সবুজ মানুষ
লেখক: সুদীপ দেব
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
“চুলে কি রঙ করেছ?”
সাতসকালে গিন্নির প্রশ্নটা শুনে শ্যামলবাবুর মেজাজ গেল সপ্তমে চড়ে। শ্যামলবাবুরা বংশানুক্রমে টাকের ধারক ও বাহক। মাত্র বত্রিশ বছর বয়সেই চকচক করছে জটায়ুর মতো মাথাজোড়া টাক। ঘাড় ও কানের ওপর যে ক’গাছা চুল বিশ্বাসঘাতকের মতো টিমটিম করছে সেগুলি নিয়েই সকাল সন্ধ্যে ঝাড়া কুড়ি মিনিট সময় অতিবাহিত করেন। কানের ওপরের চুল দৈর্ঘ্যে ফুটখানেকের মত হয়েছে। সেগুলি অসামান্য দক্ষতার সঙ্গে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বাকি মরুভূমির অংশটা ঢাকেন।
তবে তাঁর একটাও চুলে পাক ধরেছে একথা কেউ বলতে পারবে না। তাই কলপ করার কোন প্রশ্নই ওঠে না। আর তিনি একালের ছেলে ছোকরাদের মতো চুলে সোনালি-বেগুনী রঙ করবেন নাকি! সেইজন্যই গিন্নি মণিমালার এই বেমক্কা রসিকতায় বেশ বিরক্ত হলেন শ্যামলবাবু।
তবে দ্বিতীয় ধাক্কাটা খেলেন দাড়ি কাটার সময় আয়নার সামনে নিজের মুখটা চোখে পড়তে। মণিমালার কথাটা মনের অবচেতনে ছিলই, তাই চুলের দিকে নজর যেতে তাঁর বেশ অবাক লাগল। সত্যিই চুলে বেশ একটা সব্জে আভা লক্ষ্য করলেন।
অফিসে মজুমদারবাবু একবার চোখ মটকে বলে গেলেন, “ভায়ার মনে বেশ রঙ ধরেছে দেখছি। সেটা চুলেই প্রকাশ পাচ্ছে।”
টিফিনের সময় ওয়াশরুমে গিয়ে খেয়াল করলেন সবুজ রঙ-টা যেন আরো স্পষ্ট হয়েছে।
লাঞ্চে ভাত আনেন শ্যামলবাবু। আজ ভাতের সঙ্গে তাঁর প্রিয় ট্যাংরা মাছের ঝাল ছিল, কিন্তু খেতে বসে দেখলেন মাছটা খেতে ইচ্ছে করছে না। অগত্যা সবজি দিয়ে অল্প একটু খেয়েই উঠে পড়লেন।
সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ফিরে মণিমালাকে বললেন “শরীরটা ভাল লাগছে না, ঘুম ঘুম পাচ্ছে। রাত্রে কিছু খাবো না। আমি শুয়ে পড়ছি, আমাকে আর ডেকো না।”
মণিমালা তাঁর দিকে বেশ কিছুক্ষণ খর দৃষ্টিতে তাকিয়ে কপালে হাত দিয়ে বললেন, “নাহ, জ্বরটর তো আসে নি। তবে তোমায় দেখেও ঠিক ভাল লাগছে না, কেমন কালো কালো লাগছে। ঠিক আছে, শুয়ে পড়ো।”
শ্যামলবাবু এমনিতে বেশ বেলা করে ঘুম থেকে ওঠেন। শরীরটা ভাল নেই বলেই বোধহয়, ভোরবেলা ঘুম ভেঙে গেল। রাত্রে কিন্তু বেশ গাঢ় ঘুম হয়েছে। তাই আর বিছানায় শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করল না। মণিমালা জোরে জোরে নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। শ্যামলবাবু দরজা খুলে বাইরে এলেন।
তাঁদের বাড়িটা কলকাতার দক্ষিণ শহরতলিতে। এদিকে এখনো তেমন উঁচু উঁচু কংক্রিটের জঙ্গল গড়ে ওঠে নি। আশেপাশে প্রচুর গাছপালাও আছে। তাঁদের বাড়িটাই তো চার কাঠা জমির ওপর বেশ বাগান টাগান নিয়ে তৈরি। শ্যামলবাবুর বরাবরই গাছপালার শখ। তাই ফাঁকা জমিটুকুতে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু অনেকরকম ফলের গাছ লাগিয়ে রেখেছেন, এছাড়া মরশুমি সবজির চাষও করেন। একটা সিমগাছ লতিয়ে তাঁদের একতলা বাড়ির ছাদে উঠে গেছে। ছাদের ওপর বেঁধে দেওয়া মাচায় অনেক ছোট ছোট সিমও ধরেছে।
বাগানের নৈঋত কোনটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ওখানে শ্যামলবাবুর সবথেকে প্রিয় গাছটা ছিল। একটা বকুল গাছ। গাছটা তাঁর মায়ের হাতে লাগানো। দশ বছর হয়ে গেল মা আর নেই। কিন্তু ওই গাছটার গায়ে হাত বুলোলে শ্যামলবাবু যেন মায়ের স্পর্শ পেতেন।
নভেম্বরের সকাল, বাতাসে বেশ হিম হিম ভাব। অনেকদিন পর ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে শরীর আর মন দুটোই বেশ উৎফুল্ল লাগছে। রাত্রে খাওয়া হয় নি, বেশ খিদে খিদেও পাচ্ছে। দিগন্তে উদিত সূর্যের প্রথম আলো শ্যামলবাবুর গায়ে এসে পড়তেই যেন শরীরে শিহরণ খেলে গেল।
বেশ জলতেষ্টা পাচ্ছে। কিন্তু শীতের সকালের রোদ্দুরটা ছেড়ে ঘরে যেতেও ইচ্ছে করছে না। গাছে জল দেওয়ার জন্য রাখা বাইরের কলটা খুলে আঁজলা করে বেশ কিছুটা জল খেয়ে নিলেন।
“কি হে ভায়া, সাতসকালে ট্যাঙ্কের নোংরা জল খাচ্ছ কেন?”
