সীমারেখা
লেখক: ন্যান্সি ক্রেস, বাংলা অনুবাদ: সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, ঋণস্বীকার: অনুরাধা সামন্ত
শিল্পী: জটায়ু
(১)
মিস কেলির ক্লাসে প্রথম দিনই একটা বিশ্রী ব্যাপার ঘটে গেল।
মিস কেলির ক্লাসটা আমার ঠিক পাশেই। সেদিন আমি সবেমাত্র ক্লাসে ঢুকে রোলকল সেরে বসেছি। পুলিশ অ্যাকাডেমির এই ক্লাসগুলোতে বাচ্চারা পড়লেও, এদেরকে প্রতিদিন কিছু না কিছু সহবত শিক্ষা দিতে হয় – আর সেটা ক্লাসে ঢুকেই দেওয়াটা আমি পছন্দ করি। তাও আবার এই সিজনের প্রথম ক্লাস ছিল সেদিন। তা – ক্লাসে গম্ভীর ভাবে “গুন্ডামি করবে না, অস্ত্র আনবে না, নিজের হোমওয়ার্ক প্রতিদিন করে আনবে” এসব চর্বিতচর্বণ বকার পর সবেমাত্র অঙ্কের বইটা খুলে বসেছি, এমন সময় পুঁচকে লাতিশা ছুটতে ছুটতে এসে হাজির।
ছোট্ট মেয়েটার রোগাপানা চেহারাটা উত্তেজনার চোটে ফুলে উঠেছে আর চোখগুলো বিস্ফারিত হয়ে আছে। “মিঃ সনিসি, শিগগিরি আসুন, ম্যাডাম কেলির ঘরে বিরাট মারপিট হচ্ছে। ম্যাডাম চিৎকার করে কান্নাকাটি করছে।”
পরক্ষণেই পাশের ঘর থেকে দুমদাম আওয়াজ শোনা গেল। কেউ বা কারা রীতিমতো ধস্তাধস্তি যে করছে, তার একটা আপাত প্রমাণ হাতেনাতে পেয়ে, আর বসে থাকতে পারলাম না। দুর্বল হাঁটুটাতে চাপ দিয়ে উঠতে হল – বেশ কসরত করেই উঠলাম। পাশের ঘর থেকে ভেসে আসা চিল-চিতকার অগ্রাহ্য করে লাতিশাকে বললাম, “মিস কেলিকে গিয়ে বলো যে আমি আসছি।”
লাতিশা জ্যা-মুক্ত তীরের মতো ছিটকে বেরিয়ে গেল ক্লাস থেকে। চিৎকার করতে করতে গেল, “অ্যাই – মিঃ সনিসি আসছে। তোমরা থেমে যাও বলছি। নাহলে বুঝবে।”
ক্লাস থেকে বেরোনোর আগে, নিজের ক্লাসের বিচ্চুগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। দেখি, সবাই একযোগে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মনের ভাবটা পড়ার চেষ্টা করছে। সবাইকে সতর্ক করে দিলাম, যে আমার অনুপস্থিতিতে যদি কেউ ক্লাস ছেড়ে বেরোনোর চেষ্টাও করে, তাহলে তার সঙ্গে আমি পরে বুঝে নেব। আমি জানি, আমার কথা অমান্য করার মতো সাহস এদের নেই। এরা অনেকেই ভাবে যে আমি আমার জ্যাকেটের পকেটে একটা লোডেড রিভলবার নিয়ে ঘুরে বেড়াই। যদিও কথাটা একটা মিথ্যে গুজব মাত্র– তবুও রটনাটাকে আমি উড়িয়ে দিইনি। তাতে অবিশ্যি আমার লাভ বই ক্ষতি কিছুই হয়নি।
খোঁড়াতে খোঁড়াতে পাশের ক্লাসে গিয়ে দেখি, রীতিমত খন্ডযুদ্ধ চলছে সেখানে। দুটি বারো-তেরো বছরের মেয়ে নিজেদের মধ্যে খামচাখামচি আর চুলোচুলিতে ব্যস্ত, আর মিস কেলি ক্লাসের একদিকে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে চলেছেন। তবে লাতিশা একটু ভুল করেছে, মিস কেলি কাঁদেন-নি, তবে কাজের কাজও যে খুব একটা করছেন তাও নয়। ওঁকে এখনও অনেক কিছু শিখতে হবে – বিশেষতঃ এধরনের ত্যাঁদড় ক্লাস নিয়ন্ত্রণ করা।
আমি ক্লাসে মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। মেয়েদুটো এখন একে ওপরের ওপর উঠে পড়ে রীতিমতো আঁচড়াআঁচড়ি শুরু করে দিয়েছে। দুজনেরই জামা ছিঁড়ে গেছে – একজনের তো রীতিমত রক্ত পড়ছে নাক দিয়ে। কয়েকটা বাচ্চা ক্লাসের মধ্যে এদিক ওদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছে। ব্ল্যাকবোর্ডটা দেখলাম মাঝখান থেকে ভাঙা – তার সামনে একটা ভাঙা কাঠের চেয়ারও পড়ে রয়েছে। তার মানে, ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়ানো কাউকে কেউ একজন চেয়ার ছুঁড়ে মারতে গিয়েছিল। নিশানা ফস্কে চেয়ারটি ব্ল্যাকবোর্ডের ওপরই নিজের গায়ের ঝাল মিটিয়েছে। নাঃ – ব্যাপারটা রীতিমত হাতের বাইরে চলে গেছে দেখছি।
বুকভরা দম নিয়ে তারসপ্তকে গলা চড়িয়ে একটা পরিচিত হুঙ্কার ছাড়লাম। ম্যাজিকের মতো কাজ হল। ক্লাসের ছন্নছাড়া ভাবটা যেন নিমেষে উধাও হয়ে গিয়ে যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়ল। মাটিতে পড়ে থাকা দুটো যুদ্ধং দেহী মেয়েকে নড়া ধরে তুলে আনলাম। তারপর ক্লাসের বাঁদিকে তাকাতেই নজরে পড়ল মূর্তিমানের দিকে।
জেফ – জেফ কনর! বলিষ্ঠ দেহের কিশোর ছেলেটি ক্লাসে জানলার গায়ে নিজেকে এলিয়ে দিয়ে বুকে দুহাত ভাঁজ করে রেখে এতক্ষণ ব্যাপারটা উপভোগ করছিল।
সবাই আপাতত যে যার জায়গায় বসে পড়েছে। আহত মেয়েটিকে লাতিশার সঙ্গে পাঠালাম মেডিকেল ট্রিটমেন্ট এর জন্য। একটি চাইনিজ বাচ্চা দেখি এদিকে সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। বুঝলাম, তার চেয়ারটাই ব্ল্যাকবোর্ডের ওপর আক্রোশ মিটিয়ে দেহ রেখেছে, তাই বেচারি বসার জায়গা পাচ্ছে না। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে শেষে সে নিজের ডেস্কের ওপরেই বসে পড়ল।
কিছুক্ষণ সব শান্ত থাকার পর, রোজারিয়া হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “মিঃ সনিসি, জানেন, ওরা কিন্তু জেফের জন্যই লড়াই করছিল নিজেদের মধ্যে।“
বিরক্তিতে কড়া গলায় জেফ কনার বলে উঠল, “মোটেই না। যত্তসব বাজে কথা। জোনেলা লিসাকে খানকি মাগি বলেছে, তাই…”
এরপর ক্লাসের সব্বাই একে একে বা একযোগে ঘটনার নানা কারণ বলতে থাকল। কিন্তু যখন দেখল, আমি কাউকে পাত্তা দিচ্ছি না, তখন সবাই ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে গেল।
এবার জেফ আমার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে খুব সরলভাবে বলল, “ওদের সুইসাইডগুলোর ব্যাপারে জানেন তো মিঃ সনিসি?
ক্লাসের বাকি সদস্যরা পুরো ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেছে। আমিও কিছুটা থতমত খেয়ে তাকিয়ে রইলাম জেফের দিকে। মিস কেলি, যিনি এতক্ষণ ক্লাসের মধ্যে ছিলেন কিনা সেটাই বোঝা যাচ্ছিল না, হঠাৎ করেই ক্লাসের রাশ হাতে তুলে নিতে উদগ্রীব হয়ে পড়লেন। জেফের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলতে লাগলেন, “কিসব আবোল তাবোল বকছ জেফ?? কিসের সুইসাইড… ”
জেফ মিস কেলিকে সম্পূর্ন অগ্রাহ্য করে আমার দিকে তাকিয়ে বলতে থাকল, “যে বুড়ো মানুষগুলোর কথা বলছি, তাদের কথা আপনি নিশ্চই জানেন মিঃ সনিসি। আজ সকালে একজন হাসপাতালে মারা গেছেন। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যে ঘটনাগুলো কাগজে বেরোচ্ছে, সেগুলোও নিশ্চই পড়েছেন।“
আমি চুপ করে রইলাম।
“সত্তর আশি বছরের বুড়োবুড়িগুলো কেউ নিজেকে গুলি করছে, কেউ গলায় দড়ি দিয়ে মরছে, কেউ নিজের ঘরের খিড়কি খুলে ঝাঁপ দিচ্ছে। এসব কি হচ্ছে বলে আপনার মনে হয় মিঃ সনিসি?” জেফ আমার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইল।
“এরা তিনবেলা পেটপুরে খেতে পায়, কাজও তেমন করতে হয়না। জীবনে কোনো উৎপাতও নেই। এত আরামে থাকার পরও লোকগুলো যদি এভাবে আত্মহত্যা করে, তাহলে আমাদের সামনে যে কি উজ্জ্বল ভবিষ্যত অপেক্ষা করছে তা নিশ্চয়ই আপনাকে বলে দিতে হবে না। সেটা আমরা নিজেরাই টের পাচ্ছি।“
জেফের বাগ্মীতার সামনে ক্লাসের বাকি বাচ্চারা ঢকঢক করে ঘাড় নাড়ল। যদিও আমি আমার পুলিশ পেনশনের দিব্যি গেলে বলতে পারি, ক্লাসের বাকি কারুর বিন্দুমাত্র ধারণাও নেই ও কি ব্যাপারে এতক্ষণ কথা বলে গেল।
জেফের দিকে তাকালাম। চোখে-মুখে অপার ঔদ্ধত্য যেন ফেটে পড়ছে। ঘাড় তুলে বুক টানটান করে এমনভাবে সে কথাগুলো বলছে যেন মনে হচ্ছে ক্লাসের কাউকেই সে বিন্দুমাত্র রেয়াত করে না।
“খুব দুঃখজনক ব্যাপার মিঃ সনিসি।“ জেফের শেষ কথাগুলো ক্লাস থেকে বেরিয়ে আসার আগে শুনতে পেলাম, “লোকগুলো সারাজীবন ধরে নিয়মের বেড়াজালে থেকেও নিয়মগুলোকে আপন করে নিতে পারল না। তাহলে আপনারাই বলুন, আমরা কেন নিয়ম মেনে চলব? কি লাভ এই নিয়মে আবদ্ধ থেকে… …”
(২)
“জেফের ওপর একটু নজর রাখুন। নাহলে ছেলেটা হাতের বাইরে চলে যাবে।“ টিচার্স রুমে বসে স্যান্ডুইচে কামড় দিয়ে মিস কেলিকে বলতে বাধ্য হলাম। সাধারণতঃ আমি জ্ঞান দেওয়া টাইপ নই। কিন্তু মিস কেলি যেচে যখন উপদেশ শুনতে এসেছেন, তখন তাঁকে মানা করার কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না।
“আমার তা মনে হয়না” আমাকে অবাক করে মিস কেলি বললেন, “জেফ খুব প্রাণবন্ত, চঞ্চল ছেলে। ওর মধ্যে একটা কর্তৃত্বব্যঞ্জক ব্যাপার আছে যার ফলে বাকিরা ওকে অনুসরণ করে, ব্যাস এটুকুই। এখনও বখে যাওয়ার মতো কিছু তো করেনি। তাছাড়া, আপনার ব্যাপারটা আলাদা।“
“কিসের আলাদা?” আমি একটু চমকেই গেলাম।
“আলাদা নয়? জিন সনিসি – বিখ্যাত প্রাক্তন পুলিশ অফিসার। নিজে গুলি খাওয়ার আগে যে তিন তিনটে ক্রিমিনালকে পেড়ে ফেলেছিল। লম্বা – চওড়া – কত হবেন আপনি – উম, ছ’ ফুট দুই? ওরা আপনাকে এমনিই সমীহ করে জিন। আর উল্টোদিকে আমাকে দেখুন, পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চির বৈশিষ্ট্যহীন একজন মানুষ, যাকে সুবিধেমতো নাচানো যায়। তাই নয় কি?” এতটা বলে মিস কেলি আবার খাবারে মন দিলেন।
আমি বেশ আশ্চর্য হলাম দেখে যে এত কম সময়ের মধ্যেই মিস কেলি আমার ব্যাপারে এত খবরাখবর জোগাড় করে ফেলেছেন। আজ ক্লাসে এত বড় ঝামেলার পরও চোখে কোনো জলের দাগ দেখতে পেলাম না। হয়তো টিচার্স রুমে ঢোকার আগে মেকআপ করে ব্যাপারটা লুকিয়ে ফেলেছেন। ম্যাগিও তাই করত। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমি মিস কেলির মুখের দিকে তাকালাম। বয়সটা এখন যেন একটু বেশিই লাগছে, ক্লাসে অতটা লাগছিল না কিন্তু। মুখের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে না এই ত্যাঁদড় ক্লাস বেশিদিন ইনি সামাল দিতে পারবেন বলে।
“আপনি কি সত্যিই বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়ান?” মুখের ওপর পড়ে আসা চুলগুলো সরিয়ে মিস কেলি আমায় জিজ্ঞেস করলেন।
“মাথা খারাপ?” আমি মুচকি হেসে বললাম, “জানেন না? শিক্ষা বোর্ড কোনরকম আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে স্কুলের ত্রিসীমানায় ঢোকা নিষেধ করে দিয়েছে?”
“কিন্তু সবাই যে জানে – আপনি বন্দুক নিয়ে ঘোরেন?”
আমি কাঁধ ঝাঁকালাম।
“তার মানে আপনি সত্যিটা কাউকে বলেননি, তাই তো?”
আমি চুপ করে রইলাম।
মিস কেলি বললেন, “দেখুন আমি ওসব কৌশল করতে পারব না। আমি শুনেছি, আপনি এখানে একজন সফল শিক্ষক। তাই প্লিজ আমাকে বলুন ঠিক কি করলে আমি ক্লাসটা আপাতত সামলাতে পারব, যার পর অন্ততঃ আমি কিছু পড়ানোর কথা চিন্তা করতে পারি।“
মিস কেলির গলায় কিছু একটা ছিল যেটা ওঁর ব্যাপারে আমার ধারণা পরিবর্তন করতে বাধ্য করল। এত হেনস্থার পরও চোখে জল নেই, দিব্যি খেয়ে চলেছেন – যার অর্থ খিদে আছে। কথাও বলছেন স্বাভাবিক ভাবে। তবে মিস কেলির এই “জেদ” ব্যাপারটা আমি উপেক্ষা করলাম। আমার জীবনে আমি এরকম মৌখিক জেদ তো কম দেখলাম না। পুলিশ ট্রেনিং স্কুলে যখন ছিলাম, অনেক বড় বড় বচনফকিরের তিনমাসের মধ্যে হাওয়া টাইট হয়ে যেতে দেখেছি আমি।
“দুটো প্রধান জিনিস আপনাকে মনে রাখতে হবে”, আমি বললাম, “এই সব বাচ্চারা যাতে একে অপরের সংস্রবে কোনোভাবেই না আসতে পারে। পাঁচ মিনিট কেন, এক মিনিটের জন্যও যদি ওরা একে অন্যের সঙ্গে একটা সংযোগ তৈরী করে ফেলতে পারে, তাহলেই সর্বনাশ। আপনাকে বুঝতে হবে যে এরা আমাদেরই সামাজিক নিঃসঙ্গতার এক ভয়াবহ অবসাদগ্রস্ত ফলাফল। সংযোগ বলতে যা বোঝাতে চাইছি, তা-হল, এরা একে অপরের সঙ্গে যে তাৎক্ষণিক সম্পর্ক তৈরী করবে, তা হবে গালাগালির, মারপিটের, ঝগড়ার। সামান্য সুযোগেই এরা মারদাঙ্গা শুরু করে দেবে। এদেরকে ব্যস্ত করে রাখতে হবে আপনাকেই, নিজের ক্ষমতায়। তাই বলে আমি কোনো মিথ্যের ফানুস তৈরী করতে বলছি না। আপনি নিজের ব্যক্তিত্বের এমন একটা বলয় তৈরী করবেন, আপনার উপস্থিতির ওজন এতটাই বেশি হতে হবে, যা দিয়ে আপনি ওদের ওপর একটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। সেক্ষেত্রে ওরা নিজেদের মধ্যে এই সংযোগ তৈরি করাটায় বিরত থাকবে। নাহলে, আপনাকে ওরা পাত্তাও দেবে না।”
“সংযোগ – সম্পর্ক, হুম।” মিস কেলি যেন ভাবনায় পড়ে গেলেন, “আচ্ছা, কোন বস্তুর সঙ্গেও তো সম্পর্ক তৈরী হতে পারে। যেমন আমাদের সাহিত্যে তো প্রচুর জিনিস আছে, যাতে ওরা আকর্ষণ অনুভব করে এই পারষ্পরিক বৈরিতাকে ভুলে থাকতে পারে?”
“ব্যাপারটা আমি ভেবে দেখব। দেখুন, ওরা পড়াশোনা করতে চাইলে তো মিটেই যেত। আসলে বস্তুর ওপর ওদের আকর্ষণ প্রাথমিকভাবে তৈরী হয় তো মানুষের মাধ্যমেই, তাই… ”
খাবারে একটা কামড় বসিয়ে মিস কেলি জিজ্ঞেস করলেন, “আর আপনার দ্বিতীয় উপদেশ?”
“সেটা তো প্রথমেই বললাম, জেফ কনারকে হাতের বাইরে যেতে দেবেন না। ওকে খুব দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করুন।”
“ছেলেটা কে? আর এই বুড়োদের আত্মহত্যার ব্যাপারটাই বা কি?”
আমি বললাম, “খবরে দেখেননি?”
“সে তো দেখেইছি। পুলিশও তদন্ত করছে। কিন্তু তার সঙ্গে আমার ক্লাসের সম্পর্ক কোথায় সেটাই তো বুঝছি না।“
“আরে মূল বিষয় থেকে নজর ঘুরিয়ে দেবার একটা কৌশল মাত্র।”
“কি বিষয়?”
