হারানো ছেলে!
লেখক: গুরনেক সিং
শিল্পী: জটায়ু
দেওয়ালে টাঙানো ঘড়িটার দিকে আর একবার তাকাল স্নেহাংশু। পাঁচটা বেজেও বাজতে চায় না যেন! এখনও পাঁচটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি!
রিভল্ভিং চেয়ারটা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল স্নেহাংশু। পিএ মিস মৈত্রর টেবিলটা খালি। আজ আধ ঘণ্টা আগেই ও ছুটি নিয়ে বেরিয়ে গেছে। টমাস এন্ড ক্রুডাস কোম্পানির কয়েকটা স্টেটমেন্ট ছিল চেক করবার—সেইগুলি নিয়েই এতক্ষণ ব্যস্ত ছিল স্নেহাংশু। কিছুক্ষণ আগেই ফাইনাল চেকিং শেষ করে পাঠিয়ে দিয়েছে ডাইরেক্টর মিস্টার স্টিভেন্সনের ঘরে। এবার তার ছুটি—পাঁচটা বাজতে আর মাত্র চার মিনিট!
চেম্বার সংলগ্ন বাথরুমে ঢুকে কোটটা গায়ে চাপিয়ে নিল স্নেহাংশু। আয়নায় টাইয়ের নট্টা একটু দেখে নিল, বিস্রস্ত চুলগুলিকে একটু ব্রাশ করে নিল। ···বাড়ি যাবার পথে একবার নিউ মার্কেটটা ঘুরে যেতে হবে। সুমিতার কতকগুলো ফরমাশ আছে—কয়েকটি টুকরো কেনাকাটা।
কী যেন আনতে বলেছিল সুমিতা? কাস্টার্ড পাউডার, না ফেস পাউডার? ওই দেখেছ!—আবার ভুলে গেছে স্নেহাংশু! কতবার সুমিতা বলেছে, “এতই ভুলো মন যদি—একটা লিস্ট করে নাও না কেন, বাপু? খামোকা কতকগুলো আজেবাজে জিনিস কিনে টাকার শ্রাদ্ধ করা!” এখন মনে হল একটা চিরকুটে লিখে আনলেই বোধহয় ভালো হত। যাকগে—
চাইমিং ক্লকের মন্দ মধুর ছন্দে ঘরটা ভরে উঠল হঠাৎ—পাঁচটা বাজলো!
ব্যস্তভাবে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল স্নেহাংশু। টেবিল থেকে পাইপ আর পাউচটা তুলে নিয়ে পকেটস্থ করল। তার পর চেম্বারের সুইং ডোর ঠেলে এগিয়ে গেল অফিসার্স লিফটের দিকে। ···সুমিতা বার বার বলে দিয়েছে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্যে। কাস্টার্ড পাউডার (নাকি ফেস পাউডার? চুলোয় যাক, দুটোই কিনে নিলে হবে)! টি শুধু কিনে নিতে হবে যাবার পথে নিউ মার্কেট থেকে, সঙ্গে আরও দু-একটা টুকিটাকি, কিছু স্পেশাল প্যাক তামাক, একটা টুথব্রাশ। মোটামুটি সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই বাড়ি ফিরতে পারবে স্নেহাংশু। ডালহাউসি থেকে নিউমার্কেট ধরো মিনিটতিনেক—ট্রাফিক লাইটের বাধার দরুন ধরো আরও দু-মিনিট—মোট পাঁচ মিনিট; নিউ মার্কেটে পনেরো মিনিট—আর সেখান থেকে নিউ আলিপুর বড় জোর দশ মিনিট।—না, সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই বাড়ি ফিরতে পারবে ও।
লিফটম্যান সসম্ভ্রমে দ্বার খুলে সরে দাঁড়াল। গট গট করে বেরিয়ে এল স্নেহাংশু—এগিয়ে গেল গ্রাউন্ড ফ্লোরের কার পার্কের দিকে। সময় নষ্ট করার মোটেই ইচ্ছা নেই তার।
কিন্তু একি!! হঠাৎ যেন একটি প্রচণ্ড আঘাত খেয়ে থমকে দাঁড়াল সে।—তার গাড়িটা? তার গাড়িটা কোথায়? রোজ যেখানে পার্ক করে সেখানে তো নেই গাড়িটা! বড়ো সাহেবের বুইক্টা আছে, ছোট সাহেব মিস্টার রিচার্ডসনের সদ্যকেনা সেভ্রোলেটা ঝকঝক করছে, চ্যাটার্জি সাহেবের ধূসর জাগুয়ারটাও রয়েছে, অথচ তার হালকা আসমানি রংয়ের ডবলিউ বিএ ৫২৭৯ মার্ক টু-টাই নেই!
তবে কি—চুরি? কিন্তু গেটে তো চব্বিশ ঘণ্টা দারোয়ান মোতায়েন থাকে। এখান থেকে কারুর নজর এড়িয়ে গাড়ি বের করে নিয়ে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব!
