সট্রাকশন আছে, ওর যখন সুবিধা, তখন ও কন্ট্যাক্ট করবে আমাদের সঙ্গে। আমরা আগ বাড়িয়ে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে যাব না। কখন কোথায় থাকবে, ঠিক নেই। বিপদে পড়ে যেতে পারে।”
ব্রিগেডিয়ারের সঙ্গে কথা শেষ করে আমি ফোন করলাম জয়পুরে। ওখানে মনোজ আছে— আমার মুশকিল আসান। একবার রিং হওয়ার পরেই ফোন রিসিভ করল মনোজ।
“রবিভাই, দরকার পড়েছে নিশ্চয়ই। তাই ফোন করছেন।”
আমি বললাম, “দরকার তো পড়েছেই। মন দিয়ে শোন। কতগুলো ইনফো লাগবে আমার।”
“আবার সিক্রেট হ্যাকিং করাবে আমাকে দিয়ে? এবার কিন্তু ডবল চাই।”
“পাবি, যদি কাজের খবর দিতে পারিস। যা বলছি লিখে নে।”
পাঁচ মিনিট ধরে মনোজকে কাজ বুঝিয়ে দিলাম। যা সন্দেহ করছি, তা-ই যদি হয়, তাহলে আমি নিশ্চিত এর মধ্যে একটা বড় টাকার খেলা চলেছে। এই মরুভূমির মধ্যে বড় মাপের ক্যাশ লেনদেন করে লুকিয়ে রাখার রিস্ক কেউ নেবে না। তাই দরকার মনোজকে। পারলে ও-ই পারবে হদিশ করতে।
ব্রিগেডিয়ার ঠিকই বলেছেন। আদিল খানের নাম করার চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে ডক্টর সাক্সেনার মৃত্যু, ইনফর্মার আদিলের খবর আনার পরেই একটা গোটা গ্রামের লোকের মৃত্যু, ইনফর্মারও বেপাত্তা— এগুলো কোইন্সিডেন্স হতে পারে না। আরও একটা ব্যাপার আমি আবিষ্কার করেছি। ডক্টর সাক্সেনা একজন নামকরা পরিবেশবিজ্ঞানীর সঙ্গে ভাইরোলজিস্টও ছিলেন। প্রজেক্ট গ্রিনথর সম্বন্ধে ফাইলগুলো ভালো করে নেড়েচেড়ে দেখছি, মাইক্রোব্স বা অণুজীবদের কাজে লাগিয়ে ইসরোর বিজ্ঞানীরা মঙ্গলগ্রহকে টেরাফর্মিং করার যে চেষ্টায় কিছুটা সফল হয়েছেন, সেইভাবেই থর মরুভূমির একাংশে জীবাণুদের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করে সবুজায়নের ব্যবস্থা করা হচ্ছিল এখানে। সে বিষয়ে মূল উপদেষ্টা ছিলেন ডক্টর সাক্সেনাই।
রাজানা গ্রামের এই অদ্ভুত মড়কের পেছনে তাঁর অবদান কি কিছুই ছিল না?
একবার ওখানে যেতে পারলে ভালো হত, কিন্তু ঠিক কীরকম জীবাণুর সংক্রমণে এই মহামারী লাগল, সেটা বুঝতে না পারা অবধি অকুস্থলে যাওয়াটা কতটা নিরাপদ হবে, বুঝতে পারছি না।
ফোনটা বেজে উঠল হঠাৎ। “হ্যালো” বলতে ওপার থেকে ভেসে এল লক্ষ্মীর গলা, “রবি, একটা কথা ছিল।”
তার কন্ঠস্বরের অস্বাভাবিকত্ব আমার কান এড়াল না। যেন খুব নিচু গলায় কারও কান এড়িয়ে কথা বলছে সে। আমি বললাম, “হ্যাঁ, বল-না।”
“না, ফোনে সব বলব না।” লক্ষ্মীর গলায় সতর্কতার আভাস, “তুই আছিস তো এখন? আমি তাহলে একবার যাচ্ছি তোর ওখানে।”
আমি বললাম, “হ্যাঁ, চলে আয়। কিন্তু কী হয়েছে, একটু হিন্ট তো দে।”
“খুব বিপদের মধ্যে আছি আমরা। তুই, আমি— আমরা যারা এই তদন্তের সঙ্গে জড়িয়েছি, সবাই বিপদের মধ্যে আছি। আদিল ছিল রাজানা গ্রামে; ওখানে কেন মহামারীতে হঠাৎ গোটা গ্রাম সাফ হয়ে গেল, তার পেছনে কোনও রহস্য নেই ভাবছিস?”
“কী রহস্য?”
“গিয়ে বলছি। এইটুকু শুধু জেনে রাখ, আমাদের যে ইনফর্মার ওখানে ছিল, সে আর কখনও যোগাযোগ করবে না। বাকিদের সঙ্গে সেও খতম হয়ে গেছে ওই জীবাণুর আক্রমণে।”
“তুই এত কথা জানলি কী করে? ব্রিগেডিয়ার শর্মা, কর্নেল আয়ার এসব জানেন?”
“যে জানার, সে ঠিক জানে। তুই কি জানিস, এই রকম মুখ নীল হয়ে অক্সিজেনের হঠাৎ অভাবে মৃত্যু ওই গ্রামে এর আগেও হয়েছে?”
আমি হাঁ হয়ে গেলাম, “সে কী? কবে?”
“যবে থেকে এই প্রজেক্ট গ্রিনথর শুরু হয়েছে, তবে থেকেই মাঝে মাঝে ওইভাবে দু-চারটে লোক মরেছে ওই গ্রামে। ওরা সব অশিক্ষিত গরীব লোক; ওরা এত জীবাণু-সংক্রমণ বোঝে না। ওরা বলে, ‘দেও’ লেগেছে। আর জীবাণুর ব্যাপারে খোদ ভাইরোলজিস্টই ছিলেন আমাদের সঙ্গে; তাঁর এ ব্যাপারে কোনও কানেকশন নেই ভাবছিস?”
আমার সন্দেহটা লক্ষ্মী এইভাবে স্পষ্ট করে বলে দেবে, ভাবিনি। বললাম, “ডক্টর সাক্সেনা তাহলে সব জানতেন?”
“না, সব জানতেন না। তবে অনেক কিছু জানতেন। পাছে সব জেনে ফেলেন এবং সবাইকে জানিয়ে ফেলেন, তাই তাঁকে চলে যেতে হল।”
“বলিস কী? হোমিসাইড? কিন্তু ডক্টর হাজারিকা যে বললেন…?”
“সে উনি যাই বলুন রবি, এ ব্যাপারে আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না। কোনও গোপন হার্ডড্রাইভের ব্যাপারে কিছু খবর পেয়েছিস?”
“হার্ডড্রাইভ? কীসের হার্ডড্রাইভ? কী আছে তাতে?”
