শয়তানের ফুল
লেখক: জিৎ দত্ত
শিল্পী: ইন্টারনেট
“মাপিংগুয়ারির নাম শুনেছিস?’’
সবে বিস্কুটটা শেষ করে গরম চা-টায় একটা চুমুক মেরেছি, অবিনাশদার প্রশ্নটা শুনে তাড়াতাড়ি করে গিলতে গিয়ে জিভটা গেল পুড়ে। কোনও রকমে দু’চার বার ‘‘হু হা’’ করে একটু সামলে নিয়ে বললাম, “মাপিংগুড়ি, সে আবার কী? জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, লাটাগুড়ি, নিদেনপক্ষে হামাগুড়িরও নাম শুনেছি, কিন্তু এমন জায়গার নাম তো শুনিনি। এটা কি নর্থ বেঙ্গলের কোনও জায়গা?’’
সিগারেটটা অ্যাশ ট্রেতে গুঁজে দিয়ে, ট্রে থেকে চায়ের প্লেটটা হাতে তুলে নিল অবিনাশদা। তারপর পায়ের উপর পা তুলে ব্যোমকেশি স্টাইলে বসে, চায়ে একটা চুমুক দিয়ে বলল,
—প্রথমত ওটা মাপিংগুড়ি না, মাপিংগুয়ারি, পর্তুগিজ ভাষা। আর দ্বিতীয়ত এটা কোনও জায়গা নয়, এক প্রকার জন্তু।
—জন্তু!
—হ্যাঁ, তবে একপ্রকার কিংবদন্তি জন্তু। নর্থ আমেরিকার আমাজন অববাহিকায় নাকি এর কথা শোনা যায়। যদিও এর অস্তিত্বের এখনও কোনও প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অনেকটা আমাদের হিমালয়ের ইয়েতির মতন।
—ও বাবা, তা এই জন্তু দেখতে কেমন?
—সে নিয়েও অনেক মতান্তর আছে বুঝলি। অনেকের মতে এই জন্তু দু’মিটার বা সাত ফুট অবধি লম্বা, চেহারা অনেকটা ভাল্লুকের মতো রোমশ আর মুখখানা বানর বা গরিলার মতন। অনেকে আবার দাবি করে গ্রিক মাইথোলজির ‘সাইক্লোপস’-এর মতন এর নাকি মাত্র একখানা চোখ! সব থেকে মজার কী জানিস, কিংবদন্তি মতে, এই জন্তুর নাকি ভুঁড়িতে আর একখানা দাঁতালো মুখ আছে, যা দিয়ে এ হাড় মাংস চিবিয়ে খায়। গায়ে নাকি বীভৎস গন্ধ, আর বজ্রনাদের মতন নাকি তার গর্জন। অনেক স্থানীয় রেড ইন্ডিয়ান দাবি করে, তারা নাকি এই জন্তুকে দেখেছে। এমনকী এই নিয়ে ওখানকার সাহিত্যেও অনেক লেখালিখি হয়েছে এবং সাহিত্যিকদের মধ্যেও অনেক মতপার্থক্য রয়েছে।
—ওরে বাবা। বিশাল ব্যাপার তো। তা তোমার কী মনে হয়? এমন জন্তু হতে পারে যার ভুঁড়ির মধ্যে মুখ?
—কি জানি? দেয়ার আর মেনি থিংস ইন হেভেন অ্যান্ড আর্থ হোরাশিও, ভুললে চলবে কেন? তবে বিজ্ঞানীদের মতে, এই মাপিংগুয়ারি হচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক জীব ‘মেগাথেরিয়াম’ বা দৈত্যাকার শ্লথের মতন কোন জীব।
—ও, বেশ ইন্টারেস্টিং কিন্তু। তা তুমি কি এখন এই মাপিংগুয়ারি নিয়ে রিসার্চ করছ নাকি?
—ধুর, এসব আমার টপিকই নয়। আমার রিসার্চ টপিক অন্য, তবে তার সঙ্গে এই মাপিংগুয়ারির একটা হালকা সম্পর্ক আছে বলে এত কথা বললাম তোকে।
এখানে বলে রাখি অবিনাশদা আমার নিজের দাদা নয়, কোন রকমের তুতো দাদাও হয় না। ওর সঙ্গে আমার পরিচয় স্কুল লাইফ থেকে। স্কুলে ও আমাদের দু’ক্লাস সিনিয়র ছিল। ভালো ছাত্র ছিল বলে মাঝেমাঝে ওর কাছে হেল্পের জন্য যেতাম। সেখান থেকেই দু’জনের মধ্যে একটা দাদা-ভাই সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা স্কুল ছাড়ার এত বছর পরেও অটুট আছে। বা বলা ভালো আরও বেড়েছে। বর্তমানে ও একটা ইউনিভার্সিটিতে বটানির প্রফেসর।
আমি একটা বেসরকারি অফিসে কাজ করি। মাঝে মধ্যে সময় পেলে ওর বাড়িতে আসি ওর সঙ্গে আড্ডা দিতে। ওর বাড়িতে একটা ছোট্ট বাগান আছে যেখানে ও ওর রিসার্চের গাছপালা চাষ করে। সেই বাগানে হরেক রকমের দেশি ফুলগাছের সঙ্গে আছে নানান জাতের বিলিতি ফুলের গাছ। এদের এক এক জনের রং, রূপ, গন্ধ এক এক রকম। কারও কারও আবার ভেষজ গুণাগুণও আছে। অবিনাশদার কাছ থেকে এই সব গাছ সম্বন্ধে জানতে, তাদের গুণাগুণ শুনতে খুব ভালো লাগে আমার। ওর মুখেই শুনেছিলাম যে পৃথিবীতে শুধু মাত্র গাঁদাফুলেরই নাকি ছাপান্ন রকমের প্রজাতি পাওয়া যায়।
চায়ের কাপটাতে শেষ চুমুক মেরে, কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখে বললাম, “তা তোমার রিসার্চের সঙ্গে এই জন্তুর কী যোগাযোগ শুনি?’’