প্রফেসর বিপিন চাটুজ্জের গলা শুনে শ্যামলবাবু আকাশপানে চেয়ে দেখলেন পাশের বাড়ির ছাদ থেকে প্রফেসরসাহেব গলা বাড়িয়ে তাঁকে লক্ষ করছেন।
“আপনি তো এই সেদিন এ পাড়ায় এলেন। ছোটবেলায় তো আমরা পুকুরের জলও খেতাম। এইসব ওয়াটার পিউরিফায়ার তো সব কালকের গল্প। তার আগে সিমেন্টের ফিল্টার ছিল একটা। তারও আগে এই বাড়ির দু’কিলোমিটারের মধ্যে কোন টিউবওয়েলও ছিল না।” শ্যামলবাবু বেশ লাজুক হেসে এগিয়ে এলেন।
“তা না হয় হল, কিন্তু এখন তো বাপু হোলির সময় নয়। অমন সঙের মত সবুজ রঙ মাখার কী হল সেটা বুঝিয়ে বলবে একটু?”
শ্যামলবাবু চমকে নিজের শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তাঁর বাদামী ত্বকের ওপর শরীরের লোমগুলি সব কচি কলাপাতার রঙ ধারণ করেছে। তাই মনে হচ্ছে লোমশ হাতটাই সবুজ হয়ে গেছে। এবার রীতিমত ভয় পেয়ে গেলেন তিনি। ছুটে গিয়ে কল চালিয়ে দিয়ে তার নিচে হাতটা রাখলেন। জলের ধারার মধ্যে হাতটা ঘষতে লাগলেন, কিন্তু সবুজ রঙ ফিকে হল না।
“জল দিয়ে ধুলে কী উঠবে? আজকালকার রঙ সহজে উঠতে চায় না। সব জিনিসে ভেজাল। কিন্তু হোলির রঙ দিনে দিনে আরো জবরদস্ত হচ্ছে হে।”
কলের পাশে একটা সাবান রাখা ছিল। সাবানটা নিয়ে হাতে ঘষতে ঘষতে শ্যামলবাবু এবার বেশ বিরক্তির সঙ্গে বললেন, “আহ। খামোকা রঙ মাখতে যাব কেন? কাল দেখছিলাম মাথার চুলগুলো সবুজ, আজ দেখছি গায়ের লোমগুলো সবুজ হয়ে গেছে। এ তো সাবান দিয়ে ঘষেও যাচ্ছে না। কী রোগ এসে বাসা বাঁধল বলুন তো প্রফেসরসাহেব?”
“বলো কী হে! সবুজ মানুষ! দাঁড়াও দাঁড়াও, আমি আসছি এক্ষুনি।”
২
বছর চারেক হল প্রফেসর বিপিন চাটুজ্জে শ্যামলবাবুদের পাশে বাড়ি করে এসেছেন। সেই সঙ্গে এই পাড়ার শেষ ফাঁকা জমিটারও শূন্যস্থান পূরণ হয়ে গেছে। বিকেলের রোদটা আর বাগানে এসে পড়বে না ভেবে প্রথমটায় শ্যামলবাবুর বেশ মন খারাপ ছিল। কিন্তু প্রফেসরসাহেবের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর সেই খেদ আর অবশিষ্ট নেই।
বয়সে বিপিন চাটুজ্জে তাঁর থেকে কুড়ি বাইশ বছরের বড় হলেও আলাপ হওয়ার দিন কয়েকের মধ্যেই একদম বন্ধুর মত মিশে গিয়েছিলেন। অবিবাহিত ভদ্রলোক বিদেশে কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ছিলেন। শেষ জীবনটা নিজের মত করে গবেষণা নিয়ে কাটাবেন বলে দেশে ফিরে এসেছেন। ছ’কাঠা জমিটায় শোয়ার-বসার-রান্নাঘর বাদে দুটি বিশাল বিশাল ল্যাবরেটরি বানিয়েছেন। শ্যামলবাবু বেশ কয়েকবার সেসব দেখেছেন কিন্তু তাঁর স্কুলের ল্যাবরেটরির কথা মনে পড়া ছাড়া আর কোন কিছু বোঝার ক্ষমতা হয় নি।
“কী রোগ, বা আদৌ কোন রোগ কিনা তা বলার মত সময় এখনো আসে নি।”
তাঁর গায়ের লোম ও চুলের রঙ বেশ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে প্রফেসরসাহেব তাঁকে ল্যাবরেটরিতে নিয়ে এসেছেন। এখানেও বেশ কিছুক্ষণ আতস কাঁচ ও আরও কিসব দূরবীক্ষণ না অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে দেখলেন। আদ্যোপান্ত চুপচাপ থেকেছেন শ্যামলবাবু। অবশেষে প্রফেসরসাহেব তাঁর কাজের লোকের আনা দুকাপ চা-এর এককাপ তাঁকে দিয়ে নিজে এককাপে চুমুক দিতে শ্যামলবাবু আবার তাঁর সেই পুরনো প্রশ্নটা করলেন, “কী রোগ বলে মনে হল? ডাক্তার দেখাতে হবে?”
