সত্যান্বেষী – ২২৪৫
লেখক: দেব কুমার বসু
শিল্পী: অঙ্কিতা
‘কী হে টিকটিকি! সকাল সকাল মুখ গোমড়া করে বসে আছ কেন বল দেখি?’
আমার ভ্রাতৃপ্রতিম বন্ধু এবং রুমমেটটির মন মেজাজ দেখছি সকাল থেকেই বেশ খারাপ! অবশ্য গত কয়েকমাস যাবৎ নিও-আটলান্টা শহরের যা সুসময় চলছে তাতে আমার রুমমেটটির মন ভালো না থাকারই কথা! কত আশা করে সেই সুদূর পৃথিবীর কলকাতা থেকে সাত সমুদ্র, তের নদী, এক চাঁদ, তিন গ্রহ পেরিয়ে টাইটানের ‘ক্রাইম ক্যাপিটাল’ নিও-আটলান্টায় এসে থানা গেড়েছিল সে! আর তার কপাল দেখ, গত টাম-এ (টাইটান মান্থ–পৃথিবীর দুই মাস) মাত্র দুটি কেস এসেছে তার কাছে। তা-ও সেসব নেহাতই মামুলি কেস। একটা নেটওয়ার্ক সাবোটাজ, যার ফলে একটা ছোট অফিসের তিন ঘণ্টার ডেটা মুছে যায়। একজন কর্মীকে ছাঁটাই করার প্রতিশোধ নিয়েছিল তার পালিত রোবট! কেসটা সমাধান করতে ওর লেগেছিল সাড়ে চার টর! ওহ, বলা হয়নি, টর হল ‘টাইটানিয়ান আওয়ার’। এক টর প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পৃথিবীর হিসাবে।
অন্যটা একজন ঘুষখোর ভুলোমন উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসারের নিজের স্ত্রীকে দেওয়া উপহারের কথা ভুলে গিয়ে উলটো বিপত্তি! ভদ্রলোক স্ত্রীর গলায় দামী ফেরাস-ট্রিলেটের হার দেখে পরকীয়ার সন্দেহ করেছিলেন। এই কেসটায় অনির্বাণ, মানে আমার রুমমেটের দক্ষিণা পর্যন্ত জোটেনি! প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ট্রিলিজেন শুধুমাত্র ইউরোপার খনিতেই পাওয়া যায়, তাই ফেরাস-ট্রিলেটের গয়নার দাম আকাশছোঁয়া! অনির্বাণ অবশ্য ভদ্রলোককে রীতিমত হুমকি দিয়েছিল যে, একজন সরকারি কর্মচারীর কাছে কী করে এত দামী গয়না কেনার পয়সা আসে সেটাও সে খোঁজ করে দেখবে! ভদ্রলোক রীতিমত হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন!
নিও-আটলান্টায় এসব প্রশ্ন না করাই ভালো! উপরমহলে যোগসাজশ ছাড়া কি অপরাধ এভাবে ফুলে ফেঁপে উঠতে পারে!
গত এক বছরে (টাইটান ইয়ার) অনেক পরিবর্তন ঘটেছে আমাদের টাইটানে! মানুষ প্রথম এখানে উপনিবেশ গড়ে তোলে শূন্য-পূর্ব প্রায় তিন টাইটানিয়ার আগে। মানে পৃথিবীর হিসেবে একশো বছর। তখন থেকে গত এক টাইটানিয়ার আগে পর্যন্ত আমরা পৃথিবীর শাসনেই চলতাম। পৃথিবীতে বোধহয় এখন ২২৪৫ সাল। এক টাইটানিয়ার আগে, মানে পৃথিবীর হিসেবে প্রায় তিরিশ বছর আগে, আমাদের এখানে এক গুরুত্বপূর্ণ বিল পাশ হয় এবং টাইটান স্বায়ত্বশাসন পায়। এরপর থেকে আমরা মোটামুটি নিজেদের মতো করেই আছি। এখন আমরা টাইটান ক্যালেন্ডার (টাইটানিয়ার = ২৯ পৃথিবীবর্ষ) মেনে চলি। যদিও বাকি সামাজিক নিয়মনীতি অনেকটা পৃথিবীর মতোই আছে!
‘একটা কেস পেয়েছি… কিন্তু সেটা এসেছে ‘অর-সি’-দের থেকে। বুঝতে পারছি না হাতে নেব কিনা!’ আনমনা হয়ে উত্তর দিল অনির্বাণ।
‘অর-সি’? আমিও একটু অবাকই হলাম।
এখানে ‘অর-সি’-দের সম্বন্ধে একটু বলে রাখা ভালো। টাইটানের এক লাখ বারো হাজার জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় তিরিশ হাজার অর-সি। অর-সি বা ‘অরিজিনালি চ্যালেঞ্জড’-রা হল সেই সব মানুষ যাদের জেনেটিক স্ট্রাকচার অভিব্যক্তির পক্ষে সুবিধাজনক নয়। অর্থাৎ এঁদের বংশধরদের থেকে উচ্চবুদ্ধির মানুষ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সমাজে তাই এঁরা খুব একটা বেশি সুযোগ-সুবিধা পান না। এঁদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা বেশি। এখন টাইটানের জনসংখ্যা এতই বেশি যে সকলকে সামাজিক সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব নয়। তাই পুলিশের সাহায্য নিতে গেলে পয়সা খরচ করে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। ‘অর-সি’দের বেশ অনেকটা বেশি টাকাই দিতে হয় কারণ এঁরা বেশি ক্ষতিপ্রবণ। সাধারণত, ‘নন-অর-সি’রা, মানে যেমন আমরা, ‘অর-সি’দের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে তুলি না। তবে কিছু সামাজিক সুবিধা এঁরা পেয়ে থাকেন। যেমন ‘সিরাম আপগ্রেড’। প্রতি এক মাস অন্তর (পৃথিবীর হিসেবে) সরকার থেকে বিনামূল্যে উন্নততর সিরাম পলিথিন ক্যাপসুলে বিতরণ করা হয়। টাইটানের জীববিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত গবেষণা করে চলেছেন অবিরাম বদলে যাওয়া ভাইরাসদের থেকে আমাদের বাঁচানোর।
প্রত্যেক মাসে তাই ‘সিরাম আপগ্রেড’ না নিলে মারণরোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়! আমাদের তার জন্য পয়সা খরচ করতে হয়, অথচ ‘অর-সি’রা এটা বিনামূল্যে পেয়ে থাকেন। কারণটা খুবই সহজ। ভোট! ‘অর-সি’দের ভোটাধিকার রয়েছে। তাই তাদের তুষ্ট রাখাটা জরুরি! আজকাল আবার ‘অর-সি’দের একটা নতুন নামে ডাকা হচ্ছে, ‘মাইনরিটি’!
