স্মৃতি – এইচ পি লাভক্র্যাফট
লেখক: বাংলা অনুবাদঃ বৈশম্পায়ন শীল
শিল্পী: সূর্যোদয় দে
রাতে নিশ্ উপত্যকার আকাশে বসে থাকা চাঁদটাকে দেখলে মনে হয়, যেন সে কয়েকশ’ বছরের পুরোনো কোনো অভিশাপের কুষ্ঠ–ক্ষত আজও সারা শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছে। মনে হয়, কোনো ডাইনিবুড়ি তার মৃত্যুশয্যায় শুয়ে অপেক্ষা করছে কখন যমদূতেরা এসে পায়ে শিকল পরিয়ে তাকে চিরতরে টেনে নিয়ে যাবে পাতালের অন্ধকারে। তবু চাঁদের ওই আধমরা রশ্মিগুলো যেন দমতে শেখেনি, বরং বারংবার নিজেদের দুর্বল শিংয়ের আঘাতে তারা ছিন্ন–ভিন্ন করে ফেলতে চেষ্টা করে চলে তাদের পায়ের নিচের পৌরাণিক ইউপাস বিষবৃক্ষের বেড়াজালকে; চেষ্টা করে আলোয় আলোয় রাঙিয়ে তুলতে জঙ্গলের মাটিকে। কিন্তু না, তাদের আর মাটি ছোঁওয়া হয়ে ওঠে না। ফলে সেই অন্ধকারে যাদের পায়ের শব্দ হৃৎপিণ্ডের ‘লাব–ডাব’কে বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে, সৌভাগ্যবশত তাদের বিকট মূর্তিগুলো দৃষ্টির অগোচরেই থেকে যায়।
উপত্যকার ঢাল বেয়ে সরীসৃপরূপী শয়তানের মতো বুকে হেঁটে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে দ্রাক্ষালতা আর তার অন্যান্য দানব জাতভাইরা। কোথাও রাজপ্রাসাদের ধ্বংসস্তূপে শ্বেতপাথরের ফাঁক–ফোঁকর দিয়ে লতাপাতারা সদলবলে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছে, নিজেদের আকর্ষের নাগপাশে পেঁচিয়ে ধরেছে ক্ষয়ে যাওয়া খিলান আর সব অচেনা ভাষায় স্মৃতিকথা খোদাই করা মেনহিরগুলোকে। আবার কখনও তাদের শিকার হয়েছে রাজপথের দু’পাশের ফুটপাথ। দীর্ঘ অব্যবহারের কারণে এককালের সব বিলাসবহুল জমিদার বাড়ির উঠোন আজ কেবলই শিশু চারাগাছেদের দৈত্যাকার হয়ে ওঠার আদর্শ পরিবেশ। যে আদর্শ পরিবেশে সদাচঞ্চল বানরের বাচ্চারা লাফিয়ে–ঝাঁপিয়ে হেসে–খেলে নিশ্চিন্তে বেড়ে ওঠে। যেখানে অন্যদিকে, নিচের অন্ধকারে অমূল্য সোনা–দানা–রত্নে উপচে পড়া রাজকীয় খাজানা–র সিন্দুকগুলোকে বুক দিয়ে আগলে রেখে অনির্দিষ্টকালের জন্য দায়িত্ব পালন করে চলে বিষাক্ত সাপ আর নাম–না–জানা সব ভয়ংকরেরা।
হায়, যারা রাতের পর রাত এই বিলাসবহুল স্থানে উৎসবে সামিল হয়েছে, যাদের পায়ের ধুলোয় এই পথ সেদিন রাজপথের সম্মান পেয়েছে – সেই হারিয়ে যাওয়া প্রাণীদের কথকতা শোনানোর জন্য আজ কি কেউ বেঁচে আছে?
