লাল শৈবাল
লেখক: তানহা তারান্নুম ঈমিতা
শিল্পী: চিত্রা মিত্র
মঙ্গল গ্রহ: সন ২১১৮
চারপাশে সুনসান নিরবতা মাঝেমাঝে ভেঙে দিয়ে যাচ্ছে যানবাহনের মৃদু বা তীব্র গুঞ্জন। আজকাল সবাই যান্ত্রিক কোলাহল শুনেই অভ্যস্ত। স্টেডিয়ামের ওপাশটায় বিদঘুটে সব মিউজিক বাজানোর জিনিসপত্র এনে জড়ো করা হচ্ছে, কীসের নাকি কনসার্ট হবে। গতানুগতিক ঝক্কি ঝামেলা, ইলেকট্রিক তারের সুরবেদনা আর খানিক লম্ফঝম্প। বাঙালি পাড়ার মাঝ বরাবর দিয়ে টানা হয়েছে বিশাল এক পানির টানেল। ঠিক যখন থেকে স্বগোত্রীয়রা ক্ষমতায় এল, উন্নয়নের নামে এই পাড়াটার হযবরল অবস্থা করে দিয়েছে। টানেলের পাশেই স্থানীয় ছোট ছোট ছেলেমেয়ের দল খেলা করে। ওখানে কোন পার্ক বা খেলার মাঠ না থাকলেও আছে নানান রকম রং বেরঙের জিনিস। লাল শৈবাল এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। টানেলের প্রায় গা ঘেঁষেই বয়ে গেছে ছোট্ট একটি ঝর্ণার মতো স্রোতধারা। ওর পাশেই থরে থরে লাল শৈবাল, প্রকৃতি যেন সাজিয়ে রেখেছে। এই শৈবালগুলোর বিশেষত্ব হচ্ছে দুধের ছানার মতো মুখে দিলেই গলে যায়। খুব যে সুস্বাদু জিনিস তা নয়, তবু ছেলেপুলেরা এখানে এই শৈবাল মুখে পুরে মিষ্টি মিঠাই এর স্বাদ নিতে চায়। কিন্তু মঙ্গলের আবহাওয়া বিপদজনক। এই বিনে পয়সার মিঠাই যে কয়দিন পর কোন কারণে বিষাক্ত হয়ে উঠবে না তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
হ্যাঁ, কথা হচ্ছে পৃথিবী ছাড়িয়ে বহুদূর সৌরজগতের চতুর্থ গ্রহ মঙ্গলে অবস্থিত বাঙালি জনবসতির। একুশ শতকের শেষভাগে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ভিন্ন ভিন্ন প্রায় দুশো জাতির মানুষ বাছাই করে মঙ্গলে পাঠানো হয় বসতি স্থাপনের জন্য। বিজ্ঞানীরা মঙ্গলের আর্গাইর বেসিনে প্রাণের সন্ধান লাভের পর ২০৪১ সনে প্রথম কয়েক জোড়া বাছা বাছা মানুষকে পরীক্ষামূলকভাবে মঙ্গলে পাঠান। কপালক্রমে তারা সেখানে ভালোই সারভাইভ করে যায়। তারপর আর কী, মানবজাতিকে ধ্বংসের মুখ থেকে বাঁচানোর জন্য মঙ্গলে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন একটি মানব কলোনি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কীসের ধ্বংস? মানুষে মানুষে হানাহানি, যুদ্ধ বিগ্রহ, বাক বিবাদ এত বেড়ে গিয়েছিল যে সাধারণ মানুষ যারা এসব এড়িয়ে চলত, তাদের টিকে থাকাই মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ঝামেলাহীন রকমের মানুষের সংখ্যা যদিও খুব বেশি বাকি ছিল না, তাই তাদের মধ্য থেকে বাছাই করেই সুন্দর একটি সমাজ গঠনের জন্য পৃথিবীবাসী কিছু লোককে মঙ্গলে পাঠানো হয়। সমস্যাটা হচ্ছে মানুষের আদি