শুভাকাঙ্খী
লেখক: মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়
শিল্পী: অঙ্কিতা
বুধবার বিকেল চারটে
আজ প্রায় পাঁচ দিন হয়ে গেল-এত লোক দেখেছে ভিডিয়োটা, প্রায় ভাইরাল হয়ে গেছে। প্রথমদিকে মুকুলকে প্রায় মেরে ফেলার ইচ্ছেটা এখন অনেক প্রশমিত। শুধু একটা প্রচন্ড তিক্ত স্বাদ মুখে। মেট্রোরেলের জানলা থেকে দ্রুত বদলে যাওয়া শহর… আমি দেখতে পাচ্ছিনা আর কিছুই– শুধু ধূসর, বিবর্ণ আর অগুনতি মানুষ। গতকাল বিকেলে টালিগঞ্জ স্টেশনে নামার পর আমার সব ধৈর্য্যের বাঁধ যেন ভেঙে গেলো। হঠাৎ করে মনে পড়ে গেল বরুণকে কয়েকটা জিনিস বলতে হবে হাসপাতালে আনার জন্য, ব্যাগের মধ্যে অন্যমনস্ক হাত ঢুকিয়ে দেখলাম সেলফোনটা নেই।
দুবার তিনবার তন্নতন্ন করে গোটা ব্যাগটা হাতড়াচ্ছি। এতো বড়ো একটা ঝোলা-হাজারো দরকারি আর বাজে জিনিসের মেলা। ওহ! কেন যে কিছু ফেলি না আমি, পৃথিবীর সব জিনিস আছে, শুধু ফোনটাই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। হে ঈশ্বর– এত কিছুর মধ্যে ফোনটাও হারিয়ে গেলো; এতদিন ধরে জমিয়ে রাখা মানসিক চাপ যেন একেবারে বিধ্বস্ত করে দিলো। খুব কান্না পেয়ে গেলো– সম্পূর্ণ একা আমি, ওই লোকভরা স্টেশনে। এতো ক্লান্তি শরীরে, ইচ্ছেও করলো না আর স্টেশনের ভেতর ফিরে গিয়ে কোথাও খোঁজ করি বা কমপ্লেন করি। বেরিয়ে এলাম স্টেশন থেকে।
এতো খারাপ যাচ্ছে শেষ কয়েকদিন, দুদিন ধরে হাসপাতাল আর বাড়ি।
পরশুদিন রাত্রে ফোনটা এলো, বরুণ ধরেছিলো। বাবার অনেক বছরের বন্ধু আর আমাদের প্রতিবেশীও, সনতকাকু করেছিলেন। বললেন বাবার শরীরটা হঠাৎ খুব খারাপ করেছে, কাকুর নার্ভাস লাগছে। নিউটাউন থেকে নাকতলা- পথ যেন আর ফুরোচ্ছিলো না, বাবার শ্বাসকষ্ট ভীষণ বেড়ে গেছে। দৌড়োদৌড়ি করে ভর্তি করে ফেলতে হল বাবাকে ইস্টার্ন বাইপাসের ধরে একটা নামকরা স্পেশালিটি হাসপাতালে। এই টানাপোড়েনে আমার আর বরুনের মধ্যে জমে থাকা নৈঃশব্দ্যে চিড় ধরলো একটু। তবে ভিডিয়োটা নিয়ে একটা কথাও বলেনি বরুণ; কোনও প্রতিক্রিয়াই দেখায়নি, শুধু সম্পূর্ণ চুপ হয়ে গেছে। আমাদের ফ্ল্যাটে ঢোকা, বেরোনো আর প্রীতিকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেওয়া ছাড়া শুধু-স্তব্ধতা।
আমি অবশ্য একবার গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছিলাম।
“হিপোক্রিট সব হিপোক্রিট” আরো হাজার কথা। বরুণকে বারবার জিজ্ঞাসা করেছি কি করেছি আমি – কোথায় ভুল? যা মনে করি-সেটাই বলেছি। আমি তো জানতাম, বরুণের কাছে সেটাই সবচেয়ে আলাদা-ওর সবচেয়ে প্রিয় গুণ -যা ও সবচেয়ে বেশি রেস্পেক্ট করে–তাহলে?
তাহলে আজ ও সবার চেয়ে আলাদা কোথায়?
কিন্তু পাথরের দেওয়ালে চিড় ধরলো না একটুও। বরুণ কথা বলবে না এটা নিয়ে-আমি বুঝে গেছি। এইভাবেই শাস্তি দেবে ও আমাকে। মাঝরাত্রে আমাদের ফ্ল্যাটের বারান্দায় এসে বসলাম। বাড়ির মধ্যে আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা। সামনে খোলা আকাশ, কমপ্লেক্সের মধ্যে শেষ বিল্ডিং আমাদের, তাই সামনে আদিগন্ত খোলা প্রান্তর। অনেক দূরে বিরাট ডাইনোসরের মতো একটা বহুতলের কাঠামো। বিশ্বাস হয় না কলকাতায় থেকে এতটা আকাশ ফুসফুসে ভরে নেওয়া যায়। সারাদিন কাজের চাপের পর এই বারান্দাটা আমাকে ওয়েসিসের মতো টানে। এই বেতের সোফাসেট, সারি সারি টবের গাছগুলো, খোলা মাঠ ভাসিয়ে হুহু করে আসা হাওয়া, আমাদের বিছানায় ঘুমন্ত বরুণ। রাত্রে একা এই সোফায় বসে একটা সিগারেট – এই সবই আমার নিজস্ব পৃথিবী। সেদিন মাঝরাতের বারান্দায় বসে গত উইকএন্ডের ঘটনাটা ভেসে উঠলো – মস্তিষ্কে রিওয়াইন্ড হতে লাগলো।
সিদ্ধার্থ ভীষণ ভালো একটা ব্রেক পেয়েছে, টাইমস অফ ইন্ডিয়াতে, আমাদের পুরো প্রেসিডেন্সিতে গ্রূপটা জড়ো হয়েছিল। খুব উড়ছি আমরা, পার্টিতে গাঁজা, হুইস্কি, ভদকা, ওয়াইন সবই আছে – সবাই একটু কন্ট্রোলের বাইরে। মুকুল সদ্য ওর সিঙ্গাপুর থেকে আনা নতুন ক্যামেরাফোনে খুব শুটিং করছে। আমাকে মুকুল এসে বললো গাঁজা খাওয়া নিয়ে আজকের ইন্ডিপেন্ডেন্ট মহিলার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বক্তব্য পেশ করতে। আমিও শুরু করলাম; আর বন্ধুরা তো জানে আমাকে একটু উৎসাহ দিলেই নাচতে শুরু করি।
“…বন্ধুগণ, গাঁজা হচ্ছে আমাদের মতো কর্মরত মহিলাদের কাছে একটা মুক্তির উপায়। একফালি আকাশ। ঘরের দায়িত্ব, বাইরে চাকরি সামলাতে সামলাতে যখন সত্যিকারের একটা খোলা জায়গা একটা নিজস্ব নিশ্বাস নেবার জায়গা লাগে, সেটা এনে দিতে পারে এই গাঁজা। এটা মস্তিস্ককে একটা অন্য স্তরে পৌঁছে দেয়.”