চায়ের কাপে আরেকটা লম্বা চুমুক দিয়ে প্রফেসরসাহেব আবার বললেন, “আর ডাক্তার তো তোমার কথা বিশ্বাসই করবে না। তোমার অন্য কোন শারীরিক সমস্যা নেই, শুধু গায়ের রঙ ইয়ে চুলটুলগুলো সবুজ হয়ে যাওয়া…ভাববে রঙ করে এসে মস্করা করছ।”
“তাহলে উপায়?”
“শোনো হে মেডিক্যালে মাস্টার ডিগ্রি আমারও আছে। আরও যেসব আছে সেগুলো নাহয় নাই বা শুনলে। তবে যেটুকু বুঝেছি, তোমার মত এমন কেস পাওয়ার জন্য গবেষকেরা হাপিত্যেশ করে বসে থাকে। আপাতত তোমার যদি আপত্তি না থাকে কিছু প্যাথলজিক্যাল টেস্ট করতে হবে। তেমন কিছু নয়, সাধারণ জ্বর-জ্বারিতে যেমন রক্ত স্টুল ইউরিন দিতে হয় আর কি।”
“আপত্তি আর কিসের, রোগটা তো ধরা পড়ুক।”
“আর ইয়ে কিছুটা চুল আর গায়ের লোম কেটে নেব। যদি কিছু মনে না করো।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্যামলবাবু বললেন, “নিন, চুলটা একটু কম করে কাটবেন। ইয়ে মানে টাকটা ঢাকতে হয় তো।”
প্রফেসরসাহেবের বাড়ি থেকে ফেরার সময় একবার বাজার ঘুরে এলেন শ্যামলবাবু। কালো কলপ কিনে আনতে হল। অফিসে তো আর সবুজ মানুষ হয়ে যাওয়া যায় না।
বিকেলে অফিস থেকে ফেরার পর টিফিন বাক্সটা খুলে মনিমালার ভুরূ কুঁচকে গেল।
“আজ কি বাইরে খেয়েছ?”
“বাইরে খাব? কেন?”
“তাহলে টিফিন যেমন সাজিয়ে দিয়েছিলাম তেমনি আছে যে?”
“ওহ ভুলে গেছিলাম!”
“আশ্চর্য! লোকে খেতে ভুলে যায়? খুব কি কাজের চাপ নাকি গো? খিদে পায় নি?”
“হুম।” ছোট্ট করে উত্তর দিলেন শ্যামলবাবু।
“রাতে তাহলে তাড়াতাড়ি খেয়ে নিও।”
“নাহ, কিছু খাব না। ঘুম পাচ্ছে খুব। এক বোতল নুন চিনির সরবত করে দাও তো।”
শ্যামলবাবুর আজ সারাদিন কিছু খেতে ইচ্ছে করে নি। তবে অফিসের পিওনকে পাঠিয়ে ফুটপাথের সরবতওলার কাছ থেকে বেশ কয়েকবার ঠাণ্ডা নুনের সরবত আনিয়ে খেয়েছেন। খালি নুন আর জল খেতেই ইচ্ছে করছে, ব্লাড প্রেশারটা একবার মেপে নিতে হবে কাল।
রাত একটা বাজে। নানা দুশ্চিন্তায় মণিমালার ঘুম আসছে না। পাশেই শ্যামলবাবু অকাতরে ঘুমচ্ছেন। দক্ষিণের জানালা দিয়ে পূর্ণিমার চাঁদের আলো এসে পড়েছে তাঁদের বিছানার ওপর। পর্দাটা টেনে দেওয়ার জন্য বিছানা থেকে নেমে মণিমালা গেলেন জানালার কাছে।
বাগানের দক্ষিন-পশ্চিম কোণের দিকে চোখ যেতেই মণিমালার বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। ওখানে ছিল সেই বকুল গাছটা। গত সপ্তাহে ঝড়বৃষ্টির সময় গাছটায় বাজ পড়েছিল। বাজপড়া গাছ বাড়িতে রাখতে নেই, তাই কেটে ফেলা হয়েছে। স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেছে গুঁড়ির অংশটুকু। কাণ্ডটাও পড়ে আছে বাগানের এক পাশে।
কিন্তু বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে মণিমালা দেখলেন, গত পনেরো বছর যেমন দেখে আসছেন ঠিক তেমনই সেখানে ডালপালা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে বকুল গাছটা। উত্তরে হাওয়ায় অল্প অল্প পাতাগুলি নড়ছে। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় অন্য সব বড় গাছের ছায়া পড়লেও বকুল গাছটার কোন ছায়া পড়ে নি মাটিতে। গাছের নিচে জ্যোৎস্না খেলা করছে।
ভয়ে জানালা থেকে পিছিয়ে এলেন মণিমালা। চিৎকার করতে গিয়ে দেখলেন গলা দিয়ে কোন আওয়াজ বেরোচ্ছে না তাঁর। ঘুমন্ত শ্যামলবাবুকে বেশ জোরে জোরে ধাক্কা মারলেন, কিন্তু শ্যামলবাবু নিঃসাড়ে পড়ে রইলেন অচেতনের মতো।
মাথার কাছে টেবিলে রাখা বোতল থেকে জল খেয়ে কিছু পরে একটু ধাতস্থ হলেন মণিমালা। মনে সাহস সঞ্চয় করে দরজা খুলে বাগানে এলেন। কিন্তু এখন আবার সব স্বাভাবিক। বকুল গাছের কাটা গুঁড়িটাই শুধু পড়ে আছে – যার ওপর সারা সন্ধ্যে শ্যামলবাবু বসে থাকছেন এই ক’দিন।
হঠাৎ মণিমালার মাথায় চমক খেলে গেল। শ্যামলবাবুর চুল আর গায়ের লোমের রঙ সবুজ হয়ে যাওয়া, ওই গাছটার প্রতি তাঁর একটা বিশেষ আকর্ষন – সব কিছু একটা দিকেই নির্দেশ দিচ্ছে। তাহলে কি বাজ পড়ে মরে যাওয়া বকুল গাছটার আত্মা এসে ভর করল শ্যামলবাবুর ওপর?