অভ্যাস। কথায় আছে, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে। অর্থাৎ যার যেটি কাজ বা যে রকম অভ্যাস, সব জায়গাতেই তা প্রকাশ পায়। মানুষও এই নতুন গ্রহটিতে এসে, এখানকার বিস্তৃত প্রাকৃতিক সম্পদ দেখে দখলের লোভে দিশেহারা হয়ে পড়ে। গুটিকয়েক স্বার্থপর লোক তখন পৃথিবীচ্যুত পুরো দলটিকে জিম্মি করে ফেলে। তবে পৃথিবীতে যেমন একটি দেশ খুব গরীব, একটি দেশ ধনী, এখানে তেমনটা নয়। এখানে একটি দল ধনী, একটি দল গরীব। ধনী, গরীব উভয় দলেই নানা দেশের মানুষ আছে। যারা লোভী ও মানুষকে ঠকাতে ভালোবাসে, তারা ধনী হয়েছে। যারা শান্তিপ্রিয়, ঝুট ঝামেলায় যেতে চায় না, তারা খেয়ে পরেই খুশি। এই শান্তিপ্রিয় মানুষরা পরস্পর নিজেদের লোকালয়ে বাস করে, পাশাপাশি অনেকগুলো বসতি যেগুলো আদি পাড়া নামে পরিচিত। এই আদি পাড়ার মধ্যেই আছে বাঙালি পাড়া, ইংলিশ পাড়া, রুশ পাড়া ইত্যাদি। ধনী লোকগুলো থাকে গ্রহটির আরেক প্রান্তে, নয়াপাড়া নামে পরিচিত যে জায়গাটা, ওখানে।
তবে শান্তি সৌহার্দ্য বিরাজমান থাকলেও একটি জায়গায় নয়া পাড়া বা আদি পাড়ার কোন মানুষই সহমতে আসতে পারেনি। সেটি হচ্ছে, ভাষা। ইংরেজি সারা বিশ্বের ভাষা হলেও সকল দেশের মানুষ এখানে একই অনুপাতে পাঠানো হয়েছে। তাই ইংরেজি ভাষায় কথা বলা নিয়ে সকলেই ঘোর আপত্তি তোলে। বিশেষ করে রুশরা ও ফরাসীরা। তাদের জাতীয়তাবোধ প্রবল, নিজেদের ভাষা ছেড়ে অন্য ভাষাকে মেনে নিতে তারা রাজি হল না। এদিকে বিশ্বে যত দেশ আছে তাদের মধ্যে একমাত্র বাঙালিরাই নিজেদের ভাষাকে রক্ষা করার জন্য প্রাণ দিয়েছে, সেই ১৯৫২ সালে। ইউনেস্কো বাংলাকে তাই মর্যাদা দিয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে, বাঙালিরাও তাই নিজেদের ভাষার পক্ষে আওয়াজ তোলে। কোন ফলাফলে না আসতে পেরে তখন মঙ্গল থেকে সমস্ত ভাষাই নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। মানুষ কথা বলবে ইশারায়। হাতের বিভিন্ন অঙ্গ ভঙ্গীর মাধ্যমে। মুখে মুখে শব্দ করে কেউ কারো সঙ্গে কথা বললে সেটা হতে পারে দণ্ডনীয় অপরাধ। ইশারার ভাষা শিখে নেওয়াতে ভাষাগত জটিলতা যদিও রইল না, তবে মানুষ একটা সময় কথা বলতেই ভুলে গেল। সবাই, কেবল একজন ছাড়া। তিনি তোতনের দাদু, জীয়ন বুড়ো।
জীয়ন বুড়ো এককালে পেশাদার লেখক ছিলেন। বাংলায় ছোটদের জন্য অনেক অনেক সাহিত্য রচনা করেছিলেন তিনি। তবে পৃথিবীর মানুষ তখন বই পড়া থেকে এতটাই বিমুখ হয়েছিল, যে তখনকার পিতামাতারা ছোট ছেলেমেয়েদের পড়ার বই এর বাইরে অন্য বই পড়তেই দিত না। জীয়ন বুড়ো খুব দুঃখ পেয়ে নিজের ছেলেমেয়েকে নিয়ে পৃথিবী ছেড়েই চলে আসেন। যখন তোতনের জন্ম হল, ততদিনে মঙ্গলে সবাই কথা বলা প্রায় ভুলে গিয়েছিল। জীয়ন বুড়ো তাই তোতনকে কথা বলতে শেখালেন, বই পড়তে শেখালেন, বাংলা অক্ষরগুলো চিনতে শেখালেন। তোতন মনোযোগ দিয়ে সব শিখে নিল। তবে দাদু ওকে আগেই সতর্ক করে দিয়েছিলেন, বাসার বাইরে যাতে কেউ ওর মুখের কথা শুনতে না পায়। তোতন তাই করল, নিজের বন্ধুদের সামনেও তোতন কথা বলত না, ইশারায় মনের ভাব প্রকাশ করত।