তারপর মুকুল আমার শ্বশুরবাড়ি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতে শুরু করলো। তারা জানলে কি বলবে ইত্যাদি। আমি উত্তর দিয়েছিলাম, “আমার শ্বাশুড়ীমা কি বোঝেননি কাকে নিয়ে এসেছেন পরিবারে? আমার মতো সৃষ্টিছাড়া মেয়েকে যখন মেনে নিয়েছেন ভদকা, সিগারেট আর গাঁজা কি করবে? ইত্যাদি ইত্যাদি।”
না। আমি অনুতপ্ত নই যা বলেছি; কিন্তু মুকুল পরের দিন ওটা ফেসবুকে শেয়ার করে দেবে, আমি স্বপ্নেও কল্পনা করিনি। একদিনে ভাইরাল হয়ে গেলো ভিডিয়োটা। শয়ে শয়ে কমেন্টস আসতে লাগলো। অনেকের কমেন্টে সরাসরি অনাবিল বিস্ময় থেকে ঘৃণা সবই প্রকাশ করেছেন। অনেকে পক্ষে, নারীবাদী মতামতও যথেষ্ট প্রবল। তারপর এদের মধ্যে শুরু হয়ে গেলো যুদ্ধ। সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর অপমান দিয়ে শুরু করে, বিষাক্ত আক্রমণাত্মক অশ্লীল কথার বন্যা-কতরকম মানসিকতার যে পরিচয় পেয়েছি এই কয়েক দিনে! মন রাগ বিরক্তি, অপমান, তিক্ততায় ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। এই প্রবল স্রোতে ভাসতে ভাসতে খেয়াল করলাম, বরুণ একদম চুপ।
আর ওর সেই পরিস্থিতে চুপ হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে এতটা অপ্রত্যাশিত, যে কিভাবে সেটাকে নেব বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
শুধু বরুণ নয়, মা এতো প্রগতিশীল, মুক্ত মনের। বন্ধুর মতো শাশুড়ি, যিনি সর্বক্ষেত্রে আমার সহায়, যিনি কখনো আমার ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেননি। আমিও ওঁর একা থাকার সিদ্বান্তে সমর্থন করেছি, কখনো ওঁর জগতে নাক গলাইনি। আমার ধারণা আমাদের মধ্যে চমৎকার বোঝাপড়া আর সেটা অত্যন্ত মূল্যবান আমার মতো মা হীন মেয়ের কাছে। সেই মা – মা’র ফোন সুইচড অফ আজ দু দিন। আমি ল্যান্ডলাইনে আর ফোন করিনি। আর বরুণ, যে মানুষটা গত সাত বছর ধরে সমস্ত কিছুতে আমার নিঃশব্দে আমার পাশে পাশে থেকেছে, না বলতেই আমার সমস্ত ছোটোখাটো সুবিধা অসুবিধা বুঝে নিয়েছে ,আমাকে সামলাছে সমস্যায় পড়লেই- আমার বন্ধুরাও বরুণ বলতে অজ্ঞান, সেই মানুষটা সম্পূর্ণ চুপ।
বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করার দিনই RMO-র সঙ্গে আমার ঝঞ্ঝাট বেঁধে গেল। পালমোনারি স্পেশালিস্ট সপ্তাহে তিন দিন আসেন? তাহলে কিসের সুপার স্পেশাল্টি হাসপাতাল? যেখানে এই শহরের বোধহয় অধিকাংশ মানুষের ফুসফুস বিষে ভরে গেছে। আমার প্রচুর বক্তব্যের তোড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে অনড় ওই ডাক্তার। তার কিছু করার নেই। বরুণ সম্পূর্ণ চুপ, আমি একা কথা বলতে বলতে কেমন হাঁপিয়ে উঠলাম। তারপর নিজের অজান্তে ভেতর থেকে একটা ধন্যবাদ বেরিয়ে এলো ঈশ্বরের প্রতি। এর পর এটলিস্ট আমাকে অফিস যেতে হবে না।
না সেভাবে আমাকে কেউ কিছু বলেনি, প্রতীক,দূর্বা,সায়নীর মতো কিছু বন্ধুরা ছাড়া। মুকুলের শ্রাদ্ধ করেছে ওরা। সায়নী ব্যক্তিগতভাবে আমাকে বললো “কি দরকার ছিল তোর এটা করার..এতো হাই হবার” সায়নী আমার ভীষণ কাছের বন্ধু। তার সঙ্গে আমার অফিস কলিগ।ওর মতো শুভাকাঙ্খী আমার খুব কম মানুষই আছে…তাই ওকে কিছু উত্তর দিতে পারিনি।
“ভালোই গন্ডগোল পেকেছে রে পারো। এমনিতেই তোর “বন্ধুর” অভাব নেই অফিস। কালই দেখলাম সম্পূর্ণাদি অনেকক্ষণ কথা বলছে অভিরূপদার সঙ্গে। একটা মিটিং ডাকা হবে শুনছি।”
আমি নিজে কি বুঝতে পারিনা? অফিসে এই গুমোট ভাব? এই ফিসফাস? তির্যক চাউনি? অফিস আমার খুব মনমতো জায়গা। কলকাতার সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত এডভার্টাইসিং এজেন্সি গুলোর মধ্যে একটা।
আমি আমার কাজ ভীষণ ভালোবাসি। যথাসাধ্য পরিশ্রম করি; কাজের প্রতি আমার ডেডিকেশনে কোনও খাদ নেই। হ্যাঁ কলিগস, এমনকি ম্যানেজারদের সঙ্গে আমার মতবিরোধিতা হয়, মিটেও যায়। সবাই জানে আমি স্পষ্টবক্তা, রাগী কিছুটা দুর্মুখ কিন্তু কাজের ব্যাপারে আমি শতকরা একশো ভাগ একনিষ্ঠ। সেই অফিসে যেতে ইচ্ছে করছে না আমার। হাওয়াতে শুধু দুর্বোধ্যতা, একটা বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে চলেছে-ভিডিয়োটা ফেসবুকে ভাইরাল হবার পর থেকে। আমার শুধু মনে হয়, আমাকে কেউ এসে স্পষ্টভাবে কিছু জিজ্ঞাসা করুক। কিন্তু না-বড়ো বেশি নৈঃশব্দ চারদিকে। সম্পূর্ণাদির তির্যক চাউনি, অমৃতার সঙ্গে উত্তেজিত স্বরে কথা বলতে বলতে আমাকে দেখে চুপ হয়ে যাওয়া, অভিরূপদার দৃঢ়বদ্ধ চোয়াল, আমার দিকে সরাসরি না তাকানো। জানি কিছু একটা ঘনিয়ে আসছে, আর সেটার মুখোমুখি হবার মানসিক প্রস্তুতি আমার এখন নেই। না ভয় নয়, তিক্ততা। মুখে প্রোগ্রেসিভ মানুষগুলোর ভণ্ডামি আর দেখতে পারছিনা আমি. – এভাবে বড় হইনি আমি। হ্যাঁ, আমি জেদি, একগুঁয়ে ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট। আমার নিজের কাছে আমি সৎ একজন মানুষ। কি করবো আমি এখন?
