হিমঘুম
লেখক: রণেন ঘোষ
শিল্পী: জটায়ু
না, কোনও কিছুর অভাব নেই আকাশনীলের। একবিংশ শতাব্দীতে যা যা থাকলে লোকে সুখী বলে মনে করে তা সবই আছে আকাশনীল সেনের। বাড়ি, গাড়ি, জেট প্লেন, ব্যাঙ্কে প্রচুর টাকা—সব। এখন আর সমস্যা নয়। সিনথেটিক বাড়ি মাত্র দু’ঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে যায়। খুলতে এক ঘণ্টাও লাগে না। দারুণ শক্ত আর মজবুত এই বাড়িগুলো। বাকি আছে শুধু আরব সাগরের তলায় একটা ছোট বাড়ি। বর্তমান যুগে সাগরতলার বাড়ি প্রেস্টিজের একমাত্র মাপকাঠি। তা-ও দরখাস্ত করা হয়ে গেছে। তবে সময় লাগবে এলটমেন্ট পেতে।
আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক মৎস্য সংস্থায় বেশ বড় চাকরি করে আকাশনীল। মুখ দেখে এখন বয়স বোঝার উপায় নেই এ যুগে। বিভিন্ন হরমোন আর গ্ল্যান্ডের আধুনিকতম চিকিৎসায় যৌবনকে অনেক বছর পর্যন্ত আটকে রাখতে পেরেছে এ যুগ। তাই এখনও যুবক আকাশনীল। লম্বা-চওড়া সুশ্রী সুন্দর চেহারা। বেশ ছোটবেলায় মারা গেছেন বাবা-মা। ভাইবোন বলতে কেউ নেই ওর। এক বা দুই ব্যস নয় এখন। এখানকার স্লোগান—আমরা দুজনে এক, আমাদের এক! তাই একা নিঃসঙ্গ আকাশনীল! সংসার করার কোনও সদিচ্ছা নেই। যতসব অদ্ভুত অসম্ভব অবাস্তব প্রবন্ধ আর গল্পের উপর দারুণ ঝোঁক। নানান বইতে বাড়ি বোঝাই।
মাসছয়েক থেকে কী যে হয়েছে ওর কে জানে। বর্তমান সমাজের কোনও কিছুই ভালো লাগে না। সমাজের একদিকে অঢেল টাকাপয়সা, অন্যদিকে রাস্তার পাশে সারি সারি ইটের উনুন। কালো ময়লা হাঁড়িতে জলময় কিছু ফুটছে আর সেইদিকে বসে আছে জন্মদিনের পোষাক পরে গুটিকতক শিশু। ফুলের মতো শিশু বলতে কেমন যেন বাধে ওদের। ফুলের শোভা আছে—গন্ধ আছে আর এর? ময়লা থিক্থিক্ করছে—ঝাঁকড়া চুলে উকুনের চাষ। চোখের কোণে মোটা পিচুটি… আর… আরও অনেক কিছু। এসব ফুলের কুঁড়ি ফুটে ওঠার সময় পাবে না কখনও। অকালেই পোকা লেগে ঝরে যাবে ওরা। ঝরবে, আবার আসবে। খালি হবে কি কোনও দিনও ফুটপাত? কে জানে কবে কমবে লোকসংখ্যার চাপ। অঢেল থেকে তিন… তিন থেকে দুই… এক… না না, তাতেও সামাল দিতে পারছে না বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা। জনসংখ্যার চাপে দূর করা যায়নি দারিদ্র্য। সব প্ল্যানিংই বানচালের পথে।
সেই সকালবেলায় বাচ্চা ল্যাংটো ছেলেটাকে ফুটপাথে বসে কাঁদতে দেখে গেছে আকাশনীল। ধারেকাছে কেউ নেই। জনতারও কোনও ভ্রূক্ষেপ নেই ওদিকে। সমস্ত সমাজ সভ্যতাকে চ্যালেঞ্জ করে যেন কাঁদছিল সেই অসহায় ল্যাংটা ছেলেটা। বাচ্চা ভিখারী আর কী।