আজ একদল ছেলেমেয়ে যখন পানির টানেল এর পাশে লাল শৈবাল নিয়ে খেলা করতে এল, তোতনও সেই দলটির সঙ্গেই ছিল। তোতনের খুব ভালো বন্ধু হচ্ছে সাদা চুলের ভোঁতা নাকওয়ালা বুঁচি। বুঁচি জাতিগত ভাবে নেপালি। মেয়েটার বুদ্ধি খুবই তীক্ষ্ণ। সেই তুলনায় তোতন যেন একটু বোকাসোকাই, কিন্তু ওর সাহস অনেক। আজকে ঝর্ণার পাড়ে শৈবাল খুঁজতে গিয়ে ওরা দেখল কারা যেন শৈবালগুলো আগেই তুলে নিয়ে জায়গাটা পুরো সাফ করে দিয়েছে। গোড়াগুলো ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। সকলে মিলে অস্থির হয়ে হাত পা ছোঁড়া শুরু করল, একি কাণ্ড! নিশ্চই কোন দুষ্টু ছেলেমেয়ে আগেভাগে এসে একা একাই সব তুলে নিয়েছে। ঝর্ণার পাশের সেই জায়গাটাই আর্গাইর বেসিন যেখানে প্রাণের সন্ধান পেয়েছিল বিজ্ঞানীরা। প্রাণ বলতে গাছপালা, কিছু কিছু মাইক্রো-ব্যাকটেরিয়া এইসব। সকলে ভেবেছিল গাছপালা থাকলে হয়তো প্রাণীও থাকবে, যদিও এত বছরে তেমন কিছুই চোখে পড়েনি। তোতন কিন্তু বেশ চঞ্চল, ও ভাবল দেখি তো আরেকটু ভেতরে যেয়ে, টানেলের গা ঘেঁষে কিছু থাকতে পারে হয়তো। ও এক পা, দু পা করে হেঁটে হেঁটে টানেলের পাশে চলে এল। বুঁচি দূর থেকে তাকিয়ে ওকে লক্ষ করছিল, চেঁচিয়ে ডেকে সাবধান করবে সে সুযোগ তো নেই। দেখতে দেখতেই হঠাৎ পা ফসকে একটি গর্তে পড়ে গেল তোতন। বুঁচি সেটা লক্ষ্য করেই দৌড়ে বন্ধুদের কাছে গেল, উত্তেজিত হয়ে ইশারায় বুঝিয়ে দিল দুর্ঘটনা ঘটেছে। সবাই মিলে তড়িঘড়ি তখন টানেলের পাশে চলে এল, যেখানটায় পড়ে গিয়েছিল তোতন। একটা বিশাল গর্তের মুখ হাঁ করে আছে, কিন্তু ভেতরে প্রচুর অন্ধকার। দলের মধ্যে ইটালিয়ান বন্ধু ডেভিড তখন ছুটে গেল তোতনের বাসায় খবরটি দ্রুত জানানোর জন্য।
এদিকে বাকিরা যখন গর্তের মুখে দাঁড়িয়ে আছে, তোতন তখন গর্তের মধ্যেই চুপ করে বসে আছে। ও জানে, একটু পরেই সাহায্য আসবে, তাই ও ভয় পেল না। চারপাশ দেখে বোঝার চেষ্টা করল কোথায় আছে। মনে হল গর্তের মেঝে আসলে পাকা, গড়িয়ে নিচে পড়ার সময় হাঁটুতে আর কনুইয়ে খুব ব্যথা পেয়েছে তোতন, ব্যাথার জায়গায় হাত দিয়ে ডলতে ডলতে একটু উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। ওর জন্য গর্তটা খুব ছোট নয়, তাই সহজেই একটু পর গর্তের ভেতর ও হেটে বেড়াতে লাগল। আসলে