বুধবার বিকেল সাড়ে চারটে
এই সমস্ত চিন্তায় তলিয়ে যাওয়া মনটাকে সম্পূর্ণ চমকিয়ে দিয়ে বেজে উঠলো ফোনটা। অনেকদিন এরকম আপাদমস্তক চমকাইনি। যে ফোন গতকাল থেকে তন্নতন্ন করে খুঁজে পাচ্ছি না সেটা ব্যাগে এলো কি করে? কাল থেকে হাজার বার বাজিয়েছি। প্রত্যেকবার সুইচড অফ বলছিলো। কোনরকমে ধরতে গিয়ে কেটে গেল, নম্বরটা আমার মাসতুতো বোন পিউয়ের, টরন্টো থেকে কল করেছে। বোধহয় বাবা হসপিটালে সেই খবরটা পৌঁছেছে। না কি ভিডিয়োর খবরটা?
নাকতলা যাবার অটোতে সাইডে জায়গা পেয়ে গেলাম। এখনও মনটা কেমন একটু আচ্ছন্ন হয়ে আছে, কি হল ব্যাপারটা? শেষ বিকেলের একটা এলোমেলো হওয়া দিচ্ছে। নিজের অজান্তে একটা নিশ্বাস বেরিয়ে এলো। বাড়ি যাবো, কাল সকালে বাবার কিছু জিনিস গুছিয়ে নিয়ে যেতে হবে হসপিটালে। মনে মনে ঠিক করছি কোন কোন জিনিসগুলো নিতে হবে, বাবার mp3 প্লেয়ারটা, দুটো ফতুয়া, বাবার গামছা-যেটা না হলে বাবার চলেনা। দু তিনটে বই। কে জানে গীতা কি এসেছিলো এর মধ্যে? নয়তো তো বাড়ির অবস্থায় খুব খারাপ হয়ে থাকবে। মা হীন সংসারে দুটো মাত্র প্রাণী আমরা, বাধ্য হয়ে ছেলেবেলা থেকেই আমি স্বাবলম্বী আর দায়িত্ববান।
আর বাবা চিরকালই মুক্ত চিন্তার মানুষ, পাড়াপ্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনের কাছে ঠিক কিরকম ব্যবহার, চালচলন গ্রহণযোগ্য, তা নিয়ে বিশেষ মাথা ঘামাতে হয় নি। ছেলেবেলা থেকেই পড়াশোনায় ভালো, প্রেসিডেন্সি থেকে পাশ করেই এই প্রখ্যাত এডভার্টাইসিং এজেন্সিতে চাকরি-এই সমস্ত কিছু আমাকে চারপাশের পরিবেশ থেকে আলাদা করে রেখেছিলো। ঈর্ষা আর শ্রদ্ধা মিশ্রিত একটা বলয় তৈরী হয়েছিল আমার চারপাশে, সেটা সত্যি বলতে কি একটু উপভোগই করতাম। আজ হঠাৎ এক নিমেষে… না না… মনটাকে অন্য দিকে নিয়ে যেতে হবে. আজ এই ঘন্টায় ঘন্টায় বদলানো ব্রেকিং নিউজের জগতে মানুষের মনে কিছুই দুদিনের বেশি থেকে না। আমি বরং অন্য কথা ভাবি।
ঠিক সেই সময় ভাইব্রেট করে উঠলো ফোনটা, মেসেজ এসেছে-
“কি এতো টেন্সড হয়ে আছো? তবে বুঝতেই পারছি, চারদিকে এতো অশান্তি”
ভীষণ অবাক হয়ে গেলাম। নম্বরটা আমার একদম অচেনা
“May I know who is this?” আমি লিখলাম।
“আসলে এক একটা সময় আসে জানো, অদেখা মেঘনাদের তীর ছুতে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে। কোথা থেকে যে এতো সমস্যা আসছে বোঝা যায় না।”
“কে রে? দেখ, এই সময় না ভাট ফিলোসফি শুনতে আমার একটুও ইচ্ছে করছে না… কে তুই? সৈকত?”
স্টুপিড সৈকতটা এরকম প্রাকটিক্যাল জোক করে মাঝে মাঝে-নতুন নম্বর নাকি এটা? সঙ্গে সঙ্গে প্রায় মেসেজ ফুটে উঠলো।
“সে তুমি আমাকে সৈকত, অত্রি, ইয়াং-লিঙ্ বা সিমোন যা খুশি বলতে পারো।”
“মানে?”
“মানে নামে কি আসে যায়? তবে আমি তোমাকে তুমি বলে সম্বোধন করছি, ওটাই আমার কাছে স্বস্তিদায়ক।”
সঙ্গে সঙ্গে আমার আঙ্গুল লিখলো, “আমার মনে হয় আপনি যদি পরিচয় দিতে না চান, তবে আপনি টাই সবচেয়ে ভালো।”
আচ্ছা আমি কোনও কথা বলছি অপিরিচিতের সঙ্গে? ফোনের স্ক্রিন থেকে চোখ তুলে দেখি বাড়ির রাস্তা প্রায় এসে গেছে। টের পেলাম না’তো কখন?