“আছে, আছে। একজনের মরণকাঠি আছে তাতে। কিন্তু ফোনে আর বেশি বলছি না। তুই থাক, আমি যাচ্ছি তোর কাছে। একটা কথাই শুধু বলি, ডক্টর সাক্সেনার প্রাপ্য ছিল এটা। পাপ বাপকেও ছাড়ে না। আর রবি, একটা কথা।”
“বল।”
“আমার যদি কিছু হয়ে যায়— একটা চার বছরের ছেলে আছে আমার— একটু খোঁজখবর রাখিস।”
আমি কিছু বলার আগেই ও লাইন কেটে দিল।
বোঝাই যাচ্ছে, বড় রকমের কোনও খবর আছে ওর কাছে। অনেক ভেতরের ব্যাপার জানে ও। রাজানা গ্রামের মড়কের সঙ্গে জীবাণুবিদ ডক্টর সাক্সেনার মৃত্যুর কোনও একটা যোগ তো আছেই। কিন্তু ওই কথাটা বলল কেন ও— “পাপ বাপকেও ছাড়ে না” ? কী পাপ করেছিলেন ডক্টর সাক্সেনা? আর নিজের মৃত্যুর ভয়ই বা পাচ্ছে কেন লক্ষ্মী?
আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। একঘন্টা, দু-ঘন্টা— লক্ষ্মী এল না।
ফোন করলাম ওকে; বেজে বেজে লাইন কেটে গেল, কেউ ধরল না। জানি না কেন, খুব টেনশন হতে লাগল।
ব্রিগেডিয়ার শর্মা ফোন করলেন বিকেলের দিকে। লক্ষ্মী মারা গেছে— নিজের বন্দুক মাথায় ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করেছে সে। মৃতদেহ পাওয়া গেছে তার জিপের মধ্যে। হাতে ধরা ছিল তার নিজের রিভলভার।
খবরটা শুনে স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলাম। লক্ষ্মী জিপে উঠেছিল মানে আমার কাছেই আসছিল। এমন সময় ওকে খুন করে গেছে আততায়ী। ব্রিগেডিয়ার শর্মা যা-ই বলুন, আত্মহত্যা করেনি লক্ষ্মী। অনেক খবর জানত ও; পাছে ফাঁস করে দেয়, তাই ওকে সরিয়ে দেওয়া হল— ডক্টর সাক্সেনার মতোই। কিন্তু কে করল কাজটা? সেই সিরিয়ার আতঙ্কবাদী গ্রুপের লোকজন? কিন্তু আমি যতদূর জানি, ওদের কাজের ধরণ তো এরকম নয়।
কিছু একটা আঁচ তো পেয়েইছিল ও, নয়তো বলত না, “খুব বিপদের মধ্যে আছি আমরা।”
কে যেন এল। মুখ তুলে দেখি, কর্নেল আয়ার।
মুখে এখন আর হাসি নেই তাঁর। আমি বললাম, “খবর কিছু আছে মনে হচ্ছে, কর্নেল?”
“আছে।” কর্নেল বসলেন, “ক্যাপ্টেন লক্ষ্মী সাহা আপনার পুরনো বন্ধু ছিল, না?”
“হ্যাঁ। কেন?”
“মৃত্যুর পর ওর ফোনটা উদ্ধার করা গেছে ওর বডির কাছ থেকে। শেষ কলটা আপনাকেই করেছিল ও। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেছিলেন আপনারা।”
আমি ভ্রু কোঁচকালাম। কর্নেল আয়ার কী উদ্দেশ্যে কথাটা বলছেন, বুঝতে পারছি না। লক্ষ্মীর মৃত্যুর জন্য উনি আমাকে দায়ী করছেন নাকি?
আমি বললাম, “হ্যাঁ, লক্ষ্মী আমার কাছেই আসছিল। বলছিল, কিছু খবর আছে। আমরা নাকি সবাই বিপদে পড়তে পারি।”
কর্নেল আয়ার তাঁর গোঁফের প্রান্ত দুটোয় একবার আঙুল বুলিয়ে নিয়ে বললেন, “দেখুন, ক্যাপ্টেন সাহা আপনাকে কী বলেছেন, তদন্তের এই অবস্থায় তা আমার জিজ্ঞাসা করার এক্তিয়ার নেই। আমার কাছে তা ক্লাসিফায়েড ইনফর্মেশন। কিন্তু একটা কথা আমি জানতে চাইছি। আদিল খানকে নিয়ে আমরা অনেক দিন চিন্তিত। তার সম্বন্ধে যদি কোনও কথা হয়ে থাকে, আপনি আমাকে জানাতে পারেন।”
সরাসরি উত্তর না দিয়ে আমি বললাম, “আপনাদের এক ইনফর্মার তো আছে ওই গ্রামে। তার কাছ থেকে কোনও খবর পাননি?”
কর্নেল আয়ার চিন্তিতমুখে বললেন, “না, সেটাই তো সমস্যা। তার সঙ্গে কোনও যোগাযোগই তো করা যাচ্ছে না। আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে যে আমাদের মধ্যেই কেউ শত্রুর এজেন্ট আছে। ক্যাপ্টেন সাহা আর যাই হোক, সুইসাইড করার মতো লোক ছিল না। ওকে দীর্ঘদিন চিনি আমি।”
আমি বললাম, “বিশেষত সে আমার কাছেই আসছিল একটা গোপন বিষয়ে আলোচনা করতে। এই অবস্থায় সে আত্মহত্যা করতে যাবেই বা কেন? আমি নিশ্চিত, কেউ ওকে খুন করে ব্যাপারটাকে আত্মহত্যা সাজাতে চাইছে।”
কর্নেল আয়ার চুপ করে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, “দাশগুপ্তা, কাল রাত সাড়ে ন-টার দিকে আমি গিয়েছিলাম ডক্টর সাক্সেনার সঙ্গে দেখা করতে। গেলেই হুইস্কি খাওয়াতেন উনি। সেই লোভে আমাদের অনেকেই যেত ওঁর কাছে, তাও আমি জানি। কাল আমার সঙ্গে মদ্যপান করতে করতে উনি একটা কথা বলেছিলেন আমাকে।”
“কী কথা?”
“অনেকটা হুইস্কি খেয়ে ফেলেছিলেন ডক্টর সাক্সেনা। একটু বোধহয় বেসামাল হয়েই বলেছিলেন, টাকার লোভ বড় সর্বনাশা জিনিস।”
“কার টাকার লোভের কথা বলছিলেন উনি?”
“সরাসরি বলেননি, কিন্তু ইঙ্গিতটা কার দিকে ছিল, আমি বোধহয় বুঝতে পেরেছিলাম।”
“কার দিকে?”
“যে ব্যক্তি রাত বারোটার দিকে ওঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। যে ব্যক্তি শেষবার জীবিত দেখেছিল ওঁকে।”
“লক্ষ্মী!”