তাহলে?—নাকি গাড়িটা আজকে আনেইনি স্নেহাংশু? কিন্তু তাই বা কি করে হবে? তার স্পষ্ট মনে আছে—আজ যখন সে অফিসে আসবার জন্যে সবে গাড়িতে স্টার্ট দিয়েছে তখন সুমিতা ডাক দিয়ে বলল, “স্নেহ, মনে থাকে যেন, ফাইভ থার্টি শার্প!”
তবে? তবে গাড়িটা গেল কোথায়?
“সেলাম হুজুর!” কার-পার্কের ক্লীনার গিরিধারী সেলাম করে এসে দাঁড়াল।
মাথাটা একটু নোয়াল স্নেহাংশু।
কিন্তু স্নেহাংশু কিছু বলবার আগেই গিরিধারী প্রশ্ন করল, “আজ গাড়িটা আনলেন না, স্যার? বিরেক ডাউন হইয়েছে নাকি?”
চমকে উঠল স্নেহাংশু! তাহলে গাড়িটা সত্যিই সে আনেনি?
কারণ, গাড়িটা কার-পার্কে এসে ঢুকলেই গিরিধারীর প্রথম কাজ হল দরজাটি খুলে ধরে দীর্ঘ এক মিলিটারি সেলাম ঠোকা। তার নিজের ভুল হলেও গাড়ি সম্পর্কে গিরিধারীর ভুল হওয়ার কোনও সংগত কারণ নেই!
গিরিধারীর প্রশ্নের উত্তরে বিড় বিড় করে কী যে বলল স্নেহাংশু—সেটা নিজেই সে ভালো ভাবে বুঝতে পারল না। গিরিধারী কিছু বলবার আগেই ও মেন গেটের সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে নেমে গিয়ে ফুটপাথের জনস্রোতের মধ্যে মিশে গেল। কপালে হাত না দিয়েও ও বুঝতে পারল এই নভেম্বরের সন্ধ্যাতেও ওর কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমে উঠেছে!
হন হন করে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে মোড়ের মাথায় দাঁড়াল স্নেহাংশু। কম্পিত হাতে পকেট থেকে পাইপ আর তামাকের পাউচটি বার করে ধীরে ধীরে পাইপে তামাক ভরল—তারপর দেশলাই জ্বালিয়ে কয়েক বারের চেষ্টায় পাইপটা ধরাল। পিপাসার্তের মতো কয়েকটি দীর্ঘ টান দিয়ে ফুসফুসের মধ্যে টেনে নিল তামাকের কটু আর কড়া ধোঁয়াটা। তারপর রুমালটা বার করে কপালে জমে ওঠা ঘামের ফোঁটাগুলি মুছে ফেলল!
আ— !
ব্যাপারটা এখনও ও ঠিক পরিষ্কার বুঝতে পারছে না। গাড়ি যদি ও আজ নাই এনে থাকে, তাহলে ও অফিসে এল কী করে? নিশ্চয়ই বাসে বা ট্রামে নয়! তার স্পষ্ট মনে আছে আজ যখন সে অফিসে আসবার জন্যে সবে গাড়িতে স্টার্ট দিয়েছে তখন সুমিতা ডাক দিয়ে বলল—কিন্তু সেটা কি আজকে, না গতকাল? সেই যে কাস্টার্ড পাউডার আর ফেস পাউডারের ব্যাপারটা নিয়ে সুমিতা হেসে হেসে লুটিয়ে পড়ল—সেটা তো কালকের ঘটনা! হ্যাঁ, ঠিক মনে পড়েছে ওর। গতকালই তো সে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি গাড়িটা বার করে নিয়ে নিউ মার্কেটে গেল—
আবার রুমালটা বার করতে গেল স্নেহাংশু। হাতে কি যেন ঠেকল—পরিচিত ছোঁয়া। বার করে দেখল গাড়ির চাবি! সে যদি আজ গাড়ি নাই এনে থাকে তাহলে চাবিটা তার পকেটে এল কি করে? …ইস, মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করছে… উঃ! একটু ভাবতে দাও!
…হ্যাঁ, তাহলে দেখা যাচ্ছে, গাড়িতেই ও অফিসে এসেছিল, কিন্তু অফিসের কার-পার্কে গাড়িটা পার্ক করেনি। তাহলে কি ও গাড়িটা বাইরে কোথাও পার্ক করে অফিসে ঢুকেছে? খুব সম্ভব তাই। তার অফিসের সামনেই তো একটা পার্কিং স্পেস আছে, হয়তো গাড়িটা সেইখানেই পার্ক করা আছে এখনও!
বিদ্যুৎ বেগে ফিরে দাঁড়াল স্নেহাংশু। মুখের পাইপটা নিভে গিয়ে ছিল, কিন্তু সেটা পুনরায় ধরাবার মতো ধৈর্য আর তার ছিল না। ফুটপাথচারী কয়েকজনকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ও ছুটল তার অফিসের দিকে।
চারিদিকে তখন অন্ধকার নেমে এলেও রাস্তার অপর দিকের কয়েকটি বৈদ্যুতিক আলোয় পার্কিং স্পেসটি আলোকিত। বেশির ভাগ গাড়িই বেরিয়ে গেছে। যে ক-টি গাড়ি তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে—সেগুলির মধ্যে হালকা আসমানি রংয়ের মার্ক-টু গাড়িটা তো নেই !