“অনেক কিছুই হতে পারে। জেফকে তো দেখেছেন – কি মনে হয়? ছেলেটা অসম্ভব বুদ্ধিমান, প্রচুর বাইরের খবর রাখে। লোকজনকে বিপথে চালনা করতে ও এসব ব্যবহার করে। নানা খবরের মন্ড বানিয়ে এমন একটা ঘ্যাঁট আপনাকে শোনাবে যে আপনি ঘাবড়ে যাবেন। ছেলেটার একটা অদ্ভুত ব্যক্তিত্ব আছে – নেতা টাইপ। কিন্তু পুলিশ রেকর্ড ক্লিন। উল্টোপাল্টা দলের সঙ্গে দেখবেন না ওকে। সোনার চেন পড়ে বা পেজার গুঁজে ফাট মারতেও কখনও দেখিনি। ছেলেটা একটু আনপ্রেডিকটেবেল টাইপ।“
“আপনি কি ওর সঙ্গে ছিলেন গত বছর।“
“ওর সঙ্গে ছিলাম না – কেবল ক্লাসে ওকে চুপ করিয়ে রাখতাম, এটুকুই।“ আমি খাওয়া শেষ করে বললাম।
“তাহলে যখন আপনিও ওর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারেনি, তখন আমি কিভাবে করব?” জেনি কেলিকে বেশ চিন্তিত মনে হল।
আমি আর কিছু বললাম না। জেনি যেন চিন্তা করেই চলেছে। ওর মুখের দিকে চোখ তুলে তাকাতে গিয়ে ওর কানগুলোর দিকে নজর গেল। গোলাপী কানে ছোট ছোট ঝিনুকের সাইজের দুল।
জেনি বুঝতে পারল যে আমি তাকে দেখছি। আমার দিকে তাকিয়ে সে মুচকি হাসল। আমি আর বসলাম না। হাত মুখ ধুয়ে সোজা ক্লাসে চলে গেলাম। আমি জানি জেনি কেলি আমাকে যা জিজ্ঞেস করেছে তার সব ঠিক উত্তর আমি দিইনি। কিন্তু আপাতত আমার ক্লাসে অঙ্কের সমস্যাগুলো নিয়ে লেকচার দেওয়াটা বেশি জরুরি। ছেলেমেয়েগুলোকে ব্যস্ত রাখতে হবে, যাতে ওরা একে অন্যের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরী করার সময় না পায়।
(৩)
আমস্টার্ডাম অ্যাভিনিউ-র অ্যাঞ্জেল মেরি নার্সিং হোমে আরও দুটো বুড়োবুড়ি আত্মহত্যা করেছে।
ক্লাস সেভেন-এইচ এর থেকে নেওয়া একটা অংকের টেস্টপেপার কারেক্ট করতে করতে খবরটা দেখলাম।
“গিয়াকোমো ডেলা ফ্রাঞ্চচেসা এবং লিডিয়া স্মিথ – এই নামের বডিদুটিকে সনাক্ত করা গেছে। নার্সিং হোমে সূত্রে জানা গেছে ওখানে একই ফ্লোরে পাশাপাশি দুটি ঘরে ওঁরা থাকতেন। দুজনের মধ্যে যথেষ্ট আত্মীয়তা ছিল। মিসেস স্মিথ আটতলার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েছেন আর ডেলা ফ্রানচেসা-কে তাঁর ঘরে ছুরিকাহত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে। ওয়েস্ট এন্ড অ্যাভিনিউ এর বেথ ইজরায়েল বৃদ্ধাবাসে আজ সকালে যে দুটো আত্মহত্যার খবর পাওয়া গিয়েছিল, এই ঘটনাদুটি যেন তারই পুনরাবৃত্তি। যাইহোক, নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ক্যাপেটন মাইকেল ডয়েল বলেছেন, এখনই এ বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না…তদন্ত চলছে… ”
ক্যাপ্টেন ডয়েলের অবস্থাটা বুঝতে পারলাম। বেচারা নির্ঘাত ভয়ানক চাপে আছে। দশদিনের মধ্যে এই নিয়ে তিন তিনটে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটল। বয়স্ক মানুষেরা সাধারণতঃ একটা নির্দিষ্ট ছক মেনে আত্মহত্যা করে না। সেক্ষেত্রে চারপাশে যেগুলো হচ্ছে, সত্যিই বেশ অদ্ভুত। আমি নিশ্চিত কদিন পরেই “পোষ্ট” বা “ডেইলি নিউজ” একটা রহস্যময় আততায়ীকে আবিষ্কার করবে, যে কিনা বৃদ্ধাবাস এবং নার্সিং হোমগুলো ঘুরে ঘুরে বুড়োদের খতম করে বেড়াচ্ছে। কোন টেররিস্ট গ্রুপের ক্রিয়াকলাপ হিসাবেও খবরটা দেখাতে পারে, কিংবা কোনো ভিনগ্রহীর আক্রমণ হিসাবে ফেনিয়ে তোলাও ওদের পক্ষে বিচিত্র নয়। সে যাই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত দায়টা কিন্তু সেই পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ওপরই বর্তাবে।
হঠাৎ কেমন জানিনা, মনে হল – আগের তুলনায় ম্যাগির শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটেছে।
এই অদ্ভুত ব্যাপারটা আমার মাঝে মাঝেই হয়। কোথাও কিছু নেই, আমি যেন হঠাৎ করেই বুঝতে পারি কিছু একটা ঘটতে চলেছে। ব্যাপারটা যারপরনাই অস্বস্তিকর! আগে আমিও স্বাভাবিক মানুষের মতোই দেখতাম, বুঝতাম, অনুমান করতাম। কিন্তু গত একবছর ধরে মাঝে মাঝেই যেন একটা বিদ্যুৎচমকের মতো আমি কিছু দেখতে পাই – কিছু ক্ষণিকের চিন্তা এসে মনে হানা দেয়। অবাক হয়ে লক্ষ করেছি, আমার এইসব অনুমান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মিলে যায়।
আজ রাতে আমার আর হাসপাতাল যেতে ইচ্ছে করছিল না। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে লেংচে লেংচে রান্নাঘরে গিয়ে খাবারের এঁটো প্লেটটা রাখলাম। তারপর চেয়ারের ধার থেকে বেতের ছড়িটা তুলে নিলাম। যেদিন পায়ের ওপর বেশি চাপ পড়ে, সেদিনই সাধারনতঃ আমি এটা ব্যবহার করে থাকি।
হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। আমি ধরলাম না – চুপ করে রিং হয়ে যাওয়াটা শুনতে লাগলাম। কে জানে কে! ফোনটা ধরতে ইচ্ছে করছিল না। রিংটা কেটে গিয়ে যখন ভয়েস মেলে ঢুকে গেল তখন গলাটা শুনে চমকে গেলাম।
“জিন, জিন – ভিন্স রোমানো বলছি।“
“আরে বাকি – বাকি!! আমি জানি অনেকদিন কথা হয়নি তোর সঙ্গে।“ – আমি দরজার পাশে মোড়াটার ওপর ধীরে ধীরে বসে পড়লাম।
“শোন, আমি ম্যাগির ব্যাপারটা জেনেছিলাম। আমি মানে – তোকে মানে – ফোন করতাম… কিন্তু মানে, তুই মানে… ” শুনতে শুনতে হাসি পাচ্ছিল। কিছু মানুষ জীবনেও বদলায় না। একটা পুরো বাক্য বলার সময় বাকির এই আমতা-আমতা ভাবটা আর গেলনা।
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সে আবার শুরু করল, “তোকে মানে সর্যি বলার জন্য… জিন, আমি একটা খুব দরকারে, মানে খুবই দরকারে ফোন করেছিলাম। ফাদার হেইলি টাইপের ব্যাপার নয় কিন্তু, মানে তুই আবার ওসব নিয়ে ভাবতে পারিস… মানে… ব্যাপারটা খুব মানে গোপনীয়। কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। জিন, জানিস তো আমি মানে, তুই মানে… আমি বলতে চাইছি, আমি কাজটা মোটেও একা করতে পারব না।“
বাকি জিন্দেগিতে কোন কাজটা একা করতে পেরেছে!! সেই ছ-বছর বয়স থেকে তেইশ বছরের যুবক বাকি, নিজে কিছু করতে গেলেই ছড়িয়ে ফেলত। বছর তেইশের বাকি-র জীবন-কে একসময় নিয়ন্ত্রণ করত ফাদার হেইলি। সে পর্ব চুকেবুকে যাওয়ার পর, বছর সাতাশের বাকি-র যত অসহ্য সমস্যার সমাধান আমাকে করতে হয়েছে। ততদিনে ম্যাগি আমার জীবনে এসে গেছে। সে অবস্থাতে বাকি-র বায়ানাক্কা সামলাতে আমাকে যে কি ঝক্কি পোহাতে হয়েছে, এখন ভাবলেও অবাক লাগে।
বাকি নিজের ফোননাম্বারটা বলল, কিন্তু ফোনটা রাখল না। আচমকাই যেন আমি বাকি-কে দেখতে পেলাম। নিজের ঘরের মধ্যে বসে রয়েছে, প্রচন্ড উত্তেজিত। ফোনের রিসিভারটা এমনভাবে মুখের কাছে ধরে রেখেছে যেন মনে হচ্ছে পারলে ওটাকে গিলেই ফেলবে। লিকলিকে শরীরটা টানটান হয়ে আছে এই আশায় যে আমি কখন ফোনটা ধরব আর কিভাবে সে কাজটা করার জন্য আমাকে রাজি করাবে।
“জিন… আমার হয়তো বলাটা উচিত হবে না, কিন্তু তবু বলছি… কারণ জিন তুই তো… মানে ছিলি… মানে, জিন, এটা ওই বুড়োবুড়িদের আত্মহত্যা বিষয়ে…” ক্ষণিকের বিরতি, “জিন আমি কেলভিন ফার্মাসিউটিকলে কাজ করি এখন।“
কিছুই বুঝতে পারলাম না। বাকি ফোনটা রেখে দেওয়ার পর, আমিও ব্যাপারটা মন থেকে ঝেড়ে ফেললাম। বেরিয়ে পড়লাম সেন্ট ক্লেয়ার হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
ম্যাগির অবস্থা সত্যি বেশ খারাপ, অন্ততঃ কালকের থেকে তো বটেই। ম্যাগির শরীরে আরও একটা বাড়তি নল দেখে শারীরিক অবনতিটা আমি অনুমান করলাম। গত আঠারো মাস সাত দিন ঠিক যেভাবে, যে ভঙ্গিমাতে শুয়ে আছে, ম্যাগির শরীর তাতে আজও অন্যথা করেনি। মাথা ঝোঁকানো, হাঁটু ভাঁজ করা। সরু কাঠির মতো হয়ে গেছে হাত পা গুলো – সব মিলিয়ে তিরিশ চল্লিশ কেজি হয়তো ওজন হবে ম্যাগির শরীরের। গ্যস্ট্রোনমি আর ক্যাথিটারের নল শরীরের নানা জায়গায় প্রবেশ করেছে। আজ দেখলাম একটা আই-ভি ড্রপের বোতলও লোহার ডান্ডা থেকে ঝুলছে। ম্যাগির একদা ঝকঝকে বাদামী চুলের রাশির কেমন যেন ফ্যাকাসে হয়ে নেতিয়ে রয়েছে ওর বালিশের পাশে – হয়তো এতদিন ধরে বিছানায় একভাবে পড়ে থেকে চুলগুলো তাদের জৌলুস হারিয়ে ফেলেছে, অনেকটা ম্যাগির জীবনের মতোই।
“ম্যাগি – এই দেখো আবার চলে এলাম।“
ম্যাগির বিছানার সামনের চেয়ারটাতে আরাম করে পা ছড়িয়ে বসা গেল।
“লিবি এখনও ফোন করেনি। হয়তো খুব ব্যস্ত আছে। আমার ক্লাস এই সবে শুরু হল – প্রথম সপ্তাহ চলছে। বেশ চাপ যাচ্ছে। এই সেপ্টেম্বরেই বেশ জমিয়ে ঠান্ডা পড়েছে এবার। কিন্তু জানো তো, গাছের পাতাগুলো কিন্তু এখনও হলুদ হয়নি। কাল পার্কে ঘুরতে গেছিলাম, এখনও সব চমৎকার সবুজই আছে। আজ ক্লাস করে এসে একটু রেস্ট নিচ্ছিলাম। মনে হচ্ছে, এ বছর ক্লাসগুলো ভালোই হবে।“
আমার মনে পড়ে গেল, ম্যাগি আমাকে প্রতি বছর ক্লাস শুরুর আগে বলত, “এ বছরটা দারুণ কাটবে, দেখে নিও।“ কথাটা ম্যাগি আমাকে পর পর তিনবছর বলেছিল। আমার হাঁটুতে চোটের জন্য পুলিশ থেকে স্বেচ্ছাবসর নেওয়ার পরপরই আমি এই নিম্ন-বুনিয়াদী স্কুলে শিক্ষক হিসাবে যোগ দি। ম্যাগি প্রতিদিন আমি বেরোবার সময় দরজার পাশটায় দাঁড়িয়ে থাকত। অফিস যাওয়ার জন্য পুরো ড্রেস-আপ করে – আমাকে বিদায় জানাত। ম্যাগিকে বিদায় জানাতে গিয়ে কখনও কখনও থমকে যেতাম – আমার নজর পিছলে যেত তার সুডৌল স্তনের ওপর দিয়ে ঝরনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়া চিকন সিল্কের টান টান ড্রেসের ওপর দিয়ে। কতবার যে উচ্ছ্বল জলকণার মতো নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছি সেই পিচ্ছিল প্রপাতের মধ্যে, ক্লাসে দেরি হয়ে গেছে – অফিসে সময়ে পৌঁছায়নি ম্যাগি।
“শেষ ক্লাসটা ছিল সেভেনের। উফ – ক্লাস তো নয়, পুরো চিড়িয়াখানা। অবশ্য শেষ ক্লাস কবেই বা ভদ্রসভ্য ভাবে হয়? সেভেন-এ তে একটা মেয়ে এসেছে জানো, হাতের লেখা পুরো শিলালিপি। স্বয়ং ভিনসেন্ট স্মিথ ছাড়া ওই লেখা বোঝে কার সাধ্য। একে দিয়ে আর কিছু না হোক, সাঙ্কেতিক লিপি লেখানো যেতে পারে – দেখি পুলিশ ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে কথা বলে।“
ডাক্তার আমাকে বার বার করে বলেছে ম্যাগির সঙ্গে কথা বলে যেতে। আমি জানিনা – কোমাতে চলে যাওয়া একজন মানুষ আদৌ কি শুনতে পায় আর কি পায় না!! দেড় বছর হয়ে গেল, কেউ কোনো উত্তর দেয়নি।
হয়তো আমিও সেজন্য থামতে পারিনি।
“আমি বাড়ির পর্দাগুলো কিনে ফেলেছি, জানো ম্যাগি। হলুদ রঙের পর্দা। লিবি এলে, ওর সঙ্গেই লাগাবো। ওগুলো লাগানোর পর ঘরদোরগুলো একটু ভদ্রসভ্য দেখাবে। তুমি দেখলে খুশিই হতে।“
আমি জানি আমার বাড়ির বর্তমান অবস্থা ম্যাগি আর জীবনেও দেখতে পাবে না, কিন্তু নিজেকে কেমন যেন ঘোরের মধ্যে বকবক করাটা থামাতে পারছিলাম না।
“জিন”-
হঠাৎ যেন বাস্তবে ফিরে এলাম।
“হাই সুজান।“ রাতের নার্সটিকে বেশ ক্লান্ত লাগছিল। “ম্যাগির গায়ে এই নতুন নলটা কিসের জন্য বলতে পারো?”
“অ্যান্টিবায়োটিক। নিশ্বাসে সামান্য সমস্যা হচ্ছিল, তাই। তাছাড়া নিউমোনিয়ার একটা সম্ভবনা ছিল, যেটা এক্স-রে তে ধরা পড়েছে। তবে চিন্তা নেই, ওসব ঠিক হয়ে যাবে। জিন, তোমার একটা ফোন আছে।“
আচমকা বুকের মধ্যে কেমন যেন ঢিব ঢিব করে উঠল। লিবি করেছে নাকি? বেশ ক’দিন ধরে ওর থেকে কোনো ফোন পাইনি। ম্যাগির ঘটনাটার পর যেন ইচ্ছে করেই নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। কিন্তু না, আমার চমকে ওঠার কারণ অন্য।
আজ থেকে দেড় বছর আগে, এরকমই একটা অযাচিত ফোনকলে ম্যাগির খবরটা পেয়েছিলাম। শপিং করে ফেরার পথে, লেক্সিংটন স্ট্রিট পার হতে গিয়ে, একটা ফোর্ডের ধাক্কায়… সেদিন থেকে আমি হঠাৎ আসা কোনো ফোনকলের খবর পেলেই…
যাইহোক, আমি লেংচে লেংচে নার্সের কেবিনে গিয়ে ফোনটা ধরলাম।
“জিন, আমি ভিন্স – রোমানো, বাকি বলছি।“
“বাকি!!!”
“স্যরি রে, তোকে এভাবে এখন…মানে, বুঝতেই পারছি…তোকে ফোন করেছিলাম, কিন্তু মানে সেটা ভয়েস মেলে… মানে আমি ভাবলাম তুই হয়তো এখানে…শোন জিন, একবার দেখা কর। ব্যাপারটা সিরিয়াস, খুবই। প্লিজ জিন।“
“বাকি, দ্যাখ। যথেষ্ট রাত হয়েছে। আমাকে বাড়ি যেতে হবে, কাল ক্লাস আছে।“
“প্লিজ জিন। তুই দেখা করলেই জানতে পারবি তোকে কেন ডাকছিলাম। তোর সঙ্গে দেখা করাটা ভীষণ দরকার।“
আমি চোখ বন্ধ করে রইলাম একটুক্ষণ। “বাকি, আমি বেশ ক্লান্ত। আজ নয়, আজ ছেড়ে দে। অন্য আর একদিন আসব। কথা দিচ্ছি।“
“প্লিজ জিন, একবার। প্লিজ। আমি পনেরো মিনিটে তোর বাড়ি যাচ্ছি।“
অনুনয় বিনয়ে বাকির তুলনা নেই। কিন্তু আমি এখন কেমন আছি, কিভাবে থাকি – ম্যাগিকে ছাড়া আমার বাড়ির কি অবস্থা, এসব বাকিকে দেখানোর ইচ্ছে আমার মোটেই নেই। আমার একটাই শব্দ বলার দরকার ছিল বাকিকে – “না”।
এই “না”-টা আমি হাজার চেষ্টাতেও ওকে বলতে পারিনি। কোনোদিনই না। হয়তো বলতে পারলে আমাদের দুজনেরই উপকার হত, কিন্তু কেন জানিনা পারিনি।
“ঠিক আছে। কিন্তু খুব কম সময়ের জন্য। তুই সেন্ট ক্লেয়ারে চলে আয়। এখানকার লবিতেই মিট করব।“
“পনেরো মিনিট নেব। থ্যাংক্স রে – তুই জানিস না এটা আমার কাছে কত বড় একটা ব্যাপার। তুই তো জানিস – “
“বাকি – “
“আচ্ছা আচ্ছা – এক্ষুণি আসছি।“
সেন্ট ক্লেয়ারের সেই পুরানো লবিতে এসে বসলাম। ক্যাটক্যাটে সবুজ রঙের মেঝে, ধূসর রঙের প্লাস্টিকের কভার দেওয়া সোফা – জায়গায় জায়গায় টেপ দিয়ে আটকানো। কাস্টমার কেয়ার কাউন্টারে যে বসে আছে, তাকে দেখে নার্স কম বাউন্সার বেশি মনে হয়। সারা লবি জুড়ে নানা ভাষাভাষি মানুষের ক্লান্ত ও কাতর চিৎকারে, জায়গাটা কেমন যেন গমগম করছে। ম্যাডোনা, সেন্ট ক্লেয়ার এবং ক্রুশবিদ্ধ যীশুর মূর্তির মুখের গভীর প্রশান্তি যেন এই লবির হট্টগোলের কাছে আদ্যন্ত বেমানান।
বাকি আর আমি তখন থেকে বন্ধু, যখন হয়তো সবে আমরা জাঙিয়া পরা শিখেছি। বস্টনের বিখ্যাত স্কুল লেডি অফ পারপেচুয়াল সরোর কয়েকঘর আশেপাশেই থাকতাম আমরা। চার্চে একসঙ্গে যেতাম, একসঙ্গে প্রার্থনা করতাম, আমার আর ম্যাগির বিয়েতে বেস্ট ম্যান ছিল বাকি। কিন্তু সেসব তো পরের কথা। বাকি যবে থেকে ওই পাদ্রীদের স্কুলে গিয়ে ঢুকল, তবে থেকে কেমন যেন হয়ে গেল। আগে ভগবান সম্পর্কে যা দু চারটে ঠাট্টা ইয়ার্কি মারতাম, সেটাও গেল বন্ধ হয়ে। শুধু তাই নয় – মজা, মশকরা, মমতা আর মানবতা – বিশেষ করে শেষেরটাও যেন হারিয়ে ফেলেছিল আমার এই বন্ধুটি।
এসব সত্ত্বেও, ক্লাসে রীতিমত মেধাবি ছেলে ছিল বাকি। প্রতিটা বিষয়ে প্রথম দিকে থাকাটা তার স্বভাবে ছিল। কিন্তু মাঝে মাঝে কেমন যেন ভাবাবিষ্ট হয়ে যেত সে। বিভিন্ন ভক্তিগীতি মন দিয়ে শুনত, সেগুলোকে যতটা সম্ভব মুখস্থ করে সুরে গাওয়ার চেষ্টা করত। স্টেশনের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দাঁত খিঁচিয়ে মুখ কুঁচকে সে তার ভক্তিরসের প্রাচুর্য্য যেন দুনিয়াকে জোর করে দেখাতে চাইত। আমরা এ ওকে খোঁচা মেরে খিলখিলিয়ে হাসতাম, বিদ্রুপ করতাম বাকির এই অর্ধোন্মাদ অবস্থাকে।
বাকি-র পাদ্রীগিরি ছেড়ে দেওয়াটা বিরাট ভুল ছিল সেটাও বলব না, তবে সিদ্ধান্তটা নিতে ও প্রচুর সময় নিয়ে ফেলেছিল। মাসের পর মাস ও ভেবে গেছে এটা নিয়ে। চিন্তায় চিন্তায় বেচারা আরও রোগা হয়ে গিয়েছিল, ভয়ঙ্কর তোতলামি চলে এসেছিল ওর মধ্যে। কনফিডেন্স লেভেলে তলানিতে চলে যাওয়ার ফল এসব। তারপর ঘটেছিল সেই মারাত্মক ঘটনা।
প্রায় এক বোতল ঘুমের ওষুধের বড়ি এক নিব ভদকার সঙ্গে গিলে ফেলেছিল বাকি।
ফাদার হেইলি আর আমি ওকে খুঁজে বের করে কোনরকমে বমি করিয়ে সব বের করেছিলাম ওর পেট থেকে। হাসপাতালে ভর্তি করার পর ফাদার হেইলি অবশ্য আবার ওকে পাদ্রী স্কুলে ফেরত নিয়ে যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিলেন। সেদিনই হাসপাতাল থেকে বাকির ফোন আসে – চুড়ান্ত উত্তেজনায় তুতলে তুতলে ও আমার কাছে কাতর ভাবে ভিক্ষা চেয়েছিল যেন ওকে আমি কিছুতেই যেতে না দি!
না – হাসপাতালে থাকার চেয়েও ফাদার হেইলি-র কাছে পাদ্রী স্কুলে ফিরে যাওয়ার আতঙ্ক বাকির মধ্যে অনেক বেশি ছিল।
আর আমি!! একজন পুলিশ অফিসার হয়ে, রাতপোষাকে- হোলস্টারে বন্দুক গুঁজে, ম্যাগির ডাক উপেক্ষা করে, আমার আধা-পাগল বন্ধুকে এক বুড়ো ক্যাথলিক পাদ্রী এবং তার থেকেও জীর্ণ এক ধর্মের কবল থেকে বের করে নিয়ে আসতে ছুটে গিয়েছিলাম। বলিহারি আমাকেও!!
“জিন? জিন সনিসি?”