কর্নেল আয়ার দুঃখিতভাবে মাথা নাড়লেন। “এসব কথা আপনাকে আমার বলা উচিত নয়, কিন্তু ক্যাপ্টেন সাহার নিকটাত্মীয়দের রিসেন্ট ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ডিটেলস চেক করলে আপনি কিছু মূল্যবান তথ্য পাবেন বলেই আমার বিশ্বাস।”
আমি মাথা নাড়লাম। উনি বলার আগেই এই কেসের সঙ্গে জড়িত সকলের, এমনকী ওঁরও, বিগত কিছুদিনের সব অ্যাকাউন্টের লেনদেনের হিসাব হ্যাক করে জোগাড় করতে বলে দিয়েছি মনোজকে। প্রত্যেকের কাছের মানুষদের খবরও জোগাড় করা হচ্ছে। অবশ্য কথাটা ওঁকে বলার প্রয়োজন মনে করলাম না। এখন আমার শোনার সময়, বলার নয়।
আমি বললাম, “কিন্তু আর যা-ই হোক, লক্ষ্মী নিশ্চিতভাবেই সুইসাইড করেনি। তার মানে, এখনও শত্রুপক্ষের লোক আমাদের মধ্যে আছেই। আচ্ছা কর্নেল আয়ার, আপনি বলতে পারবেন, ডক্টর সাক্সেনার কোনও হার্ডড্রাইভে বিশেষ কোনও গোপন তথ্য সংরক্ষণ করা থাকত কি না?”
“হার্ডড্রাইভ? ডক্টর সাক্সেনার? না, আমি তো এ-কথা কখনও শুনিনি। আপনি কোথায় পেলেন এ খবর?”
“লক্ষ্মী একটা আভাস দিতে চাইছিল। আচ্ছা, ডক্টর সাক্সেনা মানুষ হিসাবে কেমন ছিলেন?”
একটু হাসলেন কর্নেল আয়ার, “আপনি একসময় এ প্রশ্ন করবেন, আমি জানতাম। কিন্তু সত্যি কথা কী জানেন, একটা লোক ‘মানুষ’ হিসাবে কেমন ছিল, এ উত্তর দেওয়া বড় কঠিন কাজ। জ্ঞানতপস্বী ছিলেন, গল্প করতে ভালোবাসতেন, দিলদরিয়া ছিলেন— এসবই তাঁর সম্বন্ধে খাটে। কিন্তু ‘মানুষ’ হিসাবে…”
আমি বললাম, “ওঁর সম্বন্ধে বলতে গিয়ে লক্ষ্মী বলেছিল, ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না’। কেন, কোনও আইডিয়া আছে আপনার? রাজানা গ্রামে এর আগেও এইরকম জীবাণু সংক্রমণে কিছু লোক মারা গেছে। তার সঙ্গে ডক্টর সাক্সেনার কোনওরকম যোগাযোগ ছিল কি?”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কর্নেল আয়ার। “তবে বলি আপনাকে ব্যাপারটা। আমার আর ব্রিগেডিয়ার শর্মার সন্দেহ, রাজানা গ্রামে লুকিয়ে থেকে আদিল একটা মাস-ডেস্ট্রাকটিভ বায়ো-ওয়েপন জোগাড়ের চেষ্টা করছিল। ইনফর্মার সেরকম আভাস দিয়েছিল একবার কিছুদিন আগে। আর এখানে যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে ও জিনিস তৈরি করার ক্ষমতা ছিল একমাত্র ডক্টর ভূষণ সাক্সেনার। যদিও এ-কথাও বলতে হবে, ডক্টর সাক্সেনার সঙ্গে কোনওদিন আদিলের মুখোমুখি যোগাযোগ হয়েছে, এমন তথ্য আমরা কখনও পাইনি। কিন্তু ওই যে আপনি জানতে চাইলেন, ‘মানুষ’ হিসাবে ডক্টর সাক্সেনা কেমন ছিলেন, এইখানেই একটা প্যাঁচ লেগে গেল।”
“কেন?”
“কেন জানেন? বেশ কিছুদিন আগে ডক্টর সাক্সেনা তাঁর নতুন ভাইরাসের ক্ষমতা বুঝতে নাকি লুকিয়ে তার প্রয়োগ করেছিলেন কয়েকজন গ্রামবাসীর উপর। কথাটা কতদূর সত্যি জানি না; এ খবর আমি শুনেছিলাম ক্যাপ্টেন সাহার কাছে। কিন্তু ওইরকম মুখ নীল হয়ে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনা ওই গ্রামে বেশ কয়েকটা আগেও ঘটেছে, এ সত্য তো অস্বীকার করার উপায় নেই।”
“আর এই ভাইরাসকেই এখন মহামারীর জনধ্বংসী অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে চাইছিল আদিল খান? এই ভাইরাসই তাহলে কোনওভাবে মুক্তি পেয়ে উজাড় করে দিয়েছে গোটা গ্রামটাকে?”
“আমার তো তাই ধারণা। ডক্টর সাক্সেনা নাকি একটা কথা বলতেন, লক্ষ্মী শুনেছে। বলতেন, ‘এই গরীব লোকগুলো দেশের কোনও কাজে লাগে না। অ্যাট লিস্ট, এক্সপেন্ডেবল ল্যাব-র্যাট হিসেবেও যদি এদের ব্যবহার করা যায়, তাহলে দেশের কিছু উপকারে লাগে।’”
আমি কিছুক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে রইলাম। জ্যান্ত মানুষের প্রতি এরকম মনোভাব কারও থাকতে পারে, এ আমি কল্পনাও করতে পারিনি— এক্সপেন্ডেবল ল্যাব-র্যাট ওরা! গবেষণাগারের নিষ্ঠুর পরীক্ষার গিনিপিগ— শুধু হতদরিদ্র বলে!
আমার মুখের অবস্থা দেখে কর্নেল আয়ার মুচকি হাসলেন। “ডক্টর সাক্সেনার মতো ভোলেভালা বিজ্ঞানীর মুখ থেকে এমন সব কথা চট করে ডাইজেস্ট হওয়া মুশকিল, জানি। ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না’— মানেটা বুঝলেন তো এবার?”
আমি মাথা নাড়লাম। ডক্টর ভূষণ সাক্সেনাকে যতটা সোজা লোক ভেবেছিলাম, ততটা তিনি নন, বুঝতেই পারছি। আর লক্ষ্মী— সেও নিতান্তই ধোয়া তুলসিপাতা নয় নিশ্চয়। অনেক গোপন খবর জানত ও— হয়তো সরাসরি জড়িতও ছিল অনেক কিছুর সঙ্গে। তাই নিজের জীবনের ভয় পাচ্ছিল।
আমি বললাম, “আচ্ছা কর্নেল, ওই গ্রামটাতে একবার যাওয়া যায়?”
কর্নেল আয়ার বললেন, “প্রোটেক্টিভ স্যুট পরে যেতে বাধা নেই। আপনি যদি যেতে চান, আমি নিয়ে যেতে পারি। তবে লাশগুলো সরানো হয়নি এখনও— পড়ে আছে গ্রাম জুড়ে। আমাদের টহলদারি হেলিকপ্টার এক চক্কর মেরে দেখে এসেছে, যদিও মাটিতে নামেনি।”
আমি বলললাম, “আর একটা দিন সময় দিন। কাল বিকেলের দিকে সম্ভব হবে কি?”
