সবুজ মানুষ ইনকর্পোরেটেড
লেখক: যশোধরা রায়চৌধুরী
শিল্পী: দীপ ঘোষ
অক্টোবর ২০২৫, নিউ দিল্লি
২০২৫ সালের অক্টোবর মাসে ভারতের পার্লামেন্টে জনৈক মেম্বার লোকসভা সেশন চলাকালীন এই প্রশ্নটি তোলেন।
Will the PRIME MINISTER be pleased to state: (a) whether reports of incidents expressing doubts about security of nuclear power plants in the country have come to the notice of the Government and if so, the details thereof; (b) whether the Government is aware of any reports indicating the trespassing of two Kazakh and Russian persons into a prohibited zone belonging to Indian Rare Earths Limited in Tamil Nadu; and (c) if so, the details thereof along with the steps taken to conduct a review of safety of such installations including nuclear power plants and vital installations of such capability?
দুজন কাজাখ ও রুশ ব্যক্তি সংবাদ মাধ্যমের নাম করে গিয়েছিলেন এবং তাঁদের ধরে ফেলা হয়েছে। উত্তরে জানানো হয়েছিল সেদিন লোকসভায়। এটাও বলা হয়েছিল, যে,
The premises of IREL (India) Limited, Manavalakurichi unit, is classified as ‘Prohibited Place’ and entry of Foreign Nationals is not allowed without prior security clearance from Department of Atomic Energy (DAE) as per Standard Operating Procedures and the DAE Guidelines pertaining to permitting entry of Foreign Nationals into DAE premises. Hence, the foreign nationals were denied entry. Also, considering the event as significant unusual occurrence, 2 local police authorities were notified of the incident.
আরও জানানো হয় যে এফআইআর-ও হয়েছিল পুলিশে। পুলিশ খুঁটিয়ে দেখে সিসিটিভি ফুটেজ। এবং সিকিউরিটি অডিট করানোও হয় কেন্দ্রটিতে। পরবর্তীতে আরও শক্তপোক্ত করা হবে এই সুরক্ষার বিষয়টি, এরকম কিছু কথাও দেওয়া হয় উত্তরদান পর্বে।
ঘটনাটা তার মাসছয়েক আগের। এই রিপোর্টে যেটা উল্লিখিত হয়নি তা হল, ব্যক্তিদের গায়ের রং। আর এটাও বলা হয়নি, যে এরপর ওই ব্যক্তিদের হদিশ আর পাওয়া যায়নি, এবং তাঁদের পরের গন্তব্যও জানা যায়নি।
পরের গন্তব্য ছিল পশ্চিমবঙ্গ।
মার্চ ২০৩০ কলকাতা
গ্রিন ইঙ্ক। ইঙ্ক মানে কালি নয়, আইএনসি। ইনকর্পোরেটেড এর অপভ্রংশ। বিজনেস কার্ডটার দিকে অনেকক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে নামিয়ে রাখল সুব্রত। তাকাল সামনের ভদ্রলোকের দিকে। লোকটির চেহারায় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কিছুই নেই। হালকা গায়ের রং, মাথার চুল সামনের দিকে পাতলা হয়ে এসেছে। অনেকেরই যেটা হয়, ভালোভাবে শেভ করেনি সকালে তাড়াহুড়োয়। গালে সবজেটে আভা। একই রেজর দিয়ে বার বার শেভ করে সুব্রতরও প্রথম বয়সে এমন হয়েছিল।
কিন্তু ছেলেটা একটা দামি বিজনেস স্যুট পরে আছে। সামনে করমর্দনের জন্য এগিয়ে রাখা হাতটা থিরথির কাঁপছে কি একটু, উত্তেজনায়?
সুব্রত হল ইভেন্ট ম্যানেজার। তার “ইভেন্ট ফুল” নামের এই ফার্মের বয়স মাত্র পাঁচ বছর কিন্তু এর মধ্যেই সে কলকাতার প্রায় সব বড় বড় প্রজেক্টের ফিতে কাটা, উদ্বোধন অনুষ্ঠান, প্রস্তরফলক উন্মোচন, সেমিনার, কনফারেন্সের ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট করে ফেলেছে। বিয়েবাড়ি, বা অন্নপ্রাশনের মতো ফালতু নন-কর্পোরেট ব্যাপারে সে নেই। তবে মিলিয়নেয়ার অরুণ তোড়ির মেয়ের বিয়ে হলে ব্যাপারটা আলাদা। সেটাও সে করেছিল প্রথম বছরে। যখন পায়ের তলার মাটিটা শক্ত হয়নি তেমন। এখন আর ওসবে যায় না। বড় বড় ব্যাংক, বেশ কিছু মাল্টিন্যাশনাল, কিছু সরকারি পিএসইউ বা লাভকারী পাবলিক সেক্টর কমার্শিয়াল ইউনিট ইত্যাদির সঙ্গে সে কাজ করেছে আর প্রতিবারই সফল হয়েছে, তাদের সার্টিফিকেট ভরতে ভরতে তার সিভি-র ফোল্ডার মোটকা হয়ে উঠেছে।
‘গ্রিন ইনকর্পোরেটেড, এই নাম তো আগে শুনেছি বলে মনে পড়ছে না। নতুন কোম্পানি, তাই তো? এটা কি পরিবেশ সংক্রান্ত কিছু নাকি?’ একটু তেরছাভাবে চেয়ার ঘুরিয়ে নিয়ে প্রশ্ন করল সুব্রত।
‘বলব, তার আগে বলুন, আমাদের এই ভেঞ্চারের যোগ্য করে ইভেন্ট আপনি অরগ্যানাইজ করে উঠতে পারবেন তো?’
আরে, এ যে আমার ফার্মের ওপরেই সংশয় প্রকাশ করে ফেলছে! আচ্ছা লোক তো!
সুব্রত বিরক্ত হলেও, খদ্দেরকে তো চটানো যায় না, সে হেলাফেলায় এগিয়ে দিল তার মোটকা সিভি ফোল্ডার।
দেখতেই পাচ্ছেন আমার ক্লায়েন্ট লিস্ট। এর কোনও নামটাই কিন্তু ছোটখাটো নয়। যে কোনও ইভেন্টে আমরা হেসেখেলে কয়েক লাখ টাকার বাজেট করি। সাচ্চা অরগ্যানাইজেশনরা প্রচুর বিজ্ঞাপন তুলে বাজেট বানায়।
তা, আমাদের বাজেট কম কিছু হবে না। এই ধরুন পঞ্চাশ লাখ।
এবার চমকাবার পালা সুব্রতর। ছেলেটা ভোলাভালা দেখতে। কথা বলছে যেন প্রি-রেকর্ডেড ক্যাসেট বসানো আছে। অবিশ্বাস্য শুনতে লাগল তার।
অ্যাঁ, বলেন কি। পঞ্চাশ লাখে তো একটা ছোটখাট ফ্ল্যাট হয়ে যায় মশাই। ঠিক বলছেন তো?
ঠিক কেন বলব না। রাশিয়া, ইউক্রেন, আর ইউএসএ থেকে আমাদের টপ একজিকিউটিভরা আসছেন তো এখানে। খরচ তো হবেই। তা ছাড়া ইনভেস্টররাও আসছে। ওরা অবশ্য নিজেদের খরচেই…
আচ্ছা তাহলে আগে আপনি বলুন তো, আপনাদের এই নতুন ফার্মের ব্যাকগ্রাউন্ড।
আচ্ছা, তা বলব, তবে আমাদের এই কোম্পানির সঙ্গে পরিবেশের কোনও যোগ নেই। বছর পাঁচেক হল। কাগজে বেরিয়েছে, শোনেননি?
