৩০২২-এর দিনগুলি
লেখক: শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়
শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)
“পার্থপ্রতিম রায়চৌধুরী” – এই নামটাই রাখছেন শেষমেষ?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ, আর ওই পেশাটা করুন ডাক্তারবাবু।”
“কেন মশাই? সাধ করে বাঁশ দিতে চাইছেন ছেলেটাকে? তার চে ভালো বুদ্ধি দিই, পলিটিশিয়ান করে দিন মশাই, হাপুস হুপুস করে রোজগারোবে!”
“বলছেন?”
“বলছি নয়, দেখছি! যাক গে, সে আপনার ব্যাপার মশাই। আজ বিকেলের ভেতর জানান, সিকোয়েন্সিংটা কমপ্লিট হয়ে গেলে আমরা নিউ মডিফিকেশনে হাত দেব। ভুতো, অ্যাই ভুতো! ইদিকে আয়, বেবির ডেটাশিটটা নিয়ে যা।”
পরমার্থ স্যানাল নিশ্চিন্ত হলেন একটু। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বেবিবাক্সটা হাতে পেয়ে যাচ্ছেন। বাক্সের মধ্যে ব্যবস্থা করা থাকে, জাইগোট থেকে মানুষের বাচ্চা অটোমেটিক্যালি তৈরি হয়ে যায়। খরচা অল্পবিস্তর আছে বটে, তবে এখন মার্কেটে এটা ভালো খাচ্ছে! বিয়ে কর রে, বাচ্চা তৈরি কর রে, পেটে ধর রে, ধুসস্, এ সব এখন আর চলে না কি! এই ভালো, বংশবিস্তার করতে চাও, কিরকম ছেলে বা মেয়ে চাও, প্যাকেজ সিলেক্ট কর, তারপর বাকিটা ডাক্তার রোবটদের উপর ছেড়ে দাও। এখনও অবশ্য মানুষ ডাক্তারদের কোনও কোনও দেশে দেখায় বটে, তবে তারা নিতান্তই অনগ্রসর দেশ। কিন্তু পরমার্থর পছন্দ, তার হবু ছেলে ডাক্তারি করুক ওইসব দেশে গিয়ে, সেবা করুক মানুষের। নামটা আবার জমকালো না হলে হবে না, পরমার্থের দাদুর বাবার আবার সেই-ই ইচ্ছে। তাদের সময় নাকি এক ডাক্তার এই নামে সেবা করতেন রোগীদের। এই একটা এখনকার সমস্যা, বুড়োরা অনেক বেশিদিন অব্দি বাঁচছে। অবশ্য এ সেরকম বাঁচা নয়, দেহ ছাড়া খালি চেতনাটুকু উত্তরপুরুষের মুন্ডুতে ট্রান্সফার করা যাচ্ছে। বিভিন্ন প্রকোষ্ঠে তাঁদের ইচ্ছে-অনিচ্ছে, ভালোলাগা-মন্দলাগা স্টোরড থাকে, আর মাঝে মাঝে ভারী বিব্রত করে আধুনিক প্রজন্মকে। এসব অবশ্য আপনারা প্রতিদিনই ফেস করছেন, নতুন নতুন করে আর কী বলি!
দুদিনের মাথায় বেবিবাক্স পেয়ে খুব খুশী পরমার্থ। শেষমেষ ডাক্তার ছেলেই সিলেক্ট করা হয়েছে। টাইটেল হিসেবে স্যানালটা তাঁর বিলকুল নাপসন্দ! তাঁর বাপের টাইটেল ছিল মুর্মু, ঠাকুরদার ছিল নিউটন, কাজেই ছেলের টাইটেলটা একটু বড়ো না হলে ভালো লাগে আর?
সেজন্য রায়চৌধুরী টাইটেলটাই মনে ধরল। গোলমাল বাধল ধর্মটা নিয়ে। ওটার কোনও দরকার নেই আর, তবু যে কেন সিটি কার্ড পেতে ওটা লাগে তা নেতাগুলোই বলতে পারবে। পরমার্থ চান বৌদ্ধধর্ম, ওঁর বাবা চান জৈনধর্ম। শেষতক ইহুদীতে গিয়ে রফা হল। শোনা যায়, হাজার বছর আগে, এসব এত সহজ ছিল না, লোকে কত মরেছে এসব পালটাপালটি করতে গিয়ে! শুনলে হাসি পায়, লর্ড নেমে আসার আগে অব্দি এসব মানুষে কী করে বরদাস্ত করেছে! অন্য গ্রহের বাসিন্দা লর্ড চমচম-ই যে আমাদের আরাধ্য ভগবান, সেটা বুঝতে অনেক বছর লেগে গেছে। শেষে লর্ড যখন মেরেমুরে বোঝালেন, তখন সবাই বুঝল, হ্যাঁ, ইটই ভগোমান বটেক! দু-একজন বাদে সবার হাইপোথ্যালামাসে নতুন সিস্টেম ঢুকিয়ে সাফ করা হয়েছে, তারপর বোধ জন্মেছে যে ধর্ম টর্ম বলে কিছু নেই! এসব পরমার্থ ইস্কুলে থাকতে ইতিহাসের কোর্সে পড়েছেন। লর্ড চমচমকে আর দেখা যায় না বটে, তবে তিনি সবাইকে দেখছেন, এও পরীক্ষায় এসেছিল বটে!
এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কিচেনে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন পরমার্থ। হঠাৎ কলার টিউনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। স্মার্ট ডিভাইস বাজছিল। অনলাইনে টাইম মেশিনের অর্ডার দিয়েছিলেন। ঘ্যাঁসঘ্যাঁস শব্দে থ্রিডি প্রিন্ট হয়ে সেটা রান্নাঘরেই তৈরি হতে শুরু করেছিল। বেশি বড়ো হবার আগেই সেটাকে ড্রয়িং রুমে নিয়ে এলেন পরমার্থ। এটায় চড়ে ভবিষ্যতে পৌঁছে টেস্ট করে নিতে হবে হবু ছেলেটাকে। আজকাল জিন মিক্সিং এডিটিং ঠিকঠাক করে করছে না, রোবট হলে কি হবে, চালাচ্ছে তো মানুষেই। কাজেই চেক করে না নিলে পরে বেবি বড়ো হয়ে গেলে ফেরত নিতে চাইবে না, ভারী সমস্যা।
হিসাব করে টাইম মেশিন চালান সবার কর্ম না। তবে পরমার্থ বছর পাঁচেক চালিয়েছেন এর আগে। নিজেও ওইভাবেই বর্তমান চাকরিতে এসেছেন। মিউচুয়াল ট্রান্সফার আর কী! চাকরি কমতে কমতে পৃথিবীতে এত সমস্যা দেখা দিয়েছিল যে বলার নয়! টাইম মেশিন আসার পরে অবস্থা পালটেছে। যে সময়ে যা ভ্যাকেন্সি ছিল সেই সময়ে গিয়ে পড়তে পারলে চাকরি মিলছে। পরমার্থ যে পোস্টে এসেছেন সে পোস্টে অতীতে ভ্যাকেন্সি ছিল। আর যে পোস্টে তিনি আগে মানে ভবিষ্যতে চাকরি করতেন, সেটা অতীতকালের একটি লোকের দরকার ছিল। এইভাবে আজকাল চাকরির সুন্দর ব্যবস্থা হয়েছে।
টাইম মেশিনের হিসাবমতো টাইম অ্যাডজাস্ট করে আলতো করে টাচ করলেন স্টার্ট বাটনে। বছর পঁচিশ পেরিয়ে পরমার্থ এক বিশাল ময়দানে এক বিরাট জনসভায় হাজির হলেন। অবিকল তার মতো দেখতে কে এই ছেলেটা মঞ্চে দাঁড়িয়ে ভাষণ দিচ্ছে? ঠাহর করে দেখে বোঝা গেল, ওটাই পরমার্থের হবু ছেলে! নাঃ, জিন এডিটিং করে এই তো বেশ নায়ক নায়ক চেহারা সাপ্লাই করেছে। কিন্তু, ছেলে বলে কি, “যেটা আমাদের করতে হবে, সেটা আমাদের করতে হবে, বন্ধু”!