গর্তটা ছিল একটি পুরনো গবেষণাগারের রুম, ছাদের কিছুটা অংশ ক্ষয়ে গিয়ে তাতে মাটি পড়ে এমন গর্ত হয়েছে। মানুষ যখন প্রথম এ গ্রহে আসে তখন আর্গাইর বেসিনে গবেষণাগার স্থাপন করা হয়, যা পরবর্তীতে নয়াপাড়ার লোকেরা বন্ধ করে দেয়। হাঁটতে হাঁটতে তোতন তখন গবেষণাগারের অনেক ভিতরে চলে এল। একটি গোলমতো ঘরে এসে তোতন দেখল এখানে সেখানে অনেক যন্ত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অনেকটা সিংহের মাথার আকৃতির ছোটখাটো দু চারটে পাথর। এগুলো প্রথমদিকে ছিল খুব আগ্রহ জাগানিয়া কেননা পাথর কুঁদে এত সুন্দর প্রাণীর আকৃতি দেয়া তো কোন বুদ্ধিমান প্রাণীর দ্বারাই সম্ভব। যদিও আকৃতিগুলো সম্পূর্ণ ছিল না তাও বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চরিত্র কম করেননি এগুলো নিয়ে। পরবর্তীতে অবশ্য প্রকৃতির অদ্ভুত খেয়াল ভেবে এগুলো গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। অধিকতর ভালগুলো জাদুঘরে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়, যেগুলো অবহেলা করে ফেলে রাখা হয়, সেগুলো হারিয়ে যায়। একটা পাথর তুলে নিল তোতন। ওর এক হাতে কিছুটা লাল শৈবাল ধরা ছিল। আসলেই টানেলের পাশে গুটিকয়েক শৈবাল খুঁজে পেয়েছিল ও। পাথর টা তুলে নিয়ে ভালো করে দেখবার জন্য দুহাত দিয়ে ধরে মুখের সামনে নিয়ে এল। গর্তের বাইরে থেকে খুব অন্ধকার মনে হলেও ভিতরে আবছা একটু আলো ছিল। তোতন দুহাতে পাথরটা ধরবার সঙ্গে সঙ্গেই কি জানি হল, মাথা ঘুরে পিছন দিকে পড়ে গেল ও। চোখের সামনে টেলিভিশনের পর্দার মত একটি ছবি ভেসে উঠল। মাথার ভিতর ঝিমঝিম করে উঠলে এই প্রথমবারের মতো তোতন ভয় পেল। সামনের পর্দায় দেখতে পেল প্রায় মানুষ আকৃতির দুজন প্রাণী। মধ্যবয়স্ক একজন লোক ও একটি তরুণী। মানুষের সঙ্গে খুব বেশি অমিল নেই, কেবল তাদের গায়ের রঙ গাঢ় ধূসর বর্ণের। কথা বলতে শুরু করল দুজনে। তখনই প্রচণ্ড ভয়ে দাঁতকপাটি লেগে গেল তোতনের।
এদিকে তোতনের বাবা ততক্ষণে স্থানীয় দমকলকর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। ঘটনার জায়গায় এসে জড়ো হয়েছে সবাই। বাঙালিদের মধ্যে একজন নয়াপাড়ার আবাসান প্রকল্পের প্রধান। তিনি এসেই হম্বিতম্বি শুরু করে দিলেন, যদি ঠিকঠাকমত আদিপাড়ার বাসস্থান প্রকল্প করা হত, তাহলে অপ্রয়োজনীয় ঝুট ঝামেলা সরিয়ে ফেলা যেত। খামোখা এই ঝর্ণা টর্ণার কি দরকার! এমনিতেই আদি পাড়ায় কোন উদ্দীপক ঘটনা ঘটে না, তোতনের টানেলের গর্তে পড়ে যাওয়া তাই স্থানীয়দের মধ্যে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে। বেশ কয়েকজন সংবাদকর্মী ছুটে এসেছে নয়াপাড়া থেকে। এসেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু লোক। দমকলের লোকেরা কিছুক্ষণের চেষ্টায় গর্তের মুখ বড় করে ফেলল। তোতনকে বের করে নিয়ে আসা হল ভিতর থেকে একদম অটোমেটিক শক্তিশালী হাতওয়ালা ড্রোন এর সাহায্যে। অজ্ঞানপ্রায় ছোট্ট মেয়েটির হাতে তখনও খুব শক্ত করে ধরা ছিল প্রাচীন পাথরের টুকরো।