স্মৃতি হাতড়ে কিছুই উঠে এল না। তাই সুব্রত শ্যামলের কথার দিকেই মন দিল।
আমরা মাল্টিন্যাশনাল, শুধু মাল্টি ন্যাশনাল না, আমরা আসলে ইউনিভার্সাল ও। কলকাতার শ্যামনগরে আমাদের নতুন প্রজেক্ট শ্যামল সিটি, ওটার ইনগরেশনের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভাস্ট লাইন অব লাইফস্টাইল প্রডাক্টসেরও লঞ্চিং হবে সেদিন। আসবেন মার্কিন, রুশ, মালয়েশিয়ান ও সাউথ কোরিয়ান ইনভেস্টাররা।
আরে, এই ভদ্রলোকের নিজের নামটাও বেশ মজার তো! এতক্ষণ খেয়াল হয়নি সুব্রতর। শ্যামল করণিক। শ্যামল কথাটার মানেও যে সবুজ, বিদ্যুতের ঝলকের মতো একবার তার মাথার মধ্যে খেলা করে গেল। সে মনযোগ দিল ভদ্রলোকের প্রস্তাবে।
একটা সাদা দামি কাগজে ছাপা ঝকঝকে ফোটোগ্রাফে ভরা শ্যামল সিটির প্রজেক্টের বিবরণ। ছবিগুলো কিছু আর্টিস্টের কল্পনা, কিছু অর্ধেক তৈরি হওয়া অ্যাকচুয়াল কনস্ট্রাকশন সাইটের।
গ্রিন ইনকর্পোরেটেডের প্রথম ইভেন্ট। এইসব বাড়ির উদ্বোধন। সঙ্গে শপিং মল ও লাক্সারি লাউঞ্জ।
মূল রাজধানী শহরের থেকে বেশ দূরে শ্যামনগরে এই প্রজেক্টটি নবনির্মিত। বেশ। তা বোঝা গেল। কিন্তু তার সঙ্গে এত বিদেশি স্টেক হোল্ডারের যোগাযোগ কী? বুঝতে পারছিল না সুব্রত।
শ্যামল করণিকের দিকে স্পষ্ট চোখে তাকিয়ে সুব্রত আবার নিজের গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে প্রশ্নটা করল। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার।
আপনারা বাড়িও বানাচ্ছেন, আবার লাইফ স্টাইল প্রডাক্টও ছাড়ছেন? মানে আপনার কোম্পানির কাজের নেচারটা একজ্যাক্টলি কী? ইনভেস্টরদের ইন্টারেস্টই বা কী?
শ্যামল ভাসা ভাসা নিরপরাধ চোখদুটি তুলে বললেন, তাহলে আপনাকে একটু আগে থেকে বলতে হবে। ইয়ে, গলাটা একদম শুকিয়ে গেছে, একটু জল পাওয়া যাবে?
টেবিলের নিচে থেকে নিজের জলের বোতল বার করে দিয়ে, উঠে গিয়ে একটা কাগজের কাপে অফিসের চা-কফি ডিসপেন্সার থেকে চা এনে দিল শ্যামলকে।
আমার নাম আসলে শ্যামল করণিক না। আমার আদি নাম শংকর বসু।
আচ্ছা?
শংকর এর পর যা যা বলল তা-ও অদ্ভুত। গ্রিন ইন্টারন্যাশনাল বলে কোনও কোম্পানির কথা সে নাকি কোনওদিনই জানত না। ২০২৪ সালের মার্চ মাসে, শংকর একটা বিজ্ঞাপন দেখেন কাগজে। গ্রিন ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি বহুজাতিক কোম্পানি ভারতে একটা ব্রাঞ্চ খুলছেন। নানান পদে লোক চাইছেন। কিছু পাব্লিক রিলেশন অফিসার, কিছু ডেভেলপমেন্ট অফিসার, অনেক কর্মী। কেমিস্ট। আর কনস্ট্রাকশন ম্যানেজার। কাগজে বেরিয়েছিল কোম্পানিটা রিয়েল এস্টেটে ইনভেস্ট করবে বড় রকম ভাবে। তা ছাড়া গত পঞ্চাশ বছর ধরেই সংস্থাটি কেমিক্যাল বানায়। মূলত নানা রকমের ত্বকের জৌলুশ বাড়াবার ক্রিম, তা ছাড়া বর্ষাতি, টুপি, নানা ধরণের ট্র্যাভেল গিয়ার। এবং সম্প্রতি ওরা নিজেদের ব্যবসা এক্সপ্যান্ড করছেন, ভারতের বাজারে আরও অনেক নতুন প্রডাক্ট ছাড়া হবে।
পিআরও-র জন্য অ্যাপ্লাই করে শংকর। সে তখন কিছুদিনের জন্য বেকার। একটা ছোট বেসরকারি সংস্থায় কাজ করে, সময়মত মাইনে দিত না বলে, ছেড়েছেন।
শংকরের একটা স্কাইপ ইন্টারভিউ হয় আমেরিকার সংস্থার রিক্রুটমেন্ট দপ্তরের লোকেদের সঙ্গে। শংকরকে প্রথমে তার আগেকার কাজকর্মের বিষয়ে প্রশ্ন করা হয়। শেষ প্রশ্ন, সবুজ মানুষ সম্পর্কে সে কী জানে। রিক্রুটমেন্টের লোকেদের শংকর বলে যে, সে কখনও সবুজ মানুষের নাম শোনেনি। সঙ্গে সঙ্গে তাকে বলা হয় সে মনোনীত, তবে চাকরি পেলে তাকে একটা ছদ্মনাম নিতে হবে, নামটা হল শ্যামল করণিক।
অদ্ভুত প্রস্তাব! দু-মুহূর্ত ভাবতে সময় পায় শংকর। ওভার স্কাইপ তাকে হ্যাঁ কি না বলতে হবে। পে প্যাকেজ এতটাই ভালো যে শংকর সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যায়। সে এই ভেবে অবাক হয় যে, যে মুহূর্তে সে জানিয়েছে সে সবুজ মানুষ সম্পর্কে কিছুই জানে না, সেই মুহূর্তেই ওদিকের রিক্রুটারের চোখে যেন আলো জ্বলে উঠল।
চাকরিতে জয়েন করার পর শ্যামনগরেই একটি অস্থায়ী ডেরায় শংকর থুড়ি শ্যামলকে থাকতে বলা হয়। সেখানে আরও গোটা পঞ্চাশ সহকর্মীর সঙ্গে সে ঠাঁই পায়। সবাই খুব খুশি, কারণ কারোরই আইডিয়া ছিল না যে এইরকম একটা কোনও মাল্টিন্যাশনালে এত সহজে কাজ পাওয়া যাবে। প্রতিদিন তাদের ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চ ও প্রোভাইড করা হচ্ছে, তবে ডিনার নিজের নিজের মতো। সন্ধেবেলা কাজ নেই, ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ানো যায়। তবে ব্রেকফাস্ট আর লাঞ্চ এত ভালো দেয় যে খেয়ে শরীরে তাকত ও মনে প্রফুল্ল ভাব এসে যায়। সারাদিন তারা মন্ত্রমুগ্ধের মতো কাজ করছে।
২০৩০ এর আগস্টে এ শ্যামনগরে শ্যামল সিটির প্রজেক্ট কমপ্লিট হচ্ছে। আর মাত্র দু-মাসের মধ্যে গ্র্যান্ড ইনগরেশন।
এই কিছু বছর কাজ করতে করতে কোথাও কোনও খুঁত পায়নি শ্যামল, থুড়ি, শংকর।
তাহলে বেশ সুখের চাকরি বলুন? নাম পালটেও দুঃখ হচ্ছে না আপনার?
নাহ, সবচেয়ে আনন্দের কথাটা কী, বলুন তো?
কী?
আমাদের এখানে কোনও বস নেই। সব বস স্কাইপে মিটিং করে। সব্বাই বাইরে থাকে। কাজ কিন্তু একদম নিখুঁতভাবে হচ্ছে। কোনও গাফিলতি নেই। আমার কাজের বিধিনির্দেশ সব মেইলে পেয়ে যাই। জিনিসপত্র ও এসে যায় শিপমেন্ট হয়ে। এমন কি আমাদের রেশনও আসে বিদেশ থেকে। ফরেন মাল, ইম্পোর্টেড, হুঁ হুঁ! দারুণ সব প্যাকেজড খাবার, সেসব মশাই এখনকার সুপারমার্কেটেও পাবেন না। তারপর ধরুন, জুস, লজেন্স। কোয়ালিটি একেবারে দুরন্ত। এমনকি আমাদের লোশন শেভিং সেট, ময়সচারাইজার থেকে শুরু করে সাবান… সব ওরা দিচ্ছে। ফ্রিতে। মাইনের বাইরেও। ভাবতে পারেন?
