সুরক্ষা চক্রের অন্তরালে
লেখক: দেবদত্তা ব্যানার্জী
শিল্পী: অঙ্কিতা
সকাল থেকে কলকাতার আকাশটা ধূসর চাদরে ঢেকে দিয়েছে প্রকৃতি দেবী। গুমোট গরমটা কাটিয়ে এবার শুরু হল বড় বড় ফোটায় বৃষ্টি। অয়ন একটা বড় কাজে দিল্লী গেছে দু-দিন আগে। পরদিন ফিরবে। দিঠি মুসুরি ডালের খিচুড়ি বসিয়ে দেবে ভাবল। শর্টকাট রান্না, খাওয়ার আগে একটা ডিম ভেজে নিলেই হবে। এক কাপ কড়া লিকার নিয়ে বসতেই অচেনা নম্বর থেকে পর পর চারটে মিসকল চোখে পড়ল, কলার আইডিতে নাম দেখাচ্ছে রিমঝিম। এই নামের কাউকে আপাতত মনেই পড়ছে না দিঠির। সকালে জিমে থাকাকালীন ফোনগুলো এসেছে। ঠিক তক্ষুনি ফোনটায় আবার বেজে উঠল—‘যদি তারে নাই চিনি গো সে কি…’ রবিঠাকুরের গানেই রিংটোন সেট করেছিল দিঠি ক’দিন আগেই। অল্প রিং হতেই কলটা নিয়ে নিল ও। ওপারের গলা শুনলেই মনে হল একটা বাচ্চা মেয়ে, বলল, ‘দিদি আমায় আপনি চিনবেন না। আপনার লেখা পড়ি। সেই সূত্রেই নম্বর পেয়েছি। আমাদের খুব বিপদ দিদি। আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই একবার।’
মেয়েটার উৎকণ্ঠা প্রকাশ পাচ্ছিল ওর কথায়। দিঠি ওকে এগারোটায় আসতে বলে ফোন রাখল। মেয়েটির নাম রিমঝিম গুপ্তা। গড়িয়ায় থাকে বলল।
হাতে এক ঘণ্টা সময় আছে। বৃষ্টির বেগ বেড়েই চলেছে। মেয়েটা কি এই দুর্যোগে আসবে? খুব দরকার থাকলে হয়তো আসবে।
এক ঘণ্টা পর একটা উবের ক্যাব এসে থামল ওদের ফ্ল্যাটের সামনে। কে নামল দেখা গেল না অবশ্য বারান্দা থেকে। ক্যাবটা চলে যাওয়ার চার মিনিট পর দরজার বেলটা সশব্দে বেজে উঠতেই দিঠি উঠে পড়ল।
মেয়েটার বয়স পনেরো-ষোলোর বেশি তো নয়। ও যে খুব উত্তেজিত ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। দিঠি ওকে এক গ্লাস জল দিতেই পুরোটা খেয়ে নিল।
চারদিক তাকিয়ে মেয়েটা বলল, ‘অয়নদা নেই?’
‘না, বাইরে আছে।’ দিঠির উত্তরে মেয়েটা একটু কি দুঃখ পেল মনে হয়।
এবার ও বলল, ‘আমার বাবা ডঃ রমেশ গুপ্তার নাম হয়তো আপনি শুনে থাকবেন। বাবা একজন পরমাণু বিজ্ঞানী। বাবা সরকারের হয়ে একটা খুব গোপন রিসার্চ করছিলেন হিমাচলের এক গ্ৰামে বসে। ব্যাপারটা এতটাই গোপনীয় যে মাত্র দুজন বিশ্বস্ত অনুচর ছিল বাবার সঙ্গে। আমার দিভাই রুমঝুম আর জিজু রাজন পিল্লাই, জিজু বাবার কাছেই ডক্টরেট করেছে আর দিভাইও ওই ইন্সটিটিউট থেকে ডক্টরেট করেছে। বাবার দুই হাত বলা যায়। কিন্তু গত পনেরো দিন আগে একটা বড় গাড়ি দুর্ঘটনায় দিভাই আর জিজু দুজনেই চলে যায় আমাদের ছেড়ে। এতবড় ধাক্কায় বাবা কেমন যেন হয়ে যায়। আমি খবর পেয়ে সে সময় বাবার কাছে হিমাচল গেছিলাম। বাবাদের রিসার্চটার গোপনীয়তার জন্য জিজু ও দিভাইয়ের খবরটাও সেভাবে কোথাও দেখানো হয়নি। তবে পুলিশ তদন্ত করেছিল। কিন্তু সেটার জন্য আমি আসিনি।
আমি কয়েকদিন পর ফিরে আসি। ফেরার দিন বাবা আমায় একটা ছোট দেশলাই বাক্সের মতো বাক্স দিয়ে বলেছিল সাবধানে রাখতে। বাবার কিছু হলে ওই বাক্স দিল্লিতে বাবার বন্ধু আইএএস অফিসার বন্ধন কাকুর হাতে তুলে দিতে। উনি প্রতিরক্ষা বিভাগের আমলা। আমি আট দিন হল কলকাতা এসেছি, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে কোথাও কিছু গণ্ডগোল হচ্ছে। কাল আমার জন্মদিন ছিল। বাবা আমায় প্রতিবছর রাত বারোটায় উইশ করে। এবার এখনও ফোন করেনি। তাছাড়া রোজ বাবা নিয়ম করে আমায় দুবেলা ফোন করত। ইদানীং করছে না আর। আজকাল আমি করলেও ব্যস্ত আছি বলে ফোন কেটে দেয়। প্রথমে আমি ভেবেছিলাম দিভাই আর জিজুর শোকে এমন হয়ে গেছে। কিন্তু যে ক-টা দিন ওখানে ছিলাম বাবাকে এমন লাগেনি। বাবা যথেষ্ট শক্ত ছিল।’
ও চুপ করতেই একটা কোল্ড ড্রিঙ্কসের গ্লাস এগিয়ে দেয় দিঠি।
তারপর বলে, ‘তোমার মা বা আর কেউ…’
‘মা নেই, আমার জন্মের কয়েকদিন পর মা মারা গেছিল। বাবা নিজেই আমাদের দু-বোনকে মানুষ করেছিল। ঠাম্মা ছিল। দু-বছর হল ঠাম্মাও নেই আর।’
মেয়েটা একটু ইতস্তত করে বলে, ‘দেখুন, বুঝিয়ে বলতে হয়তো পারছি না। বাবা বৈজ্ঞানিক হলেও আমাদের ভীষণ ভালোবাসতো। বাবা আমি এখানে ফেরার পরদিনও দুবার ফোন করেছিল। তারপর দুদিন ফোন না করায় আমি ফোন করেছিলাম। ব্যস্ত আছে বলে কেটে দিল। পরদিন আমিই আবার করেছিলাম, দু-চারটে কথা বলেই কেটে দিল।’
‘আমায় কী করতে হবে?’ দিঠি প্রশ্ন করে।
‘আমায় সঙ্গে একবার হিমাচল যেতে হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। বাবা নাকি আবার একটা ছেলে আর মেয়েকে রেখেছে রিসার্চের কাজে। অথচ আমায় ফিরে আসার দিন বাবা বলেছিল কাজটা প্রায় শেষ। বাবা এর মধ্যেই দিল্লি যাবে। কাজ মিটিয়ে কলকাতায় আসবে। আর কাউকে রাখবে না কাজে। অথচ পরশু উমিওর বলল বাবার কাছে দুজন কাজে ঢুকেছে। উমিওর বাবার দারোয়ান। শুনেই ফোন করেছিলাম। কিন্তু বাবা ব্যস্ত আছি বলে ফোন কেটে দিল। আমার বাবা আগে খুব ব্যস্ত থাকলে দিদি বা জিজু ফোন ধরত। পরে বাবা কথা বলত। জীবনে কখনও বাবা ফোন কাটেনি আমার। আর কাল… আমার জন্মদিন এর আগে বাবা কখনও ভোলেনি। পৃথিবীর যেখানেই থাকুক না কেন ফোন এসেছে। এই প্রথমবার…’ টপ টপ করে জল গড়িয়ে পড়ে ওর চোখ দিয়ে।
দিঠি বোঝে ওর দুঃখটা, সদ্য দিদি ও জিজুকে হারিয়েছে মা হারা মেয়েটা। এখন ডিপ্রেশনে ভুগছে। ডঃ গুপ্তাও মেয়ে জামাইকে হারিয়ে একটু অন্য চিন্তায় আছেন হয়তো। মেয়েটার পিঠে হাত রাখে ও। বলে, ‘শক্ত হও। এখন একবার ফোন কর তো বাবাকে। মনে করিয়ে দাও কাল জন্মদিন ছিল।’
কিন্তু নট রিচেবেল। পাওয়া গেল না। মেয়েটার দুশ্চিন্তা কাটানোর জন্য দিঠি বলল, ‘তুমি কী করো? একাই থাকো এখানে?’