কর্নেল উঠে পড়লেন। “ব্রিগেডিয়ারের পারমিশন লাগবে অবশ্য। আমি বলে রাখব তাঁকে। আপনি আমাকে খবর দেবেন একটা। আমি জিপ নিয়ে চলে আসব আপনাকে কপ্টার পর্যন্ত নিয়ে যেতে।”
“চালাবে কে?”
“আমিই চালাব। এর আগে অনেকবার গেছি ওই গ্রামে। জায়গাটা ভালোমতো চিনি।”
কথাটা শুনেই প্রশ্ন করলাম, “তাহলে তো আদিলের খবর আপনার আগেই পাওয়া উচিত ছিল।”
একটু চুপ করে রইলেন কর্নেল। তারপর বললেন, “আদিলের খবর আমাদের ইনফর্মার যা দিত, আমাদের ইউনিটের সবাই জানে। কিন্তু এর বেশি আপনাকে এখন আমি বলব না। এইটুকু শুধু বলছি, আদিলের উপর গোপনে একটা আক্রমণ করে ওকে জীবিত ধরার জন্য জোর প্রস্তুতি আমাদের বাহিনীতে শুরু হয়ে গিয়েছিল। ওকে ধরতে পারলে অনেক ইনফর্মেশন পাওয়া যেত নিঃসন্দেহে। কিন্তু হতভাগা তার আগেই এই জীবাণু সংক্রমণে খতম হয়ে গেল, এটাই আফশোস। কাল চলুন রাজানায়, ওখানে আরও কিছু কথা বলব আপনাকে। আজ চলি। ফোন করবেন।”
তিনি চলে যাওয়ার পর অনেকক্ষণ বসে বসে ভাবলাম। অনেকগুলো অঙ্কের হিসাব মিলছে না। মনোজের ফোনটা এলে সুবিধা হত।
ভাবতে ভাবতেই ফোন বাজল। হাতে নিয়ে দেখি, না, মনোজ নয়, অন্য কেউ। “হ্যালো” বলতেই ওপার থেকে কথা বললেন ফরেন্সিকের ডক্টর নিশান্ত হাজারিকা। “রবিকিরণ, তোমাকে মেইল করেছি পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা। দেখে নিও সময় করে।”
আমি বললাম, “সাসপিশাস কিছু পেলেন নাকি?”
ডক্টর হাজারিকা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “একটা ব্যাপার বুঝতে পারলাম না, রবিকিরণ। ঘাড়ের কাছে সার্ভিক্যাল ভার্টিব্রায় অ্যাটলাস বোনের উপরে ডানদিকে চামড়ায় একটা অতি সূক্ষ্ম ছিদ্র আছে, যেন ভীষণ সরু কোনও ছুঁচ ঢোকানো হয়েছিল ওখান দিয়ে, যদিও ওই জায়গায় হাড়ের উপর কিন্তু কোনও পাংচারমার্ক দেখা যাচ্ছে না।”
“তার মানে কী হতে পারে, ডক্টর হাজারিকা?”
“কোনও সূক্ষ্ম জিনিস ওখানে ঢুকেছিল তাঁর ঠিকই, কিন্তু এও বলব, ওই পাংচার মার্ক কিন্তু তাঁর মৃত্যুর কারণ নয় মোটেই। ব্রেনে অক্সিজেন কম পড়ায় ব্রেন কাজ বন্ধ করে দেওয়াই এক্ষেত্রে কজ অফ ডেথ।”
“জীবাণু সংক্রমণে হতে পারে এরকম মৃত্যু?”
“হুম। ইন ফ্যাক্ট, সেই রকমই মনে হচ্ছে আমার। যদিও নিশ্চিত করে বলা এই মুহূর্তে সম্ভব নয়। আরও অনেকগুলো টেস্ট করতে হবে তাহলে।”
আমি বললাম, “আচ্ছা, ঘাড়ের ওই ফুটোটা দিয়ে কেউ তাঁকে ভাইরাসটা ইঞ্জেক্ট করেছিল, এমনটা কি হতে পারে না?”
একটু ভেবে ডক্টর হাজারিকা বললেন, “কিন্তু তাহলে ছুঁচটা তো পাওয়া উচিত ছিল। না রবিকিরণ, ওখানে কোনও মেটাল বডির ইনসার্শন হয়নি, আমি নিশ্চিত। হতে পারে, ওটা হয়তো কিছুই নয়; আমরা শুধু শুধুই ওটা নিয়ে চিন্তিত হচ্ছি।”
ফোন রেখে দেওয়ার পরে বিস্তারিত পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা সবে পড়তে শুরু করেছি, এমন সময় আবার ফোন বাজল। মনোজ।
“রবিভাই, ভালো খবর আছে।”
আমি বললাম, “আমাকে ভালো খবর দিলে তোর অ্যাকাউন্টেও ভালো খবর যাবে। বলে ফ্যাল।”
খবরটা মনোজ জোগাড় করেছে দুর্দান্ত। সপ্তাহ খানেক আগেই ক্যাপ্টেন লক্ষ্মীপতি সাহার স্ত্রী-র অ্যাকাউন্টে কুড়ি লক্ষ টাকা জমা পড়েছে একটা অফশোর ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে। আরও একটা খবর। ডক্টর ভূষণ সাক্সেনা একমাস আগে মুম্বাইতে একটা বিশাল বাড়ি কিনেছেন ভাইপোর নামে, যার মূল্য বেশ কয়েক কোটি টাকা।
এত টাকা এল কোথা থেকে?
মনোজ বলল, “রবিভাই, আরেকটা খবর শুনলে চমকে যাবেন। শুনবেন?”
বললাম, “দেরি না করে ছাড়।”
মনোজ বলল, “অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে এটার জন্য। ডক্টর সাক্সেনা যখন বাড়িটা কিনতে যান, ওঁর সঙ্গে কে ছিল, বলতে পারেন? ওই বাড়ির পুরনো মালিকের চেনা ছিলেন এই ভদ্রলোক। মালিকের সঙ্গে কথা বলে আদায় করেছি তথ্যটা। আন্দাজ করুন তো কে?”