এখন তাহলে? তাহলে এখন ও কি করবে? ট্যাক্সি করে বাড়ি চলে যাবে? কিন্তু গাড়িটা সম্পর্কে যখন সুমিতা জানতে চাইবে তখন ও কি বলবে? বলবে যে গাড়িটা কোথায় পার্ক করেছি মনে পড়ছে না!—ব্যাপারটা শুধু যে লজ্জাকর হবে তাই নয় হাস্যকরও কি হবে না? নাকি পুলিশে গিয়ে রিপোর্ট করবে যে আমার গাড়িটা আমি খুঁজে পাচ্ছি না?—কিন্তু সব ব্যাপারটা যখন জানাজানি হয়ে যাবে তখন কি তাকে বিকৃতমস্তিষ্ক বলে রাঁচি পাঠাবার ব্যবস্থা পুলিশ করবে না?
হোক গে, তবু থানায় একটা ডায়েরি করিয়ে রাখাই ভালো, অন্তত মন্দের ভালো! তাতে নিজের দিকটা বাঁচবে। না হয় বলা যাবে, গাড়িটা অফিসের বাইরে পার্ক করা ছিল—কে বা কারা চুরি করে নিয়ে গেছে! গাড়ির মোটামুটি একটা বর্ণনা—রং, মডেল, রেজিস্ট্রেশান নম্বর ইত্যাদি টুকে নিয়ে ওরা ছেড়ে দেবে। সেই বরং ভালো। হয়তো সত্যিই গাড়িটা চুরিই হয়েছে।
মোড়টা ঘুরে লালবাজার স্ট্রিটে পড়ল স্নেহাংশু। থানার পুলিশ অফিসারকে কী বলবে মনে মনে তার একটা রিহার্সাল দিয়ে নিতে চাইল। …হালকা আসমানি রংয়ের মার্ক-টু গাড়িটা …১৯৬৫ মডেল …নম্বর ডবলিউ বিএ …৭৫২৯? না না, ৫৭২৯ …নাকি ৭৫৯২?
একটা ঘড়ির দোকানের উজ্জ্বল সো কেসের সামনে হঠাৎ ভূত দেখার মতো থমকে দাঁড়াল স্নেহাংশু! …গাড়ির নম্বর! গাড়ির নম্বরটা তো তার মনে পড়ছে না। কেমন যেন সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে! এ তার কী হচ্ছে? কী হচ্ছে তার!
রুমালটা বার করতে গিয়ে আবার গাড়ির চাবিটা তার হাতে ঠেকল। হঠাৎ নিদারুণ ক্রোধে চাবিটা বার করে দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিলো স্নেহাংশু! জাহান্নামে যাক গাড়ি—দরকার নেই তার! ওই ঝরঝরে ফিয়াটটা যদি কেউ চুরি করে নিয়ে গিয়ে থাকে, তাহলে উদ্ধার করে গিয়েছে স্নেহাংশুকে! ওর কত দিনের সাধ, একটা মার্ক-টু গাড়ি কিনবে—হালকা আসমানি রংয়ের ঝকঝকে তকতকে নতুন গাড়ি—
কিন্তু!!—হঠাৎ মাথাটা দু-হাতে চেপে ধরলো স্নেহাংশু। কোথায় যেন একটা গোলমাল হয়ে যাচ্ছে না, আসলে ফিয়াট গাড়ি তো ওর কোনও কালে ছিল না—বরং আসমানি রংয়ের মার্ক-টু গাড়িই তো আছে ওর। তাহলে ফিয়াটের কথা আসছে কোত্থেকে? নাকি এর ঠিক উল্টোটাই সত্যি?···আচ্ছা, ওকি পাগল হয়ে যাচ্ছে? ক্রমাগত নিজের ওপর কনট্রোল হারিয়ে ফেলছে?
