৪.৮
লেখক: সোহম গুহ
শিল্পী: সুপ্রিয় দাস
মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে ঘুম ভাঙল দীপের। ‘কোথায় আমি?’ চারপাশ বোঝার চেষ্টায় ঘাড় ঘোরালো ও। মাথার প্রতিবিম্ব ঘটছে সামনের বিপজ্জনক ভাবে এগিয়ে থাকা মসৃণ ধাতুতে। পরিস্থিতি অনুধাবন করতে তার ঘোলাটে মস্তিষ্কের বেশ কিছুক্ষণ সময় লেগে গেলো। সে এক ধাতব আধারে শায়িত; বাইরের কোনকিছুই স্পষ্ট নয়; দীপের এটাও মনে পড়লো না সে এখানে এলো কিভাবে। ‘একমিনিট’, ওর ধোঁয়াশা ভরা মস্তিষ্কে যেন বিদ্যুৎ চমকাল, ‘আমি তো নিজের ইচ্ছায় এই আধারে শুয়েছিলাম।’
গল্পের আগে যে প্রাক–কথন বলতে হয়, তা অনেক সময়ই বিরক্তির উদ্রেক করে; তাই ভণিতা ছেড়ে কাজের কথায় আসাই বুদ্ধিমানের। দীপ দত্ত, মৌলানা আজাদ কলেজের স্টার স্টুডেন্ট। বছরের শেষের রেজাল্টের মত তার রাজনৈতিক কেরিয়ারও বেশ ঝকঝকে। কলেজের জিএস হওয়ার সুবাদে নারী–মহলে তার সুপুরুষত্বের জয়জয়কারও আছে। কলেজের সবাই জানে দীপদা এক ঢেউয়ের নাম, যে ঢেউ যেকোনো পর্বতসৃঙ্গ সমান প্রফেসরকেও টলাতে সক্ষম।
সুনামি পাহাড় ভাঙে, কিন্তু সেই সুনামিও নতি স্বীকার করে সরু খাঁড়ি–মুখে পড়লে। দীপও দেখল, হঠাৎ করে সে দুনিয়ায় একা। বাবার মৃত্যুর সময় শ্মশানে কাঁধ দেওয়ারও কেউ নেই।
ঘাটে একা বসেছিল দীপ, পেছন থেকে ভেসে আসছে ইলেকট্রিক চুল্লিতে পোড়া মৃতদেহের উগ্র গন্ধ। তল্লাটে মাছি ভনভন করছে, তাও দীপ সেখানেই বসেছিল ডেথ সার্টিফিকেটটা হাতে নিয়ে।
‘তোমার চলে যাওয়ার কি খুবই প্রয়োজন পরে গেছিল বাবা?’ দীপ জানতো না বাড়ি ব্যাঙ্কের কাছে বাঁধা পরে আছে, জানতো না তার বাবা প্রত্যেক দিন দিনমজুরি করে তার সিগারেটের পয়সা যোগাচ্ছে। কি করে জানবে সে? পলু প্রজাপতি হওয়ার আগে কি জানতে পারে বাইরের দুনিয়ায় সংগ্রাম ওঁত পেতে আছে?
‘তোমাকে দেখে ভদ্র ঘরের ছেলে মনে হচ্ছে, একটা কাজ করে দেবে আমাদের?’
দীপের পিঠে হঠাৎ মৃদু চাপ পড়লো। ঘাড় ঘুড়িয়ে ও দেখল এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। পরনে তাঁর কালো স্যুট; শ্মশানের পটভূমিতে যা অত্যন্ত বেমানান। দীপ দ্রুত চিন্তা করল। বাড়িতে, যে বাড়ী আর একমাসের মধ্যেই ব্যাংকের হস্তগত হবে, সেই বাড়িতে তার ছোটো বোন একলা পরে আছে। দীপ জানেনা কি করে এই মুহূর্তে সে তারবা নিজের ভরণপোষণ করবে।
‘কি করতে হবে আমাকে?’ প্যান্ট ঝেড়ে উঠে পরে ও বলল। এই কপর্দকহীন অবস্থায় ড্রাগ বেচতে হলে ও তাতেও রাজি।
‘বেশি কিছু না, তোমায় শুতে হবে,’ ভদ্রলোকের মুখের হাসির কোন পরিবর্তন ঘটল না। দীপের ভ্রু কোঁচকাল। কলকাতার আনাচেকানাচে বাড়তে থাকা সেই আঁধার নগরীতে প্রবেশ করতে যাচ্ছে না তো সে? যেখানে উচ্চবিত্ত ঘরের একাকী গৃহবধূদের… দীপ আর ভাবল না দুবার।
‘আমি রাজি, কিন্তু পারিশ্রমিক কত পাব?’
