সাত স্বপ্নের রাত
লেখক: প্রতিম দাস
শিল্পী: প্রতিম দাস
এ কাহিনি আমার ছোটবেলার। সেদিন বুঝিনি স্বপ্ন সম্রাট আমাকে কী বলেছিলেন? বড় হয়ে অনুভব করেছি সে কথার মর্মার্থ। ছোটবেলায় আমি খুবই স্বপ্ন দেখতাম। সে সব স্বপ্নের সঙ্গে এতটাই একাত্ম হয়ে যেতাম যে প্রায় দিনই বিছানা থেকে পড়ে যেতাম। নানা রকম স্বপ্ন দেখতাম। তার কোনওটাই আমার মনে নেই। কিন্তু টানা সাতদিন ধরে দেখা একটা স্বপ্নের খুঁটিনাটি এখনও আমার মনে গেঁথে বসে আছে। আজ আপনাদের আমি সেই সাতদিনের থুড়ি, সাতরাতের কাহিনি শোনাব।
প্রথম রাত
মাসখানেক আগে একটা গল্প শুনিয়েছিল মা। তাতে ঘুমপরিদের দেশের কথা ছিল। সে গল্প শোনার পর থেকে প্রায় রাতেই ঘুমপরিদের রাজকুমারী তার বেশ কয়েকজন পরিচারককে পাঠিয়েছিলেন আমার কাছে। যাতে আমি ঠিকঠাক ওদের দেশে পৌঁছতে পারি। কিন্তু কিছু না কিছু ঘটনায় বারবার আমার ঘুম ভেঙে গেছে। শুধু তাই নয় প্রায় প্রত্যেকবার আমি বিছানা থেকে চাদর-টাদর জড়িয়ে নীচে পড়ে গিয়েছি। চেঁচিয়ে উঠেছি। যা শুনে আমার বাবা-মা ছুটে এসেছেন। ভেবেছেন, কী যে হয় ছেলেটার? মনে মনে নিশ্চিত বলেছেন, মনে হচ্ছে একবার ডাক্তার দেখানো দরকার।
অন্যান্য দিনের মতো সেদিনও রাতের খাওয়া সেরে নিজের ঘরে এসে টানটান করে পাতা সাদা চাদরের বিছানায় শুয়ে পড়লাম। মনে মনে বললাম, ‘একবার। যে করেই হোক একবার আমাকে ওই দেশে যেতেই হবে। ঘুমপরিদের প্রাসাদটা আমি দেখতে চাই। দেখতে চাই ওই দেশের রাজকুমারীকেও। কী ভালোই না হবে তাহলে! হে ভগবান, কেন বারবার ওইদেশে পৌঁছনোর আগেই আমার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে?’
সেদিন রাতেও ঘুমপরিদের দেশের রাজকুমারী তার এক বিশেষ সংবাদবাহককে দিয়ে দারুণ একটা খবর পাঠালেন আমার কাছে। মাথার ওপর ঝুঁটি বাঁধা লাল চুলের লম্বা রোগা সেই সংবাদবাহকের নাম লম্বকর্ণ। মুখে আকর্ণদন্তবিস্তৃত বন্ধুত্বসুলভ হাসি। পরনে হালকা বেগুনি রঙের কোট। তার ওপর চওড়া জ্যাকেট। সবুজ রঙের প্যান্ট আর একই রঙের বুট। মাথায় স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ খানিকটা বেশিই লম্বা একটা হ্যাট।
‘এই যে গবলু,’ মিষ্টি করে লম্বকর্ণ বলল, ‘রাজকুমারী নিজে আমাকে পাঠিয়েছেন এই আমন্ত্রণপত্রটা তোমাকে দেওয়ার জন্য!’
লম্বকর্ণর এগিয়ে ধরা এনভেলপটা নিলাম আমি। ভেতরে একটা টিকিট এবং সঙ্গে ঘুমপরি রাজ্যের রয়্যাল বক্স অফিসের ছাপ লাগানো। ‘এটা আমার জন্য?’ অবাক হয়ে বললাম।
‘হ্যাঁ। তোমার জন্য। রাজকুমারীর মনোরঞ্জনের জন্য এক বিশেষ ক্রিকেট খেলার আয়োজন করা হয়েছে। এটা তারই টিকিট। স্টেডিয়ামে তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন রাজকুমারী। খেলা শেষে আমি তোমাকে হিজ হাইনেসের সঙ্গেও দেখাও করিয়ে দেব।’
‘ক্রিকেট ! উউউওওও! কী যে বলব ভেবেই পাচ্ছি না!’
লম্বকর্ণ আমার হাত ধরে এমন এক সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে শুরু করল যার অস্তিত্ব কিছুক্ষণ আগেও এই ঘরে ছিল না। ‘দারুণ একটা খেলা হবে বুঝলে। আমিও অপেক্ষায় আছি ওটা দেখার। ওয়েস্ট ইন্ডিজের আমন্ত্রিত একাদশ আসছে। ওদের মোকাবিলা করবে বিশ্বজয়ী কপিলদেবের দল। এই মুহূর্তে বিশ্বক্রিকেটে সেরা দুই দল।’
আমি প্রায় লাফিয়ে উঠে হাততালি মেরে বললাম, ‘দারুণ ব্যাপার তো! ইস, বাবাই যদি সঙ্গে আসতে পারত।’
সিঁড়ি দিয়ে নেমে আমরা পৌঁছলাম একটা নিচু ছাদওয়ালা সুড়ঙ্গের ভেতর। এপাশে ওপাশে কিছুটা ব্যবধানে একটা মশাল লাগানো আছে দেওয়ালে। তার অনুজ্জ্বল আলোয় ভালো বোঝা যাচ্ছে দু’পাশের দেওয়াল ও ছাদে মণিমুক্তোর দারুণ সব নকশা করা আছে।
‘এই পথ আমাদের ঘুমপরিদের দেশে নিয়ে যাবে। বেশি না, মাত্র এক হাজার মাইল পথ। তারপর আরও পাঁচশো মাইল গেলেই ওখানকার স্টেডিয়ামে পৌঁছে যাব। চিন্তা নেই, সময় খুব একটা লাগবে না !’
অনেকটা সময় ধরে আমরা হেঁটেই চললাম। চারদিকের অদ্ভুত সব দৃশ্য দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম। ক্লান্তিও বোধ হচ্ছিল খুব। এক সময় থেমে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘ইয়ে, মানে আমরা আদপেই কি পৌঁছতে পারব?’
লম্বকর্ণ হাসল, ‘দাঁড়িও না গবলু, চলো চলো ! তুমি কি আমাদের রাজকুমারীর মনে দুঃখ দিতে চাও? চাও না নিশ্চয়ই? আমাদের দেশের সবাই জানে উনি তাঁর প্রিয় বন্ধুকে দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।’
আমরা আরও একশো মাইল পথ হেঁটে গেলাম, তারপর আরও একশো। মাইলস্টোন দেখে বুঝতে পারছিলাম। তারপর দেখতে পেলাম, আমদের সামনে এক শ্বেতপাথরের চওড়া সিঁড়ি উঠে গেছে। লম্বকর্ণ জানাল, আমরা ওদের রাজ্যে পৌঁছে গিয়েছি। বাতাসে তাজা অজানা ফুলের গন্ধ পেলাম।
‘জলদি চলো, গবলু! জলদি!’ আমাদের আরও পাঁচশো মাইল যেতে হবে। হাতে বেশি সময় নেই!’
‘আমি তো যত জোরে পারছি হাঁটছি!’
দু’পাশে গাছের সারি দিয়ে সাজানো চওড়া রাজপথ ধরে আমরা হেঁটে চললাম। ওখানকার অদ্ভুত সব সাজপোশাকে সজ্জিত অধিবাসীরা তাদের রাজকুমারীর নতুন বন্ধুকে স্বাগত জানাচ্ছিল চিৎকার করে। আমরা পার হয়ে এলাম এক বিশাল ভবন। লম্বকর্ণ বলল, এখানে এই রাজ্যের সমস্ত বিবাদ বিসম্বাদের মীমাংসা হয়। আরও কিছুটা সময় হাঁটার পর লম্বকর্ণ হাত তুলে বলল, ‘ওই দেখো! জাদু মায়া স্টেডিয়াম!’
‘বাহ! দারুণ ! কিন্তু আমি আর হাঁটতে পারছি না। কী করে যাব অতটা?’
‘গবলু, টিকিটটা হারিয়ে ফেলোনি তো? সঙ্গে আছে নিশ্চয়ই?’
এনভেলপটা তুলে ধরে দেখিয়ে বললাম, ‘এই যে আমার কাছেই আছে।’
‘বেশ বেশ। ওটা তোমার সামনের ওই নীল উর্দি পরা মানুষটাকে দাও। তাহলেই আমরা ভেতরে ঢুকতে পারব। খেলা এক্ষুনি শুরু হয়ে যাবে!’
চোখের নিমেষে নীল উর্দি পরা লোকটা কোথা থেকে এল রে বাবা ! এনভেলপটা এগিয়ে ধরতেই বদলে গেল চারপাশ।
জাদু মায়া স্টেডিয়ামের মতো বড় কিছু আমি এর আগে দেখিনি। শ্বেতপাথরে বাঁধানো পথ দিয়ে এগিয়ে গেলাম সেই জায়গার দিকে, যেখানে ঘুমপরিদের রাজপরিবার এবং তাঁদের আমন্ত্রিত মানুষদের জন্য বসার ব্যবস্থা করা আছে। ওখানে পৌঁছে মাঠের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলাম মাঠের পুরো দৃশ্যটা।
‘উউওওও! কী দারুণ! এরকম সবুজ ঘাস আমি আগে কখনও দেখিনি!’