উপত্যকার মধ্যে মধ্যে দেখা মেলে পাঁচিল ধ্বসে খসে পড়া পাথরের চাঁইয়ের। মসের আঁশটে, স্যাঁতস্যাঁতে চাদরের তলায় তারা কত শান্তিতেই আজ না ঘুমিয়ে আছে! বুঝতে অসুবিধে হয় না, কত যত্নের হাতে কত মজবুত কাঁচামালের মিশ্রণে সেসব আকাশছোঁয়া পাঁচিল এককালে তোলা হয়েছিল। সেই যে প্রাচীনকালে উপত্যকার স্থপতিরা শহর গড়ার প্রয়োজনে এই পাঁচিলগুলো খাড়া করেছিল, আজও তার প্রয়োজন ফুরোয়নি। আজও তাদের ছায়াতেই যে ব্যাঙ হয়ে ওঠে কুনো–ব্যাঙ্গাচিরা!
নিশের গাঢ় জঙ্গলের বুক চিরে বয়ে চলেছে দানুশ নদী। সে নদী এতটাই পাঁকে ভরা আর আগাছা–ঠাঁসা যে নদীর সংজ্ঞার সাথে তার মিল পাওয়া বেশ কঠিন। কোন গোপন প্রস্রবণ তাকে জন্ম দিয়েছে, কোন কন্দরেই বা তার মৃত্যু ঘটেছে, কে জানে! সেই সৃষ্টির আদি থেকে যে মায়াবী দৈত্য এই উপত্যকার রানীর পদে আসীন ছিলেন তাঁকেও এই প্রশ্নগুলো রোজই ধাঁধিয়ে দেয়—‘নদী, কেন তোমার জল এমনতর রক্তলাল? নদী, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ – দীর্ঘ প্রবাসের পর কোথায়ই বা মিলিত হতে যাও?’
চাঁদের আলোয় ঢাকা নিশের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে একদিন পৃথিবীতে নেমে আসে এক বৃদ্ধা পরী। সঙ্গিনী জোটে নিঃসঙ্গ দৈত্যরানির–র। নিশের বুকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানান ইমারতের কঙ্কাল দেখতে দেখতে কৌতুহলবশে সেই বৃদ্ধা বলে ওঠে দৈত্যকে—“তিনকুড়ি বয়স তো পেরিয়ে এলাম, ছোটবেলার অনেক স্মৃতিই এখন আর মনে আসে না। কিন্তু তোমারও কি কিছু মনে পড়ে না?… খুব জানতে ইচ্ছা হয়, যারা দিনরাত এক করে এত–শত রাস্তাঘাট–রাজপ্রাসাদ–ইমারত এসব গড়ে তুলেছিল, তারা কি আদৌ ইতিহাসে স্থায়ী কিছু রেখে যেতে পেরেছে? কেমনই বা দেখতে ছিল তাদেরকে?… আচ্ছা, ওদের কোনো ডাকনাম ছিল কি?”
বলিরেখা আঁকা মুখে হেসে উত্তর দেন দৈত্যরানি—“ভালো প্রশ্নই করেছ বটে। সত্যি, গত কয়েক হাজার বছরে এদের এত গৌরবের সাক্ষী থেকেছি, যে মাঝে মাঝে আমার নিজেকেই স্মৃতি মনে হয়। কিন্তু কী জানো, আমারও তো এলোচুলে পাক ধরেছে, আমিও তো বুড়ি হয়েছি—আমারই বা আজকাল কতটা মনে থাকে! তবে… আবছা–আবছা হলেও ওদের গড়নটা আমার চোখের সামনে এখনও ভাসে। দ্যাখো দ্যাখো, ওই বাঁদরগুলো কেমন খেলে বেড়াচ্ছে – অনেকটা এদের মতোই ওদের সেই চেহারা। সত্যি, বড়ই জটিল ছিল ওদের চিন্তাভাবনা, আর তার চেয়েও বেশী বোধহয় প্যাঁচালো ছিল ওদের মন; ঠিক যেন দানুশের মতোই চরিত্র – ধাঁধালো, এমন ধাঁধা যা কখনও সমাধান হয় না। … ওই প্রাণীরা ইতিহাসে কী কী ছাপ রেখে গেছে তা আজ আর স্মৃতিতে নেই, তবে নিজেরাও ইতিহাস হওয়া থেকে রক্ষা পায়নি। কিন্তু ওদের নামটা আমার বেশ পরিষ্কারই মনে আছে। তার একমাত্র কারণ, আমাদের এই জংলি নদীর নামের সাথে ওদের নামের অন্ত্যমিল।… আর ওই বিলুপ্ত প্রজাতির ডাকনাম—মানুষ।”
পরীর আশা ছিল, হয়তো দৈত্য–র স্মৃতি থেকে উঠে আসবে আরও কিছু মণি–মাণিক্য। কিন্তু সে আশা আর পূরণ হয় না। একসময় রাত ফুরিয়ে আসে। পরী উড়তে উড়তে মিলিয়ে যায় চাঁদের আলোর মাঝে। তাকে যে ফিরতেই হবে! আর উপত্যকায় একাকিনী দৈত্যরানি সেই বিলুপ্ত স্থপতিদের স্থাপত্যগুলোকে দেখে বেড়ান; হয়তো মনে করবার চেষ্টা করেন তাদের গৌরবময় ইতিহাসকে – যদি কিছু মনে পড়ে সেসব পুরোনো কথা – আর হতাশচোখে চেয়ে থাকেন ডালে ডালে ঝুলে বেড়ানো ওই বানরগুলোর দিকে…
একদিন সময়ের কঠোর নিয়মে হয়তো এদেরও শেষ ঠিকানা হবে সকলের স্মৃতিতে, কে জানে!
