শতাব্দীর সেরা সাক্ষাৎকার
লেখক: দীপ ঘোষ
শিল্পী: দীপ ঘোষ
শতবর্ষ সংখ্যা, ১৬ই মাঘ, ১৫২২ বঙ্গাব্দ
কল্পবিশ্বের এই শতবর্ষ সংখ্যার সাক্ষাৎকারে আমরা নিয়ে এসেছি একজন নয়, তিনজন জাঁদরেল সম্পাদককে। আজকের সাক্ষাৎকারটা চলবে কিছুটা আড্ডার ছলেই—হলোডেকে এই মুহূর্তে কল্পবিশ্বের সম্পাদকের সামনে হাজির হয়েছেন—সায়েন্স ফিকশনের পিতা হুগো গার্নসব্যাক, আধুনিক সায়েন্স ফিকশনের নির্মাতা জন ক্যাম্পবেল, বাংলা কল্পবিজ্ঞানের জনক অদ্রীশ বর্ধন এবং কল্পবিশ্বের সম্পাদক। তবে বন্ধুগণ মনে রাখবেন, প্রায় দেড়শো বছর আগের তিনজন সম্পাদকের হলোগ্রাম নিউরাল ল্যাটিশে স্থায়ী রাখতে প্রচুর শক্তির প্রয়োজন, তাই আমাদের এই পর্বের অনুষ্ঠানে আমরা কোনও প্রশ্ন-উত্তর পর্ব রাখছি না।
কল্পবিশ্ব: আমাদের প্রিয় বন্ধু ও সম্পাদকরা, একুশ শতকের শেষভাগে এসে সায়েন্স ফিকশন বা কল্পবিজ্ঞান সারা পৃথিবীর চালিকা শক্তির জায়গা নিয়েছে। মানব সমাজের বিবর্তন ও প্রযুক্তিবিদ্যার নিহিত শক্তির অন্বেষণে কল্পবিজ্ঞানের ভূমিকা অনস্বীকার্য আজ। পৃথিবীর সব দেশের সরকারি কমিটির মধ্যে কল্পবিজ্ঞানের লেখক ও সম্পাদকদের রাখা বাধ্যতামূলক। কিন্তু, অনেক পাঠকই আপনাদের অবদানের কথা ভুলতে বসেছে, তাই আমরা শুরুতে আপনাদের অনুরোধ করব, নিজেদের সম্পর্কে সামান্য্ কিছু জানাতে। প্রথমেই আমরা যাব গার্নসব্যাক সাহেবের কাছে। আপনার হাত ধরেই তো কল্পবিজ্ঞান বা সায়েন্স ফিকশনের জয়যাত্রা। তা আপনার মাথায় এসব নিয়ে কাজের কথা এলো কি করে?
গার্নসব্যাক: আমি প্রথমে কিছু বলতে চাই! এই যে এত বছর পরে আমি আবার আপনাদের মাঝে ফিরে এসেছি আর বিজ্ঞানের অপরিসীম উন্নতির ফলে আপনাদের অন্য ভাষার কথাও বুঝতে পারছি, এসব দেখে আমি শিহরিত। যখন আমি সায়েন্টি-ফিকশন আর অ্যামেজিং স্টোরিস ম্যাগাজিন শুরু করি কখনও ভাবিওনি ব্যাপারটা এতদূর যাবে! আমি সত্যি অভিভূত দেখে যে এখনও আমার নামে কল্পবিজ্ঞানের পুরস্কার দেওয়া হয় দেখে।
কল্পবিশ্ব: হ্যাঁ, কয়েক দশক আগে পর্যন্ত ওটিই কল্পবিজ্ঞানের সবসেরা অনুষ্ঠান ছিল। তবে এখন বাংলা আর চিনা কল্পবিজ্ঞানই পৃথিবীতে সর্বাধিক জনপ্রিয়। প্রাচ্য এখন বিজ্ঞান ও সমাজদর্শনে প্রভূত উন্নতি করে পাশ্চাত্যকে ছাড়িয়ে গেছে বহুদিন। বিশেষ করে চাঁদ ও মঙ্গলের ভূমিপরিবর্তন ও বসতি স্থাপনের পরে সারা পৃথিবী মেনে নিয়েছে এই সত্য।
অদ্রীশ: উফ, আমার সব স্বপ্ন আজ সত্যি হয়েছে। শুধু যদি দেখে যেতে পারতাম নিজের চোখে!
