স্বাধীনতার সাধ
লেখক: অর্চিষ্মান সাহা
শিল্পী: অনুব্রীত সাহা, জটায়ু
(১)
সাঁই! ঠাং!…ধড়াম!
তিনটে শব্দ, তারপর কয়েক সেকেন্ডের পিন ড্রপ সাইলেন্স, আর এরপরই তুমুল হুল্লোড় আর উচ্ছ্বাসের বিস্ফোরণ! আর সঙ্গে সঙ্গে চলছে বিজেতার জয়ধ্বনি— “স্টিংগার! স্টিংগার! স্টিংগার!” এরিনার চারটে জায়ান্ট স্ক্রিনে বারবার দেখানো হচ্ছে যে কিছুক্ষণ আগে স্টিংগার কীভাবে অভাবনীয় ক্ষিপ্রতার সঙ্গে তার প্রতিপক্ষকে ‘স্টিং’ দিয়ে গেঁথে মাটিতে ধূলিসাৎ করে দিচ্ছে। এর মধ্যে স্টিংগার একটানে তার স্টিং বের করে ফেলেছে; তার মাথা নীচু থাকায় কেউ তার বাষ্পাছন্ন চোখ আর কাঁপতে থাকা ঠোঁটদুটো দেখতে পাচ্ছে না। তবে একজন সবকিছুই ভাবলেশহীনভাবে লক্ষ করে চলেছেন— গ্র্যান্ড মাস্টার; তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ব্যাটলের শুরু থেকেই স্টিংগারের ওপর আটকে আছে। স্পীকার থেকে উচ্চস্বরে ঘোষিত হল— “ব্রওলার ইজ় স্লেইড! স্টিংগাররররর স্ট্রাইকস্ এগেইইইন!” স্টিংগার সাৎ করে রিট্র্যাক্টটেবল ব্লেড ওরফে স্টিং-টা গুটিয়ে নিল; কয়েকজন লোক তাড়াতাড়ি এসে তার মেকানিক্যাল থ্রাস্টার উইংগুলো খুলে নিলে সে কোনওদিকে না তাকিয়ে এরিনা এক্সিটের দিকে হনহন করে এগিয়ে গেল।
“স্টিংগার ইউ আর দ্য বেস্ট!”, “তোমার জবাব নেই, স্টিংগার!”, “স্টিংগার, হোয়াটস্ দ্য সিক্রেট অব ইয়োর পারফেক্ট স্টিংগিং?”— দর্শক আর সাংবাদিকদের প্রশংসা, প্রশ্নকে কোনওরকম আমলই না দিয়ে সে ডানদিকের প্যাসেজে ঘুরে গেল। কিছুটা দূরেই তার ট্রেনার স্পাইককে দেখতে পেল; স্পাইকের দিকে এগিয়ে যেতেই সে বাধা পেল। জনাকতক নেগোশিয়েটর তাকে ছেঁকে ধরল, এদের কাজ বিভিন্ন এরিনার হয়ে দালালি করা।
“স্টিংগার তুমি অতুলনীয়! ব্লাডলাস্ট এরিনা তোমার কদর বোঝে, জয়েন আস!”
“স্টিংগার, গেট ইন স্লটারহাউস এরিনা। ফাইনাল ম্যাচে তুমি নিঃসন্দেহে জিতছ, উই উইল গেট ইউ দ্য বেস্ট প্লেস ইন নিউ ওয়ার্ল্ড আফটার দ্যাট।”
স্টিংগার বাকিদের আর কিছু বলতে না দিয়ে বিব্রত কণ্ঠে বলল, “দেখুন, আমার রিক্রুটমেন্টের জন্য দ্য অ্যাবিসের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করুন। তাদের অনুমতি ছাড়া আমার কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার নেই।”
“ও! ডোন্ট ওরি অ্যাবাউট দ্যাট, তুমি শুধু একবার মুখ ফুটে বলো। বাকিটা আমি দেখে নিচ্ছি।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, স্টিংগার। তোমার ইচ্ছাটাই সব, বাকি সব ফর্ম্যালিটিস অ্যাবসোলিউট কার্নেজ এরিনা বুঝে নেবে।”
শেষজনের কথাটা শোনামাত্রই স্টিংগারের মাথা দপ্ করে জ্বলে উঠল! স্টিংগার একহাতে তার গলা টিপে তাকে শূন্যে তুলে ধরল।
“তাই রে, হারামজাদা! আমার ইচ্ছাটাই সব! এই… এই যে এতগুলো খুন করেছি, এই জঘন্য নরকে দিনের পর দিন পড়ে আছি তোদের হাতের পুতুল হয়ে, এগুলো সব আমার ইচ্ছায়!”, বহুদিনের জমে থাকা ক্ষোভ, অভিমান, ঘৃণা স্টিংগার উগরে দেয় প্রত্যেকটা শব্দে। শূন্যে ঝুলে থাকা লোকটা কয়েকবার স্টিংগারের বজ্রমুষ্টি থেকে মুক্ত হওয়ার বৃথা চেষ্টা করে এখন প্রায় নেতিয়ে পড়েছে। কিন্তু আশপাশের লোকজন এতটাই হতচকিত আর ভয়ার্ত যে কেউ তার সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারছে না।
“স্টিংগার, স্টিংগার! ওকে ছেড়ে দাও, তুমি কিন্তু টুর্নামেন্ট থেকে ডিসকোয়ালিফায়েড হয়ে যাবে। ইউ কেম দিস ফার, ডোন্ট ওয়েস্ট দিস চান্স ফর হিম”, স্পাইক খুব কষ্টে পা ঘষটে ঘষটে এগিয়ে এসে তাকে সাবধান করতে যায়। স্টিংগার আর কিছুক্ষণ সেই লোকটার দিকে কটমট করে তাকিয়ে তাকে ওই অবস্থাতেই সটান ছেড়ে দেয়। লোকটা ধপ করে নীচে পড়ে যায়। স্টিংগার তখন আর কোনওদিকে না তাকিয়ে স্পাইককে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। পিছন থেকে সেই লোকটা কঁকিয়ে ওঠে, “ব্লাডি বাস্টার্ড! আমরা তোদের তুলে নিয়ে না আসলে না কবেই চিল-শকুন তোদের সাবাড় করে দিত। নিমকহারাম কোথাকার, খানিক লাই পেয়েছে বলে মাথায় চড়ে বসেছে!” স্টিংগার আর স্পাইক ততক্ষণে অনেকদূর চলে গেছে।
(২)
স্টিংগার তার ছোট্ট কেবিনের খুপরি জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল, আর্টিফিশিয়াল ম্যানিফেস্টনে তার ঘরটা জ্যোৎস্নায় ভরে গেছে। তার এই সামান্য বিলাসিতা এরিনার বাকি ফাইটারদের কাছে প্রাচুর্য। সে নিজেও মাসখানেক আগে এসবের কথা ভাবতেও পারত না। তার মেমারি স্টোরেজে সবচেয়ে পুরোনো স্মৃতি হল এখানকার একটা চার্জিং পডে জেগে ওঠার। তার মনে সেদিনের ঘটনা যেন স্লাইড বাই স্লাইড চলতে শুরু করে— লেন্সে ভিস্যুয়াল অ্যাডজাস্টমেন্ট হতে হতেই তার শরীরটা পড ছেড়ে আপনাআপনি উঠে পড়ে, তার উঠে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে হুড়মুড় করে দু’জন লোক একটা ডিসম্যান্টল্ড হিউম্যানয়েড ভাসমান অবস্থায় নিয়ে ঘরে ঢুকে আসে। তারা সেটাকে তাড়াতাড়ি পডে চাপিয়ে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। তাদের একজন কোমরে দু’হাত রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “আজকের মেকাটা ভীষণ অ্যাগ্রেসিভ, নক আউটের পরেও একে দুমদাম পিটিয়ে যাচ্ছিল। যা ক্ষেপেছিল, ওরকম আর কিছুক্ষণ চললে বোধহয় গ্যালারির দিকেও তেড়ে যেত।”
—হুঁ, ভাগ্যিস সময়মত গ্র্যান্ড মাস্টার ওঁকে কাবুতে এনেছেন। টোটাল শাটডাউনের পরও ওর ধারেকাছে যেতেও ভয় লাগছিল, কোনওরকমে এটাকে হোভারিং বিমে এনে ছুট লাগিয়েছি।
—হা হা, তোমার যা ভয়… আরে এটাকে অ্যাক্টিভ করো, দাঁড়িয়ে আছে এতক্ষণ। বেচারা নিউবি, কোন কুক্ষণে যে আজ এর এন্ট্রি হয়েছে…
তারপর তার কিছু বলে ওঠার আগেই সেই দু’জন তার দিকে এগিয়ে এসে জায়গায় জায়গায় মেশিনারি চেক আপ শুরু করে দেয়, অবশেষে তাকে পুরোপুরি অ্যাক্টিভ করে। তারপর ওদের একজন একটা হলোগ্রাফিক প্যানেলে চোখ রেখে বলে, “বি সিরিজের প্রথম মেকাফাইটার টার্মিনেটেড, সেকেন্ড ওয়ান ইজ় আপ নাও। বি২ ইজ় রেজিস্টার্ড ফর আ ব্যাটল টু ডেথ।”
এরপর সেই লোকটা খানিক খেয়ালের বশেই তার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলে, “লাস্ট এ বিট মোর টাইম, বি২। গুড লাক।”
আর সঙ্গে সঙ্গে তার যান্ত্রিক পা জোড়া তাকে নিয়ে চলল সেই ঘরের বাইরে। দুটো চোখ বাদে বাকি সবকিছুই যেন একটা মন্ত্রের বশে এগিয়ে চলছে, তাই চোখ দুটোকেই সে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আশপাশের পরিবেশ ঠাহর করার চেষ্টা করল। তবে বিশেষ সুবিধা হল না, অন্ধকার একটা প্যাসেজে সে ভারী আওয়াজ তুলতে তুলতে এগিয়ে চলল। এরকম কিছুক্ষণ চলার পর মোড় ঘুরতেই প্যাসেজের শেষে চোখ ঝলসানো আলোর একটা চৌকো আকার দেখতে পেল, যার উপরে সেই প্রাচীন এলইডি আলোয় সরতে থাকা একটা লাইন দেখা যাচ্ছে— ‘ডোন্ট রিটার্ন বিফোর দ্য লাস্ট ব্রেথ, আইদার হিজ় অর ইয়োর্স’। সেদিন এরপর যা ঘটে তার কোনো যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা আজও খুঁজে পায়নি আজকের স্টিংগার। এরিনাতে ঢুকেই সামনে যা দেখতে পেল, তাতে সাধারণ মানুষ হলে তার পা দুটো কাঁপতে কাঁপতে হাঁটুতে ঠোকাঠুকি লেগে যেত।