‘অর-সি’দের কেস, মনে হয়, না নেওয়াই ভালো!’, আমি মৃদু আপত্তি জানালাম।
‘অনুকূলবাবুর নাম শুনেছ, অপরাজিত?’, এবার প্রশ্ন এল আমার দিকে।
‘কী ভাবো বলতো আমায়! হতে পারে আমি সরকারি পরীক্ষাগারের নথি সামলাই, তাই বলে অনুকূলবাবুকে চিনব না! তিনি তো ‘অর-সি’দের মধ্যে দৈত্যকূলে প্রহ্লাদ! উনি তো বোধহয় ‘অর-সি’দের জন্য একটা পুনর্বাসন কেন্দ্রও চালান… লোটাস কলোনী! কি তাই তো?’
‘ঠিক তাই! উনিই ডেকে পাঠিয়েছেন। যাবে নাকি?’
‘চল, এমনিতেই আজ ভাবছিলাম ছুটিই নেব।’
আমাদের অ্যান্ড্রয়েড ভৃত্য পুঁটিরামকে কচুরি বানাতে বলে দু’জনে পথে নামলাম। অনির্বাণ ‘উড়ন্ত শাটল’ বিশেষ পছন্দ করে না। আর তা ছাড়া আমাদের এই ৫৫-র ‘গ’, হ্যারিসন রো থেকে অনুকূলবাবুর পুনর্বাসন কেন্দ্র খুব বেশি হলে দুই কিলোমিটার! যেতে ০.১ টরও লাগবে না!
অনুকূলবাবু দেখলাম আমাদেরই অপেক্ষায় ছিলেন। ভদ্রলোকের চেহারাটা আগে ছবিতে দেখেছিলাম, তাই চিনতে অসুবিধা হল না। লম্বা দোহারা চেহারা, মুখে দাড়ি-গোঁফ রয়েছে। বেশ একটা সাধক-সাধক ভাব চোখের তারায়। ইনি যে সজ্জন ব্যক্তি সেটা দেখে আন্দাজ করা শক্ত নয়।
কথাবার্তায় বুঝলাম আমার বন্ধুটি জানিয়েই রেখেছিলেন তিনি আসবেন। অনুকূলবাবু দেখলাম কেজো মানুষ। সরাসরি মূল সমস্যায় চলে গেলেন।
‘অনির্বাণবাবু, আমি পুলিশ ডাকতে পারিনি কারণ পুলিশ আমাদের বৃথাই ব্যতিব্যস্ত করে। ওদের ধারণা আমি এখানে অপরাধীদের আশ্রয় দিই। হ্যাঁ, এটা সত্যি যে আমার পুনর্বাসন কেন্দ্রে এমন কয়েকজন আছেন যারা বিগত জীবনে অপরাধ করেছিলেন। আজ তারা আর সেরকম নয়! কিন্তু পুলিশ ও সমাজের চোখে তারা আজও অপরাধী! আমার ধারণা আপনি পুলিশদের মতো নন।’
আমার বন্ধু মৃদু ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল। আমি মনে মনে হাসলাম। আসার পথেই অনির্বাণ আমাকে বোঝাতে বোঝাতে এসেছে যে কেন ‘অর-সি’দের সমাজে মিশতে দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু লক্ষ্মী লাভের আশায় এখন বাবুর মতিগতি বদলে গেছে!
‘আমাদের এই কেন্দ্রে চাষ আবাদ ও রি-সাইক্লিং-এর তালিম দেওয়া হয়। আমি নিজেই দেখাশোনা করি। আমার সহকারী হিসাবে রয়েছেন আরও তিনজন। একটু পরে তাঁদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। তার আগে সমস্যাটা বলে নিই। আজ থেকে এক টিডে (টিডে মানে পৃথিবীর পনেরো দিনের একটু বেশি) আগে, আমাদের কাছে সিরাম আপগ্রেডের একটা ব্যাচ আসে। প্রতি দুই টিডে অন্তরই ব্যাচ আসে… আমি থাকলে আমি নিয়েনি, নাহলে অশ্বিনী নিয়ে নেয়। অশ্বিনী আমার সহকারী, হিসেব-টিসেব দেখে। আমি না থাকলে ওই-ই সবকিছুর দেখাশোনা করে। সেদিন ব্যাচটার ডেলিভেরি অশ্বিনীই নেয়, নিয়ে যথারীতি সেটা ল্যাবের স্ট্রংরুমে রেখে দেয়।
চার টর পরে সেগুলো বের করে আনা হয় ডিসট্রিবিউশনের জন্য। ব্যাচের সিল খুলতেই দেখা যায় সিরামের পাউচগুলো কোনওভাবে ফুটো হয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি আমি সেগুলোকে ল্যাবে নিয়ে পরীক্ষা করতে বলি পানুকে। পানুর পরিচয় পরে দিচ্ছি। যদি সিরামগুলো নষ্ট না হয়ে যায়, তাহলে অন্তত কিছু মানুষকে হয়তো ডোজ দেওয়া যেত। কিন্তু দেখা গেল, সিরামগুলো নষ্ট হয়ে গেছে শুধু নয়, এক ধরণের বিশেষ প্রোটিন রয়েছে তার মধ্যে যেটা মোটেও মানবদেহের পক্ষে উপযুক্ত নয়! প্রোটিন তো এত কম সময়ে সিন্থেসাইজ হয় না! এ নিশ্চয় ভিতরের কারওর কারচুপি!’, এতক্ষণ কথা বলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন অনুকূলবাবু। একটু জল খেয়ে অনির্বাণের দিকে তাকালেন, হয়তো ভাবছিলেন কোনও প্রশ্ন থাকতে পারে তার।
‘আচ্ছা, আপনার কেন মনে হচ্ছে এটা ভিতরের কারওর কারচুপি?’, সঙ্গত প্রশ্ন করল সে।
কিছুক্ষণ ভেবে নিলেন ভদ্রলোক। হয়তো মনে মনে একটু গুছিয়ে নিলেন ব্যাপারটা।
‘দেখুন, যখন ব্যাচ ডেলিভার হয়, তখন আমাদের একজন, মানে আমি বা অশ্বিনী, ব্যাচের সিল খুলে গুনতি মিলিয়ে নিই। ডেলিভারি শীট অনুযায়ী ডোজ ডিটেলস আছে কিনা দেখেনি, ইত্যাদি। সেই সময় সরকারি একজন লোকও উপস্থিত থাকে। তাই আমি নিশ্চিত ব্যাচটা অশ্বিনী ঠিকঠাকই হাতে পেয়েছিল। অশ্বিনী সেদিন ব্যাচটা নিজেই হাতে করে ল্যাবে নিয়ে যায়। সে নিশ্চয় এত বোকা নয় যে এমন কিছু করবে যাতে সন্দেহ সোজাসুজি তার উপরেই পড়ে! সবাই জানে সেদিন সে-ই ডেলিভারি নিয়েছিল।’
‘তার মানে আপনি বলছেন ল্যাবেই কেউ একজন এই কাজটা করেছে।… আচ্ছা, এর প্রতিফলটা ঠিক কতটা বিপজ্জনক?’, আমি জানতে চাইলাম।
‘মারাত্মক!’, থমথমে মুখে বললেন অনুকূলবাবু, ‘এর মানে হল আগামী দুই টিডে আমার কেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল সব মানুষ… প্রায় সাতশো জন… যাদের সিংহভাগই অর-সি, তারা টাইটানের বেশ কিছু মিউটেটেড ভাইরাসের সহজ শিকার! আরও খারাপ হল, অধিকাংশ সময়েই ভবিষ্যতের আপগ্রেডগুলো আগের আপগ্রেডের উপর নির্ভরশীল হয়। অর্থাৎ যারা ডোজটা এই পেল না, তারা ঠিক কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে তার কোনও নিশ্চিত বিশ্লেষণ এই মুহূর্তে আমাদের কাছেও নেই, বা থাকা সম্ভবও নয়!’
