সেইসব অমূল্য স্মৃতি
লেখক: কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
শিল্পী: সৌরভ দে ও দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
ছোটবেলা থেকেই তুমুলভাবে গল্পের বই। বিষয় বাছাবাছি নেই। একদিকে বাঁটুল দি গ্রেট তো অন্যদিকে চাঁদের পাহাড়। এই শ্রীকান্ত, তো তার পাশে টোয়েন্টি থাউজ্যান্ড লীগ্স। তবে যে সমস্ত অনুবাদ গল্পের বই পড়েছি, তার মধ্যে চূড়ান্তভাবে আচ্ছন্ন করেছেন কোনান ডয়েল। অবশ্যই আসলে তাঁর শার্লক হোমস। আর এই শার্লক হোমসের অনেকরকম অনুবাদ পড়তে পড়তেই অকস্মাৎ একদিন হাতে এল কোনও এক শার্লক হোমস অমনিবাস।
সেদিন আমি অন্যরকম চোখে দেখতে পেলাম শার্লককে। তার শুকনো চেহারা, খ্যাপাটে হাবভাব, অতীন্দ্রিয় মস্তিষ্ক, সব মিলিয়ে শার্লক হোমস সেদিন সত্যিকারের জীবন্ত হয়ে উঠলেন আমার কল্পনার জগতে। আর সেই দুরূহ কাজটাই তাঁর কলম দিয়ে করে ফেললেন যিনি, তাঁকে নিয়েই আজ লিখতে বসেছি, তাঁর নাম অদ্রীশ বর্ধন।
এই ঘটনা যখন ঘটছে, তখন আমি কিশোর বয়সী। তার মানে আজ থেকে অন্তত ত্রিশ–পঁয়ত্রিশ বছর আগের ঘটনা সেটা। কিন্তু সে লেখার মাহাত্ম্য আজও আমার মন থেকে মুছে যায়নি। আজও মনে গেঁথে আছে সেইসব অবিস্মরণীয় গল্প — লালচুলো সংঘ, সোনার প্যাঁসনে চশমা অথবা নাচিয়ে মূর্তিগুলো। আর সবথেকে আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, তার পর থেকে আর শার্লক পড়বার প্রায় দরকারই হয়নি, এমনই মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল সেইসব গল্পগুলো, এমনই জাদু সেই কলমের।
এরপর প্রফেসর নাটবল্টু চক্র। প্রফেসর শঙ্কুর পাশাপাশি থেকেও তার নিজস্ব ঘরানায় সে দুর্বার বেগে আচ্ছন্ন করে ফেলল আমায়। আমি নিজে দীননাথ হয়ে যেতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করলাম না। আর সে আচ্ছন্নতা এমনই যে, অবিলম্বে মনে মনে সৃষ্টি করে ফেললাম একটি বিজ্ঞানী চরিত্র, আর নিজে হয়ে গেলাম তার সহকারী। কল্পনায় লেখা হতে লাগল বিভিন্ন আইডিয়া আর কাহিনি। বলাই বাহুল্য, সেদিনের সেই কল্পনাই এতদিন পরে জীবন্ত হয়ে উঠেছে ডক্টর অর্কদেব বিন্দু আর তার সহকারী স্বাগত রায়ের রূপ ধরে।
এরপর কেটেছে আরও বহুদিন। পড়েছি তাঁর লেখা আর অনুবাদ করা আরও অনেক অনেক গল্প আর উপন্যাস। আর ক্রমশই মুগ্ধ হয়েছি তাঁর কলমের মায়াজালে। নিজেও লিখতে শুরু করেছি বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে। এমনই সময় এক বইমেলায় হঠাৎ তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। তাঁর নিজস্ব স্টলে তিনি ছিলেন। চোখা চেহারা, খাড়া নাক আর ক্ষুরধার ব্যক্তিত্ব নিয়ে শ্রীযুক্ত অদ্রীশ বর্ধন।
অনেক কথা হল। দু একটা বই কিনলাম। আর সঙ্গে করে নিয়ে এলাম প্রচুর জ্ঞানের ভান্ডার। বলতে গেলে, সেই থেকে প্রায় অন্ধ ভক্ত হয়ে পড়লাম তাঁর। আমার প্রথম বই ‘আরশিনগর’ তখন সদ্য বেরিয়েছিল। এত ছোট, জাস্ট একটা এক ফর্মার গদ্যের বই, তাই প্রচন্ড কুন্ঠা হচ্ছিল দিতে। তবু দিলাম। খুব একটা আশা ছিল না যে তিনি আদৌ পড়বেন। তবু দিলাম।
আর আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটল সেবার বইমেলা কেটে যাবার দিন দশেক পর। সন্ধেবেলা বাড়ি ফিরে দেখলাম, এসেছে রাজার চিঠি। অদ্রীশ বর্ধন আমাকে চিঠি লিখেছেন! আমার আরশিনগর যে তাঁকে মুগ্ধ করেছে, সেই কথা লিখে আমাকে চিঠি পাঠিয়েছেন তিনি। কী বলব আর। সে ছিল আমার জীবনের এক লাল চিঠির দিন।
এরপর বহু বছর বাদে আবার একদিন দেখা হল তাঁর সাথে। তিনি তখন রীতিমতো প্রৌঢ়, কিন্তু তখনও বলিষ্ঠ। এসেছিলেন জীবনানন্দ সভাঘরে একটা আলোচনা সভায়। সেদিনও তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলাম আমার একটি ছড়ার বই — ‘ছড়াডুম সাজে’। আর এবার দুরুদুরু বুকে প্রতীক্ষা, যদি তিনি পড়েন, যদি তাঁর ভাল লাগে, যদি তিনি আবার একটা চিঠি লেখেন!