বাকি রাতটা আর দু’চোখের পাতা এক করতে পারলেন না মণিমালা। পরের দিন শ্যামলবাবু অফিসে চলে যাওয়ার পর টিভি চালিয়ে আনমনে বসে ছিলেন। জানালা দিয়ে চোখ বারবার চলে যাচ্ছে বাগানের দিকে। একটা অজানা ভয় ক্রমশ তাঁকে গ্রাস করছে। টিভিতে কী চলছে সেদিকে তাঁর খেয়াল নেই। হঠাৎ একটা নাম শুনে সচকিত হয়ে উঠলেন তিনি।
“আমাদের সঙ্গে এখন রয়েছেন তান্ত্রিক গুরু ত্রিকালভৈরব। যে কোন সমস্যায় ফোন করুন নিচের নম্বরে। জেনে নিন আপনার সমস্যার সমাধান।”
৩
রবিবার সকালবেলা প্রফেসরসাহেবের ছোট ল্যাবরেটরিতে বসে আছেন শ্যামলবাবু। এই ল্যাবরেটরিটা ওনার বাড়ির ছাদে এবং এখানে এই প্রথম ঢুকলেন তিনি। আর ঢুকেই চমকে উঠেছিলেন। কারণটা আর কিছুই না। ল্যাবরেটরিতে সবুজ রঙের আধিক্য।
কাঁচের বয়াম, বিকার, টেস্টটিউবে রাখা রসায়নিক থেকে শুরু করে, ঘরের আলো, এমনকি যে চেয়ারে এখন বসে আছেন শ্যামলবাবু তার গদির রঙটাও সবুজ। হ্যাঁ, আর আছে একটা দাঁড়ে ঝোলা টিয়াপাখি।
“হ্যাঁ, ওই টিয়াপাখিটার পালক যে কারণে সবুজ তোমার গায়ের লোমও সেই একই কারণে শ্যামল। এতদিনে তুমি সার্থকনামা হলে।” মিটিমিটি হাসছেন প্রফেসরসাহেব।
“দেখুন আমি মরছি নিজের জ্বালায়, আপনি এখনো ঠাট্টা করছেন? আদৌ কি বুঝতে পারলেন এই সবুজ রঙের কারণ?”
“কিছুটা বুঝেছি তো অবশ্যই। কিন্তু তোমায় যদি বলি পোর্ফিরিন রঞ্জক আর অ্যামাইনো অ্যাসিডের এক বিক্রিয়ার ফল এই সবুজ রঙ এবং তার সঙ্গে অবশ্যই আছে আলোক প্রতিসরণের খেলা তাহলে কি কিছু বুঝবে?”
শ্যামলবাবুর চোয়াল ঝুলে গেল।
“সেইজন্যই তো সহজ করে বোঝানর চেষ্টা করছি। দেখো, আশেপাশে যে গাছপালা আমরা দেখতে পাই তার পাতা সবুজ হয় কেন মোটামুটি সবাই জানি।”
“ক্লোরোফিল!” শ্যামলবাবু লাফিয়ে উঠলেন।
“আহা! নেচো না। কিন্তু প্রাণীদেহে তো ক্লোরোফিল থাকে না। তাহলে এই টিয়াপাখির রঙ সবুজ হল কী করে?”
“থাকে না?” শ্যামলবাবু বিড়বিড় করে বললেন।
“ভেবে দেখো, টিয়াপাখির গায়ের রঙ কিন্তু সবুজ নয়। ওর পালকের রঙ সবুজ। যেমন বর্তমানে তোমার চুল।”
“হ্যাঁ। তাই তো, তাহলে গাছ না হয়ে পাখি হয়ে যাচ্ছি বলছেন? টিয়াপাখি?”
“আবার তোমার চুলে যে আরও কিছু পাচ্ছি, ক্লোরোফিলের সঙ্গে মিল আছে কিন্তু ক্লোরোফিল নয়। এমন এক মৌল যা আমার একদম অচেনা।”
“আর ব্লাড রিপোর্ট?”
“সেসব একদম নরমাল। আচ্ছা, তোমার শরীরে কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করেছ? কোন অসুবিধা, অস্বাভাবিকতা?”
“তেমন কিছু না, তবে খিদেটা একদমই পাচ্ছে না, আর সন্ধ্যে হলেই খুব ঘুম পাচ্ছে। কিন্তু ভোর হলেই একদম ফ্রেশ।”
“হুম। গাছের মতই, বলো? তাহলে কি নিজের খাবার নিজেই তৈরি করে নিচ্ছ না কি? এই ক’দিনে তো চেহারায় আরও জেল্লা দিচ্ছে দেখছি।”
“প্রফেসরসাহেব, আপনি এখনো মজা করছেন?”