—তোর মনে আছে মাস দুয়েক আগে আমি বেলজিয়াম গেছিলাম একটা কনফারেন্সে যোগ দিতে? ওখানে আমার পরিচয় হয় এক আমেরিকান বিজ্ঞানির সঙ্গে, নাম গ্লেন শেফার্ড। ভদ্রলোক একজন এথনো বায়োলজিস্ট। এথনো বায়োলজি ব্যাপারটা কী জানিস তো, বিভিন্ন প্রাণী বা বস্তুকে বিভিন্ন সম্প্রদায় কীভাবে দেখে বা ট্রিট করে, তার উপর স্টাডি। যেমন ধর, আমাদের হিন্দু ধর্মে সাপকে নাগদেবতা হিসাবে পুজো করা হয়, আবার খ্রিস্টান ধর্মমতে সাপ হল শয়তানের রূপ। আবার ধর প্রাচীন মিশরীয়রা কুমির বা বাঁদর এদের দেবতা রূপে পুজো করত, আবার কেনিয়া বা আফ্রিকার উপজাতিদের কাছে এরা সুখাদ্য রূপে পরিচিত, এইরকম।
তা এই শেফার্ড ভদ্রলোক পেরুতে, আমাজনের পশ্চিমে এক উপজাতির উপর রিসার্চ করছিলেন, সেখানে তিনি প্রথম এই মাপিংগুয়ারির কথা শোনেন। এর পরে উনি পশ্চিম আমাজনেরই আর এক বিচ্ছিন্ন উপজাতি কোরুবো-দের নিয়ে রিসার্চ করার সময় আবার মাপিংগুয়ারির খবর পান।
ঘটনাটা ঘটেছিল এমন, উনি কোরুবো-দের গ্রামে যাওয়ার ক’দিন আগেই ওখানে জঙ্গলে কাঠ কাটতে যাওয়া কজন কাঠুরে হঠাৎ অন্তর্হিত হয়ে যায়। তার মোটামুটি আট দশদিন পরেই নাকি মানুষরা জঙ্গলের ভিতর থেকে মাপিংগুয়ারিদের সেই বজ্রনাদি গর্জন শুনতে পায়। স্থানীয় মানুষদের ধারণা হয় ওই লোকগুলোকে মাপিংগুয়ারিতেই নিয়ে গেছে।
পরদিন কিছু লোক জড়ো হয়ে ওই মানুষগুলোর ও মাপিংগুয়ারির সন্ধানে একটা অভিযান চালায়। আমাদের শেফার্ডও সেই অভিযানে সামিল হন। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় শেফার্ড দেখতে পায় জঙ্গলের এক ধারে কয়েক মাইল জুড়ে লাইন দিয়ে সারি সারি এক ধরনের জংলা ফুল ফুটে আছে। ফুলগুলো মেটে মেটে রঙের, তার উপরে হলুদ ছিটে। ফুলগুলো থেকে খুব সুন্দর নাকি একটা গন্ধ আসছিল। স্থানীয় লোকেরা শেফার্ডকে বলে কাপড় দিয়ে নাকমুখ ঢেকে নিতে। কারণ জিজ্ঞেস করতে লোকগুলো বলে ওগুলো নাকি ‘স্যাটানাস ফ্লোরেস’ বা শয়তানের ফুল। কিন্তু কেন ওগুলোকে ‘স্যাটানাস ফ্লোরেস’ বলা হচ্ছে জিজ্ঞেস করাতে লোকগুলো বলে, তারা সে সব জানে না, তবে তাদের পূর্বপুরুষেরা জানত। তারাই বলে গেছে, এই ফুলগুলো থেকে দূরে থাকতে, আর এর গন্ধ নাকে না নিতে।
শেফার্ড নিজের ক্যামেরা দিয়ে ফুলগুলোর কয়েকটা ছবি তুলে নেয়, তারপর সেই ছবি পাঠায় নিজের পরিচিত বিজ্ঞানী মহলে। কিন্তু কারও কাছ থেকেই তেমন ভাবে কোনও সাড়া পায় না। কেউ কেউ আবার বলে ছবিগুলো নাকি এডিট করা, বাস্তবে এমন কোন ফুলই নাকি নেই। শেফার্ড মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে ফুলগুলোর কথা লোককে বলা বন্ধ করে দেয়।
বেলজিয়ামে শেফার্ড আমায় সেই ফুলগুলোর ছবি দেখায়। সত্যি অপূর্ব দেখতে ফুলগুলো। শেফার্ড আমাকে আরও বলে, ও নাকি সেই গ্রামের একটা ছোকরাকে খাবারের লোভ দেখিয়ে ওই ফুলগাছের কতগুলো বীজও সংগ্রহ করেছে। আমি বই ঘেঁটে দেখেছি বুঝলি, ওই ফুলের ব্যাপারে কোথাও কিছু পাইনি। আমি শেফার্ডের কাছে রিসার্চের জন্য ওই ফুলের একটা বীজ চাওয়ায় ও সাগ্রহে বলেছিল ও ব্রাজিলে ফিরে আমায় পাঠিয়ে দেবে।
আজ সকালে ওর পার্সেল এসেছে, তাতে দুটো বীজ আর এক প্লাস্টিক আমাজনের মাটি পাঠিয়েছে শেফার্ড।
আমি বললাম, “মাটি কেন?’’
ঠান্ডা হয়ে যাওয়া চা টা এক চুমুকে শেষ করে অবিনাশদা বলল, “শেফার্ডের মতে ওই মাটি ছাড়া নাকি এ গাছ অন্য মাটিতে হবে না।’’
আমি বললাম, “তা সেই বীজটা কি আমি একবার দেখতে পারি?’’
অবিনাশদা বলল, “হ্যাঁ নিশ্চয়ই, তুই এসে ভালোই করেছিস। আমি এখন ওই বীজটা মাটিতে বসাব, তুই আমাকে এ ব্যাপারে একটু হেল্প করবি।’’
অবিনাশদা উঠে গিয়ে ঘরের এক কোণের একটা শেল্ফ খুলে একটা ছোট্ট ওষুধের খাম নিয়ে এলো। খামটা খুলে ও বীজদুটো টেবিলের উপর ছড়িয়ে দিল। বীজ দুটো দেখতে অনেকটা আমন্ড বাদামের মতন, তবে রঙটা কালচে বাদামি আর আকারেও অনেক ছোট। অবিনাশদা বলল, মাটিটা ও বাগানে রেখে এসেছে।
আমরা দু’জনে বাগানে গেলাম। অবিনাশদা একটা ফুলের টব নিয়ে তাতে অল্প কিছুটা মাটি ভরল, তারপর কিছুটা জল দিল, তার উপরে আবার কিছুটা মাটি দিল। এই ভাবে দু’তিন ধাপ মাটি দেওয়ার পর, ও একটা বীজ মাটিতে দিল। তারপর ভালো করে জল দিয়ে ওপরে কিছুটা শুকনো মাটি ছড়িয়ে দিলো।
একইভাবে অন্য একটা টবে আর একটা বীজকে রোপণ করে, হাত ধুয়ে উঠে বলল, “চল, আজকের কাজ শেষ। এবার অপেক্ষার পালা, যতদিন না গাছ বেরিয়ে ফুল ধরছে।’’
“আর মাপিংগুয়ারি?” বললাম আমি।
অবিনাশদা আমার পিঠে একটা চাপড় মেরে বলল, “আরে রাখ তোর মাপিংগুড়ি, ঘরে চল, ওদিকে রামহরিদা ইজ ওয়েটিং উইথ আলুর দম অ্যান্ড কচুরি।’’
(২)
এরপর প্রায় মাসখানেক কেটে গেছে। মাঝে কিছুদিনের জন্য আমি ছিলামও না। কাজের সূত্রে চেন্নাই যেতে হয়েছিল। ফিরেছি ক’দিন আগেই। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই ক’দিন অবিনাশদার সঙ্গে আর যোগাযোগ করা হয়নি।
রবিবার সকালবেলা ফ্রেশ হবে বাজারের জন্য বের হতে যাব, এমন সময় অবিনাশদার ফোনটা এল।
—হ্যালো, পুলু?
—হ্যাঁ বলো অবিনাশদা, গুড মর্নিং।
—মর্নিং। তোর মনে আছে তুই আর আমি মিলে সেদিন আমার বাড়িতে দুটো ফুলগাছ বসিয়েছিলাম?
—হ্যাঁ হ্যাঁ, সেই ব্রাজিলের আমাজনের সেই শয়তান গাছ না কী যেন।
—হ্যাঁ, ঠিকই, মনে আছে তা হলে। তা সেই গাছে ফুল ধরেছে বুঝলি। তুই আমায় হেল্প করেছিলি, তাই ভাবলাম তোকেও জানাই ওটার ব্যাপারে। আশ্চর্য সুন্দর দেখতে বুঝলি ফুলগুলো। তা তুই কি আজ ফ্রি আছিস? পারলে একবার দেখে যা।
—এ বেলা তো হবে না, বিকেলের দিকে যাব। প্রবলেম নেই তো?
