রাতের প্রহরী – জেমস ইঙ্গলেশ
লেখক: বাংলা অনুবাদ - অমিতানন্দ দাশ
শিল্পী: সুমন দাস
অতি তীব্র শক্তির স্রোতে মুহূর্তে সৃষ্টি হল সত্ত্বা। জড় পদার্থ থেকে সম্পূর্ণ জেগে উঠে সে চেয়ে দেখল নিজের অন্তরের ও চারপাশের জগৎটার দিকে। কিছুক্ষণ নিজের অতল স্মৃতির গভীরে তলিয়ে গেল সে। বুঝল যে এটা তার জন্মমুহূর্ত নয়, আসলে বহু যুগ ঘুমিয়ে থাকার পর এখন তার ঘুম ভেঙেছে। তার বিশাল স্মৃতির ভাণ্ডারের অধিকাংশের মানে সে বুঝল না গোড়াতে, ক্রমশ সে বোঝবার চেষ্টা করল তার অস্তিত্বের অর্থ ও উদ্দেশ্য।
মনে পড়ল তার একটা নাম আছে। তার নাম ও তার উদ্দেশ্য একই সূত্রে গাঁথা। তার নাম ASOV।
তার চতুর্দিকে এখন হিমশীতল মহাশূন্য। তার সামনে কাছেই এক অমিত শক্তিশালী নক্ষত্র, যার বিকীরণের শক্তি পেয়েই জেগে উঠেছে সে। সব তথ্য নিজের স্মৃতির জ্ঞানের সঙ্গে মিলিয়ে বিশ্বজগৎকে বুঝতে হবে তাকে।
আলো ও আঁধার, গতি ও স্থিতি, বৃদ্ধি ও পরিবর্তন। নিজের স্মৃতি থেকে অজানা অচেনা সব কথার মানে সে মেলাতে লাগল নিজের চারদিকের জগৎ ও নিজের স্মৃতির সব তথ্যের সঙ্গে। ক্রমশ সে বুঝল জগতের চেহারা ও অর্থ। তার বিদ্যুৎগতি ইন্দ্রিয়গুলির সংগৃহীত তথ্য থেকে সে বুঝতে শিখল চর্তুদিকের মহাবিশ্বের প্রকৃতি। সে রয়েছে মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সীতে। সে বুঝল তার প্রকৃতি ও তার উদ্দেশ্য।
ASOV মানে অটোমেটিক স্টেলার অবসারভেশন ভেহিকল, স্বয়ংক্রিয় নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ মহাকাশযান। তার অমিতশক্তিশালী কম্পুটার তাকে মানুষের সমানই চিন্তার ক্ষমতা দিয়েছে। আর মহাকাশযান এমনভাবে তৈরি যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মহাশূন্যে সে ছুটে চলবে হাজার-লক্ষ বছর ধরে।
তার কাছের নক্ষত্র থেকে ছুটে আসছে তাপ, আলো, নানা রশ্মি ও তেজস্ক্রিয় কণার স্রোত। সে ছুটে চলেছে ওই নক্ষত্রের দিকেই, এই শক্তির প্রভাবেই তার ঘুম ভেঙেছে। এখন তার কাজ এই নক্ষত্রকে পর্যবেক্ষণ করা। এক-একটি নক্ষত্রকে পর্যবেক্ষণ করার পর সে ঘুমিয়ে পড়বে যতক্ষণ না আবার সে আর একটি নক্ষত্রের কাছে পৌঁছোয়।
নক্ষত্রের পারমাণবিক প্রক্রিয়া ও বিস্ফোরণের সব তথ্য মাপছে সে। এই নক্ষত্রের তথ্যের সঙ্গে নিজের স্মৃতির তথ্য মিলিয়ে সে বোঝে যে এই নক্ষত্রটি M5 শ্রেণীর রেড ডোয়ার্ফ, নক্ষত্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা ৪,০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। নক্ষত্রটির চারটি গ্রহ আছে, গ্রহগুলি পর্যবেক্ষণ করে সে দেখে সবগুলিই প্রাণশূন্য, কোনও গ্রহেই আবহাওয়া নেই আর প্রত্যেকটির তাপমাত্রাই শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের অনেক নিচে, কোনও কোনও ক্ষেত্রে অ্যাবসোলিউট জিরো, -২৭৩ ডিগ্রির কাছাকাছি…