কেন জানি না সারা দিন কাজের মধ্যে কেবলই কান্নাভেজা মুখটা ভেসে উঠছে ওর মনের মধ্যে। হাজারবার ভোলবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু না, কেবলই মনে পড়েছে ওর কথা। কত বয়স হবে ওর! কে জানে বয়স কত! ভিখারীর কি বয়স আছে, না আছে কোনও জন্মদিন? জন্মদিনের কথা মনে পড়লেই অনেকদিন আগের একদিনের কথা বিশেষ করে মনে পড়ে ওর। বাবা মা আরও ক’জন আত্মীয়স্বজন এসেছিল সেদিন। লাল-নীল আলোয় তারাময় হয়ে উঠেছিল সারা বাড়ি। জন্মদিন… আকাশনীলের জন্মদিন সেটা। নতুন জামাকাপড় পরে কেক কাটার কী আনন্দ! কিন্তু জন্মগ্রহণ করলেই তো একটা করে জন্মদিন ঘুরে ঘুরে আসবে বছরে। আর সেই দিনের অপেক্ষা… কী আনন্দ রোমাঞ্চ! কিন্তু ওই যে সেই কান্নাময় ভিখারী ছেলেটা। ও তো জন্মেছে একদিন। বছরের পর বছর ঘুরে আসছে সেই জন্মদিন। জন্মদিন, না দুর্ভাগ্যের দিন! কেউ মনে রাখে না ওদের জন্মদিনের কথা। জন্মায়, উচ্ছিষ্ট কুড়িয়ে খেয়ে বেঁচে থেকে আবার মরে যায় ওরা। অথচ একজন একজন করেও যদি রাস্তার বাচ্চাদের তুলে নিয়ে এক এক বাড়িতে… না না, আকাশনীলের কী যে হয়েছিল সেদিন কে জানে। ধিক্কার দিয়েছিল সমাজ-সভ্যতা আর পুরো একবিংশ শতাব্দীকে। কেন এখনও দারিদ্র্য ঘুচলো না সকলের? এক দুরারোগ্য ক্যান্সার সমাজের বুকে। খিদে পেয়েছিল কি সেই নীল আকাশের তলায় ফুটপাতের উপর কান্নাভরা ছোট্ট ছেলেটার?
সেই থেকে দারুণ বিতৃষ্ণার শিকার আকাশনীল। রাতের ঘুম চলে গেল দু’চোখ থেকে। কেবলই মনে হল কী যেন হয়েছে ওর। ক্লাব, বন্ধুবান্ধব—সব ছেড়ে দিল। দিনরাত কেবল ওই ভিখারী ছেলের মুখটা ভেসে রইল ওর মনের পর্দায়। একে একে সব ডাক্তাররা হার মানল। ওকে কেউ বোঝাতে পারল না যে এ ওর দেহের রোগ নয়, সমাজের রোগ। সমাজের একজন হয়ে সমাজের সব দোষটাই নিজের বলে মনে করল আকাশনীল। নিজেকেই অপরাধী বলে মনে হল। আর তাই থেকে একটা বদ্ধমূল ধারণা হল যে, দুরারোগ্য কোনও অসুখ হয়েছে ওর। যত ভাবল ততই সে মনে মনে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ল।
সন্ধে হয় হয় সেদিন। দিনান্তের আবিরখেলা শুরু হয়েছে সূর্যের। আকাশের হৃৎপিণ্ড চিরে আলোর ধারা রক্তে লাল হয়ে উঠেছে সন্ধ্যার হাল্কা মেঘ। একমনে সেদিকে তাকিয়েছিল আকাশনীল। কি ভাবছিল ও… না, তা-ও নিজেও বোধহয় বলতে পারবে না। হঠাৎ এক নিয়ন সাইনবোর্ডের দিকে দৃষ্টি পড়ল। ফুটপাত পেরিয়ে পায়ে পায়ে চলে এল নিয়ন সাইনের নিচে।
হিমঘুম… দু’শত বছর বাঁচুন
দূরারোগ্য রোগ সারান ভবিষ্যতে
লাইন বেশি নয়। জনা কুড়ি-পঁচিশ হবে। সামনে ঘেরা বারান্দা। তকমা আঁটা দারোয়ান দাঁড়িয়ে আছে দরজার দু’পাশে। সকলের হাতে এক-একটা ফর্ম। প্রেসক্রিপশন।