“আমি আন্দাজ করেছি অলরেডি। কিন্তু তোকে এত পয়সা দিচ্ছি, তুই বল।”
মনোজ যে নামটা বলল, শুনে আমি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাম। আন্দাজ মিলে গেছে।
লাইন কাটার আগে বললাম, “ভালো কাজ করেছিস। বিলটা একটু বুঝে শুনে পাঠাস।”
মনটা খচখচ করছিলই, কিন্তু এখনই সিদ্ধান্তে আসা যাবে না। মেইল খুলে আবার পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা নিয়ে বসলাম।
মৃতের স্টমাকে পাওয়া গেছে অর্ধেক হজম হওয়া আলুর টুকরো, চাপাটির অংশ আর ছোলা। দেখতে দেখতেই ভ্রু কুঁচকে উঠল আমার।
এত বড় মিথ্যেটা আমার চোখ এড়িয়ে যাচ্ছিল আরেকটু হলেই।
একবার ওই রাজানা গ্রামে আমাকে যেতে হবেই। তার আগে উপরমহলের সঙ্গে একবার কথা বলা দরকার।
হাতে ফোনটা তুলে নিয়ে একটা নাম্বার ডায়াল করলাম আমি।
***
পুরো প্রস্তুতি নিতে প্রায় চব্বিশ ঘন্টার কাছাকাছি লেগে গেল।
কর্নেল আয়ারের জিপে করে হেলিকপ্টার পর্যন্ত যেতে লাগল আরও চল্লিশ মিনিট। বিকেল হয়ে এসেছে। থরের হলদে বালি উড়ছে অপরাহ্নের হালকা হয়ে আসা রোদে। তাও তাপমাত্রা এখনও গায়ে জ্বালা ধরাচ্ছে।
কপ্টারে চড়ার অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম নয়। রোটর ঘুরছে প্রচন্ড শব্দে; তার মধ্যেই আমি উঠে বসলাম সিটে। কর্নেল আয়ার অভিজ্ঞ পাইলট। সিনেমায় যেরকম দেখায়, সেরকম বিরাট কোনও বাঁক না খাইয়েই তিনি চমৎকার দক্ষতায় অল্প একটু হেলিয়েই যানটাকে শূন্যে তুলে ফেললেন।
আমার মাথায় মধ্যে অনেকগুলো চিন্তা ঘুরছে। রাজানা গ্রামে যাওয়ার জন্য আপাদমস্তক ঢাকা প্রোটেক্টিভ স্যুট পরেছি আমরা দু-জনেই।
পারমিশন পাওয়ায় প্রথমটা একটু সমস্যা হচ্ছিল। কিন্তু কর্নেল আয়ার সঙ্গে যাবেন শুনে ওপর মহল শেষমেশ আমাকে খুব একটা বাধা দেয়নি। ব্রিগেডিয়ার শর্মার সুপারিশও বেশ কিছুটা কাজ করেছে। মৃতদেহগুলো এখনও পড়েই আছে গ্রামের মধ্যে। এক্সপার্ট মেডিক্যাল টিম কাল এসে পৌঁছবে। তারা আসার আগে আমাকে এখানে আসতে দিতে সেনাবাহিনীর বড়কর্তারা রাজি হচ্ছিলেন না। কিন্তু ব্রিগেডিয়ার শর্মা এর সঙ্গে আদিল খানের যোগাযোগ আছে বলায় তাঁরা অবশেষে নিমরাজি হয়ে মত দিয়েছেন।
নীচে সুবিশাল থর মরুভূমির বালিয়াড়িগুলোকে লাগছে নিঃসীম সমুদ্রে সোনালি ঢেউয়ের মতো। হেলিকপ্টারের রোটরের আওয়াজের মধ্যে কথা বলার জন্য ইয়ারফোন আমাদের দু-জনের কানে; মুখে লাগানো আছে মাইক। আমি বললাম, “কর্নেল, আপনি ঠিকই বলেছিলেন। লক্ষ্মীর স্ত্রী-র অ্যাকাউন্টে বিরাট অঙ্কের টাকা ট্রান্সফার হয়েছে সদ্য।”
কর্নেল মাথা নাড়লেন। “আমি গেস করেছিলাম, দেয়ার হ্যাড বিন সামথিং ফিশি অ্যাবাউট দ্যাট বয়। ছেলেটাকে আমি পছন্দই করতাম, অস্বীকার করি না। কিন্তু টাকার লোভ বড় খারাপ জিনিস, দাশগুপ্তা।”
আর কিছু না বলে আমি নীচে বালির সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলাম। দিনের আলো শেষ হয়ে এসেছে। উঁচু-উঁচু বালিয়াড়ির ছায়া দীর্ঘ হচ্ছে পূর্ব দিকে।
আমরা রাজানার কাছে এসে নামলাম অল্পক্ষণের মধ্যেই। ছোটখাটো একটা বালির ঝড় তুলে কপ্টারটা ল্যান্ড করল। প্রোটেক্টিভ স্যুটের হেলমেটটা পরে এয়ার টাইট হয়েছে কি না চেক করে নিয়ে আমরা নেমে এলাম কপ্টার থেকে। ইনবিল্ট মাইক্রোফোন আছে স্যুটের মধ্যে পরস্পরের সঙ্গে কথা বলার জন্য।
“আসুন। এইদিকে।”
পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন কর্নেল আয়ার। একটু এগিয়ে যেতেই বীভৎস দৃশ্যটা চোখে পড়ল আমার।
দিনের আলো শেষ হয়ে এসেছে। সেই বিষণ্ণ লালচে আভায় দেখতে পেলাম রাস্তার উপরে পড়ে আছে সারি সারি মৃতদেহ। মুখগুলো বেশিরভাগই বেঁকে গেছে যন্ত্রণায়; নীলচে ভাবটা স্পষ্ট। অনেকগুলো হাঁ করা মুখের উপর ভনভন করে উড়ছে বড় বড় মাছি। পচন ধরেছে বেশিরভাগ দেহে।
মানুষগুলো পড়ে আছে রাস্তার উপরে, ঘরের দাওয়ায়; কেউ কেউ মরেছে ঘরের ভিতরেও। যেন হঠাৎ মৃত্যু নেমে এসে আলিঙ্গন করেছে এদের। এয়ার টাইট স্যুট থাকায় বাসি লাশের গন্ধটা আসছে না, এই যা বাঁচোয়া।
কর্নেল বললেন, “এই দেখুন, এই যে ঘরটার সামনে মরে পড়ে আছে লোকটা। এ-ই আদিল খান।”
বিস্ফারিত চোখে মরে কাঠ হয়ে যাওয়া লোকটার দিকে চেয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। কর্নেল বললেন, “ব্যাটাকে এখন আর দেখে বোঝার উপায় নেই, বেঁচে থাকতে কত বড় আতঙ্কবাদী ছিল।”
আমি বললাম, “কর্নেল, আপনি এর সম্বন্ধে আরও কিছু বলবেন বলেছিলেন এখানে এসে।”
কর্নেল বললেন, “আদিলের সঙ্গে আমাদের ক্যাপ্টেন লক্ষ্মীর বোধহয় গোপন যোগাযোগ ছিল।”
“কেন বলছেন এ কথা?”
“নয়তো লক্ষ্মীর অ্যাকাউন্টে বিরাট অ্যামাউন্টের টাকা কোথা থেকেই বা আসবে? এসব ওই সিরিয়ার টেররিস্ট গ্রুপের কাজ নির্ঘাত। লক্ষ্মী সে তথ্য আপনার কাছে পুরোপুরি গোপন করে গিয়েছিল। আদিল খানের সঙ্গে ওর যোগাযোগের ব্যাপারেও ইচ্ছে করে আমাদের ভুল ইনফর্মেশন দিত ও।”
রাজানা গ্রামের পথে পড়ে থাকা মৃত লোকগুলো খোলা চোখে দেখছে আমাদের। আমি বললাম, “কর্নেল আয়ার, তথ্য গোপন কি লক্ষ্মী একাই করেছে? ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল ইনফর্মেশন সাপ্লাই করার দায়ও কি ওর একারই?”