‘গবলু, এদিকে এসো।’ লম্বকর্ণ ইশারা করে দেখিয়ে দিল রাজকুমারীর পাশের আসনটা।
ছবির বইয়ে যেমন আঁকা থাকে ঠিক তেমনই সুন্দরী আর মিষ্টি দেখতে রাজকুমারী বললেন, ‘এই যে এখানে চলে এসো। তাড়াতাড়ি। তোমার অপেক্ষাই করছিলাম। ক্রিকেট খেলা ভালো লাগে নিশ্চয়ই? দারুণ একটা খেলা হবে আশা করছি!’
আমি দু’হাত জুড়ে নমস্কার জানালাম রাজকুমারীকে। তারপর গিয়ে বসলাম ওঁর পাশে। তাকালাম মাঠের দিকে। খেলা শুরু হতে চলেছে। ‘আরে, ওইতো ব্যাট হাতে রেডি গাভাসকার! তার মানে ভারতীয় একাদশ ব্যাট করবে! বাবাইয়ের সবচেয়ে প্রিয় খেলোয়াড় উনি। ইস, এটা যদি উনি দেখতে পেতেন !’
রাজকুমারী চোখের সামনে তুলে নিয়েছিলেন ফিল্ড গ্লাস। বললেন, ‘গাভাসকারের সঙ্গে ওপেন করছেন শ্রীকান্ত।’
‘শ্রীকান্ত দারুণ ব্যাট করেন। আজ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলারদের মজা দেখাবেন উনি!’
জোয়েল গার্নার অনেক দূর থেকে ছুটে এসে বল করলেন। শ্রীকান্ত সপাটে ঘোরালেন তাঁর ব্যাট। ব্যাটে বলে সংঘর্ষ হতেই সেটা ধেয়ে আসতে শুরু করল আমাদের দিকে।
‘আহা, দারুণ ব্যাপার!’ লাল চকচকে বলটা দেখতে দেখতে আমি বলে উঠলাম।
রাজকুমারী ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠলেন, ‘মনে হচ্ছে ওটা আমাদের গায়ে এসেই লাগবে!’
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, ‘চিন্তা নেই, আমি ক্যাচ ধরে নেব।’
মাঠ থেকে বিন্দুসম ধেয়ে আসা লাল বলটা ক্রমশ বড় হতে থাকল। বড়, বড়, বড় আরও বড়। প্রথমে তরমুজের মতো, তারপর একটা বাড়ির মতো— তারপর দেখলাম গোটা স্টেডিয়াম ঢেকে যাচ্ছে ওটার আকারে— ওটা ধেয়ে আসছে খুব জোরে…
‘সর্বনাশ! কী হবে? ওটা তো আমাদের চিড়েচ্যাপ্টা করে দেবে! বাঁচাও!’
এরপরেই আমি বুঝতে পারলাম বিছানার চাদর জড়িয়ে বিছানা থেকে আবার মেঝেতে পড়ে গিয়েছি। দরজা খুলে ঢুকল বাবাই। আর্ত চিৎকারটা শুনেই ছুটে এসেছেন উনি।
‘ধুসসসসস! পুরো খেলাটা দেখতেই পেলাম না!’
‘বিছানায় উঠে পড়ো গবলু। আর স্বপ্ন দেখাটা একটু কমাও!’
দ্বিতীয় রাত
অঘোরে ঘুমোচ্ছিলাম। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল অদ্ভুত একটা আওয়াজে। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলাম এক অদ্ভুতদর্শন মানুষ ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে। পরনে জোকারের মতো পোশাক। মুখে সাদা রং। তার ওপর লাল রং দিয়ে মোটা করে ঠোঁট আঁকা আছে। মাথায় একটা শঙ্কু আকৃতির টুপি। ঢলঢলে প্যান্ট আর জামায় বেগুনি, হলুদ আর সবুজ রঙের অজস্র গোল গোল ছাপ। ডানহাতটা সামনের দিকে বাড়ানো। সেই হাতের আঙুলের ওপর একটা পাখি বসে আছে।
‘আপনি কি ঘুমপরিদের দেশ থেকে এসেছেন?’ জানতে চাইলাম।
‘হ্যাঁ। আমি ডুবডুবি। জোকারদের নেতা। রাজকুমারী তোমাকে নিয়ে যাওয়া জন্য আমাকে পাঠিয়েছেন। তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে ওঁর কাছে।’
‘সারপ্রাইজ! কী সারপ্রাইজ?’
‘উনি ইচ্ছের অধিকর্তার সঙ্গে তোমার দেখা করিয়ে দিতে চান।’
‘ইচ্ছের অধিকর্তা! মানে যিনি সব ইচ্ছের মালিক?’
জোকারটা মাথা নাড়লো ইতিবাচকভাবে।
হাই তুলে বললাম, ‘আবার সেই অতটা পথ হাঁটতে হবে। যেতে যেতেই তো আমি ক্লান্ত হয়ে যাই। পৌঁছনো খুব কষ্টের।’
‘আরে চিন্তা করার কিছু নেই, বুঝলে কিনা! আজ রাতে আমরা মোটেই হেঁটে যাব না।’ ডুবডুবি বললো। তারপর হাঁটু গেড়ে বসে পাখিটাকে নামিয়ে রাখল ঘরের মেঝের ওপর।
‘আরে! এ তো ভুতুম! মায়ের পোষা পায়রা!’ অবাক হয়ে বললাম।
‘হ্যাঁ, ওই আমাদের দু’জনকে ঘুমপরিদের দেশে নিয়ে যাবে।’
জোকারটার কথা শেষ হতে না হতেই আরও অবাক হয়ে দেখলাম, ভুতুম আকারে বাড়তে শুরু করেছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ওর মাথা ঘরের ছাদে গিয়ে ঠেকল।
‘এই মরেছে! এবার কী হবে! এত বড় পাখিটা ছোট্ট খাঁচায় ঢুকবে কী করে?’
ডুবডুবি একলাফে উঠে গেল দৈত্যাকার পাখিটার পিঠে। তারপর ঝুঁকে হাত বাড়িয়ে দিল আমার দিকে। উঠে বসলাম জোকারটার পেছনে। ভুতুম তার বিশাল ডানাদুটো ছড়িয়ে দিল। শোবার ঘরের ছাদ ভেঙে গেল গোল হয়ে। সেখান দিয়ে ভুতুম দোতলার ঘরে পৌছে গেল এক নিমেষে। ওখানে দুর্গা দিদি শুয়ে ছিল। আমাদের বাড়ির সবসময়ের কাজের লোক। বুঝতেই পারল না আমাদের আগমন। ভুতুম এবার দোতলার ঘরের ছাদটাও ভেঙে করে উঠে গেল চন্দ্রালোকিত শীতল আকাশে। পেছনদিকে তাকিয়ে আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘ভাঙা ছাদ দেখে বাবাই যে কী পরিমাণ খেপে যাবে তার ঠিকঠিকানা নেই!’
‘অনেকটা পথ আমাদের যেতে হবে, বুঝলে গবলু। তবে ভয়ের কিছু নেই,’ জানাল ডুবডুবি।
নিমোদের বাড়িটাকে ঘিরে বার কয়েক চক্কর মেরে ভুতুম আমাদেরকে নিয়ে উড়ে চলল শহরের ওপর দিয়ে। আকাশ থেকে নিজেদের স্কুল, দুর্গা মন্দির, বন্ধুর বাড়ি দেখতে পেয়ে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। মনে মনে বললাম, সত্যিই, হেঁটে যাওয়ার চেয়ে এটা অনেক অনেক ভালো!
‘ভালো করে চেপে ধরে থাকো। আমরা একটু বাদেই ঘুমপরিদের দেশে নামব।’
বলতে না বলতেই জোকারটা ভুতুমকে সোজা আকাশের দিকে উঠিয়ে ঝাঁপ দেওয়ার ভঙ্গিতে নীচের দিকে নামতে শুরু করল। দেখা গেল ঘুমপরিদের দেশের ঝকমকে সব গম্বুজগুলোকে। বেশ কিছুক্ষণ নীচের দিকে প্রচণ্ড গতিতে সাঁইসাঁই করে নেমে তারপর আলতো করে রাজকুমারীর প্রাসাদ প্রাঙ্গণে পা ছোঁয়াল ভুতুম।
একলাফে পাখিটার পিঠ থেকে নামল ডুবডুবি। ‘আমরা পৌঁছে গিয়েছি!’ বলেই আমাকে দু’হাতে ধরে নীচে নামিয়ে নিল। সঙ্গে সঙ্গেই ভুতুমের আকার কমতে শুরু করল। ফিরে এল নিজের আসল মাপে এবং ফুড়ুৎ করে উড়ে চলে গেল।
‘ও মনে হয় মায়ের কাছে ফিরে গেল, তাই না?’
উত্তর না দিয়ে জোকারটা বলল, ‘ওই দ্যাখো, রাজকুমারী আসছেন।’
দেখলাম উনি আমার দিকেই এগিয়ে আসছেন। ‘কিন্তু ওটা কে ওঁর সঙ্গে?’
ডুবডুবি জানাল, ‘উনিই তো ইচ্ছের অধিকর্তা।’ রাজকুমারী এবং আমার দিকে ঘুরে পরপর দু’বার ঝুঁকে বিদায় অভিবাদন জানিয়ে জোকারটা চলে গেল।
রাজকুমারী হেসে বললেন, ‘আমি খুব খুশি হয়েছি, তুমি আবার এসেছ বলে !’
‘বাপরে! আমার তো ভয় করছিল, মনে হচ্ছিল পাখিটার পিঠ থেকে বোধহয় পড়েই যাব।’
‘এসো তোমার সঙ্গে ইচ্ছের অধিকর্তার পরিচয় করিয়ে দিই। উনি এই ঘুমপরি রাজ্যের সবচেয়ে সুদর্শন ব্যক্তি। তোমার কী মত?’