সুব্রত হাঁ করে তাকায়। শংকরের থুড়ি শ্যামলের মুখে কেমন একটা হাসি। আধা-গাধা আধা-হিজবিজবিজের হাসি। কেমন ঈষৎ বোকা অনেকটা চালাক এবং সামান্য করুণ।
এবার উঠি। তাহলে আমাদের কাজটা করছেনই। এই রইল অ্যাডভান্স চেক।
পকেট থেকে একটা পাতলা চামড়ার চেকবুক বাইন্ডার বার করে শ্যামল। এরকম কেতার চেক বুক বাইন্ডার শুধু আমেরিকান সিনেমায় মিলিওনেয়ারদের হাতে দেখেছে সে।
ফস করে একটা চেক কেটে দিয়ে দেয় শ্যামল। তিন লাখ ভারতীয় মুদ্রা।
(২)
সবটাই ছিল কেমন যেন গা শিরশিরে। ওর সঙ্গে কথা হয়েছিল একবার শ্যামনগরের প্রজেক্টটা দেখাতে যাবে সুব্রতকে নিয়ে। কিন্তু তারপর সে আর রিং ব্যাক করেনি।
শ্যামলের কথা প্রায় ভুলতেই বসেছিল সুব্রত। হাতে কতগুলো খুব জরুরি কাজ এসে গেছে। নাওয়া-খাওয়া ভুলে সেসব কাজ শেষ করতে হচ্ছে। সুব্রত তার কোম্পানির কর্ণধার কিন্তু জনাকয়েক খুব ভালো ছেলেমেয়ে বাদ দিলে অধিকাংশ কাজ হাতেকলমে এখনও সে-ই করে থাকে। এইসব কাজ করে সে অদ্ভুত স্যাটিস্ফ্যাকশন পায়।
আজ তাদের পরের ইভেন্ট নিয়ে মিটিং করছিল সম্পূর্ণা আর কান্তিকের সঙ্গে সুব্রত। দুজনের বয়সই তার চেয়ে বছর পনেরোর ছোট। কাজেই ওদের রক্ত অনেক বেশি গরম। হেঁটে যেতে বললে ছুটে গিয়ে কাজ করে প্রায়। তা ছাড়া এবারের ইভেন্ট কলকাতার উপকন্ঠে একটা সাত তারা হোটেলে। দুর্দান্ত ভালো একটা কাজের বরাত। বেশ কিছু দেশি-বিদেশি নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্টকে নিয়ে আসছে কলকাতার এক বিজ্ঞান সংস্থা। বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আজকাল সরকারি সংস্থারা টাকাপয়সা কমিয়ে দিয়েছে। তাই যাবতীয় টাকা আসে ফরেন ফান্ডিং থেকে। মানে আনতেই হয়। এবং লেজুড়ের মতো জুড়ে নিতে হয় এক আধখানা প্রাইভেট সেক্টর ফার্মকে।
সম্পূর্ণা বাজেটিং করছিল। তার সামনে ল্যাপটপ, কান্তিকের হাতে ট্যাব। সুব্রত ততক্ষণ অফিশিয়াল কাগজপত্রের ফোল্ডারটা দেখছিল। সরকারি কিছু লাল ফিতের ফাঁস আছে। আজকাল সব ইভেন্টেই জলের বোতল নেওয়া হয় ক্লায়েন্টের বলে দেওয়া কোম্পানির থেকে কারণ জল সংকটের সময়ে কেউ হাবিজাবি প্যাকড মিনারাল ওয়াটার নেবেন না। সেটাও দেখতে হয়। ভূস্তরের জল নেমে যাওয়াতে অনেক জায়গায় আর্সেনিক দূষিত জল আসছিল। এসব ব্যাপার ঘোরালো, গোলমেলে। গুফ আপ করলে চাকরি থাকবে না।
তেমনি সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকে প্রাইভেট সিকিউরিটি, তবু সব তথ্য আবার জানিয়ে রাখতে হয় পুলিশ, ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চকে। ইন্টারন্যাশনাল টেররিজম খুব বেড়ে গেছে। আর, এটা যেহেতু ইন্টারন্যাশনাল ইভেন্ট, বৈজ্ঞানিকদের একটা মিট, তাই মিনিস্ট্রি অব এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার-ও যুক্ত খানিক। এসব অফিশিয়ালদের সঙ্গে কথা সুব্রতই বলে। তার মাথার বেশ কিছু রগের দিকের চুল রুপোলি হয়ে এসেছে এইটা তার ব্যক্তিত্বের অন্যতম প্লাস পয়েন্ট। কথাবার্তায় চৌকশ হওয়া ছাড়াও তার এই শরীরী প্রত্যয় অনেকটাই কাজে লাগে আজকাল।
মিটিং এর মধ্যেই সে ফোনে ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের এক বড়কর্তার সঙ্গে অ্যাপো ফাইনাল করল। মুখ্যমন্ত্রী আসবেন সেমিনারের উদ্বোধনে ফিতে কাটতে। সেই বিষয়ে আলাদা সিকিউরিটি ব্রিফিং আছে।
হঠাৎ তাকে সিকিউরিটির কথা উল্লেখ করতে শুনে কান্তিক তার বড় বড় চশমার ভেতর দিয়ে বুদ্ধিদীপ্ত চোখদুটো তুলে তাকাল। বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে রয়েছে দেখে সুব্রত চোখের ইঙ্গিতে কান্তিককে জিজ্ঞাসা করল, কী? কান্তিকের ভুরু বেশ অনেকটা ওপরে উঠল এবং সে আঙুলের ভঙ্গি করে মাথার ওপরে কিছু একটা উড়তে দেখাল। পাখির ডানার মতো আঙুল নাড়ল।
সঙ্গে সঙ্গে বুঝে নিয়ে সুব্রত ফোনের ভেতরে মধু ঢালা গলায় বলল, হ্যাঁ আরেকটা ব্যাপার ছিল, ড্রোন এমপ্লয় করার ইস্যুটা। এজেন্সিকে নিয়ে যাব স্যার আপনার কাছে।
ড্রোন এখন প্রায় প্রতি ইভেন্টের মাস্ট। হোটেলের লনে যে ইনগরেশন, যেখান থেকে লাইভ টেলিকাস্ট করা হবে ইউরেনিয়াম নিয়ে ভারতের এই বিশাল সেমিনারটির প্রথম অংশ, সেই মাঠে তিন-চারটি ড্রোন উড়বে। দুটো ক্যামেরা ড্রোন, বাকি দুটো সিকিউরিটি ফিড হিসেবে ছবি তুলে পাঠাবে পুলিশ কর্তাদের। কিন্তু ড্রোন সাপ্লাই করবে প্রাইভেট কোম্পানি, তার ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করার দায় পুলিশের। সুতরাং ইভেন্টের বেশ কিছুদিন আগে থেকেই ড্রোন এজেন্সি ফাইনালাইজ করতে হবে।
ফোন রাখার সঙ্গে সঙ্গে কান্তিক বলল, এবারে ড্রোনে এক লাখ ধরতে হবে স্যার।
এত? কেন? আগের বার তো পঞ্চাশ হাজারে হয়েছিল, তাই না?