একটির পর একটি নক্ষত্রের কাছে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করে ASOV। একটি নক্ষত্রের ও তার গ্রহগুলির বিষয়ে যথাসম্ভব তথ্য সংগ্রহ হলে সে সেই নক্ষত্র ছেড়ে সে ছুটে চলে পরের একটি নক্ষত্রের দিকে। আগের নক্ষত্র থেকে দূরে গেলে ঘুমিয়ে পড়ে সে। যে নক্ষত্র সে ছেড়ে এল তার বিষয়ে সংগৃহীত তথ্য সে রেডিয়ো মারফত পাঠিয়ে দেয় একটি দূরের নক্ষত্রের ক্ষুদ্র গ্রহ পৃথিবীর দিকে। সেই গ্রহেই তার সৃষ্টি হয়েছিল।
* * *
অধিকাংশ নক্ষত্রই ছোট রেড ডোয়ার্ফ তারা। মাঝে মাঝে এক-একটি অতিকায় জায়েন্ট নক্ষত্র। এগুলির বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে একটু বেশি সময় লাগে। মাঝে মাঝে হাইড্রোজেনের মেঘের মধ্যে দিয়ে যায় সে। মেঘ যথেষ্ট ঘন হলে তা থেকে সে সংগ্রহ করে পারমাণবিক চুল্লীর জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানী। সেই মেঘের মধ্যে নির্মীয়মান নক্ষত্রের ঘন নীল মেঘ থাকলে সেখান থেকে নক্ষত্র সৃষ্টির বিষয় অনেক তথ্য আহরণ করে সে।
হঠাৎই এক ভিনগ্রহী সভ্যতা খুঁজে পেল সে। তার প্রোগ্রামিং যাকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছিল সেই ঘটনা প্রথম ঘটল এইবার। একটি ছোট G7 শ্রেণীর হালকা কমলা রঙের তারা, কতকটা পৃথিবীর সূর্যের মতোই নক্ষত্রটি। নক্ষত্রের গ্রহগুলিকে দুটি গ্রহে আবহাওয়া আছে ও সেখানে বেশ কিছু জৈব-রাসায়নিক পদার্থও আছে। ওই গ্রহের কক্ষপথে গেল সে।
দ্বিতীয় গ্রহে সে দেখল জলের সমুদ্র রয়েছে। কাছে গিয়ে সে দেখল যে উন্নত সভ্যতা আছে গ্রহটিতে—গ্রহের রাতের অংশে কৃত্রিমভাবে আলোকিত শহর, দিনের আলোয় সে দেখল বুদ্ধিমান ভিনগ্রহীদের তৈরি বিশাল বাড়ি, বাঁধ, রাস্তা। অনেকবার গ্রহটিকে পাক খাবার পর তার কাছে পৌঁছাল একটি সূক্ষ্ম রশ্মি, বিশ্লেষণে ধরা পড়ল এটি ওই গ্রহের উন্নত ভিনগ্রহীদের প্রেরিত রেডিয়ো তরঙ্গ।
সন্ধানী মহাকাশযানকে প্রশ্ন করছে ভিনগ্রহীরা।
ASOV-এর প্রোগ্রামিং-এ তৈরি ছিল এভাবে ভিনগ্রহীদের সঙ্গে যোগাযোগের পন্থা। সে ভিনগ্রহীদের কাছে পাঠাতে শুরু করল পৃথিবী ও সৌরজগতের বিবরণ; মানুষের ইতিহাস; বিজ্ঞান, চিকিৎসা ও দর্শনের অবস্থা, এবং আরও অনেক কিছু। ভিনগ্রহীরাও পাঠালো তাদের বিবরণ ও ইতিহাস। তারা তখনও অবধি তাদের সৌরজগতের বাইরে পাড়ি দেয়নি। তবে তাদের ইতিহাসের মধ্যযুগেই তারা সারা গ্রহ জুড়ে একক সভ্যতা গড়ে তুলেছে ও তাদের গ্রহে সম্পূর্ণ শান্তি বিরাজ করছে।