কালো লম্বা চুলের অধিকারিণী রাজকুমারী নিজেও যে দারুণ সুন্দর দেখতে এটা বলতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় ঝড়ের মতো একজনের আবির্ভাব হল। হন্তদন্ত হয়ে সে এসে দাঁড়াল আমাদের কাছে। খরখরে স্বরে ব্যঙ্গ মিশিয়ে আগন্তুক বলল, ‘ইচ্ছের অধিকর্তা সুন্দর! ধুসসসস! ওটা ছেলে না মেয়ে তাইতো বোঝা যায় না ! এ আবার কী খেলা শুরু করলে বাপু তোমরা?’
‘উফফফস! উলটপালট তুমি এখানে কেন? বাবা যদি জানতে পারে তাহলে কিন্তু খুব রেগে যাবেন, বলে দিলাম!’ রাজকুমারী বলে উঠলেন।
অদ্ভুত রকমের অসুখী এক চরিত্র এই উলটপালট। এর কথা মা আমাকে শুনিয়েছিল কোনও একটা গল্পে। মুখের রং সবুজ। ঠোঁটের এক কোণে এক বিরাট মাপের চুরুট সবসময় ঝুলে থাকে। পরনে কালো লম্বা টেইল কোট, সবুজ প্যান্ট। মাথায় মাত্রাতিরিক্ত উঁচু স্টোভ পাইপ হ্যাট। তার সঙ্গে একটা কাপড় জড়ানো, তাতে লেখা আছে ‘তুর্কি নাচন দেখবে নাকি!’ পছন্দ হয়নি আমার চরিত্রটাকে। শুধু কার কী ক্ষতি করা যায় সেটাই ফন্দি আঁটে সব সময়। এখানে যে ও কেন এল?
‘এই যে উলটপালট! খুব সাবধান! যদি কোনও গণ্ডগোল পাকানোর কথা ভেবে থাকো তাহলে আমি কিন্তু তোমায় মজা দেখিয়ে ছাড়ব!’ যতটা পারলাম গম্ভীর হয়ে বললাম আমি।
সাড়ে তিন ফুটের বেঁটে বামন উলটপালট আমার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো, ‘ধুসসসস! তোমায় আমি ভয় পাই নাকি। বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমি আমার খুড়তুতো দিদিকে ডেকে নিয়ে আসব। উনি সূর্যকে সঙ্গে এনে এই ঘুমের দেশটাকে দিনের আলোয় গলিয়ে ধুয়েমুছে সাফ করে দেবেন।’
কথাটা শুনে রাজকুমারীর মুখে বিষাদ ঘনিয়ে এল। বললেন, ‘গবলু, ওর দিকে নজর দেওয়ার দরকার নেই। ও যে এখানে আছে সেটা নিয়েই মাথা ঘামানোর দরকার নেই। যাই হোক শোনো, ইচ্ছের অধিকর্তা তোমাকে কিছু বলতে চান।’
ইচ্ছের নিয়ন্ত্রক আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসলেন। ‘গবলু, ব্যাপার কী জানো? আমি খুব দামি একটা জিনিস হারিয়ে ফেলেছি।’ রাজকুমারী বললেন, ‘একমাত্র তুমিই নাকি ওটা খুঁজে এনে দিতে পারবে। আমার জন্য ওটা একটু খুঁজে দেবে প্লিজ!’
ইচ্ছের সোনালি চোখের দিকে তাকিয়ে আমি উচ্ছ্বসিত স্বরে বললাম, ‘যদি আমার সাধ্যের মধ্যে হয় আমি অবশ্যই সেটা আপনার জন্য করব।’
ইচ্ছে আবার হাসলেন। মিষ্টি সুরেলা স্বরে বললেন, ‘আমি জানতাম তুমি এরকম কিছুই বলবে।’
উলটপালট বলে উঠল, ‘এই যে মিস্টার ইচ্ছে, ঠিক কী জিনিস তুমি খুঁজছ শুনি? আমিও অনেক দূর থেকেই এসেছি। আমাকে এ ব্যাপারে জানালে ভালোই করতে।’
ইচ্ছের অধিকর্তা কিছুক্ষণ উলটপালটের দিকে তাকিয়ে থেকে পুনরায় আমার দিকে ফিরলেন।
‘আমি আশা করছি তুমি আমার সোনালি শিশিটা খুঁজে এনে দিতে পারবে গবলু। ওটার মাথায় একটা হিরের ঢাকনা লাগানো আছে। খুব ছোট্ট একটা শিশি।’
বললাম, ‘চিন্তা করবেন না। আমি সব জায়গা খুঁজে দেখব। আচ্ছা, ওই শিশিতে কী আছে?’
‘স্বপ্নধূলি। স্বপ্নসম্রাট ওটা আমাকে দিয়েছিলেন।’
‘বেশ আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব।’ মা বলেন একার চেয়ে দোকা ভালো। এই দেশের আমি তো কিছুই চিনি না। উলটপালট মনে হয় চেনে। যদিও ব্যাটাকে আমার পছন্দ নয় তবু মনে হচ্ছে ওকে সঙ্গে নিলে কাজটা সুবিধার হবে। অতএব গলার স্বর গম্ভীর রেখেই বললাম, ‘এই যে উলটপালট, চলো তাহলে। সময় নষ্ট না করে খুঁজতে শুরু করে দিই। যতক্ষণ না পাব, ফিরে আসব না, এটা জানিয়ে দিলাম।’
রাজকুমারী কিছুটা যেন জোর করেই হেসে বললেন বললেন, ‘শুভেচ্ছা রইল গবলু!’
‘খুঁজে আনতে পারলে তোমাকে একটা পুরস্কার দেব।’ জানালেন ইচ্ছের অধিকর্তা।
স্বপ্নধূলির খোঁজে রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে এলাম আমি আর উলটপালট।
সেই একই রকম ব্যঙ্গ ভরা স্বরে উলটপালট বলল, ‘এই যে খোকা, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না! কোথা থেকে খোঁজা শুরু করব আমরা? জঙ্গল নাকি মরুভূমি নাকি উত্তরের বরফের দেশ?’
দুটো বিশাল বিশাল গম্বুজওয়ালা ভবনের মাঝের এক সরু রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি বললাম, ‘বাপরে বাপ কী বিশাল বিশাল সব বাড়িঘর এখানে! রাতের তো আর বেশি বাকিও নেই বোধহয়। ওইটুকু সময় কোথা দিয়ে কি করব বুঝতেই পারছি না।’
একটু বাদেই উলটপালট রাস্তার পাশের একটা ভাঙাচোরা ধাতব নোংরা ফেলার পাত্রর দিকে এগিয়ে গেল। সেটা দেখে আমি বললাম, ‘আরে কোথায় যাচ্ছ। জলদি এসো। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই !’
উলটপালট ততক্ষণে ধাতব পাত্রটার ভেতর ঝুঁকে কিছু একটা তুলে এনেছে। ‘আরে, এটাই কি সেটা?’
আমি তাকিয়ে দেখলাম ওর হাতে একটা ছোট্ট শিশি। চেঁচিয়ে বললাম, ‘আরিব্ববাস! পেয়ে গেলে নাকি?’
‘আমার তো সেটাই মনে হচ্ছে। এটাই সেই হিরের ঢাকনা লাগানো সোনালি শিশি। হ্যাঁ এটাই!’
উলটপালটকে এই সময় বেশ আনন্দিত মনে হচ্ছিল। মুখের সেই বিষণ্ণ ভাবটা সহসাই উধাও হয়েছে। ‘সাধারণত অনেক খোঁজাখুঁজি করলে তবেই নাকি এর সন্ধান মেলে। সবাই সেটাই বলে থাকে। কিন্তু আমাদের বেশি খুঁজতেই হল না। কী বলো? কে যেন আমাকে বলে দিল ওটা ওখানেই আছে।’
‘তাহলে চলো আমরা ঝটপট ইচ্ছের অধিকর্তার কাছে ফিরে যাই। পুরস্কারটা নিতে হবে তো।’
‘সে সবের আর দরকার নেই। এটা আমি নিজের কাছেই রেখে দেব। আমিই তো এটা খুঁজে পেয়েছি।’
আমি ছুটে গেলাম সবুজমুখো বদমাইশটার কাছ থেকে শিশিটা কেড়ে নেওয়ার জন্য। শুরু হল ঝটাপটি। ওর চেয়ে আমার গায়ে জোর অনেক বেশি। হেরে যাচ্ছে দেখে উলটপালট ডাকল তার দিদিকে। ‘উষা দিদি, আমাকে বাঁচাও! ডেকে নিয়ে এসো সূর্যকাকুকে। আর এই হতচ্ছাড়া ছেলেটাকে ফিরিয়ে দিয়ে এসো ওর নিজের বাড়িতে।’
সহসাই পুরো ঘুমপরিদের দেশ ভেসে গেল উজ্জ্বল সূর্যের আলোয়। ‘এই মরেছে!’ আমি বুঝতে পারছিলাম আমার ঘুম ভেঙে যাচ্ছে…
চোখের পাতা খুলে গেল। দেখলাম মা কাঁধ ধরে ঝাঁকিয়ে বলছেন, ‘উঠে পড়ো গবলু। সকাল হয়ে গেছে। আঁকার স্কুলে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি!’
তৃতীয় রাত
তাকিয়ে দেখলাম এই মুহূর্তে আমার গায়ে পেতলের বোতামওয়ালা ফ্যাকাশে জলপাই রঙের ছোপ দেওয়া ফুলহাতা জামা আর প্যান্ট। মাথায় জাল লাগানো মিলিটারি টুপি। অবাক হয়ে ভাবলাম আরে ঘুমপরিদের শহরটা গেল কোথায়!
প্রাসাদ পুরো অদৃশ্য! রাস্তাঘাট, সাজানো পার্ক, শ্বেতপাথরের মূর্তি সব উধাও হয়ে গেছে সকালের হালকা কুয়াশার মতো। কিচ্ছুটি নেই। চারদিকে শুধু ঘাসে ঢাকা প্রান্তর। এদিকে ওদিকে চারদিকে তাকিয়ে একটা গাছও চোখে পড়ল না।
‘এসব ওই ব্যাটা উলটপালোটের কাজ একবার যদি ওকে হাতের কাছে পাই, মজা দেখিয়ে দেব! পালানোর পথ পাবে না হতচ্ছাড়াটা!’