স্যার এবারে আরও বেটার ভার্শান দিচ্ছে।
ফান্ড নিয়ে ভাববেন না স্যার। সম্পূর্ণা আত্মপ্রত্যয় নিয়ে বলল। ওরা প্রচুর ফান্ডিং এনেছে। প্রাইভেট ফান্ডিং ও।
হুঁ সে তো শুনলাম। ডিরেক্টর সাহেব নাকি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের নতুন মডেল চালু করছেন। ওঁর মতো নাকি ভালো এইসব সরকারি প্রজেক্টকে সেল করতে কোনও ডিরেক্টরকেই দেখা যায়নি। সুব্রত বলল। কারা টাকা দিয়েছে? আগের বছর নাকি সৌদি তেল কোম্পানি টাকা ঢেলেছিল। তবে ইলেকট্রিক গাড়ি চালু হবার পরে তো আর তেল কোম্পানিগুলোর সে রমরমা নেই।
স্যার, ম্যাক্সিমাম টাকা এসেছে গ্রিন ইউরেনিয়াম থেকে। আগে নাম শুনিনি। নতুন কোম্পানি।
গ্রিন ইউরেনিয়াম? নতুন কোম্পানি নাকি? আমি তো জানতাম ইউরেনিয়াম কেনাবেচা করার সবটুকু মনোপলি ভারত সরকারের… অফিস কোথায় দেখ তো কোম্পানিটার?
সুব্রতর হঠাৎ কিছু মনে পড়ে গেছে। বুকের মধ্যেটা কেমন ফড়ফড় করে উঠল। যেন এক ঝাঁক ফড়িং উড়ল।
শ্যামনগরে, স্যার।
(৩)
সিকিউরিটি ব্রিফিং এ ড্রোন এজেন্সির একটি ছেলেকে নিয়ে গেল সুব্রত। লালবাজার থেকে এখন এ রাজ্যের পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স উঠে এসেছে শহরের পাশের বিশাল উপনগরীতে। নীলরঙের বড় বাড়িটিকে বলা হয় নীলবাজার।
পুলিশ কর্তা হিরণ্ময় সেন অতি সজ্জন, খুব অভিজ্ঞ। সিকিউরিটির ঘাঁৎ ঘোঁৎ সব ডিটেইলে আলোচনার পর, ড্রোনগুলোর পোজিশন থেকে শুরু করে, কত নীচে দিয়ে সেগুলি উড়বে এবং কত মেগাপিক্সেলে ছবি নেবে সেসব আলোচনা হল। তারপর ড্রোনের ছেলেটিকে নিচু গলায় পাশের ঘরে গিয়ে বসতে বলে, সুব্রত তার আরেকটা কাজ করে নিল।
স্যার, যদি কিছু মনে না করেন, আমাকে একটা আরও হেল্প করতে হবে।
হেল্প? কী বিষয়ে? বলুন।
স্যার শ্যামনগরে গ্রিন ইন্টারন্যাশনাল নামে একটা কোম্পানি রিয়েল এস্টেট ডেভেলাপ করছে স্যার। ফ্ল্যাট বানাচ্ছে। তা ছাড়া ওদের আরও অনেক প্রজেক্ট আছে। একটা লাইন অব কনজিউমার গুডস। মানে কীসব কেমিক্যাল-টেমিক্যাল। তা সেসব তো আজ জানলাম, আমাদের সরকারি এই সেমিনারেও বড় টাকা ঢেলেছে গ্রিন ইউরেনিয়াম। দুটো কি একই কোম্পানি, স্যার? কিছু জানেন এদের সম্বন্ধে?
এতক্ষণ সুব্রত বলে যাচ্ছিল। হাতে একটা না-জ্বালা সিগারেট নিয়ে শুনছিলেন হিরণ্ময় সেন। সিগারেট টেবিলের ওপরে রাখা ফাইলে ঠুকতে ঠুকতে হঠাৎ থামলেন হিরণ্ময়, তারপর তাঁর চোখদুটো জ্বলে উঠল।
আরে! কী আশ্চর্য। রিসেন্টলি তো এসব নিয়ে বাজার তোলপাড়।
ড্রয়ার খুললেন। কিছু খুঁজলেন, পেলেন না কাগজ হাঁটকে। ফোনের ইন্টারকমে সেক্রেটারিকে কিছু নির্দেশ দিলেন। একটু পরেই গোবেচারা চেহারার সেক্রেটারি একটা হলদেটে ফাইল নিয়ে এসে বললেন, এই যে স্যার। কাটিংগুলো অন্বীতা ম্যাডামের ঘরে দিয়ে এসেছিলাম। আপনি তো ওঁকেই কেসটা অ্যাসাইন করেছেন।
হিরণ্ময় হতাশ মুখ করলেন। হতাশা ওঁর নিজের সম্পর্কে। এত রকমের বিষয় মাথায় ঘোরে, কোন বিষয়টা কাকে দেখতে দিয়েছেন সেটা ভুলে বসেছেন দেখে নিজের ওপরেই রাগ হল।
সেক্রেটারি অজয় বাবুকে বললেন, অন্বীতা ম্যামকে ডাকুন তো একবার।
রোগা সোগা অজয়বাবু তড়বড়িয়ে চলে গেলেন। একটু পরেই ঘরে ঢুকলেন ঝাঁ চকচকে, স্মার্ট পুলিশ অফিসার ম্যাডাম অন্বীতা রায়। এঁকে সম্প্রতি বহুবার টিভিতে দেখেছে সুব্রত। একটা জঘন্য রেপ কেসের সমাধান ইনিই করেছেন।
এতক্ষণে, হিরণ্ময় গ্রিন ইটারন্যাশনাল নিয়ে একটি কথাও খরচ করেননি। এবার ফোল্ডার থেকে দুটো কাগজ বার করলেন।
প্রথমটা একটা খবরের কাটিং। কাটিংটা বেশ পুরানো… ২০২০ নাগাদের। একটা আবিষ্কারের খবর। “বাংলায় বিশাল ইউরেনিয়ামের হদিশ, বদলে যাবে রাজ্যের ভাগ্য” এই হল হেডলাইন। ডিটেলে বলা হয়েছে, ব্যারাকপুর ভাটপাড়া শ্যামনগরের থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে বিজ্ঞানীরা একটা ইউরেনিয়াম রিজার্ভ আছে বলে সন্দেহ করছিলেন কিছুকাল। ইদানীং কতগুলো সয়েল স্যাম্পল বের করেছে জিওলজিকাল সার্ভে বোরহোল অর্থাৎ গর্ত থেকে। তা থেকে জানা যাচ্ছে এরকম রিজার্ভ সত্যিই আছে। তবে ইউরেনিয়াম খুঁড়ে তোলার ও প্রসেসিং এর খরচ নিয়ে দীর্ঘকালীন চর্চা চলছে, এত সহজে সমাধান হবে না। এ ক্ষেত্রে রাজ্য আর কেন্দ্র সরকারের ভেতরে চাপান উতোর ও চলবে।
দ্বিতীয় খবরটা একেবারে হালের। এই কেসটা অন্বীতাকে দেওয়া হয়েছে পরশু। তার দুদিন আগে ঘটনাটা জানা যায়। শ্যামনগর স্টেশনের কাছে একটা ধানখেতে এক অজ্ঞাত ব্যক্তির লাশ পাওয়া যায়। তার পকেটে একটাই পরিচয়পত্র ছিল। সেটা ছিল গ্রিন ইন্টারন্যাশনাল নামে এক কোম্পানির একটি জব কার্ড। নাম লেখা ছিল শ্যামল করণিক। যদিও রাজ্যের কোনও রেকর্ডস এ এই নামের কোনও ব্যক্তিকে শনাক্ত করা যাচ্ছে না। মৃতদেহটির সৎকারের ব্যবস্থাও করা যাচ্ছে না কারণ আন-আইডেন্টিফাইড লাশ, আত্মীয়স্বজন থাকলেও এই ছবি দেখে কেউ এগিয়ে আসেননি।
বিশ্রি প্রিন্টের ছোট্ট ছবি। দেখে চিনতে ভুল হল না সুব্রতর।
(৪)
হিরণ্ময় এরপর হাত নেড়ে সুব্রতকে যেতে বলেন। অবশ্যই তার আগে শুনে নেন শ্যামল করণিকের ঘটনাটা। সুব্রত এরপর যায় অন্বীতার চেম্বারে। অন্বীতার কাছে বেশ কিছু ব্যাপার জানতে পারে। কারণ গত একদিনে রিসার্চ করতে করতে অন্বীতা অনেক কিছুই জেনেছেন এই সংস্থাটির সম্বন্ধে।
বিগত শতকের মাঝামাঝি, মানে এই ১৯৫০ এর আশপাশ থেকে সারা পৃথিবীতে দেখা যাচ্ছিল, অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটছে। বেশ কিছু ব্যাখ্যাতীত ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট, প্লেন অ্যাক্সিডেন্ট। বেশ কিছু মানুষের মৃত্যু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পর এটা। সকলের মনে সন্দেহ। সবাই আশেপাশের মানুষকে অবিশ্বাস করছে। বিশেষত ইউরোপে। নাৎসি চিনতে ভুল হচ্ছে না তো? চাপা নাৎসি মতাবলম্বীদের দেখতে পাচ্ছে মানুষ, ঝোপে ঝোপে বাঘ দেখার মতো।