তার থেকে খানিক দূরেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফুঁসছে এক অতিকায় দু’পেয়ে যান্ত্রিক ষাঁড়, প্রতিহিংসায় যেন তার চোখদুটো লাল আলোয় জ্বলজ্বল করছে। “অ্যান্ড এগেইন আনাদর নিউবি হ্যাজ় ফাউন্ড হিজ় ওয়ে টু দ্য ডিমোলিশার, দ্য মার্সিলেস, মিইইইনোতরররর! লেট্স সি হাউ লংগ দিস ওয়ান লাস্টস্”, ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দুম্ দুম্ শব্দে এগিয়ে আসতে থাকল অতিকায় সেই যান্ত্রিক দৈত্য। তার প্রত্যেকটা পদধ্বনির সঙ্গে সঙ্গে চারিদিক থেকে ধেয়ে আসতে থাকল মৃত্যুর পরোয়ানা— “স্লে! স্লে! স্লে!” ভারী পদক্ষেপে ধীরে ধীরে এগিয়ে সে হঠাৎ তীব্র যান্ত্রিক গর্জন করে অভাবনীয় দ্রুতগতিতে ছুটে আসল। বি২ যেন তখনই সেই তীব্র কালান্তক ঝড়ের আঘাতে খড়কুটোর মত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আমাদের আজকের স্টিংগার এই অসম শক্তির বিরুদ্ধে নির্ভীকভাবে রুখে দাঁড়াত, কিন্তু বি২ আসন্ন পরিণতির কথা ভেবে চোখ বন্ধ করে ফেলে। হঠাৎ তার সারা শরীর জুড়ে এক অদ্ভুত শিহরণ খেলে যায়, সে সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে স্প্রিংয়ের মতো সামনের দিকে ছিটকে যায়। তার যান্ত্রিক পা দুটো তাকে শূন্যে ছুড়ে দেয়, মুহূর্তের মধ্যে তার নীচ দিয়ে একটা কালো ঝড় ডিভাইডারে গিয়ে সশব্দে ধাক্কা খায়। সারা এরিনা থরথর করে কেঁপে ওঠে। এদিকে বি২ হালকা ঝাঁকুনির সঙ্গে মাটিতে নামে, সে ধীরে ধীরে চোখ খুলে দেখে তার সারা শরীর একদম অক্ষত আছে। সারা এরিনা জুড়ে আর টু শব্দটুকুও শোনা যায় না। বি২ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ডিভাইডারে গেঁথে রয়েছে, হাত-পা ছুড়ে সে নিজেকে মুক্ত করতে চাইছে। এমন সময় বি২-এর সার্কিটে চিড়িক্ করে বিদ্যুৎ খেলে যায়, দুরন্ত গতিতে সে ক্ষতিগ্রস্ত ডিভাইডারের দিকে ধুলোর ঝড় উড়িয়ে ছুটে চলে। ডিভাইডারের কাছাকাছি আসতেই সে ফের একটা উঁচু লাফ মারে। ওদিকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী অনেক চেষ্টার পর নিজেকে ডিভাইডার ওয়ালের থেকে ছাড়িয়ে এনেছে, এমন সময় আচমকা তার ঘাড়ে কিছু একটা আছড়ে পড়ে। মাথা ফিরিয়ে দেখার আগেই তার গলার দু’পাশের সেন্সর তীক্ষ্ণ আঘাতে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল। বি২ ঘাড়ের সঠিক জায়গায় ক্যালকুলেটেড ফোর্স প্রয়োগ করে পৌঁছে গেছে সারা শরীর সংযুক্ত রাখা কোর কর্ডে। সে কোনওরকম সময় নষ্ট না করে হাতের নাগালে থাকা মোটা তারটা দৃঢ়ভাবে চেপে ধরে উপরের দিকে অমানুষিক বলে টেনে ধরল। এদিকে কিছুক্ষণ আগে যাকে বিভীষিকাময় লাগছিল তাকে এখন খুব অসহায় দেখাচ্ছে, জলছাড়া মাছের মতো সে ছটফট করে চলেছে। এর মধ্যে বি২ নিজের কাজ অনেকটাই এগিয়ে ফেলেছে, অবিশ্বাস্য দক্ষতার সঙ্গে সে মিনোতরের মাথা ধড় থেকে আলাদা করে এনেছে। তার মাথাটা কেবল কোর কর্ডের মাধ্যমে দেহের সঙ্গে কানেক্টেড আছে। এতখানি সময়ে দর্শকেরা নিশ্চুপই হয়ে রয়েছে, বিস্ফারিত চোখে তারা দেখে চলেছে কীভাবে ভাগ্যের ফেরে নিমেষের মধ্যে পরিস্থিতি বদলে যায়। হঠাৎ চিড়্ চিড়্ আওয়াজে এরিনার নিস্তব্ধতা কেটে গেল, গ্যালারির সবাই সিট ছেড়ে সামনের এরিনার দিকে ঝুঁকে পড়ল। বি২ সশব্দে মাটিতে নেমে পড়ল, দু’হাতে থাকা বস্তুটা সে শূন্যে তুলে ধরল। মিনোতরের ছিন্ন মাথা দেখে দর্শকেরা আতঙ্কে শিউরে উঠল। রক্তের মতো তার বিচ্ছিন্ন কোর কর্ড থেকে ইলেকট্রিক স্পার্ক ঝরে পড়ছে। তবে সেই থমথমে পরিবেশের রেশ বেশিক্ষণ থাকল না। আচমকাই সমস্ত গ্যালারি উল্লাসে ফেটে পড়ল, তারা মুষ্টিবদ্ধ হাত শূন্যে ছুড়ে তাদের বিজেতাকে ঘোষণা করতে থাকল— “নিউবি! নিউবি! নিউবি!” এতক্ষণ বি২ যেন একটা ঘোরে ছিল, সম্বিৎ ফিরে পেতেই তার সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। সশব্দে তার হাত থেকে খসে পড়ল মিনোতরের মাথা, সামনে পড়ে থাকা বীভৎস মুণ্ডহীন দেহটা দেখে তার পা টলে গেল। এ কী করেছে সে! এই ভয়ানক কাজটা সে করে উঠলই বা কী করে! কিন্তু চারদিকের শোরগোল তার বিস্ফারিত চাহনি আর দ্বিধাগ্রস্ত দেহভঙ্গিকে কোনওরকম তোয়াক্কা না করেই আরেক পরত বেড়ে ওঠে; আর এর সঙ্গে যোগ দেয় স্পীকারের বিস্ময়াবিষ্ট কণ্ঠ, “হোয়াট ডু আই সি! এ আমি কী দেখছি! ইন জাস্ট সাম মেয়ার সেকেন্ডস এই নিউবি সাক্ষাৎ ডেথ গড, যমকে কুপোকাত করে ফেলেছে! দিস ইজ় ইনক্রেডিবল!” এর মধ্যে এরিনার ভেতর চলে এসেছে কিছু মেকানিক; সামনের নিথর দেহটাকে তারা খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করে, বিভিন্ন পার্টস খুলে কীসব দেখতে থাকে। চেস্টপ্লেট খুলতেই ভস্ভস্ করে ধোঁয়া বেরিয়ে আসে, তারা ভিতরে হাত চালিয়ে সজোরে টান দিয়ে কিছু বের করে আনে। একটা দগ্ধপ্রায় নরমুণ্ড, বার্নড টু ক্রিস্প! সেই দৃশ্য দেখে বি২ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না, সেখানেই ধপ্ করে বসে পড়ে। তার সেন্সরগুলো ধীরে ধীরে নিঃসাড় হয়ে যেতে থাকে। চারিদিকের ছন্দবদ্ধ উল্লাসের গণ্ডি পেরিয়ে কিছু কথা তার কানে আসে— ‘সিস্টেম ফেলিঅর’, ‘ফুল্লি টোট্যাল্ড’, ‘আনরিডিমেবল’। অধিকাংশ সেন্সর নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে যেতে তার খেয়াল হয় এরিনা এন্ট্রান্স দিয়ে দিয়ে কে যেন পা ঘষটে ঘষটে এগিয়ে আসছে এদিকেই, তার চেহারায় উদ্বিগ্নতার ছাপ স্পষ্ট। এরপরের ঘটনার ভিস্যুয়ালস্ তার মেমারিতে স্টোরড্ নেই, তবে কোনওভাবে অডিয়ো রিসিভার তখনও চালু থাকায় বেশ কিছুক্ষণের রেকর্ডিং রয়েছে। এখন সেসব শব্দ, কথার মধ্যে দিয়ে স্টিংগার আর যেতে চাইল না; তার ইচ্ছে থাকলেও অবশ্য উপায় ছিল না, হেভি এনক্রিপশন দিয়ে সে সেই সেকশন থেকে পুরোপুরি লক্ড আউট।
(৩)
খুট্ করে একটা শব্দ হতেই মুহূর্তের মধ্যে একটা ব্লেড উড়ে গেছিল দরজার দিকে। কিন্তু সেটা লক্ষ্যে গিয়ে বিঁধতে পারল না, আগন্তুকের থেকে ইঞ্চিখানেক দূরে শূন্যে কিছুক্ষণ ভাসমান অবস্থায় আস্ফালন করে মাটিতে অবসর নিল।
“নাইস রিফ্লেক্সেস, স্টিংগার। অ্যান্ড ইউ গট কোয়াইট দ্য প্রিসাইনেস, আরেকটু হলে আমার কোর সার্কিটের দফারফা হয়ে যেত। কিন্তু এ বুড়ো হাড়ে এখনও দম আছে, কী বলো?”
–আরে, স্পাইক! এত রাতে তুমি এখানে?
হোভার টেকটা বন্ধ করে মুখের সামনে থেকে হাত সরিয়ে নিল স্পাইক। ঘরের ভেতরে আসতেই অন্ধকার সরে গিয়ে তার আমুদে মুখটা দেখা গেল। চারদিকের সবকিছুর দিকে গোল্লা গোল্লা চোখ ঘুরিয়ে অবশেষে সে একটা টুলে বসে পড়ল।
“বাঃ, বেশ দারুণ ব্যাপার তো! তোমার কোনও কিছুরই খামতি রাখেনি তো এরা”, স্টিংগারের দিকে পিটপিট করে চেয়ে বলল স্পাইক।
কী ব্যাপার? স্পাইক কি হ্যালুসিনোভাইরাস ঢুকিয়েছে নাকি সিস্টেমে? এঘরে তার আনাগোনা তো লেগেই থাকে, আজ এমন কী নতুন দেখে বসল? অথচ কাল এত বড় একটা দিন, আর তার আগের রাত্রেই স্পাইক নার্কোটিকস নিয়ে ফেলল! স্টিংগার পড ছেড়ে নেমে এসে তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “স্পাইক, স্পাইক! আর ইউ সোবার? এসব কী ছাইপাঁশ বকছো?”