“মজা নয় হে, আমি যে কাজের জন্য সব ছেড়েছুড়ে এখানে চলে এসেছি, মনে হয় তার ফল পেতে চলেছি।”
“তার মানে?”
“এই যে গ্রিন রুমটা দেখছ এটা কিন্তু থিয়েটারের নয়, আমার গবেষণার বিষয় এমন এক ধাতু যার কল্পনা মেণ্ডেলিফও করতে পারে নি। মানে সেই ধাতু আবিষ্কার করতে পারলে পিরিয়ডিক টেবিলে তাকে আলাদা জায়গা দিতে হবে। এবং আমার এ পর্যন্ত গবেষণার ফল বলছে সেই ধাতুর রঙও তোমার চুলের মত সবুজ।”
“বলেন কী?”
“কিন্তু আমি এটাও নিশ্চিত যে পৃথিবীতে সেই ধাতুর অস্তিত্ব নেই।”
“তাহলে?”
“সেটাই তো প্রশ্ন, তাহলে তোমার চুলে এমন এক মৌল এল কীভাবে যার ধর্মের সঙ্গে আমার কল্পিত ধাতুর প্রায় নব্বই ভাগ মিল পাচ্ছি।”
রবিবারের খাওয়াটা বরাবরই বেশ আয়েস করে সারেন শ্যামলবাবু। আজ কিন্তু এ ক’দিনের মতই খিদে অনুভব না করায়, একটুখানি খেয়ে উঠে পড়লেন। রবিবার দুপুরের ঘুমটাও তার বড় প্রিয় ছিল। আজ ঘুমও পাচ্ছে না, তাই খাওয়ার পর তিনি বাগানে এলেন শীতের রোদ্দুরে একটু দাঁড়াবেন বলে।
“শোন না, তুমি বাগানে বেশীক্ষণ থেকো না।” শ্যামলবাবুর পেছন পেছন তাঁর স্ত্রীও বেরিয়ে এসেছেন। তাঁর কথায় শ্যামলবাবু বেশ অবাক হলেন।
“কেন? কী হয়েছে?”
“আমার কেমন ভয় করছে, ওই বকুল গাছটা, ওটার বেশী কাছে যেও না।”
শ্যামলবাবু বেশ অবাক হলেন। মণিমালা সেটা বুঝতে পেরে বললেন, “বাজ পড়া গাছ খুব অমঙ্গলের। সেদিন ভৈরববাবাও বললেন, তোমার এই চুলটুল সবুজ হয়ে যাওয়ার জন্য নাকি এই গাছটাই দায়ী। আমাদের ক্ষতি করতে চায় এমন কেউ ওই গাছের মাধ্যমে তোমার কিছু করেছে।”
“এসব তুমি কী বলছ? তুমি কবে থেকে এসব বাবাজী টাবাজীর কাছে যেতে শুরু করলে?”
“যাই নি, আজ যাব। তুমিও যাবে আমার সঙ্গে। অনেক কষ্টে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট যোগার করেছি।”
“মণিমালা, তুমি জানো আমি এসব বিশ্বাস করি না।”
“জানি, কিন্তু তুমি বল, এই যে গায়ের রঙ সবুজ হয়ে যাওয়া এটাও কি কোন স্বাভাবিক জিনিস? কোনদিন দেখেছ এরকম? আর তাছাড়া…”
“তাছাড়া কী?”
“তাছাড়া সেদিন রাতে আমি যা দেখলাম তা শুনলে তুমি হয়তো আমাকে পাগল ভাববে, কিন্তু সত্যি বলছি আমি একদম পরিষ্কার দেখেছি।”
স্ত্রীর কাছে সেদিন রাত্রে বকুলগাছটার জীবন্ত হয়ে যাওয়ার কথা শুনে শ্যামলবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। তারপর বললেন, “হয়তো তোমার কথা আমি সত্যিই উড়িয়ে দিতাম, যদি না আমার নিজের এই অবস্থা হত। কিন্তু তোমার ওই তান্ত্রিক বাবাজীর কাছে যাওয়ার আগে একবার ঘটনাটা প্রফেসরসাহেবকে জানানো উচিত বলে মনে হয়।”
প্রফেসর বিপিন চাটুজ্জে সব শুনে বললেন, “এই তো! এইবারে একটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি বলে মনে হচ্ছে। গত সপ্তাহে তোমাদের বাগানে বাজ পড়ার ঘটনাটা তো আমি জানতাম। কিন্তু শ্যামলের সবুজ মানুষে রূপান্তরিত হওয়ার সঙ্গে এর যে কোন সম্পর্ক আছে তা আগে বুঝতে পারি নি। চলো তো একবার গাছটার কাছে।”