‘কাজটা একবারই তোমায় করতে হবে। তার জন্য তুমি পাবে ওই ৪২ মত।’
‘হাজার?’ দীপের কেমন যেন পোষাচ্ছিল না শুনে।
‘লাখ,’ স্যুট–ধারীর উত্তর শুনে দীপের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেলো। এতো টাকা! এতো টাকায় বাড়ী ফিরিয়ে নেওয়া, বোনের বিয়ে, তার কলেজের ফি…সব হয়ে যাবে! এতো টাকা দিতে কে ইচ্ছুক? নিজের ব্যায়াম–পুষ্ট দেহের উপর হঠাৎই খুব গর্ব বোধ করল দীপ। কিন্তু, দাতা না হয় সে, গ্রহীতা কোন মালদার পার্টি? স্বয়ং কি রানী এলিজাবেথ?
ঘরে ঢুকে দীপ মনঃক্ষুণ্ণ হল। সে ভেবেছিল তাকে নিয়ে যাওয়া হবে কোন আলিশান হোটেল বা কোন বিলাসবহুল বিচ রিসর্টে। কিন্তু কোথায় কি? গোটা ঘরে কেবল যন্ত্রপাতি এবং তারই মধ্যে পা বাঁচিয়ে কাজ করছে কিছু ভুঁড়িওয়ালা লোক। তাদের প্রত্যেকের গায়ে সাদা কোট দীপকে সন্দিহান করে তুলল। এখানে এসে সে কোন ভুল করল না তো? চারিদিকে তো কেবলি লোক। তবে কি সমকামিতায় নামতে হবে তাকে? টাকার দায় বড় দায়। দোনোমনা করে শার্ট খুলে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলল ও। অবাক হয়ে যাওয়া লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল,
“প্রথমে কাকে খুশি করতে হবে?”
“বাবা, তোমাকে ওই কাজের জন্য ডাকা হয়নি,” শার্টটা তুলে ওর হাতে দিলেন এক বৃদ্ধ,
“তোমাকে কেবল ওই যন্ত্রের ভেতরে শুতে হবে।”
ভদ্রলোকের অঙ্গুলি নির্দেশ করছিল ঘরের ঠিক মাঝে থাকা এক আধারের দিকে। প্রায় এক–মানুষ সমান বড় আধারটির কোন অংশই দীপের চেনা কোন ধাতুর তৈরি নয়। দীপের মনোভাব বুঝে স্মিত হাসলেন বৃদ্ধ,
“১৯০৮ সালে সাইবেরিয়ার টাংগুস্কা অঞ্চলে এক উল্কাপাতের প্রকোপে গোটা তল্লাট কেঁপে ওঠে। ২০১৩ সালে যে দল ওই অঞ্চলের মাইক্রো–স্যাম্পলের উপর গবেষণাপত্র ছাপায়, তার মধ্যে আমিও ছিলাম। আমি ওই উল্কায় এক তাপ এবং চাপ সহনশীল ধাতু আবিষ্কার করি। তোমার সামনের এই আধারে যতটুকু ধাতু দেখছ, তার একফোঁটা বেশি এই পৃথিবীতে কেন, এই সৌরজগতেই নেই।”
“আমার কাজ কি?” দীপ হাঁ করে থেকে শেষে জিজ্ঞেস করল।
“ওমা, দাসু বলেনি?” বৃদ্ধ স্যুটধারীর দিকে ভ্রুকুটি করলেন, “তোমাকে একটু ঘুমাতে হবে। সেটাই আমাদের এক্সপেরিমেন্ট।”
দীপ শুয়ে পড়তে আধারের ঢাকনা বাইরে থেকে বন্ধ করে দিলেন ভদ্রলোক। নিজেকে বোঝাল দীপ। দেহপোজীবক হওয়ার থেকে এই কাজ অনেক বেশি সম্মানজনক। ওর নাকে ঢুকল কোন গ্যাসের মিষ্টি গন্ধ, আফিমের মত তা যেন ভারী করে আনল দীপের চোখের পাতা। ঘুমে ঢলে পড়ার আগে বাইরে শুনতে পেল এক চিৎকার, “অপদার্থ, ওভারডোস হয়ে গেছে খেয়াল করো নি? রাখো কোথায় এমন নজর? অশ্বের বৈমাত্রেয় ভাইয়ের পশ্চাদদেশে?”