একমনে কিছুক্ষণ চিন্তা করল আকাশনীল। চারপাশটা ভালো করে চেয়ে দেখল কয়েকবার। চেনাজানা কাউকে চোখে পড়ল না। কিন্তু ওই তো, ওই তো ফুটপাতের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে ল্যাংটো একটা ছেলে। ভিখারী! সামনের খাবারের দোকানের দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে আছে সেই সমাজ-সংসার বাপ-মা-হারা ছোট্ট ছেলেটা। কী আকুল ওর শিশুচোখের সামান্য আকাঙ্ক্ষা। একমুঠো শুধু পেটভরা খাবার, আর… আর কিছু নয়। বুকটা কেমন যেন চরচর করে উঠল আকাশনীলের। দামী জামাকাপড় পরা নিজের দেহটাকে এক দাগী সমাজবিরোধী বলে মনে হল ওর। মনে হল ওইসব ছোট ছোট ফুলের মতো শিশুদের জামাকাপড়, মুখের খাবারের সে-ও তো এক ভাগীদার। শিশুর মুখের খাবার ছিনিয়ে নিয়ে দু’বেলা সে খাচ্ছে পেট পুরে। উঃ! কী অন্যায়, কী অন্যায়! হ্যাঁ হ্যাঁ, হত্যাকারী খুনী ঘাতক সে…
সকলের পেছনে তাড়াতাড়ি লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ল আকাশনীল। খুব ধীরে ধীরে এগুচ্ছে লাইন। নানান বয়সের লোক রয়েছে লাইনে। কী যেন হল সেই ভিখারী বাচ্চাটার। হয়তো খাবারের প্রতীক্ষায় অধৈর্য হয়ে কান্না জুড়ে দিল সে। প্রতিটি কান্নার শব্দ যেন ক্রমাগত ছুরি মারতে শুরু করল আকাশের সর্বাঙ্গে। কান্নায় কান্নাময় হয়ে গেল ওর চিন্তা। তাড়াতাড়ি লাইনে এগোবার চেষ্টা করল আকাশনীল।
—কী মশায় একে একে এগোবেন তো? এত তাড়াতাড়ির কী আছে এখন? সব তাড়াহুড়ো তো শেষ করেই এসেছেন এখানে। সামনের বুড়ো লোকটা বলে উঠল আকাশনীলকে লক্ষ করে।
একটু লজ্জিত হল আকাশনীল। সত্যি তো এখন আর তাড়াহুড়ো করে কী হবে! একে একেই তো যেতে হবে।
বিশাল বাড়ির একেবারে মাঝখানে ওরা দাঁড়িয়ে। বিরাট বাড়ি মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে আকাশে! মাটির তলায় আরও ক’তলা আছে কে জানে।
প্রথম প্রথম একটা টিকিটের দাম ছিল অনেক। জনসাধারণ কেন সামান্য কিছু বড়লোকেরই সহজসাধ্য ছিল হিমঘুম। বিরাট ধনী লোকেরাই হিমঘুমকে ব্যবহার করত ভবিষ্যতের ডাক্তারদের দিয়ে অসাধ্য কোনও রোগ সারাবার জন্যে। কিন্তু আস্তে আস্তে দাম কমতে শুরু করল। ব্যবহারের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে টিকিটের হারও কমতে শুরু করল। এখন তো সকলেই প্রয়োজনমতো ব্যবহার করছে বিজ্ঞানের এই অভাবনীয় আবিষ্কারকে। একমাস, দু’মাস, এক বছর, দশ বছর পরে নিশ্চয় অসাধ্য রোগকে সারিয়ে তুলবে তখনকার ডাক্তাররা। এখন আর একটা কোম্পানি নয়। এই শহরেই বেশ কয়েকটা বড় বড় কোম্পানি রয়েছে হিমঘুমের।
—আচ্ছা দাদা, খুব শীত করবে না তো ঘুমের মধ্যে? পেছনের একজন প্রশ্ন করল ওকে।