‘আমি কেমিস্ট্রি অনার্স সেকেন্ড ইয়ার। দিদি আর জিজু তো কয়েকমাস হল বাবার কাছে গেছিল। বাড়িতে পার্বতী মাসি আছে, যে আমাদের মানুষ করেছে। রাঁধুনি দিদি ড্রাইভার আর দারোয়ান আছে। আমার অসুবিধা হয় না।’
‘তুমি এত বড়!! কলেজে পড়ো!! আমি তো স্কুল গার্ল ভেবেছি। তুমি বাড়ির গাড়িতে আসোনি, উবেরে এসেছিলে…’
‘আমি চাইনি কেউ জানুক আমি কোথায় যাচ্ছি সেটা। ব্যাপারটা গোপনীয় যে।’
‘বাবা যে বাক্সটা দিয়েছিল এনেছ?’
‘না, ওটা শুধু বন্ধন কাকুকেই দিতে বলেছিল বাবা। যদি বাবার কিছু হয়ে যায় তখন।’
‘এই বন্ধন কাকুকে সবটা জানাওনি?’
‘জানিয়েছিলাম, কাকু আজ গেছে বাবার কাছে, তারপর থেকে ফোনে পাচ্ছি না আর।’
দিঠির সঙ্গে আর কিছুক্ষণ গল্প করে মেয়েটি চলে যায়। দিঠির হাতে তেমন কাজ নেই। ও কম্পিউটার খুলে বসে ডঃ রমেশ গুপ্তার খোঁজ করছিল। কোনও সোশ্যাল সাইটে উনি নেই। তবে জানা গেল উনি একজন নামকরা পরমাণু বিজ্ঞানী। সরকারের হয়ে বেশ কিছু কাজ করেছেন। নিজের রিসার্চ নিয়েই থাকেন।
পরদিন অয়ন ফিরতেই দিঠি জিজ্ঞেস করল ডঃ রমেশ গুপ্তার নাম শুনেছে কিনা। অয়ন একটু চিন্তা করে বলল, ‘পরমাণু বৈজ্ঞানিক কি?’
দিঠি সংক্ষেপে ওকে রিমঝিমের কথা বলল। অয়ন পেশায় ক্রাইম জার্নালিষ্ট, তাই রহস্য দেখলেই ঝাঁপিয়ে পড়া ওর নেশা। পুলিশের থেকে সরকারি উপর মহলে ওর খুব খাতির। সরকার ওকে দিয়ে অনেক সময় অনেক কাজ করিয়ে নেয়। দিঠি প্রতিষ্ঠিত লেখিকা, মূলত রহস্য গল্প লিখলেও অয়নের সঙ্গে বেশিরভাগ রহস্য উন্মোচনে ওর বিশেষ ভূমিকা থাকে।
অয়ন বলল, ‘এদেশে পারমাণবিক বৈজ্ঞানিকদের ভাগ্য কিন্তু খুব একটা ভালো নয়। সরকার এদের তেমন সুরক্ষা দিতে পারে কই? হোমি জাহাঙ্গীর ভাবার মৃত্যু নিয়েই আজ অবধি কোনও তদন্ত হল না এদেশে!! আল্পসের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল ওই অভিশপ্ত প্লেনের ধংসাবশেষ। তা-ও তদন্ত হয়নি। ২০০৯ সালে কায়গা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্রজেক্টের বৈজ্ঞানিক লোকনাথন মহালিঙ্গম সকালে হাঁটতে বেরিয়ে আর ফিরে আসেননি। পাঁচদিন পর প্রজেক্টের পাশের কালী নদী থেকে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। পরে আত্মহত্যা বলে তাঁর কেস ফাইল বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই লিস্টে আছে আরও প্রচুর পারমাণবিক বৈজ্ঞানিক। মেয়েটার দিদি জামাইবাবুর মৃত্যু স্বাভাবিক বলে মনে হয় না আমার। আর তাই হয়তো ওর বাবা ব্যস্ত রয়েছেন। হয়তো ওঁর জীবনেও নেমে আসবে এমন অভিশাপ। উনি হয়তো জানেন সেটা। ছোট মেয়েকে জানাতে চাইছেন না। এই পরিস্থিতিতে এটা স্বাভাবিক ঘটনা। ডঃ গুপ্তার প্রোটেকশন দরকার আমার মনে হয়। দেখো, ওই আইএএস ভদ্রলোক কতদূর কী করেন। তারপর আমি দেখছি। আসলে ব্যপারটা গোপনীয়, খবর করা যাবে না।’
দু’দিন পর রিমঝিম ফোন করে আবার আসতে চাইল। ও এসে বলল, ‘কাকু আজ ফোনে বলল বাবা ভালো আছে। তবে খুব ব্যস্ত। কাকুও ব্যস্ত।’
‘তাহলে তুমি আর চিন্তা করো না। তুমি ওই কালো বাক্সর কথা বন্ধন বাবুকে বলেছিলে?’
‘না, বলিনি। বাবাও মনে হয় না বলেছে। কিন্তু আজ ছিল আমার মায়ের মৃত্যু দিন। এদিন বাবা ফোন করে প্রতিবার। এবার এই বিশেষ দিনটাও ভুলে গেল!! আমার বাবা এত বদলে গেল কী করে? উনিশ বছরে কোনওদিন এমন ভুল হয়নি বাবার। আমি জানি না কেন এমন হচ্ছে। আমার জন্মদিনের কথাটা আমি বলেছি বাবাকে। তার কয়েকদিন পরেই মা চলে যায়, তাই এটা বাবার মনে থাকবে না কেন?’ কান্নার দমকে গলা বুঝে আসে ওর। বলে, ‘আমি যাবো ভেবেছি বাবার কাছে।’
দিঠি ওকে বুঝিয়ে বলে ওর বাবা বড় মেয়েকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছেন হয়তো। কিন্তু সদ্য উনিশের মেয়েটা ফুলে ফুলে কাঁদতে থাকে। ঠিক তক্ষুনি এসে ঢোকে অয়ন। অমন কান্না ভেজা রিমঝিমকে দেখে একটু চমকে ওঠে। দিঠি পরিচয় করায় ওদের। ও জাফরনী রঙের ওড়নায় চোখ মুছে বলে, ‘আমি কাল চণ্ডীগড় যাচ্ছি। একটা গাড়ি নিয়ে একাই যাবো বাবার কাছে।’
‘উনি কোথায় আছেন একটু বলবে?’ অয়ন প্রশ্ন করে।
‘লারজি ছাড়িয়ে জালোরি পাশের দিকে, তীর্থন রিভার ভ্যালিতে একটা ছোট্ট গ্ৰামে।’
অয়ন একটু চিন্তা করে বলে, ‘একটু সময় দাও। আমরাও যাবো তোমার সঙ্গে। ঘুরে আসা যাবে ও দিকটা।’
অয়ন পাশের ঘরে গিয়ে ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
রিমঝিমের মুখে এবার হাজার ঝাড়বাতির রোশনাই। দিঠির হাতটা চেপে ধরে বলে, ‘সত্যিই যাবে তোমরা আমার সঙ্গে?’ ও উত্তেজনায় আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে নিজেই জানে না। দিঠি মুচকি হেসে একটা ভরসার হাত রাখে ওর কাঁধে।
একটু পরেই অয়ন হাসতে হাসতে এসে বলে, ‘সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কাল রাতের ফ্লাইটে দিল্লী, ভোরের ফ্লাইটে পরশু চণ্ডীগড়, বাড়ি গিয়ে ব্যাগ গোছাও।’
রিমঝিম বলে, ‘টিকিটের টাকা আর বাকি খরচ… আমি কি এখনি চেক কেটে দেব?’