গাছের গুঁড়ি ও কাটা কাণ্ডটা অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করলেন প্রফেসর। তারপর গাছের গোড়া থেকে কিছুটা মাটি সংগ্রহ করে নিলেন। একটা ছুরি চেয়ে গাছের কাণ্ডটার থেকে কিছুটা ছাল ছাড়িয়ে নিলেন। একবার নিজের বাড়িতে গিয়ে সেসব রেখে নিয়ে এলেন একটা বিকারে বেশ খানিকটা সবুজ তরল, ও একটা স্টেথোস্কোপ। স্টেথোস্কোপ বসিয়ে বসিয়ে গাছের কাণ্ডটার ওপর যেন হৃদস্পন্দন শুনতে লাগলেন। শ্যামলবাবু আর মণিমালা চুপ করে দাঁড়িয়ে তাঁর কাণ্ডকারখানা পর্যবেক্ষণ করছিলেন। সবার শেষে প্রফেসরসাহেব সবুজ তরলটা গাছের কাণ্ডের মধ্যে এক জায়গায় ঢেলে দিলেন। একটু পরে একটা চিমটি দিয়ে কিছু একটা তুলে খালি বিকারটাতে রাখলেন। শ্যামলবাবু উঁকি মেরে দেখলেন দুটো মরা ডেঁয়ো পিঁপড়ে, সবুজ তরল লেগে সবুজ হয়ে আছে।
প্রফেসরসাহেব যাওয়ার আগে মণিমালাকে বললেন, “বৌঠান, আমি কারো বিশ্বাসে আঘাত হানতে চাই না। আপনার যদি মনে হয় তান্ত্রিক এসে শ্যামলের এই রোগ সারাতে পারবে, তবে আপনি তান্ত্রিক ডেকে ঝাড়ফুঁক করাতেই পারেন। এমন অনেক জিনিস আছে যা বিজ্ঞানের অজানা, কিন্তু তাই বলে সবকিছু নস্যাৎ করে দেওয়াটাও কাজের কথা নয়।”
৪
এ বছর ঠান্ডাটা বেশ জমিয়ে পড়েছে। সাধারণত ডিসেম্বরের শুরুতেই এত ঠান্ডা পড়ে না। তার উপর কুয়াশার দাপট। রাত দশটা এগারোটা নাগাদই চার পাঁচ ফুট দূরের জিনিস দেখা যাচ্ছে না।
বাগানের অনেকটা পরিষ্কার করা হয়েছে। নৈঋত কোনে বড় করে জ্বালানো আগুনের তাপে এই ঠান্ডায় বেশ আরামই লাগছে। তবে সেই আগুন ঘিরে বসে থাকা মানুষগুলিকে মনে হচ্ছে অপার্থিব জগতের কায়া। বকুল গাছের কাটা গুঁড়ির ওপর চোখ বন্ধ করে বসে আছেন শ্যামলবাবু। খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলে বোঝা যাবে অল্প অল্প দুলছেন। অগ্নিকুন্ডের একপাশে মণিমালা, অন্য পাশে প্রফেসরসাহেব এবং তাঁদের সঙ্গে সমকোণে বসে আছেন লাল কাপড় পরিহিত জটাজূটধারী তান্ত্রিকগুরু ত্রিকালভৈরব ও তাঁর এক সহকারী।
সেদিন প্রফেসরসাহেব চলে যাওয়ার পর মণিমালা এবং শ্যামলবাবু গিয়েছিলেন ত্রিকালভৈরবের চেম্বারে। সামনাসামনি সমস্ত কথা শুনে তান্ত্রিকগুরু নিদান দিয়েছিলেন এক যজ্ঞ করার। তাঁর নির্দেশেই আজ শুক্লা একাদশীর রাতে যজ্ঞের আয়োজন করা হয়েছে। তান্ত্রিকগুরু এসেছেন সূর্যাস্তের পর, কিন্তু তাঁর চ্যালা আগে থেকে এসে যজ্ঞের সমস্ত আয়োজন করে রেখেছে।
শ্যামলবাবুর অনুরোধে প্রফেসরসাহেবও সম্মত হয়েছেন এই যজ্ঞে উপস্থিত থাকার। তিনি অবশ্য বিকেলবেলাতেই চলে এসেছেন। এসেই বললেন, “বৌঠান, আপনার তান্ত্রিক তাঁর যোগবলে কতটা কার্যসিদ্ধি করতে পারবে জানি না, তবে আমি মনে হয় শ্যামলের রোগের ওষুধ আবিষ্কার করে ফেলেছি।”
এ কথা শুনেই শ্যামলবাবুর মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। উনি বললেন, “তাহলে আর যজ্ঞ টজ্ঞের কী দরকার! ওষুধটা দিন, খেয়ে ফেলি।”
“এ কী ম্যাজিক নাকি? ওষুধ খাবে আর সবুজ রঙ কালো হয়ে যাবে? জ্বর হলে কি একদিনে সেরে যায়? এও তেমন সময় লাগবে। তাই দেখাই যাক না বাবাজীবন কিছু ভেলকি দেখাতে পারে কি না। আর বৌঠানের সেদিন রাতের অভিজ্ঞতারও তো একটা হিল্লে হওয়া দরকার। সে ব্যাপারে তো আমি কিছু বুঝতে পারছি না এখনো পর্যন্ত।”
“তাহলে রোগটা কী সেটা নিশ্চয়ই ধরতে পেরেছেন?”
“তা না ধরতে পারলে ওষুধ বের করলাম কী করে হে?” প্রফেসরসাহেব থেমে থেমে বললেন, “শোনো, ঘাবড়ে যেও না, তোমার রোগ পৃথিবীতে এই প্রথম। আসলে রোগটা পৃথিবীর বাইরে থেকে এসেছে।”
“মানে!”