“মানে?”
“সেই রাতে ডক্টর সাক্সেনার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে আপনি হুইস্কি খেয়েছিলেন না? আপনারা দু-জনেই খেয়েছিলেন তো?”
“হ্যাঁ, তাতে কী হয়েছে?”
“হয়েছে এই, পোস্টমর্টেম রিপোর্টে ওঁর স্টমাক থেকে উদ্ধার হওয়া ডিনারের অবশিষ্টাংশের সন্ধান পাওয়া গেছে ঠিকই, কিন্তু সেখানে এক ফোঁটাও অ্যালকোহল ছিল না।”
কর্নেল ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। “কী মিন করতে চাইছেন আপনি?”
“মিন করতে চাইছি, আপনি জেনেবুঝে মিথ্যে বলেছেন আমাকে। সে রাতে আপনি হুইস্কি খেতে যাননি; তাঁকে খুন করার উপযুক্ত পরিস্থিতি আছে কি না যাচাই করতে গিয়েছিলেন। যখন দেখলেন, সুইটি রাজপুত ছুটি নিয়েছেন, তখন আপনি নিশ্চিন্ত হলেন… ডক্টর ভূষণ সাক্সেনা মুম্বইতে কয়েক কোটি টাকা দামের বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন, খবরটা জানতেন না আপনি?”
বিকেলের শেষ আলো প্রতিফলিত হচ্ছে কর্নেলের হেলমেটের কাঁচে। তার তলায় মুখটা তাঁর এইবার একটু নার্ভাস লাগছে।
একটু ভেবে তিনি বললেন, “নিতান্তই বাজে বকছেন আপনি। তবে হ্যাঁ, এ খবরটা শুনেছিলাম।”
“না কর্নেল, শুধু ‘শুনেছিলাম’ বললে তো হবে না। আপনি স্বয়ং গিয়েছিলেন ওই বাড়ি কিনতে ডক্টর সাক্সেনার সঙ্গে। বাড়ির পুরনো মালিক আপনাকে আইডেন্টিফাই করেছেন যে।”
রাগী গলায় কর্নেল আয়ার বললেন, “তাতে হয়েছেটা কী? বাড়ি কিনেছেন ডক্টর সাক্সেনা। আমি যদি তাঁর সঙ্গে গিয়েই থাকি, তাতে আপনার আপত্তির জায়গাটা কোথায়?”
“লক্ষ্মীর স্ত্রী-র অ্যাকাউন্টে যে বড় রকমের অ্যামাউন্ট ট্রান্সফার হয়েছে, তা আপনি জানতেন। আপনিই তো তার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন, না? তাই যত দোষ সব লক্ষ্মীর— এমন একটা বিশ্বাস তৈরি করতে চেয়ে আপনি আমাকে ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন লক্ষ্মীর নিকটাত্মীয়দের টাকা লেনদেনের হিসাব চেক করার। লক্ষ্মীও খুব সাধুপুরুষ ছিল না, কিন্তু আপনিই ওকে কাজে লাগিয়েছেন, তাই না?”
কর্নেল আয়ার হাসলেন এবার, “যা-কিছু ননসেন্স বকছেন, প্রমাণ করতে পারবেন তো?”
আমি বললাম, “প্রমাণ করার দায়িত্ব আমার, নিশ্চিন্ত থাকুন আপনি। আপনার কোর্টমার্শাল হলে তখন দেখা যাবে। লক্ষ্মীই মেরেছিল ডক্টর সাক্সেনাকে, এটা বুঝতেই পেরেছি। কিন্তু তার স্বার্থ এতে কিছু থাকতে পারে না। স্বার্থ থাকলে আপনার থাকাই সম্ভব। ডক্টর সাক্সেনা সম্ভবত আদিলের সঙ্গে বায়ো-ওয়েপনটা নিয়ে সরাসরি ডিল করতে চাইছিলেন। তাই লক্ষ্মীকে লাগিয়ে তাঁকে সরানো দরকার হয়ে পড়েছিল। ঠিক বলছি?”
“অনেক কিছু বুঝেছেন দেখছি।”
“একটা সত্যি কথা আপনি আমাকে বলে ফেলেছিলেন। আদিলকে জ্যান্ত ধরার জন্য প্রস্তুতি চলছিল। আপনার সঙ্গে আদিলের যোগ ছিল। আপনি চাইলে তাকে আগাম খবর দিয়ে পালিয়ে যেতে দিতে পারতেন। কিন্তু আপনি তা করেননি। আবার আদিল পালিয়ে গেলেও আপনার বিপদ। কারণ আপনার সম্বন্ধে আদিল অনেক কথা জানত। ধরা পড়লেই আপনার নাম করে আপনাকে ফাঁসিয়ে দিত সে। তাই আপনি বুদ্ধি করলেন আদিল সহ গোটা গ্রামকে খতম করে দিতে। ডক্টর সাক্সেনাকে যে অস্ত্রে খতম করেছিলেন, সেই অস্ত্র প্রয়োগ করলেন গোটা গ্রামের উপর। লোকে ভাবল, মহামারী লেগেছে গ্রামে। আসল সত্যটা জানল শুধু লক্ষ্মী আর আপনি।”
“আসল সত্যটা কী, দাশগুপ্তা?”