—আরে না না, প্রবলেম আবার কীসের? তুই আয়, তাহলে বিকেলে দেখা হচ্ছে। বাই।
অবিনাশদা ফোনটা রেখে দিল। ওর সঙ্গে কথা বলার পর থেকে নিজেরও ভেতরে ভেতরে একটা উত্তেজনা হচ্ছিল জিনিসটাকে দেখার। একে রহস্যময় আমাজন, তার আবার রহস্যময় জন্তু, সেই রহস্যময় জন্তুর চারণভূমিতে আবার নাম না জানা ফুল, মানে যাকে বলে একেবারে সাসপেন্সের ছড়াছড়ি।
বিকেলে একটা রিকশা নিয়ে অবিনাশদার বাড়িতে গেলাম। দু’বার বেল বাজাতেই অবিনাশদার বাড়ির কাজের লোক কাম অ্যাসিস্ট্যান্ট রামহরিদা পেছনের বাগান থেকে চিৎকার করে বলল, “কে পুলু দাদাবাবু এলে নাকি? তুমি বাগানে চলে এসো, আমরা এখানে আছি। রামহরিদা অনেকদিনের লোক, জাতে বৈষ্ণব, সাত্ত্বিক,সহজ সরল মানুষ, গলায় তুলসির মালা পরে। আমাকেও সেই ছোটবেলা থেকে চেনে। অবিনাশদার বাবা-মা মারা যাওয়ার পর থেকে ওই এখন অবিনাশদার একমাত্র অভিভাবক।
আমি রামহরিদার কথামতো ওদের পাঁচিলের পাশ দিয়ে সোজা বাগানে চলে এলাম। গিয়ে দেখি অবিনাশদা বাগানের এক কোণে দাঁড়িয়ে এই ফুলটা, ওই পাতাটা এসব টেনে গভীর মনোযোগ সহকারে সেগুলো দেখছে, আর একটা নোটবুকে কীসব টুকছে। আর পাশেই দাঁড়িয়ে আছে রামহরিদা, ওর ফাইফরমাশ খাটছে।
আমি যেতেই “আরে পুলু, এদিকে আয়।” বলে অবিনাশদা আমাকে নিজের কাছে ডাকল। ওর কাছে যেতেই একটা বোঁটকা ঘেমো গন্ধ আমার নাকে এসে ঠেকল। জ্যৈষ্ঠ মাসের গরমে ঘাম হওয়াটা স্বাভাবিক। আমি আর থাকতে না পেরে বলেই বসলাম, ‘‘অবিনাশদা, তুমি এই গেঞ্জিটা কতদিন কাচো না শুনি! বড্ড গন্ধ বেরোচ্ছে।’’ রামহরিদা হোহো করে হেসে উঠল। অবিনাশদা একটু অপ্রস্তুত হয়ে গিয়ে একটা বোকা হাসি দিয়ে বলল, “ইয়ে, সত্যি খুব গন্ধ বের হচ্ছে বুঝি। এটা কিন্তু কাচা জামা। আসলে খুব ঘাম হচ্ছে তো, আর এবার গরমটাও বড্ড পড়েছে। তুই একটু দাঁড়া, আমি এটা চেঞ্জ করে আসি। আর রামহরিদা তুমিও একটু চায়ের ব্যাবস্থা করো।’’
অবিনাশদা জামা পাল্টাতে ঘরে গেল। রামহরিদাও ওর সঙ্গেই চলে গেল। আমার একটু খারাপ লাগলো, এভাবে না বললেই হতো, বেচারা লজ্জায় পড়ে গেছে।
এতক্ষণে আমি অবিনাশদার বাগানটাকে দেখার সুযোগ পেলাম। এক জায়গায় টবে সেই গাছটা রাখা। কাছে গিয়ে ভালো করে দেখলাম গাছটাকে। লতানো গাছ, তাই একটা বাঁশের কঞ্চির সাপোর্ট দিয়ে জায়গায় জায়গায় বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখা। গাছের পাতাগুলো গাঢ় সবুজ রঙের, তবে ডগার কাছে কচি পাতাগুলো লালচে। গাছটার ডালপালা থেকে ফুটে আছে পোড়া মাটির রঙের বা মেটে রঙের আট-দশটা ফুল। ফুলগুলির উপর যেন কেউ তুলি দিয়ে হলুদ রং ছিটিয়ে দিয়েছে। এক কথায় ফুলগুলো দেখতে অপূর্ব সুন্দর। আমি আমাদের বাংলায় এত সুন্দর ফুল আগে দেখিনি। একটা টকসা মিষ্টি গন্ধ আছে ফুলগুলোর। অনেকটা ঠিক পাকা তেঁতুলের বা আমের আচারের যেমন হয়।
হঠাৎ করে গাছটাকে দেখলে আমাদের এখানকার অপরাজিতা বা নীলকন্ঠ গাছের মতন মনে হয়, কিন্তু ফুলগুলো দেখতে অনেকটা টগর বা নয়নতারা ফুলের মতন।
ফুলগুলোর চারপাশে বেশ কতগুলো প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে। নানান জাতের ফুল গাছ থাকায় অবিনাশদার বাগানে এমনই হরেক রকমের প্রজাপতি দেখা যায়।
আমি মোহিত হয়ে ফুলগুলো দেখছি, এমন সময় অবিনাশদা ফিরে এলো। বাবু শুধু জামাই পাল্টায়নি, বেশ কড়া করে পারফিউম ও মেখে এসেছে।
“ফুলগুলো দেখলি, কী অসাধারণ দেখতে না?” বলল অবিনাশদা।
—হ্যাঁ, আর বেশ একটা গন্ধও আছে বলো। আচ্ছা দুটো টবে বসিয়েছিলে তো, আর একটা কই?
—একটা আমার ল্যাবে নিয়ে গেছি ফুলগুলো স্টাডি করব বলে।
—কতদিন হল এই ফুলগুলো ফুটেছে?
—তা সপ্তাহখানেক হবে। এখনও কত টাটকা দেখ। একটাও শুকিয়ে যায়নি।
— তা স্টাডি করে কিছু বুঝতে পারলে ফুলগুলো সম্বন্ধে? মানে কেন একে ‘শয়তানের ফুল’ বলে?
— না রে, এখনও বিশেষ কিছুই বুঝতে পারিনি বুঝলি। কাল বোটানিক্যাল গার্ডেনে গিয়েছিলাম, ওখানকার বইপত্র ঘাঁটলাম কিন্তু কিছুই পেলাম না এই ফুলগুলো সম্বন্ধে। এর ক্যারেক্টারেস্টিক্সও খুব গোলমেলে। গাছ দেখে মনে হয় fabaceae গোত্রের, কিন্তু ফুলগুলোর প্রকৃতি আবার apocynaceae গোত্রের গাছেদের মতন। আবার রঙের প্যাটার্ন দেখে আমাদের বাংলার কলাবতী ফুলের কথা মনে পড়ে যায়, যা আবার cannaceae পরিবারভুক্ত।
—হুম, তোমার এত বৈজ্ঞানিক নামের কচকচানি না বুঝলেও এটা বুঝতে পারছি যে বেশ আশ্চর্য ব্যাপার।
—আর একটা জিনিস, যদিও আমি এই ফুলের কেমিক্যাল অ্যানালাইসিস করিনি, তবুও এটা বলতে পারি এই ফুলের মধ্যে রেডিয়াম বা ফসফরাসের মতো কোনো বস্তু রয়েছে।
—কেন?