অনুবাদ প্রসঙ্গেঃ গল্পটি এইচ পি লাভক্র্যাফটের লেখা ‘Memory’ গল্পটির থেকে অনুপ্রাণিত। এটি প্রথম প্রকাশ পায় ১৯২৩ সালে, ‘The National Amateur’ ম্যাগাজিনের মে সংখ্যায়। গল্পটি চিরাচরিত ‘লাভক্র্যাফটিয়ান হরর’–এর থেকে আলাদা, একে বরং একরকম ‘উইয়ার্ড ফ্যান্টাসি’ বলাই ঠিক। লেখক হররের বদলে এখানে মনোযোগ দিয়েছেন “ephemeral nature of human civilization”, অর্থাৎ আদম আর ইভ্–জাত এই সভ্যতার ক্ষণস্হায়ী চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে।
Tags: অনুবাদ, অনুবাদ গল্প, এইচ পি লাভক্র্যাফট, দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, বৈশম্পায়ন শীল, সূর্যোদয় দে, স্মৃতি
বেশ ভালো লাগল অনুবাদটা। এবং এই নবাগত যে লাভক্রাফটের এত কঠিন একটা কাজে হাত দিয়েছেন, শুধু সেটার জন্যই তাঁর সাধুবাদ প্রাপ্য। মুল গল্পে সম্ভবত দু’জন পুরুষ চরিত্র ছিল, যারা অনুবাদে মহিলা চরিত্র হয়ে উঠেছে–এই দিকটাও বেশ ভালো লাগল। তবে মহিলা চরিত্র-ই যদি আনা হয় তবে ‘মায়াবী দৈত্য’ বা ‘দৈত্য’ শব্দগুলোর বদলে ‘দানবী’ বা এরকম কিছু থাকলে বোধহয় ঠিক হত। সম্পাদকদের কাছে সংশোধনের অনুরোধ রাখলাম। এবাদে লেখাটি খুবই সুন্দর !
নতুন নতুন পড়া শুরু করেছি লাভক্র্যাফটের সাহিত্যকর্ম। বাংলাভাষী পাঠকদের কাছে তিনি বেশ অপরিচিত মনে হল। তার কঠিন লেখনিকে বাংলায় উঠিয়ে আনার জন্য তাই অনুবাদককে সাধুবাদ জানাচ্ছি। গল্পটা নাড়া দেওয়ার মতই, শুধুমাত্র সংলাপের মাধ্যমেই মানবজাতির পরিণতি বলে দেওয়া হল। নদীর নামের সাথে অন্ত্যমিলটা খুব ভাল লেগেছে। মানবজাতির এত এত কীর্তির পরও বৃহৎ দুই অস্তিত্বের স্মৃতিতে এতটুকুন জায়গা অধিকার না করে রাখার ব্যাপারটা অন্যরকম একটা অনুভূতির জন্ম দিল। মহাকালের সামনে আমাদের ক্ষুদ্রতার ব্যাখ্যা দিল যেন গল্পটি।