সহসা একটা মেয়ের কন্ঠস্বর ভেসে এল, ‘আসলে ব্যাপারটা কী জানো? কখনও কখনও তুমি চাইলেও কোনও ভাবেই সেটা করতে পারো না যেটা তোমার করার ইচ্ছে হয়। আহা, একেবারে আমার ভাইয়ের মতো। আমার ভাই। একদম তোমার মতো।’
ঘুরে দাঁড়াতেই দেখে পেলাম মেয়েটাকে। ওর চেয়ে খুব একটা লম্বা নয়। কেমন যেন পাগলি পাগলি টাইপের। এই ঘুমপরিদের দেশে এর মতো দেখতে আর কাউকে এর আগে দেখিনি। কেন কে জানে বেশ ভালোই লাগল মেয়েটাকে। গায়ের রং ফ্যাটফেটে সাদা। মাথার চুল একদিকে ঝুলে আছে কোমর অবধি, অন্য দিক কাঁধের কাছ অবধি কাটা। সে চুলের আবার রং বদল হচ্ছে। কখনো সোনালি, আবার কখনো গোলাপি বা বেগুনি বা কমলা। কানের দুল দুটো ছোট্ট সাদা মাথার খুলি। নাকে আর ওপরের ঠোঁটে দুটো রিং আটকানো। এরকম দেখেছি মায়ের কাছে একটা বিদেশি ম্যাগাজিনে। বুনো মানুষেরা এরকম ভাবে সাজে। এই মেয়েটাকে দেখে অবশ্য বুনো মনে হচ্ছে না। সব মিলিয়ে কালো চামড়ার জ্যাকেট আর কালো স্কার্ট পরা মেয়েটা দেখতে বেশ সুন্দর। চোখের একটা মণি সবুজ, অন্যটা নীল। সরাসরি আমার দিকে না তাকিয়ে, আমার মাথার ওপর দিয়ে সেই চোখ জোড়া কোথায় কী দেখছে বোঝা যাচ্ছিল না।
‘এক্সকিউজ মি, দিদিমণি!’ বললাম, ‘আমি একটা…’
‘ও আমাকে দিদিমণি বললো। শেষ কে যেন আমাকে দিদিমণি বলেছিল… কে যেন… যাহ, ভুলে গিয়েছি!’
পুনরায় বলতে গেলাম, ‘ইয়ে, বলছিলাম, আমি একটা…’
‘একটা হিরের ঢাকনা লাগানো সোনালি শিশি খুঁজছ, তাই তো?’
মাথা থেকে টুপিটা খুলে বারদুয়েক চুলকে নিয়ে জানতে চাইলাম, ‘আপনি কী করে জানলেন?’
‘আমি জানি না আমি কী করে জানলাম, আমি জানি এটাই জানি। যেমন তুমি জানো না তুমি কখন কী জানতে পারবে।’
‘আমি কী জানি না যা জানতে পারব?’
অল্পবয়সি মেয়েটা কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘বাদ দাও। আমি তোমায় সাহায্য করতে পারি যা তুমি খুঁজছো সেটা খুঁজে পেতে। আমরা এর জন্য তাস ব্যবহার করব।’
‘বাবাই তাস খেলতে ভালোবাসেন।’
‘এখানে বসো দেখি। এই লাল ঘাসের ওপর।’ বলল মেয়েটা। ‘এবার এটাকে শাফল দিয়ে নাও।’
আমি মেয়েটার পাশে বসলাম, কিন্তু কিছুই করলাম না কিছু বললামও না। কী করব একটাই তো তাস। একটা তাস আবার শাফল দেওয়া যায় নাকি!
‘ও ভাবছো বুঝি, কী করে শাফল দেবে? দরকার নেই ওটাকে উলটে দাও,’ বলেই ঘাসে হাত ছোঁয়াল। সঙ্গে সঙ্গেই ওখানে বেশ কয়েকটা ছোট্ট ছোট্ট আগুন উগরাতে থাকা ড্রাগন ছোটাছুটি শুরু করে দিল।
আমি বেশ কিছুক্ষণ ড্রাগনগুলোকে ভালো করে দেখে তারপর তাসটাকে ওল্টালাম। হরতনের চার।
‘আহা,’ একটু হেসে মেয়েটি বললো, ‘পঞ্চবাণে ছয়ের ফোঁটা! দারুণ তাস। উউওও।’
‘ ও কী বলছে?’
‘তাস আবার কী বলবে? একটা তাসের শুধু মানে হয়। আমি ওর মানেটা তোমায় বলতে পারি। দাঁড়াও, একটু ভেবে নিই। উমম… হ্যাঁ, এর মানে হল, এটা খুব ভালো একটা সময় কাউকে সাহায্য করার জন্য। আর সেজন্যই আমি তোমাকে সাহায্য করছি।’
‘এটা কার ভাগ্য বলে রে বাবা! যাকগে ধন্যবাদ। আমাকে ওই বোতলটা খুঁজে বার করতেই হবে !’ আমি বললাম।
‘চলো, আবার শাফল করো।’
অগত্যা হরতনের চারটাকে উল্টে দিলাম। দেখা গেল ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের মহারাজার ছবি ছাপানো আছে ওটার ওপর। আবার ওল্টালাম তাসটাকে। ছবিটা বদলে গেছে। এখন ইস্কাপনের জোকার।
‘আহা, দারুণ! দারুণ। এটা কাজকর্মের এবং খেটে খাওয়ার তাস। সাংঘাতিক তাস। এর মানে অনেক দুঃখ-কষ্ট। যখন তুমি কাউকে সাহায্য করবে তখন এরকম হবে। সাহায্য করাই উচিত নয়, বুঝতে পারলে?’ বলেই পুনরায় আমার মাথার ওপর দিয়ে দূরে তাকিয়ে থাকল। তারপর সহসাই উঠে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, ‘যাকগে, ইয়ে। ব্যাপার এই যে, গুড বাই।’
বললাম, ‘আরে, চলে যাচ্ছেন কেন? প্লিজ যাবেন না!’
মেয়েটি আবার বসল। ‘ঠিক আছে। চলো আবার একবার চেষ্টা করে দেখি। তাস উল্টাও। কিন্তু বোমা বিস্ফোরণ বা নৌকাডুবি হলে আমি কিন্তু আর থাকব না।’
হ্যাঁ বা না হতে পারে, দু’রকম ভাবেই মাথা নেড়ে আমি পুনরায় তাস ওল্টালাম। রুইতনের দুই।
‘এটা অনেক অনেক ভালো। তাই মনে হচ্ছে না? এটা স্বাধীনতা, আনন্দ এবং গোল্ডফিশের মতো। অবশ্য তুমি যদি গোল্ডফিশ চাও তবেই। আমার ওদের খুব ভালো লাগে। ওরা যতদিন বেঁচে থাকে ততদিন পর্যন্ত। তোমার ভবিষ্যৎ খুব ভালো। তুমি ভালো একজন বন্ধু পাবে। একজন লম্বা, ফ্যাকাসে মার্কা মানুষ যে এই শহর থেকে অনেক দূরে থাকে। আরে, আরে! আমি তো মনে হছে মানুষটাকে চিনি !’
‘কে? বলুন না কে?’
‘উঁ ঊঁ’।’
‘আমি কি আবার একবার তাস ওল্টাব?’
মেয়েটা ভুরু দুটো ওপরের দিকে ওঠাল। ‘আর তো কোনও তাস নেই।’
‘তাহলে আমি সোনালি শিশিটার খোঁজ কী করে পাব? উলটপালট কোথায় যে পালাল?’
মেয়েটি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘ঠিক আছে। এই সুতোটা নাও।’ বলে একটা সাদা সুতো আমার হাতে ধরিয়ে দিল। ‘এর অন্য দিকটা তোমার সোনালি শিশির সঙ্গে বাঁধা আছে। এটা ধরে ধরে এগিয়ে গেলেই তুমি ওটা পেয়ে যাবে।’
‘ধন্যবাদ।’
‘ভয় হচ্ছে তুমি ওটার কাছে পৌঁছনোর আগেই কেউ কোনও বদমাইশি না করে।’
‘ধন্যবাদ দিদিমণি,’ পুনরায় বললাম।
‘ও আমাকে দিদিমণি বলল! ‘খুশির স্বরে কথাটা বলেই মেয়েটা বাতাসে মিলিয়ে গেল।
খুলে গেল আমার চোখ। শুয়ে আছি বিছানায়। শুনতে পেলাম বাবাইয়ের গলা, ‘এই যে আলসে ঘুমকাতুরে ! এবাড়িতে যারা বেশি ঘুমায় আজ থেকে তাদের ব্রেকফাস্ট বন্ধ! মনে থাকে যেন!’
চতুর্থ রাত
এই মুহূর্তে আমার সামনে ঘুমপরিদের দেশের সেই আদিগন্ত ঘাসের এলাকাটাই আর নেই। সুতো ধরে যত এগোচ্ছিলাম কুয়াশা চারদিক থেকে পাকে পাকে এসে জমছিল আমার সামনে। ফুট তিনেক দূরের কিছুই দেখাই যাচ্ছে না।
‘বাপরে বাপ! এ আবার কোথায় এলাম? কী ঘটছে এসব?’