বুধবার সন্ধ্যে ৭ টা ৫৫
এইমাত্র উবেরটা চিংড়িঘাটার ওভারপাস পেরিয়ে নিউটাউনের দিক নিলো। লাস্ট দুঘন্টা কাজ করতে করতে কেটে গেছে। গিয়ে দেখি যথারীতি গীতা আসেনি। বাড়ির খুব বাজে অবস্থা। সমস্ত কাজ সেরে জিনিসপত্র খুঁজে, গুছিয়ে ওপরের ফ্ল্যাটে চাবি দিয়ে বেরোতে বেরোতে সাতটা বেজে গেল। একদিকে ভালো -অন্য কিছু ভাবার সময় পাইনি। বরুণ ফোন করেছে কিনা দেখার জন্য ফোনটার দিকে তাকাতেই দেখি অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে মেসেজটা।
“বড্ড খাটুনি গেল আপনার। তবে কি জানেন শারীরিক পরিশ্রম দিয়ে গীতা না আসার সমস্যাটা না হয় সমাধান করে ফেলা যায়। আর আপনি যথেষ্ট পরিশ্রমী, যতটা ক্রিয়েটিভ ততটাই। কিন্তু পারমিতা, যেখানে অন্য লোকজন জড়িত থাকে সমস্যা সমাধানের অন্তরায় হিসেবে। সেক্ষেত্রে?”
প্রথমে একটা স্নায়ুঅবশকারী ঠান্ডা শিরশিরানি নেমে গেলো শিরদাঁড়া দিয়ে। নিজের অজান্তে শিউরে উঠে সামনে তাকালাম। রেয়ার ভিউ আয়নায় উবার চালকের ভাবলেশহীন মুখের একটা অংশ-তীব্র গতিতে ছুটে চলা ট্যাক্সির দুদিকে নিউটউন, আলো আঁধারি মাখানো।
কে জানে আজ গীতা আসেনি? শুধু বরুণকে টেক্সট করেছিলাম দেরি হয়ে যেতে পারে ভেবে।…
“কে আপনি? কি চান? Are you stalking me? How did you know about Geeta? Who’s this?”
আমার আঙ্গুল চলছে দ্রুত গতিতে।
“উত্তেজনার সময় ইংরেজি ব্যবহার করা, ব্যাপারটা বড্ডো ক্লিশে হয়ে গেছে না? তবে কি জানেন পারমিতা, আজকাল না আমরা বড্ডো ভাবি, অতিরিক্ত পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ, যে কোনও ঘটনাকে কেটে ছিঁড়েখুঁড়ে বারোটা বাজিয়ে দিই…অথবা দেখবেন একদম ভাবনাহীন করে ফেলি মগজকে, তারপর এমন কিছু করি বা বলি যেটার তিনশ কোটি বিশ্লেষণ হয়.”
“কি বলতে চাইছেন আপনি?”
“তেমন কিছু নয়, খুব না ভেবে আসুন বরং একটু কথা বলি?”
বাড়ি পৌঁছতে এখনও মিনিট কুড়ি বাকি–
“বলুন”– লিখলাম আমি।
“আপনার এখন বিরাট চিন্তা বাবা আর তার পালমোনোলজিস্ট।”
আমার আর অবাক হবার ক্ষমতা নেই…
“পারমিতা আপনি একজন অত্যন্ত প্রিন্সিপলড মানুষ। যেখানে আপনি টাকা খরচ করছেন সেখানে পরিষেবার একটা নির্দিষ্ট মান থাকবে না কেন, সেটা আপনার কাছে একদম অযৌক্তিক তাই তো? কিন্তু আপনি কোনও ভাবেই পালমোনোলজিস্ট এর সঙ্গে কন্টাক্ট করতে পারছেন না..”
“না!”
“শুনুন পালমোনোলজিস্ট ডক্টর কাঞ্জিলাল কাল সকাল সাড়ে নটায় ওঁর ঘরে থাকবেন। আপনি যেভাবে হোক ওখানে ওই সময় পৌঁছে যাবেন এবং ওঁর সঙ্গে কথা বলবেন”
আবার সেই অবশ ভাবটা ফিরে আসছে। কে এ? কি করে বলছে?
“কোনও প্রতিবাদ করার আগে পুরোটা পড়ুন আপনি কি বলবেন।
‘ডক্টর কাঞ্জিলাল আপনার খুব প্রশংসা শুনেছি আমার বন্ধু সেবন্তী মুখার্জির কাছ থেকে।ওর বাবা ডক্টর মুখার্জী কে বাঁচানোটা ও একটা আপনার করা মিরাকেল বলে। ও বারবার করে আপনার সঙ্গে কথা বলতে বলছে। আপনার সঙ্গে আমার কথা বলাটা ভীষণ জরুরি। আমার বাবা আজ তিনদিন ধরে এখানে এডমিটেড কিন্তু অবস্থার কোনও উন্নতি নেই। একমাত্র আপনিই ওনাকে বাঁচাতে পারেন।”
“কেন বলবো আমি? তিনদিন ধরে পা পর্যন্ত দেননি উনি ওয়ার্ডে। ওঁর রেসপনসিবিলিটি বাবাকে দেখে আমাকে জানানো। ওনাকে তেল মারবো আমি?”