না না!—অধীর হলে চলবে না। একটু শান্ত হতে হবে। ঠান্ডা মাথায় ধীরে সুস্থে সব ব্যাপারটা ভেবে দেখতে হবে। সারাদিনের কাজকর্মের চাপে ও হয়তো বড় ক্লান্ত—সেই ক্লান্তির চাপ পড়েছে তার স্নায়ুমণ্ডলীর ওপর—এটাকে বেশি বাড়তে দেওয়া উচিৎ নয়। ঠান্ডা মাথায় সব ব্যাপারটা ভাবতে হবে।
হ্যাঁ, এখন উত্তেজিত হলে সব কিছু ভেস্তে যাবে—ও হয়তো সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে যাবে। তার চেয়ে মাথা ঠান্ডা রেখে ভাবো। না, ভাবনারও কোন দরকার নেই। চুপচাপ হাঁটা যাক বরং। কেমন ঠান্ডা ঝিরঝিরে শীত শীত হাওয়া দিচ্ছে। কার্জন পার্কের দিকেই হাঁটা যাক—না হয় পার্কে বসে বিশ্রাম করা যাবে কিছুক্ষণ। ভাবনা এখন নয়—পরে ভাববার অনেক সময় পাওয়া যাবে।
আবার এসপ্লানেডের দিকে হাঁটতে লাগল স্নেহাংশু। একবার পাইপটা ধরিয়ে নেবার কথা মনে হল, কিন্তু একটি অসহ্য ক্লান্তি যেন সারা অঙ্গে একটি ভারি বোঝার মতো চেপে বসেছে। পাইপ ধরাতে ইচ্ছে হল না আর।
সত্যি, মানুষের মনের গড়নটা কতো বিচিত্র!—হাঁটতে হাঁটতে ভাবলো স্নেহাংশু —কোথায় কি একটা কিছু ঘটল, তার জন্যে মানুষের স্মৃতিশক্তিটাই জবাব দিয়ে বসে রইলো। স্নায়ুর ওপর সামান্য একটু চাপ, মনের ওপর সামান্য একটু বোঝা, তাতেই সব কিন্তু ওলোটপালোট হয়ে যাবার জোগাড়!—হালকা মনে হাসল স্নেহাংশু।
হ্যাঁ, ঠান্ডা মাথায় একটু বিশ্রাম, তারপর একটা ট্যাক্সি ধরে সোজা সাদার্ন এভিনিউ। সুমিতা নিশ্চই অপেক্ষা করে বসে আছে। বাড়ি গেলেই হাজারো প্রশ্ন নিয়ে ছুটে আসবে—কোথায় ছিলে, কী হয়েছিল, গাড়ি কোথায়?—কিন্তু কোনও জবাব দেবে না স্নেহাংশু। বলবে, “এখন নয়, পরে; কাল সকালে সব বলব। এখন আমাকে একটু শুতে দাও। আমি বড় ক্লান্ত!” সত্যি ও বড় ক্লান্ত।… তার শোবার ঘরের দক্ষিণমুখো জানালাগুলো দিয়ে আসা লেকের ফুরফুরে হাওয়ায় ওর সত্যি এখন একটু বিশ্রামের দরকার। তারপর কালকে ডক্টর চন্দকে না হয় একবার—
হঠাৎ থমকে দাঁড়াল স্নেহাংশু। এ সব কী বাজে বক বক করে চলেছে ও? কি ভাবছে যা তা! ওর বাড়ি তো নিউ আলিপুরে— ২৯।৩।২, নিউ আলিপুর রোড। সাদার্ন এভিনিউতে ও কোনওদিন থাকত না! নিউ আলিপুরে উঠে আসবার আগে ও থাকত বালীগঞ্জের কর্নফিল্ড রোড—তখনও সুমিতা আসেনি ওর জীবনে—তারপর সুমিতাকে বিয়ে করেই ও উঠে গেল নিউ আলিপুর রোডে—২৯য়ের কতোর কত নিউ আলিপুর রোডে। তবে হ্যাঁ! মনে পড়েছে বটে! তার আগে ও বোধহয় সাদার্ন এভিনিউতেই থাকত! কিন্তু সুমিতা তো সেখানে ছিল না। তাহলে ও কি আগে নিউ আলিপুরে থাকত, তারপর সুমিতাকে বিয়ে করে উঠে গিয়েছিল সাদার্ন এভিনিউতে? তার শোবার ঘরের জানালা দিয়ে ও আর সুমিতা কতবার লেকের জলের চিকমিকানি দেখেছে! ঠিক, ঠিক। অথচ, মজা দেখ, এতক্ষণ ওর দৃঢ় ধারণা ছিল ও নিউ আলিপুরে থাকে!… কিন্তু তাই কি? এতক্ষণ যা তার ধারণা ছিল সেটাই কি ভুল, নাকি তার ভুল ধারণাটাই আসলে সত্যি?
কার্জন পার্কের ট্রাম লাইনটা পার হয়ে স্নেহাংশু টলতে টলতে পার্কের দিকে এগিয়ে গেল, তারপর ধপ্ করে বসে পড়ল সবুজ ঘাসের লনের ওপরে। সে নিশ্চয়ই অসুস্থ।—খুবই অসুস্থ। না হলে এ সব আবোল-তাবোল কথা তার মনে আসছে কেন? স্মৃতিটা এ ভাবে তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে কেন? সে তো একটি সুস্থ-সবল-স্বাভাবিক মানুষ। এই তো কিছুক্ষণ আগে সে তার অফিসে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবে কাজকর্ম করে এসেছে; রিচার্ডসন এন্ড ক্রুডাস কোম্পানির কাগজপত্র নিখুঁত দক্ষতার সঙ্গে চেক করে দিয়ে এসেছে। গতকাল সোমবারের উইকলি মিটিংয়ে ও নিখুঁতভাবে কোম্পানির সাপ্তাহিক অগ্রগতির বিবরণ দিয়েছে—তবে?—
স্মৃতির মণিকোঠায় কোথায় যেন একটি মৃদু ঘন্টি বেজে উঠল—ক্রমে সেটি রূপান্তরিত হল একটি উদ্দাম পাগলা ঘন্টিতে! অতীতের অন্ধকার স্তর ভেদ করে কি একটা প্রশ্ন বর্তমানের আলোয় উঠে আসতে চাইছে! কি! কি! কী!!… আজ কী বার?