—এর এই যে হলুদ ডট গুলো আছে না, ওগুলো অন্ধকারে চকচক করে, অনেকটা সমুদ্রের ফেনা বা রেডিয়াম ডায়ালের ঘড়ির মতন।
—বাহ, বেশ মজার ব্যাপার তো।
—হুম, সত্যিই ইন্টারেস্টিং। দেখলে মনে হয় যেন জোনাকি জ্বলে আছে। বুঝলি পুলু, আমার মন বলছে এই ফুলের মধ্যে অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে। আর যদি সেই রহস্য একবার সামনে আনতে পারি তবে বিজ্ঞানমহলকে একেবারে চমকে দিতে পারব।
আমি মজা করে বললাম, “দেখো দাদা, যদি নোবেল প্রাইজ টাইজ পেয়ে যাও তখন যেন আবার এই ভাইটাকে ভুলে যেও না।’’
অবিনাশদা হাহা করে হেসে উঠল।
আমরা কথা বলছি এমন সময় আমার বাম হাতের কবজির উপরে একটা তীব্র জ্বালা অনুভব করে “বাবারে” বলে চিৎকার করে উঠলাম। দেখি আমার বাম হাতের কবজির ওখানে প্রজাপতির মত একটা পোকা বসে। দেখতে অনেকটা প্রজাপতির মতো হলেও এটা কিন্তু ঠিক প্রজাপতি নয়। এর ডানা দুটো কালচে আর শরীরটাও কালো পিঁপড়ের মতন। আর তাই দিয়েই সেটা আমার কব্জির এক জায়গায় মাংস খুবলে রক্ত বের করে দিয়েছে।
ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরছিল। অবিনাশদা তাড়াতাড়ি পোকাটাকে তাড়িয়ে,আমায় ঘরে নিয়ে এসে জায়গাটা ধুয়ে ফার্স্ট এড দিয়ে দিল।
জ্বালা একটু কমতে বললাম,“এটা কী পোকা বলো তো? এমন পোকা তো আগে দেখিনি।’’ অবিনাশদা অন্যমনস্ক হয়ে কী একটা ভাবছিল, চমকে উঠে বলল, “সত্যি রে, আমিও দেখিনি এমন পোকা।’’
(৩)
পরশু অবিনাশদার জন্মদিন ছিল। অফিস থেকে সরাসরি গেছিলাম অবিনাশদার বাড়ি। অবিনাশদা চকোলেট কেক পছন্দ করে বলে একটা ভাল দেখে চকোলেট কেক পার্সেল করে নিয়ে গেছিলাম। এই ক’দিনে আমার হাতের ঘা টা একটু শুকিয়েছে, যদিও এর জন্য আমায় টিটেনাস নিতে হয়েছে। সেদিনের ওই পোকাটার ব্যাপারে এখনও কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি।
বেল বাজাতেই রামহরিদা তাড়াতাড়ি কোনও রকমে আমার জন্য দরজা খুলে চা নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে ছুটল। জিজ্ঞেস করলাম, অবিনাশদা কোথায়? রামহরিদা বলল, সে নাকি আজ দু’দিন হল নিজের ল্যাব থেকেই বেরোয়নি, সারাদিন নাকি ওখানেই পড়ে আছে। ওখানেই খাচ্ছে, ওখানেই ঘুমোচ্ছে, দু’দিন থেকে নাকি ইউনিভার্সিটিও যাচ্ছে না। রামহরিদা এখন ল্যাবে ওর চা দিতে যাচ্ছে।
বুঝলাম ব্যাপারটা বেশ সিরিয়াস, অবিনাশদা নিজের গবেষণার ডুবে আছে, এমন সময় ওকে ডিস্টার্ব করা ঠিক হবে কিনা ভেবে পেলাম না। ওর ল্যাবে সরাসরি চলে যাব কিনা এই নিয়ে দোনোমনো করছি, এমন সময় রামহরিদাই বললো,“তুমিও এসো না, দাদাবাবু তোমাকে দেখলে খুশিই হবে।’’
রামহরি দার কথায় ভরসা পেয়ে সরাসরি অবিনাশদার ল্যাবে চলে গেলাম। ওর ল্যাবটা দোতলার একটা ঘরে। আমি এর আগেও অনেকবার গিয়েছি তাই ঘরটা আমার চেনা। সামনে গিয়ে দেখলাম ল্যাবের দরজা ভেজানো। হালকা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল,আর খুলে যেতেই আবার সেই একটা পচা উৎকট গন্ধ আমার নাকে এসে ঠেকলো। গন্ধটা অনেকটা ঘেমো মোজা বা জুতো থেকে যেমন গন্ধ আসে তেমন। তবে এর তীব্রতা অনেক বেশি। দেখলাম অবিনাশদা দরজার দিকে পিঠ করে টেবিলের উপর ঝুঁকে পড়ে কী একটা দেখছে বা লিখছে। রামহরিদা পিছনে চা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। দু’জনেই এই গন্ধের মধ্যেও কী ভাবে রয়েছে বুঝে পেলাম না। আমি নাকে রুমাল দিয়ে খুব আস্তে আস্তে অবিনাশদার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। অবিনাশদা পেছনের দিকে না তাকিয়েই বলল,“ রামহরিদা, এখন যাও, এখন আর চা খাব না।’’
আমি বললাম, “চা ছাড়ো, এখন তো কেক কাটার টাইম।’’
অবিনাশদাআমার গলার আওয়াজ পেয়ে পিছনে ফিরল, “আরে পুলু তুই, কখন এলি?’’
আমি অবাক হয়ে অবিনাশদা কে দেখছিলাম। এই ক’দিনে কি অবস্থা হয়েছে ওর। আগের থেকে যেন একটু মোটা হয়ে গেছে, মুখ ভর্তি গোঁফ দাঁড়ির জঙ্গল, চোখ দুটো কি অস্বাভাবিক রকম টানা টানা লাগছে, সম্ভবত অনেকদিন না ঘুমানোর ফলে।
আমি বলেই ফেললাম, “তোমার এ কী অবস্থা হয়েছে অবিনাশদা? কতদিন স্নান করো না? মনে তো হচ্ছে ভালো করে ঘুমোওনি কতদিন। আর সবথেকে বড় কথা এই গন্ধের মধ্যে বসে আছ কি করে?’’
অবিনাশদা একটু অবাক হয়ে বলল, “গন্ধ! কই আমি তো তেমন কোনও গন্ধ পাচ্ছি না। রামহরিদা তুমি কোনও গন্ধ পাচ্ছ?’’
রামহরিদা ঘাড় নাড়ল, “না দাদাবাবু, আমিও তো তেমন কিছু পাচ্ছি না।’’
—তোমরা অনেকক্ষণ থেকে আছ বলে গন্ধটা তোমাদের নাকে সয়ে গেছে হয়তো। কিন্তু বাপরে কী উৎকট গন্ধ।
—তা হবে হয়তো, আসলে ল্যাবে নানা রকমের জিনিস থাকে তো, গন্ধ লাগতেই পারে। আচ্ছা দাঁড়া দেখি।
অবিনাশদা একটা আলমারি থেকে একটা রুম ফ্রেশনার বের করে ঘরের ভেতরে স্প্রে করে দিলো। তাতে গন্ধটা একটু কমল, কিন্তু পুরোপুরি গেল না। আমি রামহরিদাকে বললাম, “তোমার দাদাবাবু যখন খাবে না, চা টা তখন তুমি নয় আমাকেই দাও রামহরিদা।’’ রামহরিদা হেসে, চা-টা আমাকে ধরিয়ে দিয়ে নীচে চলে গেল। রুম ফ্রেশনারের বোতলটা রেখে অবিনাশদা আমায় জিজ্ঞেস করল, “তারপর? তুই এই সময়? অফিস থেকে সরাসরি মনে হচ্ছে। তা কী ব্যাপার?’’
—কী ব্যাপার মানে? হ্যাপি বার্থডে। তুমি তো দেখছি টোটাল ভুলে মেরে দিয়েছ। কী এমন গবেষণা করছ শুনি?
—ও হ্যাঁ তাইতো, আমার সত্যিই মনে ছিল না রে। আসলেই ওই ফুলটা নিয়েই গবেষণা করছিলাম। কী আশ্চর্য ফুল মাইরি! জিনিসটা সম্বন্ধে যতই জানছি ততই আশ্চর্য লাগছে জানিস। তুই জানিস, ওই ফুলগুলো গাছ থেকে ছিঁড়ে দিলেও এক সপ্তাহ ধরে তাজা থাকে, এমনকী ছেঁড়া অবস্থাতেও ফুল থেকে ফলে পরিণত হতে পারে।
—তাই নাকি! আশ্চর্য তো! এরকম আবার হয় নাকি? আচ্ছা তোমার গবেষণার বাকি কথা পরে শুনবো, তুমি আগে ফ্রেশ হয়ে নীচে এসো তো। আমি কেক এনেছি, আগে কেক কাটবে চলো।
—তুই কেন এসব পাগলামি করিস বল তো?