রাগের চোটে ভুলভাল টাইপ করতে শুরু করলাম।
“পারমিতা আপনার বাবার খুব তাড়াতাড়ি Invasive ventilation procedure করা দরকার। শুধু অক্সিজেন বা রেগুলার মেডিসিনে কোনও কাজ হবে না। আর এই প্রসিডিউরে কাঞ্জিলালের মতো সেফ হাত কলকাতায় আর প্রায় কারোর নেই। এখন সিদ্ধান্তটা আপনার,এই মুহূর্তে আপনার কাছে কি জরুরি।”
কিরকম একটা গাঢ় শ্বাসরোধকারী নীরবতা নেমে এলো চারপাশে। বুঝতে পারলাম যুক্তিতর্ক সব কিছু অপ্রাসঙ্গিক এখন।
শুক্রবার দুপুর একটা
একটা কফি আর দুটো ইডলি নিয়ে বসে গোগ্রাসে খাচ্ছি। আসলে লাস্ট কি খেয়েছি ভালো করে মনে করে উঠতে পারছি না। প্রায় এক ঘন্টা আগে প্রসিডিওরটা শেষ হল, আজ আর কাল অবসারভেশনে রাখবে। তবে বাবার অবস্থা অনেকটাই বিপদমুক্ত, অনেকটা স্বাভাবিক। গতকাল সকালে ডক্টর কাঞ্জিলালের সঙ্গে দেখা হবার পর সবকিছু ঠিক মতো হতে শুরু করলো। আজ সকালে ডক্টর কাঞ্জিলালের নেতৃত্বে তিনজন ডাক্তারের টিম পেশাদারি হাতে প্রসিডিওরটা করে ফেললেন।
“থ্যাংক ইউ সো মাচ ডক্টর কাঞ্জিলাল” বললাম আমি, স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে।
“উই কুড ফিনিশ হোয়াট উই ইন্টেনডেড। উনি এখন স্টেবল। আপনার সঙ্গে বিকেলে কথা হবে।”
বাবাকে ICU-তে দেবার পর আমি নীচে নেমে এলাম। নীচে বিরাট ক্যাফেটেরিয়া, পাশ দিয়ে যাবার সময় ভেতর থেকে দোসা আর কফির ভেসে আসা সুগন্ধে মনে হল কি প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। বরুণ বেরিয়ে গেছে প্রায় আধ ঘন্টা আগে। আনমনে সেলফোনটাতে হাত পরতে মেসেজ টা চোখে পরলো-
“আশা করি একটু চিন্তামুক্ত হলেন। কিন্তু আর এক দিকে যে সমস্যার মেঘটা যে ঘনিয়ে এসেছে?” মেসেজটা এসেছে, আধঘন্টা আগে।
সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় মেসেজটা খুললাম-সায়নীর।
“হাউ ডিড মেসো’স সার্জারি গো? প্রেয়িং ফর হিস্ স্পীডি রিকভারি। উইল গো ভিজিট হিঁম। সব ভালো করে হয়ে গেলে, কল করিস। ভীষণ একটা ঘোঁট পাকাচ্ছে সম্পূর্ণাদি প্রদীপ্ত এরা মিলে। এই উইকলি মিটিঙে কিছু একটা হবে। অভিরূপদা ইস লুকিং রিয়েলি টেন্সড। দেয়ার সুড বি সামথিং আনপ্রেডিক্ট্যাবল।”
পড়েই আমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত গরম হলকার মতো স্রোত বয়ে গেলো। সম্পূর্ণা দিতো না হয় ঐরকম পরশ্রীকাতর, স্বার্থপর,তাও উনি একজন অনেকদিনের কর্মী এই সংস্থায়। কিন্তু প্রদীপ্ত? মিলি? কতদিন ধরে কাজ করছে এরা? আজ অব্দি কি করে দেখিয়েছে? আমি জানি অভিরুপদা যিনি সবসময় একটা গাম্ভীর্যের আড়ালে থাকেন, যার মুখে একটু সন্তুষ্টি ফোটানো অত্যন্ত পরিশ্রমের কাজ, তার সঙ্গেও যথেষ্ট তর্ক বিতর্ক করতে পারি আমি-সবাই আমাকে খেপায় অভিরুপদার ‘ব্লু আইড গার্ল’ বলে। আমার জেদী, একগুঁয়ে, তার্কিক স্বভাব সত্ত্বেও সেটা কিন্তু আমি অর্জন করেছি আমার কাজ দিয়ে-আজ সাত এত বছর বাদে আমার এতদিনের অধ্যাবসায়, নিষ্ঠা সব বৃথা হয়ে গেল? আর বুঝি চোখের জল আটকাতে পারছি না…
ফোনটা তখনই ভাইব্রেট করে উঠলো।
“পারমিতা সম্মুখযুদ্ধ হবার যখন উপক্রম হচ্ছে, আর শত্রূপক্ষ জানে আপনি কি ভাবে রিয়্যাক্ট করতে পারেন, মানে আপনি যেহেতু একজন ট্রান্সপারেন্ট মানুষ, আপনি কি করতে পারেন বলুন তো?”
“কি?”
“বি টোটালি আনপ্রেডিক্টেবল”
“মানে?”
শত্রুপক্ষ যদি আন্দাজই করতে না পারে, আপনি কিভাবে রিয়াক্ট করবেন, ওদের শানানো অস্ত্র ওদের স্ট্রাটেজি সব ভোঁতা আর ডিল্যুটেড হয়ে যাবে। প্রেডিক্টেবল মানুষ সম্পূর্ণ আনপ্রেডিক্টবল হয়ে গেলে সেটা বুঝতেই অনেক সময় পেরিয়ে যাবে। শুনুন…”
শুক্রবার বিকেল ৩.৩৫
সায়নী টেক্সট করেছে মিটিং শুরু হয়েছে দশ মিনিট আগে। দোতলার করিডোর দিয়ে বড়ো বড়ো পা ফেলে হাঁটছি আমি। এড্রিনালিন ছুটছে যেন শরীরের প্রত্যেকটা অংশে। বেশ, এটাও চেষ্টা করে দেখি মিস্টার বা মিস মেঘনাদ। এখন টেক্সটের আড়ালের এটাই ওই মানুষটার নামকরণ। কনফারেন্স রুমের ডাবল গ্লাসডোরটা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে, প্রায় শব্দহীন ঘরটাতে নেমে এলো একটা অপ্রাকৃত নিস্তব্ধতা। টেবিলের চারপাশে বসা বারোজন মানুষের চোখ আমার ওপর –
বিস্ময় ছাড়াও অবিশ্বাসই মূলতঃ প্রায় সবার চোখে। সায়নী ছাড়া কেউ বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারেনি আমি এখানে আসবো।
“হ্যালো অভিরুপদা বাবার সার্জারিটা সকালে হয়ে গেল, তাই ভাবলাম উইকলি মিটিংটা এটলিস্ট এটেন্ড করি”
ততক্ষণে সামনের হোয়াইট স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে পাওয়ার পয়েন্টর প্রথম স্লাইড। আজকের মিটিংয়ের এজেন্ডার প্রথম লাইন বুলেট পয়েন্টে
“How our image as the employees of ‘Pioneer Advertising and Marketing Limited’, should be reflected on Social Media “
কাগজের খসখসানি আর এসির মৃদু যান্ত্রিক ভোঁতা আওয়াজ ছাড়া সবকিছু চুপ, নিস্তব্ধতা ভেঙে নিজের আওয়াজটা শুনতে পেলাম।
“Assuming এই প্রথম বিষয়টা আমার একটা কাজের ওপর ভিত্তি করেই বলা, তাই প্রথমেই আমি বলি?”