কেন, মঙ্গলবার! কাল ছিল সোমবার—উইকলি মিটিং তো কালই হল।… কিন্তু তাই বা হবে কি করে? উইকলি মিটিংয়ের পরের দিন ও যে স্টিভেন্সন সাহেবের সঙ্গে লাঞ্চ খেল, সেটাই তো গতকাল!—তাহলে মিটিংটা হয়েছিল গত পরশু, আজ তাহলে দাঁড়াচ্ছে বুধবার—
“হে ভগবান!—আমি কি পাগল হয়ে যাব! মনে মনে আর্তনাদ করে উঠল স্নেহাংশু। আতংকের একটি হিমশীতল স্রোত ওর শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে গেল। এর পর হয়তো ও নিজের অফিসের নামটা পর্যন্ত ভুলে যাবে। যা সব ঘটছে, তাতে সেটাও নিশ্চয়ই খুব আশ্চর্যের ব্যাপার হবে না! তার মত সুস্থ সবল স্বাভাবিক একটা মানুষ, রিচার্ডসন এন্ড ক্রুডাসের মতো নামকরা একটি বিদেশি ফার্মের কভেনেন্টেড অফিসার—এক কথায় রিচার্ডসন এন্ড ক্রুডাসের···!
কিন্তু!! আবার!! হে ভগবান! ওর অফিসের নাম তো রিচার্ডসন এন্ড ক্রুডাস নয়! তাহলে কী? তাহলে কী… তাহলে কী?… না! না! শয়নে স্বপনে জাগরণে যে অফিসের নাম তার জীবনের সঙ্গে জপমালার মতো জড়িয়ে আছে, সে নামটি পর্যন্ত সে ভুলে যাবে এ কখনও হতে পারে না!… মনে মনে সব ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করল স্নেহাংশু… ও নিশ্চয়ই সিরিয়াসলি ভাবছে না… নইলে অফিসের নাম ভুলে যাবার প্রশ্নই ওঠে না। রিচার্ডসন এন্ড… রিচার্ডসন এন্ড… এন্ড… একি! সত্যিই ভুলে গেছে!!
হঠাৎ স্নেহাংশুর মনে হল ওর যেন বড় বিপদ! এই মুহূর্তে ছুটে গিয়ে সুমিতার কাছে আশ্রয় নিতে না পারলে এই মহানগরের জনস্রোতের মধ্যে, এই স্মৃতিবিভ্রমের চোরাবালির মধ্যে ও হয়তো চিরকালের মতো হারিয়ে যাবে! একটা কিছু করা দরকার—এই ভাবে বসে না থেকে একটা কিছু করা দরকার—অন্তত কোনও বন্ধুর সাহচর্যও ও যদি এখন পেত! কিন্তু কই, কোনও বন্ধুরই নাম তো এখন ওর মনে পড়ছে না। ভবানীপুরে ওর দু-একটি বন্ধু আছে বটে, কিন্তু তাদের ঠিকানাও তো ওর আর মনে আসছে না! অফিসের নাম তার মনে নেই—বাড়ির ঠিকানাও গুলিয়ে ফেলেছে—এ অবস্থায় পুলিশের সাহায্য নিতে গেলে পুলিশ ওকে পাগলা গারদে পাঠাবার ব্যবস্থা করবে। অথচ একটা কিছু করা দরকার—
এক ঝটকায় উঠে দাঁড়াল স্নেহাংশু—একটা উপায় আছে—টেলিফোন! সুমিতাকে টেলিফোন করা যেতে পারে। ওকে বলা যেতে পারে আমি হারিয়ে যাচ্ছি, আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি! তুমি এসে আমাকে পরিচিত পরিবেশের মধ্যে নিয়ে যাও—আমাকে বাঁচাও!
ট্রাম গুমটির পাশেই তো রয়েছে পাব্লিক টেলিফোন বুথের সারি। এতক্ষণ কেন যে মুক্তির এই সহজ উপায়টির কথা মনে পড়েনি, সেটা ভেবে পেল না স্নেহাংশু।
হঠাৎ কোনওদিকে না তাকিয়ে ট্রাম গুমটির দিকে ছুটতে আরম্ভ করল স্নেহাংশু। এক লাফে পার্কের নীচু রেলিংটি পেরিয়ে গেল সে—আর একটু হলে ডালহৌসিগামী একটি ট্রামের তলায় তলিয়ে যেত! আসেপাশে অনেকেই হাঁ হাঁ করে উঠল—কিন্তু সেদিকে যেন ভ্রূক্ষেপই নেই তার!