গত ক’দিন যাবত স্যাটেলাইটে কেবল উদ্বেগ জনক ছবি ভেসে উঠছে। পৃথিবী তার অন্তিম মূহুর্তে উপনীত হয়েছে। একদা টেলিস্কোপে দেখতে পাওয়া গাঢ় নীল বর্ণের পৃথিবী পাউরুটির উপরিপৃষ্ঠে জন্মানো ছত্রাকের ন্যায় বর্ণ ধারণ করেছে। থার্মোডায়নামিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে পৃথিবী তার বায়ুমণ্ডলীয় তাপীয় মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জন্মের শুরুর দিকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ছিল স্বচ্ছ, শুদ্ধ। পৃথিবীর প্রকৃতিগত সমস্ত প্রক্রিয়া একটি আরেকটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে তাপীয় ভারসাম্য বজায় ছিল স্বাভাবিক নিয়মে। তবে পরিবেশ বিপর্যয়ের গোড়ার দিকে আপাত দৃষ্টিতে চোখে না পড়লেও কয়েক দশক এর মধ্যে ভয়াবহ কিছু পরিসংখ্যান দেখা দিতে শুরু করে। পৃথিবী যে পরিমাণে সোলার রেডিয়েশন শোষণ করে এবং পরবর্তী কালে নির্গমন করে, এর পরিমাণগত ভারসাম্য থার্মোডায়নামিক সামঞ্জস্যতা রক্ষা করে। নতুন তথ্যাদি অনুসন্ধান করে দেখা গেল, যে পরিমাণ সৌরশক্তি পৃথিবী শোষণ করছে সে তুলনায় বিকিরণের মাত্রা কমেছে আশংকাজনক হারে। যদিও তাপীয় মৃত্যু টার্মটি কেবল মহাজাগতিক তাপীয় সাম্যাবস্থা বুঝাতেই ব্যাবহার করা হত, তবে পৃথিবীর ক্ষেত্রে এই নামকরণ নতুন মাত্রা লাভ করল। পৃথিবীর ম্যগনেটিক ফিল্ড হয়ে উঠেছে অস্থিতিশীল যা সৌরঝড়ের কাছে বায়ুমন্ডলকে করেছে উনন্মুক্ত। হাহাকার ভরা হৃদয়ে একদা সুজলা সুফলা বাসস্থান এর জন্য আফসোস করার ছাড়া আর কিছুই বাকি নেই।
পৃথিবীর কিছু টিভি চ্যানেল সরাসরি সম্প্রচার এর মাধ্যমে দেখাচ্ছে, অবস্থাপন্ন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ইতিমধ্যেই সেকেন্ড হোম এর আশায় মঙ্গলে রওনা দিয়েছে। কয়েক যুগের পট পরিবর্তনে পৃথিবী ও মঙ্গলের সামাজিক ব্যবস্থা একটি আরেকটি থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র উপায়ে গড়ে উঠেছে। এখনো সঠিক বলা যাচ্ছে না নতুন আগত অতিথিদের সঙ্গে কেমন আচরণ করা হবে। মঙ্গলের এখনো নিজস্ব কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। সবচাইতে কঠিন সমস্যা হচ্ছে ভাষাগত জটিলতার সমাধান করা। সর্বোপরি রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা যে চরম ভাবে অশান্ত হয়ে উঠতে যাচ্ছে তা প্রায় সকলেই উপলব্ধি করতে পারছে।