সেন্ট ক্লেয়ারের বিষন্ন লবিতে বাকি-র দিকে মুখ তুলে চাইলাম আমি।
“হ্যালো বাকি।“
“হে ভগবান! জিন, তুই তো একটুও বদলাসনি ভাই! মানে কি করে… ”
এতটুকু বলেই বাকি কেঁদে ফেলল।
আমি লবির একটা আধা-অন্ধকার কোণের টেবিলে বাকি-কে নিয়ে বসলাম। টেবিলের পাশে একটা নোংরা জানলা, আর তার বাইরে তাকালে একটা অন্ধকার গলি ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না।
বাকি দরজার দিকে পিছন করে বসল। তার কান্না কেউ দেখে ফেললেও, তাতে সে খুব একটা লজ্জিত হবে বলে তো মনে হয়না। কিন্তু আমার বেশ অস্বস্তি হচ্ছিল।
দুটো বিয়ার অর্ডার দিয়ে সরাসরি কাজের কথায় চলে এলাম, “হ্যাঁ বল, কি হয়েছে।“
“তুই সেই একই মানে….. একই রয়ে গেলি। একদম সোজা…মানে…একটুও…” বাকি নাক টানতে টানতে বলে চলল।
আমার পিত্তি জ্বলে গেল, “বাকি!! ফালতু না বকে বলবি কি হয়েছে? কিসের এত তাড়াহুড়ো তোর?”
“তুই এসব ঘৃণা করিস জিন”- বাকি অদ্ভুতভাবে বলল।
আমি বাকির পেছনের দরজার দিকে তাকালাম। দেড় বছরে আমি এত কান্না, এত যন্ত্রণা পেয়েছি আর এতরকম নাটক দেখেছি – যা আমার জীবন কাটিয়ে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। যদিও বাকি-কে এসব বলার কোন কারণ নেই, তবুও ওর নাকিকান্না আমাকে খুব একটা বিচলিত করল না।
“আমি… কেলভিন ফার্মাসিউটিক্যালসে কাজ করি। ওই পাদ্রীদের…স্কুলের পর…মানে ছেড়ে দেওয়ার পর। তুই তো জানিস… ফাদার হেইলি…”
“আমি শুনছি” – ভাবলেশহীন স্বরে বললাম আমি।
আমার স্পষ্ট মনে আছে আমার সঙ্গে ফাদার হেইলির সেদিন শুধু মারপিট হওয়াটাই বাকি ছিল। হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে সেদিন আমি ফাদার হেইলি-কে কি কি বলেছিলাম সেগুলো আর মনে করতে ইচ্ছে করল না।
“আমি স্কু-স্কুলে ফিরে গেছিলাম জিন। ওই… মানে পা-পাদরী হওয়ার স্কুলে আর নয়। আমি কেমিস্ট্রিতে গ্রাজুয়েট হলাম, তারপর মাস্টার্স, পি এইচ ডি। আমি, আমি তোর সঙ্গে অনেকদিন ক-কথা বলতে পারিনি জিন। আমারই দোষ – আমার উচিত ছিল, মানে তোকে খুঁজে বের করার। সেই যখন বের করলাম, তখন অনেক দে-দেরী হয়ে গেছে, মানে ম্যাগি… যাইহোক, আমি কেলভিন ফার্মাসিউটিক্যালে ঢুকলাম। ওদের রিসার্চ সেন্টারে। কাজটা ভালোই। তারপর টমির সঙ্গে আলাপ হল। এখন আমরা একসঙ্গেই থাকি।”
একটা গভীর শ্বাস নিয়ে বাকি বলতে থাকল, “কেলভিনে কাজটা আমি খুব এনজয় করি। আমি “কামিনিওর” ওষুধটার ওপরও কাজ করেছি। তুই এই ওষুধটা নিস, তাই না জিন?”
প্রচন্ড চমকে উঠলাম। “তুই কি করে জানলি?”
বাকি হাসল, “আরে এত ভয় পাস না। আমি মেডিকেল রেকর্ড হ্যাকার নই। জাস্ট তোর অবস্থা থেকে আন্দাজ করে নিয়েছি।“
কামিনিওর একটা স্নায়ু নিয়ন্ত্রক ওষুধ। প্রোজাক বা ওই গোত্রের অন্যান্য প্রাগৈতিহাসিক মানসিক অবসাদ নিরোধী ওষুধের থেকে অনেক বেশি কার্যকর। এটা কেবল সেরেটোনিন হরমোনের নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ করে না, নোরপাইনেফ্রিন, ডোপামিন ইত্যাদি কয়েকগুচ্ছ হরমোনের নিঃসরণ সুচারুভাবে মনিটর করে। ম্যাগির দুর্ঘটনাটার পর এটা ডাক্তার আমায় খেতে বলেছিল। পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়াহীন এই ওষুধের গুণ অনেক। মস্তিষ্ককে সচল রাখে, চিন্তা শক্তিকে ভোঁতা করে দেয় না।
হয়তো এই ওষুধটা না থাকলে আমার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব হত না। ম্যাগির ঘটনাটার পর থেকে আমি খেতে পারতাম না, ঘুমাতে পারতাম না, কিছুতে মনঃসংযোগ করতে পারতাম না। আর যখনই আমি ম্যাগিকে দেখতে সেন্ট ক্লেয়ারে আসতাম, মনে হত, কাউকে খুন করে ফেলি!! সবসময়ই যেন রক্ত চড়ে থাকত মাথায়।
একদিন চলেও গিয়েছিলাম – একটা বন্দুকের দোকানে। নাইন মিলিমিটারের একটা পিস্তল নিয়ে টেস্ট করার সময় তার ট্রিগার চাপতে চাপতে মনে হচ্ছিল – আহ, কি আরাম! একদম পাখির পালকের মতো হাল্কা। কিন্তু আমার মধ্যে যে সচেতন “আমি”টা তখনও অবধি বেঁচে ছিল, সে-ই বেগতিক দেখে আমাকে বাধ্য করেছিল ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করতে – এবার নিজের ব্যাপারে।
বাকি বলে চলেছে, “কামিনিওর এমনভাবে তৈরী করা হয়েছে যাতে প্রচন্ড মানসিক চাপে তৈরী হওয়া হিংস্র কল্পনাগুলোকে নিয়ন্ত্রিত কিন্তু তীব্র স্নায়বিক ইমপালস দিয়ে বিনষ্ট করা যায়। পুলিশ, মিলিটারি, ডাক্তার – এ ধরনের পেশার লোকজনকেই সাধারণতঃ এই ওষুধটা দেওয়া হয়।“
আমি চুপ করে শুনছিলাম। বাকির আমতা আমতা ভাব, তোতলামি সব গায়েব হয়ে যায়, যখন সে তার নিজের কাজের ব্যাপারে কথা বলে।
“ওষুধটা খুব ভাল জিন। এটা খাওয়া নিয়ে এত লজ্জার কিছু নেই। এটা ব্রেনকে সেই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে সাহায্য করে, ঠিক যেমনটা ট্রমা হওয়ার আগে ছিল।“
আরও দুটো বিয়ারের অর্ডার দিলাম আমি।
বাকি নিজের বিয়ারটা শেষ করে বলল, “কামিনিওরের পর নিউরো মেডিসিন অনেক পথ পেরিয়ে এসেছে। বছর তিনেক আগে, নিউরোফার্ম রিসার্চে একটা মারাত্মক আবিষ্কার হয়। যুগান্তকারী বলতে যা বোঝায় ঠিক তাই। এত ডিটেইলে যাচ্ছি না তবে আমাদের কোম্পানী সেই আবিষ্কারের সুত্র ধরে কাজ শুরু করে, নতুন প্রডাক্টের ওপর। আমি সেই টিমে ছিলাম, বলা ভালো, এখনও আছি।“
বাকি একটু চুপ করল। আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে বুঝতে পারছি। জানলার ওপরের টিনের ছাউনিতে বড় বড় ফোঁটা পড়ার আওয়াজ ভেসে আসছে।
“গত পাঁচবছরে যেকটা নিউরোফার্মের ওপর আবিষ্কার বা কাজ হয়েছে, সবই একটা বিশেষ ব্যাপারকে কেন্দ্র করে। দেখা গেছে, ক্রমাগত তীব্র আবেগের প্রভাবে আমাদের মস্তিষ্কের নিউরো সার্কিটের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ আদান-প্রদানের পদ্ধতিতে রীতিমত পরিবর্তন আসে। মানে, জিনিসটা আমাদের মস্তিষ্কের গঠনটাকেই বেশ খানিকটা বদলে দেয়। বলতে গেলে ব্রেনের কোষে পর্যন্ত বদল আনে। এভাবেই নতুন একধরনের মস্তিষ্ক কোষের জন্ম হয়। যদিও সাধারণ পদ্ধতিটা অনেক ধীর, কিন্তু একই উত্তেজনা বা আবেগের পুনরাবৃত্তি হতে থাকলে, এই পরিবর্তনটা দ্রুত হয়। অনেক ক্ষেত্রে, এর ফলে মানুষের ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতা বেড়ে যায়, প্রচন্ড মানসিক চাপেও বরফ ঠান্ডা থাকা যায়। আবার এমন বিপত্তিও আসতে পারে, জীবন অসহ্য হয়ে ওঠে, আক্ষরিক অর্থেই হয়ে পড়ে দুর্বিষহ। “
বাকি বলে চলল, “অবসাদ, ভয় বা আত্মকেন্দ্রিক রোষ থেকে তৈরী হওয়া মস্তিষ্কের সিন্যাপটিক পথ কিভাবে প্রভাবিত করতে হয়, সেগুলো আমরা শিখেছিলাম। তোর স্মৃতির কোন ক্ষতি হবে না। তোর মনের মধ্যে পুরানো স্মৃতিগুলো রাস্তার ধারে বিলবোর্ডের মতো সাজানো থাকবে। অনেকটা যেন তুই গাড়ি নিয়ে যেতে যেতে সেগুলোকে দেখতে দেখতে যেতে পারবি, কিন্তু তাদের মধ্যে দিয়ে তোকে যেতে হবে না। তাই তোর ওপর খারাপ ভালো কোনো স্মৃতিই কোনো ইমপ্যাক্ট ফেলতে পারবে না।“
বাকি চকিতে আমার দিকে তাকাল। আমি শান্তভাবে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “তুই তোর স্মৃতি এভাবে টপকে যেতে কি ওষুধ খাচ্ছিস বলবি?”
বাকি হাসল, “জিন, দ্যাখ মাথার ওষুধ না খাওয়া মানেই যে সে বিরাট স্বাভাবিক তা যেমন নয়, তেমনি খাওয়াটাও মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়। কেবল উন্মাদরাই যে এসব ওষুধ নেয়, সে ধারণা ভুল। তবে আমার ব্যাপারটা অন্য। আমি – মানে আমি…অ-অ-পেক্ষা করেছি – অনন্ত অপেক্ষা।“
“তোর স্বপ্নের রাজকুমারের জন্য?” কিছুটা রেগেই বললাম আমি।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই বাকি বলল, “হ্যাঁ।“
আমি বাকির দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু বাকি তখন বলেই চলেছে।
“আমাদের টিম এখন এসব ড্রাগের ওপর নিরলস কাজ করে চলেছে। উত্তেজনা বা আবেগের ফলে মস্তিষ্কে যে বিরূদ্ধ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় সেগুলোকে প্রতিহত করা ছাড়াও আরও অন্য কাজ রয়েছে। আপাতত সেরাটোনিনের কথাই ধরেনি। বিজ্ঞানীরা বলেন, সেরাটোনিন যেন অনেকটা পুলিশের মতো। মস্তিষ্কের কোষ-রসায়নে সেরাটোনিনের পর্যাপ্ত উপস্থিতিতে অনেক সময় বাঁধনছাড়া আবেগ নিয়ন্ত্রণে আসে। যেমন, গুণ্ডামি, দাঙ্গা ইত্যাদি মানসিক উত্তেজনাকে বশে আনতে ওই হরমোনের জুড়ি নেই। কিন্তু শুধু সেটা হলেই তো চলবে না। সমাজে অপরাধ কমে যাওয়াটাই তো আসল নয় – মানুষের মধ্যে ভালো গুণগুলো জাগ্রত করা, তাকে শক্তিশালী করাটাই আসল।“
“তাহলে কোকেন খেলেই হয়। বা জিন আর টনিক।“ আমি বললাম।
“আরে না না – এত তাড়াহুড়োর কি দরকার? আর এত সাময়িক পরিবর্তনের কথাও বলছি না। নিউরাল সার্কিটে এমন পরিবর্তন যেটা – মানুষকে” – কথাটা শেষ না করে বাকি একটু ঝুঁকে এল আমার দিকে, “জিন তুই একটা কথা বল। তুই তো ম্যাগিকে ভীষণ ভালোবাসিস। এরকম কোনোদিন হয়নি তোর, যে মনে হয়েছে তুই আর ম্যাগি একাত্ম হয়ে গেছিস! মানে তোর কি কখনও মনে হয়েছে, তুই নিজেই ম্যাগি।“
বাইরে বৃষ্টিটা বেশ জোরে নেমেছে এখন। নোংরা জানলার সার্সিতে বড় বড় ফোঁটা পড়ে ঝাপসা হয়ে আসছে বাইরেটা। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলাম একজন ভবঘুরে বাইরে দাঁড়িয়ে নিচু হয়ে আবর্জনা ঘাঁটছে।
“এসবের সঙ্গে বুড়োদের আত্মহত্যার ঘটনার সম্পর্ক কি? দ্যাখ, যদি তোর কিছু বলার থাকে তো বল!!” আমার গলার আওয়াজটা যেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত কড়া হয়ে গেল।
“ওগুলো আত্মহত্যা নয় জিন, ওগুলো হত্যা, খুন।”
“খুন? কোনো উন্মাদ বুড়োবুড়িদের ধাক্কা মেরে ফেলে দিচ্ছে এটাই বলতে চাস? তোর কেন এরকম মনে হচ্ছে শুনি?”
“এসব উন্মাদের কাজ নয় জিন – আমি জানি।”
“কি জানিস?”
“এই আটটা বয়ষ্ক মানুষ J-24 নিচ্ছিল জিন। এটা কেলভিন ফার্মার কোড – এই ড্রাগটা একটা বিশেষ পরিস্থিতিগত একাকীত্ব সারিয়ে তুলতে কতটা কার্যকরী, তার একটা পরীক্ষামূলক প্রয়োগ বা ট্রায়াল চালাচ্ছিল কোম্পানী।”
আমি বাকির দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালাম। এই বাকিকে বেশ নতুন লাগছে। চোখে স্বতন্ত্র্য একটা আলো দেখতে পাচ্ছি যেগুলো আগে ছিল না। “বাকি, ব্যাপারটা এত সরল নয়। আমি জানি পুলিশ ডিপার্টমেন্ট খুব ভালো কিছু তদন্ত করে না, কিন্তু খুন আর আত্মহত্যার মধ্যে পার্থক্য করতে পারবে না, এটা মেনে নেওয়া কঠিন। তাছাড়া, বুড়োদের মধ্যে অবসাদের ফলে আত্মহত্যার প্রবণতা হালে বেড়েছে… তাই এটাও সেরকমই…”
“আরে সেটাই তো!!” বাকি চিৎকার করে উঠল। পাশের টেবিলে একটি বয়ষ্ক দম্পতি বসেছিলেন, তাঁরা কটমট করে আমাদের দিকে চাইলেন।
বাকি গলার স্বর এবার একটু নামিয়ে বলল, “এই ট্রায়ালে যেসব বুড়োবুড়িদের নেওয়া হয়েছিল তারা মোটেই অবসাদগ্রস্থ ছিল না। খুব বেছে বেছে এদেরকে নেওয়া হয়েছিল। মানসিক, শারীরিক, সামাজিক- কোনোভাবেই যাতে অবসাদের “অ” টুকু না থাকে, সেটা আগে থেকে দেখে নেওয়া হয়েছিল। বিজ্ঞাপনে দেখিস না – বুড়োরা টেনিস খেলছে, চমৎকার স্বাস্থ্য সব, রোমান্টিক ডিনার করছে, নাচছে – এরা অনেকটা সেরকমই। এরা আর যাই হোক – ডিপ্রেসড নয়।“
“হতে পারে তোদের দেওয়া ট্যাবলেটগুলো ওদের ডিপ্রেসড বানিয়ে ছেড়েছে। যার ফলে ওরা আত্মহত্যা করছে।”
“না না – J-24 মোটেই ওরকম নয়। এটা ওরকম কিছু… মানে কিছুতেই হতে পারে না। আমি জানি – আমি দেখেছি। আর তাছাড়া…”
“তাছাড়া কি?”
বাকি সতর্কভাবে পেছন দিকে তাকাল। একজন ওয়েটার এসে পাশের টেবল থেকে এঁটো প্লেটগুলো তুলে নিয়ে যাবার পর বাকি কথা বলল। ওর গলার স্বরটা কেমন যেন অদ্ভুত শোনাল।
“এই ড্রাগটার পেছনে আমি আমার সর্বস্ব দিয়েছিলাম জিন। প্রতিদিন ল্যাবে পড়ে থাকতাম, দিনে টানা আটঘন্টা। টমির সঙ্গে দেখা হবার পরেও আমি এটা নিয়ে জানপ্রাণ দিয়ে খেটে গেছি। কেলভিনের বড় বড় উচ্চপদস্থ লোক এই ড্রাগটা নিয়ে যা জানে না, আমি জানি। J-24 কিভাবে আমাদের স্নায়ুতন্ত্রে প্রভাবে ফেলে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ আমি জানি।”
বাকি বলে চলল, “বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা স্বাভাবিক একাকীত্ব আমাদের সবাইকেই গ্রাস করে। আর সেটা থেকে মুক্তি দিতেই এই J-24 ড্রাগটা বানানো হয়েছিল। তুই বুড়ো হবি, তোর বন্ধুরা বুড়ো হয়ে মারা যাবে। তোর ছেলেমেয়েরা অন্য দেশে, অন্য রাজ্যে থাকবে – তাদের নিজের জীবন নিয়ে, সম্পর্ক নিয়ে। সারাজীবনে তুই যে কটা সম্পর্ক তৈরী করেছিলি, এত কষ্ট করে, সেগুলো এক এক করে অদৃশ্য হয়ে যাবে তোর জীবন থেকে। একজন স্বাভাবিক, স্বাস্থ্যবান মানুষের পক্ষে সারাজীবনের এই কানেকশন গুলো একটা ঘন, মজবুত কিছু নির্দিষ্ট নিউরাল কাঠামো তৈরী করে। একজন বৃদ্ধ মানুষ, সে যতই বৃদ্ধাবাসে, নার্সিং হোমে গিয়ে নতুন মানুষদের দেখুক না কেন, সেই মজবুত সম্পর্ক আর গড়ে ওঠে না। বুড়ো বয়সে সে মানুষটা যতই উদ্যোগী, ঝুঁকি নিতে সক্ষম হোক না কেন।”
আমি চুপচাপ বাকির কথা শুনে যেতে লাগলাম।
“J-24 এই স্নায়বিক বন্ধন রাসায়নিকভাবে তৈরী করতে সক্ষম। এই ড্রাগটা তোকে অন্য কারুর সামনে বসে নিতে হবে। একে অপরকে দেখতে দেখতে। তাহলেই দুজনের নিজস্ব জগত উন্মুক্ত হয়ে পড়বে একে অপরের কাছে। একজনের মনে, মানে মস্তিষ্কের নিউরনে অপরজনের ছাপ পড়ে যাবে – পাকাপাকিভাবে। তারপরই শুরু হবে ভানুমতীর খেল।”
“তোরা কি বুড়োদের জন্য শিলাজিত বানিয়েছিস নাকি?”
“ধ্যার” বাকি স্পষ্টতই বিরক্ত, “সেক্স নয়। ওটা শুধুই শারীরিক, আর এটা মানসিক। এটার প্রভাব সেক্সের থেকেও অনেক বেশি তীব্র এবং দীর্ঘমেয়াদি। তুই নিশ্চই ম্যাগিকে কেবল সেক্সের জন্য ভালবাসতিস না।”
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর সে বলল, “স্যরি জিন।”
“গল্পটা শেষ কর।”
“গল্প এখানেই শেষ জিন। আমরা চারজোড়া ভলান্টিয়ারকে বেছে নিয়েছিলাম যারা অন্যান্য দূরারোগ্য রোগে ভুগছে, কিন্তু মানসিক অবসাদগ্রস্ত নয়। যারা এই বয়সেও ঝুঁকি নিতে ইচ্ছুক – কিছু একটা নতুন করার ঝুঁকি। আমি নিজে ওখানে উপস্থিত ছিলাম যখন ওরা ড্রাগটা নিচ্ছিল। বিশ্বাস করবি না, ওটা নেওয়ার পর – যেন একে ওপরের মধ্যে ওরা হারিয়ে যাচ্ছিল।”
বাকির চোখে মুখে একটা অদ্ভুত ভাবালুতা, “কিরকম জানিস – দেখে মনে হচ্ছিল তাদের আত্মারা যেন মিশে গেছে একে অপরের মধ্যে। একে অপরকে জানার মাধ্যমে – স্মৃতির মধ্যে দিয়ে নয়, তাদের বর্তমানেই এ যেন এক স্বর্গীয় একাত্মতা। যে হাজার বাধা-নিষেধের গন্ডি বানিয়ে আমরা একে অপরকে দূরে সরিয়ে রাখি, ওরা সেসব বাধা অতিক্রম করে ফেলেছিল। ঠিকভাবে বলতে গেলে ওরা নিজেরা নিজেদেরকে আবিষ্কার করেছিল, একে অপরের মধ্যে।”
বাকির মুখের ভাব দেখে আমার নিজেরই কেমন অস্বস্তি হচ্ছিল, “কিন্তু বাকি, ওই অনুভূতিটা তো সত্যি নয়, ওটা তো একটা ভ্রম মাত্র।”
আমি আর কথা চালিয়ে যেতে চাইছিলাম না। কিন্তু বাকির ক্ষেত্রে যা হয়, কথা চালিয়ে যাওয়ার জন্য দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির দরকার পড়ে না। একা একাই দিব্যি বকে যেতে পারে।
“কি হয়, যখন আমরা মানসিকভাবে কারও কাছাকাছি আসি, সংযোগ স্থাপন করি- আমাদের ভিতরকার বাধোবাধো ভাবটা অনেকটা কাটিয়ে উঠতে হয়। সামনের মানুষটার প্রতি অনেকটা উদারতা, অনেকটা সমানুভূতি দেখাতে হয়। আমাদের এই সমস্ত প্রতিক্রিয়া আসলে আমাদের মাথার ভিতরকার রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফল, যা আমাদের মস্তিষ্কের গঠনকে প্রভাবিত করে। J-24 এই কাজটাই ঠিক উল্টো ভাবে করে। মস্তিষ্কের ভিতরের গঠনকে প্রভাবিত করে অনুভূতি সৃষ্টি করে। শুধু তাই নয়, এই আশ্চর্য ড্রাগ প্রত্যেকটা ছোট স্পর্শ, ছোট ছোট আবেগের মাধ্যমে স্বাভাবিক সুখানুভূতির এক’শ গুণ আমাদের শরীরকে ফিরিয়ে দেয়।”
ওর কথাগুলো আদৌ কতটা বিশ্বাস করবো, বুঝতে পারলাম না।
“আর তোর এই ছাইপাঁশ ওষুধ চার-চার মোট আটজনকে দিয়েছিলি? একটা কথা বল তো, এটা কি শুধু একজোড়া নারী-পুরুষের মধ্যেই কাজ করে?”