কল্পবিশ্ব: কেন, এই তো দেখতে পারছেন। আপনার ডিএনএ থেকে স্মৃতি সঞ্চয় করে স্মৃতি ভল্টে রেখে দেওয়া আছে আরও অনেক প্রতিভাধর মানুষদের সঙ্গে। দরকার মতো আপনাদের নিয়ে এসে আমরা পরামর্শ নিই সাহিত্য, কলা, বিজ্ঞান বা সমাজ সংক্রান্ত বহু বিষয়ের জন্যে। যাই হোক, আমরা আবার বিষয়ে ফিরে আসি। গার্নসব্যাক, আপনি তো আমেরিকার মানুষ ছিলেন না, লাক্সেমবার্গ থেকে আমেরিকায় পাড়ি দিলেন কেন?
গার্নসব্যাক: আর কি! বিংশ শতাব্দীর শুরুতে আমেরিকা ছিল নতুন সুযোগের দেশ। ভাগ্যের সন্ধানে সপরিবারে পাড়ি দিলাম আমিও। ইলেকট্রিকাল যন্ত্রের কাজ বেশ ভালোই জানতাম, আর রেডিয়ো নিয়ে সেই সময় সারা দুনিয়া জুড়েই তোলপাড়। আমিও রেডিয়োর পার্টস আমদানি করতাম ইউরোপ থেকে। রেডিয়োর দোকান আর একটা ম্যাগাজিনও খুলেছিলাম। ম্যাগাজিনে প্রায়ই বিজ্ঞানের উপর প্রবন্ধ ছাপতাম অনেক। কিন্তু তখন পর্যন্ত সায়েন্টি-ফিকশন ছিল ওই ইউরোপেরই হাতে—শেলি, ভের্ণ আর ওয়েলস—এরাই তো জয় করে নিয়েছিল মানুষের মন।
অদ্রীশ: তা, আপনি তো মেতে ছিলেন রেডিয়ো নিয়ে, সেখান থেকে সায়েন্স ফিকশনের দিকে ঝুঁকলেন কীভাবে?
গার্নসব্যাক: আরে তখন মডার্ন প্রেস আর নতুন শস্তা কাগজের জন্যে পাল্প ম্যাগাজিনের যুগ। ক্রাইম, হরর, অ্যাডভেঞ্চার এরকম হরেক রকম পাল্পে বাজার ভর্তি। তাতে দু-একটা সায়েন্স ফিকশন ধরনের গল্পও যে ছাপা হত না, তা নয়। এসব দেখে আমার মনে হল এই ধরনের অ্যাডভেঞ্চার গল্পের মধ্যে যদি বিজ্ঞান ঢুকিয়ে দেওয়া যায় তবে বেশ হয়। লোকজনকেও নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে গল্পের মধ্যে দিয়ে বোঝানো যাবে, আর এই রকম ধারার একটা ম্যাগাজিনের মধ্যে দিয়ে পাঠকরাও নিজেদের সত্ত্বাকে খুঁজে পাবে।
কল্পবিশ্ব: অদ্রীশবাবুও কিন্তু বাংলায় কল্পবিজ্ঞানের ম্যাগাজিনের মধ্যে দিয়ে এই পাঠক আর লেখকদের একসঙ্গে করেছিলেন…
অদ্রীশ: হ্যাঁ, যে কোনও কল্পবিজ্ঞানের আন্দোলনের জন্যেই এই ম্যাগাজিনটা ছিল প্রথম ধাপ। গার্নসব্যাক আর ক্যাম্পবেল তো সেদিক থেকে আমার গুরু। ওঁদের রাস্তাই তো আমি অনুসরণ করেছি মাত্র।
কল্পবিশ্ব: যাক, তারপর ১৯২৬ সালে আপনি অ্যামেজিং স্টোরিস শুরু করলেন। সেই সময়টা নিয়ে কিছু বলুন।
গার্নসব্যাক: আরে শুরু তো করে দিলাম, কিন্তু লেখক কই? তখন আমেরিকায় সায়েন্স ফিকশন কেউ সেরকম লেখেই না তো। শুরু করলাম রিপ্রিন্ট দিয়ে—পো, ভের্ণ, ওয়েলস এঁদের লেখা ছাপতে লাগলাম। কিন্তু কতদিন আর এইভাবে চলে? মাথায় একদিন একটা বুদ্ধি এল। পত্রিকার মলাট আঁকিয়ে বিজ্ঞাপন দিলাম, এর উপযুক্ত গল্প লিখতে হবে। প্রথম পুরস্কার ২৫০ ডলার। সেই সময় ২৫০ ডলার অনেক টাকা। প্রচুর লোক গল্প পাঠালো। ব্যাস তাঁদের থেকে আমি নিয়মিত গল্প পেতে শুরু করলাম।