জীয়ন বুড়ো নিঃশব্দে হসপিটাল বেডের কাছে ছেড়ে রাখা টেলিভিশন সেটে সংবাদ দেখছেন। একটু পর পর ঘুমন্ত তোতনের দিকে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছেন। আরেকবার দৃষ্টি ফেরাতেই তার চোখ তোতনের হাতের দিকে আঁটকে গেল। বাচ্চা মেয়েটার হাত থেকে পাথরটি ছাড়িয়ে নিলেন তিনি। বেশ কিছুক্ষণ যাবত এর আকৃতি ঠাহর করার চেষ্টা করলেন, ইদানীং চোখে ভাল দেখতে পাচ্ছেন না বোধহয়।
– ‘দাদু,’ তোতন জেগে উঠেই কথা বলা শুরু করল।
– ‘এই পাথর দিয়ে ছবি দেখা যায়। তারা কথাও বলে।’
ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে শসসস… করে উঠলেন জীয়ন বুড়ো। ‘ধীরে’, তিনি তোতনকে বোঝালেন।
মিনিট দশেক পর তোতনের মা কে হাসপাতালে রেখে বাসার দিকে রওনা দিলেন জীয়ন বুড়ো। পকেটে করে পাথরটি নিয়ে লাইব্রেরী ঘরে চলে এলেন। কি আশ্চর্য ক্ষমতা বলে মঙ্গলে জন্মানো লতা পাতার সংস্পর্শে অদ্ভুত যন্ত্রটি কার্যক্ষম হয়ে উঠেছে। তবে ক্ষমতাধরেরা এর সন্ধান পেলে আসল তথ্য সবাইকে অবহিত না ও করতে পারে। হতে পারে নিজেদের জন্য লাভজনক, এমন ভাবেই ব্যবহার করবে তারা। তাই জীয়ন বুড়ো ঠিক করল, নিজেই আগে শুনে ও বুঝে দেখবে আসল ব্যাপারখানা কি। বাসায় ঢুকবার আগে দোড়গোড়ায় জন্মানো একটু ফার্ন পাতা কুড়িয়ে এনেছে সে। সেটিই আলতো করে ছুঁয়ে দিল পাথররূপী যন্ত্রটার গায়ে। দৃশ্যমান হয়ে উঠল হলোগ্রাম চিত্র।
‘বেশি সময় নেই ইলোরা। মধ্যবয়স্ক লোকটি ভুরু কুঁচকে বলল। তার সামনে বসে বিশ বাইশ বছরের তরুণীটি দ্বিধাগ্রস্ত ভাবে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। লোকটি আবার মেয়েটিকে উদ্দেশ্য করে বলল, যা সিদ্ধান্ত নেয়ার এখনই নিতে হবে, নিজেকে রূপান্তরিত করতে চাও কি চাও না?’
স্তম্ভিত হয়ে জীয়ন বুড়ো লক্ষ্য করল তারা পরিষ্কার বাংলায় কথা বলছে।
ঢোক গিলল ইলোরা। ‘আরেকবার পুরো প্রক্রিয়াটি একবার বলুন প্রফেসর’, অনুনয় করল সে।
হাঁপ ছেড়ে বলা শুরু করলেন প্রফেসর।
-‘বিশ্বজগতের সকল প্রাণীর বেঁচে থাকাটা আসলে তথ্য ও আবেগ হস্তান্তরের একটি নিয়ম ইলোরা, তা জান তুমি। এগুলোকে সংরক্ষণ করার জন্য যা যা করা প্রয়োজন তার সবটাই আমাদের করতে হবে। সভ্যতার একটি দুঃখজনক নিয়তি হচ্ছে এরা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনে। আমাদের গ্রহে আর কোন গাছপালা বেঁচে নেই। সমস্ত গ্রহ মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে। নিজেদের তথ্য গুলোকে টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের এটা করতেই হবে।’
-‘কিন্তু তাহলে তো আমরা মারা যাবো!’