এইরকম সময়েই সবুজ মানুষদের আইডেন্টিফাই করতে শুরু করেন অনেকে। ষাটের দশকে ভারতে চারজন রিপোর্টার এই ঘটনা নিয়ে একটা রেডিয়ো প্রোগ্রাম ও করেন। তাঁরা গল্পের ছলে জনগণকে সবুজ মানুষের অস্তিত্ব সম্বন্ধে জানান দিতে চেয়েছিলেন। এই সবুজ মানুষদের বাহু আজানু লম্বিত, এদের গায়ের রং সবজেটে-তামাটে। এরা খুব ভালো স্কিন লোশন ও মেকাপ ব্যবহার করে চলে, ফলত এদের গায়ের রং হঠাৎ করে চোখে লাগে না। আর সবচেয়ে বড় কথা, এদের গায়ের চামড়া কোথাও ছড়ে বা কেটে গেলে, সেখান থেকে গলগল করে বেরিয়ে আসে সবুজ রক্ত।
কোনও অজানা কারণে রেডিওর সেই প্রোগ্রামটার সবচিহ্ন মুছে ফেলতে কে বা কারা তৎপর হয়েছিল। বহুদিন আর সেই প্রোগ্রামটার টেপ খুঁজে খুঁজেও পাওয়া যায়নি। মনে করা হয়, গোপনে সবুজ মানুষেরাই এসব কান্ড করছিল। শুধু রেডিয়োর রেকর্ডিং ই নয়, এঁদের রিপোর্টিং এর সোর্স ডকুমেন্টগুলোও সব অদ্ভুত অদ্ভুত কারণে ধ্বংস হয়ে যায়। চার রিপোর্টারের একজন, দিলীপ, অজানা জ্বরে মারা যান ১৯৬৬-তে। অন্য একজন, অদ্রীশের সোর্স রামকান্ত ভক্ত সন্দেহজনকভাবে খাদে বাস উল্টে পড়ে, আগুন লেগে খুন হয়। দিলীপের আমেরিকার আর এক সোর্স ন্যান্সি পিকফোর্ড-ও কিন্তু উচু বিল্ডিং থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল।
পরে আর এ বিষয়ে কেউ মুখ খুললেন না কেন? কিন্তু আশির শেষে প্রেমেন্দ্র আর ১৯৯২ তে সত্যজিতের মৃত্যুর পর সত্যিই ট্যাবু টপিক হয়ে গেছে সবুজ মানুষ। ভয়ে সন্ত্রাসের ঘটনা একের পর এক কিন্তু পৃথিবীতে ঘটেই চলেছে। মানুষ লোপাট হয়ে যাচ্ছে যেখান সেখান থেকে। গায়েব মানুষরা অনেকেই আবার বছর দুই-তিন বাদে ফিরে আসছে। ততদিনে নিয়মিত নানা ধরণের ওষুধ কেমিক্যাল প্রয়োগে, শোনা যাচ্ছে তাদের রক্ত সবুজ হয়ে গেছে। তাদের ব্রেইন ওয়াশিং ও হয়েছে, কারণ শান্তশিষ্ট মানুষগুলো ফিরে আসছে হিংস্র, কূটবুদ্ধি সম্পন্ন আর বিপজ্জনক মানুষ হয়ে।
এটা ওপেন সিক্রেট যে, নানা রূপে এখনও সবুজ মানুষেরা তান্ডব করছে, কখনও তাদের ডাকনামের সঙ্গে আফগানিস্তানের কোনও উগ্রবাদী গ্রুপের নাম জুড়ে গেছে। কখনও তাদের নাম যুক্ত হয়েছে মেক্সিকোর ড্রাগ কার্টেলের সঙ্গে। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, বিশ্বে এ যাবত ঘটে চলা সব ক-টি বিস্ফোরণ, মায় ২০০১ এর ৯/১১ এর বিস্ফোরণও, আসলে নাকি সবুজ মানুষদেরই কীর্তি। তবে ওরা থাকে আড়ালে। ওদের ময়দানে নামতে সচরাচর দেখা যায় না। যত ঝাঁ-চকচকে বোর্ডরুম, যত উচ্চমার্গীয় হোটেলের নির্জন ঘর, সেখানে বসে বসে ওরা ভার্চুয়ালি সবরকমের কুকর্মের ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করেছে।
এই হল চারিদিক থেকে অর্জিত জ্ঞান অনুসারে, নিজের মেধাবী মগজাস্ত্রের প্রয়োগে পরিশীলিত করে পেশ করা, সবুজ মানুষ এবং গ্রিন ইন্টারন্যাশনাল সম্পর্কে অন্বীতা, মানে পুলিশের ডিটেকটিভ ডিডিজি ম্যাডামের ভার্শান। এখনকার কেসের ক্ষেত্রে আরও দু-তিনটে জিনিস যোগ করতেই হবে। তা হল গ্রিন ইন্টারন্যাশনালের একেবারে হালে অ্যাটমিক ওয়ারফেয়ারের জন্য প্রস্তুতির কথা, বেশ কিছু তাবড় দেশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে।
সবাই জানে যে সারা পৃথিবীর ইউরেনিয়ামের মোট ৩০% আছে অস্ট্রেলিয়াতে, তারপরেই জায়গা করে নিয়েছে কাজাখস্তান আর কানাডা ও রাশিয়া। ১৪% , ৮% ও ৮% করে বিশ্বের ইউরেনিয়ামের সঞ্চয় আছে এই দেশগুলোতে। এবং শুধু মাটির তলায় ইউরেনিয়াম থাকলেও হবে না, তাকে খনি তৈরি করে তুলে আনা, শোধন করা ও কার্যকরী অবস্থায় আনতে যে বিপুল টাকার দরকার তা সব দেশের যেহেতু থাকে না, তাই যে কোনও দেশ কেবল মাটি থেকে ইউরেনিয়াম থাকলেই বড়লোক হয়ে যাবে এমন কোনও কথা নেই। সবচেয়ে বড় কথা ইউরেনিয়াম তোলাটাকে ভায়েবল করে তুলতে হবে।
ভারতে আজ যদি ইউরেনিয়াম খুঁজে পাওয়াও যায় তাহলেও কোনও প্রাইভেট কোম্পানির কোনও লাভ নেই কারণ বিষয়টাই কেন্দ্রীয় সরকারের আওতায় এবং অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে এই সম্পদের ব্যবহারকে সরকারি কুক্ষিগত করে রাখা হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত আছে দেশের নানান অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক, আন্তর্দেশীয় এবং রাজনৈতিক ব্যাপার। অত সোজা নয় যে, যে কোনও আন্তর্জাতিক কোম্পানি এল আর ইউরেনিয়াম কোম্পানি খুলে ফেলল। সুতরাং গ্রিন ইউরেনিয়ামের অস্তিত্বটাই বিরাট প্রশ্নের মুখে। এমনও হতে পারে যে সব ক-টা কোম্পানিই আসলে জাল কোম্পানি বা যাকে বলে লোক দেখানো, শেল কম্পানি। এর ভেতর দিয়ে আসলে সারা বিশ্বের অনেক কালো টাকা সাদা করার ছক আছে।
(৫)
এর ঠিক এক মাস পরে, জুন মাসের উনিশ তারিখে ছিল কলকাতায় অবস্থিত সেন্টার ফর অ্যাটমিক রিসার্চের সেমিনার। তার ঠিক আগের দিন অনিবার্য কারণে সুব্রতকে যেতে হয় অন্বীতা ম্যাডামকে সঙ্গে নিয়ে চিফ সায়েন্টিস্ট কবীন্দ্র গোস্বামীর কাছে। ভদ্রলোক শ্বেত কেশ শ্বেত শ্মশ্রু, রীতিমত সৌম্যকান্তি বৈজ্ঞানিক। এখন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন দেখতে দেখতে নিজের আণবিক গবেষণা লাটে উঠেছে।
এখন যা ঘটেছে তাতে ভুরুর ভাঁজ আরও বাড়বে তাঁর, কিন্তু ভদ্রলোককে একেবারে অন্ধকারে রাখা ঠিক হবে না এই বিষয়টাতে। অন্তত অন্বীতার এটাই অভিমত।
অন্বীতা এর ভেতরে একাধিকবার সুব্রতর অফিসে এসেছে। সুব্রতকে ডেকে পাঠিয়ে অত্যন্ত সংগোপনে স্টেটমেন্ট ও নিয়েছে। অন্বীতা নিজের থিয়োরি ওকে জানিয়েছেন, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনে নিয়েছেন সুব্রতর জবান বন্দি। যেখানে তার দেখা শ্যামল করণিকের হাত-পা নাড়া, চোখের চাউনি, কথা, সবটা বার বার শুনে একটা ধারণা করার চেষ্টা হয়েছে।
শ্যামল ও অন্যান্য কর্মীকে যে এক জায়গায় রেখে, খাইয়ে পড়িয়ে, রেশন পাঠিয়ে যাচ্ছিল বিদেশের বসেরা, তার উদ্দেশ্য সম্ভবত তাদের নিয়মিত কেমিক্যাল ট্রিটমেন্ট করিয়ে ক্রমশ সবুজ মানুষে রূপান্তরিত করা। তা ছাড়া শ্যামলের রহস্যজনক মৃত্যুর কারণ নিয়েও ভাবছে অন্বীতা।
আচ্ছা ম্যাম, এমন নয়ত, যে, শ্যামল সরলভাবে আমাকে তার আসল নামটা বলে দিয়েছিল জানতে পেরেই ওর উর্ধতনরা ওকে সরিয়ে দিল?