‘আপাতত আমার অফিস করছে সবটাই, পরে তোমাকে বলবো তোমার খরচটা। তবে যদি কিছু নিউজ করার মতো খবর থাকে সেটা আমি করবো। যতটা গোপন রাখার অবশ্যই রাখবো।’ অয়ন বলে।
রিমঝিম চলে যেতেই দিঠি বলে, ‘সত্যি সব খরচ দেবে অফিস?’
‘শুরু হল গোয়েন্দা গিন্নির জেরা!! এই বাচ্চা মেয়েটার থেকে টাকা নিতে কেমন লাগছিল। মনে করো হিমাচল ঘুরতে যাচ্ছি আরেকবার। তবে গল্প যদি জমে যায় বস দেবে খরচ। আগে চল, গিয়ে দেখি কি ব্যাপার, তারপর না হয় ওসব হবে। ডঃ গুপ্তার থেকেই না হয় নেব ভাড়ার টাকা। ও সব নিয়ে চিন্তা নেই, চিন্তা ডঃ গুপ্তাকে নিয়ে।’
***
চণ্ডীগড় আসার পথে অয়ন আর দিঠি টুকটাক অনেক কিছু জেনে নিল রিমঝিমের থেকে। পাঞ্জাব ছাড়িয়ে হিমাচলে ঢুকতেই দৃশ্যপট বদলে যেতে শুরু করেছিল। সবুজ শস্য খেতের বদলে ছোট-বড় টিলা আর ঢেউ খেলানো নীল পাহাড় দেখা দিল দিগন্ত রেখার কাছে। বিলাসপুরে পাহাড়ের গায়ে একটা ছোট হোটেলে দুপুরের খাওয়ার জন্য একবার থেমে ছিল ওরা। অয়নের কথামতো রিমঝিম ওর বাবাকে বলেনি যে ওরা আসছে। পাহাড়ের একদিকে বহু নিচে দেখা যাচ্ছিল গোবিন্দ সাগর, ১৯৫০-এ এই গোবিন্দ সাগরের জলস্ফীতিতে ডুবে গেছিল পুরানো বিলাসপুর শহরের অংশ বিশেষ। এখনও জলের উপর জেগে রয়েছে মন্দিরের চূড়া, প্রাচীন বৃক্ষ। সেদিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিঠি। মান্ডি পার হতেই সুন্দরী বিপাশা এসে ওদের সঙ্গী হল। এখানে এই নদীর নাম বিয়াস।
বিকেল পাঁচটায় মানালির রাস্তা যখন বা দিকে অটোর টানেলে ঢুকে পড়ল ওদের গাড়ি এগিয়ে গেল বিয়াস পার করে লারজীর পথে। পাহাড়ি তির্থন নদীকে পাক খেয়ে ওরা এগিয়ে চলল বানঞ্জারার দিকে।
অপূর্ব সুন্দর প্রকৃতির মেল বন্ধন দেখতে দেখতে দিঠি বলল, ‘খবর না দিয়ে যাচ্ছি, আমাদের থাকার কী ব্যাবস্থা হবে ওখানে?’
‘বাবারা আছে সোজা ফরেস্টের ভেতর একটা বাংলোতে। ওটা ছিল পাতিয়ালার মহারাজের শিকার বাড়ি। সুরক্ষিত জায়গা। এখন সরকার অধিগ্ৰহণ করেছে। অনেক ঘর রয়েছে। অসুবিধা হবে না।’ রিমঝিম বলল।
ছোট ছোট কয়েকটা জনপদ পেরিয়ে গাড়ি তখন এক আদিম অরণ্যে প্রবেশ করছে। ঘাস ফুলের মতো একধরনের বেগুনি ফুল ছেয়ে আছে পাহাড়ের গায়ে। যখন ওদের গাড়ি বাংলোর গেটে পৌঁছল সূর্যের শেষ রশ্মিজাল গাছের ফাঁক দিয়ে এসে আলপোনা আঁকছে ঘাসের উপর।
একটা মোটা গোঁফওয়ালা দারোয়ান এগিয়ে এলো রিমঝিমকে দেখে। রিমঝিম আস্তে করে বলল এই হল উমিয়র। গেটটা বেশ শক্ত পোক্ত। চারপাশে পাঁচিলের উপর মোটা কাঁটা তারের জাল। আশেপাশে বেশ কিছু বড় গাছ থাকলেও ডালগুলোকে ওই বাংলোর পাঁচিলের ভেতর প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। ছেঁটে ফেলা হয়েছে আগেই। আউট হাউসের মাথাতে বিশাল সোলার প্যানেল চোখে পড়ল।
দারোয়ান উমিওর মুখ কাঁচুমাচু করে বলল যে ডঃ সাহেবের পারমিশন ছাড়া ও কাউকে ভেতরে ঢুকতে দিতে পারবে না এমনি আদেশ। ছোট দিদি যদি ওঁকে ফোন করে নেয় ভালো হয়।
রিমঝিম ফোন বের করে একটু সরে কথা বলছিল। ফোনটা ও উমিওরকে দিল। বোধহয় ওদিক থেকে পারমিশন এল। উমিওর গেট খুলে ওদের ঢুকতে দিল ভেতরে।
একতলায় একটা বড় হল, একটি ছেলে এগিয়ে এসে ওদের অভ্যর্থনা করল। ওর নাম বলল কুন্দন, নতুন রিসার্চের কাজে ঢুকেছে। ডঃ গুপ্তার রিসার্চের কাজ হয় দোতলায়। দিঠি অবাক হয়েছিল যে মেয়ে হঠাৎ এল তাও উনি নেমে এলেন না দেখে। হলের চারদিক চারটে ঘর।
ওদের হলে বসিয়ে ছেলেটি দোতলায় গেল। একটু পরে ডঃ গুপ্তা এলেন। সৌজন্য বিনিময়ের পর উনি বললেন, ‘এখানে আমি সরকারের পক্ষ থেকে একটা গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করছি। যেটা খুব গোপনীয়। পরিবার ছেড়ে, লোকালয় ছেড়ে এতদূরে পড়ে রয়েছি। আমি চাই না রিমঝিমকে এসবে জড়াতে, বড় মেয়েকে জড়িয়ে ফেলে ভুল করেছিলাম আমি। রিমঝিম এভাবে খবর না দিয়ে এসে ঠিক কাজ করেনি। আজ সন্ধ্যা হয়ে গেছে, তবুও আমি দেখছি বানঞ্জারায় বা সোজা বন বাংলোয় আপনাদের থাকার ব্যবস্থা করতে পারি কিনা।’
‘আমরা এখানে থাকলে কি খুব অসুবিধা হবে?’ রিমঝিম বলে ওঠে।
‘এটা ঠিক নয়। তুমি জানো বাইরের লোকদের এভাবে থাকতে দিতে পারি না। এর জন্য পারমিশন নিতে হয়।’ ডঃ গুপ্তার কথায় বিরক্তি ঝরে পড়ে।
রিমঝিম বলে, ‘আমি এখানেই থাকব। দু-চার দিন তোমার সঙ্গে থাকব বলেই এসেছি। এর আগেও তো থেকেছি।’
‘আমার কাজ শেষ হলে তুমি এসে থেকো। এখন নয়।’ উনি উঠে দাঁড়ান।
‘পেছনের আউট হাউসে তো থাকতেই পারি, বন্ধন কাকু এলে যেখানে ওঠে।’ রিমঝিম বলে।
‘না, ওটায় জলের সমস্যা চলছে। বন্ধন এসেছিল কয়েকদিন আগে। তখন থেকে সমস্যা।’
‘আজ রাতটা থাকি ওখানে, কাল দেখা যাবে। গাড়ি রয়েছে সঙ্গে অসুবিধা কিছু নেই।’ রিমঝিম ও ছাড়বে না।
‘আমরা না হয় বাইরে কোথাও থাকবো। রিমঝিম এখানে থাকুক।’ দিঠি একটু ইতস্তত করে বলে ওঠে।
‘আসলে আমাদের কাজ এখন শেষ পর্যায়, আমি রাতদিন ল্যাবেই পড়ে আছি। রিমঝিমকে সময় দিতে পারবো না একদম। তাই বলছিলাম ও আপনাদের সঙ্গেই থাকুক।’ ডঃ গুপ্ত যে ওদের থাকতে দেবেন না দিঠি আগেই আঁচ করেছিল। রিমঝিমকে ইশারা করল ও চলে আসার জন্য।
একটা বেয়ারা কফি আর চায়ের সরঞ্জাম নিয়ে এসেছিল সবার জন্য। কফি খেয়ে ওরা বেরিয়ে এল। রিমঝিম ওঁকে বলল, ‘কয়েকদিন থাকবো, আরেকবার আসবো দেখা করতে।’
‘ফোন করে আসবে।’ গম্ভীর গলায় বললেন উনি।
অয়ন উপরতলায় কথা বলে ফরেস্ট বাংলোয় থাকার ব্যবস্থা করে ফেলেছে ততক্ষণে।
বেরিয়ে গাড়িতে উঠেই রিমঝিম বলল, ‘বাবা টোটাল চেঞ্জ। এত বদলে গেল কেন হঠাৎ করে?’