—বেশ করি, তুমি নীচে চলো।
আমি কথা বলতে বলতে টেবিলে রাখা একটা কাচের বোতল হাতে তুলে নিয়েছিলাম। অবিনাশদা এক প্রকার ছোঁ মেরে আমার হাত থেকে বোতলটা ছিনিয়ে নিয়ে বলল,“এতে হাত দিস না। এটা ফ্লুরোঅ্যান্টিমনিক অ্যাসিডের বোতল, খুব বিষাক্ত,হাতে লাগলে হাত ঝলসে যাবে। এই অ্যাসিড যেকোনও জিনিসকে এক মিনিটে নষ্ট করে দিতে পারে। সুতরাং এটায় হাত দিস না।’’
—আচ্ছা বাবা, দেব না। কিন্তু তুমি নীচে তো চলো। আমি তো আমার বাড়ি ফিরব নাকি?
বোতলটা টেবিলে রেখে দিয়ে অবিনাশদা বলল, “হ্যাঁ চল, তবে আজ আমার বাড়ি থেকেই ডিনার করে যাবি। বাড়িতে ফোন করে বলে দে, আমি রামহরিদা-কে খাবার আনতে পাঠাচ্ছি।’’
সন্ধ্যা আটটার মধ্যে খাবার চলে এল। অবিনাশদাও স্নানটান সেরে বেশ ফ্রেশ হয়ে এসেছে। রামহরিদা আমাদের খাবার দিয়ে দিল। সঙ্গে নিজের জন্য একটা প্লেটে আলাদা করে বিরিয়ানি আর মাংস তুলে নিল।
খেতে খেতে অবিনাশদাকে বললাম,“হ্যাঁ, বলো এবার তোমার রিসার্চের ব্যাপারে।’’ মাংসের হাড়ের ভেতর থেকে মজ্জাটা সুড়ুৎ করে টেনে নিয়ে অবিনাশদা বলল, “রিসার্চের ব্যাপারটা বেশ খানিকটা এগিয়েছে বুঝলি। তোকে তো বললামই যে গাছ থেকে ছিঁড়ে নিলেও ফুলটা অনেক দিন বেঁচে থাকে। এর আর একটা বৈশিষ্ট্য হল এই গাছের বৃদ্ধি খুব বেশি। মাত্র কয়েকদিনেই বাগানের গাছটা বেশ ঝাড় হয়ে উঠেছে। ল্যাবের গাছটাকে অবশ্য আমি কেটেকুটে বেশি বাড়তে দিইনি। তবে এই বাড়বৃদ্ধির কারণ আমাজনের ওই উর্বর মাটিও হতে পারে। শেফার্ড আমাকে বলেছিল আমাজনের মাটি ছাড়া নাকি এই গাছ অন্য মাটিতে জন্মাবে না। কিন্তু আমার ল্যাবের গাছটার কাটা টুকরোগুলো আমি যেখানে যেখানে ফেলেছিলাম সেখানেও ওই কাটা টুকরোগুলো থেকে নতুন গাছ জন্মেছে, অর্থাৎ গাছটা অঙ্গজ জননে সক্ষম। এই ব্যাপারটা শেফার্ড মনে হয় জানত না। না হলে ও আমায় বীজ না পাঠিয়ে কাটা গাছের কয়েকটা টুকরো পাঠাত। আর এটা সংগ্রহ করতেও ওকে এত ঝামেলা পোহাতে হত না। আর একটা দোষ বা গুণ আছে বুঝলি? এই গাছটা এর আশপাশের অন্য গাছগুলোকে নষ্ট করে দেয়, মানে এটা একরকমের ন্যাচারাল উইডিসাইট।’’
আমি মুখের খাবারটা গিলে নিয়ে বললাম,“সবই তো বুঝলাম, কিন্তু ‘শয়তানের ফুল’ বলছে কেন?”
অবিনাশদা একটা বড় পিস মুখে চালান করে দিয়ে চিবোতে চিবোতে বলল,“এটা খুব ভালো প্রশ্ন করেছিস বুঝলি। আমি ফুলটার কেমিক্যাল অ্যানালাইসিস করিয়েছি। আমি ঠিকই সন্দেহ করেছিলাম, ফুলটার মধ্যে অন্যান্য কেমিক্যালের সঙ্গে সঙ্গে রেডিয়ামও রয়েছে, যে জন্য রাতের অন্ধকারেও ওর হলুদ ছিটেগুলো জ্বলতে থাকে। হলুদ ওই ডটগুলোকে মাইক্রোস্কোপে খুব ভালো করে দেখলে মনে হয় ওগুলো খুব ছোট ছোট ছিদ্র বা পোর। আমার মনে হয় ওই পোরগুলো থেকে খুব হালকা কোনও গ্যাস বের হয় যেটা ফুলটার ওই টকশা মিষ্টি গন্ধের কারণ। তবে সেটা কী গ্যাস আমি জানিনা। তবে একটা জিনিস বুঝতে পেরেছি ওই গ্যাসটার ব্যাপারে।’’
— কী জিনিস?
— সেটা এখনই বলব না। আগে নিজে কনফার্ম হই।
একটা পেল্লাই ঢেঁকুরের আওয়াজে মুখ তুলে অবিনাশদার দিকে তাকালাম, সে বাবু পরম সুখে মাংসের হাড় চিবোচ্ছে। ঢেঁকুরটা অবিনাশদা তুলল বলে মনে হল না, ওর মুখভর্তি তো খাবার। তাহলে কোথা থেকে এল আওয়াজটা? রামহরিদার দিকে দেখলাম, সেও পরম আনন্দে চিকেন লেগ পিসের সদ্ব্যবহার করতে ব্যস্ত। তাহলে ঢেঁকুর তুলল কে?