আমার প্রশ্ন ওর মুখে একটা অদ্ভুত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করলো। যেন মনে হল ও টমির কথা ভাবছে।
“আমি কি করে বলি? আমি তো শুধু এদের মধ্যেই প্রয়োগ করেছি… আর তো জানি না.. মানে জিন জানো তো..”
“আমি জানতে চাই না।“ আমি এবার একটু কড়া করেই উত্তর দিলাম। আমার মেয়ে লিবি, ঠিক এই মুহূর্তে এখানে থাকলে আমার প্রতিক্রিয়াশীল মানসিকতার সমালোচনা করতো৷ কিন্তু, আমি পেশায় একজন আইন রক্ষক ছিলাম। তাই এসব হোমোফোবিয়ার ছিটেফোঁটা তো আমার মধ্যে থাকাটাই স্বাভাবিক। যদিও, আমি এ নিয়ে ভীষণ গর্বিত তা বলা যায় না। যাইহোক, আসল কথা আমি এই মুহূর্তে ওর পেয়ারের টমির বিষয়ে রগরগে গল্প শুনতে চাই না।
বাকি বিশেষ আহত হয়েছে কিনা, তা বোঝা গেলো না।
“তুই ভাব তো, আসলে কি অসহ্য একাকীত্বের মধ্যে আমরা জীবন কাটাই…” কথা শেষ না করে ঘষা কাঁচের ওপরে জমা হওয়া বিন্দু বিন্দু জলের ফোঁটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো বাকি।
“তাহলে তোর বিশ্বাস এই বুড়োবুড়িগুলোকে কেউ খুন করেছে? কে? আর কেন?” আমিই নীরবতা ভাঙলাম।
“জানি না।“
“জানার চেষ্টা কর। একটা ওষুধ কোম্পানি কিসব স্নায়বিক ছাইপাঁশের ওষুধ তৈরি করল। তারপর FDA র তত্ত্বাবধানে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু করল।“
“তা নয়..”
“তাহলে পুরো ব্যাপারটাই তোর হাতের কাজ?”
“কিন্তু… আমি… আমি” ওর বড় বড় বাদামী চোখে বিষাদের ছায়া লাগল যেন।
ও যেভাবে তোতলাচ্ছিলো, তাতেই আমার কাছে পরিষ্কার যে পুরো ব্যাপারটার পিছনে আরও অনেক গল্প আছে। পুরো ঘটনায় বাকি নিজে যেচে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিল এবং ঘটনাচক্রে আটজন মানুষের মৃত্যু ঘটে। সত্যিমিথ্যে যাই হোক, বাকির বিশ্বাস, ওই কোম্পানি পুরো বিষয়টাকে আত্মহত্যা বলে চালাতে চাইছে। যদিও প্রত্যেকটা ঘটনাই আসলে বিশুদ্ধ খুন।
আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি বাকিকে আত্মহত্যার চেষ্টা করতে, ফাদার হেইলির প্রশ্নোত্তর পর্বের জবাব দিতে না পেরে অনুশোচনায় দগ্ধ হতে। দশবছর বয়সে কলম্বাস অ্যাভিনিউ থেকে তিনটে আপেল চুরি করে কান্নাকাটি করতে। আর সেই বাকি আট আটটা খুনের ঘটনায় জড়িয়ে পড়েও শান্তভাবে বসে আছে৷ আশ্চর্যের আশ্চর্য!
এবার আমার প্রশ্নের পালা- “তুই নিজে কি এই ওষুধ খেয়েছিস?”
“বলেছি তো… না, না ,না।“
তার বাদামী চোখে অনুনয়। “ জিন, তুই প্লিজ এই খুনের ব্যাপারে খোঁজ নে।“
“পারব না।“
“জিন…তুই আমায় বিশ্বাস কর…”
“বেআইনি ড্রাগ ট্রায়ালের খবর আটকানোর জন্য মানুষ খুন? মানতে পারলাম না।“
“তাহলে তুইই সত্যিটা খুঁজে বার কর।“
“কি ঘটেছিল বলে তোর বিশ্বাস? “
“আমি জানি না। শুধু এইটুকু জানি যে এই ওষুধ খারাপ না। এই ওষুধ একটা অনন্ত সম্ভাবনার দরজা খুলে দেয়। দুজন মানুষের মধ্যেকার মানসিক সংযোগ কে অন্য স্তরে নিয়ে যায়। এই ড্রাগ ডিপ্রেশনের কারণ হতেই পারে না। আমি নিশ্চিত। “
ও এতো স্থির নিশ্চয়তার সঙ্গে কথাগুলো বলছিল, যে আমি চমকে গেলাম। এই স্থিরতা আর যাই হোক, বাকির স্বভাব নয়। আবার হতেও পারে, ওর মধ্যেকার তীব্র আবেগ ওকে এই স্থিরতা দিয়েছে।
এবার আমায় উঠতে হবে। আমি টেবিলের ওপর বিলের টাকা রাখলাম এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম-
“আমায় এসবের জড়াস না। আর হ্যাঁ… শোন, আমি ভাবছি…মানে…” ধুত্তোর ! এভাবে তোতলাচ্ছি কেন.. “আমি মাঝেমধ্যে মনে অজানা আশঙ্কার ইঙ্গিত পাই।“
“এটা তোর আগেও হত৷ শুধু তুই বুঝতে পারতিস না। কামিনিওর মাথার ভেতরকার এলোমেলো চিন্তার স্রোতকে থামিয়ে তোর যৌক্তিক চিন্তাকে আরও শক্তিশালী করে। যার অনিবার্য ফল হলো ইনট্যুইশানের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি।“
বাকি তখনও টেবিলে বসা। তার মুখ অস্বাভাবিক থমথমে, সরু সরু আঙুল গুলো একে অন্যের সঙ্গে জট পাকিয়ে। একটা সামান্য ঘটনায় কন্সপিরেসি থিওরি আওড়ায়… পাগল না কি ও?
“শোন, আমি কিন্তু জড়াতে চাই না।“ আমি আবার কেটে কেটে উচ্চারণ করলাম।।
“তুই জড়াবি-ই।“ গভীর বিশ্বাস থেকে ও বলে উঠলো ।
(৪)
জেনি কেলি বলছেন, “জানেন আমি, জেফ কনরের সঙ্গে দেখা করতে চাইলাম। আর ও ব্যাটা রাজিই হয় না।“ শুক্রবারের বিকেল। জেনি কেলির দুচোখের তলায় দু পোঁচ গাঢ় কালি। নতুন নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকদের এক লহমায় চিনিয়ে দেয় এই কালি। যারা রাত একটা পর্যন্ত জেগে প্রশ্নপত্র তৈরি করে। ঘন্টাদুয়েকের কাকঘুম ঘুমিয়ে সকাল সাড়ে ছটায় সবার আগে স্কুলে হাজিরা দেয় এবং স্কুলে বসে আবার একসেট করে প্রশ্নপত্র তৈরি করে।
“আবার তলব করো। কখনও কখনও তিন চারবার সমন জারি করতে হয়।“
“আমি জেফের ক্লাসে একটা সামাজিক প্রোগ্রাম চালু করেছিলাম, যেখানে প্রতিবেশীর সমস্যা সহানুভূতির সঙ্গে বুঝতে শেখানো হয়। ওরা এই ক্লাসে এতো গোল বাঁধালো যে আমি তিনদিনে এগারো জনকে প্রিন্সিপালের ঘরে পাঠালাম।“
“এমন করবেন না। তাতে সবার ধারণা হবে যে আপনি ক্লাস সামলাতে পারেন না।“
“পারি না তো। তবে চেষ্টা করি, আর একদিন ঠিকই পারবো।“
“শুনে ভালো লাগলো।“
“আচ্ছা শুনুন, আমি এই ব্যাপারে আপনার থেকে আরও শিখতে চাই। আপনার একদিন সময় হবে কফি খেতে যাওয়ার?”
“সরি!”
“আচ্ছা ঠিক আছে।“ একটু বেশিই সাজগোজ করে আসা মিস কেলি তাতেও না দমে ফের বললেন, “আচ্ছা, অন্য কোনো দিন দেখা যাবে।“
“হয়তো।“
পার্কিং লটে গাড়ি বার করার সময় জেফ কনরকে চোখে পড়লো। বেশ উৎফুল্ল ভাবে আমায় জানালো, মিস কেলি আমায় খুঁজছে। আমি তাকে নস্যাৎ করে দিয়ে প্রশ্ন করলাম,”নেবারহুড সেফটি প্রোগ্রামের কেসটা কি? পুরোটাই ঢপ, তাই না?”
“ না স্যার, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। “
“দাঁড়াও, আমি মিডটাউন সাউথে খোঁজ নিচ্ছি। পালাবে কোথায়?”
“আসলে স্যার, এটা নতুন প্রোগ্রাম। সবাই এখনও জানে না ঠিকঠাক। “
“আচ্ছা, দেখা যাক।“
মিডটাউন সাউথে সবসময় দক্ষযজ্ঞ চলে। একগাদা পুলিশ হাজার একটা অভিযোগ আর কাজ নিয়ে জেরবার হয়ে আছে। কেউ কেউ একমনে রিপোর্ট তৈরি করছে, মাথা নিচু করে বিড়বিড় করা ও বারবার পেন্সিলে ধার দেওয়া এদের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। অ্যারেস্ট হওয়া কয়েদিরাও কেউ বা ঘুমোচ্ছে, কেউ ঘুম থেকে উঠে চিৎকার করছে৷ সবমিলিয়ে প্যান্ডেমোনিয়াম দশা!
আমি লিউটন্যান্ট ফেরম্যাটোর খোঁজ করতে একজন মজাদার চেহারার পুলিশ আমায় হাত নেড়ে ডাকলো। তারপর কাছে যেতেই উৎফুল্ল হয়ে হয়ে বললো,” একি তুমি! কোত্থেকে উদয় হলে অ্যাদ্দিন পরে?”
আমি উত্তর দিতে না দিতেই ফের প্রশ্ন, “তারপর সব ছেড়ে শেষে পড়াচ্ছো? চেহারাখানা বেশ শাঁসে জলে হয়েছে তো। ভালোই আছো, বলো..”
আমি ওর সঙ্গে করমর্দন ইত্যাদির পাঁচপ্যাঁচ কাটিয়ে উঠে ওকে চুপচাপ দেখতে লাগলাম, এবং ও আমায়। দেখবো নাই বা কেন, জনি হলো গিয়ে আমার সাতবছরের সঙ্গী। আমরা একসঙ্গে কতো অভিযানে গেছি, কতো কিছুর সাক্ষী আমরা। জনির ডিভোর্স। আমার হাঁটুর অ্যাক্সিডেন্টটার বছর খানেক আগে জনি নার্কোটিকস ডিপার্টমেন্টে বদলি হয়ে গেল। আমি নিশ্চিত, ও থাকলে আমার হাঁটুর আজ এই দশা হয় না। দেড় বছরের ওপর হল আমি জনির মুখ দেখিনি৷ ওর মুখখানা আমাকে আমার ভাঙাচোরা জীবনের কথা মনে করিয়ে দিল।
“ম্যাগির ব্যাপারটা…জিন…”
আমি ওকে থামিয়ে দিলাম- “আজ এসব না। অন্যকাজে এসেছি৷ একটা প্রফেশনাল হেল্প নিতে।“
“তুমি ঠিক আছো জিন?”
“হ্যাঁ। মার্সি হসপিটালের ফ্র্যান্সেস্কা ডেলা আর লিডিয়া স্মিথের সুইসাইডের ব্যাপারটায় তোমার সাহায্য লাগবে।“ ইচ্ছা করেই বাকির কথাটা তুললাম না। তাতে জটিলতা বাড়তো বই কমতো না।
“বলো, তোমার জন্য কি করতে পারি।“
“আমার এই কেসের প্রাথমিক তদন্তের রিপোর্টের একটা কপি চাই। “
“এই রে, এ তো আমার এলাকা নয়।“
আমি চুপচাপ জনির মুখের দিকে তাকালাম। জনি যদি আমায় সাহায্য না করতে চায় তো করবে না। কিন্তু জনি ম্যানহাটনের দক্ষতম পুলিশকর্মীদের একজন৷ সহকর্মী, অপরাধী, সাধারণ মানুষ, ঝাঁক ঝাঁক ইনফর্মার চরিয়ে খাওয়া জনি চাইবে, অথচ তদন্তের রিপোর্ট কপি তার হাতে আসবে না- এটা অবিশ্বাস্য।
“জরুরী দরকার, জিন?”
“খুব জরুরী।“
“আচ্ছা, দেখছি।“ ব্যস, জনির এটুকু আশ্বাসই জিনিসিটা হাতে পাওয়ার জন্য যথেষ্ট। একফাঁকে নেবারহুড সেফটি ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক নিয়েও জানতে চাইলাম।
“কথাটা আমাদের কানেও এসেছে জিন। বিশুদ্ধ গুজব। কেউ বা কারা পুলিশবিরোধী কাজকর্মকে উসকে দেওয়ার জন্য এই গুজবকে হাতিয়ার করেছে। আমরা খুব শিগগিরই এর ব্যবস্থা নিচ্ছি।“
জনির সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কাটালাম। নিজেদের সুখ-দুঃখের গল্প, নতুন কথা,বহু পুরানো স্মৃতি রোমন্থন করে যখন বাইরে এলাম, প্যান্ডেমোনিয়ামের একফোঁটাও পরিবর্তন হয় নি, যেমনকে তেমন। জাহান্নাম একটা!
(৫)
এক সপ্তাহের মধ্যেই বুড়োদের আত্মহত্যার খবরটা খবরের কাগজের পাতা থেকে উধাও হয়ে গেল। তার বদলে স্থান করে নিলো নতুন নতুন নৃশংসতার খবর। ইতিমধ্যে ম্যানহাটনের নালাগুলো দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। মিস কেলির ক্লাসে আরও দুবার মারপিট হয়েছে। একটার সাক্ষী আমি নিজে। আরেকটা ওই পুঁচকে লাতিশার থেকে শোনা-
“ওই ছেলেটা মিঃ সনিসি, ওই রিচি ট্যাং, কেলিকে ‘কুচ্ছিৎ মাগি’ বলে খ্যাপায়। আর শাসায়, ওর পিছনে লাগলে সেটা কেলির পক্ষে ভালো হবে না।“
“তারপর?”
আমার খুদে সংবাদদাতা বলে চলে, “কেলি রাগে অন্ধ হয়ে উন্মাদের মতো চিৎকার করতে করতে গোটা ক্লাসকে শাপশাপান্ত করতে থাকে। আমার মনে হয় না মিস কেলি এখানে থ্যাংকস গিভিং পর্যন্ত টিঁকতে পারবে বলে।“
“তাই কি! দেখো, হয়তো উনি টিকেও যেতে পারেন।“
“হুঁঃ, আমি বুঝি না নাকি!”
মিস কেলির মুখোমুখি হয়ে অবশ্য বুঝলাম অবস্থা আমার আন্দাজের থেকেও বেশি শোচনীয়। চোখের নিচের কালি গাঢ়তর হয়েছে, খানিকটা রাতজাগা আর খানিকটা কাজল লেপ্টানোর ফল। এককোণে বসে অসংলগ্ন ভাবে পরীক্ষার খাতায় লাল কালি দিয়ে ঢ্যাঁড়া কাটছে। আমি ওকে এড়ানোর জন্যই সচেতন ভাবে একটু দূরে বসলাম।
ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি। এর মাঝে বাকির ফোন এসেছিলো। বাকি নতুন ফ্ল্যাটে উঠে গেছে আর ওর নতুন টেলিফোন নাম্বারে যোগাযোগ করার জন্য ভয়েস মেসেজ পাঠিয়েছে। যদিও আমি স্থিরপ্রতিজ্ঞ যে জনির থেকে নতুন খবর না পাওয়া পর্যন্ত বাকির সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ নয়।
জনি ফেরম্যাটোর ফোনটা খানিকটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই ঠিক আটদিন পরে মঙ্গলবারের বারবেলায় এলো।
“হুমম, জিন, তুমি যে রিপোর্টটা চাইছিলে সেটা পাওয়া যাচ্ছে না।“
“পাওয়া যাচ্ছে না মানে?”
“পাওয়া যাচ্ছে না মানে পাওয়া যাচ্ছে না।“ জনির কাটাকাটা স্বরে উত্তর আমায় আশ্বস্ত করলো যে কথা আর বেশি এগোবে না ।
জনির ফোন রাখার ধাতব শব্দটা আমায় অনেকক্ষণ থম মেরে বসে থাকতে বাধ্য করলো।
তিন দিন অনুপস্থিত থাকার পর জেফকে আবার স্কুলে দেখা গেলো। এবার তার বাউন্ডুলে রূপ আরো খোলতাই হয়েছে একখানা মোটা কুকুরের গলার চেনের গড়নের সোনালি হারে। “এহ, বাবু লায়েক হয়েছেন না!” – লাতিশার নাকমুখ বেঁকিয়ে ঠাকুমা-দিদিমার মতো পাকা পাকা বুলি শুনে হাসিকান্না দুটোই একসঙ্গে পেয়ে গেল।
বিরতির সময় ছেলেদের কমনরুমের পাশের করিডোরটায় একটু হাঁটাহাঁটি করবো কি, দুই অবতারের মুখোমুখি হলাম। জেফ কনর ও মিস কেলি। দরজার সামনে মিস কেলি দাঁড়িয়ে। টুটাফাটা দরজাটা আর কিছুই না, ছেলেদের টয়লেটটাকে আব্রু দেওয়ার একটা হাস্যকর প্রচেষ্টা। মিস কেলি মরতে এখানে কি করছেন!
“জেফ, তোমার সঙ্গে কথা আছে৷ আমার অফ পিরিয়ডে যেন আমার সঙ্গে একবার দেখা করা হয়।“ কেলির সিংহীনাদ শুনে আমার ভিতরের মনটা বলছিলো, এবারের সমন বৃথা যাবে না।
আমার আন্দাজকে যেন সত্যি প্রমাণ করার জন্যই জেফ টক করে ঘাড় নেড়ে বাধ্য শিশুটির মতো সম্মতি দিলো৷
এবার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে চোখে কালি পড়া সিংহী অত্যন্ত নিরাসক্ত ভাবে বলে যেতে লাগলেন,” জেফের মা তিনদিন ধরে নিখোঁজ ছিলো। ছোটো ভাইকে সামলানোর জন্য জেফকে বাধ্য হয়ে স্কুল কামাই করে ঘরে বসে থাকতে হয়। জেফের মা ফিরে এসেছেন বটে, কিন্তু জেফ আর তার ওপরেও ভরসা রাখতে নারাজ।“
তর্জন গর্জন আরও কিছুক্ষণ চললো-“ মিঃ সনিসি, আপনি আন্দাজ করতে পারেন জেফ কতটা অসুবিধে, কতটা কষ্টে আছে? তার এই অবস্থাকে বদলাতে পারি আমরাই, এই আমি-আপনি। আপনি জানেন না, জেফ আপনাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার চোখে দেখে। তাই আপনার থেকে আমি অনেকখানি আশা করি।“
“শ্রদ্ধা! হবে হয়তো।“ আমি আর কথা না বাড়িয়ে ক্লাসের দিকে এগোলাম। যেতে যেতে একবারের জন্য কেলিকে উপর নিচে মেপে নিতে ভুললাম না। নতুন আত্মপ্রত্যয়ী কেলির টপের রঙ টকটকে লাল।
স্কুল ছুটির পর এঞ্জেল অফ মার্সি হসপিটালের দিকে রওনা দিলাম। আমার বৃদ্ধ মা কে রাখবো এই ছদ্মবেশ সামনে রেখে হাসপাতালের ভিতরটা ঘুরে দেখার মতলব আমার। আমার সঙ্গে কথা চালিয়ে যাওয়ার জন্য ক্যারেন নামের একটা চালাকচতুর চেহারার মেয়ে অ্যাটেনডেন্ট আমার সঙ্গী হলো। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন বাগান ঘেরা বিল্ডিং। দিন কয়েক আগে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার লেশমাত্র কোথাও নেই। তবুও আমার সন্ধানী চোখ আঁতিপাঁতি করছে কোনো একটা সূত্র আবিষ্কারের প্রত্যাশায়।
খানিকপর ক্যারেনের কাছে বললাম আমি একটু একা ঘুরে দেখতে চাই৷ চালাক ক্যারেন সঙ্গে সঙ্গে অনুমতি না দিয়ে একটু দোনামোনা করতে লাগল। আমি অত্যন্ত ক্লান্ত স্বরে টেনে টেনে নিজের পরিস্থিতি বোঝাবার মতো করে ওকে নিবেদন করলাম-
“আমার হয়েছে এক জ্বালা! মা আমার যেমন নাকউঁচু তেমনি খুঁতখুঁতে স্বভাবের। এইভাবে গতকাল গ্রীন মিডোস কে বাতিল করলো দেওয়ালের ক্যাটকেটে নীল রঙের জন্য৷ তারও আগেরবার সেইন্ট অ্যান ওল্ড এজ হোমকে বাতিল করলো কারণ নার্সদের এলোখোঁপা ওনার দৃশ্যদূষণ ঘটায়। হ্যাভেনভিউ বাতিল হলো ডাইনিং রুমে পিয়ানো না থাকার অপরাধে। আজকে এই নিয়ে দশনম্বর ভিজিট আমার!”