“ডক্টর সাক্সেনার ঘাড়ের কাছে একটা অতি সূক্ষ্ম পাংচার মার্ক পাওয়া গেছে। খুব সরু কোনও ছুঁচ জাতীয় জিনিসের দ্বারা ওই ভাইরাস সংক্রমিত করা হয়েছিল তাঁকে। কাজটা করেছিল লক্ষ্মী— ডক্টর সাক্সেনাকে ছুঁচ ফুটিয়েই ও বেরিয়ে আসে। তারপর…”
“অনেক বলেছেন।” হাত তুলে আমাকে থামিয়ে দিলেন কর্নেল আয়ার, “বাকিটা আমাকে বলতে দিন।”
“বলুন, বলুন।”
“এত কম সময়ের মধ্যে এতকিছু বুঝে ফেলবেন, ভাবিনি। একটা জিনিস ভুল করেছেন অবশ্য। ছুঁচজাতীয় কোনও মেটালের জিনিস নয়, আমরা ব্যবহার করেছিলাম ডার্টগান। আর সে বন্দুকের ডার্ট কী ছিল জানেন? তীক্ষ্ণমুখের বরফের ছুঁচ, ভাইরাস জড়িত। একবার ফায়ার করার পর শরীরের কোনও অংশে জিনিসটা শুধু ঢুকে রক্তে মেশার অপেক্ষা। কয়েক সেকেন্ডে কাম তামাম। বাইরে রয়ে যাওয়া বরফের ডার্টটা গলে গেলে তার আর কোনও চিহ্ন থাকে না। দারুণ ভাইরাস তৈরি করেছিলেন ডক্টর সাক্সেনা। নিজের অস্ত্রে নিজেকেই মরতে হবে, তা অবশ্য ভাবেননি কখনও উনি। ‘পাপ বাপকেও ছাড়ে না’, ঠিকই বলেছিল ক্যাপ্টেন সাহা।”
আমি শুনছি। আমি জানি, আজ আর উনি আমাকে জীবন্ত ফিরতে দেবেন না এখান থেকে। কিন্তু এখন ওঁর পুরো কাহিনিটা আমার শোনা দরকার।
“ওঁকে সাবাড় করে আমি আর ক্যাপ্টেন সাহা বেরিয়ে পড়লাম সেই রাতে হেলিকপ্টার নিয়ে। ইনফর্মার খবর দিয়েছিল, আদিল কোথায় আছে। আগে এখানে এসে ইনফর্মার ব্যাটাকে খতম করলাম— নয়তো ও একটা বড় সাক্ষী রয়ে যেত। তারপর ডার্ট ফায়ার করতে করতে এগিয়ে চললাম আদিলের খোঁজে। লোকগুলো ধুপ ধুপ করে মরে পড়ে যেতে লাগল।
“আপনাকে হার্ডড্রাইভের কথা বলছিল না লক্ষ্মী? ওই জায়গায় আরেকটু ভুল করেছেন আপনি। হার্ডড্রাইভটা ডক্টর সাক্সেনার নয়, ওটা আমার। আমার সম্বন্ধে বেশ কিছু বিপজ্জনক তথ্য জোগাড় করেছিল আদিল। ওইটি ব্যবহার করেই দীর্ঘদিন ব্ল্যাকমেল করে আসছে ও আমাকে; আমিও বাধ্য হয়েছি আমাদের ভেতরের অনেক খবর ওকে দিতে। বিনিময়ে আমাকে টাকাপয়সা কম দেয়নি ও অবশ্য। লক্ষ্মীও ভাগ পেয়েছে। গতবারের টাকাটা অবশ্য ইচ্ছা করেই লক্ষ্মীর স্ত্রী-র অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করার কথা বলেছিলাম আমি, যাতে ওকে খতম করার পর ওকেই ভিলেন সাজাতে পারি। লক্ষ্মীও এখান থেকে ফেরার পর বুঝতে পেরেছিল, আমার পরের টার্গেট ও নিজেই। তাই আপনার কাছে যাওয়ার কথা ভেবেছিল ও।
“সে যা-ই হোক, গ্রামের সব ক-টাকে খতম করে আদিলের সন্ধান পেলাম আমরা। বাইরে যে এত কাণ্ড চলছে, ব্যাটা বুঝতেই পারেনি। ঘুমের মধ্যেই ওর গলায় একটা ডার্ট বিঁধে দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই তড়পে তড়পে মরে গেল হতচ্ছাড়া। তারপর ওর জিনিসপত্র সার্চ করে হার্ডড্রাইভটা উদ্ধার করে আরেকবার গোটা গ্রামটা চেক করে দেখে নিলাম সাক্ষী দেওয়ার মতো বাচ্চা-বুড়ো কেউ বেঁচে রয়ে গেল কি না। দুটো ছেলে তখনও বেঁচে ছিল, তাদের ব্যবস্থা করে আমরা ফিরে এলাম। তারপর সেই রাতেই হার্ডড্রাইভটা ধ্বংস করে আমি ঘুমোতে গেলাম। তখনই অবশ্য মনে মনে ঠিক করা ছিল, ক্যাপ্টেন সাহার আর চব্বিশ ঘন্টা পেরোতে দেওয়া চলবে না। ছেলেটা কাজের, কিন্তু প্রেশার সিচুয়েশন হ্যান্ডল করতে পারবে না। আপনার জেরার সামনে পড়লে ও সব ফাঁস করে দিত।
“আমার অনুমান একদম ঠিক ছিল। আমার হাবভাব দেখে ও বুঝতেই পেরেছিল, আমি ওকে চোখে চোখে রেখেছি— যে কোনও সময় ও খতম হয়ে যাবে। তাই পরের দিনই ও যাচ্ছিল আপনার কাছে। কিন্তু তার আগেই ওকে ফিনিশ করে দিলাম আমি। আমি জানতাম, আপনি বুঝতেই পারবেন এ আত্মহত্যা নয়, খুন। কিন্তু সে খুনের সঙ্গে আমাকে কানেক্ট করার কোনও উপায় নেই, তাও জানতাম।”
মাছিগুলো এখনও ভনভন করছে মৃতদেহগুলোর উপর। কয়েকটা উড়ছে আমাদের মুখের চারপাশে। আমি সরালাম না সেগুলোকে, উড়তে দিলাম। কর্নেল আয়ার তাঁর পিস্তল বার করলেন।
“ইটস নাথিং পার্সোনাল উইথ ইউ, দাশগুপ্তা,” পিস্তলের ফিংগারপ্রিন্ট প্যানেলে আঙুল ছোঁয়ালেন কর্নেল আয়ার। “ফিরে গিয়ে বলব, আপনি আমাকে হঠাৎ আক্রমণ করেছিলেন, তাই সেলফ-ডিফেন্সের জন্য আপনাকে গুলি করতে বাধ্য হয়েছি। বুঝতেই পারছেন, এত কিছু জানার পরে আপনাকে আর ফিরে যেতে দিতে পারি না আমি।”
আমি একটু হাসলাম। দৃশ্যটা বড় অদ্ভুত লাগল আমার চোখে। সূর্যাস্তের মলিন আলো ছড়িয়ে আছে মরুভূমির প্রান্তের এই ছোট্ট গ্রামটাতে। সেই আলোয় পথ জুড়ে পড়ে আছে সারি সারি নারী-পুরুষ-শিশুর নিঃসাড় মৃতদেহ। বাতাস বইছে না। আর সেই বিষণ্ণ আলোয় একটা কিম্ভূত স্যুটপরা মানুষ বন্দুক তাক করে আছে আরেকটা কিম্ভূত স্যুটপরা মানুষের দিকে।
কর্নেল বললেন, “হাসছেন আপনি? ঠিক আছে, হেসে নিন। গুড বাই, দাশগুপ্তা।”
ট্রিগার টানলেন তিনি। গুলি বেরোল না।
অবাক হয়ে নিজের অস্ত্রটাকে উলটেপালটে দেখতে লাগলেন কর্নেল আয়ার। “হোয়াট দ্য হেল…!”
আমি বললাম, “ও জিনিস এখন আপনার হাতে একটা খেলনার চেয়েও মূল্যহীন, কর্নেল আয়ার। এখানে আসার আগেই আপনার বড়কর্তাদের সঙ্গে আমার কথা হয়ে গেছে। ব্রিগেডিয়ার শর্মাও সব জানেন। আপনি কপ্টারে ওঠামাত্রই ব্রিগেডিয়ার খবর পাঠিয়েছেন ওপরমহলে, আর গান-সার্ভারে আপনার গান-অ্যাক্টিভেশন ক্যান্সেল করা হয়েছে।”
একরাশ অবিশ্বাস দু-চোখে নিয়ে কর্নেল তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। অন্ধকার নেমে আসছে দ্রুত।
“পাপ বাপকেও ছাড়ে না। কেমন লাগবে কর্নেল, যদি এই মৃত মানুষগুলো আজ হঠাৎ জীবন্ত হয়ে ওঠে?”