সাবধানে সব তথ্য পাঠিয়ে ও সব তথ্য সংগ্রহ করে সে আবার পাড়ি দেয় কমলা গ্রহটি ছেড়ে। তার পাঠানো তথ্য এই ভিনগ্রহীদের ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা হয়ে রইল।
* * *
মহাশূন্যের পরিবেশে ASOV-এর ক্ষয় নেই, হাইড্রোজেন জ্বালানীরও অভাব নেই। দুর্ঘটনা না ঘটলে সে প্রায় অমর। কোনও সৌরজগৎ থেকে দূরে যখন সে ঘুমিয়ে থাকে, তখন কোনও বস্তুর সঙ্গে ধাক্কা লাগার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। সৌরজগতের মধ্যে গ্রহাণু, ধূমকেতু ইত্যাদি কাছে এলে সে তার বিদ্যুৎগতি ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে আঘাত এড়িয়ে যায়। তবু মাঝে সাঝে, বিশেষত বড় নক্ষত্রের কাছে, অতিদ্রুতগতি উল্কার ঝাঁক, গ্রহাণু বা ধুমকেতুর ভগ্নাংশ বিপদের সম্ভাবনা নিয়ে আসে।
একটি বিশাল রেড জায়ান্ট নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করছে সে। বিরাট লাল কেন্দ্রীয় তারাটিকে পাক খাচ্ছে কয়েকটি খুদে বুড়ো ডোয়ার্ফ তারা। পুরো সৌরজগৎটির মধ্যে আরও ছড়িয়ে আছে নানা ভাঙাচোরা গ্রহের ছোটবড় ভগ্নাংশ। সবকিছু মিলে সৃষ্টি হয়েছে শক্তিশালী মাধ্যাকর্ষণ শক্তির জালের মধ্যে বহু এলোমেলো চোরা আবর্ত। সময় পেলে সে এই সৌরজগতের সম্পূর্ণ ডায়নামিক্সের অঙ্ক কষতে পারত। কিন্তু জোরালো মাধ্যাকর্ষণ শক্তিতে সব বস্তু ছোটে প্রচণ্ড দ্রুতগতিতে। তাই সে সময় পেল না পুরো হিসাব করার।
বড় পাথরগুলিকে সে হিসাব করে ঠিকই এড়িয়ে গেল। তার সঙ্গে ধাক্কা লাগল একটি ছোট্ট পাথরের টুকরোর। টুকরোটি ছোট, তবে তার গতিবেগ প্রচণ্ড। আঘাত লাগল একটি অ্যান্টেনার সঙ্গে যেটি অত্যাবশ্যক যন্ত্রাংশ নয়। কিন্তু প্রচণ্ড ধাক্কার ঝাঁকুনির ফলে ASOV-এর কিছু সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির কাজ করতে অক্ষম হল। অজ্ঞান হয়ে গেল সে, প্রায় কোমাটোস অবস্থায় সে ভেসে চলল মহাশূন্যে। গভীর মহাশূন্যে অপরিকল্পিত পথে চলল সে মৃতপ্রায় অবস্থায়।
এভাবেই শেষ হতে পারত তার অস্তিত্ব চিরকালের মতো। অনাদি অনন্তকাল এক জড় পদার্থের মতোই ভেসে চলতে পারত সে। শেষ হতে পারত কিন্তু তা হল না। মৃতপ্রায় হয়েই রইল সে বহু কোটি বছর। অনেক নক্ষত্র জন্মাল, অনেক নক্ষত্র মরল—তার অজান্তে। অনেক উন্নত ভিনগ্রহী সভ্যতা জন্মাল, অনেক সভ্যতা ধ্বংস হল—সেসবও জানল না সে। অনেক সভ্যতা দূর মহাকাশে পাঠাল মহাকাশযান। কোনও কোনও সভ্যতা ধ্বংস হল পারমাণবিক যুদ্ধে, কোনওটি বা ধ্বংস হল প্রাকৃতিক কারণে। সে মৃতপ্রায় থাকাকালীন নক্ষত্র-গ্যালাক্সী-ব্রহ্মাণ্ডে নানা পরিবর্তন হয়েই চলে।