‘তা আপনারা আরও একটা ব্যাচের জন্য আবেদন করলেন না কেন?’
‘এই গবেষণাটা খুবই খরচ ও সময়সাপেক্ষ। সাধারণত উদ্বৃত্ত সরকারের কাছেও বেশি থাকে না! আর নতুন করে তৈরি করতেও ওই এক টিডের মতো সময় লাগে। বলতে পারেন, আমাদের মোক্ষম ঘা দিয়েছে এই ঘটনাটা!’
‘চলুন, আপনার ল্যাবটা দেখে আসি… আর আপনার সহকারী, যাদের কাছে ল্যাবে যাওয়ার উপায় বা কারণ রয়েছে, তাদেরকেও আসতে বলুন।’
অনির্বাণ তার কাজ শুরু করতে চলেছে এবার। আমার খুব বোকা বোকা লাগল ব্যাপারটা, ওই অশ্বিনী লোকটাকে চাপ দিলেই তো মনে হয় সত্যিটা বেরিয়ে আসবে! এতে তদন্তের কি প্রয়োজন!
ল্যাবরেটরিটা একটা লম্বা করিডরের শেষ মাথায়। ঘরটায় দেখলাম খুব সাধারণ চৌম্বকীয় তালা লাগানো! দরজাটা আবার খোলাই ছিল!। অনির্বাণও সেটা দেখে আমার দিকে উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে তাকাল! এখানকার নিরাপত্তার বিষয়টা খুব জোর দেওয়া হয়েছে বলে মনে হল না।
আমরা ভিতরে ঢুকে এলাম। ভিতরে দেখলাম দুজন ভদ্রলোক বসে একটা ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে কিছু দেখছিলেন। আমাদের দেখে দুজনের মধ্যে একজন এগিয়ে এলেও, আরেকজন পুনরায় কাজে মন দিলেন।
‘ইনি হচ্ছেন অশ্বিনী ঘটক… আর অশ্বিনী, এঁরা আমাদের সাহায্য করতে এসেছেন।’, আলাপ করিয়ে দিলেন অনুকূলবাবু।
অশ্বিনী ঘটক হাতজোড় করে মাথা অল্প ঝুঁকিয়ে নমস্কার জানালেন। আমরাও প্রতিনমস্কার জানালাম।
অনির্বাণ চোখের ইশারায় ঘরে লাগানো তাপ-সংবেদী সিসিটিভি ক্যামেরার দিকে নির্দেশ করল। বেশ পুরানো মডেলের জিনিসগুলো। এগুলোয় ছবি ওঠে না, হিটম্যাপ পাওয়া যায়। ফলে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাপারও চোখে পড়ে। ল্যাবরেটরির মতো জায়গায় সাধারণত এসব থাকে না। জেলেই এগুলো শোভা পায়! এগুলো কোনও রেকর্ডিং করে না। কিন্তু কোনও মুহূর্তে ঘরে কোনও জীবিত প্রাণী আছে কিনা জানতে এগুলির কোনও তুলনাই চলে না।
‘উনি?’, দ্বিতীয় লোকটির দিকে এবার দৃকপাত করল অনির্বাণ।
‘ও ঘনশ্যাম! এমনিতে রিসাইক্লিং দেখলেও, ল্যাবে সময় কাটানোটা ওর হবি বলতে পারেন।’, পাশ থেকে বললেন অশ্বিনী ঘটক।
এবার দ্বিতীয় ভদ্রলোক আমাদের বেশ উপেক্ষা করেই বেরিয়ে গেলেন ল্যাব থেকে।
‘উনি বোধহয় বিশেষ মিশুকে নন?’, আমি ফুট কাটলাম।
‘না… আসলে ওর অতীতটা বিশেষ ভালো নয়।’, চাপা গলায় বললেন অনুকূলবাবু।
‘ইনি কি সেই নিষিদ্ধ মাদক সংক্রান্ত কোনও ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে খুন করে….’, জানতে চাইল অনির্বাণ।
‘ঠিকই বলেছেন! প্রায় কোয়ার্টার টাইটানিয়ার আগের ঘটনা, এখনও আপনি মনে রেখেছেন!’, কিছুটা অবাক হয়েছেন অনুকূলবাবু।
‘না, আসলে আমি গত দু-দিন আপনার কেন্দ্রের বেশ কিছু বিশেষ অধিবাসীদের সম্বন্ধে কিছু পড়াশুনা করছিলাম!’
অনুকূলবাবুর মুখের ভাবে বোঝা গেল তিনি বেশ খুশি হয়েছেন আমার বন্ধুর বিচক্ষণতায়!
‘আসুন এদিকে, এবার আপনাদের স্ট্রংরুমটা দেখাই!’, অনুকূলবাবু এগিয়ে গেলেন ঘরের শেষ প্রান্তে।
স্ট্রংরুম মানে একটা সুরক্ষিত ফ্রিজার। বিভিন্ন গাছ, বীজ, ভ্রূণ ইত্যাদি রয়েছে ক্রায়োজেনিক অবস্থায়। যদিও আমি পরীক্ষাগারের নথি সামলাই, এসব বিজ্ঞান-টিজ্ঞান আমার বিশেষ ধাতে সয় না! রাসায়নিকের গন্ধটা মোটেই পোষায় না!
‘এই স্ট্রংরুমের পাসকোড কে কে জানেন?’