ক্যারেনের কাঠকাঠ চোখমুখে এতোক্ষণে হাসি ফুটলো৷
“আচ্ছা, আপনি নিজে ঘুরে দেখুন। শুধু বেরোবার আগে একবার আমার সঙ্গে কথা বলে নিতে ভুলবেন না।“
আমার শিকারী দুচোখ এদিক ওদিক সূত্র খুঁজে বেড়াতে লাগলো। কিছু পাবো না জেনেও সাততলায় ফ্যানসেস্কা আর লিডিয়া স্মিথের ঘরের চারপাশে বারবার চক্কর কাটতে লাগলাম। ঠিক এই সময়ই চাপদাড়ি, নীলচোখের একজন কচি চেহারার ঝাড়ুদার এলো কাজ করতে।
“ভাইয়ের এখানে কতোদিন কাজ করা হচ্ছে?”
“চার বছর”-নীলচোখ একটু বেশি নরম স্বরেই জবাব দিলো।
“বাব্বাহ, সেতো অনেকদিন গো! তাহলে তুমি এখানকার সবই জানো, তাই না?”
“অনেকটাই। আমি সবাইকেই চিনি। সবাই খুব ভালো।“
“সব্বাই ভালো?”
“বেশিরভাগই। খিটখিটে লোকজন খুব কম।“
“তা, মিসেস স্মিথ তো খুব খিটখিটে ছিলেন, তাই না?” আমি অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার একটা সুযোগও আজ ছাড়বো না।
“মোটেই না। উনি খুব হাসিখুশি আর মিশুকে ছিলেন। আর মিঃ ফ্যানসেস্কা, উনি তো সারাদিন মনের আনন্দে বই পড়তেন আর গল্প করতেন মিসেস স্মিথের সঙ্গে।“
“তোমার নামটা যেন কি ভাই?”
“পিট।“
“ওনাদের মারা যাওয়াটা আসলেই খুব দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা, তাই না? কিন্তু কি জানো পিট, ভেতরের খবর হলো ওনারা আত্মহত্যা করেন নি৷ পুরো ব্যাপারটাই বিশুদ্ধ খুন।“
“ওঁদের কে মারতে পারে?”
“খুব সহজ, মিস ক্যারেন।“
“অসম্ভব।“
“খুবই সম্ভব। মিস ক্যারেন আর ডাক্তার। তুমি আমায় চেনো না, আমি এই কেসের তদন্তকারী অফিসার। আমায় কিচ্ছু লুকিয়ে লাভ নেই।“ মাঝেমধ্যেই লোকজনকে ভয় দেখিয়ে কাজ আদায় করা আমার স্বভাব।
“আমি সত্যিই বলছি, ওনাদের ছাদের দরজা খুলে দেওয়ার পর কাউকে আশেপাশে দেখিনি। একদম সত্যিই বলছি। আমি আগেও তো বলেছি।“
“তাই কি?”
পিট ধড়ফড়িয়ে উঠে পালালো। এবার আমার পালা এখান থেকে পগারপার হওয়ার। মিস ক্যারেনের কাছে খবর পৌঁছানোর আগেই।
(৬)
বেশিকিছু করতে হলো না। পুরানো ডিপার্টমেন্টে একটা ফোনই খবর এনে দিলো এই কেসের তিনজন সম্ভাব্য তদন্তকারী অফিসারের নাম। এঞ্জেলস অফ মার্সির অন্দরমহল চাক্ষুষ করার সৌভাগ্য পুনরায় আমার হবে কিনা তা নির্ভর করছে ঠিক কোনজন তদন্তের দায়িত্বে আছে।
আমার গাড়ি ওয়েস্ট এন্ড অ্যাভিনিয়ের দিকে বাঁক নিয়েছে। অস্তগামী সূর্যের কুসুম রঙে চরাচর ভেসে যাচ্ছে। আমি জানালার কাঁচ নামিয়ে গোধূলির শেষ আলোকে আমার শরীর ছোঁয়ার সুযোগ করে দিলাম। আর ঠিক এই মুহূর্তেই ম্যাগির শীর্ণ মুখটা মনে পড়লো।
বেথ ইসরায়েল রিটায়ারমেন্ট হোমের অন্দরমহল আরো আঁটোসাঁটো। না তারা আমায় স্যামুয়েল ফেটারউল্ফ আর রোজ কেপল্যানের জোড়া আত্মহত্যা নিয়ে একটা টুঁ শব্দ উচ্চারণের সুযোগ দিলো, না একা ঘোরার অনুমতি দিলো। ভগ্নহৃদয়ে ঠিক উল্টোদিকের চিনা রেস্টুরেন্টের এককোণে আড়িপাতার ইচ্ছেয় বসলাম – টুকরোটাকরা খবর যা জোটানো যায়!
এখান থেকে বেথ ইসরায়েলের ভিতর অনেকটাই দেখা যায়। সুবেশা নারীপুরুষ কাজের শেষে ছুটে এসেছে বৃদ্ধ আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করার জন্য। তাদের ভিড়েই বেথ ইসরায়েল গমগম করছে। হঠাৎ সন্দেহজনক কথোপকথন বাধ্য করলো আমার শিকারী কুকুরের মতো কান খাড়া করতে।
“তুমি এতো নিশ্চিত হয়ে কিভাবে ওনাকে নাকচ করে দিতে পারো! ওনার বান্ধবী আত্মহত্যাপ্রবণ ছিলো কিনা, এটা সবচেয়ে ভালো তো উনিই বলতে পারবেন।“
“তুমি আমার কথা কচু বুঝেছো।“
“চুপ করো। শোনো, আমরা এই মুহূর্তে কারো কথা উড়িয়ে দিতে পারি না। উনি বুড়ো হতে পারেন, গাধা নন।“
আমি আরো কিছু সূত্রের আশায় তৃষিত চাতকের মতো দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। জোড়ার একটি নারী, কালো চুলের দীর্ঘাঙ্গী । অন্যজন পুরুষ, ভোলাভালা চেহারায় ঢিলে সোয়েটার, মাথায় হাল্কা টাক। প্রথমটি দ্বিতীয়টিকে ধমকে চমকে রাখছে।
“দেখো জো.. মানে আমি বলছিলাম যে…” কাতর পুরুষ কন্ঠ।
“তুমি আমায় বলছো গ্র্যামসের কথা উপেক্ষা করে ওকে এখানে ফেলে রাখি? জানো ও কতটা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে? তোমার ওটা মন না কি পাষাণ? “
“তুমি ভুল বুঝছো!”
“আমি ঠিক বুঝছি।“
“এক্সকিউজ মি!” এখন আমার হাতের তাসগুলো খেলবো। “আমি ভীষণ দুঃখিত। কিন্তু আপনাদের আলোচনার টুকরো টাকরা আমার কানেও আসছিল। আসলে আমার ঠাকুমাও বেথ ইসরায়েলের বাসিন্দা। আমি ভীষণ চিন্তিত, কারণ উনিও আর এখানে থাকতে চাইছেন না।“ সামনে তাকিয়ে দেখলাম দুজোড়া ড্যাবড্যাবে চোখ আমায় মাপছে। আমি থামালাম না, “আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। আসলে উনি কোনোদিনই এতটা ভীতু ছিলেন না। “
“কিন্তু আমরাই বা কি করতে পারি বলুন!” পুরুষের নিস্পৃহ উত্তর।
“আয়্যাম সরি। আমি বুঝতে পারছি। অজানা অচেনা মানুষ হয়ে এভাবে আপনাদের মাঝে…” আমি চলে যেতে উদ্যত হলাম।
“এক মিনিট!” নারীকন্ঠের তীক্ষ্ণ স্বর আমার থামতে যেন বাধ্য করলো। “আপনার নামটা যেন কি?”
“অ্যারন স্যান্ডারসন।“
“কিন্তু জো এভাবে…” পুরুষের গলায় নিষেধাজ্ঞা।
“ব্র্যাড, আমায় কথা বলতে দাও.. আচ্ছা মিঃ স্যান্ডারসন আপনি বলুন তো, আপনার ঠাকুমা কি সচরাচর এরকমই ভীতু?”
“এরকমটা তো আগে ছিলো না। আসলে উনি খুবই হাসিখুশি মানুষ। ওই দুজনের মৃত্যুর পরেই কেমন যেন… “
“একদম ঠিক কথা। আমার গ্র্যামসও মিসেস কেপলানের খুব কাছের বান্ধবী ছিলেন এবং ওনার মতে কেপলানের আত্মহত্যা এক কথায় অবিশ্বাস্য।“
“এক্স্যাক্টলি। আমার ঠাকুমারও ঠিক তাই মত। তবে আমার কি মনে হয় বলুন তো, ওনাদের কথায় এতোটা উদ্বেলিত হয়ে পড়ারও কোনো কারণ নেই।“
“কেন নেই? হতেও তো পারে ওনাদের ওপর কোনো নিষিদ্ধ ওষুধের পরীক্ষা চলছে। ইন ফ্যাক্ট আমার গ্র্যামস তো বললো মিসেস কেপলান স্বেচ্ছায় কিছু ওষুধের ট্রায়ালে অংশ নিয়েছিলেন। উনি ক্যানসারে ভুগছিলেন।“
“তো স্বাভাবিক যে উনি ডিপ্রেশড ছিলেন।“ পুরুষটি এতোক্ষণে মুখ খুললো,” তুমি যা ভাবছো ব্যাপারটা অতোটাও জটিল কিছু নয়৷ এরকম ট্রায়ালের কথা জানাজানি হলে ওষুধ কোম্পানি গুলোর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়বে। তাই আমার মনে হয় না ওরা এতটাও ঝুঁকি নিয়ে এই কাজ করবে।“
“সব জানো না তুমি! শোনো, আমার সঙ্গে গ্র্যামসের সেদিন বিকেলেই কথা হয়েছিলো। মিসেস কেপলান খুব উচ্ছ্বসিত ছিলেন সেইদিন। আসলে ওনার সঙ্গে মিঃ ফেটারউল্ফের একটা মাখোমাখো প্রেম চলছিলো। ফেটারউল্ফও এই ট্রায়ালে অংশ নিয়েছিলেন আর ওনার নাতনি ডোটির মতে তো…”
উফ! লোকের পিছনে তার প্রেমপর্ব নিয়ে আলোচনা শুরু হলে মেয়েরা আর কিচ্ছু চায় না।
“অ্যাই জো, বাড়ি চলো তো। আমার বকতে ভালো লাগছে না।“ পুরুষটি গাম্বাটের মতো মুখ করে বললো।
“আমি কিন্তু সত্যিই খুব চিন্তিত।“ মাচা নাড়ানোর সুযোগ পেলে আমিও সহজে ছাড়ি না।
“আমিও তো… আচ্ছা ব্র্যাড..”
একি! হুমদোটা তো সত্যিসত্যি যাবে বলে উঠে দাঁড়িয়েছে। মহিলাও তাকে অনুসরণ করার জন্য উঠে দাঁড়ালো। যাওয়ার আগে একঝলক অনুনয়ের দৃষ্টি দিয়ে গেলো।
টেলিফোন ডিরেক্টরি বলছে ম্যানহাটনে মোট চারজন ফেটারউল্ফ আছে৷ তার মধ্যে আবার দুজন মহিলা। আমি পাখির চোখ করলাম তৃতীয় জনকে। ডিরেক্টরি অনুযায়ী যার নাম হারমান ফেটারউল্ফ। ঠিকানা- ওয়েস্ট ফিফটি সিক্স।
ওয়েস্ট ফিফটি সিক্সের অ্যাপার্টমেন্টটা বাস্তবিকই খুব সুন্দর। লবিতে টকটকে লাল গালচে পাতা। ডোরম্যানকে বললাম মিসেস ডোটি ফেটারউল্ফকে তলব করতে, ওনার শ্বশুরের মৃত্যুর তদন্তের ব্যাপারে কয়েকটা জিজ্ঞাস্য আছে।
মিসেস ডোটি ফেটারউল্ফ এলেন খ্যাপা ষাঁড়ের মতো ফুঁসতে ফুঁসতে। একটা এলোঝেলো স্কার্ট পরা, চুল কাকের বাসা আর লাল লাল চোখমুখে লবিতে ঢুকে প্রথমেই আমাকে পাকড়াও করলেন।
“আপনি প্রাইভেট ডিটেকটিভ? তা আপনাকে কে কাজে লাগিয়েছে শুনি?”
“আমার পরিচয় ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ ধরে নিন না আমায় যে কাজে লাগিয়েছে সেও তার প্রিয়জনকে হারিয়েছে এই সিরিয়াল স্যুইসাইডের ঘটনায়।“
“কোনো স্যুইসাইড নয় ওগুলো। ওগুলো প্রত্যেকটা খুন। ঠান্ডা মাথার খুন।“
“আপনি কি করে জানলেন ওগুলো খুন?”
“একটা দিব্যি সুস্থ মানুষ তাস খেলে, বই পড়ে দিন কাটাচ্ছিলো, সময় কাটাবার জন্য পাশেই মিসেস কেপলান ছিলো। আমি ঠিক জানি না ওদের মধ্যে প্রেম-ট্রেম চলছিলো কিনা.. চললেও ওটা ওদের নিজস্ব ব্যাপার। দুদিনের মধ্যেই সেই আমুদে মানুষটা কড়িকাঠ থেকে ঝুলে পড়লো? আর তার সঙ্গী মিসেস কেপলানও বাসের সামনে লাফিয়ে পড়লো! তাছাড়াও আত্মহত্যাই যদি হবে, সুইসাইড নোট কই?” এক নিশ্বাসে কথাগুলো বলে ডোটি হাঁপাতে লাগলো।
“উম, আপনি…”
“আপনি আমার শ্বশুরমশাইকে চেনেন না মিঃ। আমি চিনি৷ উনি লিখতে ভালোবাসতেন। দুনিয়াসুদ্ধ লোককে চিঠি লিখে পাঠাতেন। আর সেই মানুষটা কিনা নিজেকে শেষ করার আগে এক লাইনও লিখিবে না!”
অনেকটা পরে ডোটির কথার স্রোতের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেলাম। ততক্ষণে অবশ্য ফেটারউল্ফের আশকথা পাশকথার সবটাই জানা হয়ে গেছে।
বাড়ি ফিরে জনি ফেরিম্যাটোকে ফোনে পেলাম না। তার বদলে একটা খসখসে গলা যান্ত্রিক ভাবে আমায় জানালো জনি এখন ব্যস্ত। “গোলমালের সূত্রপাত অনেক গভীরে।“ আমি যেন কোমায় শায়িত ম্যাগিকে শুনিয়েই কথা গুলো বললাম।
হসপিটালের বিছানায় ম্যাগি একটা মরা পাইথনের মতো নিস্পন্দ হয়ে শুয়ে রয়েছে। শরীরের এখান সেখান থেকে বেরিয়ে রয়েছে বিভিন্ন নল। একটা নিশ্বাস ফেলে আমার ব্রিফকেসটা বিছানার পাশেই ঠক করে রাখলাম। পুরানো স্মৃতি মনে পড়লো। একটা সময় এইরকম ভুলভাল কাজের জন্য কতো বকুনিই না খেয়েছি ম্যাগির কাছ থেকে। তারপর একা একাই কথা বলা শুরু করলাম ম্যাগির সঙ্গে। রোজকার মতো।
“বুঝলে ওই দুই বুড়োবুড়ি সেদিন ছাদে গিয়েছিলো। একদমই একা একা। ওদের মধ্যে নাকি খুব একচোট প্রেমপীরিতের পর্ব চলছিলো৷ ওই আশ্চর্য ওষুধ রাসায়নিক ভাবে প্রেমের অনুভূতি তৈরি করতে পারে!”
“জনি নিশ্চয়ই কিছু গোপন তথ্য জানে, বুঝলে গিন্নি৷ নয়তো ওর মুখ এভাবে বন্ধ করা হতো না। আমার কাছে ময়নাতদন্তের একটা রিপোর্ট হাতে এসেছে। আটজনের সবাই নাকি নিজেকে আহত করতে চেয়েছিলো। সবটাই গোলমেলে।“
হসপিটাল করিডোরে হঠাৎ একটা আর্তচিৎকার শোনা গেলো। আমি এবার খুব নরম গলায় উচ্চারণ করলাম, “ এখানে আসতে আমার একটুও ইচ্ছা করে না ম্যাগি।“
পরের মুহূর্তেই ইচ্ছা হলো দেওয়ালে মাথা ঠুকতে। এ আমি কি বললাম! ম্যাগি, আমার প্রথম আর শেষ ভালোবাসা। আমাদের বিয়ে, আমাদের বাবা-মা হওয়া, আমাদের সুখের মুহূর্ত গুলো…
আট বছর আগের একটা রাতের কথা। বাকির ফোন –
“জিন, জিন, আমি পেরেছি জিন, আমি শেষ অবধি করতে পেরেছি।“
“কি করতে পেরেছিস?”
“কিন্তু না – ফাদার হেইলি – “
“বাকি – কাল সকাল আটটায় আমার শিফট আছে। শুভরাত্রি।“
ম্যাগির গলা শোনা গেল – “এত রাত্রে কে ফোন করছে জিন? রেখে দাও।“
গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো লিবি জেগে উঠেছিল।
“ফাদার হেইলি কে বলে দিস, আমি আমি – কোনদিন একজন ভালো পাদ্রী হতে পারলাম না। আমি আমি – ঈশ্বরকে স্পর্শ করতে চাই জিন, কিন্তু পারলাম না।“
আমি তখনই যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলাম। পনেরো সেকেন্ডের মধ্যে রাতপোষাকে জুতো, বন্দুক নিয়ে গাড়ি চালিয়ে চলে গেছিলাম পাদ্রিদের স্কুলটাতে। ডোরবেলের ওপর মুহুর্মুহু আক্রমণে দরজা খুলে যাওয়ার পর ঝড়ের মতো ঢুকে পড়ে খুঁজেছিলাম বাকি-কে। সে ঘরে নেই। প্রার্থনা সভা, বাগান তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম আমি। ফাদার হেইলি আমাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে যাচ্ছিলেন উত্তেজিত ভাবে। আমি চিৎকার করে উঠেছিলাম, “শুয়রের বাচ্চা – ছেলেটাকে মেরে ফেলেও শান্তি হয়নি? ভগবান ভগবান করে দিয়েছিস তো ছেলেটার মনটার বারোটা বাজিয়ে।“
বাকিকে পাওয়া গেল আমাদের বাড়ির পাশেই স্কুলটাতে – সেই লেডি অফ পারপেচুয়াল সরো- তেই। স্কুলের প্রার্থনা সভার একটা কাঁচ ভেঙে ফেলেছিল বাকি। সেটা ভেঙে ঢুকে পড়েছিল প্রার্থনসভায়। নতজানু হয়ে বসেছিল জিসাসের মূর্তির পাদদেশে। ভাগ্য ভালো ছিল বলতে হবে যে রাতের পুলিশ পাহারা জবরদস্ত ছিল, নাহলে বাকিকে বাঁচানো মুশকিল হত। সেন্ট ভিনসেন্ট থেকে বাকির পাকস্থলী ওয়াশ করিয়ে যখন বাড়ি ফিরলাম তখন ম্যাগি বিছানায় ওপাশ ফিরে শোওয়া।
এদিন ম্যাগি আর লিবিকে জড়িয়ে শপথ নিয়েছিলাম – বাকির সঙ্গে আর নয়। ওর নাটক অনেক সয়েছি, আর নয়!
আজ ম্যাগির হাসপাতালের বিছানার পাশে প্রায় নতজানু হয়ে বসলাম, “না সোনা – আমি যে কি বলছি তার ঠিক নেই। আমি তোমার কাছে আসব, বার বার আসব। তোমার জীবনের শেষ ক্ষণটিতেও তোমার সঙ্গে থাকব আমি।“
চতুর্দিক নিস্তব্ধ। ম্যাগির ক্যাথিটারে ফোঁটা ফোঁটা তরল জমা হওয়ার টুপটাপ আওয়াজ ছাড়া।
এমন সময় সুসান তার নার্সের ইউনিফর্ম পরে কেবিনে ঢুকলো। আমার দিকে একটুকরো হাসি ছুঁড়ে দিয়ে নিজের কাজ শুরু করলো। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই আমার এলোমেলো মাথায় ইন্ট্যুইশান পরিস্কারভাবে কাজ করতে শুরু করলো। বাকি আমায় আর ফোন করে নি, কারণ বাকি ভালো করেই জানে কি ঘটেছিল। ও জাস্ট আমায় জড়িয়ে দিয়ে নিজে ভেগে গেলো। বরাবরের মতো। প্রচন্ড রাগে আমার রগের শিরা দুটো দপদপ করছে। আমি নিজের মনেই বলে উঠলাম-
“** মারাও!”