দিঠি আর অয়ন ওর দিকে তাকাতেই বলল, ‘বাবা ব্ল্যাক কফি ছাড়া খায় না কক্ষনো, আজ দিঠি দি দুধ দিয়ে কফি বানিয়ে দিতেই খেয়ে নিল। আমায় বাবা হোটেলে থাকতে বলল! অথচ যতবার এসেছি এখানেই থেকেছি। জিজু আর দিভাইয়ের একটা ফটো বড় করে বাঁধানো হয়েছিল, আমি যেদিন চলে গেলাম ওটা এসেছিল বাঁধিয়ে। ছবিটা সেন্টার টেবিলের নিচে যেভাবে রেখে গেছিলাম পড়ে রয়েছে। বাবা টাঙায়নি।’
‘উনি কাজে এমন ডুবে রয়েছেন হয়তো ভুলে গেছেন।’ অয়ন বলল।
‘না, বাবা ওদের কথা ভুলতেই পারে না। আর আজ বাবা আমায় বারবার রিমঝিম বলে ডেকেছে, অথচ এই নামে বাবা আমায় ডাকত না, বাবিন বলে ডাকত।’
‘তুমি বলছ লোকটা অন্য কেউ?’ অয়ন বলে।
‘দেখতে বাবা, গলার স্বর এক, কিন্তু স্বভাব তো পুরো উল্টো। বাবা লোকজন ভালোবাসত। সবচেয়ে বড় কথা বাবা তোমরা কে, প্রশ্ন করল না। অথচ দিঠিদির লেখা বই বাবা পড়েছে। তবুও নাম বলার পর বাবার মনে পড়ল না!! আমি ইচ্ছা করেই মনে করাইনি। পরিচয় দিয়েছি আমার পরিচিতা দিদি বলে। এগুলোই ভাবাচ্ছে কারণ বাবার মেমোরি খুব শার্প।’
‘আমারও পুরো ব্যপারটা ভালো লাগেনি। উনি কি কাউকে ভয় পাচ্ছেন? ব্ল্যাকমেল করছে কেউ? নাকি অন্য কিছু?’ অয়ন চিন্তিত গলায় বলে।
***
ফরেস্টের গেস্ট হাউসটা কাছেই। বেশ সুন্দর কাঠের বাংলো। সামনে লনের পাশে ফুলের বাগান। অয়নের পরিচিতি প্রচুর, ফোন এসে গেছিল ওরা আসছে বলে। রাতে গরম মুরগির ঝোল আর রুটি খেয়ে ওরা তিনজন হলে এসে বসেছিল। অয়ন বলল, ‘তোমার বাবা যেটা তোমায় রাখতে দিয়েছিল সেটা কি এনেছ? একবার দেখলে ভালো হতো।’
একটু চিন্তিত মনে হল মেয়েটাকে। ঠোঁটটা কামড়ে কিছু ভাবছিল। বলল, ‘ওটা বাবা কাউকে দিতে বারণ করেছিল আসলে।’
‘দেখো তদন্ত করতে হলে সবটা জানতে হবে। তোমার বাবা একজন পরমাণু বিজ্ঞানী। ভারতের প্রচুর পরমাণু বিজ্ঞানী রহস্যজনকভাবে হারিয়ে গেছে বা মারা গেছে এর আগে। তুমি নিশ্চই আমাদের বিশ্বাস করো তাই ডেকে এনেছ। এখন যদি সবটা খুলে না বলো আমরা কিছুই করতে পারবো না। তোমার বাবার রিসার্চের বিষয়টা সম্পর্কেও যদি কিছু জানতে পেতাম…’ দিঠির কথার ফাঁকেই মেয়েটা বলে ওঠে, ‘বেশ, যতটা জানি বলছি। বাবা পারমাণবিক অস্ত্রের হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর উপায় বার করছিল। সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়ে এক অজানা রে আবিষ্কার করেছিল যা আমাদের আণবিক শক্তির হাত থেকে রক্ষা করবে। সেটাকেই পুরো দেশের সুরক্ষায় ব্যবহার করার চেষ্টা চলছিল। এই পরীক্ষা সফল হলে ভারতকে পারমাণবিক অস্ত্র দিয়ে আর কেউ ভয় দেখাতে পারত না কখনও। বাবা প্রায় সফল হয়েই গেছিল। শেষ পর্যায়ের কাজ চলছিল গোপনে এখানে বসে।’
‘তোমার দিদি আর জিজুর দুর্ঘটনাটা কী করে হয় বলবে একটু।’
‘ওরা হঠাৎ দিল্লি যাচ্ছিল, ওদের গাড়িটা মান্ডির আগে নদীতে পড়ে যায়। আমার বিশ্বাস ওটার পেছনে কেউ আছে। কিন্তু এতদিন পর আর প্রমাণ কোথায়? বাবা ওই ব্যপারে কথাই বলতে চাইত না বেশি।’
‘এবার আমরা কী করবো? আসল ডঃ গুপ্তার বদলে কাউকে প্লেস করা হয়েছে বলছ?’ দিঠি প্রশ্ন করে।
‘না, বাবার বাঁ হাতে ছ-টা আঙুল, ভ্রু-র পাশের ছোট্ট কাটা দাগ, ঠোঁটের কোনায় তিল সব ছিল। লোকটার স্বভাবটাই মিলল না শুধু। মাত্র ক’দিন আগেই ঘুরে গেছি। লোকটা এমন ছিল না।’
‘তোমার ওই বন্ধন কাকুকে ফোন করে সবটা বলো। তোমার মনে যে প্রশ্নগুলো জেগেছে সেগুলোও বলো।’ অয়ন বলে। ফোনটা নিয়ে জানালার কাছে উঠে যায় রিমঝিম।
একটু পরেই বলে, ‘বন্ধন কাকু কাল সকালেই এসে যাবে, চণ্ডীগড়েই ছিল। ভোরে রওনা দেবে বলল।’
বেশ রাত পর্যন্ত আলোচনা করে ওরা শুয়ে পড়ল।
সকাল সাড়ে আটটায় বন্ধন বাবু এসে হাজির। ভোর চারটায় রওনা দিয়েছিলেন চণ্ডীগড় থেকে। প্রাথমিক আলাপচারিতার পর অয়ন বলল, ‘আপনি কি ওঁর রিসার্চের ব্যাপারে কিছু জানতেন?’
‘পারমাণবিক অস্ত্রের প্রয়োগ বন্ধ বা ওর অপকারিতা এসব নিয়ে কাজ করছিল। আমি ওই বিভাগেই আছি, তবে বাকিটা গোপনীয়। ওর কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল।’
‘এই রিসার্চের খরচ কি সরকার দিচ্ছিল?’