একরাশ মাথা যন্ত্রণা নিয়ে চোখ খুলল দীপ। চারিদিকে নিকষ কালো অন্ধকার, কোথায় কি? সে এখানে কি করছে? সামনে হাত বোলাতে অনুভূত হল আধারের ঢাকনাটা, কিছুটা যেন দুমড়ে গেছে তা। দু–তিনবার ঠেলাঠেলি করার পর মরাৎ করে খুলে গেলো ঢাকনা, টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে পরে গেলো দীপ।
মেঝে, দীপ হাত বুলিয়ে বুঝল, আসলে সিমেন্ট বা মার্বেলের তৈরি নয়। বরং তা ভিজে, স্যাঁতস্যাঁতে, কিছুটা এবড়ো খেবড়ো। বহুকাল আগে ছত্তিসগড়ের কুটুমশর গুহায় বাবার সাথে ঘুরতে গিয়ে গাইডের সামনে আছাড় খেয়েছিল দীপ, সেই মেঝের অনুভূতি, এবং এই মেঝের, অনেকটা যেন একই!
‘আমি কি তবে কোন গুহার ভেতর? কি ভাবে ঘুমিয়েছি আমি? গুহার মধ্যে ফেলে রেখে গেলো, বুঝতেও পারলাম না! টাকাটা ওরা কবে দেবে আমায়?’ অনেক প্রশ্ন ভিড় করে এলো দীপের মাথায়। দুপাশের দেওয়াল ধরে উত্তরের আশায় উপর দিকে উঠতে শুরু করল ও। মাথার যন্ত্রণা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যেন ধীরে ধীরে কমে আসছে, ধোয়াটে ভাবটাও যেন…
গুহামুখে পৌঁছে থমকে গেলো দীপ। বাইরে রাতের অন্ধকার, চারিদিকে কোথাও কোন আলো নেই। তারাও যেন কমে গেছে আকাশে, চাঁদও অনুপস্থিত। জ্যোতির্বিদ্যার সামান্য জ্ঞান দিয়ে আকাশ চেনার চেষ্টা করল দীপ। গুহামুখে যেটুকু আকাশ দেখা যাচ্ছে তার একটা তারাও ওর চেনা নয়। চেনা নক্ষত্রমণ্ডলীও যেন হারিয়ে গেছে। ওদের গ্রামের আকাশের মাঝ বরাবর আকাশ গঙ্গা দেখা যেত। সেই আকাশগঙ্গা আছে, তবুও যেন তা অচেনা। সেই তারায় ভরা বাহু যেন আলাদা, অচেনা।
“চিনতে পারবেনও না, কারণ ওটি মিল্কোমিড্রা, আমাদের দুই প্রতিবেশী গ্যালাক্সির মিলনের ফল।”
মাথার ভেতরে হঠাৎ বেজে ওঠা রিনরিনে স্বরটিকে দীপ চিনতে পারলো না,
“কে আপনি? কথা থেকে কথা বলছেন?”
“আমি তোমার ক্যাপসুলের এ.আই দীপ, এক বাইনারি সত্ত্বা, তোমার ঘুম ভাঙার সময় আমিও স্লিপ মোড থেকে উঠছিলাম, তাই তোমাকে সাহায্য করতে পারিনি।”
“কিন্তু, আপনি…তুমি আমার সঙ্গে কথা বলছ কিভাবে?”
“ঘুম থেকে ওঠার পর মাথা ভার ছিল? সেটা তোমার কানের পাশে একটা চিপ অপারেশন করে বসানোর দরুন। ওটাই আমাদের মধ্যেকার নিউরাল লিঙ্ক; ভুলেও কানের উপর নিজেকে মারতে যেওনা। বিপদে পরবে।“ যন্ত্র কি রসিকতা করতে পারে? তার তো খেয়াল পড়ছে না এমন কোন উদ্ভাবনের কথা কাগজে পড়ার!
