সম্পাদকীয়
লেখক: কল্পবিশ্ব সম্পাদকমণ্ডলী
শিল্পী:
স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে আপনাদের সবাইকে কল্পবিশ্বের তরফে জানাই অফুরান শুভেচ্ছা।
গত তিন-চারমাসে বাংলার সাহিত্যাকাশে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পট পরিবর্তন ঘটেছে। একের এক ইন্দ্রপতনে সাময়িকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বাংলা কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের বিজয়রথ। রনেন ঘোষের পর এবার চলে গেলেন শ্রী অদ্রীশ বর্ধন। তাঁর তিরোধানের সঙ্গে বাংলা কল্পবিজ্ঞানে রত্নযুগের শেষ সূর্যটি সম্পূর্নরূপে অস্তমিত হল।
শ্রী অদ্রীশ বর্ধনের স্মরণে “কল্পবিশ্ব” আয়োজন করেছিল এক সুধী-সমাবেশের, যেখানে সেই অস্তগামী সূর্যের স্তিমিত হয়ে আসা কিরণ-ছটা টুকু কীভাবে কেবল বাক্সবন্দী করে না রেখে, তাকে দাবানলের কাজে ব্যবহার দেওয়া যায়, সে নিয়ে আলোচনা চলেছিল অনেকক্ষণ। অদ্রীশ বর্ধন কল্পবিজ্ঞান সাহিত্যের যে ধ্বজাটি প্রায় একক হস্তে, নিজ স্কন্ধে বহন করে নিয়ে চলেছিলেন একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত, সেই পতাকা বহনের ভার এখন আমাদের মতো তরুণ কল্পবিজ্ঞান-পাগলদের কাঁধে। এই পতাকার বিপুল ওজন বহন করতে হলে চাই অদ্রীশ বর্ধনের মতো চওড়া কাঁধ, চাই ম্যাডনেস, চাই প্রচুর পড়াশোনা আর ক্ষুরধার সাহিত্যবুদ্ধি। আমরা নিশ্চিত যে কেবল শ্রী বর্ধনের মামুলি স্মৃতিচারণ নয়, “কল্পবিশ্ব” এর কারিগর, এবং তার দক্ষ লেখকরা অদ্রীশের এই স্বপ্নের “ম্যাডনেস”, বাংলা কল্পবিজ্ঞানকে আন্তজার্তিক মঞ্চে ঠাঁই করে দেওয়ার হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করবেন।
অদ্রীশ বর্ধনের স্মরণসভাতেই, “সবুজ মানুষ” বইটির লংফর্ম কালেক্টিভ প্রচ্ছদটি প্রকাশ করা হয় “কল্পবিশ্ব”- এর তরফ থেকে। শুধু বাংলা কেন, সারা ভারতের বুকে প্রথম এ ধরনের প্রচ্ছদ প্রকাশের বিরল সম্মান লাভ করল “কল্পবিশ্ব”। প্রচ্ছদটির মোড়ক উন্মোচন করে আমাদের ধন্যবাদার্হ হলেন প্রখ্যাত লেখিকা ও কবি শ্রীমতি যশোধরা রায়চৌধুরী এবং এ সময়ের অন্যতম খ্যাতনামা লেখক শ্রী দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য।
এরপর জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে “কল্পবিশ্ব” প্রত্যাশামতই নিয়ে এল দুটি একদম ভিন্ন স্বাদের বই। প্রথমটি “সবুজ মানুষ” যার প্রচ্ছদ নিয়ে পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। আর দ্বিতীয়টি, বাংলার প্রথম স্টিমপাংক কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস, শ্রী সুমিত বর্ধনের রচনা “অর্থতৃষ্ণা”।