চারদিকে ততক্ষণে চিত্কার করে লোকে বলছে, “রায়চৌধুরী সাহিব কি, জে! পার্থপ্রতিমবাবু কি, জে!” শুনে পরমার্থের মাথা গরম হয়ে গেল। আরে! তার মানে ছেলেকে পলিটিক্যাল নেতা বানিয়ে দিয়েছে ওরা। চেয়েছিলেন ডাক্তার, পেলেন ন্যাতা! এইসব গন্ডগোলের জন্যই আজকাল বাচ্চা নিতে ইচ্ছে করে না। এতটাই রেগে গেলেন পরমার্থ, পয়সা দিয়ে কেনা ধেড়ে পার্থপ্রতিমকে সভার মাঝে টেনে এক থাপ্পড় কষিয়ে দিলেন। রাজনৈতিক নেতাদের তিনি দুচক্ষে দেখতে পারেন না।
ব্যস! আর যায় কোথা! নেতার গায়ে হাত পড়েছে তো সাগরেদরা ছুটে আসবেই। যা হল তা আর কহতব্য নয়! পরমার্থের মাথা তো ফাটলই, টাইম মেশিন ফাটিয়ে তাঁর কপালও ফাটাল তারা। যত বলেন, “ওরে ও পার্থ, আমি যে তোর বাপ”, সে কে শোনে কার কথা। জখম পরমার্থকে কোনওরকমে টেনে হিঁচড়ে তোলা হল ট্রায়াল রুমে।
বিচার বসেছে। একতরফা বিচার, কারণ পরমার্থের কাছে না আছে ফিরে গিয়ে নিজেকে প্রমাণ করার পথ, না আছে সেই বেবিবাক্সের কেনার রসিদ! পার্থপ্রতিমের উকিলটি দুঁদে, মুখটি কেমন চেনা চেনা মনে হল পরমার্থের। ভবিষ্যতের পোস্টে পরমার্থ এইরকম সরকারী উকিলেরই চাকরি করতেন। না পোষানোয় চাকরি ছেড়ে অতীতের স্কুল মাস্টারি পদে অ্যাপ্লাই করেন। ওকালতি কিংবা মাস্টারি সব পেশাতেই রোবটদের কল্যাণে যা আকাল চলছে!
রসিদ দেখাতে না পারায় প্রমাণ করা গেল না যে পরমার্থ তাঁর ছেলের ভবিষ্যত চেক করতে বেরিয়েছিলেন কি না। বিচারে ভয়ানক শাস্তি হলঃ কয়েক হাজার বছর আগে টেলিভিশন নামক যন্ত্রে বাংলা মেগাসিরিয়াল নামক একটি যাত্রাপালা হত, শাস্তি হল তার সবকটা এপিসোড এক জায়গায় বসে একসঙ্গে দেখা! পরে এর থেকে পরীক্ষা নেওয়া হবে। তারপরে সরকারী টাইম মেশিনে করে পরমার্থকে নিজের সময়ে পাঠান হবে।
বিচারের শেষে ট্রায়াল রুমের বাইরে বেরিয়ে এসে পরমার্থের পায়ে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল সরকারী উকিলটা! হাত জোড় করে বলল, “একেবারে মাফ করে দিন দাদা, আমি সেই কাস্টোমার কেয়ার, যার টেবিলে আপনি বেবিবাক্স কিনতে এসেছিলেন। ওখানে একদম পয়সা নেই, না খেতে পেয়ে মরছি, তাই সময় পেরিয়ে এসে আপনার ডাক্তার ছেলেটাকে একটু নেতা বানিয়ে নিয়েছি, দুটো দিন ওয়েট করুন, তারপরে নিজের দায়িত্বে আপনাকে ওই সময়ে ছেড়ে দিয়ে আসব। সব ব্যবস্থা করা আছে, আপনাকে ঐ মেগাসিরিয়াল দেখতে হবে না!”
পরমার্থ চেঁচালেন “আপনাদের কোম্পানি তার মানে আমাকে ধোঁকা দিয়েছে, আমি নির্ভেজাল ডাক্তার চেয়েছিলাম, হাফ নেতা চাইনি!”
সেদিনের কাস্টোমার কেয়ার, এ দিনের উকিলবাবু বললেন “একেবারে খাঁটি জিনিস চাইলে রেঞ্জটা একটু বাড়াতে হত। আপনি তো সেদিন লো-প্রাইস এডিশন নিলেন, ওতে তো আর সবটা মনমতো পাবেন না, কিছু জিনিস আদ্দেক থাকে, তাতে করে আধা ইচ্ছে পূর্ণ হয়! এই যেমন হেলথ ড্রিংকস, টিএমটি বার আর মায়া প্রকাশনীর বই। কোম্পানি আর দামের রেঞ্জ দেখে কিনতে হয় স্যার। তবে আপনি ব্যাক করে যান, দেখবেন খুব একটা প্রবলেম হবে না ডাক্তার পার্থপ্রতিমকে নিয়ে।”
পরমার্থ স্যানালের মুন্ডুর ভেতরে বসে থাকা দাদুর বাবা বললেন, “বলেছিলাম, ওই জন্যই বলেছিলাম, এসব বেবিবাক্স-টাক্সর চক্করে পড় না, সাগরিকাকে আর ঝুলিয়ে না রেখে হ্যাঁ বলে দাও। বেচারি বারোতম পোস্টডক্টরেট করতে রওনা হল বলে!”
*****************************
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, কল্পবিজ্ঞান গল্প, তৃতীয় বর্ষ চতুর্থ সংখ্যা, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর), শ্রুতিসৌরভ বন্দ্যোপাধ্যায়
খুব সুন্দর লাগল গল্পটা।