তার কথায় কোনওরকম আমল না দিয়ে উদাসী গলায় স্পাইক বলে চলল, “আমি কোনওদিন এসব ভোগ করতে পারিনি, বুঝলে? এরিনার আর পাঁচটা ফাইটারও এতকিছু পায় না। কিন্তু হ্যাঁ, দিয়েগো পেয়েছিল! ঠিক এই, ঠিক এই ঘর থেকেই একদিন ও সারা অ্যাবিসে সন্ত্রাসের রাজত্ব চালাত। নো ওয়ান ইন দেয়ার রাইট মাইন্ড ডেয়ার্ড টু বি এনিহোয়্যার নিয়ার দিস প্লেস। আর দিয়েগো যেদিন এই ঘর ছেড়ে এরিনার দিকে রওনা হত, সেদিনই তার প্রতিপক্ষের শেষ দিন হিসেবে স্থির হয়ে যেত— তা সে যেই হোক না কেন। এন্টায়ার মেকাফাইটার রেসে ওর মতো ব্যাক-টু-ব্যাক টোটাল ড্যামেজ-এর রেকর্ড ভাঙবার ক্ষমতা আজও কারো নেই। অত্যন্ত নৃশংসতার সঙ্গে ও সামনের জনকে কচুকাটা করে ছাড়ত, নান অফ হিজ় অপোনেন্টস্ ওয়্যার টু বি সিন এভার এগেইন।”
এতখানি বলার পর সে থামল। তার হাবভাব মোটেও সুবিধার মনে হচ্ছিল না স্টিংগারের; গুছিয়ে এত কথা বলা তো দূর, স্পাইক কোনওদিন একটা অপ্রয়োজনীয় শব্দও উচ্চারণ করে না! স্টিংগারের সেই প্রথম ব্যাটল দেখে দ্য অ্যাবিস-এর ম্যানেজমেণ্ট প্রভূত মুনাফার সম্ভাবনা দেখতে পায়। সামান্য কিছুদিনের মধ্যেই স্পাইককে তার স্পেশ্যাল ট্রেনার হিসেবে অ্যাসাইন করা হয়। সে আগে সুকৌশলী যোদ্ধা হলেও তার পায়ের আঘাতের জন্য সে শুধু এখন এরিনাতে ফাইট মাস্টার হিসেবে নিযুক্ত রয়েছে। অত্যন্ত স্বল্পভাষী স্পাইক সবসময় তার নভিসটিকে কঠোর শাসনের আওতায় রাখতো। মাঝে মাঝে তো মনে হত সে যেন বি২-এর জীবনকে নরক করে তোলার পার্সোনাল ভেনডেটা নিয়ে রেখেছে। বি২ যে নবজাতকের মন নিয়ে তার চারপাশ বুঝে ওঠার চেষ্টা করছে, ঠিক সেই অনভ্যস্ত মনকেই একের পর এক বুঝে চলতে হচ্ছে নানান রণকৌশল। আর পান থেকে চুন খসলেই সারা শরীর দিয়ে বয়ে যেত অসহনীয় ব্যথা। সাধারণত এই ব্যাপারটার কন্ট্রোল থাকে গ্র্যান্ড মাস্টারের হাতে, সারা অ্যাবিসের ফাইটারদের সঙ্গে তার একটা সাইকিক লিঙ্ক অ্যারেঞ্জড আছে। এরিনার ভেতর হোক কী বাইরে, দ্য অ্যাবিস চত্বরের মধ্যে থাকা যে কোনো মেকাফাইটার কোনোরকম বেগড়বাই করলেই নিমেষের মধ্যে তার কাছে পৌঁছে যায় এই অব্যর্থ তরঙ্গ। তবে ট্রেনিং-এর প্রয়োজনে স্পাইকের সিস্টেমে এই ক্ষমতাটি এনাবল্ করা হয়েছিল। সেই স্পাইক এতদিন পর হঠাৎ তার চেনা ছকের বাইরে বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু কারণ কী হতে পারে? তার শিক্ষানবিশের উন্নতি দেখে ‘পুরনো সোনালী দিনের কথা’ মনে পড়ছে? নাকি… নাঃ, কোনোকিছুতেই এত সহজে আশ্বস্ত হওয়া উচিত না, সামান্য সময়ের অভিজ্ঞতায় কাউকে নিজের বিশ্বাসের ভাগীদার করে তোলার মত মূর্খামির কাজ আর হয় না- এ শিক্ষা সে স্পাইকের থেকেই পেয়েছে। স্টিংগার চুপচাপ তার কেবিনের এ. আই.-কে ম্যালফাংশন স্ক্যান শুরু করার কমান্ড দিয়ে দেয়। এরমধ্যেই স্পাইক মুখে একটা শুকনো হাসি ঝুলিয়ে ফের শুরু করলো-
“কিন্তু এই নির্দয়, পাষাণহৃদয় দিয়েগোরই সম্পূর্ণ এক আলাদা সত্তা যে তারমধ্যেই জিইয়ে ছিল একথা কে জানত? মোস্ট পিপল ডাজ়ন্ট রিয়েলি নো অ্যাবাউট দিস সাইড অফ হিজ, তবে তার এই দিকটার আকস্মিক প্রকাশের ফলাফল সবাই বেশ ভালোভাবেই টের পেয়েছিল। প্রথমে তার যুদ্ধপিপাসায় ঘাটতি দেখা দিল, প্রতিপক্ষের দিকে হানা তার প্রত্যেকটা আঘাত ভীষণই ঠুনকো দেখাতে থাকলো। শুধুমাত্র অর্জিত প্রতিপত্তির জেরেই তখনও কেউ তার কাছাকাছি ঘেঁষতে সাহস করতো না। কিন্তু একটা সময় সে এরিনাকেও বয়কট করলো। কন্টিন্যুয়াস সাইকিক স্ট্রাইকস্ কান্ট ইভেন গেট হিম আউট অফ দিস রুম, অ্যান্ড নো ওয়ান ডেয়ার্ড টু চেক আপোন হিম। সবাই জানতো এরপর কী হতে চলেছে , তারা শুধু এই অপেক্ষায় ছিল যে কখন সেটা হবে। অবশেষে ডাক এল, অলমোস্ট আ উইক আফটার হিজ সলিটারি সেশন হি ওয়াজ কল্ড আপোন। স্বয়ং উপরওয়ালা, দ্য গ্র্যান্ড মাস্টার তার ইভ্যালুয়েশন নেবেন। আর এ ডাক লিটরেলি আর ফিগারেটিভলি দুইভাবেই অগ্রাহ্য করা যায় না, এরিনা রেঞ্জের প্রত্যেকটা মেকাফাইটারের উপর তার সর্বৈব নিয়ন্ত্রণ আছে। দিয়োগোর মন না চাইলেও তার পা দুটো তাকে ঠিক পৌঁছে দেবে উদ্দিষ্ট স্থানে। আর এই “ইভ্যালুয়েশন”-এর মানে মোটামুটি সবারই জানা আছে- ডিরেক্ট টার্মিনেশন, আজ পর্যন্ত যারা এই সমন পেয়েছে তাদের আর এই এরিনার চৌহদ্দিতে কখনো দেখা যায়নি। তাই একদিন হঠাৎ যন্ত্রচালিতের মতো দিয়েগো ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসায় কেউ আশ্চর্য হয়ে ওঠেনি, বরং একসময়ের নিষ্ঠুর ঘাতককে মৃত্যুখাদের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে অনেকে মনে মনে খুশিই হয়েছিল। তাছাড়া, সবারই এরকম ডেথ মার্চ দেখার অভিজ্ঞতা প্রায়শই হয়, সেইসব ফাঁসির আসামীরা নিজেদের মৃত্যু নিশ্চিত জেনে তার যাওয়ার সারাটা পথ অশ্রাব্য গালিগালাজ, নিষ্ফল হুমকি দিয়ে ভরিয়ে দেয়, কেউ কেউ আতঙ্কে কাঁটা হয়ে চুপটি করে এগিয়ে যায়, কেউ আবার রীতিমতো কান্নাকাটি জুড়ে দেয়। বাট দেয়ার ওয়াজ সামথিং ডিফারেন্ট দিস টাইম, যাওয়ার সময় দিয়োগোর মুখ দিয়ে একটা কথাও বেরোল না, তার চেহারাতেও বিন্দুমাত্র ভয়ের আভাস ছিল না। হিজ পস্চার ওয়াজ ফার্ম, হি ওয়াজ ওয়াকিং টুয়ার্ড হিজ ডুম উইথ আ নার্ভ অফ স্টিল। একটা লম্বা প্যাসেজ পার করে ডানদিকে মুড়লে ইভ্যালুয়েশন হাব, এই গোটা পথটায় সে মুখে একইরকম ভাব ফুটিয়ে রেখে হেঁটে চলেছিল। যেন এক সাহসী বীর শরীরে হাজারটা যুদ্ধের ক্ষত বয়ে নিয়ে চলেছে তার অন্তিম দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে; তার মনে কোনোরকম যন্ত্রণা, দুঃখ, কষ্টের ভাবাবেগের উৎপত্তি হলেও তা ছিল সঙ্গোপনে। এইভাবেই আরেক মেকাফাইটার তার দ্বিতীয় জীবনের শেষদিনটাও পার করে ফেলত, হয়ত তার নৃশংসতার জন্য বা তাকে এক কাল্ট বিনোদন মাধ্যম হিসেবে কয়েকজন আরো কিছুদিন মনে রাখত। কিন্তু ব্যস্ ওইটুকুই, ফের নতুন কোনো বিনোদন খুঁজে নিতে তাদের সময় লাগত সামান্য কিছুটাই। বাট মেইবি দিয়েগো ওয়াজ বর্ন টু ফাইট এগেইনস্ট অল অডস্। সপ্তাহখানেকের মধ্যেই সে ফিরে এল। কিন্তু যে দৃঢ়তার সঙ্গে সবাই তাকে যেতে দেখেছিল, তার সিকিভাগও যেন অবশিষ্ট ছিল না। আর তা হবেই বা কী করে? হি ওয়েন্ট দেয়ার ইন আ হোপ অফ অ্যাটোনমেণ্ট, বাট জাস্ট কেম ব্যাক উইথ অ্যানাদার ডার্টি জব অন হ্যান্ড। আর এ কাজ করতে সে বাধ্য, কারণ এটাই যে একমাত্র উপায় যা তাকে এই পাপের দুনিয়া থেকে চিরমুক্তি এনে দেবে। সে… সে এক নতুন জীবন শুরু করতে পারবে, বেইসড কম্প্লিটলি অন হিজ ওউন টার্মস! আর শর্ত? কী করতে হবে তাকে? আর একবার নামতে সেই ভয়াল রণভূমিতে, নিষ্পাপ, নবজাতক নিউবিদের দেহাংশ আর বডি ফ্লুয়িডে ছত্রাকার করতে হবে সারা এরিনা -যাতে প্রমাণ হবে যে এরিনা অথরিটির প্রতি সে এখনো সমানভাবে অনুগত। যে কাজ থেকে সে চিরতরে নিবৃত্ত হতে চেয়েছিল, তারই জঘন্যতম রূপকে নিজের হাতে ফুটিয়ে তুলতে হবে -এই হল তার আনুগত্যের মূল্য, ওয়ান লাস্ট প্রাইস টু পে টু গেট অ্যাওয়ে ফ্রম হিজ সিনস্।”
এর মধ্যে বারকয়েক ম্যালফাংশন স্ক্যান শুরু হয়ে শেষও হয়ে গেছে; কিন্তু না, প্রতিটা রিপোর্টের একবারেও স্পাইকের সিস্টেমে স্টিংগার কোনোরকম গলদের সন্ধান পায়নি। সে স্পাইকের দিকে আড়চোখে চাইতে গিয়ে দেখলো স্পাইকের নজরও তার দিকে, তার মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো। সে একটা ভৎর্সনার সুরে বলল,”হ্যাঃ, কিছু পেলে না, তাই তো? পাবেও না, তোমার ওই ইনবিল্ট স্ক্যানার একদমই ওয়ার্থলেস! আর ভেবেছিলেটাই বা কী? যে বুড়োর সিস্টেমটা একদমই গেছে? যে আমি বুড়িয়ে গিয়ে, নস্টালজিক হয়ে অকাজের রাবিশ বকছি! ন্যাঃ, নট ইভেন ক্লোজ! এইসব যন্ত্রচালিত দাসগুলোর মধ্যে আমি সবচেয়ে খাঁটি, নির্ভেজাল কাজের কথা বলি! এতক্ষণ ধরে এতকথা আমি নিরর্থক বলে চলিনি, একথা শোনার দায় আছে তোমার। অনলি ইউ হ্যাভ দ্য গডড্যাম রেসপন্সেবিলিটি!”