“কি?!?!” সুজান বড়ো বড়ো চোখ করে ফিরে তাকালো।
“সরি! তোমায় নয়, তোমায় নয়…”
আমি ফুঁসতে ফুঁসতে হসপিটাল থেকে বাইরে এলাম। বেশ বুঝতে পারলাম রাগটা চড়ছে, শিরায় শিরায় ফুঁসছে আমার গরম রক্ত।
কামিনিওর তার কাজ আরম্ভ করে দিল।
(৭)
স্কুলের বাইরে বাস্কেটবল কোর্টে কয়েকটা ছেলে জড়ো হয়েছে। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। এমন সময় একটা মার্সিডিজ এসে থামলো। পিছনের সিট নেমে এলো জেফ কনর। মাথায় বাঁধা নীল ব্যান্ডানার নীচে ভারি ব্যান্ডেজ। গায়ে লেদারের জ্যাকেট। এই বৃষ্টিতেও চামড়ার জ্যাকেট! অদ্ভুত!
জেফ এক মুহূর্তের জন্য আমার চোখের দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। স্কুলের ছেলেরা কোর্টে জড় হয়েছে এসে। কিছু একটা গন্ডগোল যে হচ্ছে, সেটা বলে দিতে হয়না।
আমার আর কি! আমি গাড়ির দরজা খুলে ড্রাইভার সিটে বসলাম।
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যেই দেখলাম মিস কেলি চিৎকার করতে করতে প্রায় দৌড়ে আসছেন, “জেফ জেফ”।
মিস কেলির ধারণাতেই নেই, জেফ-কে তার পেয়ারের লোকজনদের সামনে এভাবে ডাকাডাকি করা উচিত নয়। জেফ ঠান্ডা চোখে মিস কেলির দিকে তাকিয়ে রইল। তার মুখের স্বাভাবিক দুষ্টু মিষ্টি ভাব উধাও – যেন ওটা মিস কেলি নয়, কোন পুলিশ তার দিকে ধাওয়া করে আসছে।
“জেফ, তোমার সঙ্গে এক মিনিট দরকার আছে।“
জেফের মুখ ভাবলেশহীন।
“জেফ – ঈশ্বরের দোহাই, তোমাকে আমি এমনি এমনি ডাকছি না। তোমার ভাই-এর ব্যাপারে কথা বলার আছে।“
বুঝতে পারলাম, মিস কেলি এখন পুরো অল-আউট খেলছেন। জেফ-এর পরিবারকে টেনে এনে তাকে নিয়ন্ত্রণের মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্ত তাতে কাজ হল না।
“আমি এখন ব্যস্ত আছি মিস।“
মিস কেলি মাথা নাড়লেন, “আচ্ছা, তাহলে কাল?”
“আমার হবে না। কাজ আছে।“
“বেশ, তাহলে অন্য কোনদিন। ঠিক আছে?” বলে মিস কেলি মুখ ঘুরিয়ে অফিসে ঢুকে গেলেন। গোয়ার্তুমি করলে যে ফল হবে না, সেটা দেখলাম উনি ভালোই বুঝেছেন। মিস কেলির মুখটা দেখতে পেলাম না তবে তাঁর ফেরার পথের পিছনে বাকি ছেলেদের চাপা বিদ্রুপের হাসি দেখে তাঁর মনের ভাব কিছুটা আন্দাজ করতে পারলাম। তাও মনে হল, জেনি কেলি এত সহজে ছাড়বার পাত্রী নন।
গাড়ি চালাতে চালাতে ভাবলাম, বাস্কেটবল কোর্টে যে কি হচ্ছিল, সেটা আমি মিস কেলির থেকে অনেক আগেই বুঝেছি। এটা বুঝেছি যে, যদি স্কুলের কম্পাউন্ডে এসব বন্ধ করা হয়, তাহলে স্কুলের বাইরে কোথাও হবে। এ জিনিস থামানো যাবে না – সে জেনি কেলির মতো আদর্শবান লোকজন যতই চেষ্টা করুক না কেন।
তবে আজ মিস কেলি আমাকে না দেখলেও, আমি ওঁকে লক্ষ্য করেছি। লক্ষ্য করেছি ছোট ছোট মুক্তো দিয়ে গাঁথা ওঁর কানের দুলগুলো, আর লক্ষ্য করেছি বৃষ্টিস্নাত অবস্থায় ওঁর পরণের কাপড় শরীরের ভাঁজে কেমন বিপজ্জনক ভাবে লেপটে ছিল…
পরের সপ্তাহটা আমি পুরো নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখলাম। ক্র্যাডেল থেকে নামিয়ে রাখলাম ফোন। লিবিকে নোট ছেড়ে দিলাম যে তার যদি কোন দরকার হয়, তাহলে আমাকে যেন চিঠি লেগে কেননা আমার বাড়ির টেলিফোন লাইনটা গড়বড় করছে। আমি সোজা বাড়ি থেকে স্কুলে যেতাম– ক্লাস করতাম – এবং নিয়ম করে আটটা ক্লাস নেওয়ার পর সোজা বাড়ি আসতাম। এর মধ্যে একটা দিনও আমি হসপিটাল যাইনি। শুধু মিস কেলিকে একদিন দেখলাম, বাসস্ট্যান্ডে। একটা সস্তা জামাপরা, কালো একটা বাচ্চা ছেলের হাত মুঠোয় ধরে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিল। আমি অবশ্য দাঁড়াইনি।
কিন্তু কতদিনই বা আর এভাবে পালিয়ে বেড়াতাম?
সেদিন শুক্রবারে এটিএম থেকে বেরোনোর পর-পরই লোকটাকে দেখতে পেলাম। একে আগেও কয়েকদিন দেখেছি। যেদিন স্যুটটা ড্রাইক্লিনিং করতে দিয়ে এলাম, সেদিনও একে লক্ষ্য করেছি। ব্যাপারটা অস্বস্তিকর। এসব আগে হলেও মেনে নিতাম, কিন্তু এখন মোটেই ভালো লাগছে না। যাকে ক’বছর আগে জেলের ঘানি টানিয়েছি, সে যদি বাইরে এসে বোঝাপড়া করতে চায়, তাহলে সে অভিজ্ঞতা মোটেই সুখকর হয়না।
আমি হাঁটুর জ্বালায় বেশি জোরে হাঁটতে পারি না। লেংচে লেংচে মুলকি-এর বার কাম রেস্তোরা-তে ঢুকে পড়লাম। বার আর রেস্তোরার খালি চেয়ারের সারির মাঝ বরাবর একটা লম্বা করিডোর চলে গেছে। করিডোরের বাঁদিকে একটা সরু জায়গা, যেটা সাধারণতঃ বাইরের আবহাওয়া ভালো থাকলে খুলে রাখা হয়। সেই সরু গলিটার মুখেই লেডিস এবং জেন্স টয়লেট। একটা ডানদিকে আর একটা বাঁদিকে। আর তাদের সামনেই কিছুটা এগিয়ে একটা পে-ফোন আর সিগারেট মেশিন।
আমি ব্রায়ান মুলকি-কে চোখের ঈশারা করে করিডোর পেরিয়ে আচমকা বাঁয়ে ঘুরে গেলাম। পেছনের লোকটা আসতে এখনও একটু দেরী আছে। আমি লেডিস টয়লেটে ঢুকে দরজাটা একটু ফাঁক করে রাখলাম। ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতে হবে, আপাতত টয়লেটে কোন মহিলার উপস্থিতি নেই। লোকটা দেখলাম খুব স্বাভাবিকভাবেই জেন্টস টয়লেটের দিকে মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে পেছন করে আছে। আমি বেরিয়েই ব্যাটাকে কায়দা করে জাপটে ধরলাম।
লোকটা আমার মতো ষন্ডা চেহারার নয় মোটেই। গড়পড়তা উচ্চতা ও চেহারা। আমার লৌহ-আলিঙ্গনে হাঁকপাঁক করছিল। জ্যাকেটের ওপর দিয়ে ওর কোমরে রাখা আগ্নেয়াস্ত্রটাকে বেশ অনুভব করতে পারলাম।
“মিঃ সনিসি – প্লিজ, ছাড়ুন, আমি পুলিশ।“
ছেড়ে দিলাম – লোকটা চট করে পুলিশের ব্যাজটা বের করে আমার দিকে ঘুরে তাকাল। চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছে। গজ গজ করতে করতে মৃদুস্বরে বলল, “একটা কথা ছিল আপনার সঙ্গে। তবে এখানে নয় – এসব ইনফর্মারদের আড্ডাখানা। সব ভুলে গেছেন নাকি? ২৪৮, ওয়েস্ট সেভেন্টিয়েথ – আট নম্বর অ্যাপার্টমেন্টে দেখা করুন। আর দয়া করে নিজের বাড়ির ফোনটা সারান – যত্তসব ফালতু আপদ!”
বারে বসে একটা বিয়ার খেতে খেতে ব্যাপারটা নিয়ে আমি একটু ভাবলাম। বাড়িতে ফেরার ঘণ্টাখানেক পর, দরজার ঘন্টিটা ক্রমাগত বাজতে শুরু করল। আমি শান্ত হয়ে বসে রইলাম। প্রায় দশ মিনিট ধরে বাজানোর পর, আগন্তুক বোধহয় হাল ছেড়ে দিল।
সেই রাত্রে আমি একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম, ম্যাগিকে কেউ যেন গোপনে নজরে রাখছে, ওকে হত্যা করবে বলে। টাইম স্কোয়ারের গলিঘুঁজির থেকে কেউ ওর দিকে বিষাক্ত তির ছুঁড়ে মারছে। হঠাৎ করেই দেখতে পেলাম – ওই গুপ্তঘাতকটা আমি নিজে।
(৮)
শনিবার বিকেল সাড়ে তিনটে নাগাদ আমার নামে একটা খাম এল। বেশ মোটা সোটা। খামে শুধু আমার নাম ছাড়া আর কিস্যু লেখা নেই। খুলে দেখি ওতে গিয়া কোমো, ডেলা ফ্রান্সেসকা আর লিডিয়া স্মিথের মৃত্যুর পুরো রিপোর্টের একটা কপি আর মৃতদেহের ময়নাতদন্তের আগে ক্রাইম সিনের তোলা ছবি রাখা আছে।
আশ্বস্ত হলাম, সাত বছরের সখ্যতা এত সহজে মুছে যাওয়ার নয়, তাতে যতই লাল-ফিতের ফাঁসের গেরো পড়ুক না কেন। ছবিগুলো ভালো করে দেখলাম। মিসেস স্মিথ এর দেহটা আটতলার ওপর থেকে ফুটপাতে প্রায় থেঁতলানো অবস্থায় পড়ে রয়েছে, মুখ নীচের দিকে। ডেলা ফ্রান্সেস্কার দেহটা পরিপাটি করা বিছানার পাশে মেঝেতে শোয়ানো। মুখের ছবিটা খুব স্পষ্ট না হলেও, ফর্সা হাতে গুটি গুটি লাল দাগ দেখেই বেশ বোঝা যাচ্ছে। সেই হাতদুটো ভদ্রলোকের বুকে আমূল বেঁধা ছুরির বাঁটটাকে নিবিড়ভাবে আলিঙ্গন করে রেখেছে। যদি চারপাশে রক্ত বেশি নেই। সেটা থাকার সম্ভাবনাও কম, যদি না কেউ ছুরিটাকে টেনে বের করে – তাহলে ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরবে না।
রিপোর্টে নতুন কিছু দেখতে পেলাম না। রিপোর্ট আর ফটো পরিপাটি করে গুছিয়ে আবার খামে পুরে আমার ড্রয়ারে তুলে রাখলাম। বাকিটা পুরো ঝোলালো – জনি না থাকলে আমি বাকির কনস্পিরেসি থিয়োরী বিশ্বাস করে পুরো ভুল পথে এগোচ্ছিলাম। যেমনটা পুলিশ বলেছে, যেমনটা কেলভিন ফার্মা দাবী করেছে, এগুলো দ্বিধাহীনভাবেই সুইসাইড কেস। বাকির উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন ড্রাগ এদের জরাগ্রস্ত মানসিকতাকে একদম জড় অবস্থাতে নিয়ে গেছে, আর এগুলো তারই ফলশ্রুতি। বাকি আবিষ্কারের উত্তেজনায় স্বাভাবিক কারণেই সেটা মেনে নিতে পারেনি। আশায় মরে চাষা – আমি জানি কেন বাকি এরকম করছে।
কারণ ও আর টমি দুজনেই এই ড্রাগটা নিয়েছে।
বাকি যখন আমাকে বলেছিল যে “আমি এখন অতীত ভুলে এগিয়ে গেছি” তখন আমি আন্দাজ করেছিলাম যে বাকি হয়তো ঠিকানা বা প্রেমিক বদলানোর কথা বলছে – যেমন সে নিজেকে এক ভক্তিগদগদ পাদ্রীর থেকে বিজ্ঞানের একনিষ্ঠ সেবকে বদলে ফেলেছিল। কিন্তু সে যে এই কালান্তক ড্রাগটার ওপর জীবনপন করে এতটা এগিয়ে গেছে সেটা বুঝতে পারিনি। বাকি হয়তো নিজের জীবনের ঝুঁকিটা বুঝতে চাইছে না বা পারছে না। হয়তো টমি আর সে দুজনে এই রাসায়নিক ভালোবাসায় এতটাই বুঁদ হয়ে আছে, তারা হয়তো ভয়ানক বিপদটাকে বিপদ হিসাবে মেনে নিতেই অপারগ!!
তড়িঘড়ি বাকি-কে ফোন লাগালাম। বেশ কয়েকবার রিং হয়ে গেলেও কেউ তুলল না। উফফ – কি যে করে না ছেলেটা! আমার ফোনটা ওর ভয়েস মেলে ঢুকে যেতেই আমি রেখে দিলাম। দুম করে মাথা গরম হয়ে গেল –নিষ্ফল আক্রোশে ঘরের দেওয়ালে পরপর কয়েকটা ঘুষি মারলাম। মাথাটা একটু ঠান্ডা হলে বাকির ফোনে আবার ডায়াল করলাম।
ফোনটা আবার ভয়েস মেলে ঢুকতেই আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, “বাকি – আমি জিন। মেসেজটা পেলে এক্ষুণি ফোন কর – এক্ষুণি। আমার জানা দরকার তুই ঠিক আছিস কিনা।“
যে আমি গত একসপ্তাহ ওর কোন খবর নিইনি – কোন মুখে ওকে ফোন করতে বলি?
“যদি তুই আমাকে আজ রাত ন’টার মধ্যে ফোন না করিস, তাহলে… ” তাহলে কি জিন? তের বছর আগের এরকমই এক রাতের কথা মনে পড়ে গেল। ম্যাগি আমার পেছনে চিৎকার করে কাঁদছে আর অভিশাপ দিচ্ছে আর আমি, রাতপোষাকে মাঝরাতে বাড়ি থেকে উন্মত্তের মতো বেরিয়ে যাচ্ছি।
নাঃ, ও জিনিস আর আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
“যদি তুই আমাকে রাত ন’টায় ফোন না করিস, তাহলে আমি J-24 এর ব্যাপারে যা জানি সবই পুলিশকে জানাব, আর সেটা তোকে না বলেই। সুতরাং ভালো চাইলে ফোন কর।“
সাধারণত এই সময়টাতে আমি হাসপাতালে যাই। কিন্তু আজ গেলাম না। বাড়িতে বসে বসে ক্লাস সেভেন এইচ এর অংকের খাতা দেখতে লাগলাম। এক ঘণ্টায় মাত্র তিনটে খাতা দেখে বুঝতে পারলাম আজ আমার মনোযোগ অন্যদিকে। যখনই চোখ তুলে রঙচটা দেওয়ালের দিকে দৃষ্টি যাচ্ছিল, যেন দেখছিলাম সেখানে বাকি দাঁড়িয়ে রয়েছে – যেন দেখলাম ডেলা ফ্রান্সেসকা আর লিডিয়া স্মিথ হাত ধরাধরি করে অস্তগামী সূর্যের দিকে মুখ করে বসে রয়েছেন – আর দেখছিলাম তেরো বছর আগে সেই রাতের জিন সনিসি-কে, যেদিন বাকির পেট পাম্প করে সে বের করছিল অর্ধপাচ্য ঘুমের বড়ির টুকরো!
টুকরো টুকরো চলচ্ছবি অতিক্রম করে আমি আবার অঙ্কে মন দিলাম। “সকাল ছ’টায় একটা ট্রেন A যদি X স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু করে সমবেগে সরলরেখায় ৫০ মাইল প্রতি ঘন্টা গতিবেগে চলতে থাকে… ”
একটা বুলেট যদি বন্দুক থেকে নির্গত হয়ে ১৫০০ ফিট প্রতি সেকেন্ডে ছোটে, তাহলে সে একটা মানুষের মস্তিষ্ক ভেদ করে বেরিয়ে যেতে পারে। চট করে কেউ হয়তো বুঝতে পারবে না – কিন্তু মিলিটারি, ডাক্তার, পুলিশ এরা ঠিকই জানবে –
কিছুক্ষণ পর আমি বুঝলাম, আমি আবার দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে রয়েছি। আবার খাতার দিকে কিছুটা জোর করেই নজর ফেরালাম। একি – বেশিরভাগ নামই তো চিনতে পারছি না। এটা – এটা কে? জেমস ডিলিয়ার্ড – ছেলেটা লম্বা না বেঁটে? আর পরেরটা – আমি বুঝলাম এগুলো সবই কেবল এক একটা নাম। নামের আড়ালে তাদের অবয়বজনিত অস্তিত্ব সম্পর্কে আমি ক্রমশ বিস্মৃত হচ্ছি।
হতভম্বভাবে দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে হঠাৎই দেখতে পেলাম, জেনি কেলি – জেফের ভাই-এর হাত মুঠোয় নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সাড়ে সাতটা নাগাদ বাড়িটা অসহ্য হয়ে উঠল। জ্যাকেট-টা গায়ে চাপিয়ে বেরোনর তোড়জোড় শুরু করলাম। বাকি-কে আর একটা ফোন লাগালাম – কোন উত্তর নেই। খোঁড়াতে খোঁড়াতে জুতোটা গলিয়ে সবে দরজাটা খুলতে যাব, অন্ধকারে পায়ে কি একটা ঠেকল।
স্বভাবসিদ্ধ প্রতিবর্ত ক্রিয়ায় চট করে দেওয়ালের সঙ্গে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে স্যুইচবোর্ডের আলোটা জ্বালিয়ে দিলাম। নিচু হয়ে তাকাতেই চোখে পড়ল জিনিসটার দিকে।
আরও একটা খাম। সস্তা টাইপ – ভুল দিক দিয়ে খুললে তেলতেলে পদার্থ বেরিয়ে হাত নোংরা করে দেয়। খামের কিছুটা অংশ ইতিমধ্যেই উঠে এসেছে যদিও।
শনিবারে এভাবে দরজার তলায় গোপনে খাম ঢুকিয়ে দিয়ে যাওয়া আশ্চর্যের কিছু না। অ্যাপার্টমেন্ট থেকে লোকজন আসছে যাচ্ছে। তাদেরই কারুর সামনে দিয়ে দেঁতো হাসি হেসে ঢুকে পড়ে, হাতে একটা ফলস চাবির রিং ঝুলিয়ে এসব কাজ যে কেউ করে দিতে পারে।
খামের ওপর নাম ধাম কিছু লেখা নেই। কেবল নিউ ইয়র্ক পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ছাপ মারা। খামটাকে হাতে নিয়ে সবে খুলতে যাব, আচমকা ফোনটা বেজে উঠল।
খপ করে ফোনটা ধরেই চিৎকার করে উঠলাম, “বাকি, কোথায় তুই –“
একটা অপ্রত্যাশিত মেয়েলি কন্ঠস্বর আমাকে কিছুক্ষণের জন্য নির্বাক করে দিল।
“জিন – আমি জেনি কেলি। শোনো তোমার সাহায্য দরকার – ভীষণ দরকার। আমি জেফ কনরের থেকে এইমাত্র একটা ফোন পেয়েছি। বেচারা আমি ছাড়া তো আর কাউকে চেনে না! পুলিশ ব্যারিকেড করে ওকে একটা ড্রাগ হাউসের বাইরে ঘিরে ফেলেছে আর মাইকে ওর নাম ধরে চিৎকার করছে, ওকে বেরিয়ে আসতে বলছে। জিন, জেফের সঙ্গে ওর ছোট ভাই ডেরেল-ও আছে। ওরা ভীষণ আতংকে আছে জিন। জেফ সাড়া না দিলে পুলিশ এখুনি রাউন্ড রাউন্ড গুলি চালাতে শুরু করবে – ওহ জিন, প্লিজ প্লিজ যাও। তোমার বাড়ি থেকে চারটে গলি পরেই – সেইজন্যই বিশেষ করে তোমাকে ফোন করলাম। তুমি তো এসব ভালো বোঝো – প্লিজ যাও।“
দম নেওয়ার জন্য মিস কেলি থামতেই আমি জিজ্ঞেস করলাম, “ঠিকানাটা কি?”