গুমটির টেলিফোন বুথগুলির সব ক-টিতেই লোক ছিল। কিন্তু স্নেহাংশু পৌঁছোবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একজন ভদ্রলোক টেলিফোন সেরে একটি বুথ থেকে বেরিয়ে এলেন। অপেক্ষমান অন্য ব্যক্তিটি বুথে ঢোকবার আগেই স্নেহাংশু এক লাফে বুথটিতে ঢুকে পড়ল! ভদ্রলোক প্রতিবাদ করতে গেলেন, কিন্তু ওর চোখের উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি দেখে পাগল ভেবে আর কথা বাড়ালেন না।
মরুভূমিতে পাওয়া ওয়েসিসের মতো স্নেহাংশু প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল টেলিফোনের গায়ে। কোনও রকমে ত্রস্ত-কম্পিত হাতে পনেরোটি পয়সা ফেলল সে স্লটের মধ্যে, রিসিভারটা কানে ঠেকিয়ে ডায়াল টোন শোনারও তর সইল না—ডায়ালিং শুরু করল। কিছুক্ষণ সব চুপচাপ—তারপর অপর প্রান্তে রিং আরম্ভ হল—আর বেজে চলল… ক্রিইং ক্রিইং… ক্রিইং ক্রিইং…
আঃ—সুমিটা গেল কোথায়? একটুও কাণ্ডজ্ঞান যদি ওর থাকে!
—হ্যালো… স্ত্রী কণ্ঠে সাড়া এল।
—হ্যালো সুমি আমি… আমি স্নেহ বলছি। শোনো, আমি বড়ো মুস্কিলে পড়েছি… বড় বিপদ হয়েছে… তুমি একবার—
—হোয়াট নাম্বার ডু য়ু ওয়ান্ট, প্লীজ?
—ফোর ফাইভ এইট ডবল নাইন নাইন—
—ইয়েস, স্পীকিং—
—সুমিতা বলছ তো? শোনো, আমি স্নেহ—
—সরি। দেয়ার্স নো সুমিটা হিয়ার! মাস্ট বি রং নাম্বার—ক্লিক্ করে শব্দ হল, লাইনটা কেটে গেল।
টেলিফোনটা কানে ঠেকিয়ে পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল স্নেহাংশু। কপালের বিন্দু বিন্দু ঘাম গড়িয়ে পড়তে লাগল রগ বেয়ে।
45-8999 তাহলে ওর টেলিফোন নাম্বার নয়। তাহলে ওর টেলিফোন নাম্বার কত? 45-····, 45-···, 47-···?
মৌমাছির গুঞ্জনের মতো একটি গুঞ্জনধ্বনি কানে এল স্নেহাংশুর। মনে হল হাজার হাজার মৌমাছি যেন ওই টেলিফোন রিসিভারটির মধ্যে থেকে মুক্তি পাবার জন্যে আপ্রাণ চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই বেরুতে পারছে না!… তার সারা মস্তিষ্কের শিরা-উপশিরায় সে গুঞ্জন ধ্বনি ছড়িয়ে পড়তে লাগল। মনে হল তার প্রতিটি স্নায়ু যেন অবশ হয়ে আসছে!
হঠাৎ যেন অন্য একটি জগৎ থেকে বর্তমানে ফিরে এল স্নেহাংশু। কি আশ্চর্য! টেলিফোন নাম্বারটা যদি ও ভুলে গিয়ে থাকে, তাহলে তাতে অবাক হবার কি আছে? আকছার লোকে টেলিফোন নাম্বার ভুলছে। সে যদি ভুলে গিয়ে থাকে তাহলে এতে নার্ভাস হবার কি আছে? লোকে টেলিফোন নাম্বার ভোলে বলেই না এত বড় ডাইরেক্টরিটা ছাপা হয়েছে! ওটি থেকে নাম ধরে অতি সহজেই ঠিক টেলিফোন নাম্বারটি জানা যেতে পারে!
বাঁ হাতে টেলিফোনটা কানে চেপে রেখে ডান হাতে পাশের ডাইরেক্টরিটা খুলে ধরল স্নেহাংশু। কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে পাতার পর পাতা উল্টে গেল, তারপর হঠাৎ স্থির হয়ে গেল তার ডান হাতটি। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে তার কম্পিত হাত থেকে ভারী মোটা ডাইরেক্টরিটা খসে পড়ল বুথের কাঠের মেঝের ওপর। টেলিফোন রিসিভারের সেই বন্দী মৌমাছিগুলো দ্বিগুণ শব্দে গুঞ্জন আরম্ভ করল! ধীরে ধীরে স্নেহাংশুর উত্তেজনা-রঙীন টকটকে লাল মুখটি কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল। পরক্ষণেই টেলিফোন রিসিভারটি ঝন ঝন করে পড়ে গেল বুথের মেঝের ওপর—
“আমি কে???” ওর ভেতর থেকে কে যেন একটি প্রশ্নের মধ্য দিয়ে আর্তনাদ করে প্রতিবাদ জানাল। টেলিফোন বুথের বাইরে অপেক্ষমান লোকেরা বুথ থেকে বেরিয়ে আসা এই ভীত, ক্লান্ত উদ্ভ্রান্ত লোকটির দিকে আতংকিত বিস্ময়ে তাকাল। পাগল নাকি!