“কীসব বলছেন আপনি?” চিৎকার করে উঠলেন কর্নেল আয়ার।
আমাদের চোখের সামনেই কয়েকটা নিস্পন্দ দেহ নড়ে উঠল। সন্ধ্যার অন্ধকার আকাশে তারা ফুটে উঠছে এক এক করে। দেহগুলো উঠে বসল সোজা হয়ে। কর্নেল তাকিয়ে আছেন বিস্ফারিত চোখে।
উঠে দাঁড়াল ওরা; ছায়ামূর্তির মতো এগিয়ে যাচ্ছে ওরা কর্নেলের দিকে। “স্টপ ইট! স্টপ ইট!” হাতের অকেজো বন্দুকটা উঁচিয়ে রেখেই চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি আবার। “দিজ কান্ট বি গোস্টস!”
আমি হাসলাম। “না কর্নেল, ভূত নয়, ওরা সেনাবাহিনীরই লোক। আমার আর ব্রিগেডিয়ার শর্মার যৌথ আলাপের ফল। আমরা এখানে আসার আগে থেকেই এরা মৃতদের মাঝে শুয়েছিল আপনার কনফেশনের আশায়। ভাইরাসটা আসলে সংক্রামক নয়, আমাদের নিশ্চিত করেছেন ডক্টর নিশান্ত হাজারিকা। ঠিকই বলেছিলেন আপনি। আপনাকে ধরার কোনও উপায় ছিল না— আপনার কনফেশন ছাড়া। এতগুলো লোককে মেরেছেন, তার উপর আমাকেও মারতে চেয়েছেন আপনি। আর স্ট্রাগল নয়, কর্নেল। এবার শান্তভাবে সারেন্ডার করুন।”
এখনও তেজ মরেনি তাঁর। “আমি কোনও কনফেশন দিইনি। আপনি কিছুই প্রমাণ করতে পারবেন না।”
অগত্যা আমার স্যুটের মাইক্রো-রেকর্ডারটা কিছুটা ফাস্ট-ফরোয়ার্ড করে চালু করলাম। কর্নেলের গলা ভেসে এল, “ওঁকে সাবাড় করে আমি আর ক্যাপ্টেন সাহা বেরিয়ে পড়লাম সেই রাতে হেলিকপ্টার নিয়ে। ইনফর্মার খবর দিয়েছিল, আদিল কোথায় আছে। আগে এখানে এসে ইনফর্মার ব্যাটাকে খতম করলাম— নয়তো ও একটা বড় সাক্ষী রয়ে যেত। তারপর ডার্ট ফায়ার করতে করতে এগিয়ে চললাম আদিলের খোঁজে। লোকগুলো ধুপ ধুপ করে মরে পড়ে যেতে লাগল।”
আমি বললাম, “আর শুনবেন?”
যেন জোঁকের মুখে নুন পড়ল। আমি বললাম, “আর ওই যে মাছিগুলো উড়তে দেখছেন, ওগুলোকেও বড় সাধারণ জিনিস ভাববেন না। ওগুলোর মধ্যে চারখানা ড্রোন-ক্যামেরা আছে। আপনি যে একটু আগে আমাকে মারার জন্য বন্দুক তুলেছিলেন, সে দৃশ্য ধরা পড়েছে ওদের ক্যামেরায়— আপনার উপরওয়ালারাও সব দেখছেন এই মুহূর্তে।”
মাথা নিচু হয়ে এল কর্নেল আয়ারের। আর বাঁচার উপায় নেই, বুঝতে পেরেছেন তিনি।
সেনাবাহিনীর লোকেরা যখন তাঁকে বন্দি করে কপ্টারে তুলছে, তখন সূর্য ডুবে গেছে। সে দৃশ্যের দিকে পেছন ঘুরে আমি হাঁটতে লাগলাম।
রহস্য সমাধান হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মনটা ভালো লাগছে না। মুখের ভেতরটা যেন তেতো হয়ে আছে। মাছিগুলো উড়ছে এখনও মৃতদেহগুলোর উপর। না, সবগুলো তো ড্রোন নয়— আসল মাছিও আছে— তারাই সংখ্যায় বেশি।
পাপ বাপকেও ছাড়ে না। ভূষণ সাক্সেনাকে ছাড়েনি, লক্ষ্মীপতি সাহাকে ছাড়েনি, আদিল খানকে ছাড়েনি, কর্নেল আয়ারকে ছাড়েনি। কিন্তু রাজানা গ্রামের এই নিরীহ লোকগুলো? কী পাপ করেছিল এরা?
ডক্টর সাক্সেনার কথাগুলো মনে পড়ল। “এই গরীব লোকগুলো দেশের কোনও কাজে লাগে না। অ্যাট লিস্ট, এক্সপেন্ডেবল ল্যাব-র্যাট হিসেবেও যদি এদের ব্যবহার করা যায়, তাহলে দেশের কিছু উপকারে লাগে।”
দেশের উপকার? কারা এই “দেশ”? কাদের নিয়ে এই “দেশ”?
সেই বিরাট অন্ধকার মরুভূমির তারাভরা প্রান্তদেশে নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে মনে হল, আমাদের অজান্তেই যেন এক অসীম ক্ষমতাধারী অলৌকিক ভাইরাস মহামারীর মতো প্রতিনিয়ত শেষ করে দিচ্ছে আমাদের অস্তিত্বের সবচেয়ে দামী জিনিসটাকে।
সে আমাদের মনুষ্যত্ববোধ।
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, পঞ্চম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, বড় গল্প, সৌম্য সুন্দর মুখোপাধ্যায়, সৌরভ ঘোষ
অতি চমৎকার একটি রহস্য গল্প পড়ার সুযোগ পেলাম। ধন্যবাদ সৌম্য। জয়তু কল্পবিশ্ব।
আপনার ভাল লেগেছে জেনে খুবই আনন্দিত হলাম। আমার শুভেচ্ছা নেবেন।
খুব ভালো লাগলো। আজকের এই অতিমারীর সময় এই ভাইরাসের গল্পগুলো গল্প নয়, কল্পও নয়, একেবারে কিরকম কঠিন বাস্তব হয়ে উঠেছে……
যথার্থ বলেছেন। আপনার ভাল লেগেছে জেনে খুব ভাল লাগল।
দুর্দান্ত গল্প ! পড়ে মনে হল সে আশ্চর্য যুগের গুর্নেক সিং আবার কল ধরেছেন !!
দুর্দান্ত গল্প ! পড়ে মনে হল সে আশ্চর্য যুগের গুর্নেক সিং আবার কলম ধরেছেন !!
আপনার মত মানুষের প্রশংসার মূল্য আমার কাছে অভাবনীয়, স্যার। আশীর্বাদ করবেন।
অসাধারণ৷ খুব ভালো লাগল৷
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।