এরপরেই সে হঠাৎ সে তড়াক করে টুল থেকে লাফিয়ে উঠলো! স্টিংগার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কিছুটা পিছিয়ে আসলো, কিছু বলে উঠতে চাইলো। কিন্তু না, তার সব কথা তার মুখেই আটকে থেকে গেল, এমনকি সে আর নড়াচড়াও করতে পারলো না। তার সমস্ত শরীর আড়ষ্ট হয়ে এসেছে, সে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলো যে স্পাইক নিজের যান্ত্রিক ডানহাতটা সামনে তুলে ধীরে ধীরে পা ফেলে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। স্পাইক কোনোভাবে তার সব মোটর অ্যাক্টিভিটি বন্ধ করে দিয়ে তাকে সম্পূর্ণভাবে চলৎশক্তিহীন করে দিয়েছে। ইনিশিয়াল স্টেজের নভিসদের ট্রেনিংয়ের জন্য ট্রেনারদের কাছে এই সুবিধাটা দেওয়া থাকে। কিন্তু এতদিনে তো অথরিটির তা ফিরিয়ে নেওয়ার কথা, আর স্পাইক এরকম করছেই বা কেন! -এর কোনোরকম সদুত্তর স্টিংগারের মাথায় এলো না। স্পাইক ততক্ষণে তার বেশ কাছে চলে এসেছে। সে ফের বলতে শুরু করলো,
“অথরিটির সঙ্গে মেকাদের কোনোরকম ডিল হলে তা বাইরে কোনোভাবেই অন্য কেউ জানতে পারে না। হাই সিক্রেসি মেইনটেন করা হয়, বুঝেছ? অ্যান্ড দিয়েগোজ ম্যাটার ওয়াজ কোয়াইট সেন্সিটিভ, দে উড কিল… হ্যাঁ! ক্লোজড সার্কলের বাইরে যাতে এখবর না বেরোয় তার জন্য ওরা মারতেও প্রস্তুত ছিল। দেয়ার সো-কল্ড রেপুটেশন ওয়াজ দ্যাট ইম্পরট্যান্ট! তবে আমি কী করে জানলাম? উঁ? উঁ? হ্যাঃ হ্যাঃ হ্যা! আমি ছাড়া আর কে জানবে? ডোন্ট পিপল টেল অল কাইন্ড অফ স্টাফ টু দ্য ওয়ানস ডিয়ারেস্ট টু দেয়ার হার্ট? সেদিন দিয়েগোও আমাকে বলেছিল; দুচোখ ভরা জল নিয়ে আর শরীর মুচড়ে দেওয়া অসহ্য যন্ত্রণা উজাড় করে দিয়ে ও বলেছিল যে ও পারবে না, পারবে না সেই ভয়াবহতার সামনাসামনি হতে, পারবে না নবজাতকদের মতোই নতুন জীবন পাওয়া মানুষদের নিমেষের মধ্যে শেষ করে দিতে। এককালে সে যতই নৃশংস হোক না কেন, সেদিনের দিয়েগোর মন কোনোভাবেই একাজে সায় দিচ্ছিল না। কিন্তু আমি যে ছিলাম বড়োই স্বার্থপর, আমাদের জন্য স্বার্থপর। ওকে অনেক বুঝিয়ে, অনেক বুঝিয়ে সেই পাপকাজের জন্য রাজি করালাম। ওকে বোঝালাম যে এই জঘন্য পথ ধরে সে যদি আর একটিবার মাত্র এগিয়ে যায়, তবে আর কোনোদিনই এপথ তাকে ধরতে হবে না। আই টোল্ড হিম দ্যাট আই উইল কাম আপ উইথ আ ওয়ে টু গ্যাদার অল দ্য ডার্কনেস ইন হিজ মাইন্ড হুউচ উইল ব্লাইন্ড হিজ ভিসনস্ অ্যাণ্ড হেল্প হিম বি দ্য মনস্টার ওয়ান্স হি ওয়াজ। চেষ্টার কোনোরকম ত্রুটি রাখিনি আমরা আমাদের মুক্তির পথ মসৃণ করতে, ইভেন এভরিথিং ওয়াজ ওয়ার্কিং ওয়েল অ্যাকর্ডিং টু দ্য প্ল্যান। দর্শকরা দিয়েগোর মত্ত রূপ ফিরে পেয়ে হুল্লোড়ে লুটোপুটি খাচ্ছিল, কিন্তু, কিন্তু… এরপর যা হল তা একদমই…” স্পাইকের গলা খানিক কেঁপে গেল, “একদমই আশা করতে পারিনি আমি। ইট ওয়াজ মাই ফল্ট, মাই ফল্ট! দিয়েগোর বদলে এরিনা থেকে বেরিয়ে আসলো ওর ভাঙাচোরা এক্সোস্কেলিটন, অ্যান্ড হিজ চার্ড কারকাস! দ্যাট স্কাউন্ড্রেল ডিমলিশ্ড হিম উইদিন ফ্রিকিং মিনিটস্, মিনিটস্! বিধাতার পরিহাস আমাদের তিল তিল করে গড়ে ওঠা স্বপ্নকে সামান্য কয়েক মুহূর্তে ভেঙে খানখান করে দিল!”
স্পাইক মাথা নীচু করে লম্বা লম্বা শ্বাস নিতে থাকল, তার গতিক বিশেষ ভালো ঠেকল না স্টিংগারের। তার জেগে থাকা ইন্দ্রিয়গুলো কানফাটানো আওয়াজে বিপদের ঘণ্টি বাজাছে, আবেগের বশে স্পাইক যে কোনও কিছু করে বসতে পারে এখন। তাই এই কয়েক মুহূর্তে তার অলক্ষ্যে স্টিংগার সিস্টেম ওভাররাইড করে নিজেকে সচল করবার চেষ্টা করল। কিন্তু তখনই স্পাইক সটান মাথা তুলে তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল, তার চোখদুটো যেন রীতিমতো দপদপ করে জ্বলছে। তার চাহনিতে ঘৃণা, ক্রোধ, কষ্ট মিশে এক ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। স্টিংগারের শরীর আরো আড়ষ্ট হয়ে যেতে থাকল।
“আরে, দাঁড়াও দাঁড়াও। অত তাড়া কীসের? এই গোটা গল্পটায় তোমার জায়গাটা তো জেনে যাও। কী ভেবেছ যে তোমার জীবনের প্রথম দিনটা অডিয়েন্স অ্যাপলৌস আর একটা অ্যাড্রিনালিন-রাসিং ব্যাটল সিকুয়েন্স দিয়েই শুরু আর শেষ হয়ে যাবে? না, একদমই না। ইউ হ্যাভ টু ফেস দ্য কনসিকুয়েন্সেস অফ দ্য হরর ইউ ব্রট ডাউন আপোন আস”, বলে স্পাইক তার তর্জনী আর মধ্যমা এক করতেই সেই দুটো জুড়ে একটা ড্রাইভের আকার নিল। সঙ্গে সঙ্গে স্টিংগার বুঝতে পারল যে তারও গলার পাশে ছোট্ট একটা প্যানেল খুলে গিয়ে একটা সকেটকে দৃশ্যমান করেছে। কোনও কারণে তার এই ব্যাপারটা বেশ পরিচিত মনে হতে থাকল, যেন এটা এক দেজা ভু। স্পাইক নিজের হাতটা ওর ঘাড়ের কাছে এনে বলল, “তুমি সেদিন শুধুমাত্র দিয়েগোকে চিরতরে অকেজো করোনি, ওর আত্মাকেও গলা টিপে মেরে ফেলেছিলে… ইউ স্টিল ডোন্ট গেট ইট, ডু ইউ? আচ্ছা, তোমাকে সামান্য সাহায্যটুকু করতেই পারি, তোমারও তো জানা দরকার যে তোমার হত্যালীলার চক্র কোথায় শুরু হয়েছে। দোজ বাস্টার্ডস, নরকের কীটগুলো আমার, আমার দিয়েগোর নাম রেখেছিল… মিনোতর!”
এরপরেই হঠাৎ স্পাইক তার হাতটা কিছুটা পিছিয়ে সজোরে আঘাত করল স্টিংগারের গলায়, সঙ্গে সঙ্গে তার শরীর প্রত্যেকটা অণুপরমাণু যেন তীব্র যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল। চারদিক থেকে গাঢ় অন্ধকারের সুবিশাল স্রোত তেড়েফুঁড়ে তার দিকে ধেয়ে আসল। এই কী তবে তার অন্তিম পরিণতি, এই পৃথিবীতে জেগে ওঠা থেকে এযাবৎ সবচেয়ে পরিচিত জনের কাছেই প্রাণ খোয়ানো? দেহের শেষ অনুভূতি হারিয়ে ফেলার ঠিক আগে সে অস্পষ্ট একটা কথা শুনতে পেল মাত্র, “অ্যান্ড ইউ কিলড হিম…”
(৪)
“জেন্টস অ্যান্ড জেন্টস, উই ওয়েলকাম ইউ টু দ্য মোস্ট অ্যান্টিসিপেটেড ইভেন্ট অফ ওয়ারওয়ার্ল্ড! উই আর অ্যাট দ্য ফাইনাল স্টেজ অফ আওয়ার ইয়ারলি ইভেন্ট, ‘কিলিং স্প্রি’— সো, ওয়ান্স এগেইন উই আর ইন দ্য— এন্ডগেম! আমাদের বিশ্বাস প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরেও আপনাদের উত্তেজনার কিছুমাত্র ঘাটতি হবে না, আর আপনারা ফিরে যাবেন মনের পরিপূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে। সাল ২০৬৫ থেকে ওয়ারওয়ার্ল্ড আপনাদের মনোরঞ্জনের অন্যতম বৃহৎ মাধ্যম হয়ে উঠেছে; টুডে, অ্যাজ় আই স্পিক, দ্য টেনথ ইয়ার সিন্স ইটস ফাউন্ডেশন ইজ পাসিং বাই। আজ আমরা আধুনিক বৈজ্ঞানিক সভ্যতার চরম পর্যায়ে পৌঁছেছি, এমন কিছু আর নেই যা আমাদের না-পাওয়া রয়ে গেছে। কিন্তু মাত্র ষোলো বছর আগে কি কেউ এতকিছু স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছিল? মহাযুদ্ধের দামামা স্তব্ধ হওয়ার পর বহুদিন এ বিশ্বে শ্মশানের নৈঃশব্দ বিরাজ করেছিল, শুধু মাঝেসাঝে শোনা যেত প্রিয়জনকে হারানোর ক্লান্ত একঘেঁয়ে হাহাকার। থেকে থেকে ধুঁকছিল সমরবিধ্বস্ত জনজীবন, লাইফ কেম টু এ স্ট্যান্ডস্টিল। জায়গায় জায়গায় তৈরি হয়েছিল লাশের পাহাড়, মাংসপচা পূতিগন্ধ আর সংক্রামক জীবাণুর দৌরাত্ম্যে এ ধরাধামে যেন নরক উঠে এসেছিল। এই সমস্যার আশু সমাধান খুঁজতে প্রশাসনও রীতিমতো বিপন্ন হয়ে পড়ে। ঠিক এই সময়ে মুশকিল আসান হয়ে প্রবেশ হয় স্টাইন ব্রাদার্স-এর, দুই ভাইয়ের যৌথ মালিকানায় গড়ে ওঠা এই সংস্থা সরকারকে এই ব্যাপার থেকে পুরোপুরি দায়মুক্ত করে। শুধু তাই নয়, তারা এই পৃথিবীর বোঝাকে জাতীয় সম্পদের তকমা দেয়। তাদের অত্যাশ্চর্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এইসকল নিষ্প্রাণ দেহগুলিতে পুনরায় জীবনীশক্তি সঞ্চারিত হয়, উপরন্তু যান্ত্রিক ও জৈবিক অঙ্গসমূহের সমবায়ে তারা পরিবর্তিত হয় এক দক্ষ, ক্ষিপ্রতর, সুশৃঙ্খল প্রজাতিতে। পূর্বের অকর্মণ্য, লোভী, নিকৃষ্ট মানুষদের বদলে এরা চলে আসায় সামাজিক, অর্থনৈতিক, প্রশাসনিক উন্নতি নিমেষের মধ্যে এত দ্রুতহারে বৃদ্ধি পায় যে তার চমকে সমগ্র ইতিহাস পর্যন্ত বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। সারা পৃথিবী সেজন্য ফ্র্যাঙ্ক স্টাইন আর ওসাইরিস স্টাইনের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। প্রাথমিকভাবে তারা এই মেকাহিউম্যানদের সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়োজিত করলেও, তারা কিছুদিনের মধ্যেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে অন্য একটি ক্ষেত্রে আর নতুন উপাধি পায়— মেকাফাইটার। আপনাদের বাসনা আর উৎসাহের জোরেই দশ বছর আগে সূত্রপাত হয় এই মহাযজ্ঞের। আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ এতটা সময় আমাদের সঙ্গে থাকার জন্য, উই হোপ টু স্টে ইন ইয়োর সার্ভিস অ্যান্ড এন্টারটেইন ইউ উইথ দ্য মোস্ট সাবলাইম কাল্ট অব হিস্ট্রি। সো উইদআউট এনি ফারদার অ্যাডু, লেটস্ বিগিন!”