“আমি কোথায়?” প্রশ্নটা না জিজ্ঞেস করে পারলো না দীপ।
“জটিল প্রশ্ন করলে হে। এই মুহূর্তে ক্যালকুলেশনে ব্যস্ত খুব আমি। তোমার সঙ্গে আমাকেও চালু হতে হয়েছে কিনা! তবে বলতে পারি, তোমাকে যে স্থানে আধারে শোয়ান হয়েছিল, তুমি সেখানেই আছ। এক চুলও নড় নি।”
“কিন্তু, আমি যে ঘুমিয়েছিলাম একটা ঘরে, সেখানে গুহা কোথা থেকে এলো?”
“আঃ, বললাম না হিসাব নিকাশ করছি ওটারই। তিন ঘণ্টা লাগবে, ততক্ষণ তুমি একটু ঘুরে এস। নিচের প্রকোষ্ঠে ভ্যাকুয়াম–সিল করা খাবার–দাবার আর জল আছে, ওই তরলে নিমজ্জিত করা, যেটা তোমাকে দেওয়া হয়েছিল। খেয়ে নাও। গায়ে জোর পাবে। দুরবিন আছে, চাইলে একটু টহল দিয়েও আস্তে পারো। তবে গুহা ছেড়ে বেশি দূর যেওনা। যতদূর আমার ডাটা বলেছে, তোমার ওভারডোজ হয়ে গেছে। তাই, আমার ডাটা স্যাম্পলিং–এ সময় লাগছে এতো।”
বাইরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, সেই সঙ্গে অসম্ভব রকমের শৈত্য। দীপের মনের কথা বুঝেই হয়তো বিড়বিড় করল এআই,
“–৯৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। এ কি করে সম্ভব! বাইরে যেওনা দীপ, গুহার মাইক্রো–ক্লাইমেটের বাইরে গেলেই তোমার শরীরের প্রত্যেক জলকণা মুহূর্তে জমে বরফ হয়ে যাবে। আয়তন বৃদ্ধির ফলে তোমার শরীর বেলুনের মত ফুলে উঠে…”
“বুঝেছি, কিঞ্চিৎ পড়াশুনো আমার ও আছে। তাহলে কি করব?”
“তারা গোন, সময় কেটে যাবে।“
এ.আই আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেও দীপ কে ভাবাচ্ছিল অন্য এক জিনিস। –৯৮! ভস্তকে রেকর্ডেড সর্বনিম্নরও আট ডিগ্রি নিচে। দীপ বুঝতে পারলো না এই অসম্ভব সম্ভব কি করে। হয়তো… “না দীপ, আমার সেন্সর ভুল তথ্য দেয়নি।“
দীপ বাইরে তাকাল। পিলে চমকানো তাপমাত্রাকে সঙ্গত দেওয়ার জন্য বরফের স্তূপ আশা করছিল ও। কিন্তু কোথায় কি? দৃষ্টি যতদূর যায়, কেবল বিক্ষিপ্ত পাথরের স্তূপ এবং বহুদূরে আকাশ ঠেলে ওঠা এক সুউচ্চ গিরিবর্ত্ম। দিগন্ত পথ হারিয়েছে তার খাঁজে ভাঁজে। প্রহর পেরনোর সঙ্গে শুরু হল সারা আকাশে আলোর খেলা। অরোরা যে এতো সুন্দর হতে পারে দীপ আন্দাজেও আনতে পারে নি।
রোশনাইয়ের নিচে, বহুদূরে, একটা বিশাল কোপজের পিছনে শুরু হওয়া নড়াচড়া দীপের চোখে ধরা দিল। কিছুটা কৌতূহল, এবং অনেকটা ভয় বুকে নিয়ে সে দুরবিনে চোখ রাখল।
প্রাণীটা বিশালাকার; দৈত্য কথাটা যেন তার জন্যই বাংলায় তৈরি হয়েছিল। কাঁধ, যদিও তা তার নেই, দীপ আন্দাজ করল, জমি থেকে ৬০০ ফুটেরও উপরে ঠেলে উঠেছে। এ.আই ওর আন্দাজের সাথে সহমত। বহুপদী, সর্পিলাকার প্রাণীটার সেগমেন্ট হওয়া দেহের ল্যাজামুড়ো কিছুই দীপ ঠাহর করতে পারছিল না। এ.আইকে ও জিজ্ঞেস না করে পারলো না।
“প্রাণীটা কি?”