একটু বাদেই মাথার ওপরের উজ্জ্বল নীল আকাশটাও মিলিয়ে গেল। কেমন যেন ফ্যাকাসে মেরে গেল সব কিছু। মনে হচ্ছিল, যেন কোনও ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছি। সুতো অনুসরণ করে হেঁটেই চললাম, হেঁটেই চললাম। পথ আর শেষ হয় না। কোথায় যে যাচ্ছি তার ঠিকঠিকানা নেই। আশপাশে কোনও দেওয়াল, কোনও ছাদ বা পায়ের নীচে মেঝে এরকম কিছুই চোখে পড়ছিল না। শুধু কুয়াশা যেন ক্রমেই ঘন হয়ে যাচ্ছে।
সহসাই ওখানে একটা বিশাল ধূসররঙা ইঁদুরের আবির্ভাব হল। ‘সর্বনাশ! ওটা আমাকে দেখতে পেলে কী যে হবে?’ মনে মনে বললাম আমি।
খ্যারখেরে স্বরে ইঁদুরটা বলল, ‘আমি তোমায় দেখে ফেলেছি।’
‘আরিব্বাস! এ তো দেখছি কথাও বলতে পারে!’
‘কী ব্যাপার গবলু, আমাদের এলাকায় এসেছ কেন? কেউ তো এদিকে আসে না। আর যারা আসে তারা বুঝতে পারে এসে কী ভুলই না করেছে!’
কথাটা শুনে আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল। ‘না, আর ঘুমনো চলবে না। আমাকে জাগতে হবে। নিজের ঘরে ফিরে যেতেই হবে।’
কথাটা শুনে ইঁদুরটা কুৎসিতভাবে হেসে বলল, ‘তুমি আর কখনই বাড়ি ফিরতে পারবে না গবলু। সুতোটার দিকে তাকাও একবার।’
বুকটা ধড়াস করে উঠল সুতোটা দেখেই। হাতে ঝুলছে ওটা! কেটে দিয়েছে কেউ অন্য দিকটা। ভয়ে সারা শরীর কেঁপে উঠল। ধপ করে হাঁটু গেড়ে বসে সুতোর বাকি অংশটা হাতড়াতে থাকলাম কুয়াশার ভেতর।
‘ওটা তুমি আর খুঁজে পাবে না।’ প্রায় ফিসফিস করে বললেও কথাগুলো আমার কানে ঢুকে যাচ্ছিল তিরের মতো সজোরে। ‘তুমি আর কোনওদিনই তোমার বাবা-মার কাছে ফিরে যেতে পারবে না। এভাবেই মানুষের আশা পরিণত হয় হতাশায়।’
চোখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল। উঠে দাঁড়িয়ে এদিকে ওদিকে উদভ্রান্তের মতো তাকালাম। চারদিকে শুধুই কুয়াশা। ইঁদুরটা ছাড়া কোত্থাও কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না।
‘মা !’ চেঁচিয়ে উঠলাম।
‘উনি তোমার ডাক শুনতেই পাবেন না।’
‘এরকম কেন হচ্ছে? আমি এখানে কেন এলাম?’
ইঁদুরটা নিজের হাতের চকচকে নখগুলো দেখতে দেখতে বললো, ‘ওই যে তোমার কাজটার জন্য। যা তুমি করতে পারোনি। হিরের ঢাকনা লাগানো সোনালি শিশি খুঁজে বের করা। ইচ্ছের অধিকর্তা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। আর এদিকে তুমি ওটা না খুঁজে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছ।’
‘আমি তো ওটাই খুঁজতেই বেরিয়েছি। কিন্তু এই কুয়াশার ভেতর ওটাকে কী করে খুঁজব?’
‘এর জন্যই তো অনেক কিছু শিখতে হয়, বুঝতে হয়। বোকার মতো এদিকে সেদিকে ঘুরে কিচ্ছু হয় না। একজন বুদ্ধিমান মানুষ জানে কখন খোঁজা থামাতে হয়। আর খুঁজে লাভ নেই। বাদ দাও। লাভ নেই !’
কথাটা শুনে অবাক হয়ে তাকিয়ে চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই দেখলাম তার সামনে ইঁদুরটা বদলে এক বুড়িতে পরিণত হল। গোটা গায়ের চামড়া কুঁচকানো। চোখের মণি মেঘাচ্ছন্ন শীতকালের মতো ফ্যাকাশে। মাথার কালো চুল একটা নোংরা দড়ি দিয়ে বাঁধা। গায়ে এক টুকরো কাপড়ও নেই। ডান হাতে মা যে আঙুলে বিয়ের আংটি পরেন সেই আঙুলে বুড়িটা পরে আছে একটা লোহার হুক। মাঝে মাঝেই সেটা দিয়ে নিজের মুখের চামড়া টেনে ছিঁড়ছে। সারা মুখ, গা ভেসে যাচ্ছে রক্তের ধারায়। সারা শরীর কেমন যেন করে উঠল আমার। শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা জলের স্রোত বয়ে গেল যখন দেখলাম বুড়িটা আমার দিকেই এগিয়ে আসছে।
কঙ্কালের মতো হাতের আঙুল নেড়ে বুড়িটা বলল, ‘এদিকে এসো বাছা! আমি তোমায় দেখিয়ে দিচ্ছি সব কিছু কী করে শেষ করতে হয়।’
আমি ছুটতে শুরু করলাম। কানের ভেতরে দপদপ করছিল। সারা শরীর গরম হয়ে গেছে। দিগ্বিদিক না বুঝে ছুটে চললাম। ঘন কুয়াশা জাপটে ধরছিল আমাকে। চারদিকে অনেকগুলো খোলা জানলা হাওয়ায় ভাসছিল। ওগুলোর অন্যদিকে কী আছে? কী দেখতে পাব? ভাবছিলাম ছুটতে ছুটতে। কিন্তু না, থামা যাবে না।
‘ঘুমটা ভেঙে যাচ্ছে না কেন?’ ছুটতে ছুটতে বলে উঠলাম আমি। কতক্ষণ ধরে দৌড়েই চলেছি, পিছু ছাড়েনি বিকট বুড়িটা।
এখন ছুটছি একটা কাদাভর্তি সরু পথ দিয়ে। এদিকে ওদিকে কাঠের বাঁধের মতো করা আছে। আমি কোনো একটা খাদের ভেতর ঢুকে গিয়েছি। দু’পাশে এখন ফুট তিন-চারেক উঁচু মাটির দেওয়াল। ভালো করে তাকাতেই চোখে পড়ল ওপর দিকে বালির বস্তা সাজানো আছে খাদের কিনার ঘেঁষে। কিছুটা দূরে দুরেই রাখা আছে কাঠের মই। বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কোথা দিয়ে যাচ্ছি। যদিও ছোটা থামাইনি। এদিকে সেদিকে ঘুরে ফিরে চলেছে রাস্তাটা। যেন এক গোলকধাঁধা। কোথা থেকে কোথায় যাওয়া যাবে কোনও হদিস মিলছে না।
‘বছরের পর বছর তুমি এখানে ছুটেই মরবে। তারপর একদিন তোমার প্রাণটা ফুস করে বেরিয়ে যাবে এই ট্রেঞ্চের ভেতরেই,’ ক্যানক্যানে স্বরে বলে উঠল বুড়িটা।
মনে হল বুড়িটা যেন আমার পাশেই এসে গেছে। কানে ফিসফিস করে কথাগুলো বলছে। ‘এটা ট্রেঞ্চ?’ আমি ট্রেঞ্চ মানে জানি। যুদ্ধ করার সময় এখানেই সৈন্যরা লুকিয়ে থাকে।
‘বারোটা বছর। তোমার জীবনের শেষ সময়। কিছুই না। তুমি এখানে এই ঠান্ডায়, কাদায় বাকিদের সঙ্গে পচে মরবে। শুধু পোকামাকড়ের দল এখানে বেঁচে থাকে। ঘুরে বেড়ায়। আর কেউ বেঁচে থাকে না। তুমিই বা কেন…’
আর দম নিতে পারছিলাম না। খুব কষ্ট হচ্ছে। কোনওক্রমে শরীরটাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিলাম। বাঁদিকে একটা বাঁক। তারপর আবার ডান দিকে। এভাবে কিছুটা চলার পর বুড়িটার কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু হাঁটা থামাইনি।
না এবার একটু বিশ্রাম নিতে হবে। আর দম নেই। ঘুরে তাকালাম পেছন দিকে। দুটো লাল চকচকে বিন্দু ! ‘সর্বনাশ! এ তো মনে হচ্ছে সেই ইঁদুরটার চোখ! নাহ, আমাকে এখান থেকে পালাতেই হবে।’
আরও কিছুটা এগিয়ে যেতেই কাদার ভেতর ঢুকে থাকা একটা কিছুতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। যন্ত্রণায় চোখ বুজে বলে উঠলাম, ‘ওহ, মাগো! আমার পা-টা বোধহয় ভেঙেই গেল!’
চোখ খুলে দেখতে পেলাম নিজের ঘরে পৌঁছে গিয়েছি। তবে বিছানায় নেই। পড়ে আছি নীচে, মেঝেতে।
‘আমি আবার স্বপ্ন দেখছিলাম!’
‘হুম, সে তো বুঝতেই পারছি’ বলে উঠলেন বাবাই। ‘কীসের স্বপ্ন এত দেখিস বল তো তুই?’
পঞ্চম রাত
সেদিন রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কেন জানি না মনে হল, রাজকুমারী আজও কাউকে পাঠাবেন আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি শিওর, উনি আমাকে ওই হিরের ঢাকনা লাগানো সোনালি শিশি খুঁজে বের করতে আরও একটা সুযোগ দেবেন। উলটপালট ওখানেই কোথাও লুকিয়ে আছে ওটা খুঁজে বার করে ইচ্ছের অধিকর্তাকে যেভাবেই হোক ফিরিয়ে দিতে হবেই।
‘তাহলে ওটা খুঁজতে তো তোমাকে ঘুমপরিদের দেশেই যেতে হবে।’
কে? কে কথা বলল? মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখতে পেলাম আমার চেয়ে হাইটে একটু বড় একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরনে আমাদের স্কুলের মতো পোশাক। যদিও সেটা নীলের বদলে কালো রঙের। গলায় ঝুলছে একটা রুপোর ক্রসের মতো কিছু। বললাম, ‘আরে তুমি তো খুব সুন্দর দেখতে! ঘুমপরিদের রাজকুমারীর মতোই সুন্দর। একদম! আরে দাঁড়াও দাঁড়াও! কী অদ্ভুত! তোমাকে তো একদম আমার মায়ের মতো দেখতে!”