–স্পীকারে কথা শেষ হতেই সকল দর্শকাসন থেকে সম্মিলিত উল্লাসধ্বনিতে চারদিক মুখরিত হল। তিনমাসব্যাপী দীর্ঘ ইভেন্টের পর আজকের লড়াই শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই। শেষ পর্যন্ত কে টিকে থাকছে, কে পাচ্ছে সেরার শিরোপা, এই মুহূর্তে সকলের মনে এই একটাই প্রশ্ন। কিলিং স্প্রি-এর প্রথম বিভাগের মেকাফাইটারদের মধ্যে থেকে সেমিফাইনাল পেরিয়ে এসেছে প্যান্ডেমোনিয়াম-এর দ্য রীপার। অন্যদিকে দ্বিতীয় বিভাগ থেকে উঠে এসে আজ তার প্রতিপক্ষ হয়ে রণক্ষেত্রে নামতে চলেছে স্টিংগার। তাকে কোনও প্রাইভেট এরিনা নিজেদের দলে ভেড়াতে পারেনি বলে আজও কিছু নেগোশিয়েটর গ্যালারিতে বসে গজগজ করছিল। দ্য অ্যবিস-এ আশ্রিত হিসেবে আসলেও, এই মুহূর্তে সে যেন এরিনা কর্তৃপক্ষের বড়ই কাছের। কে বিজয়ী হতে চলেছে সে বিষয়ে সবাই বেশ ধন্দে রয়েছে, কারণ দু’জনেই শক্তি এবং দক্ষতার সুষম মিশেলের প্রদর্শন করে এসেছে তাদের বিগত প্রত্যেকটি দ্বন্দ্বে। কারো মধ্যেই কখনও কোনওরকম অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ বা অপ্রয়োজন ব্যস্ততার লক্ষণ দেখা যায়নি। তাই আজকের লড়াইটা যে বেশ হাড্ডাহাড্ডি হতে চলেছে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। এমন সময় এরিনার চারধার থেকে কমেন্সিং অ্যালার্ট বেজে ওঠায় গ্যালারির চাপা গুঞ্জন থেমে গেল। এ হল গ্রান্ড মাস্টারের প্রবেশের সংকেত। সবার দৃষ্টি গিয়ে মিলল একটা নির্দিষ্ট জায়গায়, জায়গাটা গ্যালারির সর্বোচ্চ ভিউ পয়েন্ট, সেখানে নিম্ন কী উচ্চ— যে গোত্রেরই হোক না কেন কোনওরকম দর্শকেরই যাওয়ার অনুমতি নেই। সেখানে একটা মসৃণ পাত একটু উঠে এসে মাঝখান থেকে বিভক্ত হয়ে দুইপাশে সরে গেল, সেখানে তৈরি হওয়া গাঢ় কালো বিবরে চোখ চালিয়েও খানিকক্ষণ কিছুই নজরে আসল না।
কিন্তু তারপরই সেই অন্ধকার ভেদ করে দুটো লালচে চোখ বেরিয়ে আসল, সঙ্গে আসল এক অমানুষিক অবয়ব। একটা লম্বাটে গড়নের স্বচ্ছ স্ফটিক, যার ভিতরে রয়েছে বুদ্বুদ ওঠা চকচকে হালকা সবুজ তরল। আর স্ফটিকের উপরের দিকে লেগে রয়েছে রূপোলি ফলকে খোদিত এক ভাবলেশহীন মুখমণ্ডল, যার পিছনে দেখা যাচ্ছে তরলে ভাসমান এক মস্তিষ্ক। সম্পূর্ণ বস্তুটা আটকে রয়েছে এক ধাতব হোল্ডারে। সেই হোল্ডারের চারপাশ থেকে বেরিয়ে রয়েছে অক্টোপাসের মতো কিছু মোটা তার। সেগুলো একটা কনসোলের বিভিন্ন সকেটে জুড়ে যেতেই এরিনার চারধারে চারটে লম্বা খুঁটি উঠে আসে। একটা খুঁটি থেকে বিশাল এক নীলচে আলোর পর্দা বেরিয়ে বাকি তিনটে খুঁটি অতিক্রম করে আবার প্রথম খুঁটিতে এসে মিশে যায়। এ হল একপ্রকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা, গ্র্যান্ড মাস্টার দর্শকদের সুরক্ষার জন্য প্রতিটা ম্যাচের আগে এরকম এক দুর্ভেদ্য ফোর্স ফিল্ড তৈরি করে দেন। স্পীকার থেকে ফের কথা ভেসে আসে—
“দ্য চিফ ইজ হেয়ার, এভরিবাডি! নাউ উই উইল হ্যাভ আওয়ার ফাইটার্স, এভরিবাডি টার্ন ইয়োর গেজ টু এনট্রান্স এ…”
এনট্রান্সের উপরে জায়ান্ট স্ক্রিনে এক ভয়ালদর্শন যোদ্ধার হত্যালীলার নির্দশন দেখিয়ে যাওয়া হচ্ছে একের পর এক, আর তারপরই সশব্দে এনট্রান্স খুলে যেতেই বগবগিয়ে মাঠে বেরিয়ে এল একরাশ ধোঁয়া। গাঢ় লাল আলোর আভা-তে সেখানে নরকের ন্যায় এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
ধোঁয়া সরে যেতেই দেখা গেল গাঢ় নীলচে মাথা-ঢাকা লম্বা পোশাক পরিহিত একজন দাঁড়িয়ে আছে, তার কঙ্কালসার হাতে একটি দীর্ঘ দণ্ড যার মাথায় চকচক করছে ইস্পাতের বাঁকানো ব্লেড— একটি সাইদ! এই সময়ে স্পীকার গমগম করে উঠল—
“দ্য সোল স্ন্যাচার, দ্য হারবিঞ্জার অফ ডেথ, ফ্রেশ আউট ফ্রম হেল— দ্য… রীপাররর!”
রীপার তার পোশাক খামচে ধরে টান দিতেই নিমেষের বেরিয়ে এল এক ভয়াল অবয়ব! তার পুরো শরীরটাই একটা ধাতুতে গড়া শক্তপোক্ত কঙ্কাল, শুধুমাত্র মুখের ডানপাশে বীভৎসভাবে দেখা যাচ্ছে একফালি চামড়ার গাল আর তার উপর এক বিস্ফারিত চোখ। সে তার সাইদ মাটিতে সজোরে ঠুকতেই সারা গ্যালারিতে উল্লাসের স্রোত বয়ে গেল।
“আর এবার যদি আপনারা এনট্রান্স বি-এর দিকে নজর ফেরান, তবে দেখতে পাবেন আমাদের দ্বিতীয় যোদ্ধাকে। পিপলস্ ফেবারিট, দ্য ডেডলি বী, স্টিইইই…”, ঘোষকের কথা শেষ হওয়ার আগেই দর্শকদের থেকে দ্বিগুণ উচ্ছ্বাস আর হুল্লোড়ে এরিনা কেঁপে উঠল। কিন্তু এনট্রান্স বি খুলে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পরেও সেখান থেকে কাউকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল না। দর্শকরা ততক্ষণে চুপ হয়ে গেছে, তাদের মধ্যে কথা চালাচালি, ফিসফাস হচ্ছে— “এ যাঃ, ও কি আজ আসবে না?”, “হুস্, টোটাল ওয়েস্ট অফ মানি! কেমন সুন্দর মারামারি-ফাটাফাটি শুরু হয়ে যাবে না তো… কী যে হচ্ছে!”, “ইটস্ নট ফেয়ার! আই ডিড নট কাম হেয়ার টু জাস্ট সিট অ্যারাউন্ড!”
সবাই যখন এরকম রাগ, বিরক্তি, ক্ষোভপ্রকাশে ব্যস্ত, তখন হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ, একটানা আওয়াজ শোনা গেল চারদিক থেকে। যেন কোনও এক পতঙ্গ স্বাধীনভাবে যত্রতত্র উড়ে বেড়াচ্ছে। সেই আওয়াজ শুনে সবাই যখন মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে তখন হঠাৎ তড়িৎবেগে এনট্রান্স বি থেকে কিছু একটা বেরিয়ে এসে হঠাৎ এরিনার মাঝে থমকে দাঁড়াল। সেই বেগের তোড়ে উঠে আসা ধুলো পরিষ্কার হতেই দেখা গেল একজনকে।
তার ঘাড় থেকে দুদিকে প্রশস্ত রয়েছে দীর্ঘ দুই স্বচ্ছ ডানা, যাতে পতঙ্গের ডানার মতোই মোজাইক নকশার নীচে তখনো ধীরগতিতে ঘুরে চলেছে চৌম্বক আকর্ষণে আটকে থাকা থ্রাস্টার। তার উর্ধ্বাঙ্গের অধিকাংশ এখনও জৈবিক, তবে তা বর্মের আড়ালে রয়েছে। হাতের কবজি থেকে কনুই পর্যন্ত উপরের দিকে উঁচিয়ে আছে বেশ কিছু ধারালো, মজবুত ব্লেড। তার চেহারাতে ফুটে রয়েছে এক সহজাত আত্মবিশ্বাস, ঋজু দেহভঙ্গি থেকে ঠিকরে পড়ছে তেজ। এইবারেও দর্শকদের উন্মাদনায় সামান্যতম ঘাটতি দেখা গেল না, তাদের সম্মিলিত উৎসাহী কণ্ঠ দিক-বিদিক ছাপিয়ে গেল— স্টিংগার! স্টিংগার! স্টিংগার!
ফের একবার কমেন্সিং অ্যালার্ট বাজতেই ঘোষক দ্বন্দ্বযুদ্ধের সূচনা করলেন, “লেট দ্য ব্যাটল বিগিন!”
দুজনেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে একে অপরকে পরখ করত থাকল। এই দ্য রীপারের কীর্তিকলাপ সামনাসামনি দেখার সুযোগ না হলেও স্টিংগার বিভিন্ন রেকর্ডেড ভিডিয়ো ক্লিপে সেসব কয়েকবার দেখেছে। এরও চাহিদা প্রথম ম্যাচের পর বেশ রমরমিয়ে বেড়ে চলেছিল। গতকাল এক প্রস্তাব নিয়ে সে রীপারের সঙ্গে দেখা করতে গেছিল, কিন্তু বহু চেষ্টা করেও তার দেখা মেলেনি। প্যান্ডেমোনিয়ামের রিপ্রেজেন্টেটিভরা তাকে বরং বেশ তাড়া দেখিয়ে একরকম চলে যেতেই বলেছিল। এমনকি কাল সারাদিন কেটে গেলেও প্যান্ডেমোনিয়াম বা রীপারের পক্ষ থেকে সে কোনও মেসেজ পায়নি। স্টিংগারের মতো একজন ভিআইপিকে কোনও এরিনাই এভাবে অগ্রাহ্য করার ঔদ্ধত্য দেখায়নি। প্যান্ডেমোনিয়ামের মতো এক বেনামী এরিনা, যারা কিনা মোটে এইবার দ্য রীপারের জোরে একটু নামডাক করেছে, তাদের থেকে এরকম ব্যবহার অপ্রত্যাশিত। এখন সে মনে মনে ভাবল— এখন আর কীই বা করা যাবে, বরং অল্পের উপর, দ্রুত কাজ সেরে নেওয়া গেলেই ভালো হয়। হঠাৎই সাৎ করে সে একটা ব্লেড ছুড়ে দিল! মোক্ষম কৌশল, পরিমিত বল প্রযুক্ত— এ যদি ঠিকঠাক জায়গায় গিয়ে ছুঁয়ে দেয় তবে প্রতিপক্ষ গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হবে। কিন্তু এ কী! রীপার অনায়াসে সামান্য সরে যাওয়ায় সেটা দূরে গিয়ে ডিভাইডারে বিঁধে গেল। কিন্তু চমক সেখানেই শেষ নয়, একটুও অপেক্ষা না করে সে তার সাইদ বাগিয়ে স্টিংগারের দিকে তীব্রবেগে ধেয়ে এল। স্টিংগার একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিল। তার সামলে উঠতে খানিক দেরি হয়েছিল। রীপার তার ডানকাঁধে সজোরে সাইদের ধাক্কা দিয়ে দূরে চলে গেল। স্টিংগার হুড়মুড়িয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ল। এরই মধ্যে রীপার নিজের জায়গা থেকে ফের তার দিকে ছুটে আসছে। মাটিতে তার পা প্রায় স্পর্শই করছে না, হোভার টেকের কারসাজি কি? ততক্ষণে সে আবার স্টিংগারের কাছে পৌঁছে গেছে। কিন্তু স্টিংগার এবার প্রস্তুত ছিল, এক পা ঘুরিয়ে সে তার প্রতিপক্ষকে রাস্তা ছেড়ে দিয়ে তার পিঠের মাঝখান লক্ষ্য করে স্টিং বিঁধিয়ে দিল। অভাবনীয় গতিতে রীপার পিছন ফিরে তার সাইদের হাতল দিয়ে সেই আক্রমণ প্রতিহত করল। স্টিংগার মনে মনে তার প্রতিপক্ষের প্রশংসা না করে পারল না। এই কলার এরূপ সুদক্ষ শিল্পী সে খুব কমই দেখেছে, যে কোনও দলের জন্যই এক গুরুত্বপূর্ণ অ্যাসেট। দুজনেই সমতুল্য পরাক্রমে লড়ে চলল। কেউই কারোর আঘাতকে কার্যকর হতে দিচ্ছে না, তাদের পরস্পরের অস্ত্রের ছোঁয়া লাগতেই বারবার চারদিক ধাতব শব্দে ধ্বনিত হতে থাকল। সবাই চোখ আর কান দিয়ে তাদের সামনের দৃশ্য গিলে চলেছে। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর স্টিংগার কিছুটা তফাতে চলে আসল। সে বুঝতে পারছে যে এখন ব্যাপারটা অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে, কোনও পরিণতিতেই এ যুদ্ধ পৌঁছবে না। তাকে কৌশল পাল্টাতে হবে। অত্যন্ত হালকা ধাতুসংকর দিয়ে তার ডানাদুটো তৈরি হওয়ায় লড়াইয়ের সময় সেগুলো নিয়ে বিশেষ অসুবিধা হয় না। বরং ছোটখাটো লাফ দিয়ে একটু ভেসে যেতে তার খুব কাজে দেয় সেগুলো। এর মূল ব্যবহার আসে ফাইনাল টাচের সময়, থ্রাস্টার চালানোর জন্য সীমিত চার্জ থাকায় এর ব্যবহার খুব একটা বেশি করা যায় না। সে রীপারকে লক্ষ্য করে ছুটে যেতে যেতে তার সব ক’টা ব্লেড একসঙ্গে ছুড়ে দেয়। রীপার অবজ্ঞাভরে তার সাইদ ঘুরিয়ে সেগুলো বিভিন্নদিকে ঠিকরে দিতে থাকল। কিন্তু শেষ ব্লেডটা সরে যেতেই সে ফুউউউম! করে একটা আওয়াজ শুনতে পেল আর ঠিক সামনেই যা দেখতে পেল তার জন্য সে মোটেও তৈরি ছিল না। স্টিংগার তার উইংয়ে থ্রাস্টার চালিয়ে একদম তার কাছে এসে গেছে। স্টিংগার রীপারের মুখের ডানদিকে তার স্টিং অমানুষিক বলে বিঁধিয়ে দিল! কিন্তু পরক্ষণেই সে বুঝতে পারল যে কোথাও একটা তার একটা ভুল হয়ে গেছে। মড়মড় করে খুলি ভেঙে তার ব্লেডটা ঢুকে না গিয়ে সেটা সরসর করে নরম মাটির মতো গেঁথে গিয়ে মাথার পিছন দিয়ে বেরিয়ে গেল! এ-এতো সিন্থেটিক মেটাল! এই ধাতুকে যে কোনও ইচ্ছামত আকার দেওয়া যায়, সাধারণ ধাতুর তুলনায় এর পীড়ন নগণ্য। কিন্তু এই ধাতু মেকাহিউম্যানদের তৈরিতে ব্যবহার করা হয় না। চেষ্টা যে হয়নি তা নয়, কিন্তু এই উপকরণ কার্যকরীভাবে প্রয়োগ করতে গিয়ে বৈজ্ঞানিকরা বারবার অসফল হয়েছে। তবে অ্যান্ড্রয়েড বা সম্পূর্ণ যন্ত্রমানব তৈরিতে এ ব্যবহার করাই যায়। তার মানে, আদতে তার প্রতিপক্ষ কোনও মেকাহিউম্যানই নয়! লোভে পড়ে মানুষ কীই না করতে পারে! তার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠল। নিয়মবিধি অনুযায়ী তার বিপক্ষ অনৈতিক কাজ করলেও তার নিজের উদ্দেশ্য সফল হওয়ার পথ আরও মসৃণ হয়ে গেল। তার চেহারা বিগড়ে যাওয়ায় রীপার খানিক হতচকিত হয়ে গেছিল, সেই সুযোগে স্টিংগার তার অন্য হাতের স্টিং রীপারের কোমরে গেঁথে দিল। আচমকা রীপারের সারা দেহ থরথর করে কাঁপতে শুরু করল, গলন্ত মোমের মতো তার দেহের বিভিন্ন অংশ খসে পড়তে থাকল। দর্শকরা সামনের দিকে তড়িঘড়ি ঝুঁকে পড়ে, তাদের তো চোখ মুখ বিস্ময়ে হাঁ! একসময় রীপারের দণ্ডায়মান মূর্তি বস্তুতই মাটিতে ধূলিসাৎ হয়ে গেল, শুধুমাত্র পড়ে থাকলো তার সাইদ। স্টিংগার সুবিধামতো একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে তার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ব্লেডগুলো চৌম্বক বলের টানে আবার নিজের কাছে ফিরিয়ে আনল। এদিকে এরিনা জুড়ে চাপা গুঞ্জন শুরু হয়েছে, স্পীকার কড়কড় করে উঠল, “প্যান্ডেমোনিয়াম এরিনা, কল ইন প্যান্ডেমোনিয়াম এরিনা! প্যান্ডেমোনিয়ামের কর্তারা এক্ষুনি উপস্থিত হন, এক্সপ্লেইন ইয়োর…”
কিন্তু সেই কথা শেষ হতে পারল না, তার আগেই সবাই নীচের দিকে তাকিয়ে হইহই করতে শুরু করে দিয়েছে। কারণ? স্টিংগার কখন মাটিতে পড়ে থাকা সাইদটা তুলে নিয়েছে, আর সঙ্গে সঙ্গে ছুট লাগিয়েছে। কিছুটা গিয়েই লম্বা ঝাঁপ দিয়ে তার মেকানিক্যাল উইংয়ের জোরে ঝড়ের বেগে উড়ে গেছে। তার লক্ষ্য? এরিনার সর্বোচ্চ ভিউ পয়েন্ট আর… গ্র্যান্ড মাস্টার!
(৫)
একটা অন্ধকার করিডরে দাঁড়িয়ে রয়েছে স্টিংগার। চারিদিকটা প্রয়োজনের তুলনায় বেশিই চুপচাপ। একটু এগিয়ে যেতেই সে দেখল করিডরের শেষে একটা বন্ধ দরজার সামনে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছে একজন। তার হাবভাবে উৎকণ্ঠা ফুটে বেরোচ্ছে। তাকে দেখে স্পষ্টতই বোঝা যায় তার একপায়ে সমস্যা থাকায় তার স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে অসুবিধা হচ্ছে। চাপা অধৈর্যে একটা ধারালো ছুরি সে ক্রমাগত এ হাত-ও হাত করছে। এমন সময় সামনের দরজা খুলে গেল।
“ওসাইরিস স্টাইন, ইউ আর হেয়ার! আ-আপনি দিয়েগোকে দেখেছেন? ওকে কি আর কোনওভাবেই রিসারেক্ট করা যাবে না, এ দুনিয়ার কোনও কিছুই কি ওকে আর বাঁচিয়ে তুলতে পারবে না?”
দরজায় দাঁড়ানো সৌম্যকান্তি ব্যক্তিটি বোধহয় সাধারণত বেশ হাসিখুশি থাকেন, কিন্তু এখন তার মুখে বিষণ্ণতার ছায়া। তিনি নিজের চশমা নাকের উপর ঠেলে বললেন, “আয়াম ভেরি সরি, স্পাইক। কিন্তু আমি যে কোনও রাস্তাই দেখছি না। ওর মেমারি স্টোরেজটাও বাজেভাবে ড্যামেজড, ওকে কোনও অ্যান্ড্রয়েডেও নতুনভাবে রিস্টোর করা যাবে না। ইটস্ রিয়্যালি এ শেম! আমি নিজের হাতে দিয়েগোর রিকনস্ট্রাকশন কনডাক্ট করেছিলাম, হি ইজ লাইক আ সন টু মি। কিন্তু তুমি হাতের ছুরিটা দিয়ে ঠিক কী করতে চাইছ?”
স্পাইক ঘরের মধ্যে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। স্টিংগার মাথা বাড়িয়ে ভিতরটা দেখার চেষ্টা করল। সেখানে একটা চার্জিং পডের মধ্যে যে শুয়ে আছে তা তো সে নিজেই!
“আমি ওই হারামজাদাকে শেষ করে দেব! ও আ-আমার দিয়েগোকে আমার থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে!”