“মানেটা খুব জটিল হে। খুব সহজ করে বললে সেদিন তোমাদের বাগানে বাজ পড়ে নি। একটি অন্য গ্রহের মহাকাশযান ভেঙে পড়েছিল ওই বকুলগাছের ওপর। পৃথিবীর বায়ুস্তরের সঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষে সেই মহাকাশযানটা ধুলো ধুলো হয়ে যায়। কিন্তু কোন এক আশ্চর্য বৈজ্ঞানিক উপায়ে সেই মহাকাশযানে থাকা অন্য গ্রহের প্রাণীরা রক্ষা পেয়ে আশ্রয় নিয়েছে ওই গাছের কাণ্ডে। সেই প্রাণীদের সঙ্গে তাদের গ্রহের জীবাণুরাও এসেছে। মায়ের হাতে বসানো গাছটা কেটে ফেলায় ওই গাছের গুঁড়ি আর ডালপালাগুলির সঙ্গে শ্যামলের অতিরিক্ত মেলামেশার ফল ওই জীবাণুর সংক্রমণ ও সবুজ মানুষে রূপান্তর।”
শ্যামলবাবু ও মণিমালা নির্বাক হয়ে সব কথা শুনছিলেন। এবার শ্যামলবাবু বললেন, “তাহলে এবার তো এই রোগ পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে।”
“আপাতত সেটা আটকানোই আমার মূল লক্ষ্য। অবশ্য ইতিমধ্যেই আমি তার প্রতিষেধক বের করে ফেলেছি। বিষে বিষক্ষয় বলে একটা কথা আছে। আমার গবেষণায় যে ধাতু আবিষ্কার করার কথা সেদিন বলছিলাম সেটা আমি অতি সামান্য পরিমানে পেয়েছি ওই অন্য গ্রহের প্রাণীদের থেকেই। সেই ধাতুই এই ওষুধের মূল উপাদান।”
“সেই প্রাণীদের কোথায় পেলেন?”
“কেন? সেদিন বকুলগাছটা থেকে বের করে নিলাম দেখলে না? ওহ, তুমি কি ওদের সবুজ পিঁপড়ে ভেবেছ?”
“ওই পিঁপড়ের মত প্রাণীদের মাথায় এতো বুদ্ধি?”
“শরীরের আয়তন দিয়ে কি কারো বুদ্ধির বিচার হয়? তাহলে তো আমার থেকে তোমার বুদ্ধি বেশী হত শ্যামল।” প্রফেসরসাহেব মিটিমিটি হাসছেন, “কিন্তু দু’টি নয় আরও সবুজ পিঁপড়ে বাসা বেঁধে আছে তোমাদের সাধের বকুল গাছে। দেখা যাক আজ ত্রিকালদর্শী ভৈরব বাবাজীবন কতদূর তাঁর দৃষ্টি প্রসারিত করতে পারেন।”
যজ্ঞের আগুনের একপাশে রাখা আছে বাজ পড়ে পুড়ে যাওয়া বকুল গাছের কাণ্ডটা। ত্রিকালভৈরব প্রথমেই জিজ্ঞেস করেছিলেন কাণ্ডটা আছে না বেচে দেওয়া হয়েছে। আছে শুনে বলেছিলেন, “তাহলে কাজটা অনেক সহজ হয়ে গেল।”
তবে যজ্ঞের আগুনের জন্য আলাদা করে বেলকাঠ আনা হয়েছে। এখন তিনি বিড়বিড় করে কিসব মন্ত্র পড়ছেন আর মাঝে মাঝে হাতের কাপড়ের থলে থেকে ধুলো ধুলো কী সব মুঠো করে বের করে আগুনে ছুঁড়ে দিচ্ছেন। সেই সময় আগুন দপ করে আরো বেশী শিখা ছড়াচ্ছে।
মণিমালা ভীত-সন্দিগ্ধ চোখে ত্রিকালভৈরবের কার্যকলাপ লক্ষ করছিলেন। টিভি বা খবরের কাগজের বিজ্ঞাপনে তান্ত্রিক গুরুজিকে যেমন দেখা যায় এখনকার চেহারার সঙ্গে তার কোন মিল নেই। কপালে ইয়াব্বড় এক রক্ততিলক, চোখে মনে হয় কাজল বা সুরমা জাতীয় কিছু পরেছেন, কারণ দুই চোখের চারপাশ কুচকুচ করছে কালো। গলায় ও হাতে বিভিন্ন মাপের রুদ্রাক্ষের মালা। একমাথা ঝাঁকড়া চুল জটার মতো চূড়ো করে বেঁধেছেন। সামনে একটি করোটিতে মণিমালার করে আনা ধূমায়িত লাল চা। প্রফেসরসাহেব অবশ্য একবার ফিসফিস করে বলেছিলেন ওই করোটি নাকি চিনেমাটির। যাই হোক না কেন, সব মিলিয়ে ত্রিকালভৈরবের সঙ্গে কোন ঐতিহাসিক চলচ্চিত্রে দেখানো ভয়ংকর দর্শন তান্ত্রিকদের এখন অমিল নেই।
মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যেও বেশ নাটকীয়তা আছে। বিড়বিড় করে বলতে বলতে একেক সময় পিলে চমকে দেওয়ার মত চিৎকার করে উঠছেন। কী ভাগ্যিস মণিমালা আগে থেকেই পাড়ায় জানিয়ে রেখেছিলেন আজ তিনি বাগানে এক যজ্ঞের আয়োজন করেছেন তাঁর মন্ত্রগুরুর নির্দেশে। বাইরের লোক কারো সে যজ্ঞে যোগদান করার অনুমতি দেন নি গুরুজি। নাহলে এই মাঝরাতেও এতক্ষণে লোক জমা হয়ে যেত।