প্রসঙ্গ অন্যদিকে ঘোরাতে বললাম, “তা অবিনাশদা সেই মাপিংগুয়ারির ব্যাপারে আর কিছু জানাল তোমার ওই শেফার্ড? যাই বল ওটা কিন্তু আমার হেব্বি ইন্টারেস্টিং লেগেছে।’’
অবিনাশদা কেমন যেন হকচকিয়ে গেল, তারপর সামলে নিয়ে বলল, “আরে না না, সে নিয়ে আর ভাবনার সময় কই। তবে কাল শেফার্ডের একটা চিঠি এসেছে বুঝলি। সেই যে বলেছিলাম না পশ্চিম আমাজনে কোরুবোদের গ্রাম থেকে ক@জন মানুষ জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে হারিয়ে গেছিল, তাদের প্রায় একমাস পরে পাওয়া যায় ওই জঙ্গল থেকে প্রায়দশ মাইল দূরে একটা নদীর ধারে। একটা রেসকিউ টিম ওদের গিয়ে উদ্ধার করে। ওই লোকগুলোর নাকি বিগত এক মাসের স্মৃতি কিছুই মনে নেই। স্থানীয় ডাক্তারদের মতে লোকগুলোর শরীরে কোনও রকমের বিষক্রিয়া হয়েছিল, যা ধীরে ধীরে কেটে যাওয়ায় লোকগুলো সুস্থ হয়ে ওঠে। কিন্তু ওই গ্রামের এক প্রবীণ ওঝা বলে ওই লোকগুলো নাকি সুস্থ হয়েছে ওই নদীর জল খেয়ে। ওই নদীর জলের মধ্যে নাকি বিষ কাটানোর ক্ষমতা রয়েছে।
শেফার্ড আমায় আবার এক বোতল ওই নদীর জল পাঠিয়েছে। আমি জলটা পরীক্ষা করে দেখেছি জলটার মধ্যে বিশেষ এক ধরনের প্ল্যাংকটন জন্মায়, যাদের মধ্যে সত্যিই কিছুটা বিষক্রিয়া নষ্ট করার ক্ষমতা আছে। সুতরাং এ ব্যাপারে ওঝা মনে হয় খুব ভুল কিছু বলেনি। দেখি ব্যাপারটা শেফার্ডকে জানাতে হবে।’’
আমার খাওয়া হয়ে গেছিল, উঠে হাত ধুয়ে নিলাম। আমার সঙ্গে সঙ্গে অবিনাশদাও হাত ধুতে উঠে এল। রামহরিদার ও খাওয়া হয়ে গেছে। সেই পেল্লাই ঢেঁকুরের শব্দটা আর একবার শুনলাম, আর এবার স্পষ্ট দেখলাম অবিনাশদার ঠোঁট দুটো বন্ধ ছিল। তাহলে ঢেঁকুরটা তুলল কে? আওয়াজটা তো অবিনাশদার কাছ থেকেই এল বলে মনে হল। ঢেঁকুর তোলা স্বাভাবিক একটা ব্যাপার, কিন্তু তাও যেন কেমন অস্বাভাবিক লাগল, কেন যে লাগল তা জানি না।
অনেকক্ষণ ধরে একটা চাপা অস্বস্তি হচ্ছিল, কিন্তু সেটার কারণ কী ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। রাত ন’টা নাগাদ অবিনাশদার বাড়ি থেকে বেরোলাম। অবিনাশদা দরজা পর্যন্ত পৌছে দিয়ে গেল। গেটের কাছ থেকে ওর বাগানের দিকে উঁকি মেরে দেখলাম সত্যিই হলুদ রংগুলো জোনাকির মতো জ্বলে আছে। এই অন্ধকারে বেশ দেখতে লাগছে ফুলগুলো।
রাস্তার মোড় থেকে রিকশা পেয়ে গেলাম। রিকশায় বসে ফুলগুলোর কথাই মনে মনে ভাবছিলাম। হঠাৎ ক’টা কথা মনে পড়ায় এতক্ষণ থেকে হওয়া অস্বস্তির কারণটা বুঝতে পারলাম। প্রথমত, সেই পচা গন্ধটা শুধু ল্যাবের এর ভেতরে না, ল্যাবের বাইরেও পাচ্ছিলাম। কিন্তু ততক্ষণে গন্ধটা গা সওয়া হয়ে যাওয়ায় অতটা খেয়াল করিনি, এখনই বাইরের খোলা হাওয়ায় ব্যাপারটা স্পষ্ট অনুভব করতে পারলাম।
আর দ্বিতীয় কারণটা যে কী সেটা অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারলাম না। তবে অস্বাভাবিক কিছু একটা যে ছিল এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
(৪)
দু’দিন পরের ঘটনা। আমার প্রতিদিনের অভ্যাস অফিসে দুপুরের লাঞ্চ ব্রেকে বসে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে লাঞ্চ করা। সংবাদপত্রের তিন নম্বর পাতায় একটা খবর দেখে চোখটা হঠাৎ আটকে গেল। লিখেছে-
“নিজস্ব সংবাদদাতা: কাল রাতে শহরের দক্ষিণ অংশে কিছু জায়গায় এক অদ্ভুত ধরনের প্রাণীকে ঘুরে বেড়াতে দেখা গিয়েছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী প্রাণীটি অনেকটা শিম্পাঞ্জি বা গরিলা জাতীয়। স্থানীয় এক অধিবাসী বলেন তিনি নাকি রাত্রে গর্জনের মতো একটা আওয়াজ শুনে জানলা খুলে দেখেন জন্তুটা ওনার বাড়ি সংলগ্ন ল্যাম্পপোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাণীটির শরীরে থেকে নাকি তীব্র দুর্গন্ধ বেরোচ্ছিল। স্থানীয় ওই অধিবাসী সঙ্গে সঙ্গে পুলিশে খবর দেন। কিন্তু পুলিশ এসে ওই স্থানে কোনও প্রাণীকে দেখতে পায়নি।
পুলিশ এর মধ্যে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে, কিন্তু ওঁদের পক্ষ থেকে কোনও শিম্পাঞ্জি বা গরিলা পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা অস্বীকার করা হয়েছে। স্থানীয় ফুটপাতের একজন বাসিন্দা বলেছে, সে নাকি জন্তুটাকে সামনে থেকে দেখেছে। তার মতে ওই রকম ভয়ঙ্কর জানোয়ার নাকি সে আগে কখনও দেখেনি। জন্তুটাকে সামনে থেকে দেখেই সে নাকি অজ্ঞান হয়ে যায়। তবে লোকটির কথায় বেশ কিছু অসঙ্গতিও লক্ষ করা যায়, তার বক্তব্য অনুযায়ী জন্তুটার নাকি একটা চোখ, আর তার পেটের ভেতর থেকে নাকি বড় একটা ঠোঁটের মতন মাংসপিণ্ড বেরিয়ে ছিল। স্থানীয় লোকেরাও ব্যক্তিটিকে মাদকাসক্ত বলে চিহ্নিত করেছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে সুনিশ্চিত ভাবে কোন তথ্য আমরা এখনও পাইনি। তবে অনেকেই দাবি করছে তারা নাকি জন্তুটার গর্জন শুনেছে। লোকাল পুলিশ ব্যাপারটা খতিয়ে দেখছে, তবে ব্যাপারটাকে ঘিরে এলাকায় বেশ খানিকটা উত্তেজনা রয়েছে।’’
খবরটা পড়ে প্রথম যে নামটা মাথায় এল সেটা হলো ‘মাপিংগুয়ারি’। কিন্তু আমাজনের জঙ্গলের এক কিংবদন্তি জন্তু হাজার মাইল দূরে এই শহর কলকাতায় এল কোথা থেকে? ব্যাপারটা অবিনাশদা জানে কিনা দেখতে মোবাইল বের করে ওকে কল করলাম। রিং হয়ে গেল, কিন্তু ওপারে কেউ ফোন তুলল না।
ভাবলাম হয়তো নিজের কাজ নিয়ে ডুবে আছে তাই ফোন ধরছে না। ঠিক করলাম অফিস থেকে ফেরার পথে একবার ওর বাড়ি যাব।
অফিস থেকে সোজা গেলাম অবিনাশদার বাড়ি। বাড়িতে পৌঁছে কী মনে হল বেল না বাজিয়ে দরজায় ধাক্কা দিলাম। প্রথম ধাক্কাতেই খুলে গেল দরজাটা।
দু’একবার ডেকেও অবিনাশদা বা রামহরিদার কোন সারা পেলাম না। কোথায় গেল এই ভর সন্ধেবেলা দু’জনে? কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ভাবলাম অবিনাশদা আবার ওর ল্যাবে নেই তো? একটু দোনোমোনো করে উপরে অবিনাশদার ল্যাবের কাছে উঠে গেলাম। ল্যাবের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। দরজার বাইরে থেকে আবার সেই আগের দিনের উৎকট গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। এবার যেন গন্ধটা আরও তীব্র।
খুব সাবধানে ঠেলা দিলাম, আর দরজাটা খুলে যেতেই ভিতরে যা দেখলাম তাতে আমি আমার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। ল্যাবের ভেতর দাঁড়িয়েএকটা দু’পেয়ে জন্তু। জন্তুটা আমার দিকে পিছন করে দাঁড়িয়ে আছে, আকৃতি-প্রকৃতি অনেকটা গোরিলার মতো। গায়ে বড় বড় লোম, আর উৎকট সেই গন্ধটা আসছে জন্তুটার শরীর থেকে।
প্রচণ্ড ভয় পেলে মানুষ চলাফেরার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, আমারও বোধহয় সাময়িকভাবে তাই হয়েছিল। আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম বিভীষিকাটাকে।
ঘরের এক পাশে চেয়ার-টেবিল উল্টে পড়ে, বিভিন্ন কেমিক্যালের শিশিগুলো আর অবিনাশদার মাইক্রোস্কোপটা ভেঙে মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। পুরো ল্যাব লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে। জানোয়ারটা কিছু একটা খাচ্ছে মনে হল। এতক্ষণ খেয়াল করিনি, এইবার খেয়াল হল জন্তুটার গায়ে একটা পোশাক আছে। এই পোশাকটা আমি চিনি, এটা অবিনাশদারই একটা পুরানো জামা, তবে কি ওটা…! কিন্তু না না তা কী করে সম্ভব?