‘প্রতিরক্ষা দপ্তর ও সরকারের যৌথ উদ্যোগে কাজ করছিল ও। ওর প্রোটেকশনের জন্য বহুবার বলা হয়েছে। ও বলত ওর কিছু হবে না। প্রোটেকশন নিলে নাকি গোপনীয়তা বজায় থাকবে না। কাজটাও ও একাই করছিল। মেয়ে-জামাই ছাড়া আর কাউকে কিছু জানতে দিত না।’
‘এই গবেষণার ফলাফল যে দেশের হাতে যাবে তাদেরই লাভ। এ ক্ষেত্রে ওঁর শত্রু থাকাই স্বাভাবিক।’
‘তা ঠিক, তবে ও তো একাই কাজ করছিল। তাই খবর পাচার হওয়ার সুযোগ কম। আর ওর দারোয়ান থেকে রাঁধুনে, কাজের লোক সবাই এক্স-আর্মি। এটা ওকে না জানিয়েই করা হয়েছিল।’
‘অর্থাৎ ওঁর উপর সরকার ও প্রতিরক্ষা দপ্তরের নজর ছিল। তাও ওঁর মেয়ে-জামাই ওভাবে মারা গেল।’ অয়ন বিরক্ত হয়েই বলে ওঠে।
‘ওটা একটা দুর্ঘটনা, জামাই গাড়ি চালাচ্ছিল, কুয়াশা ছিল রাস্তায়। গাড়ি পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে নদীর খাদে পড়ে যায়। তদন্তে কোনও অন্তর্ঘাতের খোঁজ পাওয়া যায়নি।’ বন্ধন বাবু বললেন।
দশটা নাগাদ ওরা আবার গেল ডঃ গুপ্তার বাংলোতে, সরকারি বাতি লাগানো গাড়ি আর রিমঝিমকে দেখে এবার উমিয়র দরজা খুলে দিল। গাড়ির আওয়াজেই বাইরে বেরিয়ে এসেছিলেন ডঃ গুপ্তা। ওদের দেখে বিরক্ত, প্রথমেই বললেন, ‘ফোন করে আসতে বলেছিলাম তোমাদের!’
‘আমি এদিকে আসছিলাম, ওদের সঙ্গে দেখা হল। ভাবলাম তোকেও দেখে যাই একবার। তোর কাজ আর কত বাকি? সেদিন তো বলেছিলি তো প্রায় শেষ?’ বন্ধন বাবু প্রশ্ন করেন।
‘খুব ঝামেলায় পড়েছি। রুমঝুম আর পিল্লাই বেশ কিছু ডেটা কোথায় রেখেছে খুঁজেই পাচ্ছি না। তাই সময় লাগছে।’ বিরক্ত হলেও উনি ওদের হলে এনে বসালেন। বললেন, ‘কাজটার মেইন অংশটাই ওদের কাছে ছিল। আবার নতুন করে সব শুরু করতে হচ্ছে। আবার দুজন জুনিয়ারকে নিয়েছি। রিক্তা আর কুন্দন। এবার তাড়াতাড়ি হবে মনে হয়।’
বন্ধন বাবুদের কথার মাঝেই একটি মেয়ে এসে ঢুকল ঘরে। মেয়েটির গায়ের পোশাক বলে দিচ্ছিল ও ল্যাব অ্যাসিট্যান্ট। ও আসতেই ডঃ গুপ্তা বললেন, ‘কাজ প্রচুর বাকি। তাই এখন আমার সময় নেই। হয়তো সবার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করছি। কিন্তু রিমঝিম আর বন্ধন জানে আমি এমন না। কাজটা শেষ করতে না পারলে শান্তি পাচ্ছি না। দেশের জন্য কাজটা শেষ করা জরুরী’ উঠে পড়লেন উনি।
‘কালো বাক্সটা…’ রিমঝিম কিছু বলতে যেতেই দিঠি বলে উঠল, ‘চলো রিমঝিম, ওঁকে এভাবে ডিস্টার্ব করা উচিৎ নয়।’
‘কালো বাক্স!!’ ডঃ গুপ্তা মেয়ের দিকে তাকালেন প্রশ্ন চোখে।
‘আমার কালো সুটকেসের কথা বলছে ও।’ দিঠি তাড়াতাড়ি উত্তর দেয়।
ভ্রু কুঁচকে মেয়ের দিকে তাকিয়েছিলেন ডঃ গুপ্তা। রিমঝিম হয়তো দিঠির ইশারা বুঝতে পেরেছিল। ও উঠে পড়ল।
ফেরার পথে দিঠি ওকে বলে, ‘ওই বাক্সর কথা আর বলো না কাউকে।’
‘স্ট্রেঞ্জ…!!’ ঠোঁট কামড়ায় মেয়েটা।
***
দুপুরে নদীর টাটকা ট্রাউট মাছ ছিল মেনুতে, তৃপ্তি সহ খেয়ে বন্ধন বাবু বললেন, ‘একটা কথা কিন্তু আমার মনেও এসেছে। আজ গুপ্তার ব্যবহার কেমন যেন ছিল। মেয়ে-জামাইকে হারিয়ে শোকে এমন হয়ে গেছে ও।’
‘আমার মনে হচ্ছে ওই ছেলেটি আর মেয়েটি ওঁকে ব্ল্যাকমেল করছে। সারাক্ষণ ওঁর সঙ্গে রয়েছে কোনও একজন। বাড়ির লোকের সঙ্গেও কথা বলতে দেবে না যেন। ওদের ব্যাপারে খোঁজ নিন বন্ধন বাবু।’ অয়ন বলে ওঠে।
‘রিমঝিম তখন একটা কী বাক্সের কথা বলছিলে যেন?’ বন্ধন বাবু হঠাৎ প্রশ্ন করেন।
‘শেষবার আমি চলে যাওয়ার আগে বাবা আমায় একটা কালো দেশলাই বাক্সের মতো বাক্স রাখতে দেয়। বলেছিল বাবার কিছু হলেই বাক্সটা নিয়ে তোমায় দিতে। আর কাউকে বিশ্বাস করতে না। আর এখন বাবার সেটাও মনে নেই। বাবাকে কি ওরা মেমরি লসের ইনজেকশন দিল কিছু? তাই সব ভুলে যাচ্ছে?’
‘বাক্স!! কোথায়? বলিসনি তো?’ লাফিয়ে ওঠে বন্ধন বাবু।
‘আসলে বাবা বলেছিল বাবার অবর্তমানে দিতে। তার আগে কাউকে বলতে না, আমি তো তদন্তের স্বার্থে দিঠি দি কে জানিয়েছি।’ রিমঝিম বলল।
‘বাক্সটা কোথায়? নিয়ে আয় দেখি।’
একটু ইতস্তত করে উঠে যায় রিমঝিম। ছোট কালো দেশলাই বাক্সের মতো একটা বাক্স নিয়ে ফেরে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও বাক্সটা ওঁরা খুলতে পারে না। ঠিক মাঝখানে রয়েছে পিনের ফুটোর মতো একটা ফুটো। দিঠি একটা পিন দিয়ে চাপ দিতেই বাক্সর একটা দিক খুলে গেল। অনেকটা কার্ড রিডারের মতো, ভেতরে ছোট চিপ রয়েছে। ল্যাপিতে লাগাতেই তিনটে হিডেন ফাইল পাওয়া গেল। তবে তিনটেই কোডেড। পাসওয়ার্ড দেওয়া।
একটা ওয়ার্ড ফাইলে ছিল একটা চিঠি, বন্ধন বাবুর উদ্দেশ্যে।
প্রিয় বন্ধন,
আমার কাজ শেষ। কিন্তু দেশের মধ্যেই রয়েছে আমাদের শত্রুপক্ষ। দুই মিলিত প্রতিবেশী শক্তির কাছে বিক্রি হয়ে গেছে কিছু নেতা। মিলিত শক্তি ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে আমায় এই আবিষ্কার ওদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য। সব খবর ওরা পেয়ে যাচ্ছে নিয়মিত। আমার বড় মেয়ে জামাইকে মেরেও ওরা আমার জেদ ভাঙতে পারেনি। এ সুরক্ষা বলয় যে দেশ পাবে সে হবে অপ্রতিরোধ্য। কেউ সেই দেশের ক্ষতি করতে পারবে না। পরমাণু বোমাও এ বলয় ভাঙতে অপারগ। আমার এই সুরক্ষা কবচ দেশের জন্য উৎসর্গ করতে চাই। পুরো আবিষ্কার তোর হাতে তুলে দিলাম। যে কোনও পরমাণু বিজ্ঞানী পারবে এই ফর্মুলা দেখে সঠিক রূপায়ন করতে। তুই সঠিক লোকের হাতে দিবি বিশ্বাস আছে। আমার ছোট মেয়েকে দিলাম তোকে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব। ওরা হয়তো আমায় প্রাণে মারবে না। আরো অনেক পরমাণু বিজ্ঞানীর মতো হয়তো আমায় অপহরণ করে চাপ দিয়ে ফর্মুলাটা হাতাতে চাইবে। তবে তুই ছাড়া কেউ জানে না কাজটা যে শেষ। সবাই জানে কিছুটা বাকি। তাই প্রাণ সংশয় নেই আপাতত। যদি বেঁচে থাকি দেখা হবে।
শুভেচ্ছা,
ডঃ রমেশ গুপ্তা
‘ওই লোকটা আমার বাবা নয়, ওটা বহুরূপী কেউ।’ ভেজা চোখে বলে ওঠে রিমঝিম, ‘বাবাকে ওরা কিছু করেছে!!’