“পা ক’টা অন্ধকারে ঠাহর করেছ?”
“জন্তুটা অষ্টপদী, তাতে কি প্রমাণিত হয়?”
“দীপ,” এ.আই কি স্মিত হাসল? “জার্মান প্রাণীবিদ জহান অগাস্ট এফ্রিয়াইম গএযে ১৭৭৩ সালে একে আবিষ্কার করেন।”
“ভণিতা রেখে আসল কথাটা বললেই কি হয় না? যন্ত্রের রসিকতা–বোধ কবে থেকে শুরু হল কে জানে!” স্বগতোক্তি করল দীপ।
“ঠিকঠাক ভাবে বললে, তোমার চেয়ে আমি দেড়শ’ বছরের ছোটো দীপ। প্রাণীটা টারটিগ্রেড, বা জল ভাল্লুক। কিন্তু যার হওয়ার কথা আণুবীক্ষণিক, তাই এখানে দানব।” এ.আইএর এই উত্তরটা কেন কে জানে, দীপের রসিকতা মনে হল না।
“তাহলে তোমার বয়…” দীপের কোথায় বাধা পড়লো। মুহূর্তের মধ্যে ‘উহ!’ চিৎকার করে গুহার অন্ধকারে সেঁধিয়ে গেলো ও।
সূর্য উঠছে, পাহাড় শ্রেণির ওপার থেকে গনগনে লাল সূর্য। কি তেজ তার! আলো ফোটার পাঁচ মিনিটের মধ্যে দাবদাহ শুরু হয়ে গেলো বাইরে। ফোস্কা পোড়া বাঁ হাতের তেলোকে গুহার ঠাণ্ডা পাথরের দেওয়ালে চেপে ধরে যন্ত্রণা কমানোর চেষ্টা করল দীপ। বুকপকেটে খড়খড় করে উঠল একটা কাগজের রসিদ। বের করে একবার নজর বোলাতে আবার বুকটা হুহু করে উঠল দীপের। বাবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার রসিদটা পাকিয়ে গুহার বাইরে ছুঁড়ে ফেলল ও। কাগজটা মাটিতে পড়ার আগেই মাঝ বাতাসে জ্বলে–পুড়ে খাক হয়ে গেলো!
ধপ করে মাটিতে বসে পড়লো দীপ। ‘এটা পশ্চিমবঙ্গ নয়। এটা পৃথিবীই নয়! কোথায় এনে ফেলল ওই বুড়োগুলো আমায়?’
“দীপ,” এ.আই বলে উঠল, “মন শক্ত করো। তোমায় আমার কিছু বলার আছে।”
“কি?”
“কাগজটা পুড়ে যাওয়ার কারণ জানো? বাইরের বাতাস এখন ২৩২.৭৭৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ফুটছে। যদি ফারেনহাইট স্কেলে বলি, তাহলে হবে…”
“ফারেনহাইট ৪৫১, জানি,” ধীর গলায় দীপ বলল।
“দীপ,” এ.আই বলল, “তোমার ঘুমানোর মধ্যে বাইরে যুগ পেরিয়ে গেছে। শুনতে চাও কি কি হয়েছে?”
“যুগ? মানে?”