ঠিকানাটা বলার পরেই আমি মিস কেলির মুখের ওপরই ফোনটা কেটে দিলাম। ফালতু উৎপাত!! – যদি এই মহিলাকে এখন সামনে পেতাম, হয়তো আমার হাতই উঠে যেত ওঁর ওপরে।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে তিনটে গলি লেংচে লেংচে পেরোলাম। চার নম্বরের সামনের আসার সময় বুঝলাম খামটা এখনও হাতে ধরে রেখেছি। ওটা ভাঁজ করে জ্যাকেটের পকেটে চালান করে দিলাম আপাতত।
(৯)
ঠিকানাটা খুঁজে পেতে বেশি সময় লাগল না। দুটো পুলিশের গাড়ি রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সাইরেনের তীক্ষ্ণ শব্দে কান পাতা দায়। একটা একুশ বাইশ বছরের মেয়ে চিৎকার করছে আর লাফাচ্ছে, “আমার বাচ্চাটাকে মেরে ফেলবে। তোমরা কিছু করছ না কেন? ওই শয়তান ছেলেটার কাছে একটা বন্দুক আছে। প্লিজ ওকে তোমরা বাঁচাও।“ একটা বছর উনিশের তরুণ হাবিলদার মেয়েটাকে সামলাতে গিয়ে নাকানিচোবানি খাচ্ছে প্রায়। মেয়েটার জামাটা ছেঁড়া এবং রক্তাক্ত। ধস্তাধস্তির সময়ে মেয়েটা আচমকা সেই তরুণ হাবিলদারের হাতে সজোরে আঘাত করল। হাবিলদার চিৎকার করতেই বেগতিক দেখে আরও একজন অফিসার দৌড়ে এলেন পরিস্থিতি সামাল দিতে।
অন্য একজন অফিসারের হাতে মাইক – তিনি সেটা সামনের বিল্ডিং এর দিকে তাক করে চিৎকার করছেন। আশেপাশের বিল্ডিং এর লোক রাস্তায় জমা হয়ে গেছে – বিনাপয়সায় রগড় দেখতে। আরও এক তরুণ অফিসার একা এইসব আমোদপ্রিয় জনগণ-কে সামলাতে ব্যস্ত – যদিও বিল্ডিঙের দিকে যাওয়ার জন্য দর্শকদের কারো সেরকম আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না।
আমি জ্যাকেটের আড়াল থেকে আমার ডামি ব্যাজটা বের করলাম। পুলিশে ঢোকার পর আমরা সবাই একটা করে ডামি ব্যাজ বানিয়ে নিই। আসলের থেকে সাইজে একটু হেরফের থাকে, কিন্তু আসলটা সাধারনতঃ ফিল্ডে আমরা কেউই ব্যবহার করি না। ওটা হারিয়ে ফেললে নতুন বানাতে গিয়ে এত ঝক্কি পোহাতে হয় – যে পড়তায় পোষায় না। আমি পুলিশ থেকে স্বেচ্ছাবসর নেওয়ার সময় আসলটা জমা দিলেও, কি ভেবে ডামিটা নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলাম।
মেয়েটাকে ধরে থাকা হাবিলদারটিকে আমি ব্যাজটা বের করে দেখালাম। হয়তো এর জন্য পরে আমাকে মূল্য দিতে হবে, কিন্তু আপাতত এই কাজটা উদ্ধার করা এখন বেশি জরুরি। ব্যাজটা দেখানোর সঙ্গে সঙ্গে পুরানো পুলিশি মেজাজটা ফিরে এল।
“কি হচ্ছেটা কি এখানে? কাজটা কি ঠিক হচ্ছে অফিসার?“ আমি গম্ভীর গলায় বললাম।
মেয়েটা পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি ছেড়ে আমাকে নিয়ে পড়ল, “প্লিজ আমার ছেলেকে বাঁচান। ওর কাছে একটা বন্দুক আছে – আমার বাচ্চাটাকে ও মেরেই ফেলবে অফিসার।“ গোলমাল দেখে মাইক নিয়ে ঘোরা অফিসারটি আমাদের কাছে চলে এলেন।
“কে আপনি?” মাইক হাতে অফিসারটি কড়া গলায় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন।
হাবিলদারটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “লোকটা ওই ভিড়ের মধ্যে থেকে চলে এসেছে স্যার।“ আমি চুপ করে রইলাম। বুঝলাম মেয়েটিকে সামলাতে গিয়ে হাবিলদারটি আসলে ধৈর্য্যের চুড়ান্ত পরীক্ষা দিচ্ছে। তার হাতে বন্দী মেয়েটা এমনভাবে শরীরটা মোচড়াচ্ছিল মুক্তি পাওয়ার জন্য যে হাতকড়া পড়াতে রীতিমত বেগ পেতে হচ্ছিল তরুন হাবিলদারটিকে।
আমি বললাম, “দেখুন, প্রথমত এই মেয়েটি আপাদমস্তক মিথ্যে বলছে। যে বাচ্চাটির নাম বলছে, সে অভিযুক্তের নিজের ছোটভাই। আর একে দেখে কিছুতেই অতবড় একখানা ধাড়ি ছেলের মা বলে মনে হয়না।“
অফিসার সবে বলতে আরম্ভ করেছেন, “আপনি এত নিশ্চিত হচ্ছেন কিভাবে” ঠিক তখনই মেয়েটা একটা চিক্কুর ছাড়ল। প্রচন্ড সেই পৈশাচিক চিৎকারে মনে হল সামনের বিল্ডিঙটাই হয়তো ধ্বসে গেল!! হাবিলদার একটু অন্যমনষ্ক হতেই, মেয়েটা এক হ্যাঁচকা টানে একটা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বিদ্যুতবেগে সেটি আমার মুখ লক্ষ্য করে চালাল। দ্রুত মুখ সরিয়ে না নিলে আমার চোখটা নিশ্চিতভাবেই যেত। কিন্তু সরে গিয়েও শেষ রক্ষা হলনা। মেয়েটার হাতের ধারাল নখ আমার গালে লম্বালম্বি একটা গভীর ক্ষত করে দিল।
হাবিলদার তরুণটির ধৈর্যের বাঁধ এবার ভাঙল। মেয়েটাকে জাপটে ধরে হাতদুটো এতজোরে মুচড়ে দিয়ে হাতকড়া পড়াল যে মেয়েটা কঁকিয়ে উঠল রীতিমত। সোয়েটারটা উঠে যাওয়ায় হাতে কব্জিগুলো দেখতে পেলাম আমি। বেশ কয়েকটা ছুঁচ বেঁধার দাগ।
সর্বনাশ! জেফের তো মারাত্মক বিপদ!
তীক্ষ্ণ সাইরেনের শব্দে আরও একটা পুলিশের গাড়ি আসতে দেখলাম। গাড়ি থেকে একজন বর্ষীয়ান পুলিশ অফিসার নেমে এলেন দেখে আমিও ডামি ব্যাজটা সুড়ুত করে আবার পকেটে ঢুকিয়ে ফেললাম।
বর্ষীয়ান অফিসার কাছে এলে আমি বিনয়ের পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে বললাম, “অফিসার -আমি ওই ছেলেটাকে চিনি। মানে যে ছেলেটি বাচ্চাটাকে নিয়ে আছে, তাকে। আমি ওর শিক্ষক। ও ক্লাস এইটে পড়ে অফিসার। আর বাচ্চাটা ওর নিজের ছোটভাই ড্যারেল। যে মেয়েটিকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে গেলেন, নিশ্চই বুঝেছেন যে সে ওর মা নয়। ব্যাপারটা যে কি হচ্ছে সেটা পরিষ্কার না হলেও, মেয়েটার কথার একবর্নও বিশ্বাসযোগ্য নয়।“
সিনিয়ার অফিসার আমার দিকে কড়া চোখে তাকালেন, “আপনার মুখের আঁচড়টা এলো কি করে শুনি?”
এবার হাবিলদার বলল, “মেয়েটা ওনাকে আঁচড়ে দিয়েছে স্যার। উনি আসলে…”
হাবিলদারের মুখের কথা কেড়ে আমি বলতে থাকি, “আসলে ছেলেটা আমাকে ফোন করেছিল। ভয়ে আতঙ্কে কাঠ হয়ে আছে বেচারি। আপনারা যদি একটু নরম হন, তাহলে ও ঠিকই বেরিয়ে আসবে।“
“আপনি ওর শিক্ষক? বটে? আইডি দেখি।“
ইউনাইটেড টিচার্চ ফেডারেশনের কার্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স থেকে শুরু করে আমার ঠিকুজি চেকিং হল। তারপর শুরু হলো প্রশ্নবাণ –
“ছেলেটার কাছে আগ্নেয়াস্ত্র এল কোথা থেকে? ও কি কোন সমাজবিরোধী দলের সঙ্গে যুক্ত?”
“আমি জানি না – তবে যুক্ত থাকতেও পারে।“
“আপনি কিভাবে জানলেন যে ও এখানে একাই আছে, ওর সাঙ্গপাঙ্গরা নেই?”
“ফোনে তো বলল একাই আছে। তবে সত্যি বলতে কি আপনার এ ধারণা অমূলক নাও হতে পারে।“
“এখানকার ফোন নাম্বারটা বলুন।“
“সেটা আমি কি করে জানব? আমাকে ও এসব কিছু বলেনি।“
“ও কি কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে এখানে এসেছে?”
“বলতে পারব না অফিসার। কিন্তু আমার মনে হয়না সেরকম কোন বদ উদ্দেশ্য ওর আছে বলে।“
সেই বর্ষীয়ান অফিসার আমাকে কিছুক্ষণ জরিপ করলেন, তারপর হাতে মাইক তুলে নিলেন।
“কনর, আমরা জানি তুমি তোমার ভাইয়ের সঙ্গে আছ আর আমরা চাইনা তোমাদের কোন ক্ষতি হোক। ড্যারিয়েলকে রেখে চুপচাপ বেরিয়ে এস। বন্দুক ফেলে সোজা বেরিয়ে আসবে। বেগতিক কিছু করলেই কিন্তু বিপদ আছে।“
আমি গালের ওপর হাত বোলালাম – বিলক্ষণ রক্ত বেরোচ্ছে।
ঘোষকের গলা এখন আরও নরম, “জেফ, তুমি নিশ্চিন্তে বেরিয়ে আসতে পারো। তোমার ভাইকে আমরা সুরক্ষিত জায়গাতেই রেখে আসব, ওর কোন ক্ষতি হবে না। কথা দিচ্ছি। তারপর আমরা আলোচনা করতে পারি তোমার সঙ্গে – কেমন?”
এবার দেখতে পেলাম জেফ বেরিয়ে আসছে। মাথার ওপর হাত তুলে – আতঙ্ক বিস্ফারিত নেত্রে। “প্লিজ গুলি চালাবেন না – প্লিজ!!” স্কুলের মধ্যে সেই নাকউঁচু, রকস্টার, গ্যাংস্টারের মতো ঔদ্ধত্যের জেফ কনর’কে আজ সত্যি সত্যি ক্লাস এইটের একটা বাচ্চা, অসহায় ছেলের মতো দেখতে লাগছে। স্কুলের জেফ আর এই জেফকে মেলানো সত্যিই কষ্টকর।
জেফ বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশের দল দৌড়ে গিয়ে তাকে পেড়ে ফেলল। আর একদল ছুটে গেল বিল্ডিঙের ভেতরে।
এমন সময় আমার পেছনে একটা ট্যাক্সি থামার শব্দ পেলাম এবং দরজা খুলে হুড়মুড় করে যিনি নামলেন – তাঁকে দেখে বেশ অবাকই হলাম। কালো ভেলভেট স্কার্ট এবং লো কাট কালো সাটিনের ব্লাউজ পরিহিতা জেনি কেলি দৃশ্যতই উদ্বিগ্ন।
“জেফ জেফ – তুমি ঠিক আছো তো?”
জেফকে দেখে মনে হল, এদের দুজনকে যদি একা ছেড়ে দেওয়া হত, সে হয়তো এখুনি ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলত। কোনরকমে কান্না চেপে জেফ বলল, “ড্যারেল ওখানে একা আছে… ”
আমি বললাম, “ড্যারেলকে ওরা সুরক্ষিতই রাখবে।“
“তুমি চিন্তা করো না জেফ, ড্যারেলকে আমি তোমার মাসির কাছে ঠিকই পৌঁছে দেব।“ মিস কেলি পরম মমতায় বললেন।
তাকিয়ে দেখলাম, ট্যাক্সি থেকে একজন পুরুষ নেমে এসে ভাড়া মিটিয়ে দিলেন। একজন তরুণ হাবিলদার জেনি কেলির কাটা ব্লাউজের দিকে তাকিয়ে ছিল। ভদ্রলোক সেইদিকে চেয়ে বড় বড় চোখ করে ঘোরাতে লাগলেন – যেন চোখ দিয়েই পারলে হাবিলদারকে দুটো থাবড়া লাগিয়ে দেবেন।
জেফকে নিয়ে পুলিশের ভ্যান চলে যাওয়ার পর জেনি আমার দিকে তাকাল। “ইস, তোমার গালটা কতটা কেটে গেছে জিন। জেফকে কোথায় নিয়ে গেল বলত? তুমি কি যাচ্ছ ওদের সঙ্গে?”
“হুম – যেতে তো হবেই। কারণ আমি বলেছি যে ও আমাকে ফোন করেছিল।“
মিস কেলি আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। এরকম হাসি ওকে হাসতে দেখিনি আমি – অন্তত আমার দিকে তাকিয়ে তো নয়ই।
“জেফ কে কে ফাঁসাল জেনি?”
“ফাঁসাল? মানে?”
“একটা মেয়ে এখানে ক্রমাগত চিৎকার করছিল যে জেফ নাকি তার বাচ্চাকে আটকে রেখেছে এবং মেরে ফেলার ধমকি দিচ্ছে। কেউ বা কারা চেয়েছিল যে পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি চালাক। যদি জেফ মরত, তাহলে পুরো পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে তার দায় নিতে হত। যদি ও মারা নাও যেত – এমন আতঙ্কিত হয়ে পড়ত যে বাকি জীবনটা জেফ ওদের কেনা গোলাম হয়ে থাকত। কে এটা জেনি? যারা সেই নেবারহুড সেফটি প্রোগ্রাম চালু করেছিল, এরা কি তারা?”
“আমি বলতে পারব না জিন। জেফ কিন্তু – মানে ওর সঙ্গে কিছু সম্পর্ক তো…”
কথার মাঝেই জেনির হুমদো প্রেমিকপ্রবর বাধা দিলেন। তিনি আমার দিকে তাকিয়েও চোখ ঘোরাচ্ছেন দেখে জেনি আতান্তরে পরে আলাপ করিয়ে দিল, “জিন, এঁর নাম পল স্নাইডার, আর পল – ইনি হলেন জিন সনিসি। দেখো, পল – আজ আমাকে যেতে দাও। আমাকে জিনের সঙ্গে পুলিশ থানায় যেতে হবে, যেখান ওরা জেফকে ধরে রেখেছে।“
“মানে?” পল যারপরনাই অবাক হল, “অনুষ্ঠানটার জন্য আমাদের টিকিট কাটা আছে ডিয়ার, তোমার এখন কোত্থাও যাওয়া চলবে না, লাভ।“
পরমুহূর্তেই জেনি এমনভাবে পলের দিকে তাকাল, আমি বুঝে গেলাম – জেনির ব্লাউজের ফাঁকে আর কেউ তাকাক বা না তাকাক – পল স্নাইডার সে সুযোগ লাভে আজ থেকেই বঞ্চিত হল।
আমি বললাম, “আপনাকে থানা অবধি লিফট দিচ্ছি জেনি। আসলে, প্রথমে আমাকে দিয়েই ওরা শুরু করবে। তাছাড়া, এটা মিটিয়ে আমার একটা খুব দরকারী কাজ আছে।“ বাকির ব্যাপারটা মাথায় আসতেই কেমন যেন একটা অস্বস্তি শুরু হল।
জেনি হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “তোমার স্ত্রী কেমন আছেন? অবস্থা কি আরও খারাপ?”
আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “ম্যাগির অবস্থা এর থেকে খারাপ আর কি হবে? তবে ভালো যে হবে না সেটা নিশ্চিত।”
মিস কেলি আমার অনেকটা কাছে ঘেঁষে এল – এতটাই যে আমি ওর গায়ের পারফিউমের গন্ধটা অবধি পাচ্ছিলাম। হাওয়াতে মিস কেলির স্কার্ট উড়ে আমার পায়ে জড়িয়ে যেতে লাগল।
“জিন…” জেনি কিছু বলার আগেই আমি ওকে থামিয়ে দিলাম। নাঃ, আর বেশি বাড়তে দেওয়া যায় না।
“আপনি ছ’মাসের বেশি স্কুলে টিঁকতে পারবেন না মিস কেলি। আমি বলে দিলাম লিখে নিন। আপনি যদি সব ব্যাপারে এত বাড়াবাড়ি রকমভাবে ইনভলভ হতে থাকেন, তাহলে এখানে আপনার পাতা কাটতে আর বেশিদিন নেই।“ আমি কাটাকাটা ভাবে বললাম।
“ঠিক আছে – টিঁকব না। তবে ভবিষ্যতে আপনি এভাবে আমার সঙ্গে আর কোনদিন কথা বলবেন না।“ জেনি স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিল।
কত সহজেই না আপনি – তুমি আর তুমি – আপনি তে বদলে যায়।
ততক্ষণে বাড়ির ভিতর থেকে ড্যারেল সমেত বাকি পুলিশ অফিসাররা বেরিয়ে এসেছেন। একজন অফিসার আমার দিকে এগিয়ে এলেন – জেফের ব্যাপারে আমি আরও যদি কিছু আলোকপাত করতে পারি, সে বিষয়ে কথা বলতে।
(১০)
মধ্যরাত অতিক্রম করে বাড়ি ঢুকলাম। থানা থেকে বাড়ি ফেরার সময় একবার ডাক্তারখানায় যেতে হল। মুখের ক্ষতটার ব্যান্ডেজ, তুলো মলম দিয়ে সৎকার করার পর, রিপোর্ট লিখিয়ে তবে মুক্তি পেলাম। সেখান থেকে সোজা চলে গেলাম বাকির অ্যাপার্টমেন্টে। সেখানে বাকি নেই। কেলভিন ফার্মার সিকিউরিটি জানালো যে তার ডিউটি আজ বিকেল চারটে থেকে ছিল, কিন্তু তার মধ্যে ডঃ রোমানো আসেননি।
বাকিকে খোঁজার জন্য আমার এ দুটো জায়গাই জানা ছিল। হতচ্ছাড়া টমির পদবিটাও আমার জানা হয়নি যে তার মাধ্যমে বাকির খোঁজ লাগাব।
নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে সবে জ্যাকেটটা খুলেছি, দেখি ফোনের মেশিনটা দপদপ করছে। আমার সাধের ওষুধ কামিনিওর – কাজ শুরু করে দিল। যুক্তিবাদী ইনটিউশনের মাধ্যমে আমি টের পেলাম – কি হয়েছে।
“জিন, আমি টম ফ্লেচার। আপনি আমাকে চেনেন না – আমাদের কোনদিন আলাপও হয়নি এর আগে। আমি ভিন্স রোমানোর মেশিনে J-24 সংক্রান্ত আপনার মেসেজটা পেলাম – যাইহোক, ভিন্স এখন হাসপাতালে, সেন্ট ক্লেয়ার। চারতলায় – ৯৫১ নম্বর ঘরে। ভিন্স বলল খবরটা আপনাকে জানানোর জন্য…আর…”
হয়তো আরও কিছু বলেছিলেন মিঃ ফ্লেচার কিন্তু আমার মাথায় ঢোকেনি। আমি জ্যাকেটটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম সেন্ট ক্লেয়ারের উদ্দেশ্যে। নিজের গাড়িটা নিলাম না। মনের যা অবস্থা – ভয় হল, হয়তো হাত স্টেডি নাও থাকতে পারে।
ফ্রন্ট ডেস্কে বসে থাকা ভদ্রলোক আমার চেনা। ম্যাগির সঙ্গে দেখা করতে এসেছে ভেবে আমায় হাত নেড়ে যেতে দিলেন।
বাকি শুয়ে আছে – ওর শরীরটা একটা সাদা চাদর দিয়ে ঢাকা। না না – আপাতত মুখটা খোলাই আছে। কিন্তু কেন জানিনা চাপা চাদরের নিচেটা আমার আর দেখতে ইচ্ছে হল না। কিভাবে, কেন, কতটা, কখন এতসব প্রশ্নের উত্তর বাকির ক্ষেত্রে না পেলেও চলবে। মৃত্যুর বিষন্ন বীজগণিত যেন আমার কানে কানে বলতে লাগল, একটা ট্রেন যদি ঘণ্টায় ৫০ মাইল বেগে…
বাকির মুখভাব কিন্তু শান্ত – যেন মুখে একটা প্রশান্তির হাসি লেগে রয়েছে সেখানে। মৃত্যুর করাল ছায়া সেই মুখে কিছুমাত্র ছাপ ফেলতে পারেনি।
পরক্ষণেই বুঝলাম আমি ভুল – বাকি ব্যাটা দিব্বি শ্বাস নিচ্ছে। হনুমানটা আবার ফেল করেছে!! অসাধারণ। আমার বুক থেকে পাথরচাপা একটা নিশ্বাস ফোঁস করে বেরিয়ে গেল।
চোখ তুলে দেখলাম টমি দাঁড়িয়ে রয়েছে। চমৎকার নিটোল চেহারা – হ্যান্ডসাম। দেখে তো বাকির থেকে প্রায় বছর পনেরো ছোট বলেই মনে হল। বেচারা কি ওই ড্রাগের ব্যাপারে কিছু জানে? চারজোড়া বুড়োবুড়ি ড্রাগটা নেওয়ার পর আত্মহত্যা করেছিল – টমি এ ব্যাপারে কি একেবারেই অজ্ঞ?
টমি করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিল, “আপনি-ই জিন?”
“হুম”
“টম ফ্লেচার – ভিন্স আর আমি…”
“জানি” বলে আমি বাকির প্রশান্ত মুখের দিকে তাকালাম। আমি কি করে এই ছেলেটিকে বোঝাই যে এই রাসায়নিক ভালোবাসার পরিণতিটা ঠিক কি!!
“টম – আমার তোমাকে কিছু বলার আছে।”
“কি ব্যাপারে?”