জানোয়ারটা এতক্ষণে আমার উপস্থিতি টের পেল মনে হয়। ধীরে ধীরে সামনে ফিরল ওটা। সামনে থেকে জন্তুটার রূপ দেখে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার জোগাড়। ভাঁটার মতো বিশাল একটা মাত্র চোখ, যেন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে আমারই দিকে। সামনের চোয়াল থেকে ঝরে পড়ছে অবিনাশদার ল্যাবের গিনিপিগগুলোর টাটকা রক্ত। পেটের মাঝখান বরাবর এক জোড়া দলা ঠোঁটের মতন মাংসপিণ্ড। সব মিলিয়ে সে কিম্ভূতকিমাকার মূর্তি দেখে যে কোনও লোকেরই হার্টফেল হতে পারে।
জন্তুটা আমার উপস্থিতিতে একটু হকচকিয়ে গেছিল। তারপর নিজের হাতে ধরে রাখা আধখাওয়া গিনিপিগটাকে মুখের মধ্যে চালান করে, একটা তীব্র গর্জন করে দুই হাত তুলে আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল।
আমার বুদ্ধিশুদ্ধি ততক্ষণ লোপ পেয়েছে। চেষ্টা করেও যেন পালাতে পারছি না শয়তানটার সামনে থেকে। ওটা একটু একটু করে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আসন্ন মৃত্যু হয়তো এভাবেই হতবুদ্ধি করে দেয় মানুষকে। মনের মধ্যে তখন শুধু একটা কথাই ঘুরছে জানোয়ারটার গায়ে অবিনাশদার জামা কেন? তবে কি অবিনাশদা ব্যাপারটা জানত? নাকি জন্তুটা অবিনাশদাকেও শেষ করে ফেলেছে?
ব্রাজিল, আমাজন,শয়তানের ফুল, মাপিংগুয়ারি— সবকিছুর সঙ্গে অবিনাশদার যেন একটা যোগাযোগ আছে। সব যেন চোখের সামনেই আছে কিন্তু আমি ধরতে পারছি না। হঠাৎ একটা অদ্ভুত কথা মাথায় এলো, আচ্ছা এই জন্তুটা আসলে অবিনাশদা নয়তো? হয়তো কোনভাবে ও এমন হয়ে গেছে। চিৎকার করে উঠলাম, “অবিনাশদা!’’
হঠাৎ আমার কানের পাশ থেকেএকটা কাচের শিশি উড়ে এসে সশব্দে আছড়ে পড়ল জানোয়ারটার ঠিক পায়ের সামনে। ভয়ঙ্কর চিৎকার করে উঠল জন্তুটা। সঙ্গে সঙ্গে ধোঁয়ায় ভরে উঠলো সারা ঘর। মেঝেতে যেটা আছড়ে পড়েছে সেটা ফ্লুরোঅ্যান্টিমনিক অ্যাসিডের বোতল, আর তার থেকেই এই ধোঁয়ার উৎপত্তি।
পিছনে ঘুরে দেখি দাঁড়িয়ে রয়েছে অবিনাশদা! তাড়াতাড়ি আমার হাত ধরে আমায় ঘরের বাইরে নিয়ে এসে দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল।
আমি জড়িয়ে ধরলাম অবিনাশদাকে, বললাম, “এসব কী হচ্ছে অবিনাশদা! এই জন্তু এখানে এলো কী করে?’’
অবিনাশদা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,“এই জন্তু কোথাও থেকে আসেনি রে ভাই, এই জন্তু এখানেই তৈরি হয়েছে। অবশ্য এর জন্য আমিই দায়ী। আমার ব্যাপারটা আগেই বোঝা উচিত ছিল।’’
—তার মানে? কিছুই তো বুঝতে পারছি না।
—ওটা আসলে কোন জন্তু নয়, একজন মানুষ।
—মানুষ! কী বলছ তুমি?
—ঠিকই বলছি। ওটা আর কেউ নয় রে, আমাদের রামহরিদা।
মাথাটা যেন ঘুরে গেল আমার। একটু সামলে নিয়ে বললাম, “কী বলছ কী তুমি, রামহরিদার এমন অবস্থা হল কীভাবে?’’
—ওই ফুলটার জন্য।
—ফুলটার জন্য মানে?
—তোকে বলেছিলাম মনে আছে এই ফুলটার হলুদ পোরগুলো থেকে এক ধরনের গ্যাস বেরোয়? ওটা আসলে এক ধরনের মিউটাজেন গ্যাস।
—মানে?
—মানে ওই গ্যাস প্রাণীদের জিনের পরিবর্তন ঘটিয়ে, তাদের মিউট্যান্ট বানিয়ে দেয়। মনে আছে ওই রাক্ষুসে প্রজাপতিটার কথা? ওই প্রজাপতিগুলোও ওই ফুলের গন্ধেই মিউট্যান্ট হয়ে গেছিল। আমার ধারণা ওই কোরুবো গ্রামবাসীদের সঙ্গেও একই ঘটনা ঘটেছিল। তারাও ওই ফুলের গন্ধেই মিউট্যান্ট হয়ে মাপিংগুয়ারিতে পরিণত হয়। আসলে মাপিংগুয়ারি বলতে আলাদা কোনও জানোয়ারই নেই, ওটা মানুষেরই একটা বিকৃত রূপ।
—কিন্তু রামহরিদার এমন অবস্থা হলো কী করে?
—ও সারাদিন বাগানে ফুলগুলোর পরিচর্যা করত। তারপর আমার ল্যাবেও বিনা প্রোটেকশনে কাজ করত। কতবার বারণ করেছি, প্রতিবারই বলত, ‘ও আমার কিছু হবে না দাদাবাবু।’
—তা তুমি আগে কিছু বুঝতে পারোনি?
—সত্যি বলতে খেয়াল করিনি। যখন খেয়াল হল তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ওর গায়েতে একটা গন্ধ আছে দেখেছিস। তুইও আমার বাড়িতে এসে আমায় বারকয়েক গন্ধের কথা বলেছিস। তখন খেয়াল করিনি, ভেবেছি ঘামের গন্ধ। আর যেহেতু রামহরিদা আমার কাছে কাছেই থাকত তাই ওই গন্ধটা আমার নাকসওয়া হয়ে গেছিল। কিন্তু তুই বুঝতে পারতিস।
আমি মনে মনে ভাবার চেষ্টা করলাম। সত্যি যতবারই অবিনাশদার গা থেকে গন্ধটা পেয়েছি ততবারই রামহরিদা ওর আশপাশেই ছিল। অর্থাৎ গন্ধটা অবিনাশদার গা থেকে নয়, আসত রামহরিদার গা থেকে। কিন্তু আমি বোকার মতন ভেবেছিলাম ওটা অবিনাশদার শরীর থেকে আসছে।
আর একটা ব্যাপার আমার আজ পরিষ্কার হল, সেদিনের সেই খটকা লাগার কারণটা। রামহরিদা তো জাতে বৈষ্ণব, নিরামিষ ভোজী, ও তো মাছ-মাংস খেত না। কিন্তু সেদিন আমাদের সঙ্গে বসে বেশ জমিয়ে বিরিয়ানি, মাংস খেল। এই ব্যাপারটা সেদিন খেয়াল করিনি। কিন্তু অবচেতন মনে একটা খটকা লেগেছিল।
অবিনাশদা বলল, “কাল সন্ধে থেকেই রামহরিদা অস্বাভাবিক আচরণ করছিল, আমার তখন থেকেই সন্দেহ হয়। তারপর রাতে যখন দেখি জন্তুটা ওর ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে গেল তখন আমার সন্দেহ পোক্ত হয়। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমি ভেবেছিলাম ওটা আর ঘরে ফিরবে না, সকাল হলে নয় রামহরিদার খোঁজ করব। কিন্তু মাঝরাতে আমি যখন ওটাকে বাড়ি ফিরতে দেখি তখনই আমি আত্মরক্ষার জন্য পিছনের দরজা দিয়ে বাইরে পালিয়ে যাই। যাওয়ার সময় আত্মরক্ষার জন্য অ্যাসিডের শিশিটা হাতে করে নিয়ে যাই। আমি জানতাম এতে জন্তুটা ঘায়েল হবেই।’’
আমি বললাম, “এবার কী হবে অবিনাশদা? রামহরিদা-কে তো ভালো করতে হবে। কী ভাবে কী করবে কিছু ভেবেছ?’’