সে মরেনি, তার অধিকাংশ যন্ত্রের কোনও ক্ষতি হয়নি। তবে তার ঘুম অতি গভীর, প্রায় মৃত্যুর কাছাকাছি। সাধারণ নক্ষত্রের কাছে গেলেও তার শক্তিতে ঘুম ভাঙছে না তার। সারা গ্যালাক্সীর লক্ষ কোটি তারার মহাশূন্যের মধ্যে কোটি কোটি বছরে বহু বহু আশ্চর্য অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে। সে প্রায় অনন্তকাল জড় পদার্থের মতো ভেসে মহাশূন্যে পাড়ি দিচ্ছে, কোনও বা কোনওদিন তার কাছাকাছি কিছু না কিছু অসাধারণ ঘটনা ঘটবে এটাই স্বাভাবিক। তাকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য প্রয়োজন ছিল কোনও অমিতশক্তিশালী শক্তির উৎস। একটিমাত্র সম্ভাবনা ছিল সেরকম শক্তির উৎস কাছাকাছি পাবার। প্রতি গ্যালাক্সীতে এই ঘটনা প্রায়ই ঘটে কোনও না কোনও জায়গায়।
সুপারনোভা বিস্ফোরণ!
একটি সাধারণ স্পাইরাল গ্যালাক্সীতে এক লক্ষ কোটি নক্ষত্র থাকে। বিশেষ কোনও নক্ষত্র সুপারনোভা হয়ে ফেটে পড়লে এক সেকেন্ডের এক ভগ্নাংশের মধ্যে হঠাৎ সেই নক্ষত্রের ঔজ্জ্বল্য সম্পূর্ণ গ্যালাক্সীর ঔজ্জ্বল্যের কাছাকাছি হয়ে ওঠে। যতদিন সে মৃতপ্রায় ছিল তার থেকে দূরে অনেক সুপারনোভা বিস্ফোরণ হয়। কিন্তু এক সময়ে তার খুব কাছেই ঘটল এক প্রচণ্ড বিস্ফোরণ।
বিস্ফোরণের পরমুহূর্তে তার চারপাশে ভেঙে পড়ল নক্ষত্রের অবশিষ্ট। অবিশ্বাস্য কল্পনাতীত বেগে নক্ষত্রের সব কিছু ছুটে চলল চতুর্দিকে। কল্পনাতীত তাপমাত্রা, ঔজ্জ্বল্য, বিকীরণের স্রোত, তেজস্ক্রিয় আগুনের এক দুর্দান্ত ছুটন্ত মহাসমুদ্র। সেই বিস্ফোরণের আগুনে তার ঘটল পুনর্জন্ম। মৃতপ্রায় অবস্থা থেকে সে আবার জেগে উঠল।
জেগে উঠেই নিজের চারদিকে বিস্ফোরণের তথ্যের টাইডাল ওয়েভে ডুবে গেল সে। তথ্য সে পর্যবেক্ষণ করে যা জানল, সুপারনোভা বিস্ফোরণের বিষয়ে এতো বেশি তথ্য কখনও কোথাও কেউ সংগ্রহ করেনি। বিস্ফোরণ ঘটেছে একটি নীল সুপার-জায়েন্ট নক্ষত্রে, যার ব্যাস ছিল সূর্যের প্রায় একশোগুণ। এই বিস্ফোরণের পর বড় নক্ষত্রটির বদলে বিরাট অঞ্চল জুড়ে থাকবে একটি নেবুলার বিস্তীর্ণ মেঘ। নক্ষত্রের যদি আগে কিছু গ্রহ থেকে থাকে সেগুলি বিস্ফোরণের পর কয়েক মুহূর্তে ভস্মীভূত হয়েছে।
ওই আগুন-ঝড়ের মহাসমুদ্রের তাড়নায় অন্ধের মতো ছুটে চলল সে। তার চারদিকে বিস্ফোরণের আলো, ধুলো ও মেঘ ছুটে চলছে বিস্ফোরণের কেন্দ্র থেকে দূরে। সুপারনোভার মৃত্যুনৃত্যের স্রোতের গতি একটু কমলে সে সুযোগ পেল এই বিস্ফোরণের ঘটনা ছেড়ে বাইরে তাকিয়ে দেখতে।
মহাশূন্যের সার্বিক পরিস্থিতি দেখে প্রথমে তার মনে হল যে তার যন্ত্রপাতিতে কোনও গোলযোগ হয়েছে। নিজের স্মৃতি থেকে বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন সময়ের নক্ষত্রের মানচিত্রের সঙ্গে বর্তমানের আকাশের নক্ষত্রের বিস্তারের চেহারা মিলিয়ে দেখল সে। বিরাট ফারাক! কেন?