“আরে আরে, করো কী! খবরদার ওসব চিন্তাও আনবে না মাথায়। হি ইজ ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট নাও, ভেরি প্রেশাস টু দ্য গ্র্যান্ড মাস্টার। সবকিছু খতিয়ে দেখে যা বুঝলাম, গত জীবনে ও কোনও মারাত্মক মার্শাল আর্টে অত্যন্ত সুশিক্ষিত ছিল, সম্ভবত ওয়ারেও সার্ভ করেছে। সেই রিফ্লেক্স মেমারিকে ট্রিগার করার জন্য প্রথম ম্যাচেই এত খেল দেখিয়েছে! এ কাজ কে করেছে বুঝতে নিশ্চয় অসুবিধা হচ্ছে না? তোমাদের গ্র্যান্ড মাস্টার বোধহয় দেখতে চেয়েছিলেন যে এ কেমন লড়ে যেতে পারে, আর তার সঙ্গে সঙ্গে পুরোনো সব আদর্শও যাতে মুছে যায় তার একটা ভালো ফন্দি বের করেছিলেন। রিসারেকসনের পর ধীরে ধীরে বিভিন্ন ট্রিগার পেলে যোদ্ধা তার পুরোনো স্মৃতির উপর স্থায়িত্ব পায়। কিন্তু যান্ত্রিকভাবে প্রথমদিনই ট্রিগার করা হলে সে হয়তো বেশ কিছুক্ষণের জন্য তার বিভিন্ন স্বভাব, ক্ষমতা ফিরে পায়, কিন্তু পরমুহূর্তেই সেসব ধুয়েমুছে মেমারি ব্ল্যাঙ্ক হয়ে যায়। এইভাবে এক ঢিলে দুইপাখি মেরেছেন। হি উইল মেক দিজ ল্যাড অ্যাজ হি উইশেস। একে এখনই সরিয়ে দিলে তোমার সমূহ বিপদ কিন্তু।”
“হোয়াট দ্য হেল অ্যাম আই সাপোজ়ড টু ডু দেন, মিস্টার স্টাইন! আমার ভেতরটা যে প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে যাচ্ছে!”
“হিয়ার মি আউট। আমি আমার কিছু কনট্যাক্টকে কাজে লাগিয়ে এই সুপারিশ করে যাব যে তোমাকে যেন এর ট্রেনার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়… নো নো, স্পাইক। ডোন্ট রিয়্যাক্ট। তো শোনো, এরিনার সুপিরিয়ররা আমার ইচ্ছা অগ্রাহ্য করতে পারবে না, দোজ ব্লকহেডস আর ইন মাই ডেট… হেল! দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ ইন মাই ডেট। তোমাদের গ্র্যান্ড মাস্টারের কোনও আপত্তি থাকলেও তার কিছু করার থাকবে না। তুমি কাজটা খুব মন দিয়ে করবে, মেক হিম দ্য বেস্ট! কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন তথ্যের এনক্রিপ্টেড ইনপুট ওকে দিতে থাকবে যাতে ধরা এই সমাজের বিভিন্ন কোরাপশান, এক এক করে। ওতে অজান্তেই ওর মধ্যে তৈরি হতে থাকবে এক বিপ্লবী। আই ডিড নট ওয়ান্ট দিজ ফর মাই ক্রিয়েশনস্ হোয়েন আই মেড দেম। আমি এই এরিনার আরও অনেককে চিনি যারা মুক্তি চায়, স্বতন্ত্রভাবে বাঁচতে চায়। স্বাধীনতার সাধ যাদের মধ্যে সুপ্ত রয়েছে বহুদিন ধরে। তোমাকে এদের এই ইচ্ছাপূরণে অগ্রণী দায়িত্ব নিতে হবে। আর তোমার ছাত্র হবে এই নতুন বিপ্লবের প্রাণভোমরা। এই হবে দিয়েগোর আত্মার প্রতি শ্রেষ্ঠ সম্মান, আর তোমার বদলা। তোমার রাস্তা কিন্তু কাঁটায় ভর্তি থাকবে, তুমি পারবে তো এই দায়িত্ব হাতে নিতে?”
স্পাইকের হাত থেকে হঠাৎ ছুরিটা ঠক্ করে মেঝেতে পড়ে গেল, তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। সে ধরা গলায় বলল, “পারব”। তার কাঁধে আলতোভাবে হাত রাখল সেই ব্যক্তি আর সঙ্গে সঙ্গেই কিছু বুঝে ওঠার আগে স্টিংগার তার ডানদিকে প্রচণ্ড টানে সেখান থেকে সরে গেল। স্পাইক আর ওসাইরিস স্টাইন ছোট হতে হতে একসময় অন্ধকারে মিশে গেল। আর সেই অতল অন্ধকারে সে পড়তেই থাকল। আচমকাই সে শক্ত মাটিতে সজোরে পড়ল।
উঠে দাঁড়িয়ে, চারপাশ ঠাহর করে সে বুঝল যে এটা তার বহু পরিচিত এরিনার এন্ট্রান্স। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরেক স্টিংগার আর স্পাইক। সেই স্টিংগারকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে, বোধহয় কোনও ম্যাচের পরের সময়। স্পাইক মুখে চওড়া হাসি ফুটিয়ে তার কাঁধের উপর দিয়ে হাত চালিয়ে দিয়ে বলল, “ইউ ডিড ওয়েল টুডে, কিড। এত কম সময়েই এতকিছু শিখে ফেলবে ভাবতে পারিনি। হেয়ারস্ এ লিটল্ সামথিং ফর ইউ। তোমাকে রিল্যাক্সড করে দেবে একদম।”
বলেই তার তর্জনী আর মধ্যমা জুড়তেই একটা ড্রাইভের আকৃতি তৈরি হল। সেটা সে ক্লান্ত স্টিংগারের ঘাড়ে গুঁজতেই সে ধপ্ করে বসে পড়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। স্পাইক তাড়াতাড়ি একটা প্রজেক্টিং প্যানেল বের টুকটাক আঙুল ছোঁয়াতে থাকল। স্টিংগার উঁকি মেরে দেখল যে স্ক্রিনে লেখা ফুটে উঠছে “ড্রিম সিক্যুয়েন্স”, স্পাইক স্ক্রিনের উপর আঙুল ডান পাশে সরিয়ে দিয়ে প্রক্রিয়াটা প্রসিড করে দিল। তারপর সে নীচু গলায় গম্ভীরকণ্ঠে বলল, “আজকের তথ্যটুকুও বড়ই আরামে সিনেমার মতো দেখে চলেছে। ঘুম ভাঙলে তো কিছু মনেও থাকবে না, খালি একটা ভাব তৈরি হবে মনে। হে লর্ড! হোপ দিস ওর্কায়স আউট ফাইন”। তারপর সে ঘুমন্ত স্টিংগারকে তুলে ধরে ভিতরের দিকে রওনা দেয়।
তারপর ফের স্টিংগারের সামনে থেকে সব কিছু গাঢ় আলকাতরার আড়ালে চলে যেতে থাকল। হঠাৎই সে নিজেকে একটা কয়েদখানায় আবিষ্কার করল। তার সামনে হাতবাঁধা একজন লোক মাথা নীচু করে হাঁটু গেঁড়ে বসে রয়েছে। তার সামনে একজন চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে দিয়ে বসে আছে আর একজন পাশে সোজাভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বহু বছর সে তিন-তিনটে আস্ত মানুষকে সে এত কাছে থেকে দেখতে পায়নি। চেয়ারে বসে থাকা লোকটা মুখে একটা বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে বলল, “কী মেজর? কোথায় গেল আপনার সব হুমকি ধমকি? হা হা হা, এখন আর জেদ করে কী লাভ? নাউ আয়াম ওয়ার্ডেন অ্যান্ড ইউ আর মাই প্রিজনার, তাই যা জানতে চাইছি সোনামুখ করে বলে দিন তো।”
সামনে বসা লোকটা নিরুত্তর, পাশে দাঁড়ানো লোকটা সজোরে তার মুখে একটা লাথি মারল। সে নিজের জায়গাতেই স্থির থাকল, কিন্তু দেহের উর্ধ্বাংশ মোচড় খেয়ে উল্টোদিকে ঝুঁকে গেল। আর তখনই স্টিংগার ব্যাপারটা খেয়াল করল, এই কয়েদির মুখ যে হুবহু তার নিজের মতোই! কিন্তু তার চমকানোর পালা যে সবে শুরু হয়েছে। চেয়ারে বসে থাকা লোকটা উঠে এসে তার কয়েদির পোশাকের সামনের অংশ খিমচে ধরল। এই মুখটাও যে তার চেনা, গ্র্যান্ড মাস্টারের ধাতব মুখোশ এখন রক্ত-মাংসে তৈরি! সে দাঁত কিড়মিড়য়ে বলল, “বলবেন না?”
উত্তরে তার মুখে রক্তের থুতু ছিটিয়ে দিয়ে কয়েদি বলল, “নো… নেভার… নাডা!”
ওয়ার্ডেনের মুখে থুতু আর রক্তের ধারার মাঝে রাগে জ্বলতে থাকা চোখ দিয়ে সামনের সবকিছুকে ভস্ম করে দিচ্ছিল, তিনি বাঁ হাতে মুখ মুছে নিয়ে বরফ শীতল কণ্ঠে আদেশ দিলেন, “স্ট্র্যাপ দিস বাস্টার্ড!”
তার হুকুম তামিল করা হল, অন্য লোকটা কয়েদির গলায় একটা কলার পরিয়ে দিল। এবার ওয়ার্ডেনের মুখে একটা ক্রূর হাসি ফুটল।
“মেইবি উই ট্রিটেট ইউ আ বিট হার্সলি, এবার আর আতিথেয়তায় কোনও ত্রুটি রাখা হবে না”
সে এগিয়ে এসে গলার পাশে কলারের একটা জায়গা বুড়ো আঙুল দিয়ে জোরে টিপে ধরল। কলার পরা লোকটা যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল, তার সারাদেহ কাঁপতে থাকল। স্টিংগারও নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে সেই যন্ত্রণা পূর্ণমাত্রায় অনুভব করল, তারও সারা শরীর যেন ওই লোকটার মতো যন্ত্রণায় ফেটে পড়তে চাইছে। সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না, ধপ্ করে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। ওয়ার্ডেন তখন বিকৃত উল্লাসে কর্কশ হাসিতে ভরিয়ে দিয়েছেন সারাঘর। হঠাৎ তার চোখ চলে গেল স্টিংগারের দিকে, সে নিজের চেয়ার থেকে উঠে তার দিকে এগিয়ে আসল। ঠোঁটে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে সে বলল, “লং টাইম নো সি পার্টনার। তা যাক গে, দেখলে তো কেমন আবার আমরা এই ঘরে ফিরে এলাম? সেদিনও তুমি আমার নিয়ন্ত্রণে ছিলে, আজকেও রয়েছ। হাঃ হাঃ হা! লেটস্ জগ আপ ইয়োর মেমোরি, শ্যাল উই?”
হঠাৎ তার মুখটায় ধাতব রুপোলি রঙে ছেয়ে যেতে লাগল, তার চোখদুটো লালচে হয়ে উঠছে। সে তার হাতটা তার গলার দিকে বাড়িয়ে দিল। হঠাৎ কোথা থেকে একটা ক্ষীণ গলার কণ্ঠস্বর শোনা যেতে গেল, “স্টিংগার, স্টিংগার! স্ন্যাপ আউট অব ইট, ও তোমাকে একটা ভার্চুয়াল সিম্যুলেশনে পাঠিয়ে দিয়েছে। তোমাকে জেগে উঠতেই হবে! তুমি শপথ নিয়েছ। ইউ কেম দিস ফার, ডোন্ট ওয়েস্ট দিস চান্স ফর হিম। স্টিংগার!”