অবিনাশদা বলল,“ আজ সারা দিন এখানে ওখানে ঘুরে সেই উপায়ই ভাবছিলাম। একটা উপায় ভেবেছি। তবে জানি না সেটা কাজ করবে কিনা।’’
—কী উপায়?
—শেফার্ডের পাঠানো সেই নদীর জল। মনে নেই সেই জল খেয়েই তো ওই কাঠুরেগুলো সুস্থ হয়ে উঠেছিল।
—কিন্তু সেই জল কি কাজ করবে?
—আমাদের কাছে তো আর কোনও উপায়ও নেই।
—কিন্তু ওই এক বোতল জলে কী হবে?
— কিছুটা তো হোক। রামহরিদা ফিরে অন্তত আসুক। তারপর আমি ওকে ব্রাজিল নিয়ে যাব। এমনিতেও আমার সেখানে একবার যাওয়া দরকার রিসার্চের কাজে। আমি শেফার্ডকে কালই ইমেল করে দেব। এবার চলতো গিয়ে দেখি কী হলো ওটার। কিছুটা ধরাশায়ী যে হবে এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।
দু’জনে অতি সন্তর্পণে দরজা খুললাম। মেঝের ওপর অজ্ঞান হয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছে মাপিংগুয়ারিরূপী আমাদের রামহরিদা। তীব্র অ্যাসিডের ঝাঁঝালো গন্ধে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে জ্ঞান হারিয়েছে দানবটা। দু’জনে ধরাধরি করে, টেনে হিঁচড়ে ওকে নিয়ে এলাম পাশের একটা ঘরে। রামহরিদা রোগা পাতলা মানুষ, কিন্তু কী বিশাল ওজন এই জানোয়ারটার। অবিনাশদা ওর হাত পা শক্ত করে লোহার চেন দিয়ে বেঁধে দিল যাতে জ্ঞান এলে পালাতে বা ক্ষয়ক্ষতি করতে না পারে। তারপর নীচের ঘর থেকে জলের বোতলটা নিয়ে এসে কিছুটা জল ঢেলে দিল জন্তুটার মুখে। সেদিন প্রায় সারারাত ধরে আমি আর অবিনাশদা সেবাশুশ্রুষা করলাম আমাদের মাপিংগুয়ারি রূপী রামহরিদার। মাঝরাতে একবার জ্ঞান এসে যাওয়ায় দানবটা চিৎকার করে লোহার চেন ছিঁড়ে ফেলার উপক্রম করে। অবিনাশদা তাড়াতাড়ি ল্যাব থেকে একটা কিছু কেমিক্যাল বা ওষুধ নিয়ে এসে শুঁকিয়ে দিয়ে ওটাকে শান্ত করে। ভোররাতের দিক থেকে আস্তে আস্তে নিজের আসল রূপে ফিরতে শুরু করে রামহরিদা। প্রায় সাড়ে ছ’টা নাগাদ প্রথম কথা বলে। আমার দিকে তাকিয়ে সে প্রশ্ন করে, “পুলু দাদাবাবু, তুমি এত সকালে এখানে? সব ঠিক আছে তো?’’
আমি হেসে উত্তর দিলাম,“আর ঠিক! তুমি কাল সারারাত যা খেল দেখালে। আর একটু হলে তো আমায় খেয়েই ফেলতে।’’
***
আজ প্রায় এক মাস হল অবিনাশদা ব্রাজিলের রিওতে গেছে নিজের রিসার্চের কাজে। সঙ্গে করে রামহরিদা কেও নিয়ে গেছে। শেফার্ডের পাঠানো জল খেয়ে রামহরিদার চেহারা আবার আগের মতো হয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু মাংস খাওয়ার স্বভাবটা রয়েই গেছে। রামহরিদা এখন পুরো মাত্রায় আমিষভোজী। তবে গলায় তুলসির মালাটা ঠিকই আছে। এখন রোজ চিকেন, মটন না হলে বাবুর খাওয়াই হয় না। অবিনাশদা একদিন ওকে লুকিয়ে কাঁচা মাছ খেতেও দেখেছে। অবিনাশদার মতে ওকে পুরো ভালো করতে হলে ওই নদীর জল টানা বেশ কিছুদিন খাওয়াতে হবে। তাই রামহরিদাকেও ও নিয়ে গেছে ব্রাজিলে। একটু চেঞ্জও হবে বেচারার, সবে এত বড় ধকল থেকে উঠেছে।
যাওয়ার আগে অবিনাশদা লোক ডেকে নিজের বাগানের ওই ফুলের ঝাড় পরিষ্কার করে গেছে। নিজের ল্যাবের গাছটাকেও নষ্ট করে দিয়ে গেছে। আমাকে এক সেট ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে বলে গেছে মাঝে মধ্যে গিয়ে বাড়িটার একটু দেখাশোনা করতে।
আমি মাঝে দু একবার লোক নিয়ে গিয়ে ঘরদোর ঝাড়পোঁছ করিয়ে এসেছি। কাল সন্ধেবেলাও অফিস থেকে ফেরার পথে একবার গিয়েছিলাম অবিনাশদার বাড়ি। চাবি খুলে ঘরগুলোর একবার তদারকি করে, দোতলায় ওর ল্যাবে এসে দাঁড়ালাম। ল্যাবে সব ঠিকই আছে। দেখলে মনেই হয় না এই সেদিন কী সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটে যাচ্ছিল এই ঘরে। ঘরটায় একটু ভ্যাপসা গন্ধ রয়েছে বলে জানলাগুলো খুলে দিলাম। দক্ষিণের খোলা হাওয়া এসে শরীর জুড়িয়ে দিল। এখনও তেমনভাবে অন্ধকার নামেনি, বাইরেটা আলো-আঁধারি।
আমি জানলার কাছে এসে দাঁড়ালাম। এই জানালা দিয়ে বাগানটা দেখা যায়। হঠাৎ দক্ষিণের হাওয়ার সঙ্গে খুব পরিচিত একটা টকসা মিষ্টি গন্ধ আমার নাকে এসে লাগল, আমি চমকে বাগানের দিকে ফিরলাম। বাগানে এক কোণায় চোখ পড়তেই আমার মেরুদণ্ড দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। সেই আলো অন্ধকার দেখলাম বাগানের এক কোণে যেন অনেকগুলো জোনাকি স্থির হয়ে জ্বলে আছে। আর সেই জ্বলে থাকা আলো গুলোর উপরে উড়ে বেড়াচ্ছে প্রায় গোটা বিশেক কালো রঙের রাক্ষুসে প্রজাপতি।
অবিনাশদা বলেছিল বটে, এই গাছ অঙ্গজ জনন করতে পারে। ফুলের ঝোপ কেটে পরিষ্কার করা হলেও ওর পড়ে থাকা কাটা টুকরোগুলো থেকে ফের গজিয়ে উঠেছে এই শয়তানের ফুল। আর দক্ষিণের হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এর গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে দূর থেকে দূরে, এই শহরের বুকে।
Tags: ইন্টারনেট, কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, জিৎ দত্ত, পূজাবার্ষিকী
দারুণ লাগলো!!
অসাধারণ……. গল্প পড়তে পড়তে দেখি মাপিঙ্গুয়ারী আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে l
আসাধারন
অসাধারণ গল্প।