পাগল!! হ্যাঁ, আর কোনও সন্দেহ নেই—সত্যিই ও পাগল হয়ে গেছে! ওর সমগ্র অন্তরাত্মা আর্তনাদ করে বলে উঠতে চাইল— শোনো তোমরা, শোনো—আমি পাগল হয়ে গেছি! সব কিছু হারিয়ে গেছে আমার—কিছুই মনে পড়ছে না—বাড়ি অফিস এমন কি নিজের পদবীটি পর্যন্ত আমি ভুলে গেছি! নামটা এখনো মনে আছে—না না, এখনো মনে আছে—স্নেহ···স্নেহাং···স্নেহাংশু···হ্যাঁ, স্নেহাংশু! কিন্তু এটাও আর বেশীক্ষণ মনে থাকবে না···এটাও আমি ভুলে যাবো!···তখন আমি সম্পূর্ণ হারিয়ে যাবো······
উন্মাদের মতো হা হা করে হেসে উঠলো স্নেহাংশু, নাকি কেঁদে উঠলো? তারপর দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে লাগলো ময়দানের দিকে! কার্জন পার্ক···লাটসাহেবের বাড়ি···নেতাজী ষ্ট্যাচু···ওয়ার মেমোরিয়াল!
আবার সেই মৌমাছির দল! বোধহয় এতোক্ষণে ওরা ছাড়া পেয়েছে টেলিফোন রিসিভারের বন্দীদশা থেকে—আর ছাড়া পেয়েই ছুটে আসছে ওর পেছনে। তাদের গুন গুন গুন গুঞ্জনধ্বনি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছে, আরো তীব্র হয়ে উঠছে। ওরা ওকে ধরতে আসছে —ও বুঝতে পারছে, ওরা ওকে ধরতে আসছে! কিন্তু না, ও পালাবে না—পালিয়ে ও যাবেই বা কোথায়? যে নিজের কাছ থেকেই পালাতে চায়, তার পক্ষে কোথাও পালানো যে সম্ভব নয়!
ও ঘুরে দাঁড়াল। সামনেই নিয়ন-বিদ্যুৎ-লাঞ্ছিত চৌরংগী—লাল-নীল-সবুজের বাহারে সজ্জিত রংগিনী চৌরঙ্গী—গাড়ির পর গাড়ি চলেছে, ছুটন্ত লাল আর সাদা আলোকবিন্দুর সমারোহ—চলেছে জনস্রোত। কোলাহল, ব্যস্ততা—
কিন্তু একটা কুয়াশা কেন নেমে আসছে তার চোখে। একটি হালকা সাদা পর্দার মতো, একটি বিরাট মাকড়সার জালের মতো হালকা কুয়াশা! আলোর সমারোহ ক্ৰমে ম্লান হয়ে আসছে না? ব্যস্ত নগরীর কোলাহল কেমন স্তিমিত হয়ে আসছে না?—আর ক্রমাগতই তীব্র হয়ে উঠছে সেই রহস্যময় গুঞ্জনধ্বনি!
আকাশের দিকে তাকাল সে। তারাগুলি ম্লান—যেন কুয়াশায় ঢাকা—কেমন যেন ছাই রঙা নির্জীব আকাশ। হালকা সাদা কুয়াশার পর্দাটি ক্রমশই ভারী হয়ে উঠছে—আর তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছে ওই গুঞ্জনধ্বনিটি! ওর স্নায়ুতে স্নায়ুতে একটি অকথ্য যন্ত্রণার বাষ্প যেন পাক দিয়ে দিয়ে উঠছে। কে যেন আর্তনাদ করছে—না, বাইরের কেউ নয়, ওর ভেতরেই। একটি শিশু যেন ডুকরে ডুকরে কাঁদছে—আমি যাবো না—আমি বাড়ি যাবো না!
কান্নার রেশটি সম্পূর্ণ মিলিয়ে যাবার আগেই ও জ্ঞান হারাল।
কতক্ষণ ও জ্ঞানহারা অবস্থায় ছিল জানা নেই। মনে হল প্রায় এক যুগ!
জ্ঞান ফিরতে দেখল ও একটি সাদা ধপধপে বিছানার ওপর শুয়ে আছে। পাশের একটি ধাতব টিপয়ে কিছু ওষুধপত্তর সাজানো। মনে হল হাসপাতালের একটি কেবিন।
জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে দেখা যায়—ধূসর আকাশের তলায় চকচক করছে একটি ধাতব নগরী। অদ্ভুত তার গড়ন, বিচিত্র তার স্থাপত্য—হঠাৎ দেখলে মনে হয় বাড়িঘর নয়—যেন কোনও কিউবিষ্ট চিত্রকরের আঁকা জ্যামিতিক রেখাচিত্রের সমষ্টি।… ক্লান্তভাবে চোখ বুজল সে! এখনো দুঃস্বপ্নের ঘোর কাটেনি বোধহয়—
কাঁধে হালকা ছোঁয়া পেয়ে চোখ খুলল সে, “এখন কেমন আছো?”