ক্যাম্পবেল: শুধু লেখকদের উৎসাহই নয়। আপনার থেকে পাঠকরাও কী পরিমাণ সাহায্য পেয়েছে ভেবে আমি অবাক হই। আপনিই তো প্রথম পাঠকদের চিঠিকে পত্রিকায় ছেপে তাঁদের গুরুত্ব দেন। তাঁদের নিজেদের মধ্যে সায়েন্স ফিকশনের ক্লাব তৈরিতে উৎসাহ দেন। সায়েন্স ফিকশন নিয়েও যে অন্য ধারার সাহিত্যের মতো মাতামাতি করা যায় সেটা আপনি না থাকলে কে-ই বা জানতো। আপনিই আমাদের সবাইকে রাস্তা দেখিয়েছেন। শুধু পত্রিকাটা আরেকটু ঠিকভাবে চালালে আর গল্পে বিজ্ঞানটা কম করলে আপনি আরও বহুদিন সম্পাদক হিসেবে থাকতে পারতেন।
গার্নসব্যাক: আরে সে তো এখন বুঝি হে বাপু। কিন্তু ব্যবসাটা আমার দ্বারা কোনওদিনই ভালো চলত না। আর সব সামলে লেখকদের নিয়মিত পয়সা দেওয়াও কি কম হ্যাপার ছিল? তাও কোথায় আর ওঁদের ধরে রাখতে পারলাম? আমার হাতে তৈরি লেখকরা চলে গেল অন্য ম্যাগাজিনে, একবার ভাবলোও না অ্যামেজিং স্টোরিসের কথা!
কল্পবিশ্ব: কিন্তু আপনার প্রচুর বদনাম যে আপনি লেখকদের টাকা দিতেন না। এই বদনামটা কিন্তু আপনাকেও শুনতে হয়েছে অদ্রীশবাবু।
অদ্রীশ: কি যে বলো! বাংলার কল্পবিজ্ঞান ম্যাগাজিনের বিক্রির সঙ্গে আমেরিকার সেরা ম্যাগাজিনের বিক্রির তুলনা? আমাদের সময় আমরা আশ্চর্য আর ফ্যান্টাসটিককে কীভাবে বাঁচিয়ে রাখব সেই নিয়ে লড়ে গেছি ঘটি-বাটি বেচে। তবে হ্যাঁ, অনেক লেখককেই তাঁর যোগ্য সাম্মানিক হয়তো দিয়ে উঠতে পারিনি তা সত্যি, কিন্তু উপায় ছিল না। তোমরা তো আমার শেষের জীবন দেখেইছো।
ক্যাম্পবেল: সত্যি অদ্রীশ, তোমাদের লড়াইটা অনেক কঠিন ছিল। তবে গার্নসব্যাকের ওই সায়েন্স ফিকশনের মডেল এমনিতেও চলত না। ওর মধ্যে গল্প কোথায়? রকেট, রশ্মি-বন্দুক নিয়ে দু-চার কথা আর বড় বড় ফিজিক্সের তত্ত্ব দিলেই গল্প হয় নাকি? আর বলতে বাধ্য হচ্ছি অ্যামেজিং স্টোরির লেখকরা বিজ্ঞান খুব একটা বুঝতেন না, আর গার্নসব্যাকও তাঁদের শুধরে দিতেন না। সেদিক থেকে অ্যামেজিং স্টোরি ছেড়ে দেওয়াটাই ঠিক কাজ হয়েছিল ওঁর পক্ষে।
গার্নসব্যাক: ছেড়ে না দিয়ে কী করতাম বল দেখি। ব্যাংকরাপ্ট হয়ে গেলাম রাতারাতি ১৯২৯ সালে, সেই যে বাজারে ধস নামল যে বছর। আর টানতে পারলাম না পত্রিকাটা।
কল্পবিশ্ব: অদ্রীশবাবুও কিন্তু বহুদিন পর্যন্ত এভাবেই পত্রিকাগুলি টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছেন। আরেকটা মিল আমি দেখতে পাচ্ছি, গার্নসব্যাক যেমন প্রচুর টেলিপ্যাথি, ইএসপি এরকম অনেক অপবিজ্ঞান নিয়ে গল্প ছাপতেন, অদ্রীশবাবুও ফ্যান্টাসটিকে কল্পবিজ্ঞানের নামে অনেক ফ্যান্টাসি আর হরর ছেপেছেন।
অদ্রীশ: বারবার কথাগুলো কৈফিয়তের মতো শোনালেও এটা বুঝতে হবে যে আমেরিকা আর ভারতের পাঠক এক ছিল না। ভারতে ভালো কল্পবিজ্ঞান গল্পের লেখকের অভাব চিরকালই ছিল। আবার পাঠকদের কাছে ভৌতিক ফ্যান্টাসির আবেদনও কম নয়। আমি বাধ্য হয়েছিলাম… হয়তো বয়স হয়ে যাচ্ছিল, মনের সেই জোরও ছিল না আর। তোমাদের, মানে কল্পবিশ্বকে যদি আরেকটু আগে পেতাম…