“ঠিক আছে, প্রথম থেকেই শুরু করি। তোমাকে ঘুম পাড়ানো হয়েছিল ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে। তার পর তিনটে বিশ্বযুদ্ধ সমেত আরও অনেক কিছু হয়েছে। কিন্তু তোমায় আমি বিশদ বিবরণে গিয়ে ভারাক্রান্ত করব না। সংক্ষেপে বলি। তোমার ঘুমানোর মাত্র হাজার বছরের মধ্যে ভাষার প্রবল বিবর্তন আসে, ফলে তোমার–আমার বলা কোন শব্দই আর টিকে থাকেনি। ‘হাম্নজ্জ’ নামক যে ভাষাটি উঠে আসে, তা আদপে তার পূর্বতন সবকটি ভাষার সন্তান। গ্যামা সাফে ধ্রুবতারাকে সরিয়ে নতুন উত্তর নক্ষত্র হয় প্রায় একই সময়ে। তার আরও এক হাজার পরে পৃথিবী বরফমুক্ত এক প্যানডোরায় রূপান্তরিত হয় – যার সঙ্গে কারবনিফেরাসের পৃথিবীর তুলনা টানা চলে। সমুদ্রপৃষ্ঠ ছয় মিটার উঠে সব সমতল ডাঙাকে গ্রাস করে নেয়। প্রায় ২০০০০ বছর পর চেন্রবিল আবার তেজস্ক্রিয়তা মুক্ত অঞ্চল হয়ে ওঠে। মরুভূমির জায়গা নেয় ঘন জঙ্গল সমগ্র পৃথিবীতে – মেরু থেকে বিষুবে। তার ৩০০০০ বছর পর নায়াগ্রা ফলস হারিয়ে যায় লেক ঈরির বত্রিশ কিমি তটভূমি ক্ষয়ে বেরিয়ে যাওয়ার ফলে। দীপ, তোমার ঘুমানোর ১০০০০০ বছর পর পৃথিবীর শেষ ম্যাকবুকের টাইটেনিয়াম প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে যায়; ইয়েলোস্টোনের বিস্ফোরণ ঘটে, গোটা পৃথিবী ঢেকে যায় অকাল তমসায়। ৫০০০০০ বছর পর পৃথিবীর পরিবেশ সম্পূর্ণ রূপে মানব–দূষণ থেকে মুক্ত হয়। যদিও গোটা পৃথিবী ততদিনে ঢেকে গেছে একটা পুরু বরফের চাদরে। পাঁচ মিলিয়ন বছর পর ওআই ক্রোমোজোম ক্ষয়ে যাওয়ায় পৃথিবীর শেষ মানুষ পঙ্গু এবং বিকলাঙ্গ অবস্থায় এক অচেনা পৃথিবীতে চলনশক্তিরহিত অবস্থায় নিতান্ত জড়বস্তুর মত মাউন্ট রাশমোরের প্রায় মুছে যাওয়া মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে। পঞ্চাশ মিলিয়ন বছর পর আফ্রিকা ইউরেশিয়ায় ধাক্কা খেয়ে নিও–আল্পস নামক পৃথিবীর সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্বতশ্রেণী গড়ে তোলে, যার কাছে আমাদের হিমালয়ও শিশু। ২৫০ মিলিয়ন বছর পর টেকটনিক মুভমেন্ট পরে পৃথিবীর সবকটি মহাদেশ জুড়ে তৈরি করে নিও–প্যাঞ্জিয়া। ৮০০ মিলিয়ন বছর পর পৃথিবীর শেষ গাছটি মারা যায় সি–ফোর সালোকসংশ্লেষ অসম্ভব হয়ে পরায়। এক বছরের মধ্যে বহুকোষী খাদ্য–শৃঙ্খল সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয়ে যায়। বসুন্ধরা বন্ধ্যা হয়ে পরে। দুই বিলিয়ন বছর পর পৃথিবীর কোর জমাট বেঁধে যায়, পৃথিবীর অক্ষীয় গতি রুদ্ধ হয়ে পরে। কোন অক্ষীয় গতি না থাকায় পৃথিবীর ভুচৌম্বকত্ব নষ্ট হয়ে যায়। এই গ্রহ অসহায়ের মত মহাজাগতিক বিকিরণে স্নান করতে থাকে। বাইরের ঐ চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া তারই ফলশ্রুতি। পৃথিবীর সৌরকক্ষও বর্তমানে বিনষ্ট। নাহলে সাড়ে সাত ঘণ্টায় রাত থেকে দিন হয় না দীপ। বাইরের সূর্য এখন এক রেড জায়ান্ট। আজকে সোমবার। তুমি ঘুমিয়ে ছিলে এক সোমবারে। মাঝে কালের নদীতে বয়ে গেছে চার দশমিক আট বিলিয়ন বছর। তুমি এই মুহূর্তে গোটা মহাবিশ্বে মানুষের প্রাচীনতম এবং একমাত্র জীবিত প্রতিনিধি। নিজের মন কে ভুল বুঝিয়ে লাভ নেই দীপ। আমি যন্ত্র। যন্ত্র মিথ্যা বলে না। এই বন্ধ্যা দুনিয়ায় কেবল প্রাণ ঐ সর্ব–সহনশীল টারটিগ্রেডই।”