‘আমি কাল একটা সরকারি প্রতিনিধি দল পাঠাতে বলেছি। সঙ্গে ফোর্স নিয়েই যাবো একবার।’ বন্ধন বাবু বললেন। উনি কালো বাক্সটা নিজের কাছে রাখতে চাইছিলেন। কিন্তু রিমঝিমের জেদ বাবা বলেছিল বাবার কিছু হলে দিতে। আপাতত ও এখন কিছুতেই দেবে না। ও নিয়ে চলে গেল নিজের ঘরে। বন্ধন বাবু একটু বিরক্ত মনে হল।
***
কিন্তু পরদিন সকালে ওরা বাংলোয় পৌঁছে শুনল ডঃ গুপ্তা দুই সহকারীকে নিয়ে দিল্লি রওনা দিয়েছেন। গাড়ির নম্বর জেনে পুলিশকে জানালেন বন্ধন বাবু। অয়ন রিমঝিমের সঙ্গে গোটা বাড়িটা খুঁজে দেখছিল। প্রতিনিধি দলের লোকেরা ল্যাব ঘুরে দেখে বলল সব কম্পিউটার ফাঁকা। সব ডেটা মুছে ফেলা হয়েছে।
দিঠি কাজের লোকদের থেকে খোঁজ নিচ্ছিল ডঃ গুপ্তার মধ্যে কোনও পরিবর্তন এসেছিল কিনা। ওরাও বলল উনি হঠাৎ করে চুপচাপ হয়ে গেছিলেন। ইদানীং ওষুধগুলো খেতেন না ঠিক করে। রিমঝিম ও বলল ওর বাবার প্রেশার ও সুগারের ওষুধ সব রয়েছে ড্রয়ারে যেভাবে ও রেখে গেছিল। এমন ভুল নাকি আগে কখনও হয়নি ওঁর। ওষুধ বরাবর ঠিক করে খেতেন।
এর মধ্যেই এলো খারাপ খবরটা। ডঃ গুপ্তার গাড়িতে দুর্ঘটনা ঘটেছে। ওরা সবাই তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল সেই খবর শুনে।
লারজির ছাড়িয়ে কিছুদূর গিয়েই একটা ষোলো চাকা ট্রাকের নিচে ঢুকে গেছিল গাড়িটা। ড্রাইভার আর ডঃ গুপ্তা স্পটেই শেষ। তবে ছেলেটি আর মেয়েটি উধাও হয়ে গেছিল। অনেক খোঁজ করেও ওদের পাওয়া গেলো না।
সব ফর্মালিটি মিটিয়ে ওরা আবার সোজার বাংলোতেই ফিরে এলো সন্ধ্যায়। রিমঝিম তখনও বলে চলেছে এটা ওর বাবা নয়। অয়ন, দিঠি আর বন্ধন বাবু বসেছিল বারান্দায়। বন্ধন বাবু বললেন, ‘আমার উপর এখন বড় দায়িত্ব। কালো বাক্সটা পৌঁছে দিতে হবে ঠিক লোকের হাতে।’
রিমঝিম উত্তর দিল না কিছু। দু-হাতে কপাল টিপে বসে রইল।
অয়ন বলল, ‘২০১১ সালে ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টারের বৈজ্ঞানিক আইয়ারের মাথায় রক্তক্ষরণ হয়ে মৃত্যু হয়েছিল। বাইরে থেকে কোনও আঘাতের চিহ্ন নাকি পাওয়া যায়নি। তাঁর মৃত্যু তাঁরই কোনও পরীক্ষার পরিণাম বলে কেস বন্ধ করে দেওয়া হয়। কে কে যোশ এবং আবিশ শিবম ছিলেন ভারতের প্রথম পারমাণবিক ক্ষমতাশালী সাবমেরিন INS Arihant প্রকল্পে কর্মরত দুই ইঞ্জিনিয়ার। ২০১৩ সালে রহস্যজনকভাবে তাঁরা দুজনে একসঙ্গে মারা যান। তাঁদের মৃতদেহ দুটি পাওয়া যায় রেললাইনের ওপর, অথচ কোনও ট্রেন কিন্তু তাঁদের ধাক্কা দেয়নি। ফরেনসিক রিপোর্টে তাঁদের দুজনের বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হয়েছে বলা হলেও তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রক এই অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনাকে সাধারণ দুর্ঘটনা বলে ঘোষণা করে।সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার যে মিডিয়াও এই ঘটনা নিয়ে কোন প্রশ্ন তোলেনি। একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্ট এর দুই ইঞ্জিনিয়ার এক সঙ্গে মারা যাওয়া সত্ত্বেও তাঁদের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে কোনও স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন হয়নি। সব ক-টি মৃত্যুর ক্ষেত্রেই ফরেনসিক এক্সপার্টরা নাকি কোনও ফিঙ্গারপ্রিন্ট পাননি। এভাবেই হয়তো এই ফাইলটাও বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা কিছুই করতে পারবো না।’
বন্ধন বাবু বলেন, ‘যদি এ গুপ্তা না হয় এ তবে কে ছিল? ওর টুইন!! অবিকল এক, হাতের আঙুল, তিল, কাঁটা দাগ!! কোনও মেকআপ বা সার্জারির চিহ্ন নেই, হাতের ছাপ ও এক খোঁজ নিয়েছি, এটাই আমার বন্ধু। ভালো করে দেখিছি এটাই গুপ্তা।’
‘না, এটা বাবা ছিল না, বাবার চশমাটা কোথায়? বাবাকে যে দু-দিন দেখেছি একবারও চশমা ছিল না চোখে। তবে বাবা শুধু কাজের সময় চশমা পরত বলে খেয়াল করিনি সেভাবে। আমি পুলিশকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ওরাও পায়নি। চশমা ভেঙে যেতে পারে, উধাও হবে না কখনও। বাবা কাজে গেলে চশমা নিয়েই যেত। কাজের লোকেরাও বলছে কয়েকদিন বাবার চশমা দেখেনি।’
‘লোকটাই সব ছেড়ে চলে গেল আর চশমা খুঁজে কি হবে? আমাকেও কাল ফিরতে হবে। গুপ্তা যখন নেই চিপটা জায়গামতো পৌঁছে দিতে হবে এবার। এবার ওটা দাও।’ বন্ধন বাবু বললেন রিমঝিমকে।
রিমঝিম উঠে গেল নিজের ঘরে, চোখের ইশারাতে দিঠিকে ডেকে নিল। ঘরে ঢুকে আসতে করে দরজাটা বন্ধ করল ও। দিঠি একটু অবাক হয়ে ওর পিঠে একটা হাত রাখতেই ও ঘুরে দাঁড়াল, খুব আস্তে বলল, ‘গভীর ষড়যন্ত্র দিঠি দি। এই লোকটা বন্ধন কাকু নয়। এ আমাদের উপর নজর রাখছে। তাই এমন সেঁটে রয়েছে। ওই কালো বাক্সটা ওকে দেওয়া যাবে না কোনওভাবেই।’
‘মানে? কি বলছ!!’