ক্যাম্পবেল: আমার লড়াইটা কিন্তু ঠিক ওই জায়গাটা থেকেই শুরু হয়েছিল। কল্পবিজ্ঞান থেকে সমস্ত আগাছা দূর করা। তাকে সঠিক রাস্তা দেখিয়ে কড়া হাতে তার বেড়ে ওঠা নিয়ন্ত্রণ করা। তোমাদের কল্পবিশ্বের কাজ একুশ শতাব্দীর প্রথমে আমি দেখেছি। যদি গার্নসব্যাকের সঙ্গে অদ্রীশের তুলনা করা যায়, তাহলে তোমাদের কাজের মধ্যে আমি নিজের ছায়া দেখতে পাচ্ছি।
গার্নসব্যাক: দেখো, আমার সময়ও লেখকদের মধ্যে বিজ্ঞান চেতনার অভাব ছিল। আমি তো আর ক্যাম্পবেলের মতো আসিমভ, ক্লার্ক বা হাইনলেনের মাপের লেখককে পাইনি। আর ক্যাম্পবেল বিজ্ঞানটাও বুঝতো ভালো। এমআইটি-র ছাত্র ছিল, সেটা তো মানতেই হবে। কিন্তু আমার হাতে তৈরি সায়েন্স ফিকশনের ক্লাবগুলো না থাকলে কিন্তু এই তিনজনকে পাওয়াও সম্ভব হত না। আমি পরে সায়েন্টিফিক ডিটেকটিভ স্টোরি আর এয়ার ওয়ান্ডার স্টোরিও সম্পাদনা করেছি, তবে ততদিনে প্রতিযোগিতা অনেক বেড়ে গেছিল, আরও অনেক পত্রিকাও এসে গেছিল।
কল্পবিশ্ব: হ্যাঁ, এটা কিন্তু দেখাই যাচ্ছে যে কল্পবিজ্ঞানের এই পত্রিকা আর তাকে ঘিরে তৈরি ছোট ছোট গ্রুপের মধ্যে আইডিয়া আদানপ্রদান ভালো কল্পবিজ্ঞান তৈরির মূল শর্ত। আর আপনার দেখাদেখি অন্য পাল্প ম্যাগাজিনগুলোও কল্পবিজ্ঞান ছাপতে আগ্রহী হয়। এর জন্যেই তো আপনার নামেই হুগো পুরস্কার দেওয়া হয়। আপনাকে কল্পবিজ্ঞানপ্রেমীরা ভুলবে না।
অদ্রীশ: ক্যাম্পবেলকেও আমরা পেতাম না গার্নসব্যাক না থাকলে। সায়েন্স ফিকশন টার্মটাও তো ওঁরই আমদানি। ক্যাম্পবেল আপনিও বলুন এবার সেই চল্লিশের দশকের কথা। পাশ্চাত্য কল্পবিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ। আহা কি সব লেখক ছিলেন সেই সময়। আমরা ভাগ্যবান।
ক্যাম্পবেল: আসলে গার্নসব্যাকের সময়ে সায়েন্স ফিকশন তার আসল চেহারা পায়নি। তখন লেখা হত সায়েন্স বা কোনও গ্যাজেটের বর্ণনার সঙ্গে জোর করে কিছু গল্প ঢুকিয়ে। গল্পটা ছিল গৌণ, মানুষকে বিজ্ঞান চেতনা দেওয়াই ছিল মুখ্য উদেশ্য। ধরো একটা গল্প শুধু একটা রশ্মিবন্দুক আর তার কার্যকারিতা নিয়েই। আমি এর ঘোর বিরোধী ছিলাম, আমি বললাম এর থেকে এমন গল্প লেখা হোক যেখানে দুনিয়ার সবার কাছেই রশ্মিবন্দুক আছে, তাহলে সেই দুনিয়াটা কেমন হতে পারে? ১৯৩৭ তে আমি যখন অ্যাস্টাউন্ডিং স্টোরির মুখ্য সম্পাদকের দায়িত্ব নিলাম, তখন থেকেই আমার উদ্দেশ্য ছিল যে কোনও ভাবেই সায়েন্স ফিকশনকে সাহিত্যের মূল ধারায় নিয়ে আসব।
অদ্রীশ: আপনি নিজেও তো বেশ কিছু লেখালেখি করেছেন কলেজে পড়ার সময়—অ্যামেজিং স্টোরিতে সায়েন্স ফিকশন নিয়ে চিঠিও লিখতেন। ডন স্টুয়ার্ট ছদ্মনামে আপনি ৩০ সালে প্রচুর কল্পবিজ্ঞানও লিখেছেন। তাদের মধ্যে টোয়ালাইট আর হু গোজ দেয়ার তো একেবারে কাল্ট ক্লাসিক!