‘আমি, অশ্বিনী, ঘনশ্যাম আর পানু।’
‘এক কাজ করুন, আপনি বাকি দুজনকেও ল্যাবের বাইরে অপেক্ষা করতে বলুন। আমি অশ্বিনীবাবুর সঙ্গে একটু কথা বলি। শেষে হয়তো আপনার সঙ্গে আবার কথা বলে নেব।’, অনির্বাণ অশ্বিনীবাবুর দিকে তাকিয়েই অনুকূলবাবুকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বলল। দেখলাম অশ্বিনীবাবু একবার ঢোক গিললেন, তারপর অসহায়ভাবে ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়া অনুকূলবাবুর দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আমাদের অনুকূলবাবু যা বলেছিলেন, অশ্বিনীবাবুকে জিজ্ঞাসাবাদ করে উত্তর মোটামুটি একই পাওয়া গেল। অনির্বাণের মুখ দেখে বুঝলাম সে মোটেই খুশি নয়!
‘আচ্ছা একটা শেষ প্রশ্ন। আপনাদের ল্যাবের দরজা বন্ধ থাকে না, দরজাতেও সাধারণ তালা। স্ট্রংরুমের পাসকোড থাকে চারজনের কাছে। তাহলে ল্যাবের মধ্যে সাধারণ সিসিটিভি ক্যামেরার বদলে তাপ-সংবেদী ইনফ্রারেড ক্যামেরা কেন? এত নিরাপত্তার প্রয়োজন কিসের? এমন কী ঘটে এই ঘরে?’
এই প্রথম হাসলেন অশ্বিনীবাবু।
‘এ ঘরে সেরকম বিশেষ গোপনীয় কিছুই থাকে না। তবে আমরা চাষের ফলন বাড়ানোর জন্য বিশেষ মাইক্রোব বা ব্যাকটিরিয়া নিয়েও কাজ করি। এই তাপ সংবেদী ক্যামেরাগুলোয় সেই সব সূক্ষ্ম জিনিসও ধরা পড়ে। ফলে কেউ যদি কোনও ‘ভায়াল’ এখানে-ওখানে অযত্নে ফেলে রাখে, তাহলে এই ক্যামেরায় তা ধরা পড়ে। আর কোনও কারণ নেই!”
এবার কপালে ভাঁজ পড়ল অণির্বাণের।
‘তার মানে বলছেন যে, এই ঘরেই এমন কিছু মাইক্রোব থাকে যারা হয়তো ওই ব্যাচের সিলের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করতে পারে?’
‘না, তা নয়’, অসম্মতিতে মাথা নাড়লেন অশ্বিনীবাবু, ‘কিন্তু… কেউ হয়তো ব্যাচের সিল খুলে, সেগুলোকে ঢুকিয়ে দিয়ে থাকতে পারে!’
‘কেউ মানে, আপনাদের চার জনের এক জন…’, অণির্বাণের স্বরে এবার দৃঢ়তা!
থতমত খেয়ে গেলেন ভদ্রলোক।
‘না মানে… ঠিক তা নয়… হয়তো ভুল করে…’
‘কে ভুলটা করল?’, এবার আমি চেপে ধরেছি অশ্বিনীবাবুকে।
‘প্লিজ আমাকে ছেড়ে দিন… আমি সত্যি কিছু জানি না! আমি কিছুই করিনি… কেন করব বলুন তো?’
‘জানি অশ্বিনীবাবু! যা বুঝতে পারছি, সাতশো মানুষকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়ার মতো নার্ভ আপনার নেই। কিন্তু কার আছে সেটা বললে ভালো করতেন!’, শীতল স্বরে বলল অনির্বাণ।
ঘনশ্যামবাবু লোকটার সঙ্গে কথা বলাটা মোটেও সহজ হল না। লোকটা কিছুই উত্তর দেয় না। তার একটাই কথা, ‘আমি কিছু জানি না’।
‘একজন শিক্ষক কী করে নিষিদ্ধ মাদক বিক্রি করে, সে ব্যাপারে কিছু জানেন? নাকি এবারও বলবেন আমি কিছু জানি না!’, ভদ্রলোকের চোখে চোখ রেখে মোক্ষম অস্ত্রটা ছাড়ল অনির্বাণ।
এই প্রথম লোকটার ঔজ্জ্বল্যহীন চোখে একটা ঝিলিক খেলে গেল।
‘সে কথা আমি আপনাকে বলব কেন? পুলিশ তো সবই জানে!’, লোকটার গলায় ব্যঙ্গের সুর!
‘প্রথমত, আমি পুলিশ নই! দ্বিতীয়ত, আপনার কেস-ডকুমেন্টে কোথাও লেখা নেই আপনি জনাতিরিশেক ছেলে-মেয়েকে বিনা পারিশ্রমিকে পড়াতেন। এমনকি এটাও লেখা নেই আপনি মাদক বিক্রির প্রতিবাদ করতে গিয়ে বারদুয়েক কুখ্যাত ‘ডন’ জন লেসলি-র দলের লোকের হাতে মারও খেয়েছেন!’, অনির্বাণের কণ্ঠস্বরে অনুকম্পা।
এবার ঘনশ্যামবাবুর মুখ থেকে কাঠিন্যের পর্দাটা সরে যাচ্ছে! ভদ্রলোক চোখটা নামিয়ে নিলেন।
‘অনেক কিছুই জানলেও বলা যায় না, অনির্বাণবাবু!… আমি কিছুই জানি না।’
‘অনেকগুলো মানুষের প্রাণ নিয়ে খেলছি আমরা ঘনশ্যামবাবু, জানলে সত্যিটা বলে ফেলুন!’
‘লড়াই করেই মানুষ এতটা এগোতে পেরেছে, অনির্বাণবাবু। আপনার হাতে ঢাল থাকতেই পারে, কিন্তু হাতে তরবারি না থাকলে সেই ঢাল আপনাকে বাঁচাতে পারবে না! কথাটা মানেন আপনি?’
‘হ্যাঁ, মানি।’
‘ভালো, সবাই মানতে পারেন না! যারা লড়াইটা করেছেন, তারাই পারেন!… আমি এখন আসতে পারি?’
অনির্বাণ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল ভদ্রলোকের দিকে। তারপর অস্ফুটে বলল, ‘ধন্যবাদ… আপনি আসুন!’
পানু জনসন লোকটা বেশ চালাকচতুর। এককালে বিজ্ঞানের ছাত্র ছিল। পড়াশুনার পর সমাজ কল্যাণের হুজুগে যোগ দেয় অনুকূলবাবুর পুনর্বাসন কেন্দ্রে! এঁর মূল কাজ কেন্দ্রের নেটওয়ার্ক দেখাশোনা করা! এখন বেশ মজায় আছে, খায় দায়, এখানকার কাজকর্ম করে আর মাঝে সাঝে জুয়া খেলে। বেশ অকপটভাবেই স্বীকার করল সে কথা।
‘তুমিই সেদিন পরীক্ষা করেছিলে সিরামগুলো!’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ! এক্কেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল প্রোটিনগুলো!’