মেয়েটি হেসে বলল, ‘তুমিও খুব সুন্দর দেখতে গবলু।’
‘আচ্ছা তুমি কি আমার স্কুলেই পড়ো? আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে আমি তোমাকে ওখানে দেখেছি।’
মেয়েটি মাথা নেড়ে বললো, ‘না। আমাদের এর আগে কোনওদিন দেখাই হয়নি। যদিও বেশিরভাগ মানুষ আমার সঙ্গে একবার দেখা করাটাকেই অনেক কিছু পাওয়া বলে মনে করে। যাকগে, তুমি যদি ঘুমপরিদের দেশে যেতে চাও, তাহলে আমি তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারি। ওটা ওই দরজার ওপাশেই।‘
‘কিন্তু ওখানে তো কোনও দরজা নেই! আরে সত্যিই একটা দরজা! কোথা থেকে এল!’
হঠাৎ করে আবির্ভাব হওয়া দরজাটা খুলল মেয়েটা। মেয়েটার পেছন পেছন সেই দরজা দিয়ে পা বাড়ালাম অন্যদিকে। ঝকঝকে নীল আকাশ। কিন্তু এটা সেই ট্রেঞ্চের এলাকা। মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম পেছনে দরজাটা নেই।
‘কী হল গবলু?’ জানতে চাইল মেয়েটা।
‘এ জায়গাটা আমার একদম পছন্দ নয়। ওই কুৎসিত ভয়ানক বুড়িটা আমাকে বলেছিল…’
মেয়েটা হাসল, ‘আমি জানি ও তোমাকে কী বলেছে। এবার আমি যা বলছি সেটা শোনো। অনেক কিছুই ও বলে দেয় কিছু না বুঝেই।’
মাথার ওপর জ্বলজ্বলে সূর্য তবু কেমন যেন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগছিল আমার।
‘কে ছিল ওটা?’
‘আমার বোন। আমার ছোটো বোন।’
আমি এবার সত্যিই দোটানায় পড়ে গেলাম। একে তো এই মেয়েটাকে ওই বুড়ির বোন বলে ভাবতেই পারা যাচ্ছে না। তাছাড়া এই মেয়েটা কী করে ওই বিদঘুটে বুড়িটার বড় দিদি হবে। প্রশ্ন করলাম, ‘ও আমাকে এখানে কেন নিয়ে এল?’
‘আসলে ও মনে করে, মানুষ যদি আগে থেকে জানতে পারে সে কীভাবে মারা যাবে, তাহলে সেই মানুষ মানসিকভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। সে ভাবতেই পারে না, মৃত্যুর চেয়েও খারাপ কিছু হয়। অনেক অনেক খারাপ অবস্থা।’
কী যে বলেছিল কিছুই মাথায় ঢোকেনি সেই সময়। শুধু বুকের ভেতরে একরাশ ভয় জমাট বেঁধে উঠেছিল। বিড়বিড় করে জানতে চেয়েছিলাম, ‘ও কী করে জানল আমার সঙ্গে কী হবে?’
‘ও মনে করে ও সব জানে।’
‘ওহ, আচ্ছা। বলছি যে, আমি কি সত্যি আর বারো বছরের মধ্যেই এখানে মরে যাব?’
‘হতেও পারে।’ মেয়েটা এগিয়ে এসে আমার দিকে ভালো করে তাকিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, ‘আবার নাও হতে পারে। আমার মনে হয় আমার ছোট্ট বোনটার ভালো করে আরও কিছু জানা দরকার। তারপর কিছু বলা উচিত। যাকগে বাদ দাও ওসব কথা। এস আমার সঙ্গে।’
আমার হাত ধরে মেয়েটি এবার হাঁটতে শুরু করল। এরকম ফ্যাকাশে গায়ের রং আর এত কালো চুলওলা মেয়ে আমি আগে দেখিনি। কিছুটা হাঁটার পর মেয়েটার গলার ভারী রুপোর লকেটটা দেখিয়ে জানতে চাইলাম , ‘ইয়ে, ওটা কী?’
‘এটা। একে বলে আঁখ।’
‘আঁখ। মানে চোখ? একেই আঁখ বলে বুঝি?’
মেয়েটি আবার হাসল। লকেটটাকে হাতে ধরে বললো, ‘আমার একটা ভাই আছে। সে এটাকে বলে অ্যান্সেট ক্রস। অ্যান্সেট মানে ওই পাহাড়ি পথের বাস ড্রাইভাররা যেমন হাতল ব্যবহার করে।’
‘কী?’
‘বাদ দাও। আপাতত এখন তুমি অন্যদিকে কী আছে সেটা দেখো দেখি।’ বলেই আঙুল দিয়ে কিছুটা দূরে ট্রেঞ্চের দেওয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে রাখা একটা মই দেখাল মেয়েটা।
‘আমি কি ওটাতে উঠব?’
‘হ্যাঁ, ওঠো। তারপর আমাকে জানাও কী দেখতে পেলে…’
এই ট্রেঞ্চ থেকে উঠতে পারার মতো আনন্দ আর কিছুতে নেই এই মুহূর্তে আমার কাছে। তরতর করে উঠে গিয়ে তাকালাম অন্য দিকটায়। ‘ওয়াও! কী দারুণ একটা বাগান! ওখান দিয়েই কী ঘুমপরিদের দেশে ফিরে যাওয়ার পথ খুঁজে পাওয়া যাবে? প্রাসাদটা কি কাছেই কোথাও?’
‘নীচে তাকাও। দেখো পায়ে চলার একটা পথ দেখা যাচ্ছে। ওটা ধরে চলে যাও। রাজকুমারীর সঙ্গে দেখা হলে আমার তরফ থেকে একটা চুমু দিও।’
‘বেশ, তবে আর যা কিছু করি না কেন এবার আগে আমাকে সোনালি শিশিটা খুঁজে বার করতেই হবে। যেভাবেই হোক ইচ্ছের অধিকর্তাকে আমি সন্তুষ্ট করবই।’
মেয়েটি ভুরু কুঁচকে তাকাল। ‘আমি জানি। প্রায় সকলেই তোমার মতো সেটাই করতে চায়। ওই ইচ্ছেটাকে ভালবাসতে গিয়ে মানুষ কীভাবে সব অপরাধ করে আর শাস্তি পায়, আমার একদম ভালো লাগেনা। যাকগে আর দেরি কোরো না। ওপরে উঠে যাও, সাবধানে।’
উঠে গেলাম ওপরে। তারপর তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে প্যান্টটা আটকে গেল কাঁটাতারে। টাল সামলাতে না পেরে আবার পড়ে গেলাম। তবে ওই বাগানের দিকেই।
‘গবলু! অ্যা-আই গবলু!’ কাঁধ ধরে ঝাঁকাচ্ছিলেন মা। ‘শীতকালে এভাবে প্রতিদিন রাতে তুই যদি মেঝেতে পড়ে থাকিস তাহলে তো একটা কেলেঙ্কারি বাঁধিয়ে বসবি দেখছি!’
ষষ্ঠ রাত
আগের দিন যেখানে পড়ে গিয়েছিলাম সেখানেই নিজেকে ফিরে পেলাম পরের দিন। পায়ে চলার পথটার দু’পাশে নিচু মাপের বেড়া দেওয়া আছে। এগোতে এগোতেই একটা সূর্যঘড়ি আর একটা লোহার বেঞ্চ চোখে পড়ল। বাগানটা, যদি এটা বাগান হয়, অনেক অনেক বড়।
‘এ আবার কোন জায়গায় এসে পড়লাম কে জানে? এটা কি ঘুমপরিদের দেশের ভেতরেই?’
গত রাতে ট্রেঞ্চের অলিগলিতে পথ হারিয়েছিলাম। আর এখন এই বেড়ায় ঘেরা রাস্তায় ঘুরপাক খাচ্ছি। চারদিকে ঝুমকো লতাগাছগুলো ঝুলে আছে। আগের জায়গাটার মতোই বুঝতে পারছিলাম না কোথায় এগিয়ে চলেছি। প্রত্যেকবার বাঁক ঘোরার পর এমন জায়গায় হাজির হচ্ছিলাম যা দেখে মনে হচ্ছিল এখানে একটু আগেই এসেছিলাম। সব জায়গাতেই সুন্দর করে ছাঁটা ঘাসের লন, নিখুঁত করে বানানো বেড়া আর সবুজ রং করা বেঞ্চ।
চারদিকে অনেক অনেক মূর্তি। একসঙ্গে এত মূর্তি আগে দেখিনি কোনওদিন। পুরুষরা সবাই একেবারে ফিটফাট হয়ে আছে। বাবাই অফিসে যাওয়ার সময় যেমন পোশাক পড়ে, ঠিক তেমন সব পোশাক ওদের গায়ে। মহিলারাও সব সেজেগুজে আছে। বইয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত মনে হচ্ছে। বেশ কিছু বাচ্চার মূর্তিও আছে আশপাশে। হয় তারা খেলা করছে নয় ডেস্কে বসে পড়ছে বা লিখছে। এভাবেই আরও কিছুক্ষণ গোলকধাঁধার মতো পথ হাঁটার পর একটা মূর্তির কাছে এসে অবাক হয়ে তাকালাম। আরে! এটা তো সুজিত আঙ্কেল ! এখনে ওঁর মূর্তি কেন?