ক্যাম্পবেল: হ্যাঁ, ৩৭ সালে অ্যাস্টাউন্ডিং স্টোরির দায়িত্ব নেবার পরে যদিও আর কিছু লিখিনি। আমার একার পক্ষে লিখে সায়েন্স ফিকশনের মোড় ঘোরানো সম্ভব হত না। দরকার ছিল একটা টিমের। সেই টিমটা আমি পেলাম হেইনলেন, স্টারজন বা ভ্যান ভটের কাছে। অ্যাসিমভ আর ডক স্মিথও অনেক সাহায্য করল আমায়।
কল্পবিশ্ব: আপনি কিন্তু নিজেও বহু লেখককে প্লট লিখে দিয়েছেন, নিজে বসে তাঁদের গল্প কারেক্ট করে দিয়েছেন। আর নতুন লেখকদের খুঁজে বের করা? লেস্টার দেল রে, ভ্যান ভট, হেইনলেইন, স্টারজন—কল্পবিজ্ঞানের নক্ষত্র সব, তাঁরা তো প্রদক্ষিণ করতেন আপনার চারপাশেই।
অদ্রীশ: ঠিকই বলেছো। ক্যাম্পবেলের নামে একটা কথা তো চালুই আছে—ওঁর জন্যেই লেখকরা বড়দের জন্যে প্রাপ্তমনস্ক বুদ্ধিদীপ্ত কল্পবিজ্ঞান লেখা শুরু করেন। তোমরাও তো এটাই চাইতে, তাই না?
ক্যাম্পবেল: হ্যাঁ, আমি চাইতাম লেখকরা ভবিষ্যৎ সমাজের গল্প লিখুক যেখানে বিজ্ঞান হবে বাস্তবসম্মত। পরে অনেকেই বলেচে আমিই নাকি হার্ড সায়েন্স ফিকশনের প্রবর্তন করি। তবে আমি আমার সায়েন্স ফিকশনে বিজ্ঞানকেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভেবেছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের একটা ঘটনা বলি—১৯৪৪ সালের এক সকালে দুই ভদ্রলোক এসে হাজির হলেন আমার অফিসে। তখন পুরোদমে চলছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। দুজনেই পরিচয়পত্র দেখালেন—এফবিআই। আমার কাছে কেন? ক্লাইভ কার্টমিলের ‘ডেডলাইন’ আমি কী করে ছাপলাম? পারমাণবিক বোমার কথা লেখকের মাথায় এল কী করে? তাও এত বিশদে? তাঁদের আমি বোঝালাম, গল্পটা লেখার সময় আমি আর কার্টমিল, সেই সময়ের এই সংক্রান্ত পদার্থবিদ্যার গবেষণাপত্র পড়ে ফেলেছি। এর থেকে বোঝাই যাচ্ছিল আর কিছুদিনের মধ্যেই বোমা কেউ না কেউ বানাবেই। শেষ পর্যন্ত এফবিআই আমার কথা বিশ্বাস করে। (মৃদু হেসে) আরে লস আলমোসে প্রায় সবাই যে অ্যাস্টাউন্ডিং সায়েন্স ফিকশন পড়ত।
অদ্রীশ: আমার মনে পড়ে গেল লালবাজারে সেই কমিশনারের ঘরে ডাক পড়াটা। তবে আমায় ডেকেছিল অবশ্য আমি ছদ্মনামে পত্রিকা সম্পাদনা করছিলাম বলে। আসলে সেটা যে আইনবিরুদ্ধ তা জানা ছিল না। আর কমিশনার আবার আশ্চর্যের ভক্ত ছিলেন, তাই আমার সঙ্গে পরিচয় করতেও চেয়েছিলেন।
কল্পবিশ্ব: কল্পবিজ্ঞান লেখক-সম্পাদকরা চিরকালই সমাজে বিশেষ সম্মান পেয়ে এসেছেন। একমাত্র কল্পবিজ্ঞানই দেখাতে পারে সমাজ কোনদিকে যেতে চলেছে আর সেই রাস্তার বাঁক আর গর্তগুলি কোথায় আছে।