একসময় যখন অগ্নিশিখা লেলিহান রূপ ধারণ করল তখন ত্রিকালভৈরব তাঁর চ্যালাকে নির্দেশ দিলেন বকুলগাছের কাণ্ডটা এনে ওই আগুনের মধ্যে বিসর্জন দিতে।
গাছটার আয়তন খুব বড় ছিল না, তার ওপর বাজ পড়ে অধিকাংশ পুড়ে গিয়ে আরও হাল্কা হয়ে ছিল। তাই ওই সিরিঙ্গে চেহারার চ্যালা একাই মাটিতে ঘষে ঘষে টেনে আনতে পারল সেটা।
“এইবার আসল কাজ।” ত্রিকালভৈরব উঠে দাঁড়ালেন আসন ছেড়ে, “এই গাছের ওপর বান মেরে তোর স্বামীর যে ক্ষতি করতে চেয়েছিল তাঁর সমস্ত মন্ত্রবিদ্যা বিফল হয়ে যাবে। আমার যজ্ঞের আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। এই গাছটা এবার তোরা দুজন মিলে ধরে ওই যজ্ঞের আগুনে আহুতি দে।”
মণিমালা সম্মোহিতের মতো উঠে দাঁড়ালেন। শ্যামলবাবু একবার প্রফেসর সাহেবের দিকে তাকালেন। প্রফেসরসাহেব ফিসফিস করে বললেন, “যা বলছে করো। আমিও চাই ওই ভয়ংকর প্রাণী পৃথিবী থেকে মুছে যাক।”
শ্যামলবাবু আর মণিমালা এগিয়ে গেলেন গাছের কাণ্ডটা নিয়ে। তারপর দুজন মিলে ঠেলে সেটাকে আগুনে প্রবেশ করানো হল।
প্রথমে যজ্ঞের আগুন কিছুটা স্তিমিত হয়ে এল। ত্রিকালভৈরব তখন আবার ঘি ও সমিধ ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতে লাগলেন, সঙ্গে চলতে লাগল তারসপ্তকে মন্ত্রপাঠ। একসময় যজ্ঞের আগুন আবার লেলিহান হয়ে উঠল। আগুনের তাপ এসে লাগছে সবার গায়ে। এই শীতেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা যাচ্ছে। এমন সময় গোঁ গোঁ করে এক যান্ত্রিক আওয়াজ শোনা গেল। যেন বহুদূর থেকে একপাল ভ্রমর গুঞ্জন করতে করতে এগিয়ে আসছে। বকুল গাছের কাণ্ডটা আগুনের ভিতর থরথর করে কাঁপছে। ভ্রমরের গুঞ্জন বাড়তে বাড়তে এক সময় এমন হল মনে হল যেন সামনেই কোন উড়োজাহাজ ল্যান্ড করবে। ত্রিকালভৈরব মন্ত্রোচ্চারণ বন্ধ করে ভয়-বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে যজ্ঞের আগুনের দিকে তাকিয়ে আছেন। এক সময় দেখা গেল বকুল গাছের কাণ্ডটা নিজে থেকেই উঠে দাঁড়াচ্ছে কেটে ফেলা গুঁড়িটার ওপর।
প্রফেসরসাহেব চিৎকার করে বললেন, “সবাই সরে এসো। যতদূর পারো পিছিয়ে এসো। ওরা নিজেদের স্পেশশিপ তৈরি করে নিয়েছে। ফিরে যাবে নিজেদের গ্রহে।”
সবাই ছুটে চলে এলেন শ্যামলবাবুদের বারান্দায়। সেখান থেকেই দেখতে পেলেন আস্তে আস্তে গাছটির পোড়া কান্ড সতেজ হতে লাগল। ডালপালা বিস্তার করে পাতা দেখা গেল। একসময় বকুলফুলের গন্ধে বাগান ম’ ম’ করতে লাগল।
“ওই দেখুন বৌঠান, আপনি রাত্রিবেলা কিছু ভুল দেখেন নি। তখন ওরা স্পেশসিপ তৈরি করছিল,” প্রফেসর বিপিন চাটুজ্জে বললেন, “আপনি হঠাৎ বাইরে বেরিয়ে পড়ায় তখনকার মত কাজ মুলতুবি রেখেছিল, কিন্তু আমার বিশ্বাস প্রতিদিন রাতেই ওরা স্বদেশে ফেরার তোড়জোড় করছিল। আজ আপনার ত্রিকালভৈরবের যজ্ঞের আঁচ বা মন্ত্রের জোর ওরা সহ্য করতে পারল না।”
এরপর সবাই অবাক বিস্ময়ে দেখল বকুল গাছের গোড়া থেকে বেরিয়ে আসছে লক্ষ লক্ষ পিঁপড়ের মত প্রাণী। উজ্জ্বল সবুজ বর্ণের। তাঁরা বকুলগাছের গা বেয়ে উঠে সম্পূর্ণ গাছটা আচ্ছাদিত করে ফেলল। এবার ঘটল সবথেকে আশ্চর্য ঘটনা। সবুজ পিঁপড়ের মতো প্রাণীগুলো কোন ছিদ্র দিয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে গাছের ভিতরে প্রবেশ করে গেল। গাছের গোড়ায় দেখা গেল সবুজ আলো। তারপর একসময় গাছটা রকেটের মত আকাশে উড়ে মিলিয়ে গেল।
রইল শুধু বাগানে ওই গাছটা যে জায়গায় ছিল সেখানে এক বিশাল গহ্বর।
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, দ্বিতীয় বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সবুজ মানুষ, সুদীপ দেব, সুপ্রিয় দাস
ওঃ!ভাবাই যায় না এমন কনসেপ্ট।দারুন,দারুন।