‘অত সময় নেই, পরে বুঝিয়ে বলছি। এখন তাড়াতাড়ি কিছু ভাবো। এই চিপটা ওকে দেওয়া যাবে না।’
দিঠি কালো বাক্সটা মাথার পিন দিয়ে খুলে চিপটা বার করে নিল দ্রুত। বলল, ‘তুমি এটা নিয়ে দাও, খুলতে চাইলে পিন লাগবে, তুমি পিন আনছ বলে উঠে আসবে। আমি কফি নিয়ে যাচ্ছি এখনি।’
কফির সঙ্গে কড়া ঘুমের ওষুধ দিয়ে বন্ধন বাবুকে ঘুম পাড়াতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। কালো বাক্সটা ওর হাতব্যাগেই ছিল। অয়ন তখনও কিছুই জানে না।
সবটা শোনার পর অয়ন বলল, ‘তুমি কি করে শিয়োর হলে উনি নকল?’
দিঠি আর অয়নের দিকে তাকিয়ে রিমঝিম বলল, ‘বন্ধন কাকু ছিল বাবার প্রিয় বন্ধু। প্রতিরক্ষা বিভাগের বড় আমলা। ওর অনেক অবদান ছিল বাবার রিসার্চে। বাবার চশমাটা স্পেশাল চশমা ছিল যেটা বন্ধন কাকু জাপান থেকে আনিয়েছিল নিজের ব্যক্তিগত উদ্যোগে। একটা ট্রান্সমিটার রয়েছে ওই চশমায়। ওটাকে লোকেট করা যায় বাবা যেখানেই থাকুক। আর বাবা যে কাজটা করছিল সেটার বেস স্টেশন রয়েছে রোতাংপাশের কাছে। লোকচক্ষুর আড়ালে বরফের রাজ্যে একটা ছোট পরিত্যক্ত ক্যাম্পের ভেতর রয়েছে লঞ্চারগুলো যেগুলো সূর্যের এক রশ্মির সাহায্যে দেশকে এক সুরক্ষা বলয়ে মুড়ে দেবে। একথা মাত্র কয়েকজন জানত। এই লোকটা এসব জানে না। বাবাকে কাজটা করতে হবে একটা নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে থেকে। আর বাবা যেখানে বসে কাজ করবে সেখানে একটা সোলার প্যানেল চাই ঠিক এত বড়। এখন বাবাকে খুঁজে বার করতেই হবে। আমি ট্রান্সমিটার সিগন্যালটা ধরতে পারি মোবাইলেই।’
‘কিন্তু এই লোকটা তাহলে কে?’ দিঠি বলে ওঠে।
‘সেটা নিয়ে পরেও ভাবা যাবে। আগে রিমঝিম ডঃ গুপ্তাকে খুঁজুক।’
দিঠি ওকে বলল, ‘খুব সাবধানে এগোতে হবে। প্রতিপক্ষ দুই দেশের মিলিত শক্তি। কে শত্রু কে মিত্র বোঝা যাচ্ছে না। রাঁধুনি দারোয়ান সবাই শত্রু হতে পারে।’
‘উমিওর নয়, ও তো আমায় খবর দিয়েছিল।’ রিমঝিম বলে।
একটু পরেই দেখা গেল ট্রান্সমিটার সিগন্যাল দিচ্ছে মনিকরণ ছাড়িয়ে নাগ্গরের পথে।
‘এটা এতদিন মনে পড়েনি তোমার!! আগেই তো ওঁকে খুঁজে পেতাম।’
‘বাবাকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম যে, তাই এই চশমার কথা ভুলে গেছিলাম।’
বন্ধন বাবুকে বন্দী করে উমিওরকে পাহারায় রেখে উপর মহলে সব জানাল অয়ন। পুলিশ আসতেই ওরা রাতেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ল মনিকরণের দিকে। বন্ধন বাবুর ঘুম পনেরো-ষোল ঘণ্টার আগে ভাঙবে না।
ভোরবেলায় ওরা পৌঁছে গেল সেই গ্ৰামে। গ্ৰামটা একটা মডেল গ্ৰাম, একটা বিদেশি এনজিও কাজ করছে ওখানে। পুরো গ্ৰামটাই সোলার শক্তিতে চলছে। সব বাড়িতেই ছোট-বড় সোলার প্যানেল। অয়ন আগেই উপর মহলে কথা বলে এই গ্রামে ফোর্সের ব্যবস্থা করে ফেলেছিল। পুলিশ ও প্যারা-মিলটারী ফোর্সের সাহায্যে নির্দিষ্ট অঞ্চল ঘিরে ফেলা হয়েছিল। দিঠি অয়ন আর রিমঝিমকে অবশ্য গাড়িতেই বসে থাকতে হল। হঠাৎ আক্রমণে প্রতিরোধের সুযোগ পায়নি দলটা, প্রায় বিনা বাধায় উদ্ধার হয়েছিলেন ডঃ গুপ্তা। রিমঝিম কেঁদে ফেলেছিল বাবাকে জড়িয়ে। প্রবল মানসিক চাপে ছিল মেয়েটা। উনি প্রথমেই মেয়ের থেকে জেনে নিলেন বাক্সটার কথা। ওঁকে চাপ দিয়ে বিদেশি মিলিত শক্তি ওই সুরক্ষা বলয়ের ফর্মুলাটা নিতে চাইছিল। উনিও ওদের থেকে সময় নিচ্ছিলেন কাজের নাম করে। বলছিলেন কাজ পুরো শেষ হয়নি।
ভুন্টুর থেকে চার্টার্ড প্লেনে ওদের দিল্লি নিয়ে এসেছিল প্রতিরক্ষা দপ্তর। নকল বন্ধন বাবুকে গ্রেফতার করেছিল পুলিশ। সেদিনই বসেছিল প্রতিরক্ষা দপ্তরের বিশেষ গোপন অধিবেশন। সেখানে বসেই পুরো ঘটনাটা বললেন ডঃ গুপ্তা, ‘বিদেশী শক্তির হাতে রয়েছে মানব ক্লোনিং এর আধুনিক উন্নত পদ্ধতি। সেই পদ্ধতিতেই ওরা আমায় অপহরণ করে আমার ক্লোন করেছিল মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টায়। এত দ্রুত ক্লোন হয়তো পৃথিবীতে এই প্রথম।’
অয়ন বলল, ‘আমার প্রথমদিন থেকেই সন্দেহ হয়েছিল এটাই। কারণ শুধু অপহরণ করলে ওঁর খোঁজে এলাকা তোলপাড় হবে। এই এলাকা থেকে দূরে নিয়ে গেলে আবার কাজ শেষ হবে না। কাজটা বেস ক্যাম্পের একটা নির্দিষ্ট দূরত্বে বসেই করতে হবে। তাই এই উন্নত ক্লোনের ব্যবহার। তবে আমি ভেবেছিলাম ছদ্মবেশ বা প্লাস্টিক সার্জারি। মানব ক্লোনের সবকিছু এক হলেও মেমরি তো এক নয়। রিমঝিমের সন্দেহ হয়েছিল কয়েকটা ছোট ঘটনা দেখে। তাই ও বন্ধন বাবুকে খোঁজ নিতে বলেছিল। বন্ধন বাবু গতবার এসে পার্থক্য ধরে ফেলেন সহজেই।’
‘ঠিক, আর তাই ওকে সরিয়ে দেয় কুন্দন বলে ছেলেটা। তবে বন্ধনকে না পেলেও ঝামেলা হবে। তাই সাত তাড়াতাড়ি ওর ক্লোন করে তাকে পাঠায় ওর জায়গায়। মাঝে দু-দিন বন্ধন সোজায় এসেছিল সবাই জানে। তাই কারো সন্দেহ হয়নি। তবে ওকে দিল্লি পাঠালে ধরা পরে যেত। তাই চণ্ডীগড়ে থেকে গেছিল ও। আবার ওর ক্লোনকেই ব্যবহার করেছিল ওরা তোমাদের উপর নজর রাখার জন্য।’ ডঃ গুপ্তা বললেন।
‘এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। মানব ক্লোন এত সফলতার সঙ্গে করা যায় আর এত তাড়াতাড়ি?’ দিঠি অবাক হয়ে প্রশ্ন করে।
‘কিছু বৈজ্ঞানিক মানব ক্লোন নিষিদ্ধ জেনেও গোপনে এসব গবেষণা করে চলেছে। সালামান্ডারার নাম শুনেছ, গভীর সমুদ্রের এক আজব প্রাণী। এদের কোনও অঙ্গ খসে গেলে বা কেটে বাদ দিলে চব্বিশ থেকে আটচল্লিশ ঘণ্টার ভেতর ওরা অঙ্গটা নতুন করে গঠন করতে সক্ষম। দ্রুত কোষ বিভাজন হয় ওদের শরীরে। মানব জিনের সঙ্গে ওই জিনের মিলন ঘটিয়ে ক্লোন করা হয়েছিল। এত কম সময়ে এত উন্নত ক্লোনিং আগে হয়নি। চিনের ইয়েং কিকিতামার নাম শুনেছেন কেউ। মানব ক্লোনের অপরাধে জেল খেটেছিল এই বৈজ্ঞানিক, তাকে ব্যবহার করেছে এই শত্রুপক্ষ। ও তো ধরা পড়েছে কাল ওই গ্ৰামেই। আরো দু’জন চাঁই ধরা পড়েছে। তবে এরা প্রচণ্ড দুঃসাহসী। এরপর কী করবে জানি না। আসল মাথাগুলো তো দেশের বাইরে রয়েছে।’
রিমঝিম বলে, ‘যদি আমার সন্দেহ না হত কী হত?’