দীপ কথা বলতে পারছিল না। এ.আই নিরুত্তাপ ভাবে যা বলল, তা তাকে মূক করে দিয়েছিলো। ক্রমাগত তথ্যের চাপে ওর মস্তিষ্ক বিকল হচ্ছিল। বাইরে আলো নিভে গেছে এর মধ্যেই। আকাশের মুছে যাওয়া তারাগুলোর মধ্যে থেকে হঠাৎ করে একটা ফ্লাড লাইট গুহার ভেতরে এসে পড়লো। অসংলগ্ন মানসিক অবস্থায় সেই আলোর দিকে টালমাটাল পায়ে এগোল দীপ এ.আই এর শত বারণ সত্ত্বেও। তারপর তার আর কিচ্ছু মনে নেই।
বিশাল মহাকাশযানটির এক অংশে সার দিয়ে রাখা ট্রান্সপোর্ট আইটেমগুলো। প্রত্যেকটাই নিলামের জন্য এক দূর স্টার সিস্টেমে যাচ্ছে। ফলতঃ মহামূল্যবান। কারবোনেডো ফ্রিজ করে মমিকৃত দীপের দেহের স্ল্যাবটার নিচে একটা ছোটখাটো ভিনগ্রহী লেবেল আটকাতে যাচ্ছিল। ওর ঊর্ধ্বতন ছুটে এসে ওকে থামালেন। বিস্তর বকাঝকা করে বললেন, “হতভাগা, এটার নিচে হান সোলো লেবেলটা আটকাতে যাচ্ছিলি কেন? এক ধরনের স্ল্যাব মানেই কি এক জিনিস গণ্ডমূর্খ? ঐ দামি স্ল্যাবটাচার নম্বর স্লটে আছে। এরকম ভুল করলে এম্পারর কিন্তু আমাদের কচুকাটা করবে, খেয়ালে রাখিস।”
এ.আই দীপের সঙ্গে শত চেষ্টার পরও যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হওয়ায় শেষ প্রচেষ্টা হিসাবে বৈজ্ঞানিকদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করল। দীপের থেকে নিউরাল লিঙ্কটা মহাকাশযানের মেইনফ্রেমের সঙ্গে যুক্ত করতে ও সক্ষম হওয়ায় এক বিশাল পরিমাণের তথ্যাদি মহাকাশযানটা হাইপারস্পেসে লাফ দেওয়ার আগে ওর হস্তগত হয়। সর্বশেষ ব্যাটারিটুকু খরচ করে মহাকাশ যানের সমগ্র ডেটাটা এক অতিক্ষুদ্র ওয়ার্ম–হোলের মাধ্যমে অতীতে পাঠাতে সক্ষম হল ও। জানতেও পারলো না তথ্যগুলো বৈজ্ঞানিকদের হস্তগত হল কিনা, তার আগেই ঢলে পড়লো চিরনিদ্রায়। একটাই কথা বিড়বিড় করল শেষ বারের জন্য, “সাবকনশাস নিউরাল লিঙ্ক পাওয়া গেছে।”
পুনশ্চঃ
USC-র হস্টেলে হাঁ করে ঘুমচ্ছিল কলেজ–পড়ুয়া ছেলেটা। হঠাৎ ঘুম থেকে উঠে রুমমেটকে ঘুম থেকে টেনে তুলতে গিয়ে প্রায় মেঝেতে ফেলেই দিল।
“ওয়ে র্যান্ডাল। একটা সলিড প্লট মাথায় এসেছে সিনেমার জন্য, বলতে পারিস স্বপ্নে পেলাম। শুনবি?”
ছেলেটার জুলুজুলু আগ্রহী চোখের দিকে দৃষ্টিপাত না করে পাশ ফিরল র্যান্ডাল ক্লেইসের, “লুকাস, ভাই আমার, এখন মাঝরাত! কালকে সকালে বলিস?”
ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার আগে র্যান্ডাল শুনল পাশের খাটে বসে আঙুল মটকাচ্ছে জর্জ লুকাস, মুখে তার একটাই কথা, “স্টার ওয়ারস… স্টার ওয়ারস।”
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, কল্পবিজ্ঞান গল্প, দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, সুপ্রিয় দাস, সোহম গুহ