-‘না, আমরা মারা যাবো না। অনেকটা ঘুমন্ত অবস্থায় থাকবো। পৃথিবীতে প্রাণের উদ্ভব হচ্ছে। প্রাণের মূল হচ্ছে ডিএনএ, যাতে সব তথ্য সংরক্ষিত থাকে। আমরা কেবল নিজেদেরকে সে সকল তথ্যে পরিণত করে পৃথিবীর প্রাণীদের ডিএনএ তে ছড়িয়ে দিব। আমরা তখন তাদের শরীরে বেঁচে থাকবো, ওদের অবচেতনে লালিতপালিত হতে থাকবো। একটা সময় আমাদের ডিএনএ-ই হবে প্রতিনিধিত্বশীল। আপাত দৃষ্টিতে পৃথিবীবাসী হলেও তারা আসলে হবে মঙ্গলবাসীদের সুগঠিত উত্তরসূরী। হ্যাঁ, এটা তারা উপলব্ধি করতে পারবে না। আমাদের ও নিশ্চিত হবার সুযোগ নেই যে এ প্রক্রিয়া কতটা স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারবে, তবে প্রাণের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এর চাইতে ভাল কোন উপায় আপাতত নেই। ওরা যত উন্নত হবে ওদের পরবর্তী প্রজন্মের ডিএনএ তে তত সুন্দর ভাবে তথ্য সংরক্ষিত হবে। আমরাও ওদের সঙ্গেই বংশবিস্তার করতে থাকবো। একদিন হয়তো তারা উন্নতির শিখরে উপনীত হবে, এবং আদি আবাসস্থল মঙ্গলে ফিরে আসবে।’
-‘আমার মেনে নিতে দারুণ কষ্ট হচ্ছে, তারা আমাদের ব্যাপারে কখনোই জানবে না।’ একগুঁয়ে ভাবে বলল ইলোরা।
-‘জানবে, মঙ্গল পুনরায় জীবন ধারণের উপযোগী হলে তারা অবশ্যই এখানে আসবে। যেহেতু সকল সভ্যতাই নিজের ধ্বংস ডেকে আনে, তাই এমন একটি সময় ও আসবে যখন পৃথিবী জীবন ধারণের অনুপযোগী হয়ে উঠবে,’ প্রফেসর নিজের পকেট থেকে একটি পক্ষী আকৃতির পাথর বের করলেন। ‘কালেকশন ডিজাইন দ্বারা তুমি নিজের স্মৃতি সংরক্ষণ করতে পার জান তো?’ মাথা ঝাঁকাল ইলোরা। ‘নতুন একটি প্রযুক্তি এতে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। মঙ্গলে জন্মানো বৃক্ষ, লতাপাতার সংস্পর্শে এর ডাটাবেস একটিভ হয়ে উঠবে। সহজেই তখন আমাদের সংরক্ষিত স্মৃতিগুলো কেউ দেখতে পাবে। ভবিষ্যৎ কালের কথা চিন্তা করেই এটি নকশা করা হয়েছে। যাতে পৃথিবীবাসী নিজেদের আদি পরিচয় এর ধারণা পায়।’
কিছুক্ষণ চুপ থেকে পুনরায় বললেন প্রফেসর, ‘তুমি আমার প্রিয় ছাত্রী ইলোরা। ক্লাসের সবচেয়ে চালাক চতুর মেয়েটি নও, তারপরও আমি তোমাকে পছন্দ করি। এও জানি অনেকেই কানাঘুষা করে ব্যাপারটি নিয়ে।’
ধৈর্য ধরে বাকিটা শোনার অপেক্ষা করল ইলোরা।
‘এর পেছনে খুবই তুচ্ছ একটা কারণ আছে বলতে পার। প্রথম জীবনে আমি এক সন্তানের পিতা হবার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম। মাত্র দু’বছর বয়সে আমার মেয়েটি মারা যায়। ওর নাম ছিল ইলোরা।’
চোখ বড় বড় করে চাইল ইলোরা প্রফেসরের দিকে। কী বলবে বুঝতে পারছে না।
‘আমি তোমাকে তাই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সম্পর্কে যথাযথ অবহিত করতে চাইছি। ভেবে দেখ, প্রত্যেক প্রাণীর মৃত্যু অবধারিত। মঙ্গলের বিষাক্ত এই আবহাওয়ায় ধুঁকে ধুঁকে মরার চাইতে বিবর্তনের নতুন চেহারায় নিজেকে শামিল করাই কি বেশি যুক্তিযুক্ত নয়? বাকিটা তোমার সিদ্ধান্ত, তোমার উপর ছেড়ে দিলাম আমি’ প্রফেসর নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। হলোগ্রাম বন্ধ হয়ে গেল। জীয়ন বুড়ো চেয়ারে ঠেস মেরে বসে রইলেন।
পুরো বিষয়টা তিনি হস্তগত করার চেষ্টা করছেন। ঢোক গিলে ভাবলেন তিনি, ‘সর্বনাশ!’ নিজেকে এখন কি বলে পরিচয় দিবেন! মানুষ এতকাল মহাজাগতিক প্রাণের সন্ধান করে এসেছে। মঙ্গলে প্রাণের সন্ধান করে এসেছে। মানুষ কি এখন নিজেকেই এলিয়েন বলে পরিচয় দিবে! জীয়ন বুড়ো নিজেকে প্রশ্ন করলেন, তুমি কে? পুরোটাই মঙ্গলবাসী নাকি পৃথিবীবাসী?