ক্যাম্পবেল: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগেই আমেরিকায় সায়েন্টি-ফিকশনের থেকে সোশ্যাল সায়েন্স ফিকশনের চল শুরু হয়ে গেছিল। আমি বার বার বলতাম লেখকদের—তোমাদের চরিত্রগুলিকে একটা অন্য সমাজে, অন্য জগতে এনে ফেল, যেখানে তারা নিজেদের চেনা পরিচিত চার দেওয়ালের বাইরের কোনও সমস্যার সম্মুখীন হবে। তবেই না গল্প মানুষের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। যদিও বিশ্বযুদ্ধের সময় সারা আমেরিকা রিসেশনে চলে গেছিল। কাগজেরও আকাল ছিল, সমস্ত লেখকরা যুদ্ধের কাজে বিভিন্নভাবে সাহায্য করছিল। কিন্তু এইসময় কল্পবিজ্ঞানকে বাঁচিয়ে রেখেছিল পাঠক আর ভক্তরা। এছাড়াও বার বার গল্প আর কমিকসে এসে পড়ত আমেরিকার বা মনুষ্যত্বের রক্ষাকর্তা সুপার হিউম্যানের কথা। এই প্রসঙ্গে মনে পরে ভ্যান ভটের স্ল্যান উপন্যাসটির কথা। ধারাবাহিকভাবে বের করেছিলাম গল্পটা আমার পত্রিকায়। অনেকেই বলে থাকেন সুপার হিউম্যানদের এই উপন্যাসই নাকি প্রথম মডার্ন কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস। তবে নাজি প্রচার মাধ্যমের বিরুদ্ধে লড়াই করতে আর আমেরিকানদের মনোবল বাড়াতে এই অতিমানবীয় গল্পগুলো খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল সেই সময়।
অদ্রীশ: সমাজের এবং বিজ্ঞান চেতনার উপরে কল্পবিজ্ঞানের গতিপ্রকৃতি নির্ভর করে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ইঞ্জিনিয়ারিং, রকেট, পারমাণবিক শক্তি, কৃত্রিম যন্ত্রগণক—এই সব কিছুই পাশ্চত্য কল্পবিজ্ঞানের গোল্ডেন এজের বৈশিষ্ট। আর সে সময় আমরা ব্যস্ত নতুন ভারত গড়ার কাজে। শিক্ষা-স্বাস্থ্য-খাদ্য এইগুলিই তখন আমাদের প্রধান চাহিদা। কল্পবিজ্ঞান মানে ভবিষ্যতের দিকে তাকানোর সময় কোথায়। তাও ষাটের দশকে আমরা চেষ্টা করেছিলাম। মানিকদা, প্রেমেন্দ্রবাবু, আমি এবং আরও অনেকে একটা জোয়ার এনেছিলাম জানেন বাংলা সায়েন্স ফিকশনের। অনুবাদই হত প্রচুর। নামে-বেনামে, অনেক সময় মূল লেখার উল্লেখও থাকত না। কিন্তু বাংলার এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় কল্পবিজ্ঞানের গাড়িটাকে জাম্পস্টার্ট দেবার কাজ করেছিল ওই অনবদ্য অনুবাদগুলি। পরে ক্লার্কের সঙ্গে দেখা হয়েছিল যখন, তিনি আমায় ঢালাও অনুমতি দিয়েছিলেন ওঁর লেখা অনুবাদ করার। কিন্তু সে আর করতে পারলাম কই। সম্পাদনা, অনুবাদ, প্রকাশনা—একের পর এক কাজে জড়িয়ে গেলাম। যাই হোক, আপনার কথায় ফিরে আসি। লোকে বলে আপনি সায়েন্স ফিকশনকে বাঁচিয়েছেন, তাকে আজকের রূপ দিয়েছেন, আবার আপনিই তাকে ডুবিয়েছেন। কি আশ্চর্য জানেন, আমাকেও এই একই কথা শুনতে হয়েছে!