‘কেমন অবস্থায় ছিল পাউচগুলো?’
‘হে হে… বললে বিশ্বাস করবেন না, একদম ঝাঁঝরা! যেন কেউ সূঁচ দিয়ে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ফুটো করে দিয়েছে সব ক-টা পাউচে!’
‘কোনও রাসায়নিকের প্রভাবে এরকম হতে পারে কি?’
‘মনে হয় না! আর তা ছাড়া সিরামে এক ধরনের বিশেষ প্রোটিন ছিল! রাসায়নিক হলেও সেটা নিশ্চয় জৈব-রাসায়নিক!… ঠিক বুঝতে পারিনি!’
‘স্যাম্পল আছে তোমার কাছে? দেখা যায়?’
এবার মাথা চুলকালো পানু জনসন!
‘না স্যার। সব তো ফেলে দিতে বললেন অনুকূল স্যার!’
‘ফেলে দিলে…!!’, বেশ বিরক্ত হয়েছে অনির্বাণ।
‘অনেক সময় ফেলে দেওয়াটাই লাভজনক হয়ে যায়, স্যার!…’, দেঁতো হাসি হাসল লোকটা, ‘পোকায় কাটা জিনিস কি রাখতে আছে!’
‘কথা হল ওদের সঙ্গে?… কিছু আন্দাজ করতে পারলেন?’, নিজের ঘরের চেয়ারে বসেছিলেন অনুকূলবাবু।
‘কথা হল… এবার আপনাকে কিছু প্রশ্ন করব।’
‘নিশ্চয়, করুন।’, চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন উনি।
‘আপনাদের ল্যাবে গত এক টিডে কেউ ঢোকেনি, আপনারা চারজন ছাড়া! তাই তো?’
‘ঠিক!’
‘আপনাদের ল্যাবে কোনও জৈব-রাসায়নিক নিয়ে কাজ হয়?’
‘বুঝেছি! না, ল্যাবের কোনও রাসায়নিক ব্যবহার হলে, জনসন বা আমি বুঝতেই পারতাম। আমিও পরে পরীক্ষা করেছিলাম!’
‘যদি না, কেউ মিথ্যে বলে থাকেন…’, যেন নিজের সঙ্গেই কথা বলছে অনির্বাণ।
‘সরি! ঠিক বুঝলাম না!’, ভ্রূ কুঁচকোলেন অনুকূলবাবু!
দেখলাম, ঘরের উপরদিকে কোণে কিছু একটা দেখছে অনির্বাণ! এ ঘরেও সেই তাপ-সংবেদী ইনফ্রারেড ক্যামেরা!
‘আশা করি, আপনারা ল্যাবে সকলে দস্তানা পরেই কাজ করেন! সেক্ষেত্রে হাতের ছাপও পাওয়া যাবে না! …বিড়ম্বনা!’, হেসে বলল অনির্বাণ, ‘আপনার উচিত ছিল অন্তত একটা পাউচ রেখে দেওয়া যাতে পরীক্ষা করে দেখা যায়! বুঝলাম না কেন সেগুলো নষ্ট করে ফেললেন! আমাকে ডাকতে দশ টর সময়ই বা নিলেন কেন?’
‘আসলে আমি তখন বুঝতেই পারিনি যে ঘটনাটা এত জটিল হতে পারে! পরে ভেবে দেখলাম, এটা নেহাত ছোটখাটো ঘটনা নয়! তা ছাড়া আমি জানতাম না ওই প্রোটিনগুলোর মানবদেহে বা বীজগুলির উপর কী প্রভাব পড়বে! তাই নষ্ট করে ফেলাই শ্রেয় মনে হয়েছিল!’
‘আপনিও কি মাইক্রোব নিয়ে কাজ করেন?’, ক্যামেরাটা দেখিয়ে বলল অনির্বাণ!
‘কেন বলুন তো!…’, তারপর ক্যামেরাটা দেখে হাসলেন অনুকূলবাবু, ‘না না, আমি মাইক্রো-এনটেমোলজিস্ট! শখ বলতে পারেন। টাইটানে কত অণু-পতঙ্গ আছে জানেন?’
‘আপনাদের এখানে কোনও প্রাক্তন সৈনিক আছেন কি?’
‘সৈনিক…?’, ভাবতে হল অনুকূলবাবুকে!
‘নাহ… সৈনিক… না!’
‘আচ্ছা, এবার একটু বলুন আপনার যদি কাউকে সন্দেহ হয়ে থাকে তার কথা!’, চেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দিল অনির্বাণ।
কিছুক্ষণ মাথা নিচু আর চোখ বন্ধ করে ভাবলেন অনুকূলবাবু।
‘আমার তিন সহকারীর মধ্যে সবথেকে সৎ ও আদর্শবাদী হল ঘনশ্যাম। একসময় ও অপরাধ জগতে জড়িয়ে গেলেও, আজ কিন্তু ওসবের থেকে ও অনেক দূরে। আমাদের কেন্দ্রের প্রতিটি মানুষের সঙ্গে ওর পরিচয় আছে। তারাও ঘনশ্যামকে ভীষণ পছন্দ করে। ইদানীং ও আমাকে বেশ সাহায্যও করে ল্যাবের কাজে। আজকাল আমার কাছে এসে মাইক্রো-এনটেমোলোজি নিয়েও জানতে চায়! আমার মনে হয় না এরকম কিছু ও করতে পারে!’
‘বেশ, এবার অশ্বিনীবাবু…’
‘অশ্বিনী নিতান্তই গোবেচারা ভালোমানুষ! আমাকে ভগবানের মতো ভক্তি করে! না না… ও একাজ করবে না!’
‘পানু?’, চেয়ার ছেড়ে এবার সোজা হয়ে বসল অনির্বাণ।
‘আপনি কি কিছু আন্দাজ করেছেন?’, থমথমে মুখে জানতে চাইলেন অনুকূলবাবু।
‘সে কথায় পরে আসছি… আগে আপনি বলুন…’
‘পানু আমার কাছে আছে প্রায় চার বছর। ছেলেটার মধ্যে বহির্মুখীভাব বেশি হলেও বেশ চটপটে আর চালাকচতুর! তাই আমাদের এখানকার নেটওয়ার্কের দেখাশোনা করা ছাড়াও আরও বিভিন্ন কাজ করে থাকে ও। আজকাল শুনছি কিছু নিষিদ্ধ মাদক চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েছে। এমনকি কেন্দ্রের মধ্যেই নাকি ওসবের ব্যাবসা শুরু করেছে! আমি সেদিন ওকে ডেকে খুব ধমকে দিয়েছি। হয়তো ওকে চলে যেতেও বলতে হতে পারে!’