হতেই পারে, ও হ্যাঁ ভালো কথা, শংকর বসু নামের লোকের হদিশ পেয়েছে পুলিশ ডিপার্টমেন্ট। ছেলেটির প্যানকার্ড, আধারকার্ড আছে। কিন্তু পরিবারে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। কলকাতায় যে ভাড়াবাড়িতে থাকত সেখানেও গত ছ-মাসের ভাড়া বাকি রেখে গা ঢাকা দিয়েছে শংকর, এই কথা বললেন বাড়িওয়ালা।
এই কথাগুলো হচ্ছিল সুব্রতর অফিসে, সেমিনারের দু’দিন আগে। সকাল থেকে রাত কাজ করছে সম্পূর্ণা আর কান্তিক, ওদের মোটামুটি সম্পূর্ণ গোপনীয়তার শর্তে কিছুটা আভাস যদিও দেওয়া হয়েছে সবুজ মানুষ সম্পর্কে।
হঠাৎ টোকা দিয়ে সুব্রতর ঘরে ঢোকে সম্পূর্ণা। ভীষণ উত্তেজিত।
এই দেখুন স্যার, দেখুন ম্যাম। আজ সেমিনারের রেজিস্ট্রেশনের কমপ্লিট লিস্ট পেলাম, সেন্টার ফর অ্যাটমিক রিসার্চ থেকে। এই লিস্টে দেখছি গ্রিন ইউরেনিয়াম থেকে একজন লোক আসবে।
ওকে? জিজ্ঞাসু, উৎকণ্ঠিত অন্বীতা লিস্টের ওপর ঝুঁকে পড়েন।
এই দেখুন, রিপ্রেজেন্টেটিভ অব গ্রিন ইউরেনিয়াম। নামটা, হল এস করণিক।
এস?
দাঁড়ান ডিটল দেখছি। ইয়েস। সম্পূর্ণা ল্যাপটপে খুটখাট করে, তারপর ল্যাপটপটা ঘুরিয়ে ধরে।
শ্যামল। শ্যামল করণিক।
(৬)
ফলত ওদের ব্রিফিং করাই সাব্যস্ত হয় সেন্টার ফর অ্যাটমিক রিসার্চে। এবং আপাতত অন্বীতা ও সুব্রত দু-কাপ ধূমায়িত কফি সহ কবীন্দ্র গোস্বামীর সামনে উপবিষ্ট।
সুব্রতর ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্মের ইতিবৃত্তে এই জাতীয় ঘটনা একেবারেই বেমিল, তা ছাড়া এসব পুলিশের ব্যাপার। তাই সে চুপ। অন্বীতা আস্তে আস্তে ভাঙলেন বৈজ্ঞানিক মহোদয়কে, আগামীকালের অনুষ্ঠান খুব সাবধানে, এবং তৎপরতার সঙ্গে সম্পন্ন করতে হবে, বিশেষত বিদেশি ডেলিগেটদের বিষয়ে বিশেষ অবধান প্রয়োজন।
কবীন্দ্র বললেন, হ্যাঁ, সে তো অ্যাজ ইউজুয়াল থাকবেই। সাততারা হোটেলে তো এসব বন্দোবস্ত এমনিও ভালোই হয়। আমি তো আগেও এধরণের সেমিনার করেছি, এতটা বেশি আপনাদের নার্ভাস দেখাচ্ছে কেন?
অন্বীতা সামান্য কেশে বললেন, গ্রিন ইউরেনিয়াম বলে কোম্পানি আপনাদের প্রচুর টাকা দিয়েছে। কোম্পানিটা সম্বন্ধে কিছু জানেন?
দেখুন, ওরাই আমাদের অ্যাপ্রোচ করে। ছ-মাস আগে কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল আমরা সেমিনার করছি। ডেলিগেটস যাতে পাওয়া যায় তাই ইন্টারন্যাশনাল সায়েন্স জার্নালে দেওয়া হয়েছে। ইন ফ্যাক্ট সারা পৃথিবীর সব নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্ট গত এক বছর ধরেই অ্যানুয়াল ক্যালেন্ডারে ডেটগুলো মার্ক করে রাখেন। আমার যেমন সামনের মাসে কুয়ালালামপুরে যাবার আছে। প্রতিটি ইভেন্ট তো ক্যালেন্ডার অনুযায়ী রাউন্ড দ্য ইয়ার প্ল্যান হয়। তো, সেদিন এই ছেলেটি এল, নাম বলল, শ্যামল করণিক। আমাকে ওদের ব্রশিয়োর দিল।
শ্যামল করণিক!!!!?????
হ্যাঁ, কেন? একটা পিআরও টাইপ লোক।
অন্বীতা সুব্রতর দিকে ইঙ্গিত করতেই সুব্রত খেয়াল করল, ম্যাডামের ফোল্ডার সে বইছে। অন্বীতার হাতে দিতেই অন্বীতা কাগজে বেরনো শ্যামলের মৃত মুখের ছবি আর ইনকাম ট্যাক্স প্যান কার্ডে ছাপা শংকর বসুর ছবি দুটোর জেরক্স বার করে দেখাল কবীন্দ্রকে।
এই লোকটা?
না তো! বেশ গোলগাল, মোটাসোটা। বিশাল আকৃতির চেহারা। একটু দানব দানব। খুব চকচকে স্যুট পরে এসেছিল তো।
সে কী!
ইন ফ্যাক্ট গতকালও তো এসেছিল। দাঁড়ান ওর বিজনেস কার্ডটা কোথায় যেন রাখলাম, খুঁজে দিচ্ছি।
আচ্ছা, বুঝলাম। মাথার মধ্যে দ্রুত অঙ্ক কষল অন্বীতা। শ্যামল করণিক একজন নয়। বহুজন। ডেফিনিটলি কাল যে সেমিনার অ্যাটেন্ড করতে আসছে সে আরেকজন শ্যামল করণিক। অন্যরকম দেখতে। হয়তো চিমশে, গাল বসা, কাঁধ ঝুঁকে আসা।
‘আচ্ছা ডক্টর গোস্বামী একটা কথা বলুন তো, আপনার একবারও মনে হয়নি গ্রিন ইউরেনিয়াম নামে কোনও কোম্পানি একজিস্ট করতে পারে না?’