কল্পবিশ্ব: সত্যিই আশ্চর্য না? প্রথমে গার্নসব্যাক, তারপর ক্যাম্পবেল আর পরে আপনি অদ্রীশ— আপনাদের তিনজনের অবদান অপরিসীম কল্পবিজ্ঞানে বা সায়েন্স ফিকশনে। কিন্তু তিনজনের সেরা সময়ের পরে অভিযোগের বন্যা বয়ে গেছে আপনাদের উপর।
গার্নসব্যাক: আসলে কল্পবিজ্ঞান নতুন সমাজের, তরুণদের গল্প। আমরা বয়স হয়ে গেলেই বাঁধা পড়ে গেছি আদ্যিকালের ধ্যান ধারণায়। আমার গল্প বাছার সময় যেমন আমি নিজে বিজ্ঞান বলতে যা বুঝতাম তার উপর অ্যাডভেঞ্চার আর স্পেস অপেরা বেছে গেছি। কিন্তু ক্যাম্পবেলই বা কি করল? সাই-পাওয়ার? আনসায়েন্টিফিক অ্যান্টি গ্র্যাভিটি থিয়োরি? এসব নিয়ে লিখতে চায়নি বলে কতজন লেখককেই না তুমি ব্ল্যাকলিস্ট করেছো। নতুন যুগের সঙ্গে তুমিও কিন্তু তাল মিলিয়ে চলতে পারোনি।
ক্যাম্পবেল: এখন বুঝি সেটা। কিন্তু তখন আমার কাছে কল্পবিজ্ঞান ছিল আমেরিকান। তা হবে শ্বেতাঙ্গ, কঠিন, বুদ্ধিমান, সাহসী। ভবিষ্যৎ বিজ্ঞানের হাত ধরে সে উদ্ধার করবে নীলনয়না সুন্দরীদের। সেখানে অশ্বেতাঙ্গদের জন্যে কোনও জায়গা ছিল না, মেয়েদের কোনও জায়গা ছিল না। আমি ভুল ছিলাম, এখন বুঝতে পারি। ভাবতাম আমিই শেষ কথা বলব সায়েন্স ফিকশনের। সময় আমার থেকে অনেক বড়। জানো, প্রধান চরিত্র আফ্রিকান আমেরিকান হবার জন্যে আমি গল্প বাতিল করেছিলাম! এখন ভাবলে লজ্জায় মাথা কাটা যায়।
কল্পবিশ্ব: হ্যাঁ, ২০১৯ সালে আপনার পত্রিকাই সেই জন্যে আপনার নামে পুরস্কার দেওয়া বন্ধ করে দেয়। তবে মানুষ হিসেবে আপনার দৃষ্টিভঙ্গীর কথা জানার পরেও কল্পবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আপনার অবদান আমরা ভুলতে পারব না।
অদ্রীশ: দেখো, আমরা লেখক সম্পাদক যাই হই না কেন, শেষে তো আমরা মানুষই। মানুষের দোষ-গুণ সবই আছে আমাদের মধ্যে। আমিও ফ্যান্টাসটিকের সময় কল্পবিজ্ঞানের জায়গায় অনেক ভূতের গল্প ও অন্য ধারার লেখা ছেপেছি। কী করব, লেখক কোথায়? বড় লেখকদের উপযুক্ত সম্মানিক দিতে পারতাম না তখন। কত আর বিক্রি হত কল্পবিজ্ঞান পত্রিকা? কিন্তু আজ যারা আমায় সেই সময়ের জন্যে দোষারোপ করেন, তাঁরা কেন তখন হাল ধরলেন না? অন্তত তার পরেও পঁচিশ বছর? বাংলা কল্পবিজ্ঞানের জগতে একটা অন্ধকার যুগ যেন সেই সময়টা। কল্পবিশ্ব না এলে এই যুগ যে আরও কতদিন চলত কে জানে?