‘আপনি ওকেই সিরাম পরীক্ষা করতে দিয়েছিলেন ও তারপর পাউচগুলো ফেলে দিতে বলেন, তাই তো?’
‘হ্যাঁ!’
‘পরে এই নিয়ে আপনাদের কোনও কথা হয়েছে?’
আবার নিস্তব্ধতা বেশ কিছুক্ষণের জন্য।
‘না!’, বেশ কড়া গলায় এল উত্তরটা!
‘ঠিক আছে। আসি আজকে… চল অপরাজিত!’, বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল বন্ধুবর, তারপর আমার অপেক্ষা না করেই হাঁটা দিল বাইরের দিকে!
আমি অনুকূলবাবুকে একটা নমস্কার ঠুকে ঘর থেকে বেরোতেই দেখলাম অশ্বিনীবাবু কিছু কথা বলছেন অনির্বাণের সঙ্গে। আমাকে দেখেই থতমত হয়ে উলটো রাস্তা ধরলেন!
‘কী বলছিল তোমায় লোকটা?’, শুধোলাম বন্ধুকে।
‘সবটা বলতে পারল না, তুমি চলে এলে যে! শুধু এটুকু বুঝলাম, উনি অনুরোধ করতে এসেছিলেন আমি যেন তদন্ত না করি!’
বাসায় এসেই শোয়ার ঘরে ঢুকে সটান লম্বা হল সে! হাতমুখ ধুয়ে বসতেই পুঁটিরাম কচুরির থালা দিয়ে গেল! অনির্বাণের দেখলাম সেদিকে খুব একটা মন নেই!
‘কি হলটা কি?’
‘কি হল মানে? সঙ্গেই তো ছিলে! শুনলে না!’, বেশ ঝাঁঝিয়ে উঠল সে! বুঝলাম বাবু থই পাচ্ছেন না!
‘আমার মনে হয়…’, আমি একটু তাকে বুদ্ধি দেওয়ার চেষ্টা করলাম, ‘অশ্বিনীবাবু ছাড়া কেউ একাজ করতেই পারেন না! পানু ছেলেটাকে নেহাত ভোলাভালা বলেই মনে হয়! আর ঘনশ্যামবাবু তো যা বুঝলাম নেহাতই আদর্শবাদী ভদ্রলোক। পরিস্থিতির ফেরে অপরাধীর লেবেল বয়ে বেড়াতে হচ্ছে!’
‘প্রতিটি লোকেরই কাজটা করার সুযোগ আছে! কিন্তু করেছে হয়তো একজনই!’, একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল অনির্বাণ।
‘কেন? ‘হয়তো একজনই’ মানে?… একাধিক লোকও দোষী হতে পারে বলছ!’, আমি বিস্মিত।
‘প্রথমেই আমাদের মক্কেল, অনুকূলবাবু। জনসনকে দিয়ে সব ক-টা পাউচ ও স্যাম্পল ফেলে দিয়েছেন! কোনও প্রমাণ রাখেননি! কেন? ল্যাবরেটরি থেকে মাত্র ত্রিশ হাত দূরে বসে তিনি অণু-পতঙ্গ নিয়ে গবেষণা করেন। জনসনের কথা সত্যি হলে, বলতেই হয়… হয়তো কোনও অণু-পতঙ্গ, অনেকটা পৃথিবীর উইপোকার মতো, সিরামের পাউচগুলি নষ্ট করেছে। তারপর নিজেরাই ডিসলভড হয়ে গেছে সিরামে উপস্থিত প্রোটিনের জন্য! সেই প্রমাণ নষ্ট করতেই তড়িঘড়ি সব পাউচ ফেলে দিয়েছেন অনুকূলবাবু। পানুর বলা ‘পোকায় কাটা’ কথাটা আমার ধারণা, আংশিক হলেও সত্যি! পানু জনসন কি কিছুই বোঝেনি!’
‘আচ্ছা, বুঝলাম! অশ্বিনীবাবুরও তো যথেষ্ট সুযোগ ছিল সিরামের পাউচগুলি নষ্ট করার!’, বললাম আমি।
‘অশ্বিনীবাবু অবশ্যই প্রথম সন্দেহভাজন। কিন্তু সেটা তো উনি নিজেও বোঝেন! এত বড় বোকামি করবেন বলে মনে হয় না! না, উনি মোটেই অত বোকা নন! কিন্তু উনি জানেন কে দোষী… সেটা উনি বলবেন না!’
‘কেন?’
‘শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা অথবা ভয় কিংবা অনুকম্পা!’
‘ঘনশ্যাম দাস… তার তো এমনিতেই ক্রিমিনাল ব্যাকগ্রাউন্ড রয়েছে!’
‘সেজন্যেই তাকে ফাঁসানো সহজ! এদিকে সে আবার কোনও এক লড়াকু মানুষের কথা বলতে চাইছে!’
‘ওহো, সেজন্যেই তুমি সৈনিকের কথা বলছিলে?’, এবার আমি বুঝতে পারলাম!
‘হুম… আর আমাদের শেষ সন্দেহভাজন, পানু! পরিষ্কার অতীত, কিন্তু অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ!’
‘অনিশ্চিত কেন?’
‘এই জন্যেই বলি অপরাজিত, খবরের সাইটের থেকে চাকরির সাইট বা বিপণনের সাইট অনেক বেশি আকর্ষক!… এই দেখ…’, বলে সে তার কমিউনিকেটরে একটা সাইট প্রজেক্ট করল!
বিজ্ঞাপনটা দেখে তাজ্জব বনে গেলাম!
‘লোটাস কলোনীতে নেটওয়ার্ক অ্যাডমিনিস্ট্রেটার লাগবে! তার মানে পানুর সঙ্গী, নাকি বদলি?’
‘আমার ধারণা, দ্বিতীয়টাই ঠিক!’, ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হাসল অনির্বাণ!
‘তার মানে… প্রতিশোধ!’
‘অথবা, ব্ল্যাকমেল…’
‘ব্ল্যাকমেল!!’, আমি আবার অবাক।
‘ইয়েস স্যার!… আমার ধারণা আগামী কয়েক টর-এ অনেক কিছু ঘটবে আমাদের লোটাস কলোনীতে…!’
আমি বেশ উত্তেজনা অনুভব করছি এখন!
‘একটু বেরতে হবে, বুঝলে… কিছু লোকের থেকে কিছু খবর লাগবে!’, বাইরে যাওয়ার পোশাক হাতে নিয়ে বলল অনির্বাণ।
প্রায় দুই টর পরে ফিরল অনির্বাণ। মুখে চওড়া হাসি।
‘কী ব্যাপার… মন যে দেখছি খুব খুশি, দোষী ধরে ফেললে নাকি?’, শুধোলাম আমি!