—ঘুমের মধ্যে শীত! হাসালেন মশাই আপনি। এই ঘুমের সময় কি কিছু টের পাবেন আপনি? লাইনের পেছনের আর একটি গলা ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিলে ভদ্রলোককে।
সামনেই চাপরাশ পরা দারোয়ান। আপাদমস্তক একবার দেখে সরে দাঁড়াল দরজা থেকে। সামনে দাঁড়াতেই আপনা থেকে খুলে গেল দরজা। একঝলক বরফঠান্ডা হাওয়া ঝাপটা মারল ওকে। শিরশির করে উঠল সর্বাঙ্গ। ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আপনা থেকেই বন্ধ হয়ে গেল দরজাটা।
সামনে আর একটা মোটা কাচের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে পড়ল আকাশনীল। ঠান্ডা… হিমঠান্ডা চতুর্দিকে। সামনের টেবিলে সুবেশা এক ভদ্রমহিলা। পাশে আরও কয়েকজন ভদ্রলোক।
যন্ত্রের মতো একটা ফর্ম এগিয়ে দিল ওরা আকাশনীলের দিকে। চেয়ার টেনে নিঃশব্দে টেবিলে বসে পড়ল ও। একের পর এক লিখে চলল ফর্মের জবাব।
দারুণ ক্লান্ত লাগল নিজেকে। ডাক্তারদের ধিক্কার দিল সে বারে বারে। মন বা শরীরের যেখানেই হোক না কেন অসুখ, ডাক্তাররা তো খুঁজে বের করবে সেটা, তারপর নানান ওষুধে সারিয়ে তুলবে ওকে। কিন্তু কোনও ডাক্তাররাই ধরতে পারল না ওর অসুখ। নিজে তো স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে ওর সাংঘাতিক অসুখ করেছে। না, এখনকার ডাক্তাররা সারাতে পারবে না ওর অসুখ।
একেবারেই হোপলেস ওরা। হ্যাঁ, ভবিষ্যতের ডাক্তাররা নিশ্চয় সারিয়ে তুলবে ওকে। নিশ্চয় ডায়াগোনাইজ করতে পারবে ওর অসুখ। আবার ভালো হয়ে উঠবে আকাশনীল। আবার…
চিন্তায় ছেদ পড়লে ওর। প্রশ্ন করল সেই ভদ্রমহিলা।
—এই, এই প্রশ্নটার জবাব দেননি কেন?
—কোনটা, কোন প্রশ্নটা? একটু ঝুঁকে পড়ে বুঝতে চাইল আকাশনীল।
—এই যে দশ নম্বরটা। কী অসুখ আপনার, কোন ডাক্তার দেখেছেন আপনাকে? প্রেসক্রিপশনটা দেখি? অনেকগুলো প্রশ্নের খোঁচায় থতমত খেয়ে গেল আকাশনীল। ভালো করে সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল কয়েকবার। ভাবলেশহীন মুখে সবাই তাকিয়ে আছে ওর দিকে।
—মানে… প্রেসক্রিপসন নেই আমার। মানে কোনও ডাক্তারই ধরতে পারেনি আমার অসুখ।
—তাহলে আপনি এসেছেন কেন এখানে?
—ডাক্তাররা ধরতে পারেনি সত্যি। কিন্তু তাই বলে তো আমার রোগটা মিথ্যে নয়। বিশ্বাস করুন সত্যি অসুস্থ আমি। একফোঁটা ঘুমুতে পারি না রাতে। ফাইলের পর ফাইল খেয়েছি ঘুমের ওষুধ। কিন্তু না, ঘুম আসেনি আমার চোখে। তাই তো ঘুমিয়ে থাকতে চাই, যদি ভবিষ্যতের কোনও ডাক্তার সারিয়ে তুলতে পারে আমাকে। কী বলেন আপনারা—সেরে উঠব না আমি? আবার আগের মত সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে উঠব না?