আরও কিছুক্ষণ হাঁটার পর শরীর আর পারছিল না। খিদেও পেয়েছিল খুব। নিজের মনেই বললাম, ‘এইসময় যদি রাজকুমারী কাউকে পাঠাতেন আমার কাছে, তাহলে বেশ ভালো হত।’
একটু বাদেই… স্বপ্নের জগতে এই একটু আসলে কতটা সময় কে জানে। হয়তো সেটা এক সেকেন্ড বা এক ঘণ্টা বা এক বছর, পথের বাঁকে একজন মানুষের আবির্ভাব হল। সম্ভবত আমার ইচ্ছের সুত্র ধরেই। মানুষটার পরনে লম্বা বাদামি রঙের আলখাল্লা, মুখটা ঢেকে আছে ঝুলে থাকা টুপিতে। হাঁটতে হাঁটতে মানুষটা একটা বিরাট মাপের বই দেখছিলেন। মানুষটার কবজিতে একটা শিকল বাঁধা। যার শেষ প্রান্ত গিয়ে আটকানো আছে বইটার সঙ্গে।
ইচ্ছে ছিল না পাঠরত বাদামি আলখাল্লা পরা মানুষটাকে বিরক্ত করার, কিন্তু কৌতূহল সাংঘাতিক জিনিস। বলেই ফেললাম, ‘ইয়ে, বলছিলাম, আপনি ওটা কী বই পড়ছেন?’
মানুষটা আমার দিকে তাকালেন, তারপর অবিকল আমাদের স্কুলের প্রিন্সিপালের মতো শান্ত গম্ভীর কন্ঠে বললেন, ‘এটা হল সেই বই, যেখানে আজ অবধি যা ঘটেছে এবং আগামীতে যা ঘটবে সব কিছু লেখা আছে।’
কথাটা শুনে চমকে গেলাম। ‘আচ্ছা এটাতে কি বলা আছে কীভাবে এই পৃথিবী সৃষ্টি হল?’
‘হ্যাঁ, আছে তো, জগৎ সৃষ্টির কথাও লেখা আছে।’ বলেই বইটার চারভাগের একভাগ পাতা উলটে একটা পাতা বার করলেন। ‘এই যে, এই চ্যাপ্টারে সব লেখা আছে।’
ব্যাপারটা অদ্ভুত মনে হলো আমার। ‘শুরু কী করে হল যদি অতগুলো পাতার পর লেখা হয়, তাহলে ওর আগের পাতাগুলোতে কী লেখা আছে?’
‘সেই সমস্ত ঘটনা যা জগৎ বা পৃথিবী সৃষ্টির আগে ঘটেছিল।’ একই রকম শান্ত স্বরে জবাব এল।
‘জগৎই যখন ছিল না, তখন কী ছিল?’
‘তোমার ইচ্ছে হলে সেটা এই বই পড়ে জেনে নাও।’
বইটার দিকে তাকালাম। লেখাগুলো যদি বাংলা বলেই মনে হচ্ছে কিন্তু যেন বাংলা নয় ! অদ্ভুত! কিছুই বুঝতে পারছিলামনা। মাথা নেড়ে বললাম, ‘পড়তে পারছি না। আচ্ছা, তাহলে এতে এই জগৎ কী করে ধ্বংস হবে সেটাও লেখা আছে নিশ্চয়ই?’
টুপিপরা মাথা ইতিবাচকভাবে নেড়ে মানুষটা শেষের এক-চতুর্থাংশ পাতা বাকি রেখে একটা জায়গায় আঙুল রাখলেন।
জানতে চাইলাম, ‘পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর কী হবে?’
‘তুমি চাইলেই সেটা পড়ে নিতে পার।’
‘ধন্যবাদ। বললাম যে পড়তে পারছি না। ইয়ে, বলছিলাম কী, এ বই তো সবই বলে দেবে বলছেন। এটা কি বলতে পারবে, আমি হিরের ঢাকনা লাগানো সোনালি শিশিটা খুঁজে পাবো কি না?’
কোনও কথা না বলে মানুষটা বইয়ের ভেতরের একটা পাতা পুনরায় খুলে আমার দিকে এগিয়ে ধরলেন।
‘না, আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আমাকে প্রাসাদে যাওয়ার পথটা খুঁজে বার করতে হবে। আপনি কি আমায় বলতে…’
এবার আমার দিকে না তাকিয়ে বই পড়তে থাকা মানুষটা আঙুল তুলে একটা রাস্তা দেখিয়ে দিলেন।
‘অনেক ধন্যবাদ আপনাকে!’ বলেই দ্রুত হাঁটতে শুরু করলাম। একটু বাদেই দেখলাম সামনে অনেক উঁচু একটা একটা বেড়া। ‘ধ্যাত্তেরি! আবার পথ বন্ধ! কী বড় বড় ঘাস এখানে!’
কিছুক্ষণ ঘাস আর বেড়া ঠেলাঠেলি করার পর বুঝতে পারলাম আমি আসলে বিছানার চাদর আর বালিস ধামসাচ্ছিলাম। ‘উফস! আমি আবার স্বপ্ন দেখছিলাম!’
সপ্তম রাত
একটা শব্দ শুনে আমার সেই স্বপ্ন সফরের শেষ রাতের সূচনা হয়েছিল। ঘুমটা ভেঙে যায় সেই শব্দে। কিন্তু ঘরে কিছুই দেখতে পেলাম না। পায়ের কাছে আমার পোষা বিড়াল লিও শুয়ে ছিল। বললাম, ‘কীরে? তুই কোনও আওয়াজ করলি নাকি?’
‘হ্যাঁ। কী আর করব। যা ঘুমোচ্ছিলে। ওদিকে রাজকুমারী যে অপেক্ষা করছে। জলদি চলো!’
অবাক হয়ে বললাম, ‘তুই যে কথা বলতে পারিস তা তো জানতাম না!’
লিও সামনের ডানপায়ের থাবাটা একবার চেটে নিয়ে বললো, ‘ইচ্ছের অধিকর্তা হিরের ঢাকনা লাগানো সোনালি শিশিটার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে আছেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাক প্রাসাদে যেতে হবে। সবাই ওখানেই অপেক্ষা করছেন !’
‘তুই কি আমার সঙ্গে ওখানে যাবি ?’
‘অবশ্যই যাব। টিনের সেপাইও যাবেন আমাদের রক্ষক হিসাবে। ও হ্যাঁ, ওই ভাল্লুকটাও যাবে।’ কিছুদিন আগে কেনা টেডি বিয়ারটা দেখিয়ে বললো লিও।
ঝটপট রাতপোশাক ছেড়ে ভালো জামা প্যান্ট পরে নিলাম। ‘কিন্তু লিও ঘুমপরিদের দেশে আমরা যাবো কীভাবে?
‘কেন? তোমার ওই রকিং হর্সটায় চেপে। ওই আমাদের নিয়ে যাবে, চিন্তা কীসের!’
কথা না বাড়িয়ে এক লাফে কাঠের ঘোড়াটার ওপর চেপে বসলাম। একহাতে টিনের সেপাই আর অন্য হাতে উঠিয়ে নিলাম টেডি বিয়ারটাকে।
‘এই মরেছে!’ লিও বলে উঠল, ‘আমি বসব কোথায়?’
নিজের কোলের কাছটা দেখিয়ে বললাম, ‘এখানে জায়গা হয়ে যাবে।’ তড়াক করে কোলের কাছে উঠে পড়লো ছোট্ট সাদা রঙের বেড়ালটা। সামনে পিছনে নিজে নিজেই দুলতে শুরু করল কাঠের ঘোড়াটা। চোখের পলক বার দুই ফেলতে না ফেলতেই দেখা গেল সবুজ ঘাসজমির ওপর দিয়ে আমরা ছুটে চলেছি। জাদুমন্ত্রে বদলে গেছে আশপাশের জগৎ। আমার শহর পড়ে আছে কোন পেছনে।
‘ওয়াও! দারুণ! আমি ঘোড়ার পিঠে চেপে কোনওদিন কোথাও যাইনি! বাপরে মাথা বনবন করছে !’
টিনের সেপাই বলে উঠল, ‘একটু বাদেই আমরা ঘুমপরিদের দেশে পৌঁছে যাব।’
‘আরে ওইতো প্রাসাদের চূড়া দেখা যাচ্ছে,’ বলল টেডি বিয়ার।
‘ঠিক আছে পৌঁছে গেলে আমাকে জানিও। আমি আর চোখ খুলে রাখতে পারছি না।’
এক মিনিট যেতে না যেতেই কাঠের ঘোড়া এসে দাঁড়াল শ্বেতপাথরের সিঁড়ির ধাপগুলোর কাছে। যা বেয়ে উঠে যেতে হবে প্রাসাদের গেটের কাছে। আমি জানি এখানে ১,২৩৪,৫৬৭,৮৯০টা ধাপ আছে। গুনেছি এর আগের বার। অনেকটা সময় লাগল সব ধাপ পার হয়ে সদর দরজার কাছে পৌঁছতে। ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল লম্বকর্ণ।
হেসে বললো, ‘আরে গবলু, এবার দেখছি তুমি তোমার বন্ধুদেরও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছ। ভালো ভালো।’ তারপর সবুজ টুপিটা খুলে ওদের অভিবাদন জানাল একটু ঝুঁকে। ‘রাজকুমারী তোমাদের ফুচকা ঘরে অপেক্ষা করতে বলেছেন। যত খুশি ফুচকা খেতে পারো ওখানে।’ বলেই বিদায় নিল। রাজকুমারীকে খবর দিতে গেল নিশ্চয়ই।
ফুচকাঘরটা একটা বিরাট ফুটবল মাঠের মতোই বড়। তার ঠিক মাঝখানে অবস্থান করছে একটা ফুচকার পাহাড়।তার পাশেই বেশ বড় একটা থালায় আলুছোলা মশলা দিয়ে মেখে রাখা আছে। তার পাশে একটা কল লাগানো কন্টেনার। গায়ে লেখা আছে তেঁতুল জল। ‘উফস! উউউউও! সাংঘাতিক ব্যাপার!’ আমার মুখ দিয়ে বেড়িয়ে এল শব্দগুলো।
টেডি বিয়ার বললো, ‘এখানে যা ফুচকা আছে তাতে একটা বড়সড় মাঠ ঢেকে যাবে! মনে হচ্ছে এক লাফে ওটার ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়ি !’