‘ওঁরা ওই ক্লোন কে রেখেছিল যাতে কেউ সন্দেহ না করে। সঙ্গে ছেলে মেয়ে দুটোকে রেখেছিল নজরদারির জন্য। যেই মুহূর্তে বন্ধন বাবুর ক্লোন ওই চিপটা পায় জানতে পারে কাজটা শেষ, কিন্তু রিমঝিম বলে বাবা বেঁচে থাকতে ও দেবে না বাক্সটা। তখন ও প্রথমে নকল ডঃ গুপ্তাকে মেরে দিতে বলে। আজ হয়তো ওই চিপটা নিয়ে এসে আসল ডঃ গুপ্তাকে ডিকোড করার জন্য চাপ দিত, বা মেরে গুম করে দিত। কেউ তো আর ওঁর খোঁজ করত না। প্ল্যান তো ভালোই ছিল। সফল হয়েও যেত, কিন্তু রিমঝিম ধরে ফেলে ও যে নকল। ভ্যাগিস চশমার কথাটা ওর মনে পড়েছিল।’ অয়ন বলল।
‘দিভাই আর জিজু…’ রিমঝিম উৎকণ্ঠার সঙ্গে ওর বাবার দিকে তাকায়।
‘না, আমার দুর্ভাগ্য ওরা সত্যি আর নেই। আমার জেদের বলি হয়েছে ওরা।’ ডঃ গুপ্তা বলেন।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সব শুনে বললেন, ‘ডঃ গুপ্তা এবার বলুন আপনার আবিষ্কারের কথা, কাজ তো শেষ বললেন। ফলাফল দেখতে চাই।’
‘আমার এই সফলতার পেছনে অবদান রয়েছে আমার মেয়ে-জামাই, আমার প্রিয় বন্ধু বন্ধনের আত্মত্যাগের। এত সহজে আমি হেরে যাব না। কাজ প্রায় শেষ। পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করতে চাই। তবে তার আগে ফর্মুলা কাউকে দেব না। আর আমি ছাড়া ওই পাসওয়ার্ড কেউ জানে না। আমি গোপন করার জন্য দুটো ডামি ফাইল রেখেছি। না জেনে কেউ কিছু করলে হিতে বিপরীত হবে। আণবিক বিস্ফোরণ হবে এবং ধ্বংস হবে একটা অঞ্চল। আগে সর্ষের মধ্যে ভূত খোঁজা হোক। এত গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের তথ্য বাইরে যাচ্ছে কী করে দেখা হোক। তারপর না হয় ফলাফল দেখবেন। এখন এখানে কে আসল কে ক্লোন তাই তো বোঝা দায়। কার হাতে তুলে দেবো এই ফর্মুলা!!’ মন্ত্রীসহ সব আমলা ও প্রতিরক্ষা কর্তা চুপ করে গেছিল ওঁর বক্তব্যে।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বললেন, ‘আমায় কয়েকদিন সময় দিন। আমি বিশেষ গোয়েন্দা দপ্তরের সহায়তা চেয়েছিলাম। সবার চেকাপ হবে, কে আসল কে নকল থেকে কে গুপ্তচর সব ধরা পড়বে। ততক্ষণ আপনার সুরক্ষার ভার আমাদের ওপর। আপনারা সবাই এখন আমাদের অতিথি। তবে মিডিয়ার কাছে সব গোপন রাখা হবে।’
অয়ন মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
‘আপনারা আজ অবধি কয়জন বৈজ্ঞানিককে সুরক্ষা দিতে পেরেছেন? ওটা গল্প কথা। প্রাণের ভয় পাই না। দেশের জন্য কাজ করছি। দেশের সুরক্ষাই আসল কথা। সেটাই মাথায় রাখুন। দেশকে জীবাণুমুক্ত করুণ।’ গম্ভীর গলায় কথাগুলো বলে বেরিয়ে গেলেন ডঃ গুপ্তা।
অধিবেশন শেষে বেরিয়ে এসেছিল ওরা চারজন। ডঃ গুপ্তা বললেন, ‘আপাতত দিল্লিতে থাকতে হবে, ওঁরাই ব্যবস্থা করবে।’
‘আপনি কিন্তু ওঁদের কাছে থাকলেও অসুরক্ষিত। শত্রুরা আবার আপনাকে তুলে নিতে পারে।’ দিঠি বলল।
‘সে জন্যে তো তোমরা রইলেই। ওঁরা খুব তাড়াতাড়ি কিছু করবে না, বড় ধাক্কা খেয়েছে তো। ক্লোন মাস্টার তো জেলে। তবে ওরা আমায় প্রাণে মারবে না। আর আসল জিনিস ও গচ্ছিত রইল তোমাদের কাছে। ওটা তোমাদের কাছেই থাক। তোমাদের গল্প অনেক পড়েছি। বিশ্বাস করি তোমরা পারবে ওটা রক্ষা করতে। আমি এখন মেয়ের সঙ্গে ছুটি কাটাবো কিছুদিন।’
‘ওটা তো সরকারের জিনিস…’
‘ওটায় রয়েছে দেশের সুরক্ষাকবচ। যা তোমায় গচ্ছিত রাখতে দিয়েছি যতক্ষণ বিশ্বস্ত লোকের দেখা না পাচ্ছি। সরকারকে উপযুক্ত জবাব দেওয়ার মতো জিনিস আমার হাতে আছে। আগে দেখি কী হয়।’
‘যদি দিভাই আর জিজুও এভাবে ফিরে আসত কি ভালো হত। ওরাও যদি ক্লোন হত…’ রিমঝিমের চোখে জল।
‘হয়তো আমার জেদেই ওরা চলে গেল, দেশের জন্য শহিদ ওরা, এটা মেনে নিতেই হবে।’ উদাস হয়ে উনি আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, ‘যে দিন সত্যি এই সুরক্ষা বলয়ে মুড়ে দিতে পারব গোটা দেশ কে সে দিন ওরাও শান্তি পাবে।’
নীল আকাশে সাদা মেঘের দল হাসছে। সেদিকে তাকিয়ে রিমঝিম চোখ মুছে বাবাকে জড়িয়ে ধরে।
Tags: অঙ্কিতা, কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, ডিটেকটিভ সায়েন্স ফিকশন, দেবদত্তা ব্যানার্জী
খুব ভালো লাগলো। আশা করি দিঠি তার কাজ চালিয়ে যাবে……
ভীষণ সুন্দর লেখা, পড়েতে পড়তে আশ্চর্য ফ্যান্টাসির জগতে গিয়েছিলাম চলে!!
durdanto….khub valo laglo…..