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে ফেলল আকাশনীল। সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে চায় ও। সেই আনন্দোচ্ছ্বল আগের দিনের মত।
—সব সারিয়ে তুলতে পারবে ভবিষ্যতের ডাক্তাররা। সে বিষয়ে আমরা সুনিশ্চিত। কিন্তু আপনার তো হিমঘুম সম্ভব হবে না। কারণ কোনও ডাক্তার প্রেসক্রিপশন না করলে—অসুখ না হলে হিমঘুমের অধিকার নেই কারুর? আপনি তো সুস্থ, সব ডাক্তারই যখন আপনাকে সুস্থ বলেছে…
—দোহাই আপনাদের, বিশ্বাস করুন কিছু জানে না এখনকার ডাক্তারেরা। আমি অসুস্থ। একটা সুযোগ দিন আমাকে ভালোভাবে বাঁচবার… অসহায়ের মতো কাতর প্রার্থনা জানাল আকাশনীল ওদের কাছে।
কথা না বলে চুপ করে কিছুক্ষণ দেখল ওকে ওরা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল।
—দেখতে পাচ্ছি বিয়ে করেননি আপনি। চাকরিও বেশ ভালোই করেন। আত্মীয়স্বজনও তো নেই কোথাও। তাহলে কী করা বল তো? পাশের সঙ্গীকে জিজ্ঞাসা করলেন ভদ্রমহিলা।
হতাশভাবে মাথা নিচু করে বসে আছে আকাশনীল। চোখে চোখে তিনজনের কীসব যেন কথা হল।
—দেখুন মিঃ সেন, সুস্থ লোকদের জন্য নয় এই হিমঘুম। একমাত্র রুগিদের জন্যই এই বন্দোবস্ত। তাও বর্তমানকালের হিসাবে দুরারোগ্য হতে হবে। আর এই সার্টিফিকেট দেবার অথরিটি আছে একমাত্র ডাক্তারদেরই। আর যার সেই সার্টিফিকেট নেই…
—ডাক্তার… ডাক্তার… ডাক্তার। উঃ, দোহাই আপনাদের। বিশ্বাস করুন, অসুস্থ… দারুণ অসুস্থ আমি। একটু… একটু সিমপ্যাথি যদি দেখান… বলতে বলতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল আকাশনীল। মুখের না বলা সব অনুরোধ এক হয়ে গেল সকরুণ চোখের ভাষায়।
—বসুন, বসুন মিঃ সেন। উত্তেজিত হবেন না আপনি। কী যে করা যায়… উপায় যে একেবারে নেই তা নয়… তবে কিনা একটু বেশি খরচ পড়বে… বুঝতেই পারছেন তো…
মনে মনে জ্বলে উঠল আকাশনীল। এইখানে… মৃত্যু পথযাত্রী রুগিদের নিয়েও ঘুমের কারবার। হায় ভগবান!… না না, সত্যি তো অসুস্থ ও। যেমন করেই হোক আশ্রয় পেতে হবে হিমঘুমে। ঘুম… ঘুম দরকার… তারপর ভবিষ্যতে নিশ্চয় সুস্থ হয়ে উঠবে সে তখনকার ডাক্তারদের কল্যাণে… কী ভালো পৃথিবীর আলো হাওয়া আর… আর নিরোগ হয়ে বেঁচে থাকায়…
—নিন ড. সিং, সই করে দিন মি. সেনের ফর্মটা। কী রোগ লিখলেন… ক্যান্সার… তা আজকে ক’জনকে ক্যান্সার বলে দয়া করলেন মি. সিং? হাসতে হাসতে কথাগুলো বললেন ভদ্রমহিলা।
—আজকে আর বেশি কোথায় হল, মোটে তো ৭১ জন… কথা বলতে বলতে লিখে চললেন ড. সিং। নির্বিকার ভঙ্গি। সরল সহজ স্বাভাবিক।
বর্তমান দুনিয়ায় এও সম্ভব। মানুষ কি আর মানুষ নেই আজ? আর ভেবে লাভ কী! আর মাত্র কয়েক মিনিট, তার পরেই…
চেক লেখা সাঙ্গ হল আকাশনীলের। চেকটা কম্পিউটারে পুরে দেবার সঙ্গে সঙ্গে নীল আলো জ্বলে উঠল ঘরে। টাকা আছে ব্যাঙ্কে। চেক ক্লিয়ার।
সঙ্গে সঙ্গে ঘরে ঢুকল রোবট নার্স। হুবহু একটি মেয়ে।
—চলুন মি. সেন। সব রেডি আছে, কোনও কিছু অসুবিধে পাবেন না আমাদের কোম্পানিতে।