“সবুজ মানুষ” গল্পটির ইতিহাস কমবেশি আমরা সকলেই জানি। কিন্তু হয়ত এটা অনেকের অজানা, যে এই বারোয়ারী গল্পটির লেখক চারজন ক্ষণজন্মা প্রতিভা (প্রেমেন্দ্র মিত্র, অদ্রীশ বর্ধন, দিলীপ রায়চৌধুরী ও সত্যজিত রায়), নিজেদের গল্পগুলিকে আকাশবাণীতে পাঠ করেছিলেন ষাটের দশকে। সেই রেকর্ডিং বাংলা কল্পবিজ্ঞান ইতিহাসের এক অন্যতম মূল্যবান দলিল।
অবহেলায় পড়ে থাকা সেই রেকর্ডিং-কে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিগরি সহায়তায়, এবং যাদবপুরেরই প্রফেসর অজিভিত গুপ্তের পৃষ্ঠপোষকতায় পুনুরুদ্ধার করতে সক্ষম হয় “কল্পবিশ্ব”।
“সবুজ মানুষ” ও “অর্থতৃষ্ণা” বই প্রকাশের দিনটিতেই “কল্পবিশ্ব” এর তরফের দর্শকদের সামনে বাজিয়ে শোনানো হয় সেই রেকর্ডিং। ইতিহাসকে এভাবে জীবন্ত হতে দেখে, সেদিন দর্শকদের অনেকেই যে অভিভূত হয়েছিলেন, তা বলাই বাহুল্য।
ফিরে আসি আমাদের এবারের সংখ্যার থিমে।
“কল্পবিশ্ব ওয়েবজিন” এর এবারের বিষয় “ডিটেকটিভ ফিকশন”। আমরা জানি বিজ্ঞানের দৌলতে মানুষের পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রভূত উন্নতি হতে পারে এবং ভোগ্যপণ্যের সহজলভ্যতা হয়ত বাড়তে পারে, কিন্তু দিনের শেষে আমরা সেই রক্ত মাংস, মস্তিষ্ক, স্নায়ু দিয়ে গড়া এক অনির্দেশ্য সৃষ্টি। যার মননে চিন্তনে প্রযুক্তির চেয়েও বেশি প্রভাব ফেলে সামাজিক নিয়ম কানুন – একজন মানুষের সঙ্গে অপরজনের সংযোগে সূত্রপাত হয় নব নব সম্পর্কের। তাই কালের নিয়মে, বিজ্ঞানের প্রভাবে পৃথিবী এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, মানুষের অপরাধবোধ, তার রিপুর ওপর নিয়ন্ত্রণ সভ্যতার পাতলা চাদরে ঢেকে যায় – ঢাকা পড়ে যায় তার নৃশংসতার নখদন্ত। কিন্তু তাই বলে কি মানুষ অপরাধ করা ছেড়ে দেয়? সেটা সম্ভব না – কারণ শুধু যে পার্থিব অভাবের তাড়নায় রিপুর জন্ম হয় তাই নয়, মানসিক, শারীরিক অভাবও অনিয়ন্ত্রিত আবেগের, ইচ্ছার জন্ম দেয়। ডিটেকটিভ বা গোয়েন্দার দল তাই, যুক্তিজাল বিস্তার করে, অপরাধ বিজ্ঞানের নানা ফন্দি খাটিয়ে অনিয়ন্ত্রিত রিপুর প্রভাব দমন করে সমাজকে নিষ্কলুষ রাখেন। তা যেমন আমাদের সময় সত্য, সেরকমই সকল কাল্পনিক সময়েও সত্য।
বাংলা কল্পবিজ্ঞানের ইতিহাসে হয়ত সেরকম অর্থে পেশাদার গোয়েন্দা-কে দেখায় যায়নি। কিন্ত অনুসন্ধিৎসু বৈজ্ঞানিক চরিত্র এসেছেন অনেক। বিখ্যাতদের মধ্যে প্রথমেই প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা বা ঘনশ্যাম দাস (ডস) কে রাখা যেতেই পারে। এরপরই আসেন সত্যজিত রায়ের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আবিষ্কারক প্রফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু এবং অদ্রীশ বর্ধনের উদ্ভটরসের