কল্পবিশ্ব: কেউ না কেউ নিশ্চয়ই এগিয়ে এসে হাল ধরতেন। শুধু ক’দিন আগে বা পরে। তবে আপনাদের দেখানো পথেই এগিয়ে চলার চেষ্টা করেছে কল্পবিশ্ব সবসময়। আশা করি আপনাদের ভুলগুলি আমরা এড়িয়ে চলতে পারব। তবে একথা অনস্বীকার্য যে কল্পবিজ্ঞান পত্রিকা আর সম্পাদক ছাড়া উৎসাহী লেখক আর কল্পবিজ্ঞান ফ্যানবেস তৈরি হওয়া অসম্ভব। তিনটি ক্ষেত্রেই এই উদাহরণ আমরা দেখলাম। আর সঠিক সময়ে তাঁদের হাতেই হয় কোনও ঘরানার উত্থান। আজ আমরা যতই তর্ক করি, ষাটের দশকে কল্পবিজ্ঞান পত্রিকা, সিনে ক্লাব, পাঠাগার, ক্লাব ইত্যাদি নিয়ে যে আলোড়ন তুলেছিলেন অদ্রীশরা সেরকম ঢেউ বাংলায় আসতে আমাদের প্রায় ষাট বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল। যাই হোক, আমরা আশা করব ভবিষ্যতের পৃথিবী আপনাদের তিনজনের কল্পবিজ্ঞানের অবদানের কথাই মনে রাখবে, মানুষ হিসেবে দোষগুণ নিয়েই বিচার করবে। আমরা আজকের সাক্ষাৎকার এখানেই শেষ করলাম। ধন্যবাদ সকলকে।
লেখকের কথা: এই সাক্ষাৎকার সম্পূর্ণ কাল্পনিক হলেও এর তথ্যগুলি ইতিহাসনির্ভর। যেখানে কোনও সম্পাদকের মূল্যায়ন করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ লেখকের দায়িত্ব ও ব্যক্তিগত মতামত।
তথ্যসূত্র:
১) দ্য ম্যামথ এনসাইক্লোপিডিয়া অব সায়েন্স ফিকশন
২) দ্য কেম্ব্রিজ হিস্ট্রি অব সায়েন্স ফিকশন
৩) দ্য গোল্ডেন এজ অব সায়েন্স ফিকশন
৪) ইন্টারনেটের বিভিন্ন প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকার
Tags: কাল্পনিক সাক্ষাৎকার, দীপ ঘোষ, পঞ্চম বর্ষ প্রথম সংখ্যা, বিশেষ আকর্ষণ
দারুন, দারুন!
অনেক কিছু জানলাম। খুবই চমৎকার হয়েছে। শুরু থেকেই হুকড হয়ে গেছি। কখন যে শেষ হয়ে গেল টেরই পাইনি।
ক্যাম্পবেল যে নারী ও আফ্রিকান আমেরিকানদের প্রতি এমন ধারণা পোষণ করতেন শুনে অবাক হলাম। তবে শেষে ঠিকই বলেছেন, শেষপর্যন্ত তারা মানুষই ছিলেন।
অনেক ধন্যবাদ এমন চমৎকার ও অভিনব একটি ইন্টারভিউ উপহার দেওয়ার জন্যে। শুভকামনা রইল।
সাক্ষাৎকারটা পড়তে-পড়তে চমকে উঠছিলাম। আজ, এই একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকেও বাংলায় জঁর ফিকশনের অবস্থাটা বোধহয় গার্নসব্যাক-কথিত অবস্থার চেয়ে খুব একটা বদলায়নি। আর আজও কল্পবিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হচ্ছে ক্যাম্পবেলের মতো কিছু কঠোর সিদ্ধান্ত নিয়েই। তবে এই সাক্ষাৎকারের কেন্দ্রে আছে একটা প্রকাণ্ড আশাবাদ— চিনের পাশাপাশি বাংলা কল্পবিজ্ঞানও একদিন তুমুল জনপ্রিয়তা পাবে!
চরৈবেতি।
অসাধারণ ভাবনা ও উপস্থাপনা। হুগো গার্ন্সব্যাক, ক্যাম্পবেল ও অদ্রীশ বর্ধন – তিন জনই নিজেদের সময়ে পথিকৃৎ হিসেবে কাজ করেছেন, তাদের সাফল্য ও ব্যর্থতার খতিয়ানও প্রায় একই রকম – সেটা খোলামেলা আড্ডার মেজাজ ছাড়া প্রকাশ পেত না। সাইন্স ফিকশন যেভাবে ভবিষ্যতের মুখ চেনায়, এই সাক্ষাৎকারটিও ভবিষ্যৎ-সম্পাদনার গতি-প্রকৃতি চেনাতে পারে।
One word: damn!
ভীষন ভাল লাগল ।