রোবট নার্সের পিছু পিছু চলল আকাশনীল। এক নিমেষে সরে গেল সামনের দেওয়ালটা। চলন্ত কনভেয়ার বেল্টে নেমে চলল ওরা পাতালপুরীর বুকের মধ্যে। ঠিক চার তলায় নেমে থামল কনভেয়ার বেল্ট। উঃ! কী প্রচণ্ড ঠান্ডা! চারপাশে কেবল দুধ-সাদা দেওয়াল। চোখ ধাঁধিয়ে যায়। হিমেল স্রোত আসছে ঝলকে ঝলকে। কম্পিউটারের মধ্যে ফর্মটা পুরে দিতেই যান্ত্রিক গলায় বলে উঠল—০৭১০,৯১০ চেম্বার।
আবার চলা শুরু। বিরাট হলঘরে এসে পড়ল এবার। একটা কাচের ঘরের মধ্যে দাঁড়াতে বলল নার্সটা। দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে রক্তের চাপ, নাড়ীর গতি, ব্লাড সুগার, ইউরিয়া, এনপিএন প্রভৃতি যাবতীয় পরীক্ষার ফল ফুটে উঠল সামনের পর্দায়।
আভ্যন্তরীণ কোনও রোগ নেই আকাশনীলের।
চার পাশের স্বচ্ছ আধারে শ’য়ে শ’য়ে মানুষ শুয়ে আছে হিমঘুমে। বিরাট পাম্পের চাপা আওয়াজে ধকধক করছে সমস্ত হলঘর। বিশাল হৃৎপিণ্ডের মতো অবিচ্ছিন্ন চলেছে পাম্প—পাম্প তো নয়, এ যেন প্রতিটি জীবন্ত অসার লোকের একমাত্র জীবনসূত্র।
সামনের একটা খালি চেম্বারে হড়হড় করে ঢালা হল তরল হিলিয়াম। আকাশনীলের জন্যে রিজার্ভ চেম্বার। হিলিয়ামের মধ্যে হিমঘুমে থাকবে ও ভবিষ্যতের আশায়। বিজ্ঞানের কী অপূর্ব অগ্রগতি।
—নিন, জামাকাপড় খুলে ফেলুন এবার। রোবট নার্সের কণ্ঠস্বরে চমকে উঠল আকাশনীল।
সেই প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যে জামাকাপড় খুলে শুয়ে পড়ল সে অপারেশন টেবিলের ওপর। হিম হয়ে যাচ্ছে সমস্ত শরীর। ঠান্ডায় কি প্রচণ্ড কষ্ট হয়? আবার সেই কথা মনে পড়ে গেল ওর। ওঃ! কী দারুণ কষ্ট হয় খালি গায়ে রাস্তায় দাঁড়ানো ভিখারী ছেলেটার। শীতের রাতেও তো ওর গায়ে জোটে না কিছু… তখন কি কাঁদে বাচ্চাটা… ঠান্ডার জমে যায় ওর কচি কচি মাখন নরম দেহটা… আর আমরা তখন শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে মোটা লেপের তলায়… না না, এ হয় না… কান্নাভেজা ছোট্ট ভিখারীর মুখটা জ্বলজ্বল করে উঠল ওর চোখের সামনে। টস টস করে জল পড়ছে ওর দু’চোখ বেয়ে… অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠল আকাশনীল…
ছুঁচ ফোটাবার সামান্য অনুভূতি হল একবার… কেমন যেন আচ্ছন্ন… তন্দ্রা নেমে আসছে সর্বাঙ্গে… ঝিমঝিম করছে মাথা… উলঙ্গ ছোট্ট ছেলে… তেলহীন হলদে চুল… কাঁদছে কাঁদছে… চোখের জলের ফোঁটাগুলো ক্রমেই বড়… আরও বড়…
ভবিষ্যতের মাঝে চোখ মেলল আকাশনীল। তন্দ্রাচ্ছন্ন! সীসের মত ভারী চোখের পাতা, মনের কপাট বন্ধ এখনও… আবছা আবছা সাদা দেওয়াল ফুটে উঠছে দৃষ্টির সামনে… উলঙ্গ ছেলেটা এখনও কেঁদে চলেছে ওর মনের কোণে… কী করুণ ওর মুখ…
বেশ বুঝতে পারল বিরাট এক অপারেশন থিয়েটারে শুয়ে আছে ও। ঠিক বুকের ওপরে ঝুলছে গোলকার জোরালো আলো। অপারেশনের নানান যন্ত্রপাতি রয়েছে ঘরের চারপাশে। মাথায় সাদা টুপি, মুখে মাস্ক আর গ্লাভস পরা হাতে ডাক্তাররা ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘরের মধ্যে।
তাহলে হিমঘুম ভাঙিয়ে তুলেছে ওরা! এবার সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে আকাশনীল… প্রাণভরে ঘুমুতে পারবে রাতে, নীল আকাশের নীচে সমাজ সংসারের মধ্যে আনন্দে কাটবে ওর দিনগুলো—কত কত বছর সে ঘুমিয়ে ছিল। হিম ঘরে—