প্রফেসর নাটবল্টু চক্র। পরবর্তী সময়ে অনেকটা একই ধারা অবলম্বন করে বাংলার পাঠকের সামনে অবতীর্ণ হয় সাহিত্যিক স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্মিত চরিত্র “স্যার সত্যপ্রকাশ”, ত্রিদীবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের “জগুমামা সিরিজ” এবং স্বনামধন্য কল্পবিজ্ঞান লেখক অভিজ্ঞান রায়চৌধুরীর ক্ষুরধার মহিলা গবেষক এবং গোয়েন্দা চরিত্র “অনিলিখা”র রোমাঞ্চকর অভিযান।
যদিও আমরা অনীশ দেব এর “ইনস্পেকটর রনি” চরিত্রটিও কল্পবিজ্ঞান গোয়েন্দার পর্যায়ে ফেলতে পারি, কিন্তু চরিত্রটি যেহেতু একটি রোবো, তাই এটিকে সাইবারপাংক শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
এর মধ্যে একটি বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান গল্পের উল্লেখ না করলে হয়ত আলচনা অসম্পুর্ণ থেকে যায়। অত্যন্ত প্রতিভাবান কল্প-সাহিত্য লেখক সিদ্ধার্থ ঘোষের “মহাকাশের মণিমুক্তো”। যদিও এই গল্পে সেরকম কোন পেশাদার গোয়েন্দা চরিত্র নেই, তাও একজন সদ্য কন্যা-হারা পিতার বুকে জ্বলতে থাকা যন্ত্রণার আগুন কীভাবে এক ভয়ঙ্কর রহস্যের উৎসমুখ খুলে দেয়, তা রচনার মুন্সিয়ানা যেকোন গোয়েন্দা গল্পের উত্তেজনা থেকে কিছুমাত্র কম নয়।
বিদেশি কল্পবিজ্ঞানে গোয়েন্দা চরিত্র এসেছে নানাভাবে এবং নানারূপে। আইজাক আসিমভ থেকে শুরু করে প্রচুর নামি-অনামি লেখক গোয়েন্দা চরিত্রকে কল্প-বিজ্ঞানে এনেছেন এবং অসামান্য সব সাহিত্য রচনা করে গেছেন। আসিমভের “কেভস অফ স্টিল”, ডগলাস অ্যাডামসের জটিল কল্পবিজ্ঞান ডিকেটটিভ উপন্যাস “ডার্ক জেন্টলি’স হোলিস্টিক ডিটেকটিভ এজেন্সি” বা ফিলিপ কের এর লেখা “আ ফিলজফিক্যাল ইনভেস্টিগেশন” প্রভৃতি এক অন্যরকম কল্পবিজ্ঞানের আস্বাদ বহন করে আনে, যা আমাদের চেনাপরিচিত কল্পবিজ্ঞানের ছক থেকে বেশ অনেকটাই আলাদা।
আমাদের এবারের ডিটেকটিভ ইস্যুর মধ্যে যেমন দুটি নভেল্লা থাকছে, সেরকমই থাকছে ছোটগল্প এবং একটি বড়গল্পের অনুবাদ। এই গল্প উপন্যাসের মধ্যে যেমন চেনা ছকের কল্পবিজ্ঞান আছে, সেরকমই আছে ফর্ম ভাঙা লেখা। পাঠকদের পছন্দ হলেই আমাদের শ্রম সার্থক।
চমৎকার প্রচ্ছদটি এঁকে ইস্যুটিকে সর্বাঙ্গসুন্দর করতে সাহায্য করেছেন তৃষা আঢ্য। তাঁকেও আমরা শুভেচ্ছা জানাই। আর শুভেচ্ছা জানাই আমাদের সমস্ত লেখক এবং অগণিত পাঠকবৃন্দকে – যাঁদের প্রতিদিনের উৎসাহে “কল্পবিশ্ব” তার ডালি সাজিয়ে রাখতে পারছে অসামান্য সব কল্প-রচনার উপঢৌকনে।
Tags: চতুর্থ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, ডিটেকটিভ সায়েন্স ফিকশন, সম্পাদকীয়
CONGRATULATIONS. GO AHEAD, I AM WITH YOU WISHING YOU A GRAND SUCCESS.