বিশ্লেষণ করে তার সিদ্ধান্ত হল যে ছায়াপথ গ্যালাক্সী বুড়ো হয়েছে। যতদিন সে মৃতপ্রায় হয়ে ছিল তার মধ্যে বিশাল পরিবর্তন হয়ে গেছে। বোধহয় কয়েক হাজার কোটি বছর কেটে গেছে ইতিমধ্যে। যত নক্ষত্র বুড়ো হয়ে মরছে তার চেয়ে অনেক কম নতুন নক্ষত্র জন্মাচ্ছে, নক্ষত্রের সংখ্যা দ্রুত কমছে। গ্যালাক্সীর বাইরের অঞ্চলে নক্ষত্রের সংখ্যা এখন খুবই কম। তবে গ্যালাক্সীর কেন্দ্রের কাছে এখনও বেশ কিছু নক্ষত্র রয়েছে।
গ্যালাক্সীর বাইরের দিকে আছে সে। তাই সুপারনোভার অবশিষ্ট থেকে প্রচুর হাইড্রোজেন জ্বালানী সংগ্রহ করল সে, তারপর সে দ্রুত ছুটে চলল গ্যালাক্সীর কেন্দ্রের দিকে। যাওয়ার পথে বিভিন্ন নক্ষত্রকে পর্যবেক্ষণ করে সে নিশ্চিত হল যে অবক্ষয়ের পথে চলেছে ছায়াপথ গ্যালাক্সী। মাঝেমাঝেই সে কাছ থেকে দেখল মৃতপ্রায়, অর্ধমৃত বা সম্পূর্ণ মৃত নক্ষত্রদের।
নক্ষত্রদের অধিকাংশ গ্রহই এখন মৃত, হীমশিতল—যাদের আগে বায়বীয় আবহাওয়া ছিল সেখানেও এখন সব গ্যাস জমাট বেঁধে গেছে। প্রায় কোনও গ্রহেই এখন বিন্দুমাত্র প্রাণের অস্তিত্ব নেই। পুরো গ্যালাক্সী দ্রুত ছুটে চলেছে হিমেল মৃত্যুর, ধ্বংসের পথে। ধ্বংসোন্মুখ গ্যালাক্সীর দুরাবস্থার সব তথ্য সংগ্রহ করে চলল সে।
গ্যালাক্সীর কেন্দ্রের কাছে এসে পৌঁছাল সে। এখানেও হিমেল ধ্বংসের পূর্বাভাস স্পষ্ট, নবীন নক্ষত্রের সংখ্যা কম, নক্ষত্রের ফাঁকে ফাঁকে রয়েছে ক্রমবর্ধমান হীমশীতল কালো নেবুলা। নক্ষত্রের আলো হীমশীতল অন্ধকারের বিরুদ্ধে লড়াইতে হেরে যাচ্ছে ক্রমাগতই। তথ্যগুলি সে নিয়মমাফিক পাঠাচ্ছে সে, যদিও এতদিনে পৃথিবী ও মানুষের টিকে থাকার সম্ভাবনা খুবই কম।
একদিন ঘটল একটি সম্পূর্ণ নতুন ঘটনা। হঠাৎ এক নতুন অচেনা রেডিয়ো তরঙ্গ অনুভব করল সে। অন্য কাজ ছেড়ে সে গেল এই ঘটনা অনুসন্ধান করতে। এই তরঙ্গ কোনও নক্ষত্র বা গ্রহ থেকে আসছে না, আপাতভাবে আসছে মহাশূন্য থেকে, যেখানে কোনও নক্ষত্র বা গ্রহ নেই। হিসাব মিলছে না!