অবশেষে প্রতীক্ষা সার্থক হল। আবার এল তাঁর চিঠি, এবার বেশ বড় আকারে। বইয়ের ছড়াগুলির উল্লেখ করে করে তিনি বিশ্লেষণ করেছেন একে একে। আর বইতে একটি ছড়া ছিল, যার মধ্যে কল্পবিজ্ঞানের ভাবনা মিশে ছিল, সেই ছড়াটিকে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলা সাহিত্যে নীরেন্দ্রনাথের পর সম্ভবত দ্বিতীয় কল্পবিজ্ঞানের ছড়া।’ এ যে কী পরম পাওয়া, যে না পেয়েছে সে বুঝবে না।
তারপর কতদিন কেটে গেছে। লেখার জগতে একটু একটু করে জায়গা করছি। অন্যসব বিষয়ের সঙ্গেই কল্পবিজ্ঞান ওতপ্রোত ভাবেই জড়িয়ে আছে সর্বক্ষণ। কল্পবিজ্ঞানের গল্প, ছড়া এসব নিয়েও চর্চা চলছে অন্য সব কিছুর পাশাপাশি। এর মধ্যেই কোন এক সময় হাতে এসে গেছে তাঁর সম্পাদিত ‘আশ্চর্য!’ পত্রিকাটির পাঁচটি সংখ্যা। দেখেছি, কী অনবদ্য চিন্তা আর পরিশ্রমের ফসল ছিল এই পত্রিকা। উল্টেপাল্টে দেখেছি আর মুগ্ধ হয়েছি। শুনেছি, আশ্চর্য বন্ধ হবার পরেও তিনি বের করেছিলেন ‘ফ্যানটাস্টিক’ পত্রিকা। পেয়েছি তারও দু–একটি সংখ্যা। যথারীতি বিস্মিত হয়েছি। মাত্র একজন লোক এত লেখা আর অনুবাদের পরেও কিভাবে এমন পত্রিকা সম্পাদনার কাজ একা করতে পারে ভেবে বারবার চমকে উঠেছি।
এমন সময়, এই সেদিন, হঠাৎ কি খেয়াল হল, বোধহয় পুরোনো আশ্চর্যের খোঁজেই, বেরোলাম সেই মানুষটির খোঁজে। কী এক আশ্চর্য আকর্ষণে, তাঁর পাঠানো সেই চিঠি থেকে ঠিকানা নিয়ে ছুটে গেলাম তাঁকে আরেকবার দেখবো বলে।
খুঁজে খুঁজে পৌঁছেও গেলাম। দেখা হল, কথা হল। এখন তিনি অনেকটাই অথর্ব, কানে ভাল শোনেন না। কিন্তু মনের সেই দাপট আজও আছে। স্মৃতি নিয়ে ফিরে এলাম। খারাপ লাগলেও স্মৃতিটা তো ভোলা যাবে না।
আর তারপর, এল নতুন যুগের যাত্রীরা। এল ‘কল্পবিশ্ব’। একঝাঁক তরুণ প্রবল উন্মাদনায় আর উদ্যমে ভরপুর আবেগ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে নতুন করে কল্পবিজ্ঞানের প্রাণপ্রতিষ্ঠা করতে। প্রতি তিনমাস অন্তর বেরোচ্ছে ‘কল্পবিশ্ব’ ওয়েবজিন। আর সেই ম্যাগাজিনেরই উদ্বোধন করেছেন বাংলা কল্পবিজ্ঞানের জগতের সেই মহাযাত্রী — অদ্রীশ বর্ধন। বুক চওড়া করে বলবার কথা এই যে, সেই উদ্বোধনের দিন আমিও ছিলাম সেই ইতিহাসের অঙ্গীভূত। তাঁর বাড়িতে গিয়ে তাঁর হাতে যখন কল্পবিশ্ব পত্রিকার উদ্বোধন হল, তখন সেই দৃশ্যের সাক্ষী হয়ে মনে হচ্ছিল, আর সবকিছু নশ্বর হলেও, কল্পবিজ্ঞানের মৃত্যু নেই। সে আছে, থাকবে। এইভাবেই এক পুরুষ থেকে আর এক পুরুষে রূপান্তরিত হবে সে, শক্তির মতোই, কিন্তু একেবারে হারিয়ে যাবে না কখনোই।
Tags: কৃষ্ণেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর), দ্বিতীয় বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, সেইসব অমূল্য স্মৃতি, সৌরভ দে, স্মৃতিচারণ