দেখল একজন সৌম্যমূর্তি বৃদ্ধ, গায়ে তার অ্যালুমিনিয়াম জাতীয় ধাতুর একটি ঝকঝকে পোষাক।
“কেমন আছো—” মিষ্টি মধুর গলায় আবার প্রশ্ন করলেন বৃদ্ধ।
“ভালো… তবে… তবে আমি ঠিক… মানে কিছুই…”
“বুঝতে পারছো না, তাই তো? না পারাটাই স্বাভাবিক। সেরে ওঠো… সবই বুঝতে পারবে।”
“কিন্তু—”
“ব্যস্ত হয়ো না… সব ঠিক হয়ে যাবে। কিছু ভাববার চেষ্টা করো না… তাতে স্মৃতির ওপর চাপই পড়বে—হয়তো আবার জ্ঞান হারাবে—”
“স্মৃতি—?”
“সব কিছু বোঝবার মতো অবস্থা এখন তোমার নয়, তবে এইটুকু শুনে রাখো, আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর আগে তুমি হারিয়ে গিয়েছিলে; তখন তোমার বয়স তিন বছর—”
“হারিয়ে গিয়েছিলাম?”
“হ্যাঁ! তোমার বাবা ছিলেন বিরাট বৈজ্ঞানিক—পঞ্চবিংশ শতাব্দীর খ্যাতনামা টাইম এন্ড স্পেস সায়েন্টিস্ট। টাইম স্ক্রীন নিয়ে উনি নতুন একটি গবেষণা করছিলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে তুমি একদিন ঢুকে পড়েছিলে সেই টাইম স্ক্রীনের মধ্যে—তারপর স্টার্টিং লিভারে তোমার হাত লেগে টাইম স্ক্রীনটা অ্যাক্টিভেটেড হয়ে যায়, আর তুমি গিয়ে পড়ো বিংশ শতাব্দীর মধ্যে—আমাদের সময় থেকে প্রায় পাঁচশো বছর অতীতে!
“দুর্ঘটনাটি ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা তোমাকে ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা করি। বিংশ শতাব্দীতে গিয়ে তুমি নিশ্চয়ই সঙ্গে সঙ্গে টাইম স্ক্রীনের এলাকা থেকে সরে গিয়েছিলে, তাই তোমাকে আমরা বিংশ শতাব্দীর একটি মহানগরীর জনারণ্যের মধ্যে হারিয়ে ফেলি। কিন্তু তবু আমরা আশা ছাড়িনি—দীর্ঘ তিরিশ বছর ধরে তোমাকে আমরা খুঁজেছি।… তারপর যখন তোমার সন্ধান পাওয়া গেল তখন দেখা গেল তোমার মনের ওপর তোমার তখনকার পরিবেশের এমন একটি স্থায়ী ছাপ পড়েছে যে সেটি ধীরে ধীরে মুছে না দিলে তোমায় ফিরিয়ে এনে কোনও লাভই হবে না। তাই ক্রমে ক্রমে তোমার স্মৃতির ওপর আমরা চাপ দিতে আরম্ভ করি—যাতে সেটি ধীরে ধীরে এলোমেলো করে ক্রমে ক্রমে একেবারেই মুছে ফেলা যায়! গতকাল সেই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়েছে—তাই তোমাকে আমরা ফিরিয়ে এনেছি আমাদের মধ্যে তোমার আসল জায়গায়!”
“আমাদের হারানো ছেলে আবার আমাদের মধ্যে ফিরে এসেছে—এ আজ আমাদের সকলের পক্ষেই বড় আনন্দের দিন। আমাকে চিনতে পারলে না?—আমি তোমার বাবা—”
কান্নায় গলা যেন বুজে আসতে চায়। ঝুঁকে পড়ে ওর কপালে কম্পিত হাতটি রাখলেন বৃদ্ধ। রুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, “আমার প্রাণের বিয়াত্রে—”
ওর বাবা কাঁদছেন। ও-ও কাঁদছে।
“ও তাহলে বিয়াত্রে… অন্য কেউ নয়… আর কোনও নাম নেই ওর! আমার হারানো ছেলে! শতাব্দীর গোলকধাঁধায় পথ হারিয়ে ভেসে গিয়েছিল ও—আবার নিজের ঘরে ফিরে এসেছে… বাবা, মা, ভাই-বোন সকলের মধ্যে ফিরে এসেছে ও…”
ওর বাবা কাঁদছেন। ও-ও কাঁদছে।
কিন্তু ওর মধ্যে আর একটি ভিন্ন কান্না গুমরে গুমরে উঠছে না? একটা অনেক চেনা কণ্ঠের কান্না? মুছে ফেলা স্মৃতিপটের ওপরে কি একটা মুখ ভেসে উঠেও উঠছে না—আবার হারিয়ে যাচ্ছে!… ও জানে ওই মুখের, ওই কান্নার নাগাল ও আর কোনওদিন পাবে না। হারানো ছেলেকে ওরা খুঁজে পেয়েছে… কিন্তু সেই ছেলের যে কী হারিয়ে গেল তার খোঁজ কেউই রাখে না।
সবই স্বপ্ন? হবেও বা!
সম্পাদকঃ গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল আশ্চর্য! পত্রিকার চতুর্থ বর্ষের বারোতম সংখ্যায়। প্রকাশকাল – ডিসেম্বর ১৯৬৬। গল্পটি টাইপ করে দিয়েছেন নির্জন সেন।
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, গুরনেক সিং, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, জটায়ু, পূজাবার্ষিকী