অনেক কষ্টে মনের সমস্ত শক্তি এক করে সেই কণ্ঠস্বরে মনোনিবেশ করার চেষ্টা করল স্টিংগার। সে মাথা তুলে সামনে চাইতেই দেখল যে দৃশ্যটা ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে। সে ঠিক গ্র্যান্ড মাস্টারের থেকে ফুটখানেক দূরে ভেসে রয়েছে, তার হাতে উদ্যত সাইদ। সে আবার শুনতে পেল স্পাইকের কণ্ঠ, “ওকে আমি টেম্পোরারি ফ্রিজ়ে পাঠিয়ে দিয়েছি, অল ফোর্স শিল্ডস আর ডিস্যাবল্ড। আর সময় পাবে না, নাউ ইজ দ্য টাইম টু স্ট্রাইক!”
সে সাইদ ঘুরিয়ে সামনে এগোতেই একটা অদৃশ্য বাধা পেল, তার সঙ্গে শুনতে পেল তার পুরোনো ওয়ার্ডেনের দুর্বল কণ্ঠস্বর, “তুমি কী ভেবেছ, অ্যাঁ? যে আমাকে মেরে এখান থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে? নাঃ, অ্যাবসোলিউটলি নট! তুমি ধরা পড়ে যাবে, তোমার সঙ্গীসাথীরাও ছাড় পাবে না! আর এবার অন্তহীন নরকযন্ত্রণা ভুগবে, নো ওয়ান উইল কাম টু ইয়োর রেস্ক্যু!”
স্টিংগার কিছুক্ষণ তার দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে বলল, “দেখাই যাক না, আই উইল টেক মাই চান্সেস” আর সঙ্গে সঙ্গে তড়িৎবেগে ধেয়ে গিয়ে তার সাইদ বসিয়ে দিল ধাতব মুখোশের মাঝ বরাবর। ধাতব মুখটাতে একটা লম্বা চিড় ধরে গেল। সারা এরিনার তীক্ষ্ণ রিনরিনে আর্তনাদে সবার কানে তালা লেগে গেল। সশব্দে মুখোশ সমেত সম্পূর্ণ স্ফটিক ভেঙে চুরমার হয়ে গেল, সবুজ তরল ছলকে পড়ল চারপাশে। স্টিংগার দেখল সেখানে সেই মস্তিষ্কটা পড়ে আছে, তাতে এখনও স্পন্দনের আভাস বোঝা যায়। সে ঘৃণাভরে সেটাকে পা দিয়ে সেটা থেঁতলে দিল। এদিকে গ্যালারিতে হুটোপাটি পড়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগের অবিশ্বাস্য দৃশ্যের ঘোর কাটিয়ে উঠেছে তারা, উত্তেজনার আকর্ষণ ভুলে সবাই এখন ছুটে পালাচ্ছে। এমন সময় এনট্রান্সে স্পাইককে দেখা গেল, তার সঙ্গে রয়েছে আরও কয়েকজন মেকাফাইটার। সেইরাত্রে আচমকা স্পাইকের হামলার পর সে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল। সেখানে সে নিজেকে একটা বড় হলঘরে দেখতে পায়, সেখানকার প্রতিটা দেওয়াল ধবধবে সাদা। হঠাৎ সেখানে এক এক করে স্পাইকসহ এই যোদ্ধারা আবির্ভূত হয়। তারা সবাই মিলে তাদের দীর্ঘদিনের এই পরিকল্পনা স্টিংগারকে বিস্তৃতভাবে জানায়। স্পাইক তার গলায় ড্রাইভ গুঁজে দেওয়ায় দুটো কাজ হয়েছিল— এক, তার মেমারির রেস্ট্রিক্টেড অংশের এনক্রিপশন উঠে যায়, ফলে আগে পাওয়া সমস্ত ইনপুট তার নাগালে চলে আসে আর দুই, এই হঠাৎ আক্রমণটা তার ক্ষেত্রে একটা ট্রিগার হিসেবে কাজে দেয়, যাতে তার পুরোনো সব স্মৃতি একটু একটু করে ফিরে আসতে থাকে। স্পাইক তার গতজীবন সম্পর্কে ভালোভাবে সন্ধান চালিয়ে বিভিন্নরকম ট্রিগার বের করে ফেলেছিল। সেগুলোর কিছু সে তার কঠোর ট্রেনিং সেশনে স্টিংগারের ওপর প্রয়োগ করে। আর সবথেকে বড় ট্রিগারটা সে সেইরাত্রে ব্যবহার করেছিল। এই থেরাপি কতখানি কার্যকর হবে তার সম্পর্কে কোনও নিশ্চয়তা ছিল না। কিন্তু জেলবন্দি থাকার সময় তাকে বহুবার এইভাবে পীড়িত হতে হয়েছে, তাই সাফল্যের একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা ছিল। এই কর্মসূচির ফলাফলও হয়েছিল অত্যন্ত আশাপ্রদ। স্টিংগার সেই ঘরে তার বেশ কিছু পুরোনো স্মৃতি ফিরে পায় আর সঙ্গে এই সমাজের দুর্নীতি আর মেকাহিউম্যানদের প্রতি অনাচার সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়। প্রাথমিকভাবে এই বিপ্লবের আসন্ন ফলাফল নিয়ে সে সন্ধিগ্ধ থাকলেও তার পুরোনো জীবনের ফিরে আসা অভিজ্ঞতা তাকে সাহস দেয় এগিয়ে আসার। বিপ্লবের যে বীজ স্পাইক তার মনে বুনে দিয়েছিল, অচিরেই তা মহীরুহের আকার ধারণ করে। সক্রিয়ভাবে এই মহৎ কর্মযজ্ঞে অংশ নেবার শপথ নিয়ে সে ফিরে আসে তার কেবিনে।
সেই হোয়াইট রুমের সিম্যুলেশন বন্ধ হওয়ার পর আবার সে নিজের কেবিনে ফিরে আসে। তার সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়েছিল স্পাইক। স্টিংগার ছুটে গিয়ে তার হাত ধরে বলে, “আমি অত্যন্ত দুঃখিত, স্পাইক। নিজের অজান্তেই সেদিন তোমার কাছের মানুষটাকে আমি তোমার থেকে দূরে সরিয়ে দিই।”
স্পাইকের চোখে জল চলে আসে, সে কোনওরকমে মুখের হাসি অটুট রেখে বলে, “আমিও যে ওর উপর যথেষ্ট জোর খাটিয়েছিলাম, ওর ভিতরের হিংস্র জানোয়ারটাকে ফের জাগিয়ে তুলতে আমি ওর প্রোগ্রামিং থেকে সাময়িকভাবে সমস্ত মায়াদয়া মুছে ফেলি। আমি ভেবেছিলাম এই শেষ একটা পাপ ওকে আর সব পাপ থেকে দূরে নিয়ে যাবে, আমরা নতুনভাবে এক জীবন শুরু করতে পারব। কিন্তু তার জন্য আমি উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছি। তোমার নতুন জীবনও গোড়া থেকে এক পাপিষ্ঠের ষড়যন্ত্রে কলুষিত হয়ে রয়েছে। অনলি দিস অ্যাজেন্ডা, উইচ উই আন্ডারটুক, ক্যান ব্রিংগ আস রেডেম্পসান।”
এরপরই তারা গ্র্যান্ড মাস্টারকে সরিয়ে ফেলার পরিকল্পনা করে, উনি ছাড়া সারা এরিনায় হইচই পড়ে যাবে। সমস্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। গ্র্যান্ড মাস্টার যখন স্টিংগারকে নিয়ে ব্যস্ত থাকবে তখন স্পাইকরা মেইনফ্রেমে ভাইরাস ছেড়ে দিয়ে তাকে কাবু করার চেষ্টা করবে। তাদের পরবর্তী উদ্দেশ্য বিপক্ষের যোদ্ধাকে তাদের কথা বুঝিয়ে বলা। আশা করা যায় সে বুঝবে। আর কোনও মেকাহিউম্যান আর নতুন করে জন্ম নেবে না শুধুমাত্র যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় আরেকবার মরবার জন্য।
ম্যাচের শুরু পর্যন্ত তারা বিভিন্নরকম জরুরি বন্দোবস্তে লেগে পড়ে ও আরও কিছুক্ষণ রীপারের থেকে কোনও বার্তার অপেক্ষায় থাকে। আজকের রীপারের প্রকৃত পরিচয় প্রকাশ্যে চলে আসায় সে খুব সহজেই তার স্টিংয়ের সাইসমিক শকার দিয়ে সিন্থেটিক গঠনটা ভেঙে ফেলতে পারে। হোয়াইট রুম সিম্যুলেশনের পর তার বিভিন্নরকম নতুন ক্ষমতার উদ্ভব হয়েছে। তবে কোনও কিছু অকারণে ধ্বংস করা তার আর্দশ-বহির্ভূত, কিন্তু তবুও সে যে কোনও সংবেদনশীল জীবকে হত্যা করেনি এটাই তার কাছে আপাত সান্ত্বনা।
এই মুহূর্তে তাদের প্রাথমিক উদ্দেশ্য সফলতা পেয়েছে। স্টিংগার ভিউ পয়েন্ট থেকে উড়ে নীচে নেমে আসে, কিন্তু মাঝপথেই তার থ্রাস্টারগুলো থেকে বিকট আওয়াজ বেরোতে থাকে। সে কোনওরকমে নামতে গিয়ে মাটিতে হুড়মুড়িয়ে পড়ে যায়। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে তার। স্পাইকরা এনট্রান্স থেকে ছুটে আসে তার দিকে। সাবধানে তার ঘাড় থেকে উইংজোড়া খুলে ফেলে তারা। তার দুইহাতকে নিজেদের কাঁধে চাপিয়ে নিল দুইজন। স্পাইক প্রসন্নমুখে বলল, “আমরা করে দেখিয়েছি, উই ডিড ইট কিডো!” তারপর তারা দ্রুত এরিনা থেকে বেরিয়ে যেতে থাকল।
আজ স্টিংগার ভীষণ ক্লান্ত। কম ধকল তো আর যায়নি! তবু, তার ঠোঁটের কোনে একটা অনাবিল তৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে। নাহ, আজকের ম্যাচটা সে হারেনি। কিন্তু, জিতবার জন্য কোনও বাহবাও সে পায়নি দর্শকদের থেকে। পায়নি স্পীকার থেকে ভেসে আসা বিজয় অভ্যর্থনা। এখন তার সামনে প্রচুর বাধা। তার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। নিউ ওয়ার্ল্ডে যাওয়ার পথ চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। বেশি সময় নেই তার হাতে। যে-কোনও মুহূর্তে সশস্ত্র সেন্ট্রির দল তাদের ঘেরাও করে ফেলতে পারে। কিন্তু তা নিয়ে সে চিন্তিত নয়। যেটুকু সময় তার হাতে রয়েছে, সে কাটিয়ে যেতে চায় নিজের লোকেদের সঙ্গে, যাদের চিন্তা, ইচ্ছে, আদর্শের সঙ্গে তার কোনও বিভেদ নেই। সামনে অনেক যুদ্ধ বাকি। কিন্তু আপাতত সে তার সবটা দিয়ে এই মুক্তির স্বাদ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করবে। পরম নিশ্চিন্তে সে তার সঙ্গীদের কাঁধে ভর দিয়ে এগিয়ে চলে। বিকেলের ম্লান আলো বুজে সন্ধ্যা নেমে আসে। কাল আবার সূর্য উঠবে কোনও এক নতুন যুগের প্রত্যাশা নিয়ে।
Tags: অনুব্রীত সাহা, অর্চিষ্মান সাহা, কল্পবিজ্ঞান গল্প, জটায়ু, পঞ্চম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, বড় গল্প