অভিরূপদা কিছু বলার জন্য মুখ খোলার আগেই আগেই আমি বলতে শুরু করলাম।
“প্রায় এক সপ্তাহ আগে পোস্ট হয়েছিল ভিডিয়োটা ফেসবুকে, এক সপ্তাহের মধ্যে ভাইরাল হয়ে গেছে। আমি জানি এর মধ্যে অনেক কথা হয়েছে যার ফলশ্রুতিতে আজকের এই এজেন্ডা। আমি আমার আচরণের কোনও কৈফিয়ত দেব না, শুধু কয়েকটা কথা বলবো। এতো বছরে এই কোম্পানি আমার পায়ের তলার মাটিই দেয়নি, PML আক্ষরিক অর্থে আমার পরিবারের মতো। আমি মনে করি যে এই কোম্পানি আমার বুদ্ধি, ক্রিয়েটিভিটিকে বিকশিত হবার সুযোগ দিয়েছে, পালন করে চলেছে। আর এই টিমের প্রত্যেকের কাছ থেকে আমি সহযোগিতা, উৎসাহ বা এক অর্থে প্রশ্রয় পেয়ে এসেছি I am one of those lucky prople, every morning who looks forward to go to work”। কয়েক সেকেন্ড সময় নিলাম- “একটা ভিডিয়ো দিয়ে আমার নিজের বা PAML র বিন্দুমাত্র সম্মানহানি করার কোনও উদ্দেশ্য আমার ছিল না। ওটা একটা অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের প্রাইভেট পার্টি; সম্পূর্ণ মজা করে তোলা একটা ভিডিয়ো। আর আমার সুদূরতম কল্পনার বাইরে ভিডিয়োটা বাইরে পোস্ট হতে পারে। আমি খুব খুব দুঃখিত যদি এই ওটার জন্য আমাদের কোম্পানির ইমেজের কোনও ক্ষতি হয়ে থাকে।”
এর পরের অংশটা কেমন একটা সেপিয়া রঙের মোছা মোছা সিনেমা দেখছি বলে মনে হচ্ছিলো। আমি সিনেমার একটা অংশ আবার চারপাশের মানুষের রিঅ্যাকশনও দেখতে পাচ্ছি। আমার কথাগুলো শেষ হবার পর ঘরের নৈঃশব্দ্য যেন মনে হচ্ছিলো ছুরি দিয়ে কাটা যায়। তারপর অনেকগুলো মানুষ একসঙ্গে শ্বাস ছাড়লো। অভিরূপদার গলা শুনতে পেলাম সবার আগে,
“Ok since Paramita already clarified and apologized, I think we should move on”
উনি সৌরভকে এজেন্ডার পরের অংশে চললে যেতে বললেন। দেখতে পাচ্ছি টেবিলের দুই কোনায় বসে সম্পূর্ণাদি আর প্রদীপ্তদার মধ্যে চোখে চোখে বার্তা বিনিময়। সায়নীর মুখ তখন দৃশ্যত হাঁ। পুরো মুখটাই একটা বিস্ময়বোধক চিহ্নে পরিণত হয়েছে। পূর্ব পরিকল্পনা মতো অথবা বলা যায় মিস্টার/মিস মেঘনাদের নির্দেশানুযায়ী আমি উঠে কিছুটা ঘুরে গিয়ে অভিরূপদার কানের কাছে মুখটা নিয়ে বললাম “অভিরূপদা, I think I have to go back to hospital” ব্যস্ত ভঙ্গীতে অভিরূপদা বলে উঠলো “হ্যাঁ হ্যাঁ তুমি বেরিয়ে পরো।”
শুক্রবার বিকেল ৫টা
বেলগাছিয়া পর্যন্ত মেট্রোতেই যাবো ভেবেছিলাম, কিন্তু এত ক্লান্তি, একটা উবের ডেকে নিলাম। ট্যাক্সিতে বসে ফোনটা নিয়ে নাড়াচাড়া করছি অন্যমনস্কভাবে-কোনও নতুন মেসেজ নেই, হঠাৎ করে সিরি র দিকে চোখ পরলো আমার ফোনে। ইন্টারেক্টিভ ভার্চুয়াল- অ্যাসিস্ট্যান্ট, কত প্রশ্নের উত্তর যে আছে ওর কাছে; কতভাবেই যে আমরা নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি টেকনোলজির ওপর…
সিরিকে জিজ্ঞাসা করলাম
“Siri what is the success rate of invasive ventilation procedure”?
সিরি উত্তর দিতে শুরু করলো-শুনতে শুনতে অন্যমনস্ক হয়ে গেলাম। বরুনের প্রিয় পাস টাইম হল সিরি কে অদ্ভুত সব প্রশ্ন করা।
“সিরি স্প্রিং কবে আসবে?”
“সিরি ইলিশমাছের ডিম কোন বাজারে পাওয়া যাবে?”
“সিরি তুমি ভ্যাম্পায়ার দেখেছো?”
মাঝে মাঝে এমন করে বলার কথা নয়। আমি বলি “সিরিকে তুমি এতো জ্বালাও, দেখো সিরি একদিন ওই ফোন থেকে দুটো হাত বার করে তোমার গলা টিপে দেবে”…
এই ছোট ছোট প্রত্যহিকতাতেই কি ভরা থাকে জীবনের অক্সিজেন? নয়তো শরীরের এতো ক্লান্তি কথা থেকে আসে?
ট্যাক্সিটা শাশুড়ীমার বাড়ির গলির মোড়ে ছেড়ে দিলাম। হাঁটতে হাঁটতে দেখি দুটো মিসড কল, দুটোই মায়ের। আমাকে বোধহয় মনে পড়েছে এতদিনে। মায়ের বাড়ির দরজা পর্যন্ত হাঁটতে গিয়ে মনে হল যেন সমস্ত শরীর বিশেষত পা দুটো ভেঙে আসছে। এতক্ষণ ধরে শরীর জুড়ে ছুটে বেড়ানো এড্রিনালিন স্তিমিত হয়ে আসছে। একটা প্রচন্ড স্বভাববিরুদ্ধ কাজের পর কিরকম ভেতর নিংড়ানো ক্লান্তি; একটা গভীর অবসাদ-ছায়া চাইছে শরীর, মন দুটোই। কলিংবেল বাজানোর আগেই দরজা খুলে গেলো। মা’র হাতে চিরুনি, খোলা চুল, শাড়ি পরে তৈরী হচ্ছেন বাইরে যাবার জন্য। “কি রে মিতা আমি ফোন করছিলাম, বেয়াইমশাইকে দেখতে যাবার জন্য”।
আমি চুপ – আমার গলায় মনে হচ্ছে শুকনো ধুলোতে ভরে গেছে গলা, কথা বেরোচ্ছে না।
মা এসে হাত ধরতেই বেরিয়ে এলো সব। এতো কান্না জমে ছিল ভেতরে? বাবাকে নিয়ে এত টানাপোড়েন, বন্ধুর বিবেচনাহীন সিদ্ধান্ত, চেনা মানুষদের রাতারাতি বদলে যাওয়া,সারা পৃথিবী লোকের সঙ্গে এক অন্তহীন যুদ্ধ, জীবনে প্রথম নিজের অস্তিত্বের বিপরীতে হেঁটে গিয়ে পরিস্থিতি অনুযায়ী দাবার চাল দেওয়া, সামনের মানুষকে প্রতিপক্ষ হিসাবে বুঝতে শেখা – দুদিনে যেন কত হাজার মাইল পথ হেঁটে এসেছি।
কিন্তু মুখ থেকে শুধু একটাই কথা বেরোলো, “অব অল পিপল, তুমি ফোন তুললে না আমার”?
মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে মা শুধু বললো, “আমি সরি রে মিতা। নিজেকে যতটা স্ট্রং ভাবতাম ততটা বোধহয় নই। দিদির বাড়ি, রেখার বাড়ি, মিসেস চ্যাটার্জী। ওফ এতো কথা, এতো কৌতুহল-আমি আর নিতে পারছিলাম না। ফোন তখন থেকেই সুইচ অফ করে রেখেছি”।
আমি একটু শান্ত হলে মা বললো, “চল স্নান করে একটু খেয়ে নে।”
এক ঘন্টা বাদে মা’র বিছানায় শুয়ে আছি। মা আমার পাশে আধশোয়া, নিজের মনেই বললো, “কোন পরিস্থিতে কে যে কি আচরণ করে বোঝা খুব কঠিন রে, মানুষ নিজেকে মোটেই চেনে না।”
আমার মন এখন ছবিতে দেখা পান্না- কালো রঙা দীঘির জলের মতো নিঃশব্দ। ঘুম আসছে। শরীরের প্রতিটা গ্রন্থিতে ঘুমের রিমঝিম। একবার মনে হল মাকে বলি মেঘনাদের কথাটা, কিন্তু বড্ডো ঘুম আসছে। সন্ধ্যেবেলা হসপিটাল যাবার পথে ট্যাক্সিতে বসে বললাম বরুনের কথাটা। মা শুধু বললো, “বরুণ তো খুব যুক্তিবাদী মিতা, ইমোশন তো সেভাবে ক্লাউডেড করে না ওর সিদ্ধান্তকে কখনো।”
আর আশ্চর্জনকভাবে আমি গিলে ফেললাম আমার উদ্গত প্রশ্নট – মা ও আমাকে একবার কিছু জিজ্ঞাসাও করেনি, শুনতে চাই নি কিচ্ছু। ও যদি রাগও করত, আমার একটা এক্সপ্লানেশন দেবার অধিকারও তো আছে?
প্রথমবার, এই প্রথমবার কে যেন দুহাতে চেপে ধরলো শব্দযন্ত্র। কিছু বললাম না আমি।
“চিন্তা করিস না, দরকার হলে আমি কথা বলবো বরুনের সঙ্গে” মা বললো।
তাও চুপ আমি। রাস্তার আলোয় ট্যাক্সির ভেতরটা একবার আলো একবার অন্ধকার। শুধু ড্যাশবোর্ডের ওপর জ্বলজ্বল করছে ড্রাইভারের ফোনের মধ্যেকার ম্যাপ। ওই ম্যাপে একটা সঞ্চারমান বিন্দুর মধ্যে আছি মা আর আমি। কিন্তু আদৌ আছি কি?
শুক্রবার রাত্রি ১২টা দশ
সিগারেট ধরিয়ে এসে বসলাম বারান্দায়। বরুণ ঘুমিয়ে পরেছে। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ভেতর থেকে, অংকুরিত একটা নয়, অনেকগুলো চিন্তা একে অপরকে ঠেলে কেমনভাবে যেন বেরিয়ে আসছে ভেতর থেকে। আচ্ছা, শারীরিক বোঝাপড়া হয়ে গেলে কি সব ঠিক হয়ে যায়? নাকি থেকে যায় কোথাও বীজগুলো? না বলা অসন্তোষ ক্ষোভ। আমাদের মধ্যে এরকম অশান্তি প্রথম-তাই এই অভিজ্ঞতা আমার কাছে নতুন। বরুণের সঙ্গে ওর মার কথা হয়েছে, তাই ও প্রস্তুত ছিল। বাড়ির দরজায় পা দিয়েই বিরিয়ানির সুগন্ধে ম ম করছে চারদিক, ঘরে ঢুকতেই এগিয়ে এসে হাত ধরলো সে -তারপর সব যেরকম হবার কথা। ও জানতো আমি রাগ করে থাকতে পারবো না; ওর চেয়ে ভালো চেনে আমাকে কে? এলোমেলো চিন্তার মাঝখানে একটা কথা আমার বিদ্যুৎচমকের মতো মনে হল…অত ঘনিষ্ঠ মুহূর্তেও আমি জিজ্ঞাসা করতে চেয়েছি বরুণকে, কেন ও শুনতে চায়নি আমার কথা? কেন এই নৈঃশব্দ? কিন্তু কে যেন ভেতর থেকে খুব চেনা গলায় একটানা বলে চললো “এখন নয়, এটা সময় নয় কিছু বলবার। কে বলছিলো?”
মেঘে ঢাকা অন্ধকার আদিগন্ত আকাশকে আধাআধি ভাগ করে বিদ্যুৎ চমকে উঠলো -আর তার সঙ্গে আমার ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো। নতুন মেসেজ এলো। চমকালাম না, জানতাম অনিবার্য আসবে এই মেসেজ।
“আজকের দিনটা তো শেষ, কিন্তু কাল পারমিতা?
এই হাউসিংয়ের কর্তাদের সঙ্গে আপনাদের যে প্রব্লেম চলছে, তারপর বাবার হেলথ ইন্সুরেন্স – রোজই তো কিছু না কিছু। সমস্যার কি কিছু শেষ আছে?”
চেয়ার থেকে উঠে বারান্দার রেলিং এর কাছে দাঁড়ালাম। বৃষ্টি শুরু হবে, তার আগে সমস্ত কিছু থেকে একটা তীব্র বনজ গন্ধ উঠে আসছে। চোখ ঝলসে একটা বিদ্যুৎ রেখা এফোঁড় ওফোঁড় করে দিলো আকাশ -পল অনুপল কাটতে লাগলো।
কে এই মেঘনাদ? কি দেখতে পায় সে? কি শোনে?