আমি আগে খানিকটা চুরমুর বানিয়ে খাব। এতটা পথ ঘোড়ায় চেপে এসে আমার খুবই খিদে পেয়েছে।
‘দেরি করে কী লাভ। চলো শুরু করে দেওয়া যাক।’ বললো লিও।
‘কিন্তু আলাদা কোনও জায়গা তো নেই যাতে ফুচকাটা নেব! একটা একটা করে নিজেদের বানিয়ে খেতে হবে নাকি?’ বললো টিনের সেপাই।
আমি সবে একটা ফুচকা নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়েছি, ওখানে হাজির হল সেই সবুজমুখো, বদমেজাজি শয়তান উলটপালট। ধড়াম করে দরজা খুলে গটমট করে হেঁটে এল আমাদের কাছে। ‘আরে! সাহস তো কম নয়! আমাকে বাদ দিয়ে তোমরা ফুচকা পার্টি শুরু করে দিয়েছ?’
‘এটাই কি সেই উলটপালট?’ লিও জানতে চাইল।
‘এই যে ! কী ব্যাপার শুনি? আবার কী বদমায়েশি করতে এসেছ? শিশিটা কোথায়?’
‘শিশিটা? আমার কাছেই আছে। ওটাতে তেঁতুল জল ভরে নিয়ে যাব ভাবছি। তারপর সারাদিন আয়েশ করে খাব।’ বলেই হিরের ঢাকনা লাগানো সেই সোনালি শিশিটা উঁচু করে ধরল।
‘ওটা আমাকে দিয়ে দাও উলটপালট!’ বললাম চিৎকার করে।
‘তোমাকে কেন দেব? ভাবছি আমিই এটা রাজকুমারীকে দেব। তাহলে উনি তোমাকে ভুলে আমাকেই… হি হি !’
আমার ভেতরে একটা রাগের আগ্নেয়গিরি ফেটে পড়ল। এরকম কিছু এর আগে ওর কোনওদিন অনুভব করিনি। চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম, ‘শেষবারের মতো বলছি, ওটা আমাকে দিয়ে দাও!’
সম্ভবত আমার বদলে যাওয়া মুখটা দেখে উলটপালট বলল, ‘আহা, রেগে যাচ্ছ কেন গবলু ! আমার কথাটা শোনো!’
‘কোনো কথা শুনতে চাই না। জলদি ওটা আমাকে দাও, তা না হলে যা হবে তা তু্মি কোনও দিন ভুলতে পারবে না!’
বলেই এক লাফ দিয়ে ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম আমি। কেড়ে নিলাম শিশিকে। ওটাকে দু’হাতে চেপে ধরতেই শরীর মন ভরে উঠল আনন্দ-উচ্ছ্বাসে। বিড়বিড় করে বললাম, ‘আহা! কী দারুণ! সারা পৃথিবীতে এর চেয়ে ভালো কিছু আর হতেই পারে না।’
টিনের সেপাই বললো, ‘চলো গবলু, এবার ওটা আমরা রাজকুমারীর কাছে নিয়ে যাই। ইচ্ছের অধিকর্তাকে ফিরিয়ে দিতে হবে তো।’
‘আমি…ইয়ে…মানে…’ একদম ইচ্ছে হচ্ছিল না ওটা কাউকে দিতে। শুরু করলাম ছুটতে। ফুচকাঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। আমার পেছন পেছন ছুটতে শুরু করল বাকিরা। সবাই আমাকে থামতে বলছিল, কিন্তু আমি থামিনি। আমি জানি না বোতলের ভেতর কী আছে। শুধু বুঝতে পারছিলাম ওটার ভেতর যা আছে, সেটাকে নিজের কাছে রাখাটাই আমার মনের একমাত্র ইচ্ছে। আমি যা করছি সেটা ওটার জন্যই।’
‘গবলু ফিরে এসো!’ শুনতে পেলাম টিনের সেপাইয়ের ডাক। ‘ভুলে যেও না, যেটা তোমার কাছে আছে, ওটা তোমার নয়।’
আমি নিজেকে বললাম, ‘আমি এটা ওদের কিছুতেই দেব না।’ প্রাসাদের এলাকা থেকে বেড়িয়ে নামতে শুরু করলাম সেই বিশাল সংখ্যক সিঁড়ি দিয়ে। অর্ধেক যেতে না যেতেই দেখতে পেলাম দু’জন মানুষ উঠে আসছে। ‘মা! বাবাই!’ অবাক হয়ে বললাম, ‘তোমরা ! এই ঘুমপরিদের দেশে?’
কীরকম যেন একটা স্বরে বাবাই শিশিটার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘এবার আমি ওটা নেব গবলু।’
আমি এক ঝটকায় উঠে বসলাম বিছানায়। ‘ বাপরে বাপ! পুরোটাই স্বপ্ন ছিল! লিও। তোরা আমাকে আদপেই তাড়া করছিলি না তাহলে?’
সাদা বেড়ালটা কোনও সাড়া দিল না।
‘এবার আমি ওটা নেব,’ শুনতে পেলাম ইচ্ছের অধিকর্তা কণ্ঠস্বর।
হাতের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলাম, ‘আরে! শিশিটা দেখছি এখনও আমার হাতেই আছে। হিরের ঢাকনা লাগানো সোনালি শিশি!’
‘হ্যাঁ,’ ইচ্ছে বললেন, ‘এবার ওটা আমাকে দিয়ে দাও।’
বুঝতে পারছিলাম আমার হৃৎপিণ্ড সহসাই খুব জোরে জোরে লাফাচ্ছে। একটুও ইচ্ছে হচ্ছে না শিশিটা দেওয়ার।
ইচ্ছের অধিকর্তা বিছানার একপাশে বসলেন। আমার হাত ধরে বললেন, ‘তুমি আমাকে ভালোবাস না গবলু? তুমি যদি আমাকে এক্ষুনি ওটা না দিয়ে দাও, তাহলে আমি কিন্তু তোমাকে আর ভালোবাসব না।’
আমার কান্না পাচ্ছিল। চাইছিলাম ইচ্ছের অধিকর্তা আমাকে ভালোবাসুন। কিন্তু শিশিটা দেওয়ার একটুও ইচ্ছে আমার নেই।
ঠিক ওই মুহূর্তে ঘরে একজন প্রবেশ করলেন। খুব লম্বা এবং রোগা। পরনে কালচে বেগুনি পোশাক। ‘এবার ওটা আমি নেব,’ বললেন উনি।
বলেই লম্বা হাত বাড়িয়ে কিছু বোঝার আগেই উনি প্রায় শিশিটা কেড়েই নিলেন। যেই উনি শিশিটা নিয়ে নিলেন, আমার কেমন যেন একটা অদ্ভুত রকমের স্বস্তি বোধ হল।
‘আমি মনে হয় এখনও স্বপ্নই দেখছি!’
কালচে বেগুনি পোশাক পরা মানুষটা ইচ্ছের অধিকর্তার দিকে ঘুরলেন। ‘এত সাহস তোমার কী করে হয়? একজন স্বপ্নচারীর কাছ থেকে হৃদয় নিঃসৃত ইচ্ছের মায়া চুরি করার চেষ্টা করছিলে তুমি?’
ইচ্ছে ফিচ করে হেসে বলল, ‘আমিই ইচ্ছে। আমিই কামনা। আমিই বাসনা ভুলে যেও না স্বপ্নসম্রাট, ওর কামনা বাসনা আমার আওতার জিনিস, মনে করিয়ে দিতে হবে নাকি নতুন করে?’
‘আমি ভুলিনি। কিন্তু একটা শিশুর ইচ্ছেকে নিয়ে এভাবে খেলা করা তোমার উচিত নয় মোটেই। যাও ভাগো এখান থেকে!’ ধমকে উঠলেন স্বপ্নসম্রাট। ইচ্ছের অধিকর্তা ফুস করে মিলিয়ে গেলেন।
এবার স্বপ্নসম্রাট এসে বসলেন আমার বিছানায়। আমার কপালে হাত রেখে তাকালেন আমার চোখের দিকে। ঠোঁট নেড়ে কী সব বললেন। তারপর ইচ্ছের অধিকর্তার মতোই নিমেষের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আমি আজ পর্যন্ত মনে করতে পারিনি স্বপ্নসম্রাট আমাকে ঠিক কী বলেছিলেন শেষ মুহূর্তে।
আমাকে দ্বিতীয়বার ঘুম ভেঙে জেগে উঠতে হয়নি। কারণ আমি তো জেগেই ছিলাম। শুয়ে শুয়ে দেখছিলাম জানলা দিয়ে সকালের নরম সোনালি রোদ এসে পড়েছে ঘরের ভেতর। একটু পরেই মায়ের গলা শোনা যাবে, ‘ব্রেকফাস্ট রেডি!’
লেখক: জর্জ আলেক এফিংগারের ‘সেভেন নাইটস ইন স্লাম্বারল্যান্ড’ কাহিনির ছায়ায় লেখা। ১৯৯৬ সালে ‘স্যান্ডম্যান-বুক অফ ড্রিমস’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। যেখানে নীল গেইম্যানের সৃষ্ট চরিত্রদের নিয়ে বেশ কিছু লেখকের লেখা ছোটগল্প সঙ্কলিত হয়। যা বেছে নিয়েছিলেন গেইম্যান নিজে। এটি ছিল তারই একটি।
Tags: অনুবাদ গল্প, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, জর্জ আলেক এফিংগার, পূজাবার্ষিকী, প্রতিম দাস