ইশারায় ডাক্তারকে ডাকতে চেষ্টা করল আকাশনীল। গলা দিয়ে এক অস্পষ্ট আওয়াজ বেরুলে শুধু।
—এ কী! ০৭১০,৯১০ জাগল কী করে? ইনজেকশনটা আনো তাড়াতাড়ি…
ভারী গলার স্বরে চমকে উঠল আকাশনীল। পাশের টেবিলে এইমাত্র একটা অপারেশন শেষ হল। তরল পদার্থে ভর্তি বড় বড় নানান আকারে স্বচ্ছ জারের মধ্যে কী যেন সব রাখছে নার্সরা। ওই তো বিচ্ছিন্ন পা দুটোকে ঢুকিয়ে দিল জারের মধ্যে… কাটা হাত দুটোকে রেখে দিল ওরা পাশের জারের ভেতর… বিচ্ছিন্ন সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো একে একে রাখছে ওরা বিভিন্ন জারের মধ্যে… ফুসফুস… হৃৎপিণ্ড… দুটো চোখ… রক্তাক্ত অপারেশন টেবিল রক্তজবার মতো টকটকে লাল।
কিছুই বুঝতে পারল না আকাশনীল। ঘুমঘুম মাথায় চিন্তা করতে পারল না কিছু।
—ডাক্তারবাবু… ডাক্তারবাবু… এবার সারিয়ে তুলুন আমাকে… সুস্থ করে দিন…
কোনও কথা বলল না কেউ। শুধু এগিয়ে এল একজন।
—কী হল এর? কোথায় ইনেজেকশন?
—ডাক্তারবাবু, আবার ইঞ্জেকসান কেন… এবার তো সারিয়ে…
—কী আবোল তাবোল বকছেন! হিমঘুম থেকে বাঁচিয়ে তোলা বন্ধ হয়ে গেছে অনেকদিন। আইন পাশ হয়েছে দেশে। জনসংখ্যা কমিয়ে এনেছি আমরা। হাজার হাজার অতীতের লোককে ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। রীতিমতো অপরাধ এখন হিমঘুম ভাঙানো…
—তাহলে… আমার কী হবে?
—কিছুই হবে না, আবার ঘুমিয়ে পড়বেন এক্ষুনি। আপনার অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো প্রিজার্ভ করা হবে এখন। অ্যাক্সিডেন্ট বা অন্য কোনও প্রয়োজনে কাজে লাগবে আপনার হাত, পা, চোখ—কৃত্রিম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের চেয়ে অনেক ভালো…
অসম্ভব অবাস্তব সব কথা! এও কি হয়! কিন্তু ওই তো পাশের টেবিলের সেই কাটা হাত, পা, হৃৎপিণ্ড… তাহলে…
—শুধু একটা কথা বলুন আমাকে… ফুটপাতের সেই ল্যাংটো ভিখারীর ছেলেটা কি কাঁদছে এখনও?
—ভিখারী! গরীব? না না, সে সব আর কিছু নেই এখন। ফুটপাতে কেউ থাকে না আর…
আঃ! কী আরাম। কী দারুণ শান্তি। কাঁদছে না আর সেই ছোট্ট ছেলেটা… টলটলে জলে ভরা চোখ দুটোয় ফুটে উঠেছে হাসির রামধনু…
আবার ছুঁচ ফোটানোর কষ্ট… ধারালো ছুরি-কাঁচি নিয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মুখোশধারী ডাক্তারেরা… ধারালো ছুরির স্পর্শ পেল শরীরে… যন্ত্রণা… কষ্ট… হাসছে… টলটলে কান্নাটা মুক্তো হয়ে ঝিলিক মারছে… কচি কচি দাঁত বার করে খিলখিল করে হাসছে সেই ছেলেটা… কী সুন্দর… কী আরাম… হাসছে… হাসছে… কী আনন্দ…
কিছুক্ষণের মধ্যে আকাশনীল ছড়িয়ে পড়ল বিভিন্ন জারের মধ্যে। কোনও জারে রইল ওর হাত পা… কোনওটার মধ্যে ওর চোখ… হৃদয়… আর…
সম্পাদক: গল্পটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ফ্যানট্যাসটিক ১৯৭৭ আগস্ট মাসের সংখ্যায়। গল্পটি টাইপ করে দিয়েছেন জটায়ু।
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, চতুর্থ বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, জটায়ু, পূজাবার্ষিকী, রণেন ঘোষ
ভাল লাগল।