আজ ইন্টারনেটে যে কোনও সার্চ ইঞ্জিনে বাড়ির জন্য নতুন ফার্নিচার এর সার্চ করলে অথবা কাছাকাছি কোথায় ভালো মেডিটেরেনিয়ান কুইসিন আছে সার্চ করলে কিছুক্ষনের মধ্যে সোশাল মিডিয়া সাইটে, রিটেল কোম্পানি গুলোর ফার্নিচার ডিভিশনের, ই-ফার্নিচার আউটলেট গুলোর অথবা যেখান থেকে বসে সার্চ করছি তার ১০ কিমির মধ্যে কি রেস্তোরাঁস এ যেতে পারি তার বিজ্ঞাপন আসতে থাকে। কোথায় আছি, কি খুঁজছি, কি দেখছি প্রত্যেক মুহূর্তে সব কিছু ট্র্যাক হচ্ছে। বাড়িতে হওযা অশান্তি, মনোমালিন্য শুনছে – স্মার্ট স্পিকার আর লেখা বা বলা প্রতিটি কনভার্সেশন- যে কোনও- এই ফোন থেকে চলে যাচ্ছে ই- ক্লাউডে। থাকছে। ছড়িয়ে যাচ্ছে -কোথায়?
নিজের অজান্তে হঠাৎ গা টা কেমন শিউরে উঠলো।
বিক্রি হয়ে যাচ্ছে আমাদের আকাঙ্খা, লোভ আর লোভের অংকুরগুলোও যেন।
দিগ্বিদিক কাটিয়ে গর্জে উঠলো আকাশ আর তারপরে চোখ ঝলসে যাওয়া বিদ্যুৎ রেখা। তার মধ্যে দিয়ে হঠাৎ যেন পারমিতা একটা শুঁড়িপথ দেখতে পেলো। ভবিষ্যতের। না তেমন দূরের তো নয়, একটা সায়েন্স ফিক্শন ডিস্টোপিয়ার মতো। অতি সূক্ষ্ম জালে মোড়া শরীর আমাদের; আমাদের চারপাশও। এক অতিকায় অক্টপাসের মতো সে জাল যেন অজস্র অদৃশ্য ইলেক্টেট্রোড দিয়ে ব্রেনের প্রত্যেকটা ইম্পালস মেপে নিচ্ছে। পড়ে নিচ্ছে মনের কথা, জেনে যাচ্ছে কি হচ্ছে আমাদের চারপাশে। আমি যেন ওই ভবিষ্যত গোলিয়াথের হাতের পুতুল। না সে ভবিষ্যৎ দূর কোথায়? তার সামনে দাঁড়িয়ে মানুষ সম্পূর্ণ নিরস্ত্র।
সেই ভবিষ্যতই আজ পিছিয়ে এসে আজকের তাকে গিনিপিগ বানাচ্ছে না তো?
কিন্তু আমাকে কেন?
কেন আমি?
আবার গর্জে উঠল আকাশ– লক্ষ লক্ষ ডেসিবেলে–
…কেন আমি নয়? আমি তো নিজেই ডেকে এনেছি।
একটা সোশ্যাল এক্সপেরিমেন্টের সবচেয়ে সুবিধা জনক ক্রীড়নক।
পারমিতা তো সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রমানিত রেবেল-যে নিজের ইমেজ টুকরো টুকরো করে ছিঁড়েছে।
তার ভিডিয়োর মিলিয়ন ছাড়ানো দর্শক।
আর তারপর থেকে শুরু হয়েছে এই খেলাটা-তাকে পথে আনার খেলা। তাকে ঝাঁকের মাছে মিশিয়ে দেবার জন্য, তাকে প্রত্যাশিত জগতের পথে ফিরিয়ে আনার জন্য। তাতে তার প্রত্যেকটা পদক্ষেপ কিভাবে সহজ হয়ে যাবে সেই সমাধান পথ দেখিয়ে দেওয়া। কে জানে মেঘনাদ আরো কত মানুষের কাছে এভাবে পৌঁছচ্ছে?
মেসেজটা যে আপনার আসবে তা আমি জানতাম।
আপনি ঠিক সময় মেসেজ করবেন, পথ দেখিয়ে দেবেন, দু দিন… তিন দিন… এক সপ্তাহ–
সমস্যায় পড়লে, অথবা সমস্যাহীন সময়েও।
শিখব আমি চাল- পাল্টা চাল, একটু একটু করে হয়ে উঠবো চালাক, বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন। তারপর আর মেসেজ আসার দরকার পরবে না। ভেতর থেকেই আসবে আপনার আওয়াজ; আমি বুঝে যাবো এই পৃথিবীতে টিকতে গেলে রং, আকার সব কিভাবে পাল্টে ফেলতে হবে, পরিস্থিতি আর মানুষের সঙ্গে।
বুঝতে শিখবো কোন ত্রিকোনমিতিটিতে দাঁড়ালে, সোশ্যাল মিডিয়াতে আমি, আমার দেখতে পাওয়া অথবা না দেখতে পাওয়া পারিপার্শ্বিকের ছবি হবে ঝলমলে নিখুঁত মনোক্রোমাটিক।
আমি এডজাস্ট করতে শিখব।
কি করব আমি এখন?
অনেক সোজা হয়ে যাবে তার পৃথিবী, সাবলীল হয়ে যাবে সব, কাজে উন্নতি হবে, সম্পর্ক মসৃন হবে-
নীচের দিকে তাকিয়ে মনে হল অনেক নীচে থেকে মাটি ডাকছে হাত বাড়িয়ে-
আবার একবার আকাশের দিকে তাকালাম্।
আকাশ ফাটিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসছে বৃষ্টিকণারা, ধারালো, তীব্র, তছনছ করা, নির্মোহ।
আমি জানি আমি কি করবো।
না ডেভিডের মতো কোনও অস্ত্র নেই আমার হাতে- এই অসম লড়াইতে।
কিন্তু কোথাও কাউকে শুরু করতে হবে…. আর নিজের সঙ্গে লড়াইটাও।
বৃষ্টির মধ্যে ফোনটাকে শূন্যে ছুড়ে দিলাম আমি, কোটি কোটি বৃষ্টিবিন্দুর সঙ্গে নীচে পড়তে থাকলো। অনেক অনেক নীচে।
Tags: অঙ্কিতা, কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায়
চমৎকার গল্প। পড়ে খুব ভালো লাগলো।