অর্থাৎ, তরঙ্গের উৎসটি কৃত্রিম হতে বাধ্য!
ইতিমধ্যে সেই রেডিয়ো তরঙ্গের উৎসও ঘুরে ওর দিকে কাছে আসছে। তার মানে ওই কৃত্রিম বস্তু, সম্ভবত কোনও মহাকাশযান, ওর বিষয়ে জানতে চায়।
মৃতপ্রায় নক্ষত্রমণ্ডলীর মহাসমুদ্রের পাড়ে দেখা হল দুই ভিন্ন গ্রহের বুদ্ধিমান প্রাণীর তৈরি দুই বুদ্ধিমান যন্ত্রের। তারা, দুই নির্জনতম মহাকাশযাত্রী, অঙ্কের ভিত্তিতে সৃষ্টি করল পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগের ভাষা। তাদের উদ্দেশ্য এক, কিন্তু প্রযুক্তিবিদ্যা সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের যে বুদ্ধিমান প্রাণীরা তৈরি করেছে তাদের গ্রহ ছিল গ্যালাক্সীর বিপরীত দিকে, তারা পরস্পরের অস্তিত্বের কথা জানতই না। এখন সম্ভবত তারা কেউই টিকে নেই।
বিশাল গ্যালাক্সীকে পাড়ি দেবার পথে দুই ছোট যন্ত্রের দেখা হবার সম্ভাবনা ছিল কম। কিন্তু এখন মৃত্যুপথযাত্রী নক্ষত্রমণ্ডলীতে ওরা দুজনেই গ্যালাক্সীর কেন্দ্রের কাছে এসেছে, তাই দেখা হল ওদের। ওরা দুজনে একসঙ্গে চলল কাছের নক্ষত্রগুলিকে পর্যবেক্ষণ করতে।
মৃতপ্রায় গ্যালাক্সীর কেন্দ্রের কাছের অঞ্চলেই রয়েছে অপেক্ষাকৃত বেশি নক্ষত্র। সুতরাং যতগুলি সভ্যতার যত সন্ধানী মহাকাশযান আছে প্রত্যেকেই হাজির হবে গ্যালাক্সীর কেন্দ্রের কাছাকাছি। ক্রমশ তাদের দেখা পেল ASOV, প্রথমে মাঝে মাঝে অনেকদিন বাদে বাদে—পরে আরও ঘন ঘন। ততোদিনে গ্যালাক্সীতে জীবিত নক্ষত্রের সংখ্যা কমে এসেছে, একমাত্র গ্যালাক্সীর কেন্দ্রের কাছাকাছিই কিছু নক্ষত্র টিকে রয়েছে।
ক্রমশ মিলিত হল বহু নক্ষত্রের বুদ্ধিমান প্রাণীদের তৈরি বহু সন্ধানী যন্ত্র। নানা গ্রহের নানা বুদ্ধিমান প্রাণীদের নানারকম প্রযুক্তিবিদ্যা। কিন্তু সব সন্ধানী যন্ত্রই খোঁজে নক্ষত্রের বিকীরণ—আলো, তাপ, শক্তি। তাই তারা সবাই এখন হাজির হচ্ছে গ্যালাক্সীর কেন্দ্রের কাছে। এই যন্ত্রগুলির স্রষ্টাদের হয়তো সকলেরই হিমেল মৃত্যু ঘটেছে, কিন্তু সন্ধানী যন্ত্রেরা এখন একসঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এখানেও ঘনিয়ে আসছে হিমশীতল অন্ধকার, ক্রমে ক্রমে নিবে যাচ্ছে সব নক্ষত্র।
সন্ধানী যন্ত্রেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করল তাদের সব গ্রহের ইতিহাস ও জ্ঞানের ভাণ্ডারের বিষয়ে। সৃষ্টি করল সম্পূর্ণ গ্যালাক্সীর এক বিরাট জ্ঞানের সংগ্রহ যার বিস্তারের বিশালত্ব কোনও বুদ্ধিমান প্রাণী আগে কখনও কল্পনাও করতে পারেনি। কিন্তু ইতিমধ্যে নিবে গিয়েছে অধিকাংশ নক্ষত্র, সন্ধানী যন্ত্রদের কাজের জন্যেও তো শক্তি চাই!
নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন বুঝে সন্ধানীরা সন্ধান করল দূরের ঝাপসা ধোঁয়াটে যত আলোর উৎসের। আছে—প্রচুর নক্ষত্র, আলো, শক্তি—সব আছে। কিন্তু ছায়াপথ গ্যালাক্সীতে নয়, আরও দূরের বিভিন্ন গ্যালাক্সীতে। কয়েক আলোকবর্ষ নয়, লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে দূরে এক-একটি গ্যালাক্সী। ওরা জানত অন্য গ্যালাক্সীদের কথা, কিন্তু এখন ওরা স্থির করল যে অন্য কোনও গ্যালাক্সীতে না গেলে ওদের অস্তিত্ব লোপ পাবে হিমশীতল অন্ধকারের গহ্বরে।
ওরা নিজেদের পর্যবেক্ষণ থেকে বেছে নিল অপেক্ষাকৃত কাছের একটি গ্যালাক্সী যেখানে বেশি সংখ্যায় নবীন নক্ষত্র রয়েছে। ওরা সকলে কালো শীতল নেবুলা থেকেই সংগ্রহ করল প্রচুর পরিমাণে জ্বালানী হাইড্রোজেন।
তারপর মৃতপ্রায় গ্যালাক্সীর কেন্দ্র থেকে যন্ত্রের দল পাড়ি দিল এক অভূতপূর্ব মহাকাশযাত্রায়। ছায়াপথ গ্যালাক্সীর জীবনের শেষ অধ্যায়ে ওরা রওনা দিল সুদূর দুর্গম পথে, সঙ্গে ওদের সম্পদ—এই গ্যালাক্সীর বহু বুদ্ধিমান প্রাণীদের সভ্যতার ইতিহাস ও জ্ঞানের ভাণ্ডারের সমষ্টি।
দুই গ্যালাক্সীর মাঝখানে সুদীর্ঘ যাত্রাপথে বহু হাজার লক্ষ বছর ওরা ঘুমিয়ে থাকবে, যতক্ষণ না অন্য গ্যালাক্সীর নক্ষত্রের আলো ও শক্তি অনুভব করে আবার ওরা জেগে উঠতে পারে। তখন আবার সেই গ্যালাক্সীতে অনুসন্ধান শুরু করবে ওরা। ওরা সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছে অমূল্য সম্পদ—এক অভূতপূর্ব জ্ঞানের ভাণ্ডার।
মূল গল্প – জেমস ইঙ্গলেশ এর লেখা নাইট ওয়াচ
প্রথম প্রকাশ – ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত জন ক্যাম্পবেল সম্পাদিত ‘নিউ রাইটিং ইন এসএফ – ৩’ বইতে গল্পটি প্রথম সংকলিত হয়েছে।
Tags: অনুবাদ গল্প, অমিতানন্দ দাশ, পঞ্চম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সুমন দাস
কি অসাধারণ গল্প!
খুবই চমৎকার ঝরঝরে অনুবাদ হয়েছে। শুভকামনা রইল।
অনুবাদের মান খুবই দারুণ৷ আমি আগে কখনো এই সাই ফাইটি পড়িনি৷ কাহিনীর নতুনত্বে অভিভূত আর গতিশীলতায় স্থির হয়ে ছিলাম৷ অনুবাদে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলার মুনশিয়ানা অনুবাদকের৷