‘না, তা নয়! তবে এখন রহস্যটা মোটের উপর ধরে ফেলেছি।… কিন্তু কিছু একটা না ঘটলে হাইপোথেসিসটা ঠিক থিয়োরিতে পরিণত করা যাচ্ছে না!’
‘কিছু ঘটবে বলছ?’
‘হ্যাঁ! সেই চেষ্টাই করছিলাম।… অশ্বিনীবাবুকে একটু বাজিয়ে দেখে এলাম!’
‘মানে… একটু খুলে বল দেখি!’, আমি খাটের উপর সোজা হয়ে বসলাম!
‘না হে… এখন নয়! তুমি লোকটা মোটেই সুবিধের নও! প্ল্যানটা কাজ না করলে পরে খোঁটা দেবে!’
বুঝলাম এখন আর বাবু মুখ খুলবেন না!
টাইটানের একদিন পৃথিবীর হিসেবে পনেরো দিনের একটু বেশি! মানুষের শরীর, হাজার হোক পৃথিবীর মানুষেরই বংশধর তো আমরা, অত দিন জেগে থাকতে পারে না! তাই মোটামুটি চার-পাঁচ টর অন্তর আমরা ঘুমিয়ে নিই, দুই-তিন টরের জন্য! সেরকমই একটা ছুটির আমেজের সুখনিদ্রায় বিভোর হয়ে আছি, এমন সময় বন্ধুবর বাদ সাধলেন!
‘ওহে কুম্ভকর্ণ, উঠে পড়! লোটাস কলোনিতে হুলুস্থুলু কাণ্ড! অশ্বিনীবাবু পানুকে খুন করতে গিয়েছিলেন! পানু যদিও মরেনি, কিন্তু অবস্থা আশংকাজনক! অনুকূলবাবু জরুরি তলব করেছেন!’
রাস্তায় নেমে একটা উড়ন্ত শাটল ধরলাম! এগুলিতে ভাড়া বেশি হলেও বেশ সময় বাঁচে! আড়চোখে দেখলাম অনির্বাণের মুখ চকচক করছে!
‘ঝেড়ে কাশো তো বন্ধু! তোমার প্ল্যান কাজ করেছে, তাই না!’, এরকম ঢাক-ঢাক-গুড়-গুড় আমার মোটেই সহ্য হয় না!
‘আর্ধেক করেছে! আর্ধেক বাকি… ধৈর্য ধর বন্ধু!’, হেসে উঠল অনির্বাণ, ‘শুধু এটুকু বলে রাখছি, লড়াই শুধু সৈনিকরাই করেন না, সাধারণ মানুষও প্রতিনিয়ত লড়াই করে থাকে!’
আর কোনও কথা বলল না সে বাকি রাস্তাটা!
লোটাস কলোনির গেটের সামনে থেকেই আজ বিস্তর ভিড়! আমাদের দেখে চাপা গুঞ্জনের আওয়াজটা খানিক বেড়ে গেল!
অনুকূলবাবু নিজে এগিয়ে এসে ভিড় সরিয়ে আমাদের তাঁর ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালেন। ভদ্রলোককে বেশ বিধ্বস্ত লাগছে আজকে!
‘আর আমার কিছু মাথায় আসছে না, অনির্বাণবাবু। এবার পুলিশ ডাকতেই হবে! অশ্বিনী বলছে ও-ই নাকি সিরামও নষ্ট করেছে!’
‘জানি অনুকূলবাবু! আর এটাও জানি, উনি মিথ্যে বলছেন! উনি একজনকে আড়াল করতে চাইছেন! যাঁকে উনি ঈশ্বরের মতো ভক্তি করেন!’, নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে চলল অনির্বাণ!
‘কি বলছেন! কার কথা বলছেন আপনি?’, অধৈর্য হয়ে উঠেছেন অনুকূলবাবু।
‘আপনার!’
চমকে উঠলেন অনুকূলবাবু!
‘কীসব বলছেন আপনি! আমাকে আড়াল করতে চাইছে অশ্বিনী! কেন? আমি কী করেছি?”
‘আমি তো বলিনি আপনি করেছেন! কিন্তু সত্যি গোপন আপনিও করেছেন! বলুন তো, কী ছিল ওই নষ্ট হয়ে যাওয়া সিরামে?’
কাঁপতে কাঁপতে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লেন অনুকূলবাবু।
‘বিশ্বাস করুন! আমি কিছু করিনি!… আপনি সেদিন ঠিকই সন্দেহ করেছিলেন!… সিরামে একধরনের বিশেষ প্রোটিন ছিল যা পাওয়া যায় এক রকম অণু-পতঙ্গে!… একরকম উইপোকা বলতে পারেন! আমার কাছে রয়েছেও কিছু স্যাম্পল… এই ঘরেই!… তাই আমি সেদিন ফেলে দিতে বলেছিলাম সব ক-টা পাউচ! আমি জানতাম সন্দেহ আমার উপর আসবেই…’
‘ঠিক একই সন্দেহ করেছিলেন অশ্বিনীবাবু এবং পানু জনসন। আর আমার ধারণা তার পরেই পানু আপনাকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করে!… পরে আমার সঙ্গে অশ্বিনীবাবুর আরও একবার কথা হয়। উনি আপনার ও পানুর উত্তেজিত কথাবার্তা বাইরে থেকে শুনতে পেয়েছিলেন।’
‘হ্যাঁ, এরকম কিছু একটা ঘটেছিল চার-পাঁচ টর পরে!’
‘ঠিক তাই’, পাকা রহস্যভেদীর মতো তখন চিত্রনাট্যের হাল ধরেছে আমার বন্ধুটি!
‘আপনার প্রতি অসীম শ্রদ্ধা অশ্বিনীবাবুকে বাধ্য করে পানুর উপর প্রাণঘাতী আক্রমণ চালাতে! অবশ্য, তার জন্য আমার উস্কানিও বেশ কিছুটা দায়ী!’
‘কী বলছ তুমি!’, আমিও চমকে উঠেছি অনুকূলবাবুর মতোই!
‘প্রকৃত অপরাধীকে ধরার আর কোনও উপায় আমার মাথায়ও আসছিল না! পাকা চাল চেলেছিল লোকটি!… তবে এবার মনে হয়, তিনি নিজেই ধরা দেবেন!’, বলে চলল অনির্বাণ, ‘ঘনশ্যামবাবুকে একবার এ ঘরে ডেকে পাঠান অনুকূলবাবু, আর আপনারা বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করুন।’
লোটাস কলোনি থেকে হেঁটে ফেরার পথেও আমার ধন্দ কাটছিল না!