ছ’মাস ব্যাপী দীর্ঘ শুনানি শেষে জীয়ন বুড়োকে শেষ পর্যন্ত হাইকোর্ট দোষী সাব্যস্ত করে রায় দিল। অপরাধ, আইন বহির্ভূতভাবে অনমনীয় নির্দেশ লঙ্ঘন করে পৃথিবীতে কথনীয় ভাষা চর্চা করা ও মঙ্গলে জন্মগ্রহণকারী শিশু সন্তানকে নির্দিষ্ট একটি ভাষা শিক্ষায় শিক্ষিত করা। যদিও জীয়ন বুড়ো মনুষ্যগোষ্ঠীর জাতিসত্তার প্রকৃত পরিচয় সকলের কাছে উন্মোচনে সাহায্য করেছেন, এবং এ নিয়ে তর্ক বিতর্ক ও চলেছে সীমাহীন। প্রসিকিউশন ল’য়ার এর মতে উক্ত হলোগ্রামটি বানোয়াট ও মিথ্যা, যা জীয়ন বুড়োর নিজের দ্বারাই তৈরি, হয়তো কর্তৃপক্ষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টায় এরূপ ফন্দি আঁটা হয়েছে। আদালতের আদেশে আর্গাইর বেসিনের সেই গুহার মুখ বড় করা হয় ও গবেষণাগারের মেঝে থেকে অবশিষ্ট পাথরের টুকরো বাজেয়াপ্ত করা হয়, যা পরবর্তীতে এ বিষয়ে জীয়ন বুড়োর নিরপেক্ষতা প্রমাণ করে। তারপরও প্রশ্ন থেকে যায়, সব ছেড়ে মঙ্গলের আদি অধিবাসীরা বাংলায় কেন কথা বলত? এমনকি এমন একটি হলোগ্রাম ও পাওয়া যায়নি যা অন্য কোন ভাষার ব্যবহার প্রদর্শন করে। কর্তৃত্বপূর্ণ ব্যক্তিগণ হলোগ্রাম এর বিষয়সমূহ দ্বারা খুব একটা সন্তুষ্ট হয়েছেন বলা যায় না। তারই প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় পৃথিবী থেকে কোন স্পেসশীপ আগমনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ ও আজকের এই রায়ের মাধ্যমে। মঙ্গল ও পৃথিবীর সকলে হতবাক হয়ে দেখল জীয়ন বুড়োর রায়ের বাস্তবায়ন। ভাষার জন্য আরেকবার প্রাণ দিতে হল একজন বীর বাঙালিকে।
Tags: কঙ্কাবতী কল্পবিজ্ঞান লেখেনি, কল্পবিজ্ঞান গল্প, গল্প, চতুর্থ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, চিত্রা মিত্র, তানহা তারান্নুম ঈমিতা
খুবই সুন্দর লাগল গল্পের প্লটটি। আপনার আরো লেখা পড়ার আশায় থাকলাম।
অসাধারণ,,🇧🇩🇧🇩