হুঁ, সরি ম্যাম। আমার একবার একটু সংশয় হয়নি তা নয়। এটা স্ট্রিক্টলি সেন্ট্রাল সাবজেক্ট। ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাটমিক এনার্জিতে একটা ফোন করব ভেবেওছিলাম, আমার বন্ধু ডক্টর খট্টর আছেন, ওঁকে জিজ্ঞেস করব যে কী এমন পলিসি চেঞ্জ হল যেটা আমরা জানতেও পারলাম না অথচ এই বাংলার মাটিতে ইউরেনিয়াম এক্সট্র্যাকশন করছে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি।
ফোনটা করলেন না কেন?
খুব কড়া গলায় অন্বীতা বলল।
স্পষ্টত থর থর করে কাঁপছে কবীন্দ্র গোস্বামীর হাত।
ওরা যে ফান্ডিংটা দিয়েছে সেটা দেখেছেন, ম্যাম?
সুব্রত বলল, সেটাই তো আরও ফিশি। পঞ্চাশ লাখ।
তা ছাড়াও আপনার বাড়িতে শারদনে ওয়াইট ওয়াইনের বোতল, ম্যালাকাইটের বাক্স, এসব গিফট ও গেছে নিশ্চয়ই, কী বলেন?
অন্বীতার গলা যেন ছুরির মতন কেটে কেটে বসবে কবীন্দ্রের গায়ে।
ম্যাডাম, ওরা আমাকে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের অ্যাক্রেডিটেশন-ও দেখিয়েছে। দেখবেন?
নিজের অধস্তনকে ডেকে ফাইল থেকে কাগজটা বার করালেন কবীন্দ্র। আত্মরক্ষার্থে এ ছাড়া আর কী-ই বা করতে পারতেন?
ওটা যে একটা ফর্জারিও হতে পারে, ভেবেছিলেন? এই দেখুন আমার ফাইলে কতগুলো খবরের কাটিং আছে, কোনও বিদেশিকে ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটমিক এনার্জি নিউক্লিয়ার প্ল্যান্টের আশেপাশেও ঘুর ঘুর করতে দেখলে পাকড়াও করবে।
(৭)
উদ্বোধন অনুষ্ঠানের ভারভারিক্কে বক্তৃতার ওপর একটা কান রেখেও সুব্রতর চোখ ঘুরছিল অন্যদিকে। ঝাঁ চকচকে একটা সবুজ লনে সাদা সাদা কাপড়ে মোড়া চেয়ার পাতা হয়েছে, চেয়ারে বাঁধা হয়েছে নীল রিবন। দু-তিনটে পোর্টেবল এসি সাদা ধোঁয়ার মতো করে ঠান্ডা হাওয়া ছাড়ছে, জুনের গরমে সে হাওয়া বাষ্প তৈরি করছে দ্রুত। তবু বাইরের কটকটা রোদ অতটা গায়ে লাগছে না শামিয়ানার জন্য। সাদা শামিয়ানার নীচে তাবড় বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে রাজনীতির লোকেরাও বসেছেন। আসন গ্রহণ করেছেন মাননীয় সিএম।
ওদিকে বক্তৃতা হচ্ছিল একটানা।
গত বেশ কিছু বছর ধরে আণবিক শক্তিতে শক্তিধর হয়ে উঠেছে ভারত। কেন্দ্র সরকারের ডিএই (department of atomic energy)-র অধস্তন সব ক-টা পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র আর হেভি ওয়াটার সেন্টার। এনপিসিআইএল অর্থাৎ নিউক্লিয়ার পাওয়ার কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া লিমিটেড ট্রম্বে তারাপুর আর কল্পাকর্ণ মিলিয়ে ২৪০০০ মিলিয়ন ইউনিট বিদ্যুৎ বছরে উৎপাদন করে। এ কাজে প্রাকৃতিক ইউরেনিয়াম অক্সাইড জ্বালানি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত। ধ্রুব আর অপ্সরা দুটি রিঅ্যাক্টর দারুণ উন্নতি করেছে বলে সংস্থা জানায়। সামুদ্রিক মাছ রেডিয়েশন প্রসেসিং করার কাজেও ভারত এগিয়ে আছে। ইন্ডিয়ান রেয়ার আর্থস লিমিটেড রেকর্ড টার্ন ওভার করেছে।
ভারতীয় বৈজ্ঞানিকদের গবেষণাও থেমে নেই। বিগত বছরে ৪৫টি পেপার লেখা হয়েছে, যা মৌলিক ও নানা আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত…
হঠাৎ সুব্রত দেখল, একটা খুব দামি স্মার্টফোন দিয়ে ভিডিয়ো করতে করতে একটা অতি গোবেচারা দেখতে ছেলে ঢুকল।
সম্পূর্ণাকে আগেই বলে রাখা হয়েছিল। সেই রিসেপশনে বসে লোকেদের নামের তালিকায় টিক দিয়ে দিয়ে ডেলিগেটদের ঢোকাচ্ছে।
সুব্রত দেখুল, সম্পূর্ণা প্রায় দৌড়ে এসেছে এবং চোখ ও মাথার ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিচ্ছে এ-ই হল সেই তৃতীয় শ্যামল করণিক।
সুব্রত খুব সাবধানে আস্তে আস্তে লোকটার পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
তার বুকের ভেতরে লক্ষটা হাতুড়ি দুম দুম করে পড়ছে।
যে কোনও মুহূর্তে জীবন সংশয় হতে পারে, কিন্তু তবু সে ডিঙি মেরে লোকটার কোট আর চুলের মাঝখানে ঘাড় গলার চামড়ার দিকে তাকাল। কানের দিকে তাকাল।
স্পষ্টতই, শ্যাওলা সবুজ।
না দাড়ি কাটার ফল না।
সে আস্তে করে ছেলেটির কানের কাছ থেকে বলল, তোমার আসল নামটি কী, ভাই?
লোকটা ভয়ংকর চমকে গিয়ে প্রায় পড়েই যাচ্ছিল আর কী।
থতমত খেয়ে, ভিডিয়ো করতে করতেই বিড়বিড় করে বলল, কী?… কী বলছেন?
সুব্রত চাপা গলায় বলল, তোমাদের কোম্পানি সবার নাম শ্যামল করণিক দিয়েছে কি না, তাই ভাবছিলাম। খুব সাবধান। তোমার মত আরেকজন কিন্তু মর্গে শুয়ে আছে।
ইতিমধ্যেই অন্বীতা কনট্রোল রুম থেকে এসেছেন। এই হোটেলের ভেতরেই সাদা পোশাকের পুলিশ গিজগিজ করছে। দু-জন চেনামুখের পুলিশকর্মী এসে সুব্রতর পাশে দাঁড়াল। চোখের ইঙ্গিতে সুব্রতকে সরে যেতে বলল।
খানিক বাদে তিন নম্বর শ্যামল করণিককে ডেকে নিয়ে গেল জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অন্বীতার এই অধস্তনরা। শ্যামল কোনও আপত্তি করেনি। চোখ দেখে মনে হচ্ছিল সে ভয় পেয়েছে।
(৮)
আপনার আসল নাম কী?
আমার নাম শ্যামল করণিক।
সেটা আপনাদের সবাইকে কোম্পানি থেকে দেওয়া নাম। আসল নাম কী?
আমার নাম শ্যামল করণিক।
কতদিন কাজ করছেন এ কম্পানিতে?
দু-বছর। না না, চার বছর।
কী কাজ করেন আপনি?
যা বলেন বস।
কে আপনার বস?
জানি না। মেসেজ আসে।
কী কাজ আপনার?
লোক জোগাড় করা।
কী জন্য?
কোম্পানিতে কাজ করার জন্য।
কী ভাবে?
এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের সামনে থেকে। বেকার যুবক। বেশি লেখাপড়া চাই না। সাদাসিধে হতে হবে। শিখিয়ে পড়িয়ে নেওয়া হবে। বাড়ি থেকে চলে আসতে পারবে। বাড়ির সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখবে না। যা বলবে তাই শুনবে। এরকম।
কতজনকে জোগাড় করেছিলেন আপনি।
পনেরো-ষোল। অনেক সব মফস্বলের, জেলার ছেলে। আমরা খুব খুশি। আমরা সবাই আপিসের দেওয়া বাড়িতে থাকি। রোজ খাবার পাই। জামা পাই। সাবান সেন্ট পাই।
এই আইডি-ও কোম্পানি দিয়েছে?
হ্যাঁ। ওরা সব করে দেন। সরকারি অনুমতি, যা যা দরকার। আমাদের কোনও অভাব নেই। আমরা উন্নততর মানুষ হব বলে ওঁরা দয়া করে এইসব দেন…
যন্ত্রের মতো, মন্ত্র পড়ার মতো বলে চলেছিল তিন নম্বর শ্যামল। কোনও গোপন ধর্মীয় সংগঠনের মতোই অতি সযত্নে এই কর্মীদল তৈরি হয়েছে। ডাক্তারি পরীক্ষায় রক্তে পাওয়া গিয়েছে প্রচুর কেমিক্যাল। বাস্তববোধকে বেঁকিয়ে চুরিয়ে দেওয়া ড্রাগ আছে ওদের। ওরা সবাইকে শিখিয়ে পড়িয়ে নিজেদের প্রতি অন্ধ আনুগত্যসম্পন্ন এক একটা পুতুল তৈরি করছিল। এই মুহূর্তে, এখনই, করছে। নানা দেশে। গরিব দেশে, বড়লোক হতে চাওয়া দেশে। প্রচুর বেকার যেসব দেশে। ভালো চাকরির টোপ দিয়ে নিজেদের সংখ্যা বাড়িয়ে চলছে ওরা।
আপনাদের কোম্পানির মোটো কী?
এই মুহূর্তে শ্যামলের চোখ দুটি অস্বাভাবিক উজ্জ্বল।
আমরা মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসি। সভ্যতাকে পথ দেখাই। আমাদের মতো উন্নত মানুষ আরও তৈরি করতে হবে। প্রশ্ন করলে মরতে হবে, আর যারা পুরানো, অনুন্নত, যারা আমাদের মতো আলোকপ্রাপ্ত না, তাদের খতম করতে হবে। মারতে হবে। তাহলেই আসবে ধরণীর বুকে স্বর্গরাজ্য।
আবার আমরা জাগছি।
(৯)
এর পরের ইতিহাস খুবই সংক্ষিপ্ত। সুব্রতর কাছে যে প্রস্তাব এসেছিল, গ্রিন ইন্টারন্যাশনালের সেই বিল্ডিং প্রজেক্টের ইভেন্ট আর হয়নি। প্রথম শ্যামল করণিকের দিয়ে যাওয়া ওই চেকটাও বাউন্স করেছে।
হিরন্ময় সেন প্রেস ব্রিফিং দিয়ে জানিয়েছিলেন, অন্বীতা পুরো ইনভেস্টিগেশনের দিনগুলোতে কী অপরিসীম মানসিক যাতনার মধ্যে দিয়ে গিয়েছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের ডিপার্টমেন্ট অব অ্যাটমিক এনার্জির কর্তাদের হাত দিয়ে কীভাবে গ্রিন ইউরেনিয়াম সংস্থা আদৌ ছাড়পত্র পায়, দেখতে গিয়ে জানা গেল বিশাল জাল বিছিয়ে রেখেছিল এই সংস্থা। ফলত, কেন্দ্র রাজ্য নানা ধরনের জটিলতা এড়িয়ে শেষমেশ ডকুমেন্ট জোটানোটাই ছিল এক বড় ব্যাপার। নিদ্রাহীন রজনী কেটেছে অন্বীতার টিমের। ভারতীয় সরকারি মালিকানার ইউরেনিয়াম সংস্থাগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় মিটিং, কলকাতায় সেন্টারে কবীন্দ্রকে কিছুদিন জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রায় নার্ভাস ব্রেক ডাউনের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়া… এসবের নিট ফল, এই জ্ঞানলাভ, যে, গ্রিন ইনকর্পোরেটেড আসলেই একটি শেল কোম্পানি। সারা পৃথিবীর নানা কুকর্মের প্রচুর টাকা এখানে কিছুদিন খাটানো, এবং এদেশের বেশ কিছু নিরীহ ছেলেকে গিনিপিগ করে নিজেদের ওষুধপত্র খাইয়ে সবুজ মানুষে রূপান্তরের কাজটা করা… তাদের দিয়ে নিজেদের কোম্পানির ফোলানো ফাঁপানো চিত্র হাজির করিয়ে আরও কিছু সাধারণ উদ্যোগপতির টাকা হাতিয়ে পালানো, এটা ছিল একটা উদ্দেশ্য। শ্যামনগরে বাড়ির কাজ একেবারেই এগোয়নি, লোহার কিছু খাঁচা শুধু পড়েছিল শেষমেশ। সত্যি বলতে কি, ইংরেজিতে একটা শব্দ আছে sham… মানে আজগুবি মিথ্যা… এই শ্যামনগর আসলে ছিল সেই শ্যাম-নগর।
দ্বিতীয় উদ্দেশ্য ছিল আরও ঘোড়েল। এদের আসল ইন্টারেস্ট সেখানেই। ইউরেনিয়াম উত্তোলনের আঁটঘাঁট বাঁধাটাই ছিল মূল ব্যাপার। সম্পূর্ণ অবৈধভাবে শ্যামনগরের আশপাশ থেকে বাড়ি তৈরির নাম করে ইউরেনিয়াম তুলে নেওয়া, এবং এ কাজে বেশ কিছু সরকারি কর্মচারি অফিসার ও সরকারি ছাপ মারা বৈজ্ঞানিককে হাতে নেওয়াটা ছিল ওদের ছক। প্রচুর টাকা ঢেলে কবীন্দ্র গোস্বামীর আন্তর্জাতিক সেমিনারে ওরা অনেকগুলি নিজেদের লোককে ঢুকিয়ে দেয়। এমনকি বেশ কিছু বক্তৃতার ভিডিয়ো তুলে সেগুলো সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দেয় নিজেদের ঘাঁটিগুলোতে।
শ্যামনগরে পুলিশ গিয়ে দু-তিনটে লোহার বাক্স অর্থাৎ কনটেনারে কিছু চেয়ার টেবিল পায়। কাগজপত্র পায়নি। অর্ধেক তৈরি হওয়া কিছু বাড়ি শূন্য খাঁ খাঁ করছে।
অর্ধসমাপ্ত বাড়িগুলোর পাশে একটা বিশাল গহবর। চাঁদের ক্রেটারের মতো বীভৎস হাঁ করে আছে।
সেই গর্তের মাটি পরীক্ষা করে ইউরেনিয়ামের ট্রেস পাওয়া গেছে। তবে অতবড় গহ্বর কীভাবে তৈরি হল আর সে মাটি কোথায় গেল কেউ তা বলতে পারেনি।
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, দীপ ঘোষ, পূজাবার্ষিকী, যশোধরা রায়চৌধুরী, সবুজ মানুষ
খুব ভাল লাগল দিদি । শুরুতেই ‘গালে সবজেটে আভা ‘ পড়েই বুঝলাম ‘দেযা ভু ‘ হয়েছে , তারপর কখন যেন কানেক্টেড হয়ে গেলাম । খুবই সমসাময়িক গল্প বলার অপেক্ষা রাখে না ।
থাঙ্কু! আমার খুব ভয় ভয় করছিল এই ফ্যান ফিক লিখতে।
সবুজ মানুষ বারোয়ারি লেখাটির যোগ্য উত্তরসূরি বলা যায় একে। যশোধরাদির কাছে একটাই অনুরোধ, আপনি এই গল্পটার একটা সিকয়েল লিখুন।
onek dhonyobad soham… thanks… khub i bhoye bhoye kora kaaj
খুব ভালো লাগল
thank you!