“বাকি – মানে ভিন্স – তোমার আর ভিন্সের ব্যাপারে।”
“কি?” টমি অবাক হল।
বাকির ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, “এখানে নয়। ওয়েটিং রুমে যাই চলো।“
ওয়েটিং রুমে এই সময় কেউ নেই। চকচকে ফ্লুরোসেন্ট আলো, কিছু ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ম্যাগাজিনের ডাঁই। দুজনে দুটো প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে মুখোমুখি বসলাম।
“তুমি জানো J-24 এর ব্যাপারে??”
ওর চোখে আশঙ্কার মেঘ জমল, “হ্যাঁ জানি।”
“কি জানো শুনি?” আমি ওকে জেরা করতে চাইছি -কিন্তু কোথায় যেন বাধো বাধো ঠেকছে।
“এই ড্রাগটার ওপরেই তো ভিন্সের কোম্পানি কাজ করছে। তাই না? মানুষে মানুষে একটা বন্ধন তৈরী করতে সাহায্য করে এই ড্রাগ – একদম রাজযোটক বানিয়ে দেয় একে অপরকে।“ খসখসে গলায় টমি বলল।
“আর কি বলেছে তোমাকে?”
“আর কি বলা উচিত ছিল ওর?”
উফ- আর কত দেখব? নিষ্ঠুরতা এমনরূপে মাঝে মাঝে সামনে চলে আসে, যে শত অভিজ্ঞতা দিয়েও তার ছদ্মবেশকে চেনা সম্ভব হয়না। বাঞ্চোত বাকি! তোর মনে এই ছিল? – তোর ভাবসমাধির লোভ আর গেল না, তার জন্য তুই আজকাল মানুষ খুনও করতে পারিস!!
আমি বললাম, “তুমি কি জানো যে সব লোকেদের ওপর এই ড্রাগের ট্রায়াল হয়েছিল – মানে যাদের মধ্যে এই রাসায়নিক বন্ধন তৈরী হয়েছিল, তারা সবাই বয়ষ্ক?”
“না তো।”
“সেই বয়ষ্ক লোকেরা আত্মহত্যা করেছে – প্রত্যেকে। খবরের কাগজে পড়েছ হয়তো।”
“হে ভগবান।“ টমি চেয়ার থেকে উঠে কয়েকপা পায়চারি করে আবার ফিরে এল। ওর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। “ওরা J-24 নেওয়ার পর মারা গেছে? মানে J-24 এর জন্য মারা গেছে?”
আমি মাথা নাড়লাম। টমি পুরো এক মিনিট চুপ থেকে বলল, “বেচারা ভিন্স।”
“বেচারা? তুমি কি এখনও বুঝতে পারছ না হে ছোকরা? তুমি আর ভিন্স দুজনে এই হতচ্ছাড়া ড্রাগটা নিয়েছিলে তোমাদের মানসিক রাসায়নিক বন্ধন না কিসব ছাইপাঁশের জন্য। তোমাদের হপ্তা তিনেকের মজা আপাতত শেষ – ভায়া। বাকির অবস্থা দেখতেই পাচ্ছ। এরপর সেই কেমিকেল তোমার ব্রেনেও লোচা বাঁধাবে আর তুমি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করবে। বাকির মতো সৌভাগ্যবান না হয়ে যদি সফল হয়ে যাও, তাহলেই খেল খতম।“ আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম।
টমি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “ভিন্স কিন্তু আত্মহত্যা করেনি জিন। তোমার যদি এটা ধারণা হয়ে থাকে যে J-24 খেয়ে ভিন্স আত্মহত্যা করতে চেয়েছে, সেটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। আর একটা কথা, আমি কিন্তু ওই ড্রাগটা নিইনি।”
আমি অবাক হয়ে গেলাম।
“ভিন্স এখন কোমায় আছে জিন। তবে ওর ব্যাপারটা অন্য।”
“কি ব্যাপার?” আমি পুরো ঘেঁটে গেছি এতক্ষণে।
“ঈশ্বর – ভগবান – জিসাস।“ টমির খসখসে গলায় একরাশ ঘৃণা ঝরে পড়ল, “ভিন্স ঈশ্বরের সঙ্গে ড্রাগটা নিয়েছিল জিন। অর্থাৎ কোন একটা চার্চে বসে, কি একটা সরোফুল লেডি না কোথায় ঢুকে, উপবাস করে ঈশ্বরের মুর্তির দিকে তাকিয়ে সে এই ড্রাগটা নেয়।“
আমার চোখের সামনে থেকে যেন একটা পর্দা সরে গেল। তার মানে বাকি সেদিন আমার সামনে বসে যার কথা বলে যাচ্ছিল, সে টমি নয়। সে ভগবান – সে তার একমাত্র আরাধ্য, একমাত্র ভালোবাসা! বাকি সারাজীবন ভগবানকেই চেয়ে এসেছে, কামনা করেছে, একাত্ম হতে চেয়েছে। তের বছর ধরে, প্রতিটা ক্ষণে বাকি তাহলে এটাই চেয়ে এসেছিল!!
ফাদার হেইলি কে বলে দিস, আমি তাঁকে স্পর্শ করতে পারলাম না।
তুই কি ভেবেছিস যে কি চরম আনন্দটাই না হবে যেদিন আমি ওঁর সঙ্গে মিলে যেতে পারব, একাকার হয়ে যেতে পারব তাঁর মধ্যে?
কিসের জন্য অপেক্ষা করছিস বাকি? তোর রাজকুমারের?
“হ্যাঁ”
টমি বলে চলল, “যেদিন থেকে ভিন্স এই ছাইপাঁশ ড্রাগটা নিল, সেদিন থেকে আমাকে যেন ভুলেই গেল। সমস্ত কিছুতেই যেন ওর আগ্রহ চলে গেল সেদিনের পর থেকে। কাজে যায়না, এককোণে বসে থেকে আপনমনেই কাঁদে, গান গায়, হাসে। সেই গাঁজাখোর উন্মাদগুলোকে দেখেছেন – অনেকটা সেরকমই!!”
ভগবানের সঙ্গে একাত্মতা – ভাব জিন, এই নশ্বর দুনিয়ার নশ্বর সম্পর্কগুলোর থেকে অনেক পরিণত, মধুর, অনির্বচনীয় সম্পর্ক – তুহুঁ মম শ্যাম হে!
কভু দেখি আমি তুমি – তুমি আমি।
“আমার খুব রাগ ধরত জিন। একদিন এমন খচে গেলাম যে সোজা খেদিয়ে দিলাম বাড়ি থেকে। নিঃশব্দে বিনা প্রতিবাদে বেরিয়ে গেল ভিন্স। দু-তিনদিন পরে খোঁজ চালালাম – কিন্তু কোত্থাও পেলাম না। যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে পুরো। আমিও কেমন একটা হয়ে গেলাম। সেই আজ দুপুরে ওর ফোন এল। হাপুস নয়নে অঝোর ধারায় কাঁদছে ভিন্স। কিন্তু আমি বুঝলাম, ও কান্না আমার জন্য নয়। ওর জীবনে বা ওর মনে আমার কোন অস্তিত্বই নেই।”
টমি চেয়ার ছেড়ে উঠে জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আমার দিকে পেছন করে নিজের মনেই যেন বলতে লাগল, “আমাকে ভিন্স বলল যে আপনাকে ফোন করতে। জানাতে বলল, এই রাসায়নিকের প্রভাব একসময় কেটে যায়। আর তারপর আসে, চরম দুঃখ আর ভয়ানক রাগ। সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার, আবেগের বন্ধন থেকে বেরিয়ে আসার রাগ। কিন্তু ভিন্স সেটা সহ্য করে নিতে পেরেছে, কিন্তু বাকিরা পারবে না। পারে নি। এতটুকু বলেই সে ফোন কেটে দেয়।“ টমি কিছুটা সময় নেয়, “আমার ব্যাপারে একটা শব্দও খরচ করেনি ভিন্স।”
আমি ওকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পেলাম না।
টমি আমার দিকে ঘুরে তাকাল, “ভিন্স এরকমই, তাই না জিন? সব সময়েই সে নিজেকেই প্রাধান্য দেয়, বরাবরই।“
আমি বলতে চাইলাম, না, সে নিজে নয়। সে প্রাধান্য দেয় ঈশ্বরকে। আর সেজন্যই বাকি J-24 এর এফেক্টকে নস্যাৎ করতে পেরেছে। মানবিক বন্ধন অনেক বেশি ভঙ্গুর – যত তাড়াতাড়ি তা গড়ে ওঠে, তার থেকেও দ্রুত তা ভেঙে যায়। কিন্তু উল্টোদিকে ঈশ্বরকে নিয়ে সে চিন্তা নেই। তিনি তোমার সঙ্গে তিন বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন না, খাবার ভাগ করে খান না, সময়ে অসময়ে বাতকম্ম করেন না, রাত শুয়ে নাক ডাকেন না – টাকা পয়সার ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে পাড়া মাথায় করেন না। ঈশ্বর এসবের উর্দ্ধে – অন্তত বাকির জন্য তিনি এতটাই সর্বব্যাপী যে বাকির মনের পুরোটাই তিনি অধিকার করে নিয়েছিলেন। তাই যখন এই রাসায়নিকের প্রভাব মুছে গেল, ঈশ্বর বাকিকে ছেড়ে গেলেন, বাকির সমস্ত সত্ত্বাও যেন তাঁর সঙ্গেই অনন্ত সমাধিতে চলে গেল।
মানবিক ও ঐশ্বরিক সত্ত্বার মিলন – অবাঙমানসগোচর নির্বিকল্প সমাধি।
“ডাক্তার বলেছে এই কোমা বা সমাধি থেকে ও হয়তো আর কখনও বেরিয়ে আসতে পারবে না।“ টমের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল বেচারা বেশ রেগে যাচ্ছে, “আবার আসতেও পারে। তবে আমার জন্য যে আসবে না সেটুকু নিশ্চিত। আমার আর এখানে বিন্দুমাত্র থাকার ইচ্ছে নেই। আমার সঙ্গে ও খুব খারাপ ব্যবহার করেছে – যার জন্য আমি ওকে কখনো মাফ করতে পারব না।”
বুঝলাম লম্বা সম্পর্কের জন্য উপযুক্ত লোক টমি নয়। বাকি যে কি দেখে… আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তুমি কি J-24 নিয়েছিলে কোনদিন?”
“নাহ – আমি কি এতটাই গাধা? যাগগে, আপনার সঙ্গে আলাপ করে ভালো লাগল জিন। আমায় এবার যেতে হবে। আর হ্যাঁ, ভিন্স আর একটা কথা বলতে বলেছিল – যে এটা কিন্তু খুন-ই। আমি কিছু বুঝিনি। তবে এই কথাটা কি খুব দরকারি?”
“হুম – দরকারি।“ আমি বললাম, কিন্তু তোমার জন্য নয় ছোকরা।
(১১)
টমি চলে যাওয়ার পর আমি জ্যাকেটের পকেট থেকে খামটা বের করলাম। স্টিকারটা জ্যাকেটের পকেটে লেগে উঠে এসেছে। খামের ভেতর হাত ঢুকিয়ে বের করে আনলাম কতকগুলো ছবি। লিডিয়া স্মিথ আর ডেলা ফ্রান্সেসকার ক্রাইম সিনের মূল ছবি। টমি ফারমেন্টো যেটা পাঠিয়েছিল, সেই নকল ছবি নয়। রিপোর্টে দেখতে পেলাম ব্রুস ক্যাম্পিনেলার সই রয়েছে। এই অফিসারটিকে না চিনলেও আমি চোখ বুজে বলে দিতে পারি, এর সঙ্গেই সেদিন মুলকি’স এ মুলাকাত হয়েছিল, লেডিস টয়লেটের বাইরে।
ছবিতে দেখা লিডিয়া স্মিথের ছবিটা আগের মতোই – ফুটপাতে পড়ে থাকা। কিন্তু ফ্রান্সেসকার ছবিটা আলাদা। এটা যখন তোলা হয়েছিল, তখনও ব্যাপারটা ধামাচাপা দেওয়ার পদ্ধতি শুরু হয়নি। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ফ্রান্সেসকা একই ভঙ্গিতে শুয়ে রয়েছেন, কিন্তু বিছানার পাশে নন। ছাদের আলসের ধারে। আর তাঁর মুখটা এই ছবিতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
কি নেই সে সেখানে? প্রচন্ড রাগ, হতাশা, দুঃখ বেদনা যেন মূর্ত হয়ে ফুটে রয়েছে সে স্থির মুখচ্ছবিতে।
হতে পারে ফ্যান্সেসকা লিডিয়া স্মিথকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিলেন। রাসায়নিক ভালোবাসা কেটে যাওয়ার পর অসম্ভব ক্রোধ এবং হতাশায় দুজনে ছাদে চিৎকার করে ঝগড়া করেন। তারপর ফ্রান্সেসকা লিডিয়াকে ঠেলে ফেলে দেন। আবার এটাও হতে পারে, অবসাদে লিডিয়া স্মিথ হাতের ছুরিটা ফান্সেসকার বুকে আমূল বসিয়ে দিয়ে তারপর নিজে ছাদ থেকে লাফ মারেন? ভালোবাসা শেষ হলেই কি ঘৃণা আসে? সেটা হয়তো নয়। আমার মনে হয়, এই চুড়ান্ত একাকিত্ব থেকে বেরিয়ে আসা দুটো মানুষের মন যে আনন্দ, যে শান্তি, যে অপার ভালোবাসায় জারিত হচ্ছিল, সেটা আচমকা হারানোর পরই কি এই দ্বিতীয় রিপুর আবির্ভাব ঘটে, তাও এত নৃশংস ভাবে?
বা এটাও হতে পারে, যে বাকি হয়তো ভুল করেছে। এগুলো আত্মহত্যাই। ডেলা ফ্রান্সেসকার মুখে ফুটে ওঠা রাগ হয়তো এই অনির্বচনীয় আনন্দ থেকে আচমকা নির্বাসিত হওয়ার দুঃখ। নিজেকে ওই পরমানন্দ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার যে বেদনা, যে মনবৈকল্য, সেটা থেকে বেরোনর উপায় হিসাবে নিজের জীবন শেষ করে দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। কারণ তিনি হয়তো বুঝেছিলেন, আর যাই হোক না কেন- ওই জীবন তিনি আর ফিরে পাবেন না।
মনে পড়ে গেল, স্যামুয়েল ফেটারউলফের কথা। J-24 নেওয়ার আগে, ভদ্রলোক পরিবারের সব্বাইকে চিঠি দিতেন – সব্বার সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন। মনে পড়ছে জেফ কনরের কথা, মার্সিডিজ এবং বড় বড় টাকা পয়সার লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত হয়েও যে নিজের গরীব ভাইটাকে আঁকড়ে থাকতে চেয়েছে। মনে পড়ছে জেনি কেলির কথা, যে নিজের ভালোবাসার পাত্রকে সরিয়ে, রাতের পর রাত জেগে, ব্যাক্তিগত জীবনকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজের সন্তানের মতো চেষ্টা করে চলেছেন কিভাবে ক্লাসের বাচ্চাগুলোকে ভালোভাবে গড়ে তোলা যায়।
হাসপাতালের লিফট-টা খারাপ থাকায়, সিঁড়ি দিয়ে নেমে ম্যাগির ঘরে এলাম। আবছা আলোতে ম্যাগির শরীরটা যেন শুকনো খড়ের মাড়াই এর মতো পড়ে রয়েছে। ম্যাগির বিছানার পাশেই চেয়ারখানা টেনে বসলাম।
অনেক পুরানো স্মৃতি হুড়মুড়িয়ে মনে পড়ে গেল।
জানলার শার্সিটা নামিয়ে দাও জিন।
আরে, বাইরে পনেরো ডিগ্রি ঠান্ডা -ম্যাগি।
আরে আসল হাওয়া তো বাইরেই। একদম চিলড বিয়ারের মতো ঠান্ডা – আহ। তোমার গাড়ির ভেতরের গন্ধটা শুঁকে দেখেছ কোনোদিন? যেন কারখানার বোটকা গন্ধ! ইসস।
আবার শুরু করলে তো!
তোমার কি মনে হয় জিন? তোমার চাকরির চাপে তুমি না মরলেও, সিগারেট ফুঁকে ফুঁকে তো পাক্কা মরবে।
ফালতু উপদেশ দেওয়া বন্ধ করো ম্যাগি।
ফালতু উপদেশ! সত্যিই তো – নিজের দিকে তাকিয়ে দেখেছি কোনদিন?
যে রাতে বাকি পারপেচুয়াল সরো তে ঝামেলাটা পাকিয়েছিল, সেরাত্রে ফিরে এসে আমি ম্যাগিকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। শপথ করেছিলাম আর কোনদিন এরকম হবে না – বাকি-র পাল্লায় আমি আর পড়ব না। কিন্তু ম্যাগি কেঁদেই যাচ্ছিল – একটানা। আমি আর পারিনি – সেদিন আমার ওপর দিয়ে যা গেছিল, তাতে আর নাটুকেপনা সহ্য করা অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। আমি উঠে গিয়েছিলাম বিছানা থেকে, ম্যাগির পাশ থেকে। সে রাত্রিটা আমি সোফাতে শুয়েই কাটিয়েছিলাম।
এর পরপর তিনরাত্রি আমি ওভাবেই কাটাই যতদিন না আমাদের মধ্যে ব্যাপারটা মিটে গিয়েছিল।
ম্যাগি বলত, “এ বছরটা তোমার ভালো যাবে, দেখে নিও।“ বছরটা মোটেই ভালো যায়নি আমার। স্কুলে সমস্যা হত প্রতিদিন। একজন পুলিশ অফিসার থেকে শিক্ষক হয়ে ওঠাটা সহজ নয়। নিজের পুলিশি সত্ত্বাকে জলাঞ্জলি দিতে হয় পুরোপুরিভাবে। এইসময়ে ম্যাগির সঙ্গে আমার দুরত্ব বেড়েই চলেছিল। আমি বেশি বেশি করে বাড়ির বাইরে থাকা শুরু করলাম সংসারের অশান্তি এড়াতে। আবার আমি যখন ফিরতাম, তখন সে থাকত না। এরপর যখন আমাদের সম্পর্ক জোড়া লাগতে শুরু করল, তখন জানিনা কিভাবে, কেন ম্যাগির সে রাত্রিতে শপিং করার দরকার পড়ল আর…
ম্যাগি সেদিন ঠিক কার জন্য শপিং করতে গেছিল, সেটাও রহস্যময়। কারণ ও আমার জন্য তো কোনদিন অতদামী স্টেক আর শ্যাম্পেন কিনে আনেনি!
সেদিন বাকি বলেছিল, জিন তুই একটা কথা বল। তুই তো ম্যাগিকে ভীষণ ভালোবাসিস। এরকম কোনোদিন হয়নি তোর, যে মনে হয়েছে তুই আর ম্যাগি একাত্ম হয়ে গেছিস! মানে তোর কি কখনও মনে হয়েছে, তুই নিজেই ম্যাগি।
না বাকি – আমার কখনো এরকম মনে হয়নি। আমি আমার মতো, ম্যাগি ম্যাগির মতো। আমরা এত পারফেক্ট ছিলাম না কোনদিনই। আর হয়তো সে কারণেই আমি এখনও বেঁচে রয়েছি। যদি আমি আর ম্যাগি একাত্ম হয়ে যেতাম, ম্যাগির এই অবস্থা সহ্য করা আমার পক্ষে সম্ভব হত না।
আমি হাঁটুতে চাপ দিয়ে উঠে পড়লাম। দরজা দিয়ে বেরোনর আগে, পকেট থেকে কামিনিওরের বোতলটা বের করে ওয়েস্ট বাস্কেটে ফেলে দিলাম। ও আর আমার লাগবে না।
বাইরে এসে একটা পে ফোনের কাছে গিয়ে পকেট থেকে কিছু খুচরো বের করলাম। এতক্ষণে নিশ্চই জেনি কেলি ড্যারেলকে তার মাসির কাছে পৌঁছে দিয়েছে। জেফ কনারের এখন দরকার একজন ভালো উকিল। আমি জানি একদম ঠিক লোকটার হদিশ। ফোনটা তুলে কয়েনটা ফেললাম।
ওপারে রিং হওয়ার আওয়াজ কানে এল।
***
লেখক পরিচিতি: ন্যান্সি ক্রেস জন্ম ১৯৪৮ সালে আমেরিকাতে। ১৯৭৬-এ কল্প-সাহিত্যে হাতেখড়ি আর “বেগারস ইন স্পেন” বড়গল্পের জন্য “হুগো” পুরষ্কার লাভ ১৯৯১ সালে। এ ছাড়াও ২০১৩ এবং ২০১৫ সালে পেয়েছেন “নেবুলা পুরষ্কার”। তাঁর রচনাগুলির মধ্যে জেনেটিক বিজ্ঞান এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব উল্লেখযোগ্য। মূলত তাঁর লেখাগুলিকে সমাজকেন্দ্রিক হার্ড সায়েন্স ফিকশন হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে। অনুবাদ করা লেখাটি গার্ডনার ডজিস এবং শেলা উইলিয়াম সম্পাদিত “আইজাক আসিমভ’স ডিটেকটিভস” থেকে নেওয়া হয়েছে, নাম ফল্ট লাইনস।
Tags: অনুবাদ উপন্যাস, অনুরাধা সামন্ত, চতুর্থ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, জটায়ু, ডিটেকটিভ সায়েন্স ফিকশন, ন্যান্সি ক্রেস, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
চমৎকার অনুবাদ। এমন একটি অত্যুৎকৃষ্ট কাহিনি বাংলায় আমাদের পড়ার সুযোগ দেওয়ার জন্য টিম কল্পবিশ্বকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।