‘সত্যি এখনও বুঝতে পারনি তুমি! এই সহকারী নিয়ে আমি বিখ্যাত গোয়েন্দা হব কি করে বলতো!’
‘বাজে বোকো না! ঘনশ্যামবাবুকে তোমার সন্দেহ হল কী করে?’
‘সত্যি বলতে কি, ভদ্রলোক এত সরলভাবে আড়াল করেছিলেন নিজেকে যে প্রথমে আমার সন্দেহই হয়নি! কিন্তু অতি বড় চালাকেরও ভুল হয়! প্রথম দিন কথার শেষ দিকে উনি বলে ফেললেন যে শুধু ঢাল থাকলেই প্রাণ বাঁচে না!… খুব দামি কথা! এবং এটাও বললেন যে, যে লড়াই করেছে, সেই এ কথার মানে বুঝবে!
আসলে এই লোকটি চিরকাল নিজের আদর্শের প্রতি নিষ্ঠাবান ছিলেন! তিনি প্রথম জীবনে, ‘অর-সি’-দের অধিকারের দাবিতে আন্দোলন করেছেন! তাদের জীবনে মাদকের অভিশাপের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন! এসবই খাঁটি সত্য!
কিন্তু গত কয়েকমাস ধরে তাঁর মনে হচ্ছিল এই সিরাম আপগ্রেডের ফলে মানুষের স্বাভাবিক ইমিউনিটি কমে আসছে! পৃথিবীতে বিভিন্ন ভাইরাস, ব্যাকটিরিয়ার সঙ্গে লড়াই করেই মানুষ বেঁচে এসেছে! এতে মানুষের ইমিউনিটি বেড়েছে! কিন্তু টাইটানে যেভাবে কৃত্রিম ইমিউনিটি দেওয়া হচ্ছে সেটা তাঁর মনঃপূত হচ্ছিল না! তাঁর এটাও মনে হচ্ছিল, ‘অর-সি’দের জেনেটিক ইভলিউশনের পরিপন্থী এই সিরাম আপগ্রেড!
তাই তিনি ঠিক করেন অন্তত তাঁর ক্ষমতা অনুযায়ী তিনি প্রতিরোধ করবেন এই অপচেষ্টার! অনুকূলবাবুর সঙ্গে কাজ করে এই বিশেষ অণু-পতঙ্গ সম্বন্ধে জানতে পারেন তিনি। এরপরেই তাঁর মাথায় আসে এই প্ল্যানটা!
কিন্তু এবার ফল হয় উলটো! অশ্বিনীবাবু ও পানুর সন্দেহ হয় যে অনুকূলবাবুই দায়ী! পানু চেষ্টা করে তাঁকে ব্ল্যাকমেল করার, কিন্তু লাভ হয় না! এদিকে অশ্বিনীবাবু লোটাস কলোনি ও অনুকূলবাবুকে বাঁচানোর জন্য পানুকে খুন করে নিজের উপর সব দায় নিতে প্রস্তুত হন!
এই ঘটনাটা না ঘটলে, আমার পক্ষে কিছুতেই ঘনশ্যামবাবুকে ‘ব্রেক’ করা সম্ভব হত না! লোকটা আসলে খারাপ তো নয়! তাঁর বৈপ্লবিক আদর্শ কিছুক্ষণের জন্য তাঁর বিচারবুদ্ধিকে রাহুর মতো গ্রাস করেছিল মাত্র! যে মুহূর্তে আমি তাঁকে বোঝাতে পারলাম যে, তিনি যা করলেন তাতে বেশ কিছু নিরপরাধীর সাজা হওয়া নিশ্চিত, তখনই তিনি স্বীকারোক্তি দিতে সম্মত হলেন!’
এরপর কিছুক্ষণ আমরা দুজনেই চুপচাপ হাঁটলাম! বিপ্লব সত্যি জটিল ব্যাপার আর বিপ্লবীদের মনঃস্তত্ত্ব আরও জটিল!
বাড়ি এসে এক প্রস্থ খাওয়া-দাওয়া সেরে অফিসে বেরনোর তাল করছি, এমন সময় দেখি আমার গোয়েন্দা বন্ধু মুখে বাঁকা হাসি নিয়ে তার ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে!
‘আমার বাবা একটা ভিডিয়ো মেল পাঠিয়েছেন। তাতে একটা তথ্য আছে। তোমায় বলেছিলাম কি তিনশো বছর আগে পৃথিবীতে আমার এক পূর্বপুরুষ সত্যান্বেষণের জন্য বিখ্যাত ছিলেন?’
‘হ্যাঁ, বলেছিলে বটে… কী যেন নাম ছিল তাঁর?’
‘তাঁর নামটা অত জরুরি নয়, জরুরি তাঁর সহকারীর নামটা!’
‘কেন বল তো?’, বেশ অবাক হলাম আমি!
‘তাঁর সহকারীর নাম ছিল অজিত, তোমার অপরাজিত! আবার দেখ, তাঁর আর আমার নামের অর্থেও মিল! সেটা অবশ্য পারিবারিক প্রথা বলতে পার!’
এমন সময় ‘ডিং ডং’ শব্দে ডোরবেল বেজে উঠল।
পুঁটিরাম দরজা খুলতেই এক ভদ্রলোক বেশ অপ্রস্তুত ভঙ্গীতে বলে উঠলেন, ‘ইয়ে… নমস্কার… আমি… মানে… এই কিছুক্ষণ আগে কমিউনিকেটরে একটা মেসেজ পোস্ট করেছিলাম! খুব সমস্যায় আছি…’
‘নতুন মক্কেল!’, চাপা গলায় কথাটা বলেই এক লাফে দরজার সামনে গিয়ে উপস্থিত হল আমার বন্ধুটি।
‘ভিতরে আসুন! আমাকে আপনার সমস্যা স্বচ্ছন্দে বলতে পারেন! আমিই… অনির্বাণ বক্সী!’
Tags: অঙ্কিতা, কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, ডিটেকটিভ সায়েন্স ফিকশন, দেব কুমার বসু
সাধু-সাধু! শরদিন্দু জীবিত থাকলে এই লেখা পড়লে আশীর্বাণী বর্ষণে কুণ্ঠিত হতেন না নিশ্চয়। অনির্বাণ বক্সী’র পরবর্তী সত্যান্বেষণের অপেক্ষায় রইলাম।
ধন্যবাদ!!
গল্পটা খুবই ভালো, কিন্তু ঘণ্টা, দিন আর মাসের হিসেবগুলো কি খুব জরুরি ছিল?
ঐ আর কি😒…
darun….Junir Bakshir aro kahini chai…
1ta prosno! Byomkesh ar Anirban er namer mane ki eki?naki ota Ajit o Aparajit er namer mane bola hoyechhe?
Dutor manei surjo…
এটা ব্যোমকেশ বক্সী না?